বাবুই

৬ ঘণ্টার প্যারোলে বাবুভাই বাড়ি এসেছিল।

আমার উচ্চারণে কোনো সমস্যা ছিল কিংবা আমি জেনে শুনেই বাবুভাই কথাটাকে বিকৃত করতাম।

কখনো বলতাম বাবুই, কখনো বুভাই।

ও বাবুই, আর কত ঘুমাবে? তোমার পেছন দিকে তো লেজ গজিয়ে গেছে।

ঘুমের মধ্যে মাছি তাড়াবার মতো বাবুভাই নিজের নাকের পাশ দিয়ে হাত চালায়। কোথায় মাছি? বাবুভাই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

আমি ফার্স্টক্লাস জিরার শরবত বানাতে শিখেছি। এক গ্লাস নিয়েও এসেছি। বাবুইকে খাওয়াব।

আমি জানি বাবুই কী করবে। প্রথমে ছোট্ট এক ঢোক মুখে দিয়ে বলবে ওয়াক থু। কী বানিয়েছিস পেতনি? আমার তো নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে এল।

তারপর বাবুই বমি করার ভান করবে।

আরেক ঢোক শরবত মুখে নিয়ে চেহারাটা বিচ্ছিরি রকম বিকৃত করে বলবে, আমি জানি তুই আজরাইলের লোকাল অ্যাজেন্ট। আমাকে তুই দেখতে পারিস না, সেজন্য তুই শরবতের নাম করে আমাকে হেমলক দিয়েছিস। আমি তোর শাশুড়িকে বলে দেবো যেন তোকে জনমের শিক্ষা দেয়।

সেই প্রথম আমি হেমলকের নাম শুনি।

তারপর বাবুই আরো এক ঢোক গিলে বলল, তুই আমাকে সক্রেটিস পেয়েছিস?

পরের ঢোকে গ্লাসটা খালি করে দিল।

আমি যে একটা দারুণ শরবত বানাতে শিখেছি তার স্বীকৃতি আমি আমার বাবুইয়ের কাছেই চাই।

জিজ্ঞেস করি, কেমন হয়েছে?

বাবুই বলল, জঘন্য।

কিন্তু খেলে যে?

না খেলে তুই কষ্ট পাবি সেজন্য এমন বমি বমি ভাবের মধ্যেও বিচ্ছিরি এই জিনিসটা খেতে হলো। কে জানে কখন বিষের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। হয়তো আজকের রাতটাই আমার জীবনের শেষ রাত। কাল সকাল দশটার দিকে এসে দেখবি আমি খাটে নয়, খাটিয়ায় শুয়ে অছি। আগরবাতির ধোঁয়ার একটা মিষ্টি ঘ্রাণ চারদিকে।

আমি চিত্কার করে উঠি, বুভাই, স্টপ ইট। আমি আর শুনতে চাই না।

আমার খুব রাগ হচ্ছে। রাগ বেড়ে গেলে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এখন বুঝতে পারছি আমার মেজাজ খারাপ করিয়ে দিলে আমি বাবুভাইকে বুভাই ডাকি, অন্য সময় বাবুই।

বুভাই বলল, এরকম শরবত খেয়েই সক্রেটিস ঢলে পড়েছিলেন। আমি গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

আড়চোখে আমাকে দেখে বুভাই আবার বাবুই হয়ে উঠবে এবং ধমকের স্বরে আমাকে বলবে, যা আর এক গ্লাস নিয়ে আয়। এক গ্লাসে তো আমার জিহ্বার গোড়া পর্যন্তও ভেজে না।

আমার বাষ্পাচ্ছন্ন ঝাপসা চোখ আবার পরিষ্কার হয়ে যায়, আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই।

আমার বানানো জিরার শরবত যে ভালো, বাবুই সে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। সেজন্যই তো আরেক গ্লাস চাচ্ছে।

আমি শরবত বানাতে ছুটে যাই।

দুই

বাবুভাই উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমি ডাকি, ওঠো বাবুই।

বাবুই মাছি তাড়ায়। আমি কি মাছি নাকি?

একটি কটন বার হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে বাবুইর মাথার দিকটাতে যাই। খুব কায়দা করে আমার মাথাটা নুইয়ে তুলো-মাখা কটন বারের আগাটা বাবুইর নাকের ডান ছিদ্র দিয়ে একটুখানি ঢোকাতেই বাবুই হ্যাচ্ছো দেয়, নাক চুলকায় এবং বলে ওঠে, ধ্যাত্ মাছি।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি।

বাবুই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

আমার আবার মেজাজ খারাপ হয়। বিড়বিড় করে তখন বলি, বুভাই, তুমি ঘুমিয়ে থাকো, কি মরে যাও তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি জিরার শরবতটা টেবিলে রেখে দরজাটা টেনে দিয়ে ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে আমাদের টিভি রুমে চলে আসি। আমাদের যেটা টিভি রুম, এটার নামই আমরা বলি ড্রইংরুম, কিন্তু আমার অনেক অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও নয়, কিন্তু বেশ আপন—এমন একটি কালো মেয়ে ওয়াঙ্গারি বলেছে এটার নাম লিভিংরুম।

তাহলে ওয়াঙ্গারির কথা আগে একটু বলে নিই। এই মেয়েটি আমার চেয়ে সাড়ে পাঁচ বছরের বড়। কেনিয়ান- আমরিকান। কেনিয়ার সবচেয়ে বড় গো কিকুয়ু। ওয়াঙ্গারি হচ্ছে কিকুয়ু। তার মা গ্যাব্রিয়েলা একজন আমেরিকার ডাক্তারকে বিয়ে করে তার সঙ্গে মিনেসোটা স্টেটে চলে আসে। ডাক্তার খুব ভালোমানুষ, ওয়াঙ্গারিকে কেনিয়ায় ফেলে আসতে বাধ্য করেননি।

ওয়াঙ্গারির বাবা মুকামি এনডেঙ্গো এইডস রোগে মারা যান। ডাক্তার নিকোলাস সিশৌর তখন কেনিয়ায় এইডস চিকিত্সক হিসেবে কাজ করতেন। মুকামি তার রোগী। মুকামির মৃত্যুর পর তিনি গ্যাব্রিয়েলাকে বললেন, তুমিও এইচআইভি পজিটিভ। তুমি যদি ঠিকমতো ঔষধ খাও এবং অন্য কোনো পুরুষমানুষের সঙ্গে না শোও আমি আশা করি তোমাকে এইডসমুক্ত করতে পারব। অনেকদিন চিকিত্সার পর গ্যাব্রিয়েলা যখন এইচআইভি থেকে মুক্ত হলো, ডাক্তার নিকোলাস সিশৌর তাকে বললেন, এইডস ভাইরাস বহন করছে—এমন কারো সাথে যদি তুমি শোও, তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে, তখন হয়তো তোমাকে বাঁচানো না-ও যেতে পারে। তোমার ছোট বাচ্চাটির কথা ভেবে সাবধানে থেকো। যদি কোনো পুরুষের সাথে শুতে খুব ইচ্ছে করে তাহলে এইডস ভাইরাস নেই—এমন কাউকে বেছে নেবে।

কৃতজ্ঞ গ্যাব্রিয়েলা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে এই ভালোমানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছো কেন?

গ্যাব্রিয়েলা বলল, ডাক্তার আমি কাঁদছি আমার দুঃখে। আমার যে তোমার সাথে শুতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি জানি, আমি যে কালো আর গরিব সেজন্য তুমি রাজি হবে না। তুমি যে আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে আমি সেই কষ্টে কাঁদছি।

এরপর কী যে হলো গ্যাব্রিয়েলা ডাক্তারকে ডাকতে শুরু করল নিক, আর ডাক্তার তাকে গ্যাবি।

ওয়াঙ্গারি বলল, নিক আর গ্যাবি যতই ঘনিষ্ঠ হলো আমি ততই কষ্ট পেতে থাকলাম আর গোপনে কেঁদে কেঁদে বাবাকে বললাম, বাবা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমরা তখন থাকতাম নাইরোবি থেকে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার দূরে একটি গরিব পৌরসভা কিটুই-তে। ডাক্তার নিক মাকে অক্সিলিয়ারি নার্স হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

আমি জিজ্ঞেস করি অক্সিলিয়ারি নার্স আবার কী?

আসল নার্সের হেল্পার। মা তখন তার ডাক্তারের সাথে আজ এ শহরে, কাল ও শহরে। আমি একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে মুটোমো জেলার রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে চলে গেলাম, বলতেও পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। কেউ একজন আমাকে ধরে পুলিশ স্টেশনে দিয়ে গেল।

পুলিশ বলল, তোমাকে চেনে—এমন কারো নাম বলো।

আমি ডাক্তার নিকোলাসের কথা বললাম।

তিনি খুব পরিচিত মানুষ। পুলিশ তার সাথে যোগাযোগ করল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার ছ দিন পর ডাক্তার আর মা পুলিশের কাছ থেকে আমাকে যখন নিয়ে যেতে আসে, কোনো এক অভিমানে আমি বলে দিই, যাব না।

আমার মা আমার অভিমান কতটা বুঝেছে জানি না, কিন্তু ডাক্তার যখন আমাকে কোলে নিল আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।

পরের ব্যাপারগুলো খুব দ্রুত ঘটল। মোম্বাসার একটি চার্চে ডাক্তার নিক আমার মাকে বিয়ে করল। আমাকে অ্যাডপ্ট করল। দু মাসের মধ্যেই আমরা তিন জন একসাথে আমেরিকার মিনেসোটায় ডাক্তার নিকোলাসের খামারবাড়িতে এসে উঠলাম। এসব প্রায় পনের বছর আগের কথা।

তখন থেকে এই অভিমানী মেয়েটির নাম হলো ওয়াঙ্গারি সিশৌর, কিন্তু আমাদের বাড়িতে ওয়াঙ্গারি এল কেমন করে সে কথাটাও তো বলতে হবে।

পড়াশোনা করতে আর ভাল্লাগছে না, কিন্তু ভালো একটা চাকরি যে পাবে সে সম্ভাবনাও কম। সুতরাং ওয়াঙ্গারি সিশৌর আমেরিকান পিস কোরের ভলান্টিয়ার হিসেবে নাম লেখাল। তিন মাসের মধ্যেই তাদের দশ জন নারী স্বেচ্ছাসেবীকে দশটি দেশের জন্য নিয়োগ করা হলো : জারা আব্রাহাম যাবে আলবেনিয়ায়, ওয়াঙ্গারি সিশৌর বাংলাদেশে, টেরেসা রুজভেল্ট কিউবায়, সুসান ব্রাউনমিলার গ্যাবনে, রোজেতা ভেচপুচি হেইতিতে, পামেলা রোজবার্ড ইন্ডিয়ায়, মার্গারেট ড্রেপার জামাইকায়, লিয়ানা আদ্রিয়েভা মাল্টায়, জেসমিন প্রিচার্ড নাইজেরিয়ায় এবং ফ্রান্সেসকা ভিক্টর উগান্ডায়।

ওয়াঙ্গারি স্কুলের প্রাইমারি ক্লাস পর্যন্ত বাচ্চাদের ইংরেজি শিখতে সাহায্য করবে, আমেরিকা সম্পর্কে ধারণা দেবে আর বড় মেয়েদের মানে ক্লাস এইট থেকে টেন, রিপ্রোডাকটিভ হেলথ মানে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলবে, প্রশ্নের জবাব দেবে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে যা জানবে শিখবে তার নোট নেবে, দেশে ফিরে পনের হাজার শব্দের মধ্যে হোস্ট কান্ট্রির ওপর একটি রিপোর্ট জমা দেবে। বাংলাদেশের ওপর লিখবে ওয়াঙ্গারি। যে স্কুলে ওয়াঙ্গারি নিযুক্ত হলো সেই স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের টিচার রেবেকা সুলতানা, আমার মা। সম্ভবত গায়ের রঙ কালো বলেই তাকে থাকা খাওয়ার সুবিধে করে দেবার জন্য তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি, আমার মা রাজি হয়ে গেল। পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকবে, মা নিশ্চিত তার পেছনে যে ক-টাকা খরচ হবে অন্তত তার তিন গুণ টাকা দেবে। টাকাটা আমাদের কাজে লাগবে। ভেতরে ভেতরে মা-র আর একটা উদ্দেশ্য ছিল—আমরা ভাইবোনেরা তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলে জড়তা কাটাতে পাবর, নতুন কিছু শিখবও।

বাবুভাই যে রুমটাতে ঘুমোচ্ছে এটাই ছিল আমার বাবার চেম্বার। চেয়ার টেবিল একপাশে নিয়ে ভেতরে একটা খাট ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, সাথে জাজিম, তোষক, চাদর, বালিশ, কম্বল, জানালার পুরোনো পর্দা ধোয়া হলো, লাগোয়া বাথরুমটার মেঝে লোহার জালি দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করা হলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে মা ওয়াঙ্গারিকে সাথে নিয়ে এলো সঙ্গে একটা বড় স্যুটকেস আর বেশ ভারী একটা হাতব্যাগ।

রুমে ঢুকে ওয়াঙ্গারি বলল, ওয়াও!

বাইরের আলমারির ওপরের দিকটাতে একই ধরনের ফ্রেমে একই মাপের তিন জন মানুষের ছবি। ছবির নিচে বেশ পুরু কালো বাংলা হরফে ছবির মানুষদের নাম লিখা।

ওয়াঙ্গারি একটু পরপর অবাক হয় আর বলে, ওয়াও।

বলল, আমি দুজনকে চিনতে পেরেছি, বাঁ দিকে আইনস্টাইন, ডানদিকে ট্যাগোর। ঠিক বলিনি? মাঝখানে কে?

আমি খুব গর্বের সাথে বললাম, নাম বাংলায় লেখা আছে। মাই ফাদার মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবি।

ভেরি হ্যান্ডসাম ইনডিড।

বাবার কথা মা নিশ্চয়ই বলেছে, সে-জন্যই জিজ্ঞেস করেনি, এমরান আলী কোথায়?

আমার বয়স যখন দু বছর তখন থেকেই কেউ বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে বলি, মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবি।

মিস্টার এবং এমএ এলএলবিকে তাঁর নাম থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু মনে হয়নি, এখনো না। সবটুকু মিলিয়ে আমার বাবা। সাদা শার্ট কালো বোট আর বো-টাই।

হি লুকস লাইক গ্রেগরি পেক।

গ্রেগরি পেক!

গ্রেগরি পেককে দেখোনি? হলিউডের নায়ক। আমি তোমাকে ‘রোমান হলিডে’ দেখাবো।

মা বলল, ফিল ফ্রি। এটা তোমার রুম। দুটো দরজা, সামনেরটা সরাসরি রাস্তার উপর, ডানদিকেরটা ছোট্ট করিডোর হয়ে আমাদের মূল ঘরের সাথে।

করিডোরটা খুব সরু, একজন মানুষ ভালোই চলাফেরা করতে পারে, দুজন হলে একজনকে দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মা ওয়াঙ্গারিকে আমাদের ঘরবাড়ি সব দেখিয়ে দিল আর আমাকে দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটা তোমার সব খোঁজখবর রাখবে—খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো কেনাকাটা পর্যন্ত, সবই।

আমার খুশির সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে, সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারছি আমার চেয়েও কালো মেয়ে আছে।

আমি ওয়াঙ্গারিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এটা কি ঠিক কালো মেয়েরা বেশি স্মার্ট?

এটা কেন জিজ্ঞেস করলে?

তুমি তো অনেক স্মার্ট তাই, আমিও আমার ফর্সা বোন আর কাজিনদের চেয়ে বেশি স্মার্ট।

হ্যাঁ। যখন এ বাড়িতে পুলিশ আসে একটা ফর্সা মেয়েও সামনে যায় না। আমাকেই সব কথার জবাব দিতে হয়।

ওয়াঙ্গারি বলল, দ্যাটস গ্রেট। আমি এটা জানতাম না যে ব্ল্যাক ইজ স্মার্ট। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

আমার মনে হলো একজন কেনিয়ান-আমেরিকান আমার এই আবিষ্কারটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কিন্তু আমি জানি, ওয়াঙ্গারি বলল, ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল।

আমি থ হয়ে আমার চেয়েও কালো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকি কী সুন্দর কথা :ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল।

ওয়াঙ্গারি বলল, যাও তোমার একটি খাতা নিয়ে এসো।

আমি দু মিনিটের মধ্যেই খাতা নিয়ে ফিরলাম। একেবারে নতুন খাতা।

খাতার প্রথম পাতা পুরু লাল বড় হাতের হরফে ওয়াঙ্গারি লিখল;

SAY IT LOUD

I’M BLACK I’M PROUD

তরপর বলল, দাঁড়াও তোমাকে জেমস ব্রাউনের গানটা শোনাচ্ছি। তার স্মার্টফোনে টেপাটেপি করে গানটা বাজিয়ে দিল। কী দারুণ গান! এই গানের কয়েকটা লাইন আমি একজনকেই শোনাব, আমার বাবুভাইকে। তারপর বলব, সাবধান বাবুই, আমাকে আর কোনোদিন পেতনি বলবি না।

এক-একদিন সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে ওয়াঙ্গারি অদ্ভুত সব কথা শোনায়।

একদিন বলল, অদ্ভুত সব বৈপরীত্যের দেশ আমেরিকা। বোমা ফেলে ভিয়েতনামের শিশুদের হত্যা করেছে, জাপান বোমায় কম্বোডিয়ার শিশুদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আবার আমার মতো ওয়াঙ্গারির যেখানে অনাদরে, অবহেলায় না খেয়ে, এইডস হয়ে মরার কথা নিকোলাসের মতো আমেরিকান আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে, আমি যে কতদিন তার চওড়া বুকের ওপর উপুড় হয়ে ঘুমিয়েছি।

এটুকু বলে হঠাত্ ওয়াঙ্গারি নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে, দু চোখ থেকে দু ফোঁটা কান্না এখনই ঝরে পড়বে। ওয়াঙ্গারি টেবিলের ড্রয়ার টেনে একটা রিগলে চুইংগাম বের করে মাঝখান দিয়ে দু টুকরো করে অর্ধেক আমাকে দিল অর্ধেক নিজে চিবুতে শুরু করল। চুইংগাম চিবুতে থাকলে কি কান্না থেমে যায়?

বাবুভাই উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। এতবার ডেকেও যখন ঘুম ভাঙাতে পারলাম না, আমার বয়সের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ একটা কাজ করতে শুরু করলাম। বেশি ঘুমোলে লেজ গজাবার কোনো কারণ নেই জানি, তারপর ছোটবেলায় শোনা এই কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে—দেখি না বাবুভাইর লেজ গজিয়েছে কি-না। লেজ তো পেছনেই গজায়। লেজওয়ালা মানুষ আগে তো দেখিনি বাবুভাই দিয়ে শুরু করি।

আমি ঘুমন্ত মানুষটির ট্রাউজার আস্তে করে টানলাম ইলাস্টিক বাঁধন খানিকটা নিচে নেমে এল, আমি মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছি লেজটা কত বড় হয়েছে।

বাবুভাই হঠাত্ উঠে গেল এবং চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা থাপ্পড় লাগাব। তুই আমার পাজামা খুলছিলি কেন?

লেজটা কত বড় হয়েছে দেখার জন্য।

কিসের লেজ?

ঘুমের।

দাঁড়া, আমি এখনই তোর মা-কে বলছি।

কী বলবে?

যা করছিলি, আমাকে নেংটা করার চেষ্টা।

তা হলে বানিয়ে বানিয়ে ওরকম একটা কথা তোমার বিরুদ্ধে আমিও বলব।

মানে?

খুব সহজ। মেয়েদের বলা মিথ্যাকথাকে অনেকেই ছেলেদের বলা সত্য কথার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ঠিক বলিনি, বাবুই?

তিন

তুই ওই কালীটার সাথে তিন মাস থেকে অনেক বেশি পেকে গেছিস।

আমি ওয়াঙ্গারির কাছে শোনা কথাটা আরো জোর দিয়ে বললাম, শোনো বাবুই, ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল।

তার মানে তুই সত্যিই পেকে গেছিস।

বাবুভাই বিছানায় বসেই জিরার শরবতের গ্লাসের দিকে হাত বাড়ায়। দুই ঢোকে সবটা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, এটাও কি মা কালীর কাছে শিখেছিস নাকি? আমি বাথরুমে ঢুকছি। আর এক গ্লাস বানিয়ে নিয়ে আয়। সকালে তাহলে আর নাস্তা লাগবে না। একটু আগে আগে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেব। নাস্তাটা তাহলে বেঁচে যাবে।

কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোলে কেন?

আমি কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সে-জন্য তাড়াতাড়ি দুটো ঘুমের, ওষুধ খেয়ে নিলাম, একটা খেলেই হতো।

দু দিন ধরে বাবুভাই এখানেই, এ রুমেই রাস্তা বরাবর দরজাটা ওয়াঙ্গারি থাকার সময়ই অনেকটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখানে আসার দশ দিন পর ওয়াঙ্গারি নিজে থেকেই বলেছে, রেবেকা আমি তো তোমাদের ফ্যামিলির মেম্বারই হয়ে গেছি, আমি এই করিডোর দিয়েই আসা যাওয়া করতে পারব। তা ছাড়া আমার গেস্টও আসবে না যাকে এই দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে।

তাহলে তো ভালোই আমাদেরও টেনশন কমবে। ঘরে বিদেশি মেয়ে—এই দরজা ভেঙে কেউ ঢুকল কি-না সে দুশ্চিন্তা আমাদেরও থাকবে না।

ব্যাপারটাকে আরো সিরিয়াস করে তোলার জন্য এই রুমের দরজার বাইরে একটি পুরোনো ও ভারী তালাও লাগানো হলো আর ভেতর দিকে দরজা বরাবর পুরোনো মডেলের লম্বা ফাইল ক্যাবিনেটটি বসিয়ে দেওয়া হলো। এক আলমারির তিন তাক বোঝাই আইনের বই, আর এক তাকে হাদিস, ইতিহাস ও সাহিত্যের বই, আর ফাইল ক্যাবিনেটে কিছু কাগজের ফোল্ডার, পুরোনো মামলার কিছু কাগজপত্র এবং নিচের তাকে তিন জোড়া জুতো, একটি ছোট টেবিল এবং এক পা জোড়া দেওয়া একটি চেয়ার—এগুলো সব মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবি-র, দেয়ালে ঝুলোনো ছবি তিনটিও।

বাবুভাই যদি তিন দিন আগে আসত তখন এই রুমটি তাকে দেওয়া সম্ভব হতো না। কারণ ওয়াঙ্গারি মাত্র গত পরশু সকালে কুড়িগ্রাম রওয়ানা হয়েছে। পৌঁছেছে রাত আটটায়। একটা এসএমএসও টেক্সট করে দিয়েছে : অ্যারাইভড সেইফলি।

সেখানে নদীভাঙা এলাকায় তিন মাস কাজ করে আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসবে। আমরা নিশ্চয়ই কাউকে ভাড়া দেবো না।

যেহেতু ওয়াঙ্গারি ভলান্টিয়ার সেজন্য বেতন খুব কম, সাথে সামান্য পকেটমানি। নিজেই হিসাব করে মাকে বলেছে থাকাখাওয়া বাবদ দশ হাজার টাকার বেশি দিলে তার অন্য খরচে টানাটানি পড়বে। পনেরো দিন কাটানোর পর মা বলল, যদিও আমার কিছু বড় টাকার দরকার, তোমাকে কোনো ভাড়াই দিতে হবে না, তুমি আমার মেয়েকে যতটা পারো ইংরেজি শেখাবে আর তোমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে বাধ্য করবে।

ওয়াঙ্গারি বলল, কিন্তু আমিও তো ওদের কাছে বাংলা শিখব। তখন তো কাটাকাটি হয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দশে তিরিশ হাজারই নিল, কিন্তু কুড়িগ্রাম যাবার দিন মা তাকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, এটা আমি তোমাকে দিলাম।

দ্যাটস গুড, আমি তাহলে মিনেসোটা যাবার সময় অনেকগুলো বাংলাদেশি সুভেনির কিনে নিয়ে যেতে পারব। থ্যাঙ্ক ইউ—ইউ আর সো কাউন্ড। আমি টাকাটা আমার সাথে নিলে খরচ হয়ে যেতে পারে। তোমার কাছে রাখো, বাংলাদেশ ছাড়ার কয়েকদিন আগে নেব। ওয়াঙ্গারি মাকে যেভাবে রেবেকা বলে, এটা আমার পছন্দ হয়। আমি কি ওর মাকে গ্যাব্রিয়েলা বা গ্যাবি ডাকতে পারব?

কুড়িগ্রাম যাবার আগের দিন ওয়াঙ্গারির তিন মাসের বিদায় উপলক্ষে পোলাও কোর্মা জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা করা হলো।

ভালো খাবারের ঘ্রাণ পেলে ওয়াঙ্গারির ছোটবেলার খাবার না পাওয়া কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কেবল ও গালি খেয়েই নাকি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে।

ওগালির কথা বলতে বলতে মা’র কথাও বলল। দ্য পুওর লেডি আমেরিকায় এসে এইডসমুক্ত গ্যাব্রিয়েলা নিকোলাসের ঐশ্বর্যের মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তারের সাথে নার্সের সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় নিকোলাসের ল্যান্ডরোভারের স্টিয়ারিং-এ বসে গাড়ি চালানোটা শিখে নেন। আমেরিকায় এসে ড্রাইভিং স্কুলে একুশটা লেসন নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেন। লাইট ভেহিকল চালাবার ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়ে যান।

ডাক্তার নিকোলাসের চোখে অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই ছানি পড়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ায় তিনি গাড়ি চালানো ছেড়ে দেন। পুরো দায়িত্বটাই নিয়ে নেন গ্যাব্রিয়েলা। কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ডাক্তার নিকোলাসের প্রথম স্ত্রী ক্যারিবিয়ান নারী আমান্দা হো-র সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেন। রাতের বেলা হাইওয়ে ধরে পাশ্ববর্তী স্টেট উইসকনসিন যাবার পথে তুষার ভেজা রাস্তায় তার গাড়ি স্কিড করে হাইওয়ের বাইরে গিয়ে উল্টে যায়। পেছনেই ছিল তাকে অনুসরণ করে আসা পুলিশের গাড়ি। তিনি নির্ধারিত সর্বোচ্চ গতির চেয়ে কুড়ি কিলোমিটার বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়নি, আবার হাসপাতালেও জীবিত পৌঁছাতে পারেননি। ফায়ার ব্রিগেড আনিয়ে ভেতর থেকে লক করা গাড়ির দরজা ভেঙে তাকে বের করতে হয়। অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়।

আমার কাছে খটকা লেগেছে তা হচ্ছে ওয়াঙ্গারির শেষ মন্তব্য :অ্যাকচুয়ালি শি ডিজার্ভড ইট। আসলে এটা তার প্রাপ্য ছিল।

গ্যাব্রিয়েলার মৃত্যু ঘটেছে তিন বছর আগে। এই মৃত্যু ওয়াঙ্গারির ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্তু বছর না পেরুতেই ডাক্তার নিকোলাস সিশৌর যখন বিছানায় পড়লেন, ওয়াঙ্গারি ভেঙে পড়ল। বিছানায় পড়ার সাথেই হাসপাতালে এরপর আর তার বাড়ি ফেরা হয়নি। হাসপাতালে ভর্তির একাশিতম দিনে ডাক্তার নিকোলাস মারা গেলেন। এইডস রোগে।

ওয়াঙ্গারি বলল, তারপরই আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। পরক্ষণেই, মিষ্টি এক হাস্যেজ্জ্বল চেহারায় আবির্ভূত হয়ে বলল, আজ আমি অনেক বেশি করে খাবো। কেনিয়ায় কোথাও কোথাও এটা মনে করা হয়—মৃতকে স্মরণ করে বেশি খেলে, তৃপ্তির সাথে খেলে মৃতের আত্মা শান্তি পায়। আমি ডাক্তার নিকোলাসের কথা মনে করে খাবো।

আমি মুখ খুলিনি।

হঠাত্ আমার মা বলল, ওয়াঙ্গারি, আমি খাবো তোমার মা’র কথা মনে করে।

ওয়াঙ্গারি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ রেবেকা। তুমি নিজে থেকে না বললে আমি তোমার মেয়েকে রিকোয়েস্ট করতাম। অফটার অল শি ইজ মাই মাদার।

খেতে খেতে মা’র রান্নার প্রশংসা করতে গিয়ে বলল, দ্য ফুড ইজ এক্সট্রিমলি ফ্যাবুলাস। তুমি আমেরিকান শেফ অব দ্য ইয়ার লাইভ অনুষ্ঠানে গেলে আমি নিশ্চিত তুমি প্রথম পাঁচ জনের মধ্যেই থাকবে।

ডেজার্ট হিসেবে খেজুর গুড়ের পায়েশ খাবার সময় ওয়াঙ্গারি বলল, ডিনারের পর বড় মগে এক মগ কালো কফি খাবো। আমি সেই মুভিটা ডাউনলোড করেছি। দেখবে গ্রেগরি পেক আর ইমরানের চেহারার মধ্যে অনেক মিল। রেবেকা তুমিও আমাদের সাথে জয়েন করো। মুভিটার নাম ‘রোমান হলিডে’।

আমিই বললাম, না মা দেখবে না। বাবার মতো চেহারার কোনো পুরুষমানুষকে দেখলে মা আপসেট হয়ে কাঁদতে শুরু করবে, সিনেমা দেখার পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

মা এক মগ কফি দিয়ে বলে গেল, দরজা খোলা থাকবে তাড়াতাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়িস।

দরজা মানে করিডোরের শুরুতে একটা দরজা। যখন এই রুমটা মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবি-র চেম্বার ছিল, তখন এই দরজাটা সারাদিনই বন্ধ রাখা হতো। বাবা এটা খুলত রাতের বেলা।

সিনেমাটা সত্যিই দারুণ। জো ব্র্যাডলি হচ্ছে আমেরিকান সাংবাদিক আর অ্যান হচ্ছে ইউরোপের এক খামখেয়ালি প্রিন্সেস। এই দুজনের যতসব কীর্তিকলাপ সব রোমে। গ্রেগরি পেক হচ্ছে জো আর আদ্রে হেপবার্ন সেই প্রিন্সেস অ্যান।

একটু পরপরই ওয়াঙ্গারি বলেছে, লুক লুক দ্যাটস ইমরান।

যেভাবে সে ইমরান ইমরান করছে, মনে হচ্ছে তার বন্ধু। আমার ওই লোকটিকে ভালো লেগেছে, কিন্তু দেখতে বাবার মতো এটা মনে হয়নি।

অবশ্য ওই ছবিটাসহ আর একটি কি দুটি ছবি ছাড়া আমিই বা বাবার কতটুকু দেখেছি। আমার বয়স যখন দু বছর সাত মাস নয় দিন, তখন থেকেই বাবা নেই। সত্যি বলছি, বাবার কথা আমার একটুও মনে নেই।

আমার রাতটা কাটল ওয়াঙ্গারির সাথে, তার বিছানাতেই।

চার

বাবুভাই সম্পর্কে দুনিয়ার সব নোংরা কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। যেমন :

বাবু একটা আস্ত হারামজাদা।

বাউব্যা হচ্ছে ভয়ংকর এক ক্রিমিনাল।

বাবুর বগলে ইট মুখে শেখ ফরিদ (এ কথাটার মানে আমি বুঝতে পারিনি)।

বাবুর একটা জঙ্গি কানেকশন আছে।

আরো আছে। বাবুর চরিত্র খারাপ। বাজারের মেয়েদের সাথে বাবুর ওঠাবসা।

আরে ওঠাবসা মানে উঠবস করা নয়, মানে শোয়া।

মিথ্যে কথা।

মিথ্যে হবে কেন? বাজারের সবাই জানে। তুই তো দুনিয়ার কোনো খবরই রাখিস না। বাজারের মেয়েদের সাথে শোয় বলেই তো ওদের কাছ থেকে অনেকগুলো খারাপ রোগ নিয়ে এখন বড্ড পেরেশানিতে আছে। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখিস, চাপাটা ভেঙে গেছে।

তখন আমি বললাম, বাবুভাই কারো কাছ থেকে কোনো খারাপ রোগ আনেনি আর তার চাপাও ভাঙেনি।

বাবু সম্পর্কে একটা নোংরা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। বাবুভাই বাজারের মেয়েদের সাথে ওঠাবসাশোওয়া কিছুই করে না। এগুলো সব তোমাদের বানানো কথা।

তুই বিশ্বাস করিস না বলেই বাবুর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র হয়ে গেল।

হ্যাঁ হয়ে গেল। বাবুভাই সম্পর্কে আমি যা জানি সেটাই সত্য, বাবুভাই সবচেয়ে ভালো।

বেশ, তুই না হয় বিশ্বাস নাই করলি। বাজারের মেয়েছেলেদের সাথে শোয়া-বসার ব্যাপারটা ধরলাম মিথ্যে। তার কাছে যে পিস্তল ছিল এটা তো আর মিথ্যে নয়। ভালো মানুষের কাছে কি কখনো পিস্তল থাকে? তাই বলবি পিস্তল তো বেলুন ফোটানোর জন্য। শোন, বেলুন ফোটায় খেলনা এয়ারগান দিয়ে, পিস্তল দিয়ে নয়।

টুকু ভাই আমি সব জানি। আমার বয়স ফিফটিন। শুধু জানি তা নয়, আমি বুঝিও।

তুই কী জানিস? কী বুঝিস?

বাবু ভাইর ঘরে পিস্তল লুকিয়ে ওসি সাহেবকে ফোর্স নিয়ে আসতে কে ফোন করেছিল—এটা এ বাড়ির নাবালক শিশুরাও জানে। আমার কথায় টুকু বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী বললি? আমি তার কথার জবাব না দিয়ে উঠোন পেরিয়ে আমাদের ঘরে চলে আসি।

টুকু আমার বড়চাচার ছেলে। এমনিতে চুপচাপই থাকে। কিন্তু মিনমিনে স্বভাবের। কুটনা স্বভাবের মহিলাদের মতো সুযোগ পেলেই কুটনামি করে।

টুকুর একটা কান বারোমাসই পচা থাকে, দুর্গন্ধও বের হয়। এজন্য এ বাড়িতে তার নাম হয়ে গেছে কানপচা টুকু। টুকুর কপালেও একটা সমস্যা আছে। ঠিক নাক বরাবর উপরের দিকে একটা জায়গা ফুলে উঠছে। মনে হয় শিং গজাচ্ছে। কিন্তু ভেতরের খবরটা আমি জানি। এটা মাথার টিউমার। বায়োপসি করাতে হবে। তাতেই ধরা পড়বে এটা একটা সাধারণ টিউমার নয়, এতে ক্যানসারও আছে। ভেতরের খবর আমি একজনের কাছ থেকেই পাই, আমার বান্ধবী রূপা।

টুকু ছোট। বড়টার নাম খুকু। বড় চাচার দুই ছেলে।

খুকু কিন্তু মেয়ে নয়, পুরু গোঁফওয়ালা পুরুষ মানুষ। কিন্তু গোঁফের সাথে খুবই বেমানান ছাগলা দাড়ি। আমিও বলেছি খুকু ভাই, আপনার দাড়ি রাখার কী দরকার?

দরকার নেই মানে? কবরের ফেরেশতা পুরুষমানুষকে দাড়ি ধরে টেনে বসায়, তারপর সওয়ালজবাব করায়।

কিন্তু শেভ করার দু-একদিনের মধ্যে যারা মারা যায় তাদের কি সওয়ালজবাব হয় না?

খুকু ভাই ধমক দিয়ে বললেন, বল অস্তাগফিরুল্লাহ!

আমিও বললাম, অস্তাগফিরুল্লাহ।

তরপর আমি আর তাকে দাড়ি রাখতে দেখিনি।

খুকু ভাইয়ের মূল সমস্যা মৃগী রোগ। ইংরেজিতে বলে এপিলেপসি। এক অমাবস্যায় বাদ গেলেও পরের পূর্ণিমাতে দেখা যাবে রাস্তার পাশে ড্রেনের ধারে পড়ে আছেন। কেউ ভাবতে পারে মরে গেল নাকি?

কিন্তু খুকু ভাইর স্ত্রী বলেছেন, মরলে তো ভালোই ছিল। এমন মানুষ মরে না, কেউ কেউ নব্বই-পঁচানব্বই বছরও বেঁচে থাকে। একটা ভালো ওষুধ আছে—পুরোনো জুতোর দুগর্ন্ধযুক্ত সুখতলা তার নাকের কাছে পাঁচ মিনিট ধরে রাখলেই জ্ঞান ফিরে আসে। আমার মা এই চিকিত্সাপদ্ধতিকে বলে সুখতলা থেরাপি। এই খুকুই প্রথম কথাটা ছড়াল যে উকিল চাচীর চরিত্র খারাপ।

অনেক পুরুষমানুষ নিজের বিরুদ্ধমত সহ্য করতে পারেন না। কোনো পুরুষমানুষ তার দ্বিমত পোষণ করলে বলেন লোক খারাপ আর কোনো নারী করলে চরিত্র খারাপ।

আমার মা কখনো উকিল ছিল না। শুরু থেকেই স্কুলের টিচার। কিন্তু আমার বাবা উকিল হবার কারণে মা হয়ে গেল উকিল চাচী, উকিল মামি, উকিল ভাবি।

মা বলল, বাজে লোকের কথায় কিছু এসে যায় না। সুখতলা থেরাপি দিয়ে খুকুর জ্ঞান ফেরাতে হয়, বাকি জীবন জুতোপেটা খেয়ে কেটে যাবে। এসব মানুষ দেখলে বমি আসে।

খুকুভাইকে দেখে মা বমি করেছে—এমন কখনো শুনিনি কিংবা তার বমির উদ্রেক হয়েছে এমনও নয়। তবুও মা বলে, টুকুটাকে তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু এর বড়টাকে দেখলে বমি আসে।

খুকু ভাইর শুরুটা ভালোই ছিল। বিএ পরীক্ষায় বসে ইংরেজির দিন একবস্তা নকলসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং এক্সপেল্ড হন। এক্সপেল্ড করেন কলেজের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল আলা মুস্তাহিদুল ইসলাম।

খুকুভাই শালা আবুল আলা বলে ভয়ংকর এক ঘুষি বসিয়ে দেয় এই শিক্ষকের উপর। তার চশমা ছিটকে পড়ে, নাক দিয়ে রক্ত পড়ে, তিনিও হুমড়ি খেয়ে হিজাবপরা এক ছাত্রীর উপর পড়ে যান।

খুকুভাই এরপর দৌড়ে পালাননি, বীরের মতো কলেজের কম্পাউন্ডে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পড়াশোনায় জনমের মতো ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

আবুল আলা মুস্তাহিদুল ইসলাম কলেজের প্রিন্সিপালের কাজে বিভিন্ন ধরনের বাধা সৃষ্টি করায় তার রক্তপাতে তিনি পুলকিত হন এবং ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, খুকু তো ছেলে ভালো, অকারণে ঘুষি মেরে কারো নাকের বাঁশি ভেঙে দেবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না! তবুও শিক্ষকের গায়ে যেহেতু হাত তুলেছে, তদন্ত করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে।

আবুল আলার অনুসারী দুজন শিক্ষক তাদের রক্তাক্ত সহকর্মীকে প্রতিটি রুমে রুমে নিয়ে যান এবং প্রতিবাদে পরীক্ষার হলে ডিউটি বর্জনের ঘোষণা দেন। খুশিতে আটখানা হয়ে পরীক্ষাার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে নকল খুলে বসে এবং টুকতে শুরু করে। সবশুদ্ধ সাত শ জন শিক্ষকের কুড়ি জনই আবুল আলাপন্থি হওয়ায় প্রিন্সিপাল বেকায়দায় পড়েন এবং পরদিন পিয়ন-দপ্তরি দিয়ে এবং পাশের প্রাইমারি স্কুলের ক’জন শিক্ষককে দিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যান।

নকলের এই অসামান্য সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষার্থীরা খুকুর কাছে কৃতজ্ঞ যাকে এবং পরীক্ষার পর প্রতিদিন মিছিল করে তার অ্যাক্সপালশন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।

দৈনিক জাহান পত্রিকায় খুকুর ছবি ছাপা হয়, নিচে ক্যাপশন ‘শিক্ষক প্রহারকারী ছাত্র’। খুকু হঠাত্ হিরো হয়ে ওঠে।

জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতিনিধি তদন্ত করতে এলে সেই হলের দু-একজন কেবল নিশ্চুপ থাকে, বাকিরা সমস্বরে বলে, খুকুকে এসব করতে তারা কেউ দেখেনি। আবুল আলার আইএ ফাস্ট ইয়ারে পড়া মেয়ে নার্গিসের সাথে তার একটি সম্পর্ক রয়েছে সন্দেহ করে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে স্যার তাকে পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করেছেন।

অবস্থা বেগতিক দেখে তার অনুসারীরা দ্রুত তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য কলেজে চলে আসেন। থানা থেকে একজন দারোগা গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি লিখিতভাবে জানিয়ে দেন, খুকু তাকে আঘাত করেনি, পা পিছলে পড়ে গিয়ে নাকে মুখে সামান্য ব্যথা পেয়েছেন।

হিরো মাস্তান হিসেবে খুকুর খুব নামধাম হয়ে গেল। তিনি যেদিকে যান অন্তত দশ-বারো জন ভক্ত তাকে ঘিরে থাকবেই। তাদের চা-বিস্কুট ও সিগারেট খাওয়াতে খাওয়াতে ফতুর হয়ে গেলেন। শিষ্যদের প্ররোচনায় নতুন বাজারে চাদাবাজি করতে গিয়ে অধিকতর সেয়ানা এক দোকান মালিকের পাল্লায় পড়ে পুলিশের হাতে মা’র খেয়ে আবুল আলাকে পিটিয়ে মাস্তান সমাজে যে গৌরব ও ইজ্জতের অধিকারী হয়েছিলেন তা খোয়ালেন।

দোকানমালিক তার কথোপকথন পুরোটাই স্মার্ট ফোনে রেকর্ড করে নিয়েছিলেন। পরদিন সকাল এগারটায় দশ হাজার টাকা দেবার অঙ্গিকার করে টাকাসহ প্রস্তুত ছিলেন। পুলিশের সাদা পোশাকধারী একজন সাব ইন্সপেক্টর হাজার টাকার প্রতিটি নোটের ওপর গভর্নরের সইয়ের পাশাপাশি নিজের সই করেন, দোকান-মালিকের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে কিছুদূর হেঁটে মন্ডার দোকানে এসে বসতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো। টাকাটা যে চাঁদাবাজির টাকা নয়—এটা তিনি প্রমাণ করতে পারলেন না। তিনি যথেষ্ট মারধোর খেলেন, জেলে গেলে পরিবারের মানসম্মানে হাত পড়ে যাবে—এই আশঙ্কায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে বড় চাচা ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন। মার খেলেও টাকা গেলেও খুকুর একটা বড় শিক্ষা হয়েছে। গভর্নরের সইয়ের পাশে উপরে কিংবা নিচে, বড় নোটে অন্য কারো সই থাকলে তিনি সেই টাকা হাতে নেন না।

হাজতে যারা তাকে দেখতে গিয়েছেন, তাদের অন্যতম আবুল আলা মুস্তাহিদুল ইসলাম। তিনি প্রকাশ্যেই তার ফোনের ক্যামেরায় হাজতবন্দি খুকু ভাইয়ের একটি ছবিও নিয়েছেন।

খুকু ভাই পরে জেনেছেন নতুন বাজারের সেই দোকান মালিক আসলে আবুল আলা স্যারের সমন্ধি, স্ত্রীর বড় ভাই।

এই ঘটনায় তার স্ট্যাটাস এতটাই নেমে যায় যে আবুল আলা স্যারের মেয়ের মুখোমুখি হতে খুব বিব্রত বোধ করেন। নার্গিসকে দেখলে তিনি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেন।

শেষ পর্যন্ত খুকুভাই নিজেকে আমাদের এলাকার সিনিয়র মাস্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে জুনিয়র ছেলেদের পেছন পেছন ঘোরেন। তাদের কেউ কেউ তাকে তুই তুমিও সম্বোধন করে থাকে।

খুকুভাই বিবাহিত এবং এক কন্যার জনক। স্ত্রীর নামের সাথে মিল রেখে মেয়ের নাম রেখেছেন সিমকি—মুম্বাইতে এই নামের একজন গরম নায়িকাও ছিলেন।

খুকু ভাইয়ের স্ত্রী, আমাদের রুমকি ভাবি তেমন গরম না হলেও লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বেশ স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন, এমন ধ্বজভঙ্গ মাস্তানের সাথে আমি সংসার করতে চাই না।

তিনি আমাকে বললেন, মন্ত্রী সাহেব সাতষট্টি বছর বয়সে বিয়ে করে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন আর তোমার ভাই সাতাশের আগেই কাত হয়ে পড়েছে।

খুকুভাই রেগে গেলে একটু তোতলান। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আমি সি সি সিমকির বাবা হয়েছি, তারপরও আমাকে বলবে ধ্বজভঙ্গ। শোন, রু রু রুমকি আমি একটা একটা করে দাঁত তুলে, মাথা ন্যাড়া করে তোকে রাস্তায় নামিয়ে দেবো। তুই আমাকে চিনিস না। শালা আবুল আলাকে সামনে পেলে দেখিস উপর পাটির দুটো দাঁত নেই। আমার এক ঘুষিতেই।

রুমকি ভাবি আমাকে বলেছেন, তোমাদের খুকুমণিকে আমার চেনা হয়ে গেছে। মেয়ের বাবা হবার বাহাদুরি করে। সিমকির বাবা কে এটা কি খুকুর জানার কথা না আমার? আমি জানি।

সিমকি যখন পেটে, আড়াই কি তিন মাস চলছে, বমি শুরু হয়ে গেছে খুকু ভাইর বেমক্কা এক ঘুষিতে তারও চোয়ালের দাঁত নড়ে গিয়েছিল। উকিল সাহেব তাকে বলেছেন, খুকু সাহেবের মুষ্ঠাঘাতে আপনার একটি দন্ত শহীদ হলে বরং ভালো ছিল। পেনাল কোডের ৩২৬ ধারায় পার্মানেন্ট ডিসফিগারেশনের একটা মামলা দেওয়া যেত। তারপর পাঁচ থেকে সাত বছর জেলে।

সিমকির কষ্টের কথা বিবেচনা করে আর মামলার আর্জি দাখিল করা হয়নি। খুকুর অন্তত একটা ভালো দিক তো আছে—মেয়েকে ভালোবাসে, কেনাকাটা যা করে সব মেয়ের জন্যই।

টুকুর মতো খুকু ভাই আমাকে ঘাঁটাল না। তা ছাড়া আমি রুমকি ভাবিকে পছন্দ করি। সিমকিটা দেখতে দারুণ কিউট।

পাঁচ

একপাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, একপাশে আলবার্ট আইনস্টাইন, মাঝখানে মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবি, সাদা শার্ট, কালো কোর্ট, কালো বো টাই, ওয়াঙ্গারির মতে দেখতে গ্রেগরি পেকের মতো— এই মানুষটিই আমার বাবা।

কারণটা তিনিই ভালো জানেন আমার জন্মের পর তিনি আর শেভ করেননি। মুখভর্তি দাড়ি, চোখে সুরমা, গায়ে আতরের গন্ধ—এমন একজন এমরান আলীর ছবি আমার বড় আপুর স্মৃতিতে কিছুটা আছে। আমার স্মৃতিতে কিছুই নেই। আমার দুই ভাইয়ের স্মৃতিতে কিছু আছে কি-না—তারা কখনো মুখ খুলে বলেনি। দাড়িঅলা কোনো ফটোগ্রাফ নেই। বাবা কোনো ছবি তোলেননি। বলেছেন, নাজায়েজ। হাশরের ময়দানে যখন ফটোকে প্রাণ দিতে বলা হবে তখন তুমি, আমি, এমনকি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফারও প্রাণ দিতে পারবে না, তখন যার ফটো তাকে এবং যে ফটো তুলেছে তাকে কঠিন আজাব দেওয়া হবে।

সেই কারণেই বাবার কোলে এমন শৈশবের এমন একটি প্রত্যাশিত ছবি আমার অধিকারে নেই। ফ্রেমে বাঁধানো তিনটি ছবি নামিয়ে ফাইল ক্যাবিনেটের নিচের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। মা পরে উঠিয়েছেন।

বাবা তিন জনের নাম বদলেছেন। বড় মেয়ের নাম নিজের প্রিয় নায়িকার নামে রেখেছিলেন : সোফিয়া লরেন।

দুই ছেলের নাম : আব্রাহাম লিঙ্কন ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

সোফিয়া লরেনের নাম হলো বিবি হাফসা। আব্রাহাম লিঙ্কন হলো আহমেদ বেনবেল্লা এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন হলো ইয়াসির আরাফাত। আমার নাম আর বদলাতে হয়নি, কারণ আমার জন্মের সূচনা থেকেই বাবা একজন ভিন্ন মানুষ। তবে নিজের নাম পদবী সব আগের মতোই রেখে দেন। কিন্তু তার অবয়ব পরিবর্তনের সাথে সাথে উকিল পদবীর গুরুত্ব কমতে থাকে—তিনি ‘হুজুর’ সম্বোধন শুনতে থাকেন।

ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের পেছনের দিকটাতে গুলকি বাড়ি রোডে আমার দাদার চৌদ্দ কাঠা জমিতে চার ছেলেকে তিনি নিজের ঠিকানা করে দিয়েছেন। বড় ছেলে ও ছোট ছেলে তিন কাঠা করে রাস্তাঘেঁষা জমি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছেলে চার কাঠা করে পেছন দিকে। পেছনের দুজন এক কাঠা করে বেশি জমি পাওয়ায় বরং সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদের বাবার সুবিচারের প্রশংসা করেছেন। চার জনেরই একতলা বাড়ি। নিজেদের মধ্যে কিছু সমস্যা থাকায় ডেভেলপার এখনো এ জমিতে দাঁত বসাতে পারেনি। কিন্তু এ কোনো স্থায়ী সমস্যা নয়, নিজেদের স্বার্থেই একতলা গুঁড়িয়ে দিয়ে আটতলা দশতলার দিকে যেতে হবে। স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে হাউস বিল্ডিং লোনের যে বরাদ্দ তার অর্ধেকও বিতরণ হচ্ছে না, ব্যাংকের সুদ আরো এক দফা কমানোর আলাপ চলছে। সুদ কমলে মানুষের ঋণ নেবার আগ্রহ বাড়বে। এসব অবশ্য আমার বোঝার কথা নয়, কিন্তু বাবুভাই অনেক কিছুর সাথে এটাও বুঝিয়েছে।

বাবার বড় তোফাজ্জল আলী—খুকুভাই, টুকুভাই, হীরা, রূপা ও মুক্তার বাবা—আমাদের বড়চাচা। লোকজন তাকে ডাকে টি আলী। টি ফর ট্রাবল। ট্রাবল আলী। যেখানেই যান একটা না একটা সমস্যা তৈরি করেন। বাবুভাই তাকে নিয়ে কিছু কথা বলেছে, সবটা আমি বুঝিনি। মানুষ চায় তার অস্তিত্ব নিজে টের পাবে, অন্যদেরও টের পাওয়াবে। এজন্য লেখকরা বই লেখে, গায়ক গান গায়, পুলিশ ঘুষ খায়, তোফাজ্জল আলী সমস্যা তৈরি করে।

দু নম্বর সিকান্দর আলী—পুতুল ও মিতুলের বাবা এবং নাজমুননেসা ও রাহাত আরার স্বামী। দুই স্ত্রী নিয়ে শান্তিপূর্ণ বসবাসের একটি বড় উদাহরণ সিকান্দর চাচা।

সাজ্জাদ আলী বাবুভাইর বাবা।

মিস্টার এমরান আলী এমএ এলএলবির কথা তো বলেছিই।

একজনই আমাদের ফুপু, বয়সে টি আলীর চেয়েও বড়। ব্রাহ্মপল্লীর মোহাইমেন সাহেবের স্ত্রী ছিলেন। মোহাইমেন ফুপা একটি বড় কনফেকশনারির মালিক। তিনি সিনেমার একজন এক্সট্রাকে বিয়ে করে ফেলায় ফুপু ক্ষুণ্ন হন। ফুপু তার নিজস্ব গোয়েন্দাসূত্রে জেনেছেন সুমনা নামের এই এক্সট্রা পেশাগত জীবনে দেহ ব্যবসায়ী ছিলেন। একজন দেহ ব্যাবসায়ীর স্বামীর সাথে একই বাড়িতে থাকা সমীচীন হবে না বিবেচনা করে একমাত্র মেয়েকে রেখেই ভাইদের কাছে চলে আসেন। আমার মা তাকে সাথে রাখতে সম্মত হন। মাস তিনেক ফুপু আমার সাথে একই বিছানায় ঘুমোতেন। ফুপু নিজের টাকাতেই ইট-সিমেন্ট-বালি কিনে আমাদের ঘরের ছাদে আর একটি রুম করেন। কিন্তু সিঁড়ি তৈরিতে অনেক খরচ হবে বিবেচনা করে বাইরে থেকে ছাদ পর্যন্ত একটি কাঠের সিঁড়ি—অনেকটা লঞ্চের সিঁড়ির মতো, নির্মাণ করা হয়েছে।

সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠাটা ছিল আমার প্রতিদিনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কাজ।

আমি বাবার চেম্বারটাকে আমার রুম হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। মা কখনো রাজি হয়নি। তবে ক্লাস নাইনে ওঠার পর হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে ছোট হলেও আমার জন্য একটি রুম করে দেওয়া হয়েছে। বাকিটা সিঙ্গেল, টেবিলটা ছোট, কিন্তু চেয়ারটা বাবার, আমার তুলনায় বেশ বড়। আমার রুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসবাব হচ্ছে আমার বুকশেলফ। এর ভেতরে কোনো টেক্সট বই নেই। আমার বড় চাচী মিসেস টি আলী একদিন এসেছিলেন। শেলফের বইগুলো খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আমাকে বললেন, কাজের বই তো একটাও দেখলাম না। সব বাজে বই।

আমি শুধু বললাম, জি বড়চাচী, ঠিকই বলেছেন।

আমার বাজে বইয়ের সংখ্যা ২০৫টি, এর মধ্যে পুরোপুরি ইংরেজি বই ১৯টি। আমার বয়স আঠার বছর হতে হতে আমার বইয়ের সংখ্যা হবে ৬০০। আমি শ্বশুর বাড়িতে যাবার সময় বইসহ এই বুকশেলফটা নিয়ে যাব। আমার বাবার আলমারিতেও অল্প কিছু বাজে বই আছে সেগুলোও নেবো।

আমার ডায়েরি আছে, এবারেরটিসহ তিনটি। সবদিনই যে লিখেছি, এমন নয়। কোনো কোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও লিখিনি, আবার তুচ্ছ বিষয় লিখে রেখেছি। শ্বশুরবাড়িতে ডায়েরিগুলো নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না, এগুলো আমার কালো ট্রাঙ্কে ভরে তালা মেরে রেখে যাবো।

সাজ্জাদ চাচা একসময় গণমানুষের রাজনীতি করতেন। কিন্তু কৃষক ও মজুরের রাজনীতি বেকায়দায় পড়ে যাওয়ায় তিনি সরকারি দলেই দলবলসহ যোগ দেন। এমনিতেই জনপ্রিয় ছিলেন, এবার আরো বাড়তে থাকে। আর এমপি সাহেবের ছেলে, মেয়ের জামাই, ভাস্তে ও শালার অনাচার তার জনপ্রিয়তায় ধস নামায়। গোয়েন্দা সংস্থাও জানিয়ে দেয়, তিনি পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছেন। তিনি স্থানীয় বিরোধী দলের নেতাকে নয়, তার নিজদলের মানুষটিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেন, আতঙ্কিতও বোধ করেন।

বড়চাচাও পাঁচটি কারণে তার ওপর নাখোশ ছিলেন। প্রথমত তিনি তখনকার সরকারি দলের নামটি শুনতে পারতেন না; দ্বিতীয়ত সাজ্জাদ চাচা খুকুর কিছু অপকর্ম নিয়ে খুকুকে বকাবকি করেছিলেন, বড় চাচাকেও বিষয়গুলো বলেছিলেন, তৃতীয়ত সাজ্জাদ চাচা তার স্ত্রীকে আস্কারা দিয়ে এতটা মাথায় তুলেছেন যে—এমনকি টি আলীর সামনেও চাচী মাথায় কাপড় দিতেন না; চতুর্থত আইনত সাড়ে তিন কাঠা পৈতৃক জমি প্রাপ্য হলেও সাজ্জাদ চাচা নিয়েছেন চার কাঠা; পঞ্চমত কারও না কারও ওপরে নাখোশ হয়ে না থাকলে বড়চাচা যে বেঁচে আছেন—সেটা তো আর বোঝা যাবে না।

সিকান্দর চাচাও তার ওপর নাখোশ ছিলেন মূলত দুটি কারণে। প্রথমত তিনি টি আলীর কথায় নাচেন; দ্বিতীয়ত বুলবুলি চাচী তার দুই স্ত্রীর তুলনায় বলা যায় হুর-পরির মতো।

তিনিও বুলবুলি চাচীর চরিত্র নিয়ে একথা-সেকথা বলেছেন। তিনি গলা ফাটিয়ে বলেছেন, অস্তাগফিরুল্লাহ, বুলবুলির চাল-চলন বেশরিয়াতি। তার এই বয়সে সালওয়ার-কামিজের মতো বেশরিয়াতি পোশাক পরার কি দরকার? শাড়ি পরলেই হয়।

সিকান্দর চাচার মেয়ে মিতুল বাবার আচরণে বিব্রত ছিল। মিতুল বলল, আরব দেশের মেয়েরা কি শাড়ি পরে?

তিনি খেপে গিয়ে বললেন, এক থাপ্পড় মেরে ছত্রিশটা দাঁত ফেলে দেবো।

মিতুল ভাবল বাবাকে বলবে, ছত্রিশ দাঁতের জন্য চারটা গেজ দাঁত থাকতে হয়।

তখন হয়তো তিনি থাপ্পড় মেরেই বসবেন এই আশঙ্কায় আর এগোয় না।

তিনি আরো বললেন, সে কি ওড়না দিয়ে বুক ঢাকে নাকি তার বুকে কী আছে অন্যদের জানায়?

সিকান্দর চাচার আক্রোশ বুলবুলি চাচীর বাবার বক্সওয়াগান গাড়িটার ওপর। চার ভাইয়ের শ্বশুরদের মধ্যে একমাত্র সাজ্জাদ চাচার শ্বশুরই গাড়ির মালিক। অভিযোগ, এই গাড়িটা আসার পথে দুটি বাচ্চা পেপে গাছের ওপর পেছনের চোঙা দিয়ে ইচ্ছে করে গরম গ্যাস ছেড়ে যায়। এসব অপরাধ প্রশ্রয় দিলে এই গাড়ি গরম গ্যাস ছেড়ে ছোট বাচ্চাদেরও মেরে ফেলবে—একে ছাড়া ঠিক হবে না।

বাবার বাড়ি থেকে এটা-ওটা নিয়ে আসা বুলবুলি চাচী তখন ঘরে ঢুকেছেন। গাড়ি রাস্তার পাশে সাইড করে রেখে ড্রাইভার বিড়ি-সিগারেট ফুঁকতে গেছেন, এই ফাঁকে আক্রোশ মেটাতে সিকান্দর চাচা তার এক টেন্ডলকে দিয়ে গাড়ির পেছনের চাকা দুটোতে পেরেক ঢুকিয়ে দেন।

এটা তো মানতেই হবে চার বউয়ের মধ্যে পড়াশোনা কেবল দুজনের—রেবেকা সুলতানা আর কুররাতুল আইন বুলবুলি। আর শারীরিক সৌন্দর্য পিতার বিত্ত ও বৈভব—এসব বিবেচনায় আনলে বুলবুলি চাচী সবাইকে ছাড়িয়ে। এমন কি মিষ্টি ব্যবহারেও। কাজেই ঈর্ষাপরায়ণ স্বজনেরা কিছু কথা তো রটাবেই।

কুড়িগ্রাম থেকে আমার নামে একটি চিঠি আসে। বাংলাদেশ ডাকঘর থেকে ইস্যু করা খামে। চিঠি নিয়ে আসে ডাকপিয়ন। কত বছর পর যে ডাকপিয়ন দেখলাম! আজকাল তো কেউ চিঠিই লেখে না, ফোনে কথা বলে, এসএমএস করে, ই-মেইল পাঠায়। কাগজ পাঠাতে হলে কুরিয়ার সার্ভিস। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বিদেশ পাঠাতে হলে ডিএইচএল সার্ভিস।

ডাকপিয়ন দেখে সুকান্তের কবিতাটা মনে হলো, এটিতে সুর দিয়ে গান গেয়েছেন হেমন্ত। আমি একটু একটু গাইতে পারি:

কতো চিঠি লিখে লোকে

কতো দুঃখে ও শোকে

এর দুঃখের কথা কেউ জানবে না কোনোদিনও

এর দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ।

ছোট্ট চিঠিতে ওয়াঙ্গারি লিখেছে :

একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি—নিকোলাস আর ইমরান কেনিয়ায় একটা ট্যাভার্নে বসে ড্রিঙ্ক করছে। তারা দুজন বহুদিনের পুরোনো বন্ধু।

কুড়িগ্রাম এসে একটা গানের প্রথম কয়েকটি লাইন শিখেছি : ফান্দে পড়িয়া রে বগা কান্দেরে। সুরটা খুব করুণ।

ব্যস এই টুকুই। ডিকশনারি ঘেঁটে ট্যাভার্ন শব্দটার মানে বের করলাম—রাস্তার পাশের শুঁড়িখানা। বাবা জীবনে ট্যাভার্নে যাবার মানুষ নন। তাছাড়া মদ তো মুসলমানদের জন্য হারাম।

যা-ই লিখুক, ওয়াঙ্গারির কারণেই একটা চিঠি পেলাম। বহুদিন পর ডাকপিয়ন দেখলাম।

মাকে বললাম, ওয়াঙ্গারির চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে কী লিখেছে তাও বলেছি।

মা বলল, মেয়েটার মাথা খারাপ। আমার সামনে যেভাবে ইমরান ইমরান করে, বাংলাদেশি মেয়ে হলে তো বাপ-মা তুলে গালি দিতাম।

মা বলল, আমার জন্য বুলবুলি ভাবি দামি এক বোতল কডলিভার অয়েল দিয়েছে। আমাকে নাকি তার মনে হয়েছে ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছি। কিন্তু বুলবুলি ভাবির যে গলা ও গালের চামড়া ঝুলে পড়ছে, বলিনি। কষ্ট পেতো।

সাজ্জাদ চাচাকে একদিন সন্ধ্যারাতেই সাদামাটা পোশাকের চার জন লোক এসে এই বাড়ি থেকেই তুলে নিয়ে গেল।

সেদিন বাবু ভাই-র জন্মদিন ছিল। সিকান্দর চাচা কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার একজন বাবুর্চি আনিয়ে রান্না করিয়েছিলেন। কাচ্চি, একটা করে রোস্ট, বোরহানি, আর নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি। মুক্তাগাছার মণ্ডা তো কমন, থাকবেই।

বাবু ভাই-র তেরো। কেকে লেখা ছিল ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু বাবু’ আর শলার মতো লিকলিকে তেরোটি মোমবাতি।

আমার তখন চার। আমাদের বয়সের ব্যবধান নয় বছর।

আসলে বার্থডে-টা কেমন হয়েছিল, কেকের উপর আদৌ মোমবাতি ছিল কি-না, বিরিয়ানিটা খাসির কাচ্চি নাকি মুরগির—এসব আমার মনে নেই। সারাদিন হই হুল্লোড় করে কেক কাটার সময় আমি ঘুমে ঢুলছিলাম। কী হয়েছে কী খেয়েছি আমার মনে নেই তবু ঘটনার সাথে মিলিয়ে বর্ণনা করে যেতে পারি—এটাকে বলে রিকনস্ট্রাকশন—পুনঃনির্মাণ।

বাবুভাই এক বছর বয়সেই মায়ের দুধ ছেড়েছে, দু’বছর বয়স থেকে আলাদা বিছানায় ঘুমায় আর চার বছর বয়স থেকে আলাদা রুমে। বাবুকে কেন এক বছর বয়সের পর মায়ের দুধ দেওয়া হয়নি—এ নিয়ে বুলবুলি চাচীকে অনেকগুলো নোংরা কথা শুনতে হয়েছে : সাজ্জাদের সাথে কুকাম করার জন্য দুধের বাচ্চাটাকে আলাদা করে দিয়েছে।

বুলবুলি চাচী কেবল শুনে গেছেন। কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে কখনো ঝগড়া করতে আসেননি। কেন ঝগড়া করছেন না এটাও তার অপরাধ।

বড় বাপের মেয়ে, সেজন্য এত দেমাগ। থু, এমন বড় বাপের গুষ্টি কিলাই।

যারা নিয়ে গেল, বলল, এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে সাজ্জাদ চাচা ফিরে আসবে। বুলবুলি চাচী বললেন, দেখুন আমাদের একটা মাত্র ছেলে। বাপ-ছেলে মিলে কেক-কাটবে।

নো প্রবলেম, কিছুক্ষণ পর এসেই কাটবে। থানায় একটু যাবেন আর আসবেন।

থানায় কেন?

পার্টির একটা ছেলে কাটা বন্দুকসহ ধরা পড়েছে। সাজ্জাদ সাহেব না গেলে ছাড়বে না।

কাটা বন্দুকসহ ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে কেন? জেল খাটুক।

সেই চার জনের একজন বলল, এর নামই তো পলিট্রিক্স। কত কিছু যে সামাল দিতে হয়।

আপনারা কি পুলিশ?

হ্যাঁ, জি না…

সে রাতে সাজ্জাদ চাচা ফেরেননি। বাবুভাই ঘুমিয়ে পড়েছিল কেক কাটা হয়নি। অন্য খাবারে কেউ হাত লাগিয়েছে, কেউ লাগায়নি।

পরদিনও ফেরেনি। বড়চাচা ও সিকান্দর চাচাকে বুলবুলি চাচীই বলেছে, সাজ্জাদ তো ফেরেনি।

বড়চাচা বললেন, তুমি কি ঝগড়া করেছ নাকি? নতুবা নিজের ছেলের জন্মদিন ফেলে কেউ যায় নাকি?

সিকান্দর চাচা বললেন, অন্য কোথাও ঘর-সংসার শুরু করেছে নাকি? এরকমই কী যেন শুনেছি।

চাচী থানায় এলেন। ওসি সাহেব বললেন, সাজ্জাদ সাহেবকে আমরা থানায় ডাকতে যাব কেন?

পার্টির কেউ কাটা বন্দুক নিয়ে ধরা পড়েছিল, তাকে ছাড়াতে এসেছিল?

কী যে বলেন, ভাবি। পার্টির ছেলেরা কি ছিঁচকে নাকি যে কাটা বন্দুক ব্যবহার করছে। ওদের কাছে ব্র্যান্ডনিউ রিভলবার পিস্তল আছে। একে ফর্টি সেভেন সাব-মেশিনগান আছে। তিন-চার দিন ওয়েট করেন, এর মধ্যে যদি না আসেন একটা জিডি করে যাবেন।

বুলবুলি চাচী রাত এগারটায় এমপি সাহেবের ডেরায় হাজির হয়ে বললেন, সাজ্জাদ যদি আপনার কাছে কোনো অপরাধ করে থাকে, প্লিজ মাফ করে দিন। আমি আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইব।

তিনি বললেন, তা কেন? সাজ্জাদ তো আমার মায়ের পেটের ছোট ভাইয়ের মতো। আমরা একই দল করি, আমাদের আদর্শও একই।

এমপি সাহেব ঘড়ি দেখলেন। রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। তিনি বললেন, দেখুন আমার শত্রুরা এমনকি আমার চরিত্র নিয়েও কথা বলে। এতরাতে আমার সাথে কেউ আপনাকে দেখলে আরো বেশি সুযোগ পাবে। বুলবুলি চাচী বললেন, আমি জানি আপনার চরিত্র ভালো।

এমপি সাহেবের সার্বক্ষণিক ক্যামেরাম্যান এক ফাঁকে ক্লিক করলেন।

পরদিনই প্রথম পাতায় বক্সনিউজ ‘মধ্যরাতে সাজ্জাদ আলীর স্ত্রী বললেন, এমপি সাহেব আপনার চরিত্র ভালো। ভেতরের পাতায় ছবি।

তিনি যখন ফিরে আসছেন, এমপি সাহেব বললেন, পিপীলিকার পাখা গজায়…

তাকে বেস্টন করে রাখা চেলারা সমস্বরে বললেন, মরিবার তরে।

তিনি যখন ফিরে তাকালেন, দেখলেন, এমপি সাহেবের চোখে মুখে নির্মমতার ফ্রেসকো।

পরদিন ভোরে ভালুকার হবির বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তার পাশে সাজ্জাদ আলীর মৃতদেহ আবিষ্কার হলো। ক্রসফায়ার বা অ্যানকাউন্টারের মতো বিবৃতি কেউ দেয়নি। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। এতটুকুও রক্তপাত হয়নি। গোলাগুলির কোনো চিহ্ন নেই।

তবে শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা, হাঁটু ভাজ করা। জরায়ুতে শিশু যেমন থাকে, ঠিক তেমন। পুলিশ এসে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করল। একজনকে বলতে শোনা গেল, মনে হয় ডিপ ফ্রিজে ছিল।

অন্য একজন ডিজ্ঞেস করল, মেরে ডিপফ্রিজে ঢুকিয়েছে, না ডিপফ্রিজে ঢুকিয়ে মেরেছে?

কী জানি, মারপিটের কোনো চিহ্ন তো দেখছিনা।

সাজ্জাদ আলীর ঘনিষ্ঠজনেরা বিপদ আঁচ করে দূরে দূরে রইলেন। তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে এমপি সাহেবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন।

তোফাজ্জল আলী ও সিকান্দার আলী প্রায় সমস্বরে বললেন, সাজ্জাদ বেশি বেড়ে গিয়েছিল। এটাই আর প্রাপ্য ছিল। খুকুভাই বলেছে, আগুনে ফেলে পুড়ে তো আর মারেনি, ঠাণ্ডা আরামে রুহ বেরিয়ে গেছে। সাজ্জাদ চাচার ভাগ্যটা ভালো।

ছয়

আমার বাবা তওবা অস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে ওকালতি ছেড়ে দিলেন। বললেন, এটা হচ্ছে খান্নাছের পেশা। শার্ট-প্যান্ট, কোট, বো-টাই, কালো গাউন সব ছেড়ে দিলেন এবং বন্যা-দুর্গতদের জন্য সব ডিসি সাহেবের রিলিফ শাখায় দান করে এলেন।

তিনি বললেন, কেয়ামত খুব কাছে এসে গেছে। মানে দাজ্জালের শাসন শুরু হয়ে গেছে। কেবলমাত্র কামেলজন দাজ্জালকে চিনতে পারেন, আর অন্যরা তার কথায় মুগ্ধ হয়ে তারই ইবাদত করতে থাকবে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার হুজুর খ্যাতি ছড়িয়ে যায়। তিনি দাজ্জালকে দেখছেন। অবশ্য আমার সন্দেহ আছে।

আমার মাকেও চাকরি ছেড়ে দিতে হলো নিতান্ত অনিচ্ছায়। অবশ্য সেটা অস্থায়ী চাকরিই ছিল। প্রতিবেশীরা আমাদের চেনে হুজুরের মেয়ে ও হুজুরের ছেলে হিসেবে। আমার দুই ভাই বেনবেল্লা ও ইয়াসির আরাফাত কখনো দাড়িতে ব্লেড লাগায়নি। বেনবেল্লা বলত পাইলট হবে; আরাফত বলত, বিজ্ঞানী হবে। এখন আর কিছু বলে না, মিটিমিটি হাসে।

বুলবুলি চাচীকে উচ্ছেদ করার কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বড়চাচা বলেন, বাবু আমাদের রক্তের। সে থাকুক কিন্তু চরিত্রহীন ওই মহিলা আমাদের কে?

আরও কথা ওঠে ওসির সাথে খাতিরজমা করে বুলবুলি সাজ্জাদের লাশ এনে কাফন-দাফন করেছে। পুলিশের খপ্পরে পড়ে যাওয়া লাশ বের করে আনা সহজ নয়। ওসি তো আর মুখ দেখেই দিয়ে দিতে রাজি হয়নি, বুলবুলিকে আরো কিছু দেখাতে হয়েছে।

চাচীর বাবা এখান থেকে বুলবুলি চাচীকে জামালপুর কলেজ রোডের বাড়িতে নিয়ে যাবার অনেক চেষ্টা করছেন আবার বিয়ে করার জন্য পাত্র এনেও হাজির করেছেন।

কিন্তু মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বলতে যা বুঝায় তিনি তা-ই করেছেন। বলেছেন সাজ্জাদকে ধরে রাখতে পারিনি, তার এই ছোট্ট বাড়িটাকেও ছেড়ে দেবো?

আমার বড়চাচী কখনোই বলেন না তোফাজ্জল, কিংবা পুতুল মিতুলের মা বলে না সিকান্দর, আমার মাকেও ইমরান বলতে শুনিনি। কিন্তু বুলবুলি চাচী কেমন অবলীলায় সাজ্জাদ, সাজ্জাদ বলে যান। স্বামীকে তার এই নাম ধরে ডাকা অন্যদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয় এসব বেশরিয়তি ডাক যদি তাদের স্ত্রীরাও শেখে সর্বনাশ হবে।

বুলবুলি চাচী বলেছেন, আমি সাজ্জাদের বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও নড়ব না। আমার বাবুটা নিজের পায়ে দাঁড়ালে একটা বিয়ে করাব। বাবুটাকে আর বউটাকে সাজ্জাদের বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি জামালপুর চলে যাব, আশেক মাহমুদ কলেজের পাশে আমার বাবার বাড়িতে। সে বাড়িতে এখনও পাঁচটা রুম ফাঁকা। আমার লাগবে মোট একটা।

একথাও অন্যদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়—বাপের বাড়িতে রুম বেশি, সেই বাহাদুরি দেখাচ্ছে, দে ঘাড় ধরে বের করে, জামালপুরেই থাকুক, এদিকে যেন না আসে।

পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তুলে সিকান্দর চাচার বড় মেয়ে পুতুল। সুদর্শন বাবু ভাইয়ের জন্য কিছুটা উতলা হয়ে ওঠে। বাবুভাই তখন আনন্দ মোহন কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার, সাবজেক্ট ইকনোমিক্স। পুতুল মমিনুন্নেসা গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার।

বাবুভাই তখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়, অনির্বাণ নাট্যগোষ্ঠীর নাটকগুলোর প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে।

বুলবুলি চাচী শুধু দোহাই দেন, আগে ভালো করে অনার্সটা পাস করে নে, তারপর যত ইচ্ছে অভিনয় করিস। তখন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের বাংলাদেশি ভার্সন চলছে, দর্শক টানার জন্য রোমিওর মুখে তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলা প্রেমের গান।

রোমিওর বন্ধু বেনভোলিও রোমিওর মা লেডি মন্তেগুকে জানান, তার ছেলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। কখনো তাকে দেখা যায় শহরের প্রান্তে গাছের ছায়ায় অবকাশের দিকে মুখ করে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছে। কেউ যদি তাকে দেখে ফেলে তাহলে স্থান বদল করে সে চলে যায় গভীর বনের ভেতর। কখনো কখনো রোমিওর অশ্রু ঘাসের উপর বিছিয়ে থাকা শিশিরকণার সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। কখনো সে রোদের আলো এড়িয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে কৃত্রিম অন্ধকারে কী সব লেখালেখি করে। সেখানে সংযুক্ত হয় বাংলাদেশি ভার্সন। তারপর কে জানে কোন তরুণীর উদ্দেশে সে গেয়ে ওঠে, আমার এই ভালোবাসা জানিগো তোমার ক্ষণিকের ভালোলাগা ফুল/ ক্ষণিক করবী মাঝে দিয়েছিলে ঠাঁই তারপর ভেঙে গেছে ভুল।/ ক্ষণিকের ভালোলাগা ফুল।

মন্তেগুদের শত্রু ক্যাপুলেত পরিবারের বাগানের সুড়ঙ্গপথে রোমিও প্রবেশ করে। তার ওপর নজর রাখছে বেনভোলিও আর মার্কোশিও। প্রেমোন্মাদ রোমিও দেয়াল টপকে জুলিয়েটের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছে। বেনভোলিও বলল, প্রেম বড় অন্ধ, প্রেম অন্ধকারে মানানসই, আমাদের উন্মাদটা তাই অন্ধকারের গহ্বরে। মার্কোশিও প্রতিবাদ করে, প্রেম কখনো অন্ধ হতে পারে না, তাহলে ভুল নিশানায় চলে যেত, কিন্তু এমন কখনো হয়নি। ঠিক তখনই তারা রোমিওর কণ্ঠে শুনতে পায় : ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি/ তোমারি দুয়ারে কুড়াতে এসেছি ভুলে//// যাওয়া মালাখানি।’

গানের পর কী যে তুমুল করতালি। টাউন হলের সেই প্রদর্শনীতে পুতুল ও মিতুলও ছিল। থ হয়ে থাকা পুতুল তালি দিতে ভুলে যায়—তার মনে হয় বাবুভাই এই গানটি শুধু তার জন্যই গেয়েছে।

ঠিক পরদিনই সিকান্দর চাচা আবিষ্কার করেন নিজের হাতে রান্না করা পায়েশ নিয়ে পুতুল ঢুকেছে বাবুর রুমে। তিনি আর কী দেখেছেন তিনিই জানেন।

বাবু তখন আর সাজ্জাদের ছেলে নয়। বাজে বুলবুলির বদমাশ ছেলেটার এত বড় দুঃসাহস—আমাদের পুতুলকে ফুসলে নিজের রুমে নিয়ে গেছে। এতটা ছাড় দেওয়া যায় না। পুতুলের মা আগাগোড়া নিশ্চুপ থাকে।

সিকান্দর চাচা পুতুলের মামাদের খবর দেন, তারা নান্দাইলের মাস্তান। ঠিক পরের সপ্তাহে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট শো শুরু হবার এক ঘণ্টা আগে থেকেই টাউন হলের পাশে তারা ওত পেতে ছিল। সিকান্দর চাচাও ছিলেন।

তিনিই দেখলেন বাবু আসছে। তিনি তার শালাদের বললেন, তোমাদের ভাগ্নির মান-ইজ্জতের ব্যাপার। বাজে মহিলার পোলাটারে জনমের শিক্ষা দেওয়া চাই।

‘ছয় আঙ্গুইল্যা’ নাসিম ও হাসিম এবং তাদের দুই বন্ধু যখন বাবুর দিকে এগোয়, সিকান্দর চাচা হঠাত্ দয়ালু হয়ে ওঠেন। তিনি কাতর কণ্ঠে তাদের বলেন, পোলাটার বাপ নাই, প্রাণে মারিস নারে।

সেদিন টাউন হলে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট শো না হওয়ায়, ভাঙচুর হয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, দর্শকদের একজন ছিলেন ময়মনসিংহ কালেক্টরেটের এনডিসি আতিক আহমেদ। প্রধান চরিত্র রোমিও নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরও হাজির না হওয়ায় শো বাতিল করতে হয়েছে। এনডিসি খবর পান যে রোমিও টাউন হলের কাছ থেকেই অপহূত হয়েছে। বাকিটুকু তিনিই সামলে নেন।

নান্দাইলের মাস্তানরা তাদের দুলাভাইর কথা রেখেছে। বেদম মারধর করে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থার চরপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপ্রান্তে সামনের দুই চাকাখোলা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের একটি পুরোনো বাসের ভেতর ফেলে রেখে যায়।

সে রাতের শেষ প্রহরে এনডিসির উদ্যোগেই অনুসন্ধান চালিয়ে পুরোনো বাস থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। চরপাড়ার একটি ক্লিনিকে একজন ডাক্তার তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, থ্যাঙ্কস গড, কোনো ফ্র্যাকচার হয়নি। ব্যথা নিরাময় করার আর ঘুমোনোর কিছু ওষুধ দিয়ে সাত দিন কমপ্লিট বেডরেস্ট লিখে ছেড়ে দিলেন।

বাবু পুলিশকে আক্রমণকারীদের কারো নামই বলতে পারল না।

অবশ্য বাসায় ফেরার পর বাবুভাই ফিসফিস করে বলল, শুরুতে এদের সাথে সিকান্দর চাচা ছিলেন। আমি দূর থেকে টাউন হলের কাছে পাঁচজনের একটি জটলা দেখেছি, লম্বা-চওড়া সিকান্দর চাচা তাদের মধ্যে ছিলেন। আমি ভেবেছিলাম পুতুল আবার শো দেখতে এল কি-না এটা পরীক্ষা করতে চাচা এসেছেন।

সিকান্দর চাচাই তার স্ত্রীকে বলেছেন, কুত্তার হাড্ডি, কিন্তু বাড়ি পড়লে কুত্তাও তো ঘেউ ঘেউ করে। মার সহ্য করার এমন ধৈর্য অবিশ্বাস্য। কেবল মার খেয়ে গেছে, বাধা দেয়নি, চেঁচিয়ে ওঠেনি। যতটুকু মারের সাথে সাথে ককানো। এটুকুই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে।

সব গোপন খবরই আমি পাই। বড় চাচার মেয়ে রূপা আমাকে সত্যটা বলে দেয়, সিকান্দর চাচার মেয়ে মিতুল তো সুযোগ পেলেই বাবার সব ষড়যন্ত্রের কথা আমাকে জানায়।

বুলবুলি চাচী গ্রামের বউদের মতো বিলাপ করা টাইপের নন। তিনি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোকে ওরা মেরে ফেলল না কেন, তাহলেও আমি বুঝতাম, যাক, তোকে আর কিছু করবে না। বাবুভাই মাকে বলল, আমার কিছুই হয়নি।

আমার বড় আপু বিবি হাফসা ফ্রিজ থেকে বরফচৌকো বের করে এটাকে আবার নরম পশমি রুমালে ঢেকে বাবুভাইর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোলা ও রক্তাভ অংশে চেপে ধরেছে। বলেছে, বাবুভাই, আপনি ওদের কিছু বললেন না?

আমার তো তেমন কিছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ধরে দেখ, আমার হাড় কত শক্ত।

যতক্ষণ বাবুর শরীরে বরফ চেপে ধরে রেখেছে, বিবি হাফসার চোখ থেকে ততক্ষণ নিঃশব্দে অশ্রু নেমে এসেছে।

বিবি হাফসা বলেছে, বাবুভাই, মানুষ এত পাষণ্ড হয়। বাবুভাই আমি আজ রাতে শেষ প্রহরে, সাড়ে তিনটার দিকে আপনার জন্য দু রাকাত নফল নামাজ পড়ব, আল্লাহ যেন আপনাকে দ্রুত সারিয়ে দেন। কালকের দিনটা রোজা রাখব। আর রোজাভাঙার আগে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাকে বলব, যারা আমার বাবুভাইকে এমনভাবে মেরেছে, হে আল্লাহ, হে পরোয়ারদিগার, আপনি তাদের ওপর গজব নাজেল করবেন। ফজরের আগের মোনাজাত আর ইফতারের আগের দোয়া আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা তাড়াতাড়ি কবুল করেন!

বাবুভাই বিবি আফসাকে বলল, তুই যে আমার কাছে এসেছিস, ওরা কেউ দেখেছে? ওরা আজেবাজে কথা বলবে।

না, আমি রান্নাঘর দিয়ে ঢুকেছি। দেখলই বা, আমি হুজুরের মেয়ে। আমাকে নিয়ে কথা বলা এত সহজ হবে না।

বললে ক্ষতি হবে।

বাবুভাই সেই ক্ষতিটাই তো আমি চাই। ওরা কিছু বললে আমার বিয়ের প্রস্তাব ভেঙে যাবে, এই তো? সেটা তো আমিও চাই।

পুতুল বাবুভাইকে দেখতে আসেনি। আসেনি মানে আসতে দেওয়া হয়নি। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে কোনো বাড়িতেই যেতে পারবে না। কিন্তু পুতুলের বাবা সিকান্দর চাচা এসে দেখে গেছেন। তাকে ঠিকমতো ঔষধ-পথ্য খেতে বলেছেন এবং চোখকান খোলা রেখে রাস্তায় চলাচল করতে বলেছেন। দিনকাল খারাপ, কখন কী হয় কে জানে। বাবুভাই বলবে কি বলবে না কতক্ষণ এই দ্বিধায় থেকে বলেই ফেলল, না চাচা, চোখ আর খোলা রাখতে চাই না। খোলা রাখলে দেখা যায়, দেখলে চেনা যায়।

সিকান্দর চাচা হঠাত্ ঘামতে শুরু করলেন।

বাবুভাই বলল, আমাকে মেরে ফেলার অন্য একজনই যথেষ্ট। পাঁচ জন হলে এতগুলো লোকের সময় নষ্ট।

সিকান্দর চাচা বললেন, পাঁচজন কীভাবে?

মুরুব্বিজন শুরুতে ছিলেন, চরপাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আর যাননি।

আমি তাহলে যাই বলে তিনি দ্রুত বাবুর কাছ থেকে সরে গেলেন।

যন্ত্রণার মধ্যেও বাবুভাই ফিক করে হেসে উঠল। বিবি হাফসাকে বলল, দিলাম সিকান্দর চাচার বাকি জীবনের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে।

বুলবুলি চাচী হুকুমজারি করলেন, বাবুকে আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।

বাবু বলল, তাহলে তো মা ওরা ঘরে এসে পেটাবে।

চাচী বললেন, আমি টাকা-পয়সা জড়ো করছি, আমি তোকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেবো, তোর ছোটমামার কাছে।

বাবু বলল, দেশ ছাড়ার জন্য আমি এয়ারপোর্টে ঢোকার সাথে সাথে আমার দুই চাচা তোমাকে বাড়িছাড়া করবে।

চাচী বললেন, সাজ্জাদ তো আমার অন্তরেই আছে। এই বাড়ি ধরে রেখে আর কী হবে? বাড়ি বেচার জন্য আমি শক্ত পার্টির খোঁজ করছি। ব্রিগেডিয়ার ফাত্তাহ এই এলাকায় বাড়ি করার জন্য জায়গা খুঁজছেন, চার-পাঁচ কাঠার প্লট। আমি ফোনে তার সাথে কথা বলেছি। আগে তোকে পাঠানোর ব্যাপারটা পাকাপাকি করে নিই।

চাচীই বললেন, অবশ্য অস্ট্রেলিয়াতে একটা সমস্যাও আছে। নুপুরটা তো একটা পাঙ্ক।

নুপুর, চাচীর ছোটভাই, মানে মণ্টু মামার মেয়ে। এই বাড়িতে একবার এসেছিল। পুরো মাথা শেইভ করা। প্রত্যেক মাসের তৃতীয় রোববার সকালে শেইভ করে থাকে। সেদিন শরীরের আরো একটা জায়গাতে শেইভ করে যা নুপুর অবলীলায় বলে ফেলল।

নুপুর এমন সব নোংরা নোংরা বিষয় নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে শুরু করল আমি তো লজ্জা পেলামই, বাবুভাই পর্যন্ত বিব্রত বোধ করতে শুরু করল।

নুপুর বাবুভাইকে বলল, রাতে আমি তোর সাথে ঘুমোবো। মেয়েদের সাথে শুলে আমার ঘুম আসে না।

বাবুভাই বলল, ইম্পসিবল।

নুপুর বলল, তুই মনে মনে ঠিকই চাচ্ছিস, কিন্তু মুখে না বলছিস। এর নামই হচ্ছে হিপোক্রেসি। তুই একটা হিপোক্রেট। বাংলাদেশের সব ছেলেই তাই। সেজন্যই আমি ড্যাডকে বলেছি, আই অ্যাম নট গোয়িং টু ম্যারি অ্যানি বাংলাদেশি বয়।

বাবুভাই’র মনে হলো এই উদ্ভট মেয়েটার সাথে কথায় মার খেয়ে যাচ্ছে, সুতরাং জোর দিয়েই বলল, আমি মুখে যা বলেছি, দ্যাটস কারেক্ট, ওটাই আমার মনের কথা।

নুপুর এবার নিজের দু হাত মাথার তালুতে রেখে বলল, ওহ মাই গড। এই অবস্থা—ইউ আর অ্যা গে? এটা কি তোর মা জানে?

বাবুভাই ধ্যাত্ বলে উঠে পড়ল।

নুপুর বলল, নাথিং রং বিয়িং অ্যা গে। সবাই আগে থেকে জেনে গেলে রিলেশনশিপ ইকুয়েশনগুলো রি-অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে। ইটস ওকে। ক্যানবেরাতে যে ছেলেটার ওপর আমার ক্রাশ ছিল, ওয়ান ফাইন মর্নিং শুনলাম, হি ইজ অ্যা গে।…

মানে সেই ছেলেটা আমাকে এ কথাটা বলেনি, বলেছে তার পার্টনার আলফ্রেড, আলফ্রেড ডগলাস। আমি খুব আপসেট হয়ে পড়েছিলাম।

নুপুর বাবুভাইকে আরো বলল, আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে একটা ধারণা নিয়ে এসেছি যে তুই আমাকে বিয়ে করতে ইন্টারেস্টেড। সেক্ষেত্রে পরে আপসেট না হয়ে আগেভাগে সব জেনে নেওয়া ভালো পার্টিকুলারলি তোমার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন। তুইও আমার যা যা জানতে চাস জিজ্ঞেস করতে পারিস। সেজন্যই আমাদের একসাথে কিছু সময় থাকা দরকার।

এসব কথার সবগুলোর মানেই আমি বুঝতে পেরেছি এমন নয়, তবে বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ আমি তা বুঝতে পেরেছি।

আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি বলে বাবু সে-ই যে বের হলো, পরদিন রাতেও ফেরেনি। টাউন হলে ‘টিপু সুলতানের তরবারি’ নাটকের রিহার্সেল দিয়েছে, রাতে ফরাস পেতে মশার কামড় খেতে খেতে ওখানেই ঘুমিয়েছে।

বাবু ফেরার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নুপুর ঢাকা রওয়ানা হয়ে গেল। তবে যাবার আগে নুপুর বাবুকে বলল, তুই দু দিন যে ছেলের সাথে ঘুমিয়েছিস তার একটি ছবি পাঠিয়ে দিস, হি মাস্ট বি ভেরি গুড লুকিং।

নুপুর বেরিয়ে যাবার পর বাবুভাইর স্বাভাবিক হতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। কমবয়সী একটা মেয়ের কাছে (কমবয়সী মানে এই নয় যে বয়সে আমার চেয়েও ছোট, বরং বড়) কোনো পুরুষমানুষকে এরকম নাস্তানাবুদ হতে দেখেনি। বাবুভাই তার মন্টু মামার মেয়ে নুপুর সম্পর্কে কয়েকটা কড়া শব্দ উচ্চারণ করল। শি ইজ ক্র্যাজি অ্যান্ড পার্ভার্ট।

আমি জিজ্ঞেস করি, মানে কী?

বড় হলে বুঝবি।

সেই নুপুরদের বাড়িতে বাবুভাই যাবে এটা বিশ্বাস করার মতো নয়।

তা-ই হলো। মন্টু মামা এবং বুলবুলি চাচী যতটা এগোলেন, বাবুভাই ঠিক ততটাই পিছিয়ে গেল।

বাবুভাই যে রাতে আবার লম্বা তলোয়ার হাতে টিপু সুলতান সেজে টাউন হলের মঞ্চে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতেই প্রবল হাততালি পড়ল, ঘটনাটা সে রাতেরই। সিকান্দর চাচার ছোট শালা ছয় আঙ্গুইল্যা নাসিমের লাশ পাওয়া গেল নান্দাইল থানার চণ্ডিপাশা ইউনিয়নের একটি খড়ের গাদার নিচে।

বাবুভাই বিবি হাফসাকে ডেকে ঘটনাটা বলল এবং ছয় আঙ্গুইল্যা নাসিমের মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করল।

বাবুভাই বলল, আমি তো নাসিমকে কখনো মেরে ফেলতে চাইনি, তোর নফল নামাজ, রোজা আর মোনাজাতের কারণেই এই গজব নাজেল হয়েছে। পুলিশ আমার কাছে এলে তোর নাম বলে দেবো।

আপ্লুত বিবি হাফসা আবার দুই হাত তুলে বলল, আল্লাহ তুমি ন্যায় বিচার করেছ। এজন্য আমি আরো দু রাকাত নফল নামাজ পড়ব।

বিবি হাফসা বলল, বাবুভাই দোহাই আল্লাহর, আমাকে শুধু এটুকু বলো, তুমি এর মধ্যে ছিলে না।

সত্যিই ছিলাম নারে। আমি তো টিপু সুলতান সেজে টিনের তরবারি হাতে মাঝরাত পর্যন্ত টাউন হলে। ভালোই হয়েছে। এসপি সাহেবের স্ত্রী নাটক দেখতে এসেছিলেন। কেউ আমার দিকে আঙুল তুললে আমি এসপি সাহেবের স্ত্রীকেই সাক্ষী মানব।

বিবি হাফসা বলল, বাবুভাই, তোমার এই নাটকটা আমাকে দেখাবে না?

দেখাতে তা চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই তো আবার হুজুরের মেয়ে।

সাত

আমার বয়স যখন দু বছর সাত মাস বাবা দ্বিনের রাস্তায় বাড়ি ছাড়েন। বাবার একজন দ্বিনি ভাই সাবেক ডিআইজি আনোয়ার হাশমত কাঁধে ঝোলা ব্যাগ তাতে বাঁধা একটি বদনা এবং একটি হারিক্যান, সকাল সকাল এসে হাজির হলেন। মা স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?

আনোয়ার হাশমত কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, মৌলানা ইমরান আলী ভাই সাহেবের জিনিসপত্রগুলো ফিরিয়ে দিতে এসেছি। এই ঝোলাতে কাপড়-চোপড়, তসবিই ও কয়েকটি কিতাব, সাথে আছে ভাইসাহেবের বদনা এবং হারিক্যান। ভাইসাহেব আল্লাহর পেয়ারা বান্দা, আমরা তার সমকক্ষ নই সেজন্য আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা ভাই সাহেবকে আগে তুলে নিয়েছেন।

মা’র পাশে এসে দাঁড়ায় বালিকা বিবি হাফসা। কিছু বুঝেই হোক কি না বুঝে, জিজ্ঞেস করল, আব্বু কোথায়?

ডিআইজি সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, আমি একটা পান খাব।

একমাত্র বড় চাচা তোফাজ্জল আলী পান খান। বিবি হাফসা তাকেই গিয়ে বলল, আব্বুকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন। সেজন্য একটা পান লাগবে।

বড়চাচাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি পান খাবেন?

জি আমি পান খাই।

তিনি বিবি হাফসাকে বললেন, তোমার চাচীর কাছ থেকে পান নিয়ে এসো।

ডিআইজি সাহেব ওপরের দিকে তাকিয়ে জিকির শুরু করলেন, আল্লাহু আল্লাহু। মা ঝোলা, বদনা ও হারিক্যান বড় চাচাকে দেখালেন। হাফসার আনা পান মুখে দিয়ে তিনি বড়চাচাকে বললেন, ইমরান আলী সাহেবের সাথে আপনার সম্পর্ক কী জানতে পারি।

বড়ভাই, আমি সবার বড়। আমি এ বাড়ির গার্ডিয়ান। ইমরান সবার ছোট, আমার চেয়ে উনিশ বছর নয় মাসের ছোট।

আলহামদুলিল্লাহ, ১৪ রবিউস সানি একান্তে বন্দেগির জন্য ইমরান আলী ভাইসাহেব একটি পাহাড় শিখরে আরোহন করেছিলেন। প্রায় পূর্ণচন্দ্র ছিল সে রাতে। আল্লাহতায়ালার অপূর্ব সৃষ্টি চাঁদের আলো ঝলমল করছিল। সম্ভবত আরো কিছু দেখার জন্য তিনি কদম বাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেখানে ছিল কেবল পত্রগুল্মের আস্তরণ। ভাইসাহেব সেখান থেকে খাদে পড়ে যান। ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নালিল্লাহে রাজিউন। সেখানেই তিনি এন্তেকাল করেছেন বলে আমাদের ধারণা।

বড়চাচা জিজ্ঞেস করলেন, লাশ পেয়েছেন?

জিনা, সেই খাদে নামা সম্ভব নয়।

তাহলে কাফন-দাফন ইত্যাদি কেমন করে হবে?

তিনি বললেন, সমুদ্রযাত্রায় এন্তেকাল করলে সমুদ্রই গোরস্থান। ভাই সাহেবের বেলায় গিরিখাদ। তিনি আমাদিগের অপেক্ষা উত্তম মানুষ, পেয়ারা বান্দাকে আল্লাহ আগেই নেন।

হঠাত্ বড়চাচা চেঁচিয়ে উঠলেন, সবকিছুর জন্য ইমরানের এই নাফরমান স্ত্রী রেবেকাই দায়ী। সে তার পুণ্যবান স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি। সে স্বামীর তরিকাও কবুল করেনি।

আমার মা দরজা বন্ধ করে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু কাঁদলেনও না। কেঁদেছে বিবি হাফসা। আমিও কাঁদিনি। আসলে কী হয়েছে সেটা সম্ভবত আমি বুঝিওনি।

ময়মনসিংহ আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক মা’র সাথে দেখা করে বাবার লিগাল মাইন্ড এবং প্লিডিং-এর অনেক প্রশংসা করেন এবং সমিতির পক্ষে দশ হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে যান।

সভাপতি ও সম্পাদক চলে যাবার পরপরই বড়চাচা মাকে আদেশ দেন এই টাকাটা দিয়ে একটা মিলাদের ব্যবস্থা করো। অন্যেরা নিমকি-জিলাপি খেয়ে ইমরানের জন্য দোয়া করুক।

মা বলল, তিনি এমনিতেই আল্লাহর পেয়ারাবান্দা। মানুষ খাইয়ে তাদের কাছ থেকে ইমরানের জন্য দোওয়া আদায় করার বদলে টাকাটা আমাদের বাচ্চাদের পড়াশোনার পেছনে খরচ করব।

বড়চাচা শুধু বেতমিজ আওরত বলে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। বিবি হাফসা হা করে তার চলে যাওয়া দেখল।

বাবা এমনিতেই সংসার থেকে সরে গিয়েছিলেন, মাকে সব সামলাতে হতো। কাজেই বাবার মৃত্যু যে বড় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছে এমন নয়। মা এতদিন শুধু স্কুলে পড়াতো, এখন বাসায়ও ট্যুশানি করে। বিবি হাফসা বাবার হারিকেনটা টেবিলের ঠিক মাঝখানে রাখে, ক’দিন পরপর কাপড় দিয়ে মুছে রাখে।

হারিকেনটা এখনো আছে। ওয়াঙ্গারি একদিন নিজের টাকায় ৫০০ এমএল কেরোসিন তেল ও একটি সলতে কিনে আনে। হারিকেন ধরিয়ে বাবার টেবিলের মাঝখানে রেখে বাল্বের সুইচ অফ করে দেয়। ভিন্ন ধরনের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ওয়াঙ্গারি বলল, আমি এখন ইমরান ও নিকোলাসের জন্য প্রার্থনা করব।

ওয়াঙ্গারি আমার একটা সাদা ওড়না তার কাঁধের উপর জামার দু পাশে ছড়িয়ে দিল। তাকে কমভেন্টের সিস্টার টেরেসার মতো দেখাচ্ছিল। সলতে আরো নামিয়ে দেয়। ওয়াঙ্গারি ঈশ্বর, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার কাছে নিকোলাস ও ইমরানের নাম ধরে প্রার্থনা করে।

পরদিন সকালে ওয়াঙ্গারি এক অদ্ভুত কথা শোনাল। গড ইন হেভেন তাকে বলেছে, ইমরান মরেনি।

আমি থ হয়ে জিজ্ঞেস করি, মানে?

মানে খুব সহজ। ইমরান সেই পাহাড়ের উপত্যকায় ঈশ্বরের শেপার্ডের দায়িত্ব পালন করছে।

শেপার্ড?

মানে মেষপালক। ইমরান সেখানে মেষপালন করছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা রোদ-বৃষ্টি, লু-হাওয়া কিংবা হিমবাহ কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না, গ্রেগরি পেকের মতো দেখতে সেই সুন্দর মানুষটিকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।

কনসেনট্রেট করো, তাহলে তুমিও দেখতে পাবে।

কিন্তু কীভাবে কনসেনট্রেট করব?

ওয়াঙ্গারি বলল, খুব সহজ, জাস্ট থিঙ্ক অব গড অর ইয়োর ড্যাড। ঈশ্বর কিংবা বাবার কথা ভাবো—ওই তো ইমরান, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

আমি জিজ্ঞেস করি, বাবার কি দাঁড়ি আছে?

হ, মুখভর্তি। ইমরানকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

আট

বড়চাচা তোফাজ্জল আলীর ছেলে টুকুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নতুন বাজারের এক ঘটক টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রায় ছ-মাস ধরে। প্রথমদিকে ছিল শুধু ময়মনসিংহ শহরের। জিলা স্কুল রোডের এক পাত্রীর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, খুকুর ভাই টুকু তো? তাহলে সমস্যা আছে। প্রথমত আমাকে ‘সিভিল সার্জনের কাউন্টার সাইন করা কোনো স্পেশালিস্ট ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখাতে হবে যে পাত্রের মৃগী রোগ নেই। দ্বিতীয়ত আমাকে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের আরো একটি সার্টিফিকেট দেখাতে হবে যাতে বলা হবে মৃগী বংশানুক্রমিক কোনো রোগ নয়।

এই দুটি সার্টিফিকেট পাবার পর আমি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসব।

খুকু ভাই-র শ্বশুর বাড়িতেও একটা টোকা দেওয়া হয়েছিল। রুমকি ভাবির বোন চুমকির জন্য।

রুমকি ভাবির বোনটা সম্ভবত একটু আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ভাবি তার মাকে বলেছেন, এক বাড়িতে বলদ একটিই যথেষ্ট। টুকুকে নিয়ে সংখ্যা বাড়ানোর দরকার নেই।

তাছাড়া এই দুজনের বাবা টি আলী একাত্তর সালে ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলোতে ঘনঘন আসাযাওয়া করতেন। গাঁটের পয়সা ভেঙে মেজর সাহেবকে পোলাও কোর্মা খাওয়াতেন। তবে এটা ঠিক তিনি শান্তি কিংবা রাজাকার বাহিনীতেও নাম লেখাননি। তবে ময়মনসিংহের হানাদারদের দোসর তালিকায় তার নাম আছে, কিন্তু তার ভায়রা এমপি হওয়ায় কেউ তাকে তেমন ঘাটায় না। মেয়ের বাবাই হোন কি ছেলের বাবা হানাদারের দোসরকে বেয়াই বানানো যাবে না—এমন গো ধরে কিন্তু কেউ বসেনি। কাজেই টুকু এ কারণে মার খেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করার কারণ নেই।

সর্বশেষ প্রস্তাবটি পাত্র সরাসরিই দিয়েছে :বুঝলি, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

টুকু ভাই, সিদ্ধান্তটা কি আজ নিলেন?

না গতকাল।

ঘটক যে এতদিন ধরে বউ খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেটা কি খুকু ভাইয়ের জন্যে, মানে রুমকি ভাবির সতীন খুঁজছে?

তখন মেয়ে খোঁজার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল বাবা।

বড়চাচীকে কাজে সাহায্য করার জন্য আরেকজন চাচী?

চুপ, বাজে কথা বলিস না। আমি সরাসরি তোকেই প্রস্তাব দিচ্ছি।

টুুকুভাই আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি। কিন্তু প্রথমত আপনি ভালো করেই জানেন আপনার বাবা জনাব তোফাজ্জল আলী মোটেই রাজি হবেন না। দ্বিতীয়ত নিজে কামাই করে বউ পালার মতো মুরোদ আপনার নেই। তৃতীয়ত আপনার পচা কান থেকে যখন পুঁজ বেরিয়ে বিছানা বালিশ নষ্ট করবে—এই দুর্গন্ধটা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না। চতুর্থত আমি এখনো এইটিন হইনি। যখন আপনার আর আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে, ময়মনসিংহ পৌরসভার ম্যাজিস্ট্রেট আর থানার দারোগা নাবালিকা বিয়ের অপরাধে আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে জেলখানায় নিয়ে যাবে। আমার মতো একটা সামান্য মেয়ের জন্য আপনার জেল হোক এটা আমি মোটেও চাই না।

টুকুভাই বললেন, বলে ভালোই করেছিস। তোর মা’র কারণে ইমরান চাচা পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। তোকে বিয়ে করলে আমাকে যে লাফিয়ে পড়ার আগে কত ওপরে উঠতে হবে আল্লাই জানে। তুই হচ্ছিস এই বাড়ির আসল খান্নাস। তোর মতো ছেড়িকে বিয়ে করতে টুকুর বয়েই গেছে, ভাবির বোন চুমকির জন্যই আমাকে রাজি করাতে পারেনি।

ঠিক আছে, এই কথাটা রুমকি ভাবিকে আমি কালই বলছি।

যা যা বলিস। এই বাড়িতে রুমকি ভাবি, বুলবুলি চাচী আর তোর মা’র চরিত্র খারাপ।

আমি সাথে সাথে গ্লাসভর্তি পানি তার গায়ে ছুড়ে দিয়ে বলি, তোর মতো একটা নোংরা ছেলে যে মহিলা জন্ম দিতে পেরেছে তার চরিত্র আরো বেশি খারাপ।

টুকু আমার গালে চড় বসিয়ে দিতেই আমি নাটকীয়ভাবে চিত্কার করে উঠি, বড়চাচা, রুমকি ভাবি, টুকু আমার গায়ে হাত দিয়েছে। খুকুভাই টুকুকে ধরেন, আমার গায়ে হাত দিয়েছে।

বড়চাচা দ্রুত বাইরে এসে দেখেন টুকু পালাচ্ছে। তিনি বারবার আমাকে বললেন, যাক মা, কাউকে বলিস না, আমি বিচার করব।

আমার মা তো স্কুলে। বড়চাচী এসে পারলে আমার পায়ে ধরেন। বড়চাচা মসজিদ কমিটির সভাপতি হবার জন্য নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। তার ছেলের কেলেঙ্কারির কথা তার বিরোধীরা যে খুব খাবে এটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে।

আকস্মিকভাবে খুকুভাই এসে আমার পক্ষ নিল, নিজের বাবাকে বকাঝকা করল, বলল, আপনার প্রশ্রয়ে টুকু এসব করছে, আমাদের রুমকির গায়েও হাত দিয়েছে।

আসলে আমার ক্রোধ তো বড়চাচার ওপর। বুলবুলি চাচীকে তো বলেছেনই, আমার মাকেও বলেছেন, বাজারের মেয়েমানুষ।

এবার আমিই বললাম, ঠিক আছে আছরের নামাজের পর আমিই মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেব আর মুসল্লিদের বলব।

বিচলিত বড়চাচা আমার কাছে এসে বললেন, আমি তোকে দশ হাজার টাকা নগদ দিচ্ছি। টুকুরও বিচার করব, তুই মসজিদে যাসনে।

আমি বললাম, আপনি যে আমার মুখ বন্ধ করার জন্য দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন এটাও বলব।

ততক্ষণে সিকান্দর চাচাও হাজির। এই প্রথম তাকে দেখলাম বড়চাচার মুখের ওপর কথা বলতে : কী ভাইজান, যেখানে ইমরানের এতিম বাচ্চাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার, সেখানে যদি বেড়াই খেত খায় তাহলে মসজিদ কমিটির সভাপতি হয়ে আপনি কী খেদমত করবেন?

হঠাত্ পরিস্থিতি থমথমে হয়ে গেল। টুকুর দেখা নেই অনেকদিন। রূপা টুকুদের ছোট বোন, আমারও তিন মাসের ছোট, আমার সাথে কথা হলেই ভেতরের খবরগুলো দেয় আর বলে, কসম আল্লার কেউ যেন না জানে। আমিও কসম কাটি এবং বলি, তোর কথা কেউ কোনোদিন জানবে না। রূপা জানায় : টুকুভাই বর্তমানে সুনামগঞ্জে বড়চাচার এক বন্ধুর বাড়িতে বসবাস করছে। থাকা খাওয়ার খরচ বাদে বন্ধুকে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা এবং হাতখরচ বাবদ টুকুভাইকে মাসে এক হাজার টাকা পাঠানো হচ্ছে। বড়চাচা মনে করে সাজ্জাদ চাচার ছেলে বাবুভাই আমাকে বেয়াদবি করার সাহস জুগিয়েছে। সেজন্যই বাবুকে তিনি জনমের শিক্ষা দেবার পরিকল্পনা করেছেন। আমি মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেব ও মুসল্লিদের কিছু না বলায় তিনি সন্তুষ্ট। তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

টুকুভাইকে আমি সেই কথাটাই বলেছিলাম : বাবুভাইর ঘরে নষ্ট পিস্তল লুকিয়ে ওসি সাহেবকে ফোর্স নিয়ে আসতে কে ফোন দিয়েছিল—এটা এ বাড়ির নাবালক শিশুরাও জানে।

আমি চোখে দেখিনি। কিন্তু এটা ওটা শুনে আমার মনে হয়েছে পিস্তল এনেছিলেন সিকান্দর চাচা সম্ভবত তার শালাদের কাছ থেকে, বাবুভাইর বিছানার মাথার কাছে তোশকের নিচে পলিথিনে ভরা পিস্তলটা রেখে এসেছেন খুকুভাই আর ফোর্স নিয়ে আসতে থানায় ওসিকে ফোন করেছেন পরিবারের প্রধান মুরুব্বি তোফাজ্জল আলী। তিনি ওসিকে অনুরোধ করেছেন ইনফর্মারের নামটা যেন ডিসক্লোজ না করা হয়। বলতে হবে এর সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ইন্টিলিজেন্স। আমি আরো নিশ্চিত হয়েছি খুকুভাই আর তার বাবার ঝগড়ার একটি অংশ শুনে।

তোফাজ্জল আলী ছেলেকে বলছেন, না পারিস দুটো টাকা কামাই করতে, না পারিস গাড়িটা চালাতে। সংসার বড় হলে যে খরচ বাড়ে সেই জ্ঞান নেই তোর?

খুকুভাই বললেন, বিয়ের পর আমি কি আঙুল চুষব নাকি। সংসার তো বাড়বেই, আমি কি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, না আপনি বাধ্য করেছেন? আপনি যদি আমার সাথে তেড়িবেড়ি করেন আপনার মুখোশটাও আমি খুলে ফেলব। আপনি আমাকে দিয়ে একটা অন্যায় কাজ করিয়ে বাবুকে আর্মস কেইসে ফাঁসিয়েছেন।

তোফাজ্জল আলী তার সর্বশক্তি দিয়ে চিত্কার করে উঠলেন, খামোশ।

খুকুভাই সরে পড়লেন। আমি দেখলাম বড়চাচা বুক চেপে প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসলেন, তারপর আস্তে করে ডান কাতে শুয়ে পা দুটো ছড়িয়ে দিলেন।

বড়চাচার কী হয়েছে? বারবার এই কথাটি বলতে বলতে কাছে গিয়ে দেখি তার মুখ দিয়ে কেমন ফেনা বের হচ্ছে।

আমি চিত্কার করতে থাকি, বড়চাচী, খুকুভাই বড়চাচার দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

খুকুভাই দূর থেকে বললেন, বেরোতে দে।

শেষ পর্যন্ত সিকান্দর চাচা কমিউনিটি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স আনালেন, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে করলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই হবে উত্তম স্থান।

বড়চাচা সে-যাত্রা মারা যাননি। উনিশ দিন পর যখন ফিরে এলেন, তখন তার হার্টে রিং।

বাবার অসুস্থতা টুকুভাইকে ঢাকা আসার সুযোগ করে দিয়েছে। তাকে বাবার সাথে সার্বক্ষণিক থাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। টুকুভাই দাড়ি রেখেছেন। আমি দিনে একবার সকালের দিকে বড়চাচাকে দেখতে যাই। কোনোদিন সাথে নিই কাসুন্দিমাখা আনারস, কোনোদিন আমার নিজের হাতে করা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কোনোদিন একটি কি দুটি তালের শাঁস।

টুকুভাই আঁড় চোখে আমার দিকে তাকান। একদিন বড়চাচার রুমে ঢোকার সময় টুকু ভাই বললেন, আমার তো অনেক শাস্তি হয়েছে, আর কত?

আমি চুপ থাকি।

সুনামগঞ্জ টুকুভাইকে অনেক বদলে দিয়েছে। টুকুভাই সারাদিনই গুনগুন করে গান করেন। বড়চাচা বাইরে কোথাও গেলে গলা খুলে গান গান। এসব গান আমি আগে কখনো শুনিনি। যেমন :

স্টিমারে কি আজব কল

উপরতলায় ইঞ্জিন আর নিচতলাতে ছাড়ে জল।

দুই ধারে দুই পাখা ছিল, মাঝখানে ইঞ্জিন বসাইল রে

কয়লা দিলে চলে ভালো, না দিলে সে হয় দুর্বল।

….

যাইতে চাইলে স্টিমারে, দরে না টিকেট মাস্টারে রে

দুর্বিন শাহ কুমতির ফেরে হারাইল পথের সম্বল!

এরকম আরো গান। রূপা বলেছে, টুকুভাই মনে হয় দিওয়ানা হয়ে গেছে।

টুকুভাই দুর্বিন শাহর এক সাগরেদ ফকির মোহাম্মদ সাদিকের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে একটা দোতারা কিনেছেন, তার কাছ থেকে দোতারার তালিমও নিয়েছেন। তার সাথে দুর্বিন শাহর বাড়ি ছাতক থানার নোয়ারাই গ্রামেও গিয়েছেন।

বড়চাচা একদিন আবিষ্কার করলেন, টুকু ভাই গাঁজা খান। তিনি বললেন, আমি গন্ধেই টের পাই, পোড়া কাঁচা ঘাসের গন্ধ।

বড়চাচা বকাবকি শুরু করলেন। টুকুভাই দোতারা হাতে নিয়ে একবস্ত্রে আবার বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হলেন। বললেন, আব্বার ধারণা ভুল, খোদার দুনিয়া অনেক বড়।

বড়চাচী তাকে আটকালেন।

সিকান্দর চাচা এসে বললেন, বাসায় থেকে গাঁজা খায় এটা তো ভালো; বাইরে গিয়ে যখন সাদাগুঁড়া ধরবে তখন কী করবেন?

সাদাগুঁড়া কী?

হেরোইন।

বড়চাচা বাড়িতে, এর মধ্যেই টুকুভাই আমাকে বললেন, শিল্পীকে গানের অনুরোধ জানাতে হয়। তোমার কোনো অনুরোধ নেই?

টুকুভাই আমাকে তুই বলতেন, এখন বললেন তুমি। টুকুভাইর কানে পচা গন্ধ ছিল, এখন গলায় মিষ্টি সুর। টুকুভাই গান গাইবেন এটা তো কখনো ভাবিনি। বললাম, টুকুভাই একটা গান শোনান।

আমার সাথে সিকান্দর চাচার মেয়ে পুতুল আর মিতুল।

টুকু ভাই শুরু করলেন :

আমার অন্তরায় আমার কলিজায়

প্রেমশেল বিঁধিল গো, বুক ছেদে পিঠ পার হইল

মারিয়া ভুজঙ্গ তীর কলিজা করিল চৌচির

কেমনে শিকারি তীর মারিল গো

বিষ মাখিয়া তীরের মুখে, মারিল তীর আমার বুকে

দেহ থুইয়া প্রাণ লইয়া গেল গো

নয়

পুলিশ অস্ত্র পেল বাবুভাইর শিয়র বরাবর তোষকের নিচে।

বড়চাচাকে বলে গেল, আসামি বাড়ি এলেই আমাদের খবর দেবেন। আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে বিরোধী দলের সাথে বৈঠক করে বাবুমিয়া নাশকতামূলক কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের প্রতিমন্ত্রী সাহেবের গাড়িতে কে বা কারা গুলি করেছিল। আমরা বাবুমিয়াকে সন্দেহ করি।

বাবুভাই সে-রাতে আর ফেরেনি। পরের রাতেও না। পুলিশ রেইড করেছিল। বুলবুলি চাচীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। ব্যাটন দিয়ে তার পেটে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, এই পেটে এমন অস্ত্রবাজ ছেলে ধরলেন কেমন করে?

চাচী বললেন, তবু ভালো যে আপনাদের মতো পুলিশ হয়নি।

দারোগা সাহেব বললেন, দেখলে মাস্টরনির তেজ!

বুলবুলি চাচী সাজ্জাদ চাচার ভাগের জমি ও বাড়ি বেচার চেষ্টা করছেন—এটা বড়চাচার কানে আসতেই তিনি এবং সিকান্দর চাচা দুজনেই সই করে সিভিল কোর্টে একটি প্রিএমশন মামলা করে দিলেন। তার মানে এ জমি বিক্রি হলে আগে কেনার অধিকার তাদের।

বুলবুলি চাচী ও বাবুভাইকে বাস্তুচ্যুত করাই তাদের লক্ষ্য। তারপর দু ভাই জমিটা ভাগাভাগি করে নিয়ে নেবেন। বাবুকে একবার লম্বা সময়ের জন্য জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারলে কাজটা সহজ হবে।

নিজেদের ঘাড়ে ঝামেলা না নিয়ে পুলিশকে দিয়ে একটা অস্ত্র মামলা করিয়ে দিতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে। তা-ই করেছেন।

পরদিন সন্ধ্যায় বোরকাপরা এক ভদ্রমহিলা বুলবুলি চাচীর সাথে দেখা করতে এলেন। চাচী তখন চরপাড়ায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যাবিনে তার মায়ের সাথে। তিনি দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা পিছলে পড়ে গেছেন, কোমরের হাড় নড়ে গেছে। বড় ব্যান্ডেজ দিয়ে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

আমি বোরকাপরা মহিলাকে বলি, কাল সকালে আসুন, চাচী কখন ফেরেন ঠিক নেই।

তিনি বললেন, অসুবিধে নেই, আমি অপেক্ষা করতে পারব।

তাহলে ঘরে এসে বসুন।

যখন বুলবুলি চাচী বাসায় থাকেন না, বাবুভাইদের বাসার অনেক সিদ্ধান্ত আমিই নিই।

আমি জিজ্ঞেস করি, চা খাবেন?

তিনি বললেন, চায়ে ঘন দুধ আর দু চামচ চিনি দেবে।

কী আশ্চর্য, এমন চা তো আমি একজনকেই করে দিই। আরো একজন বেড়ে গেল নাকি?

আমি চা নিয়ে আসি। তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিতে আমার চেনা আঙুলগুলোকে দেখে বলি, দুধটা তেমন ঘন নয়, চাটা ভালো হয়নি বাবুভাই।

টাউন হলে একটা নাটকে তুমি এই বোরকাটা পরেই না রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক করেছিলে? শোন বাবুভাই, জীবনটা কিন্তু নাটক নয়।

তুই এত পাকা কথা বলতে শিখেছিস? তোর বয়স কত? নাকে টিপলে এখনো তো মুখ দিয়ে দুধ বেরোবে।

বাবুভাই মুখের সামনের পর্দাটা মাথার ওপর ঠেলে দিল। তারপর বলল, বহু কষ্ট করে জোগাড় করা পিস্তলটা নিয়ে গেল!

তার মানে? ঘটনা সত্য! আমি তো জানি খুকুভাই তোমার রুমে পিস্তল রেখে গেছে আর বড়চাচা ফোর্স নিয়ে আসার জন্য ওসি সাহেবকে ফোন করেছে। তার মানে এটা তোমারই।

তুই কি পিস্তল দেখেছিস?

হ্যাঁ পুলিশের হাতে ছিল। এটা যে নিচ্ছে একটা কাগজে বড়চাচার সইও নিয়েছে। এর নাম সিজার লিস্ট।

বাবুভাই নিজে উঠে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে তার রুমের দিকে গেল। আমি তাকে অনুসরণ করি।

বাবুভাই ঘরের ভেতরটা পাশের ঘরের পার্টিশনের ওপর দিয়ে আসা আলোতে একটু দেখে নিল। তার চোখ পড়ল ওয়েলিংটন স্যু জোড়ার ওপর, আমরা এগুলোকে বলি গামবুট। পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, বর্ষাকালে কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো কোট পরে আমার বাবা অ্যাডভোকেট ইমরান আলী এই জুতোগুলো পরে কোর্টে যেতেন। আমার মা বাবুভাইকে জিজ্ঞেস করেছে, তোর চাচার কোনো কিছু তোর লাগবে? লাগলে নিয়ে যা। বাবুভাই শুধু এই বুটজোড়া নিয়েছে।

বাবুভাই বামপায়ের বুটের ভেতর হাত ঢোকাল। বের করে নিয়ে এল কালো রঙের পিস্তল। তার চোখেমুখে আনন্দের ছোঁয়া।

কিন্তু ওরা তো পেয়েছে তোশকের নিচে।

ততক্ষণ দরজায় বেল বাজে। বুলবুলি চাচী চলে এসেছেন।

আমি বলি, চাচী দেখুন।

বোরকা ঢাকা মহিলা চোখের সামনের পর্দা সরায়।

তিনি দ্রুত আলমারি খুলে একমুঠো টাকা এনে দেন এবং বলেন, যেকোনো সময় পুলিশ আসতে পারে। ময়মনসিংহ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যা। ফোন করিস না। এখন ট্র্যাক করার যন্ত্র পুলিশের হাতে আছে। তুই তো জেলেই মরবি, আমাদেরও সাথে নেবে।

বুলবুলি চাচী একটি পলিথিন ব্যাগে দুটো মণ্ডা আর একটি আপেল ঢুকিয়ে ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি চলে যা। টি আলীদের চোখে পড়লে এখনই সর্বনাশা কাজটা করে ফেলবে।

টি আলী বা অন্য কেউ আছে কি-না দেখার জন্য আমি বাবুভাইদের ঘর থেকে বের হয়ে চারদিকটা একটু রেকি করে আসি। কাউকেই চোখে পড়ল না, রাতও তো এগারোটা ছাড়িয়ে গেছে। টুকুভাইও নেই, আজ সকালেই চলে গেছেন সুনামগঞ্জে।

আমি ফিরে আসি। বুলবুলি চাচী বললেন, এখন চলে যা।

কিন্তু আমি তো চাই না বাবুভাই চলে যাক। আমি ইদানীং বিশ্বাসযোগ্য করে মিথ্যে কথা বলতে পারি। বললাম, সমস্যা আছে, সিকান্দর চাচা বাইরে। বাবুভাই জিজ্ঞেস করল, মা কালী কী করছে?

ওয়াঙ্গারি?

ও থাকতে তোকে কীভাবে কালী বলি?

আমার মাথায় একটা নতুন চিন্তা এল।

আমি আবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে আমাদের নিজেদের রান্নাঘরের দরজা খুলি। এই দরজা দিয়ে ঢুকে মূল ঘরের ভেতর দিয়ে আমাদের ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে বাবার চেম্বারে দরজা দিয়ে বেরোলে বরং বেশি নিরাপদ।

আমি বাবুভাইর হাত ধরে টানি। বাবুভাই দ্রুত বুলবুলি চাচীর পা ছোঁয়। চাচী বাবুভাইর মাথাটা নিজের পেটের ওপর চেপে ধরে একটু পরেই ফি আমানিল্লাহ বলে ছেড়ে দেয়।

আমাদের ঘরে সবাই ঘুমে। বাবুভাইকে একটানে রান্নাঘরে ঢোকাই, দরজা বন্ধ করতে করতে বলি, তুমি আজকের রাতটা ওয়াঙ্গারির সাথে ঘুমোও।

ইম্পসিবল।

বাবুভাইকে ঢোকানোর পর মনে হলো ভুল হয়ে গেছে। চেম্বারের দরজা তো বাইরে থেকে লক করা, দরজায় ভারী আলমারি।

তবুও আমি করিডোর দিয়ে বাবুভাইকে এনে অনেকটাই জোর করে ঠেলে বিছানায় বসাই এবং বলি, ওয়াঙ্গারি কুড়িগ্রাম চলে গেছে। আমি তোমাকে এখানে লুকিয়ে রাখব। তোমার কোনো সমস্যা হবে না। কেউ জানবে না, এমনকি বুলবুলি চাচীও না। শুধু আমার মা জানবে।

এই রুমে এখন আলো জ্বলে, ওয়াঙ্গারি ছিল, এটা বড়চাচাও জানেন। আমি এখানেই পড়াশোনা করি।

তবু কেবল ঢিম লাইটটাই জ্বাললাম।

দেখি কেমন ক্লান্ত চোখে বাবুভাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে বলল, না, দরজা খোল, আমি বেরোই।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে বাবুভাই ঘুমিয়ে পড়ল। পা-টা ঝুলছে খাটের বাইরে, শরীরটা বিছানায়।

পায়ে কাপড়ের জুতো। আমি জুতো খুলি, মোজাও ছিল, মোজাতে বাজে গন্ধ। আমি খানিকটা উঁচিয়ে খানিকটা ঠেলে পা-জোড়া বিছানায় তুলে দিই।

বাথরুমে এসে মোজাজোড়াতে সাবান লাগিয়ে ধুই, চিপে পানি ছাড়িয়ে চেয়ারের হাতলে ছড়িয়ে দিই। ওয়াঙ্গারির জন্য কেনা কম্বলটা পায়ের উপর বিছিয়ে দিই। মাথার নিচে একটা বালিশ দেওয়া দরকার, কিন্তু দিতে গেলে যদি ঘুম ভেঙে যায়, সে-জন্যে আর এগোই নি। মাঝারি স্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে দিই, একটু ঠাণ্ডায় ঘুমটা ভালো হবে।

আমি জানি যদি এ অবস্থায় বাবুভাই ধরা পড়ে যায়, তার দায় আমারই, আমিই তাকে আটকে রেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, বাবুভাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতেই আছে। পুলিশ এ রুমে ঢুকতে যাবে না। আমি ঢুকতে দেবো না।

ভোর পাঁচটা থেকে কিছুক্ষণ পরপর আমি এসে দেখে যাচ্ছি বাবুভাই জেগেছে না তখনও ঘুমিয়ে।

মা বেরিয়েছে সাড়ে আটটায়। মৃত হুজুরের স্ত্রীকে বুলবুলি চাচীই আবার ঘর থেকে বের করেছেন। ধমকের স্বরে বলেছে, শোনো রেবেকা, ঘরে বসে থাকলে ফেরেশতা এসে তোমাকে খাবার দিয়ে যাবে না। তুমি কি হাঁড়ি-বাসন মাজার জন্য বিএ পাস করেছ?

স্কুলে চাকরিটা বুলবুলি চাচীই পাইয়ে দিয়েছেন। স্কুলের সভাপতি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা বারের সভাপতি ও সম্পাদককে দিয়ে অনুরোধ করিয়ে মন্ত্রীর একটি সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে তার জন্য চাকরিটা নিশ্চিত করেছেন। আমার মাও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, মাকে দেখে আমিও।

আমি আলমারি খুলে একটি নতুন তোয়ালে, বাবার একটি পাজামা ও একটি পাঞ্জাবি বের করি। দুটো ডিম একত্রে ফেটে সাথে একটু দুধ মিশিয়ে তাওয়ায় ভাজি।

মা’র বানানো রুটি তাওয়ার তেলে ভেজে নিই। ঘন দুধ ও দু চামচ চিনি দিয়ে চা বানাই। ঘরে ঢোকার দরজা বন্ধ করে চা ছাড়া আর সব নিয়ে বাবুভাইর কাছে আসি। একটা টুথব্রাশে খানিকটা পেস্টও।

বাবুভাই উঠেনি। এত ঘুম কেন? আমি নাকের সামনে হাত রেখে নিঃশ্বাস পড়ছে কি-না পরীক্ষা করি।

বাবুভাই বেঁচে আছেন। আমি ডাকি, বাবুভাই।

চোখ খুলে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমি কোথায়?

এখানে, ওয়াঙ্গারির রুমে।

বাবুভাই উঠে বসে, বোরকাটা তখনও পরনেই।

ডান হাত সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে এনে কাঁধের কাছে বাম হাতের পেছন দিকটা দেখায়। বলে, প্রচণ্ড ব্যথা, তখন বুঝিনি। এখন মনে হচ্ছে ফ্রাকচার থাকতে পারে। নিজে নিজেই ব্যথার আর ঘুমের ওষুধ খায়।

আমি টুথব্রাশটা এগিয়ে দিই।

জিজ্ঞেস করে, ব্রাশটা কার?

আমাদের মতো ফ্যামিলিতে অতিথির জন্য নতুন ব্রাশ থাকবে—এটা না হবারই কথা।

আমি বলি, আমার। আমারটাতে ব্রাশ করতে তোমার ঘেন্না লাগবে, বাবুই?

না।

বাবুভাই ব্রাশ করতে শুরু করে। আমি অনেকদিন পর বাবুই বললাম।

আমি তার বোরকাটা ভাঁজ করে রাখি।

বাবুভাই বাথরুম সেরে আসে। আমি তাকে ডিমরুটি খাওয়াই। ঠিক রুটি নয়, পরোটা। তারপর চা আনতে যাবার আগে বললাম, তোমার জন্য তিন মিনিট সময়। সবগুলো কাপড় খুলে বাথরুমে রেখে বাবার এই কাপড়গুলো পরে এসো।

কিন্তু আমাকে যে যেতে হবে।

রাতের আগে বেরোনো নিরাপদ হবে না। ততক্ষণে তোমারগুলোও শুকিয়ে যাবে। চিন্তা করো না।

বাবুভাই বলল, আমার তো চলে যাবার কথা ছিল। তাহলে আমি রয়ে গেলাম কেমন করে?

তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তোমার সাইজের একটা ঘুমন্ত মানুষকে তো আমি ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় ফেলে আসতে পারি না।

আমি যে এখানে আছি কে কে জানে?

শুধু আমি। আমার মা এখনো জানে না।

আমার মা?

না। সকালেই চাচী আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, সব ঠিক আছে?

আমি বলেছি, হ্যাঁ। আর হ্যাঁ মানে তুমি ঠিকঠাকভাবে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছ। এখন যদি চাচী জানেন তুমি এখানে তাহলে আমাকে মিথ্যেবাদী ভাববেন।

আচ্ছা ঠিক আছে, দরজা জানালা খুলিস না।

তুমি আমাকে বোকা ভাবছ কেন?

জবাব না দিয়ে বাবুভাই আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে নাও, বলে আমি কিচেনে চলে এলাম। পানি ফুটছে, দুধটাও গরম! আমরা এক কৌটা মাঝারি সাইজের নেসক্যাফে ক্লাসিক কফি কিনেছি। আমি গাঢ় দুধ, আড়াই চামচ চিনি আর দেড় চামচ কফি দিয়ে মিষ্টি করে কফি বানালাম। দ্রুত বেডরুমে গিয়ে আলমারি খুলে হট ওয়াটার ব্যাগটা এনে ফুটন্ত বাকি পানিটুকু তাতে ঢাললাম।

বাবুভাই বলল, চা-টা ভালো হয়েছে।

তুমি জীবনে কফি খাওনি? এটা কফি।

বিছানায় আমি বাবুভাইর পেছন দিকটাকে বসে হট ওয়াটার ব্যাগটা তার বাম কাঁধের উপর চেপে ধরি।

অন্য সময় হলে বলত, তুই আমার পেছনে কী করিস? ভাগ এখান থেকে? গরম লাগাচ্ছিস যে? আমাকে পুড়িয়ে মারবি নাকি?

কিন্তু আজ বলল, খুব আরাম লাগছে। রাতে একবার দিয়ে দিবি?

তুমি থাকলে তিন বার দিয়ে দেবো।

সরি আমাকে চলে যেতে হবে।

কোথায়?

জানি না, আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়তে চাই না। পুলিশ খুব মারধোর করে।

অসুবিধে কী, তুমি তো মারধোরে ব্যথা পাও না। নাসিম আর হাসিম যে তোমাকে মেরেছিল। তখন তো ব্যথা পাওনি।

বাবুই বলে, বিবি হাফসা ছয় আঙুইল্যা নাসিমকে মেরে ফেলেছে।

আমি বলি ধ্যাত্, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। হাফসা আপু জীবনে কোনোদিন নাসিমকে দেখেও নি।

হত্যা করার জন্য কাউকে দেখার প্রয়োজন হয় না। হিটলার যে এত মানুষ মেরেছে, তাদের কারো সাথেই তার সামনা-সামনি দেখা হয়নি। বিবি হাফসা আল্লাহর কাছে ওদের জন্য গজব চেয়েছে। আল্লাহ তা-ই কবুল করেছেন। এটা তো মার খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি ডেঞ্জারাস।

আমি এই বাথরুমেই কাপড়গুলোতে সাবান লাগিয়ে ভালো করে কেচে ধুয়ে, চিপে ঘরের ভেতর টানানো একটা দড়িতে ছড়িয়ে দিলাম। তখন মনে হলো আন্ডারওয়্যার তো ধুইনি। আমি বললাম, বাবুভাই আন্ডারওয়্যারটা দিলে না।

এটা তো আরো বেশি নোংরা হবার কথা।

হোক।

আমি বললাম, বাবুভাই তোমার দুপুরের খাওয়া পেতে দেরি হবে। আমি এখনই স্কুলে যাচ্ছি। এগারটা থেকে চারটা। বাসায় কেউ নেই। আপু শ্বশুর বাড়ি। আহমেদ বেনবেল্লা আর ইয়াসির আরাফাত ফুলবাড়িয়া মাদ্রাসায়। মা স্কুলে। আমি বাইরে থেকে তালা মেরে যাচ্ছি। তুমি ঘুমোতে পারো, বাবার আলমারি থেকে বই বের করে পড়তে পারো, চুপি চুপি আমার রুমে গিয়েও বই নিয়ে আসতে পারো। বেশি খিদে লাগলে ফ্রিজ থেকে কিছু বের করে খেয়ো। কোনো চিন্তা করো না।

আমি স্কুল ড্রেস পরে বেরিয়ে যাই। আমরা ক্লাস টেন। বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্লাস আমাদেরটা। জুনিয়র মেয়েরা খুব সমীহ করে।

ক্লাস ভালোই হয়েছে। ইন্টারস্কুল ডিবেট কম্পিটিশনে আমরা নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের বিরুদ্ধে লড়ব। বিটিভিতে দেখাবে। আমরা কেউই বিটিভি দেখি না, বিটিভির খবর তো নয়ই। কিন্তু ডিবেট তো দেখতে হবে। বিদ্যাময়ী স্কুল লড়ছে—এটা একটা কারণ, কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ চার জনের ডিবেট টিমে আমি হলাম এক্সট্রা। এগারো জনের ক্রিকেট দল যখন বিদেশ যায় টুয়েলফথ প্লেয়ারকেও সাথে নেয়। যদি কোনো কারণে একজনের মাথা ভো ভো করে ঘুরতে থাকে, কিংবা পেট ভয়ংকর খারাপ কিংবা কব্জিতে চোট লাগে তখন তার ডাক পড়ে।

আমাদের টিম লিডার নূরে আফসান, টিম মেম্বার তারই বোন নূরে ফারজান, পার্বতী গৃহ ঠাকুরতা এবং রায়হানা চৌধুরী। যদি কোনো সাধারণ কারণ কিংবা মেয়েলি কারণে একজন কেউ ডায়াস পর্যন্ত না যেতে পারে তবেই আমার চান্স। বিতর্কের বিষয় এখনো জানায়নি। ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে জানাবে যাতে বাইরে থেকে আমরা বেশি পণ্ডিতি না করতে পারি। এটা ঠিক পণ্ডিতি ধাঁচের বক্তব্য খুব বোরিং হয়। বোরিং শব্দটার বাংলা কী ঠিক মনে করতে পারছি না।

পৌনে চারটায় ছুটি হলো। মা বললেন, তুই একা চলে যা। টিচারদের কাউন্সিলের মিটিং দিয়েছে। আমি ছ’টার আগে বের হতে পারব না। আসার সময় মুরগি নিয়ে আসব। রাতে রান্না করব।

দশ

বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে গুলকিবাড়ি-বহুদূরের পথ নয়। কড়া রোদ ও বৃষ্টি না থাকলে আমরা রিকশা নিই না। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতেও না। আমাদের বাবা নেই। অবশ্য থাকা অবস্থায়ও শেষদিকে কামাই করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার কথা একটাই—আগামীকালের কথা ভাবার মতো দুঃসাহস তুমি কোথায় পেলে? তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তুমি যে কালও বেঁচে থাকবে এই গ্যারান্টি তোমাকে কে দিল?

হতে পারে বাবাই ঠিক। আমি, মা, বিবি হাফসা—আমার হয়তো বাবার মতো করে ভাবি না। আমি তো ষাট বছর পর কী করব তাও ভাবি। তখন আমার বয়স হবে পঁচাত্তর। তখন যদি আমার হাতে অনেক টাকা থাকে আমি ব্রক্ষপুত্র নদীর তীর দিয়ে হেঁটে বেড়াব।

মা অবশ্য সাথে যোগ করেছে, একটা হুইল চেয়ার কেনার আর একটা মানুষকে হুইল চেয়ার ঠেলার জন্য বেতন দেবার মতো টাকাটা হাতে রাখিস, নতুবা বেঁচে থাকলে হয়তো বিছানায়ই পড়ে থাকতে হবে। এটুকু বলেই মা বলল, তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ। এমন যেন কখনো না হয়।

আমি নতুন বাজার পার হবার সময় রাস্তার পাশের একটা মিষ্টির দোকান থেকে দশ টাকার বুন্দিয়া কিনলাম। ছোট বেলায় বাবুভাইর সাথে একবার বেরিয়েছিলাম, কী করেছিলাম, কোথায় গিয়ে ছিলাম কিছুই মনে নেই। কিন্তু একটা দোকানে বসে বুন্দিয়া খেয়েছিলাম এটা বেশ মনে আছে।

আজ বাবুটাকে দশ টাকার বুন্দিয়া খাইয়ে সেই ঋণটা শোধ করব।

স্কুলে থাকা অবস্থায় যে বাবুভাইর কথা খুব মনে হয়েছে—এমন নয়, সম্ভবত মনেই হয়নি। কিন্তু এখন বাসার কাছে যত আসছি আমি তত বেশি পুলিশ দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হলো কেউ একজন টেলিফোনে সদর থানার ওসিকে ফোন করে বলেছে, ওসি সাহেব, সেদিন তো কেবল পিস্তল উদ্ধার করেছেন আজ ঘুঘুটাকে ধরে নিয়ে যান। এবার আপনি পিপিএম-প্রেসিডেন্সিয়াল পুলিশ মেডেল পাবেনই।

আমি তালা খুলে যখন ঘরে ঢুকব সাথে সাথে দশ জন পুলিশ আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘর সার্চ করতে শুরু করবে। আমি জিজ্ঞস করব, কী করছেন?

একজন বলবে, খানাতল্লাশি।

মানে কী?

এখানে কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য কিংবা কোনো অপরাধী আছে কি-না তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখব। অবশ্য তুমি যদি জানো, তাড়াতাড়ি বলে দাও। আর তুমি জানতে, কিন্তু বলোনি, আমরা খুঁজে বের করেছি—এমন যদি হয় যাবার সময় তোমাকেও হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাব। তোমার জন্য আমরা মহিলা পুলিশ নিয়ে এসেছি। তিনি ছাল তুলতে এক্সপার্ট। তোমার জামা খুলে, না না, সামনের দিকে কিছুই করা হবে না, জাস্ট পিছনটা কোরবানির গরুর খাল ছাড়ানো মতো দেড় ফুট বাই এক ফুট জায়গার চামড়া তুলে লবণ আর নাগা মরিচের পেস্ট লাগিয়ে দেবো।

নার্ভাস ভাবটা কাটানোর জন্য আমি ছোট্ট পলিথিন ব্যাগটাতে হাত ঢুকিয়ে চার পাঁচটা বুন্দিয়া বের করে মুখে দিই। কিন্তু বিস্বাদ লাগে। আমি থু থু করতে বাড়িতে চলে আসি। আমাদের চারটে বাড়ির মাঝখানে উঠান, অনেক মহিলা ও পুরুষ। সিকান্দর চাচার স্ত্রী গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, আমার বাপের বংশে আর পুরুষ মানুষ নাইরে। সব শেষ হয়ে গেছে।

সিকান্দর চাচা তাকে ওঠানোর চেষ্টা করছেন আর বলছেন, চলো শেষ দেখা দেখে আসি। লাশ এক ঘণ্টার মধ্যে নান্দাইল জামে মসজিদের সামনে জানাজার জন্য আনা হবে।

আমি এই অবস্থার মধ্যেও ব্যাগের ভেতর পলিথিনের মুখ খুলে আট-দশটা বুন্দিয়া বের করে সকলের অগোচরে মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। এবার আর বিস্বাদ মনে হয়নি। বরং বুন্দিয়ার রসটা গলায় ঢুকায় শুকিয়ে যাওয়া অবস্থাটা বদলেছে।

আমি ব্যাগ কাঁধে খুকু ভাইর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে খুকু ভাই?

তিনি ধমকে ওঠেন, মেয়ে মানুষ এত কিছু জানার দরকার কী? যাও, গিয়ে পড়াশোনা কর।

ঠিক উল্টো দিকে রুমকি ভাবি দাঁড়িয়ে। সিমকি তার আঙুল ধরে বলছে, একটা আইসক্রিম খাবো।

আমি আবার আমার ব্যাগের ভেতর পলিথিনে হাত ঢুকিয়ে দশ-বারোটা বুন্দিয়া বের করে সিমকির মুখে ঢুকিয়ে দিই।

আমার দিকে তাকিয়ে সিমকি কী যে এক কৃতজ্ঞতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করল। আমি ভাবছিলাম, বলবে আরো দাও।

কিন্তু বলেনি। মা’র আঙুল ছেড়ে শক্ত করে আমার আঙুল ধরেছে।

আমি জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে ভাবি?

ভাবি বললেন, খোদার বিচার!

উঠানে কান্নাকাটির এই জটলার মধ্যে চার জন পুলিশ এসে হাজির, আমার অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরল। আমি নিশ্চিত বাবুভাইকে ধরতে এসেছে।

আমি সিমকি ভাবির গায়ের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকি। পুলিশ দেখলে লোক বাড়ে, ভিড় জমে এটা যেমন সত্য, পুলিশ দেখলে লোক কমে, ভিড় পাতলা হয়ে যায় এটাও তেমন সত্য।

আমাদের উঠানের লোক কমতে থাকে। একটা মাইক্রোবাস বাড়ির ভেতরই ঢুকেছে, সিকান্দর চাচা আনিয়েছেন, চাচীকে নিয়ে নান্দাইল যাবেন।

রুমকি ভাবি নিজেই বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কী?

তারপর আমাকে বললেন, বাবুর মামলার খবর জানো?

কোন মামলা?

ছয় আঙ্গুইল্যা নাসিম হত্যা মামলা।

মামলায় ওরা দাবি করেছে বাবুর ঘর থেকে উদ্ধার করা পিস্তলের গুলিতে নাসিম নিহত হয়েছে। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আছে গলাটিপে হত্যা করেছে। তার মানে কেইস খতম।

আমি বলি, রুমকি ভাবি আপনি অনেক কিছু বোঝেন।

ভাবি বললেন, তোমারও বুঝতে হবে, কিন্তু বেকুবের ভান করে থাকবে, তাতে লাভ বেশি।

পুলিশ যখন কিছু একটা জিজ্ঞেস করার জন্য সিকান্দর চাচার দিকে এগিয়ে যায়, তিনি সর্বশক্তি দিয়ে দৌড় দেন। পুলিশ তার পেছনে দৌড়ায়নি। তবে পরস্পর বলাবলি করেছে, হি মাস্ট বি অ্যা ক্রিমিনাল।

অন্য একজন তরুণ পুলিশ বলল, আমরা তো ছুটলেই ধরতে পারতাম, তাই না স্যার।

তাই, কিন্তু শিখে নাও, আসামি ধরার চেয়ে দৌড়ের ওপর রাখাটা বেশি লাভজনক। আমাদের আর বেতন কত, কিছু খরচ তো ওদের কাছেও পাওনা, কী বলো?

তরুণ পুলিশ সবটুকু বোঝেনি।

আঙিনায় পুলিশ দেখে বড় চাচা তখনই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন হাতের লাঠি দিয়ে মোনাজাতে হাত তোলা বড়চাচার পিঠে গুঁতো মেরে বলল, মুরুব্বি আর কত মোনাজাত করবেন? শোনেন ওই যে পালিয়ে গেল ওই লোকটাকে কাল সকাল সাড়ে দশটা থেকে থানায় হাজির করবেন।

তোতলাতে তোতলাতে টি আলী বললেন, আচ্ছা স্যার।

পুলিশ বেরিয়ে যেতেই বড় চাচা বললেন, আমার পিঠে খোঁচায়। শালা পুলিশের বাচ্চা পুলিশ। দেবো শালাদের থানছি পাঠিয়ে।

থানছি কোথায় আমার ধারণা নেই। বড়চাচা কেন থানছি পাঠানোর হুমকি দিলেন সেটা জানার জন্য আমার একবার থানছি যাওয়া দরকার।

তাছাড়া পুলিশকে থানছি পাঠাবার তিনি কে?

সিকান্দর চাচা দৌড় দেওয়ায় তিনি পুলিশকে বলছেন স্যার!

স্বামীর এই দৌড় দেখে রাহাত আরা চাচী তার পরিবারের শেষ পুরুষ মানুষ হাসিম উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়ে চিত্কার শুরু করেন, পুতুলের আব্বা কোথায় গেল? পুতুলের আব্বা কোথায়?

সাথে যোগ হলো মাইক্রোবাস ড্রাইভারের হইচই। হয় নান্দাইল চলেন নয় টাকা দেন।

বড়চাচা ড্রাইভারের হাতে এক শ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, সমস্যা আছে চলে যাও।

ড্রাইভার চটে গিয়ে বলল, বুড়া মিয়া, এটা কী করলেন? আমারটা রিকশা না, দশ সিটের নতুন এয়ারকন্ডিশন লাগানো মাইক্রোবাস। ক্লাচে চাপ দিলেই পাঁচ শ টাকা।

বড়চাচা আরো এক শ টাকা দিলেন।

ড্রাইভার বলল, অই বুড়া মিয়া, ফকির পাইছেন নাকি? দান করলেও তো আমি পাঁচ শ’র কম দিই না।

বড়চাচা আরো এক শ দিয়ে বললেন, এবার যাও তো।

ড্রাইভার তখনও গজরাচ্ছে। পুলিশ এসেছিল একটা সিএনজি টেম্পোতে। সুন্দর একটা মাইক্রোবাস পেয়ে ড্রাইভারকে বলল, চল থানায়। এই গাড়ি রিকুইজিশন হয়ে গেছে।

বড়চাচার হাত থেকে পাওয়া তিন শ টাকার পুরোটাই পুলিশকে সেধে বলল, স্যার ছেড়ে দেন। জমার টাকা এখনো উঠে নাই।

ড্রাইভারের হাতে ধরা তিনটি নোটের দিকে তাকিয়ে পুলিশ বলে, তুই কি আমাদের ফকির পাইছস?

মাইক্রোবাস স্টার্ট দেয়। পুলিশ গাড়িতে ওঠার সময় বড়চাচাকে জিজ্ঞেস করে, ওই যে পালিয়ে গেল কী নাম তার?

বড়চাচা বলবেন কি বলবেন না ইতঃস্তত করছিলেন।

বলেন বুড়ো মিয়া, অসুবিধা নেই।

পাশ থেকে খুকুভাই বলে দিলেন, সিকান্দর আলী।

পুলিশ বলল, দ্যাটস গুড। সিকান্দর আলী।

মাইক্রোবাস রাস্তায় নামল।

বড়চাচা ছেলের ওপর খেপেছেন, সিকান্দর আলী না নুরু ব্যাপারী সেটা তোর বলার কী দরকার? পুলিশ কি ঘাস কাটে? তুই কি পুলিশের ইনফর্মার? তাহলে শুনে রাখ, এখান থেকে দৌড়ে পালিয়েছে নুরু ব্যাপারী। পুলিশ তোকে আবার ডাকলে এটাই বলিস।

এগারো

আমি পুলিশের বিদায়ের অপেক্ষায় ছিলাম। যখন ঘরের তালা খুলতে যাই, আমার মাথায় বুলবুলি চাচীর হাত। ফিসফিস করে বললেন, তোফাজ্জল মিয়া কখন কোন ঝামেলায় ফেলে দেন ঠিক নেই, আমি কয়েকটা দিন জামালপুরে থেকে আসি।

জি চাচী।

ঘরের দিকে খেয়াল রাখিস। কখন না আবার বোমাটোমা কিছু একটা ঢুকিয়ে আমাকেই ফাঁসিয়ে দেয়।

বুলবুলি চাচী তার হাতব্যাগ থেকে একশত টাকার একটি নোট বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, এগারোটার দিকে রোদটা কড়া থাকে। রিকশায় স্কুলে যাবি।

বুলবুলি চাচী এরকম কতদিন যে করেছেন। পাঁচ টাকা থেকে এক শ টাকা একটা না একটা কথা বলে আমাকে দেবেনই।

এর মধ্যে নিশ্চয়ই আমাকে রোদে হাঁটতে দেখেছেন।

চাচীই আমাকে জীবনের প্রথম অ্যান্টি-পার্সপিরেন্ট রোল দিয়েছেন। শেমিজ পরার পর হাত উঁচিয়ে বগল তলায় ঘষলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে আর কী যে মিষ্টি একটা গন্ধ বের হয়। ডান হাতে বাম বগল ঘষি, আর বাম হাতে ডান বগল।

আমি ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিই। আমার বাবুই দুপুরে কিছু খায়নি, ক্ষিদেয় নিশ্চয়ই পেটটা চো চো করছে।

সরু করিডোর ধরে বাবুভাইর ঘরে যাই।

সরি, তোমার দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি।

সমস্যা নেই। আমাকে কতদিন না খেয়েও তো কাটাতে হবে। আমি ইমরান চাচার শেলফ থেকে একটা মোটা বই বের করে পড়ছিলাম। শুরুতে বোরিং লাগছিল, এখন বেশ মজা পাচ্ছি। যুদ্ধ ও শান্তি, তলস্তয়ের লেখা। বইটা যে আমাকে পড়ে শেষ করতে হবে। বাইরে কান্নাকাটির শব্দ হচ্ছিল। হইচই হচ্ছিল। ঘটনা কী?

তোমাকে ধরতে পুলিশ এসেছিল।

তুই কি স্কুল থেকে থানায় গিয়ে পুলিশের কানে কানে কথাটা বলেছিস যে আমি ইমরান চাচার চেম্বারে।

হুঁ, বলেছি।

বাবুভাই ভয়ে একটুও নড়াচড়া করেনি, আলোও জ্বালেনি। বলা যায় প্রায় অন্ধকারেই এতবড় বইয়ের অনেকটা পড়ে ফেলেছে। আমি ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পলিথিনটা বের করে আনি, বলি, খাও বাবুই। তোমার জন্য দশ টাকার কিনেছিলাম, দু টাকার বুন্দিয়া আমিই শেষে করেছি। পিরিচ আনতে পারব না, সরাসরি এটা থেকে খাও। অনেক খবর আছে, আমি স্কুল ড্রেসটা পাল্টে আসি।

আমি ফিরে এসে দেখি বাবুভাই পলিথিন চেটেপুটে বুন্দিয়া শেষ করেছে। আমি ফ্রিজ থেকে গতকাল বাবুভাইকে বুলবুলি চাচীর দেওয়া দুটি মণ্ডা ও আপেল এবং মা’র রান্না গুড়ের পায়েস তার সামনে রেখে বলি, খাও। ভাত পেতে দেরি হবে, মা আসার পর।

বাবুভাই বলল, পুলিশ সত্যিই এসেছিল?

হ্যাঁ। সিকান্দর চাচার শালা, পুতুল মিতুলের একমাত্র জীবিত মামা হাসিম উদ্দিন ক্রসফায়ারে শহীদ হয়েছেন। এই জন্যই সিকান্দর চাচী মানে রাহাত আরা বিলাপ করছিলেন, চাচীর বাবার ফ্যামিলিতে হাসিম উদ্দিনই ছিলেন শেষ পুরুষ মানুষ। মাগরেবের নামাজের পর নান্দাইল জামে মসজিদের সামনে জানাজা।

আমার কাঁধে রড দিয়ে হাসিমই মেরেছিল। হাসিম আর নাসিমই। আর দুজন এমনি দাঁড়িয়েছিল। একজন বলেছে, ছুঁচো মেরে আমি হাত নষ্ট করব না।

অন্যজন বলেছে, আমিও না।

আমি বললাম, দেখলে বাবু ভাই, সিকান্দর চাচার শালাদের পরিণতি। পুলিশ কার খোঁজে এসেছে বলেনি। কিন্তু পুলিশ যখন সিকান্দর চাচাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় অমনি সিকান্দর চাচা দৌড়ে পালায়।

কিন্তু, কিন্তু আমি তো নাসিম হাসিমের মৃত্যু চাইনি। ওরা তো আমাকে মেরে ফেলেনি।

একটু দম নিয়ে বাবুভাই বলল, আমি জানি কাজটা করেছে বিবি হাফসা। সে-ই আল্লাহকে বলেছিল, ওদের ওপর গজব নাজেল করো। তাই হয়েছে।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে আমি ছুটি। মা এসেছে। এক হাতে দু কেজি আটার প্যাকেট, অন্যহাতে মুরগি। চোখে অনেক জিজ্ঞাসা।

কী হয়েছে? ঘটনা কী?

সিকান্দর চাচার ছোট শালা হাশিম উদ্দিন ক্রসফায়ারে খতম হয়ে গেছে। এখন নান্দাইলে জানাজা হচ্ছে। চাচী উঠোনে গড়িয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছেন। তাদের ফ্যামিলিতে আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই।

মা বলল, এমন পুরুষ না থাকলেই তো ফ্যামিলির মঙ্গল।

সিকান্দর চাচা চাচীকে নিয়ে নান্দাইল যাবার জন্য মাইক্রোবাস এনেছিলেন। কিন্তু হঠাত্ করে পুলিশ এসে পড়ায় সিকান্দর চাচা পালিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ থেকে পুলিশ চলে গেল। বড়চাচাকে অর্ডার দিয়েছে কাল এগারোটায় সিকান্দর চাচাকে থানায় হাজির করতে হবে।

মা বলল, তাহলে তো অনেক ঘটনা ঘটেছে।

বুলবুলি চাচী বললেন, কখন কোন ঝামেলায় ফেলে দেয় তাই তিনিও একটু আগে জামালপুর চলে গেছেন। যাও মা, তুমি কাপড় বদলে এসো, আমি ভাত বসিয়ে দিচ্ছি। তুমি এসে মুরগিটা করবে।

মাকে বেডরুমে পাঠিয়ে আমি দ্রুত বাবুভাইর কাছে আসি এবং বলি, দু-এক ঘণ্টা চুপচাপ থেকো, বাইরে পুলিশ টহল দিচ্ছে। আমি রান্না শেষ হবার আগে আর আসছি না।

মা গোসল সেরে রান্নাঘরে ফিরল, মাকে খুব ফুরফুরে লাগল। ভাতের পাতিলে লম্বা হাতাওয়ালা চামচ ঢুকিয়ে বলল, এত চাল দিয়েছিস ক্যান?

বললাম, যাতে কাল ভাত রাঁধতে না হয়।

অনেকদিন পর মা সালোয়ার কামিজ পরেছে। কাপড় থেকে ন্যাপথোলিনের গন্ধ আসছে।

মশলা মাখিয়ে মুরগিটা বসাতে বসাতে মা বলল, একটা ভালো খবর আছে। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সাহেব ফোন করেছিলেন। আমাদের ইয়াসিরকে দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইউনিভার্সিটি চার বছরের অনার্স করার জন্য ফুল স্কলারশিপ দেবে। মানে ইউনিভার্সিটিকে আমাদের কোনো পয়সাকড়ি দিতে হবে না। কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচ তো ছেলেটাকে দিতে হবে, সে তো অনেক টাকা।

আমি বললাম, তাহলে?

মা বলল, আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম্বারেই ছেলেটাকে ডাকিয়ে কথা বলেছি। ও বলেছে, চিন্তা করো না। আমি বেশি ইন্টারেস্টেড কায়রো আল আজহার ইউনিভার্সিটির ব্যাপারে। ইনশাল্লাহ আমার থাকা-খাওয়া-টিউশন সবটার স্কলারশিপ হয়ে যাবে।

আমি বললাম, দারুণ খবর।

মা হঠাত্ আমার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি জানি তারপর কী হবে—এক ফোঁটা দু ফোটা করে অশ্রু নেমে আসবে। একটি কি দুটি দীর্ঘশ্বাসও শোনা যাবে। প্রচণ্ড খিদে থাকলেও এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়বে।

রান্না শেষ হবার পর মাকে বলি, ভাত বেড়ে দিই।

মা বলল, টিচার্স কাউন্সিলের মিটিং-এ ভালোই খাইয়েছে। আজকে থাক, সকালে খাব। তুই খেয়ে ভাত-তরকারি ঠাণ্ডা হলে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিস। আমার কি সিকান্দর ভাই-র ওয়াইফকে দেখে আসা দরকার?

আমি বললাম, না। ভুল ব্যাখ্যা করবে। ভাববে তুমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে গিয়েছ।

মা বলল, রান্নাঘরে তেলাপোকার বাচ্চা দেখতে পাচ্ছি। সব ফ্রিজে ঢুকিয়ে ফিনিস পাউডার ছড়িয়ে দিস তো। আজকাল পোকামাকড়ও স্প্রে আর পাউডারের মধ্যে কেমন করে বাঁচতে হয় শিখে নিয়েছে। কোনো ঘরে প্যারাসিটামল আছে? দুটো দে।

মাথা ধরেছে মা? আমার স্কুলের ব্যাগেই এক পাতা আছে। তোমাকে দিচ্ছি।

আমি ব্যাগ থেকে প্যারাসিটামল বের করে দুটো হাতে নিয়ে এক গ্লাস পানিসহ মা’র কাছে আসি, মা বেডরুমে চলে এসেছে।

মা বলল, রেখে যা।

দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনলাম। আমার ভেতরে এখন অভূতপূর্ব এক উত্তেজনা। আমি এখন বাবুইকে খাওয়াব।

গরম ভাত আর মুরগির মাংস একই প্লেটে, একপাশে একটু সাতকড়ার আচার নিয়ে বাবুভাইর কাছে আসি। জিজ্ঞেস করি, খাইয়ে দেবো না নিজের হাতে খাবে?

বাবুভাই প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল এবং খেতে শুরু করল।

বাবুই তুমি হাতও ধুলে না, আমি খেয়েছি কি-না জিজ্ঞেসও করলে না?

বাবুভাই বলল, আয় তোকে খাইয়ে দিই।

আমি হা করি এবং ভাত মাংস মেশানো একটা লোকমা মুখে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যাই। আর একটা প্লেটে নিজের জন্য ভাত, একটু মাংস এবং ফ্রিজ থেকে পুরোনো একটু ঠাণ্ডা ডাল নিয়ে বাবু ভাইর কাছে চলে আসি।

বাবুভাই জিজ্ঞেস করে, চাচী কি কিচেনে? খেয়েছে?

না, খায়নি, ছেলের কথা মনে পড়েছে। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

আর একটু ভাত আছে? খেতে খুব ভালো লাগছে। চাচীর কষানো মাংসটা খুব মজা হয়।

আমার প্লেটটা বাবুভাইর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারটা টেনে নিই, বলি এটা থেকে খেতে থাকো, আমি আরো নিয়ে আসছি।

আমি আরো ভাত, আরো মাংস নিয়ে আসি। বাবুভাই বলল, তুই আমাকে রাক্ষস পেয়েছিস?

আমি জিজ্ঞেস করি, রাক্ষসের খাবার মেন্যু তুমি জানো? রাক্ষস কাঁচা মাংস খায়, ভাত এবং কোনো ধরনের শর্করা খায় না। বুন্দিয়া খায় না।

বাবুভাই জিজ্ঞেস করে, কাপড়গুলো শুকিয়েছে?

হ্যাঁ, আমি ইস্ত্রি করে দেবো।

খুব কাতর কণ্ঠে বাবুভাই বলল, আমি আজকের রাতটা থেকে যেতে পারি?

তলস্তয়ের বইটার আরো দেড়শ পৃষ্ঠা পড়ার বাকি? একবার মাঝপথে ছেড়ে দিলে সে বই আর কখনো আমার পড়া হয় না।

আমি খুব জোর দিয়ে মিথ্য কথাটা আবার বলি, তোমার থেকে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। বলেছিই তো বাড়িটা পুলিশ ওয়াচ করছে। তুমি তো আছোই, এখন সিকান্দর চাচাও যোগ হয়েছে। আচ্ছা, আমাকে বলো তো সিকান্দর চাচা পুলিশ দেখে পালালেন কেন?

নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছেন, যা এখনো পুলিশ জানে না, কিন্তু তিনি নিজে তো জানেন। পুলিশ দেখেই ভেবেছেন তাকে ধরতে এসেছে।

খাওয়া শেষে হয়, আমি প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে যাই। ধোয়া-মোছার কাজ করি। পাতিলসুদ্ধ মাংসটা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিই। ভাতের পাতিলটায় আগেই গরম পানি বসিয়েছিলাম। বাবুভাইর জন্য ঘন দুধের মিষ্টি কফি। একটা বড় পেয়ালায় ভাতটা তুলে পাতিলটা ধুয়ে ফেলি। আর দরজায় কান লাগিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি মা কি ফোঁপাচ্ছে? না শব্দ আসে না। কিন্তু আলোও নেই, ভেতরে কোনো শব্দও নেই। তার মানে মা ঘুমিয়ে আছে। ওয়াটার ব্যাগ ভর্তি ফুটন্ত গরম পানি নিয়ে আগে যাই, কফিটা পরে দেবো। বলি, বাবুই, তুমি একটু উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।

কেন শোব? কেন? বাবুভাই এসব জিজ্ঞেস করতে থাকে।

আমি ধমকের সুরে বলি, শোও তো বলছি।

আমি কাঁধের উপর গরম পানির ব্যাগ চেপে ধরি। একবার এ-কাঁধ একবার ও-কাঁধ করি।

খুব আরাম লাগছে, বাবুই বলল।

তাহলে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেল অথবা পেছন থেকে উঠিয়ে কাঁধ পর্যন্ত খালি করে দাও।

পাঞ্জাবি উঠিয়ে পিঠ ও কাঁধ বের করে দিল। আমি এক হাতে ব্যাগ চেপে ধরি, অন্য হাতে পিঠের উপর আঁকিবুঁকি করি। কিছু একটা লিখতে চাই, কিন্তু লেখা হয়ে ওঠে না। অন্য একটা কথা লিখি : বাবুই, তুই একটা পাগল।

বাবুই পিঠের নিচের দিকে ডানপাশে একটা কালচে জন্মদাগ নিচের দিকে নেমে গেছে, পায়জামার ইলাস্টিকেরও নিচে।

ফিতের পাজামাতে ঝামেলা। মাঝে মাঝে আন্ধাগিট লেগে গেলে খুলতে অনেক সময় লাগে। আমার বাবার দুটো পাজামাতেই ইলাস্টিক লাগানো। প্রায় সাড়ে বারো বছর ধরে প্রতি ঈদ-উল-ফিতরের আগে মা এগুলো ধোয়, ইস্ত্রি করে, তার শাড়ি ও কামিজের পাশে রেখে দেয়।

বাবুই বলল, কাপড়টাতে আমি ইমরান চাচার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি।

আমি বললাম, ওটা গুঁড়ো সাবান আর ন্যাপথোলিনের গন্ধ।

চাচা আমাকে তার কাঁধে বসিয়ে গাঙ্গিনার পাড় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার দু পা তার ঘাড়ের দু পাশ দিয়ে বুকের ওপর ঝুলেছিল।

বাবুই বলল, অনেক সেবা করেছিস, আমার জন্য তোরা ঝামেলায় পড়ে যেতে পারিস, কাল সুবিধাজনক সময় আমাকে বের করে দিস।

তুমি কোথায় যাবে বাবুই?

ঢাকায়, কামরাঙ্গির চর।

বাবুভাই এবার কাত হয়ে শুয়ে।

আমার মনে হলো বাবুভাই কেমন অস্থির হয়ে উঠছে।

তুই এখন যা, ঘুমোতে যা।

যাবো তো, এত অস্থির হচ্ছো কেন?

দেরি করিস না। আর থাকলে তোকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করবে।

একটু আদর করোই না!

আমিও কেমন চাঞ্চল্য অনুভব করি, বাবুই তুমি আমাকে একটু আদর করোই না।

বাবুই বলল, না একটু থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়। আমাকে বইয়ের বাকিটা শেষ করতে হবে।

আমিও সিনেমার নায়িকাদের মতো একটা বানানো কথা বলে ফেললাম, বাবুভাই তুমি বেহুদাই পিস্তল রাখো, তুমি তো একটা কাউয়ার্ড।

বাবুভাই বলল, তুই-ই ঠিক বলেছিস।

আমি আমার শরীরের ভেতরের সেই অস্থিরতাটা নিয়েই আমার বিছানায় চলে এলাম। আমি ঘুমোবো। বাবুইটার জন্য আমাকে সময় নষ্ট করতে হবে কেন?

আমি সুইচ অফ করে দিই।

খুকুভাই, সিকান্দর চাচা এবং বড়চাচার ওপর আমার রাগটা একটু কমে আসে। পুরোনো জংধরা পিস্তল শিয়রের কাছে তোশকের নিচে রেখে ওসিকে খবর দিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে বাবুভাইর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়েছে। বাবুভাই পলাতক।

যদি এই জংধরা পিস্তলটা ওখানে না থাকত, তাহলেও তো একই কথা, বাবুর কাছে বরং আরো মারাত্মক পিস্তল ছিল, সেই ঘরেই ওয়েলিংটন বুটের ভেতর।

অবৈধ অস্ত্র যখন তার কাছে ছিল, তাহলে বাবু হলেও যা নাসিম উদ্দিন হাসিম উদ্দিন হলেও একই কথা। আইন হচ্ছে আইন। ছয় আঙুইল্যা নাসিম উদ্দিনের কাছে থাকলে কড়া মামলা হবে আর বাবু হলে ছাড়া পেয়ে যাবে এটা হবে না।

তারও শাস্তি হতেই হবে।

তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বলতেও পারব না। তবে ভোরের দিকে যে স্বপ্নটা দেখেছি এটা ছিল বেশ মজার।

ওয়াঙ্গারি ঠিকই বলেছে। আমিও দেখলাম বাবা মরেনি। যে পাহাড় থেকে বাবা পড়ে গিয়েছিলেন বলে আমাদের ধারণা, অনেক দূর থেকে বাবাকে দেখলাম ঠিক সেই পাহাড়ের নিচে এক চিলতে উপত্যকায় বাবা বসে আছেন আর ওয়াঙ্গারি বসে তার সাথে কথা বলছে, একটু পর পর বাবা মাটি থেকে কী যেন একটা তুলে খাচ্ছেন এবং একটা দুটো ওয়াঙ্গারিও মুখে পুরছে। আমি বুঝতে পারছি না জিনিসটা কী। ঠিক তখনই কোত্থেকে বাবুইটা এসে বলল, উপর থেকে তাকালে দেখতে পাবি/ দু দিকে দু পা ছড়িয়ে আমার কাঁধে উঠ।

আমি দু হাতে মুঠ করে বাবুইর ঘন চুল ধরে রাখি। বাবুও ঘোড়ার মতো টগবগ টগবগ করে এগোতে থাকে। আমি বলে উঠি, বাবুই, আমি দেখতে পাচ্ছি, বাদাম খাচ্ছে।

বাবুই আমাকে নিয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে, কিন্তু দূরত্বটা কমছে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা যতই এগোই সেই পাহাড় সেই উপত্যাকা ততই সরে যায়।

আমার হিসু পায়।

বাবুই, আমি হিসু করব।

অসুবিধে নেই, করে দে। তুই ছোট মানুষ।

বাবুই এগোচ্ছে উপত্যাকা সরে যাচ্ছে।

বাবুই আমি আর পারছি না, হিসু হয়ে যাচ্ছে।

হোক।

তোমার কাপড় ভিজে যাবে।

বাতাসে শুকিয়ে যাবে, ভাবিস না।

এবার মনে হচ্ছে আমরা যতটা এগিয়েছি উপত্যকা ততটা পেছাতে পারেনি। আমি বাবার হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছি।

আমি যখন বাবুইর কাঁধে চড়ি ঘাড়ের দু পাশে দু পা ছড়িয়ে তখন আমার বয়স ছিল তিন বছর। তারপর বছরের পর বছর বাবুই আমাকে কাঁধে নিয়ে শুধু এগোচ্ছে আর এগোচ্ছে। প্রতিদিন উপত্যকার বাতাস বাবুইর কাপড় শুকিয়ে দিয়েছে।

তারপর হঠাত্ একদিন দেখি, নেমে এসেছে রক্তাক্ত তরল। আমি কাঁদতে শুরু করি।

বাবুই ও বাবুই, শুধু রক্ত, রক্ত বেরোচ্ছে। আমি আর বাঁচবো না বাবুই।

বাবুই, কাপড়টা কালচে লাল হয়ে গেল।

কিচ্ছু হবে না। তুই বড় হয়ে গেছিস।

তারপর বাবুভাই দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। তখন ক’টা বাজে? আমি কি আজানের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি?

বাবুই আমাকে কাঁধে নিয়ে এতটা পথ, এতটা বছর পার করে দিয়েছে। আমি কি এই বাবুইকে ছাড়তে পারি?

বারো

ঘুম ভাঙলো মা’র ডাকে। উঠ। দরজা বন্ধ কর।

আমি বলি, আজ না শুক্রবার, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

ফ্যামিলি প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের লোক নিয়োগ পরীক্ষা আছে। আমাকে পরীক্ষার হলে ডিউটি দিতে হবে। দেড় হাজার টাকা অনারারিয়াম দেবে।

আচ্ছা মা, তুমি কিছু খেয়েছ?

ওখানেই নাস্তা আর লাঞ্চ করাবে। বিকেলের চা-ও।

মা কাঁধের বড় ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। এর ভেতর পরীক্ষার খাতাও, সস্তা ইন্ডিয়ান পেঁয়াজও থাকে, দেশি মুরগিও। আমি দরজা বন্ধ করে দিই। বাথরুম সেরে নিই। দাঁত ব্রাশ করি। এই ব্রাশের উপরই পেস্ট লাগাই, বাবুইর জন্য।

আমি যে এখন কেমন করে বাবুইর দিকে তাকাব? ঘুমের মধ্যে কী যে লজ্জার ব্যাপারগুলো ঘটেছে। আর শেষে যা ঘটল, ওহ মাই গড, বাবুইর পরনের কাপড়টা লাল হয়ে গেল। এটা আমাকে অবশ্যই ধুয়ে দিতে হবে।

এগারোটার দিকে বাবুভাইর ঘুম সত্যিই ভাঙল। বলল, তলস্তয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ যখন শেষ করি তখন ভোর পৌনে পাঁচটা। আমার জীবনে দ্বিতীয়বার কোনো সুযোগ আসে না।

আমি বাবুভাইর পোশাকের দিকে তাকালাম এবং আশ্বস্ত হলাম কোথাও রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই। পেস্ট লাগানো ব্রাশ তার হাতে দিই।

বাবুভাই জিরার শরবত খেয়েছে।

আমি চারটা পরোটা বানিয়েছি। সাথে ডিমের মামলেট, কাল রাতের মুরগিও। বাবুই খাবে তিনটা, আমি একটা।

দুপুরে পোলাও খাওয়াব। আমি ভালো রাঁধতে পারি—এটা বাবুই দেখে যাক।

আমার রান্না তখন মাঝপথে। বাবুই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ নামের একটা বই পড়তে শুরু করেছে। আমি বলেছি, বাবুই আমি তোমাকে এখানেই লুকিয়ে রাখতে পারব।

আমি একটি সিনেমায় দেখেছি। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ভয়ংকর দিনগুলোতে একটি মুসলমান ছেলে একটি হিন্দু মেয়েকে কেমন করে দিনের পর দিন লুকিয়ে রেখেছে।

আমার রান্না তখন মাঝপথে, দরজায় ধাক্কা ও কলিংবেল দুটোই। আমি খুলে দেখি রুমকি ভাবি।

বড়চাচা এবং খুকুভাই আমার মা’র চরিত্র নিয়ে কথা তুললে আমরা ওই বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিই। টুকুভাই ছাড়া বড়চাচার ফ্যামিলিরও কেউ আসত না।

রুমকি ভাবি বললেন, তোমার পোলাওর গন্ধ পেয়ে এসেছি।

আমার ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা কাটাতে বললাম, আসলে তো আপনাকে আমাদের দাওয়াত করেই খাওয়ানো উচিত ছিল। কিন্তু কী করব বলুন বড়চাচা আর খুকু মা সম্পর্কে এত নোংরা কথা বলেছে যে…।

তিনি আমার কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, আমি তো সবই জানি।

তারপর তিনি পলিথিনে প্যাঁচানো একটি কালো কাপড় আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এটা বোরকা, অনেক লম্বা। পায়ের জুতাও ঢাকা পড়ে যাবে।

আর কাগজে প্যাঁচানো একটি পুঁটলি দিয়ে বললেন, এর ভেতর পাঁচ হাজার আছে।

আমি বললাম, এসব দিয়ে আমি কী করব?

ভাবি বললেন, বোকা মেয়ে, একটা মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে অনেক কিছু করতে হয়, আমিও তোমার সাথে একটু করলাম।

আমি ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকি।

তিনি বললেন, তুমি যে মানুষটাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছ, আমিও তো তা-ই চাই।

তিনি আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন, আমি যাই।

তিনি আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না।

জুম্মার পরপরই মসজিদ থেকে বেরোবার সাথে সাথে বড় চাচাকে অ্যারেস্ট করে প্রথমে বাড়িতে আনা হলো। বাড়ি তখন খানাতল্লাসি চলছে। কাজটা করিয়েছে নুরু ব্যাপারী। একাত্তরের হানাদারের দোসর টি আলী। সিকান্দর আলীকে এগারটায় থানায় নিয়ে যাননি, নিজেও হাজির হননি। মসজিদের মুসল্লি থেকে শুরু করে নারী-পুরুষে উঠান বোঝাই।

আমার কোর্মা রান্না তখনও শেষ হয়নি। চুলা নিভিয়ে দিলাম। গতকালকের ঠাণ্ডা মাংস মিলিয়ে আমি বাবুইর মুখে দুটো লোকমা ঢুকিয়ে দিলাম।

বাবুভাই জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল, অনেক মানুষ। বেরোবার এটাই সুযোগ। এই ঘরেও সার্চ করতে পারে।

বড় বোরকাটা দিয়ে বললাম রুমকি ভাবি দিয়েছে। টাকাটাও পকেটে ভরে নিল। কিন্তু আমার যে দেবার মতো কিছু নেই। আমার যদি একটা আংটি কিংবা গলার চেইনও থাকত!

বাবুভাইর হাতে একটা ভারী বই, বাবার আলমারির নিচের তাক থেকে বের করা, মিশকাত শরিফ।

আমি জানালা খুলে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখের সামনে দিয়ে ছোট কদমে পা ফেলে আমার বাবুই বই হাতে একেবারে পুলিশের গা ঘেঁষে এ বাড়ির আঙিনা থেকে বেরিয়ে জেলা স্কুল রোডের দিকে চলে গেল।

বড়চাচা টি আলী লিখা একটি সার্টিফিকেট বের করে চেঁচিয়ে উঠলেন, এই দেখ মিয়া সার্টিফিকেট।

সার্টিফিকেট দেখানোর পর নুরু মিয়া পিছিয়ে গেলেন, পুলিশও বিব্রত বোধ করতে শুরু করল। খানাতল্লাশি বন্ধ করে বড় চাচাকে তাজিমের সাথে থানায় নিয়ে গেল। থানায় বেশিক্ষণ থাকতে হয়নি। তদন্তে সহযোগিতা করবেন এমন একটা কাগজে সই করিয়ে নিজ জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তেরো

মা ফিরল ঠিক সাড়ে ছ’টায়। বেতনের বাইরে হাতে টাকা এলে মা একটা না একটা খাবারের আইটেম কিনে আনে, কিন্তু নিজে খায় না। কিন্তু এবার হাত খালি।

মা কিছু আনোনি যে?

না খরচ করিনি। ভাবলাম পুরো টাকাটাই ছেলেটাকে দিয়ে দিই।

আমি জিজ্ঞেস করি, কোন ছেলেটাকে?

মা বলল, কেন বাবু চলে গেছে?

আমিই অবাক হই। ধরে নিলাম রুমকি ভাবি দেখেছে পায়ের জুতোটা ছেলেদের। কিন্তু মা?

মা, তুমি কেমন করে জানলে?

শেষরাতের দিকে তোর বাবার চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখি ডিমলাইটে একটা মোটা বই পড়ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভয় পেয়ে যেতে পারে সে-জন্য চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।

বাবুভাইয়ের ফেলে যাওয়া বোরকাটা আনতে গিয়ে দেখি খাটের নিচে ডিজাইন করে বইয়ের পাতা কাটা। কাটার ধরনটা একই। অনেকগুলো কাটা পাতা। এটা বাবুরই কীর্তি। ডিজাইনটা মেলাতে চেষ্টা করি। বুঝে গেছি। এটা পিস্তলের মতো। বাবুভাই যে বইটা হাতে নিয়ে বের হয়েছে পাতা কেটে পিস্তলটাকে এর মধ্যেই ঢুকিয়ে দিয়েছে।

বাহ, বাবুইটার তো অনেক বুদ্ধি।

সিকান্দর চাচা সেই যে পুলিশ দেখে পালালেন তার খোঁজ নেই পঁচানব্বই দিন। সেই পঁচানব্বইতম দিনেই ত্রিশাল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গা-ঘেঁষা একটি বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট হয়েছে টিপু সুলতান। দৈনিক জাহানের খবরটা এমনই টিপু সুলতান গ্রেফতার। ভেতরে লেখা টিপু সুলতান চরিত্রের অভিনেতা বাবু—অস্ত্র ও হত্যা মামলার পলাতক আসামিকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা গ্রেফতার করেছে। দুই কলাম ইঞ্চিতে খবরে টিপু সুলতানের ভূমিকায় তরবারি হাতে বাবুর একটি বহুল পরিচিত ছবিও ছাপা হয়েছে।

পরের ছ’মাসের মধ্যে দুটি মামলার রায় হয়ে যায়। হত্যা মামলায় বাবু বেকসুর খালাস। বাবু ঘটনাস্থলে থেকে ছয় আঙুইল্যা নাসিমকে গুলি করেছে—এটা প্রমাণিত হয়নি।

দ্বিতীয়ত নাসিম উদ্দিনের মৃত্যুর কারণ শ্বাসরোধ। কিন্তু অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগটি শুরু থেকেই বলা যায় প্রমাণিত। পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়েছে এবং তা গ্রেফতারের দিন থেকে কার্যকরী হবে।

বাবুর রায় ঘোষণার পর খুকুভাই তার বাবাকে অনেক বকাঝকা করেছে। বলেছে, টি আলী এতিমের ওপর অবিচার করেছেন।

ছেলের দুর্ব্যবহার বড়চাচাকে ব্যথিত করে, এশার নামাজ থেকে ফেরার পথে হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান। তারপর হাসপাতাল। পত্রিকা লিখেছে পাকিস্তানিদের দোসর ও স্বাধীনতা বিরোধী হবার কারণে যে মামলা হতে যাচ্ছে তা এড়াতে টি আলী অসুস্থতার ভান করছেন।

বাবুভাইয়ের বিরুদ্ধে এসব মামলা মোকদ্দমা হবার আগে বুলবুলি চাচী তাকে বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার কোনো একটি হাসপাতালে নাকি ক্যানসারের ভালো চিকিত্সা হয়। তুই যদি অস্ট্রেলিয়ায় যাস তাহলে আমারও যাওয়া হবে।

বাবু সেই প্রথম জানতে পারে মা’র ক্যানসার।

কিন্তু কোথায়? লাঙ্স, লিভার না ব্রেইন?

ব্রেস্ট ক্যানসার কথাটা মা ছেলেকে কেমন করে বলবে—সে-জন্য বুলবুলি চাচী একটু সময় নেয়।

ছেলে যদি বলে, দেখি মা কোথায়? তখন কী করবেন?

তিনি জিজ্ঞেস করেন, অস্ট্রেলিয়া অনেক দূর তাই না? সিঙ্গাপুর হয়ে যেতে হয়?

বাবু বলে, কুয়ালালামপুর হয়ে গেলে ভাড়া কম পড়ে।

বাবুভাইয়ের উকিল বললেন, আপিল করে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। শাস্তি কমই হয়েছে। সরকারি ছুটি, সদাচারণের পুরস্কার, সব মিলিয়ে চার বছরের বেশি জেল খাটতে হবে না। এর মধ্যে তো এক বছর হয়েই গেছে।

মাসে দু-একবার বুলবুলি চাচী বাড়িতে এসেছেন। বাকি সময়টা জামালপুরে, বাবার বাড়িতে অথবা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিংবা ঢাকার ডেল্টায় রেডিয়েশন নিয়েছেন।

ঘরের চাবিটা আমাকেই দিলেন, আর দিলেন একটা মোবাইল ফোন। বললেন, তিন দিনে একবার আমাকে ফোন দিস। তোদেরও পড়াশোনা আছে, নইলে প্রত্যেকদিন ফোন করতে বলতাম।

চাচী আর একবার এসে মাইক্রোওয়েভ ওভেনটা বের করে বলেন, তোদের ঘরে নিয়ে যা। বারবার চুলা ধরাতে হবে না। যখনই দরকার গরম করে নিতে পারবি।

একদিন বুলবুলি চাচীর দেওয়া ফোনে মা স্কুল থেকে আমাকে ফোন করে বলল, আমি সরাসরি জামালপুর চলে যাচ্ছি। তোর চাচী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সকালের বাসে সরাসরি স্কুলে আসব, তুই সাবধানে থাকিস। চুলায় আগুন দিস না। দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাতে যাস।

আগের সপ্তাহে শুনেছি চাচীর টিউমার ম্যাটাস্ট্যাসিস হয়ে গেছে। মাথায় ও হাড়েও ছড়িয়েছে।

ম্যাটাস্ট্যাসিস কথাটার মানে আমি আসলে বুঝতেই পারিনি। মা বলল, বিদ্যাময়ীর সুপ্রিয়া দিদি তো সাত মাসের মাথায়ই মারা গেল।

বুলবুলি চাচী মৃত্যুবরণ করতে একটু বেশি সময়ই নিয়েছেন। তার কথামতোই লাশ আনা হয়েছে গুলকিবাড়ি রোডে, সাজ্জাদ আলীর বাড়িতে।

অসুস্থ মাকে দেখাবার জন্য বাবুর উকিল দু’বার প্যারোলের আবেদন করেছিলেন, মঞ্জুর হয়নি। কিন্তু মরা মাকে একনজর দেখাতে রাষ্ট্রদ্রোহীও প্যারোলে অল্প সময়ের জন্য জেলখানা থেকে বেরোতে পারে।

বাবুভাইও পেয়েছে, ছ’ঘণ্টার।

চৌদ্দ

মায়ের লাশের সামনে বাবুভাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক ফোঁটাও কাঁদেনি।

বড়চাচী বলেছেন, ছেলেটাও মায়ের মতোই পাষাণ। সাজ্জাদের লাশের সামনে বুলবুলিও ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়েছিল। চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখিনি।

সিকান্দর চাচী সমর্থন দিয়েছেন, একই রক্ত তো।

অস্ট্রেলিয়া থেকে বাবুর মন্টু মামা, মানে নুপুরের বাবা ফোন করে জানিয়েছেন, দাফন হবে জামালপুর সেন্ট্রাল গোরস্থানে। কিন্তু বুলবুলি চাচী তো এসব সমস্যার সমাধান আগেই করে গেছেন। আমার মা’র নোটবইতে নিজের হাতে তার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো লিখে দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে : আমার বড় ভাসুর জনাব তোফাজ্জল আলীর বড় ছেলে খুকুর এপিলেপসি চিকিত্সার জন্য আমার ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা ভাঙানোর পর পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

অপর একটি হচ্ছে : যেখানেই আমার মৃত্যু হোক, আমার লাশ মুক্তাগাছার শিমলাতে আমার স্বামী মরহুম সাজ্জাদ আলীর কবরেই দাফন করা হবে।

আরো কিছু ছিল, মা সব দেখায়নি।

বাবুভাই ওয়াকিটকি হাতে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকা তরুণ পুলিশ অফিসারটিকে বলল, আমি কি আমার মায়ের দাফন পর্যন্ত থাকতে পারব?

না। পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে আমাদের জেলগেটে পৌঁছাতে হবে।

আমি কি আমার নিজের ঘরে গিয়ে একটু বসতে পারি?

হুঁ।

আমি তাড়াতাড়ি এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে বাবুভাইর কাছে নিয়ে এলাম। হাতকড়া থাকলেও বাবুভাই ডানহাতে গ্লাসটি ধরতে পারল এবং দু হাত একসঙ্গে উঁচিয়ে দুই ঢোকে শরবতটা শেষ করল।

আমার বড় আপু বিবি হাফসা, হিজাবপরা ভিন্ন এক নারী, বুলবুলি চাচীর মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে জয়দেবপুর থেকে স্বামীর অফিসের গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। তার স্বামী, আমাদের দুলাভাই আবুল আলা মমতাজ মুহাম্মদ আবদুশ শাকুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সায়েন্টিফিক অফিসার। তিনি ব্যস্ত, আসতে পারেন নি।

বাবুভাই বলে ডাক ছেড়ে চিত্কার করে হাফসা তার দু পা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কেঁদে বলল, বাবুভাই আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারিনি। নিজের ঠোঁট চেপে ধরে বাবুভাই হাতকড়া লাগানো হাতে হাফসাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। যখন হাফসা নিজে থেকে উঠে দাঁড়ায় বাবুভাই বুঝতে পারে এর মধ্যে অনেককিছু ঘটে গেছে। বেশ ফুলে উঠেছে বিবি হাফসার পেট।

উঠোন ভরা মানুষের সামনে বিবি হাফসা অবলীলায় হাতকড়া পরা হাত দুটো টেনে নিজের পেটের উপর রেখে বলল, বাবুভাই আপনি আমার বাবুটার জন্য দেয়া করবেন। কথাটা বলেই কান্নাভারী চোখ দুটো লুকিয়ে তাকে কদমবুসি করার জন্য আবার নুয়ে পড়ল। কয়েদির পোশাকে তাকে আনা হয়নি। প্যান্ট আর মেরুন রঙের পাঞ্জাবি আর বাটার স্যান্ডেল। এগুলো তারই পোশাক।

আমি এগিয়ে গিয়ে সেই পুলিশকে বলি, স্যার, আমি কি বাবুভাইকে একটু খাবার দিতে পারি?

কিন্তু হাতকড়া খোলা যাবে না, এমনি খেতে হবে।

আমি আবার বলি, স্যার আপনারা অনেক কষ্ট করে বাবুভাইকে নিয়ে এসেছেন। আমার মা গুনে গুনে আপনাদের জন্য আট প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি এনেছেন। এটা কি আপনাদের দিতে পারি?

আমারটা শুধু প্লেটে। বাকিদেরটা যার যার প্যাকেট তার হাতে। প্যাকেট থেকে তুলে খাবে। কী নাম তোমার? খুব স্পার্ট মেয়ে দেখছি।

স্যার আমি একটু আসছি বলে রান্নাঘরে ঢুকি। এক প্লেট ভাত, গতকলের একটু মুরগির মাংস, বাবুভাইর প্রিয় ডাবল ডিমের ওমলেট আর একটু পুঁই শাক নিয়ে আসি।

আমার খাইয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বাবুভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সম্ভবত এটাই বলেছে, হাত দিয়ে খাওয়ানোর এটা সঠিক সময় নয়।

আমি পাশের রুমে হাফসার ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মাথায় ঝুটি, চিবুকে একটু দাড়ি পরনে হলদে কাপড়, হাতে দোতরা টুকুভাইকে দেখে আমি অবাক হই। তিনি এগিয়ে গিয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সালাম দিয়ে বলেন, আমি টুকু সাঁই, মাইয়েত আমার সাজ্জাদ আলী চাচার পত্নী। আমি আপনাদের আমার গুরুর গুরু দুর্বিন শাহ-র একটা গান শোনাতে চাই। অমনি শুরু করলেন :

অচিন এক জংলি পাখি এ দেহ পিঞ্জরে থাকি

ডাকে পাখি নিজ নাম ধরিয়া রে

এটুকু শোনার পর পুলিশের ওয়াকিটকি ওয়ালা ইন্সপেক্টর বললেন, যথেষ্ট হয়েছে এবার গেট আউট। শালা গাঁজাখোর।

আমি দেখলাম টুকুভাইর মাথার টিউমারটা আরো বড় হয়েছে।

ওয়াকিটকিওয়ালা পুলিশ যখন খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধুচ্ছেন, আমি দ্রুত দুটি চকলেট এবং একটি চিরকুট বাবুভাইর পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আমি যে এমন একটা কাজ করেছি, বাবুভাই দেখেছে।

বাবুভাই আসবে খবরটা শুনে সকালেই চিঠিটা লিখেছি।

এসময় একটা ছোট্ট নেংটা বাচ্চা দৌড়ে পুলিশের সামনে এসে খিল খিল করে হাসতে থাকে। এটা আমাদের সিমকি। রুমকি ভাবির মেয়ে।

রুমকি ভাবি ছুটে এসে মেয়েকে এমনভাবে কোলে নিয়ে হাত দিয়ে ঢেকে দেন যে সিমকির নগ্নতা আর দেখা যায় না। বাবুভাই ও আমার চোখ পড়ে সিমকির পিঠের নিচের দিকে ডানপাশটাতে একটা লম্বাটে জন্ম দাগ। কেন?

লাশের পিকআপ বারকয়েক হর্ন বাজিয়ে মুক্তাগাছার শিমলার উদ্দেশে রওয়ানা হয়।

ইন্সপেক্টর অকারণেই ওয়াকিটকি টেপাটেপি করে চেঁচিয়ে ওঠেন, ফোর্স তৈরি হবে, ফোর্স রেডি, অ্যাকশন।

ধুপধাপ বুটের শব্দ শোনা যায়। পুলিশের জিপ এগিয়ে আসে।

বাবুভাই যখন জিপে উঠতে যাচ্ছে, সদ্য ছাঁটা চুল, ক্লিন শেভ করা এক তরুণ এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবুভাই, দোয়া করবেন।

অবশ্যই। অবশ্যই।

আমি তো এই তরুণকে চিনি। কিন্তু তার মাথাভর্তি চুল ও দাড়ি কোথায়? ও কোত্থেকে এসেছে?

ও আমার ভাই ইয়াসির আরাফাত। মিশরের আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আছে। কিন্তু তার এই বেশরিয়তি বেশ কেন?

আমার বাবার চোখে পড়লে তিনি সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যেতেন : ইসলামের সাথে এ কী বিশ্বাসঘাতকতা!

আমার মা এগিয়ে এসে সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকান।

জিজ্ঞেস করেন, তুই কখন এলি? আমাকে জানাসনি কেন? তোর এই চেহারা কেন?

ইয়াসির বলল, দাড়ি দেখলে জঙ্গি ভাবে তো, তাই। আমি একটা মিশনে এসেছি।

মা চেঁচিয়ে ওঠে, তোর আবার কিসের মিশন?

ততক্ষণে উঠোনের একপ্রান্তে অপেক্ষমাণ একটি মোটর বাইকের পেছনে উঠে বসে ইয়াসির আরাফাত। আমার ছেলেটা আমার ছেলেটা—বলতে বলতে আমার মা মাটিতে বসে পড়ে। আমার মা আমার ভাই আহমেদ বেনবেল্লাহর কথা বলতেও পারে না।

ঠিক এক বছর আগে সিরিয়ায় নিহত অশনাক্তকৃত নয় জন যুবকের ছবি আলজাজিরা এবং সিএনএন দেখায়।

ঢাকার পত্রিকায়ও ছাপা হয় ছোট ছোট নয়টি ছবি। আমার মা নিশ্চিত নওফেল হাসনাইন নামের ছেলেটি আসলে তার পেটের সন্তান আহমেদ বেনবেল্লাহ। আমারও তা-ই মনে হয়। তারও দাড়ি ছিল না, কিন্তু মাথায় ছিল আরবি পাগড়ি। আমার মা এ কথাটা কাউকেই বলেনি।

বাবুভাইকে নয়ে জিপটি রওয়ানা হলো। ঠিক পেছনের জিপে আমার বড় আপু বিবি হাফসা।

পনেরো

প্যারোল ছিল ৬ ঘণ্টার। সব সেরে বাবু যখন জেলগেটে পৌঁছায় তখন ৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। ২০ মিনিট আগেই পৌঁছেছে।

কয়েদির পোশাক পরার সময় পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি চিরকুট এবং দুটো চকলেট তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোতে নিয়ে নিল। জেলখানার ডিনার সন্ধ্যার আগেই হয়। তারপর লকআপে। আজ বাবু খাবারটা কাউকে দিয়ে দেবে। শুধু চকলেট দুটো খাবে। সবাই যখন খাবার জন্য হুড়োহুড়ি করে ছুটছে বাবু চিরকুটের ভাঁজ খুলল :

আমার বাবুই,

বুলবুলি চাচী অনেক ভালোমানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করবেন।

তোমার শরীরের জখমে বরফ ঘষে বিবি হাফসা তোমাকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। তুমি যখন জেলে যাও তখন তার বিয়ে হয় হয় অবস্থা। এ কথা সে কথা বলে অনেকদিন বিয়ে ঠেকিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত একজন সায়েন্টিফিক অফিসারকে বিয়ে করেছে। তার পেটে সন্তান এসেছে, দোয়া করো।

আরো দুটি বছর কেটে গেছে। মমিনুন্নেসা কলেজে আমার সেকেন্ড ইয়ার চলছে। আমি এখন সেভেন্টিন। আর এক বছর পর কেউ আমাকে আর মাইনর বলতে পারবে না। আমি তখন যাকে ইচ্ছে বিয়ে করব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পিঠে হট ওয়াটার ব্যাগ ধরে রাখব। তোমার বেরোতে ম্যাক্সিমাম টু ইয়ার্স। আমি তখন নাইনটিন।

তোমাকে যখন ছোটরা সবাই আপনি করে বলত আমি বলতাম তুমি। এ জন্য শুধু বকা নয়, মারও খেয়েছি। কারণ এটা বেয়াদবি। কিন্তু আমি জানতাম বাকি জীবন বাবুইকে আমি তুমিই বলব। হাজব্যান্ডকে আপনি বলার কোনো মানেই নেই। তাই না বাবুই?

তোমার কাছে একটা খবর লুকোবো না। আহমেদ বেনবেল্লাহ অনেকদিন ধরে নিরুদ্দেশ ছিল। মা জিডিও করেছিল। কিন্তু বেনবেল্লাহ সিরিয়ায় মসুল নামের এক রণক্ষেত্রে শহীদ হয়েছে। মা আল জাজিরাতে তার ছবি দেখে চিনে ফেলেছে। কিন্তু স্বীকার করছে না। কাউকে কিছু বলছেও না।

তুমি যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাবে আমি তোমাকে জেলগেটে রিসিভ করব। তারপর একটা রিকশা নিয়ে সোজা কাজি অফিস। সোনাগয়না আমার কিছু লাগবে না। দেনমোহর হবে মাত্র এক টাকা।

তারপর তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাও আমি যাব। শুধু অস্ট্রেলিয়া বাদ।

এই কথাটা কি আমি এখন তোমাকে বলতে পারি? আই লাভ ইউ বাবুই।

পারি। একশ বার পারি।

তোমার প্রতীক্ষায়

বিবি মরিয়ম।