কেরানিও দৌড়ে ছিল


১১
জীবনের চেয়ে বড় নাটক নাই, সত্য। তবে এ নাটক আমাদের এ কথনের কেরানি অনুভব করে না। তার জীবনে এর চেয়ে নাটকীয় ঘটনা আর কী হতে পারে যে পনেরো দিনের ভেতরে দুই নারীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়? কিন্তু আরো আছে অতীতে। আরো অনেক নাটকীয় ঘটনা। সে সকল তার লক্ষে নাই। আমাদেরও তা জেনে কাজ নাই। আমরা বরং তাকে নিয়ে অগ্রসর হই।
কেরানি এখন বাসরে। রুহিতনের সঙ্গে তার আজ প্রথম রাত। বিয়ে পড়ানোর পর তাকে নিয়ে নানা রুসুমাত হয় মেয়েদের পরিচালনায়। তখনি গুঞ্জনটা তার কানে পশেছিলো_ সুহাগ রাত! এ ভাষা সে ভালোমতো না জানলেও তার বুকের মধ্যে তোলপাড় তোলে_ এরা বাসর রাতের কথাই বলছে। সে তার নগদ অতীত ভুলে গিয়ে এই রাতটিকেই তার জীবনের প্রথম সোহাগ রাত বলে ধারণা করে ওঠে। সে যদি ভুলে গিয়ে থাকে, তবে আমাদেরই বা এখন কোন দায় পনেরো দিন আগে মদিনার সঙ্গে বাসরের কথা মনে করবার? সে বাসরে এসে প্রবেশ করে।
আশা করেছিলো, আর এটাই তো হবার কথা, ঘরের ভেতরে রুহিতন বসে থাকবে তার বরের অপেক্ষায়_ লাল বেনারসি শাড়িতে সুগন্ধে আস্তমস্ত এক নববধূ। কিন্তু ঘরে যখন তাকে ঢোকানো হয়, ঘর শূন্য। রুহিতন নাই। কেরানি একটু হকচকিয়েই যায়। শূন্য ঘর তার কাছে শূন্যের অধিক শূন্য বলে মনে হয়।
আইবো! আইবো! পেরেশান হইয়েন না। মেয়েদের এহেন আশ্বাসবাণীতে কোনো কাজ হয় না। মেয়েরা তাকে ঠেলে ঢুকিয়ে হাসির ছররা ছুটিয়ে বেরিয়ে যায়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেরানি। রুহিতনের জন্যে মন অধীর হয়ে থাকলেও চেহারাটি তার মনে পড়ে না। আয়না দেখায় যে মুখ সে দেখেছিলো বধূরূপে রুহিতনের, সে মুখ বড় অচেনা বলেই তার কাছে মনে হয়েছিলো। যেন সদরঘাটে ফেরিওয়ালার হাতে সিনেমার কোনো নায়িকাকেই সে দেখেছিলো আয়নায়।
বুলবুলমিয়ার এ বাড়িতে কেরানি এতকাল যে ঘরে থাকতো সেখানেই বাসর সাজানো হয়েছে। এতকাল সে আম কাঠের শস্তা একটা চৌকির ওপর ঘুমোতো। এখন সেখানে খাট। দেয়ালে ঝোলানো সবুজ কাঠের ফ্রেমে সাঁটা ছোট্ট আয়নায় মুখ দেখতো। এখন ড্রেসিং টেবিল। কী বিশাল আয়না! জানালায় পর্দা ছিলো না। এখন নীল ছিটের পর্দা। হাতপাখায় গরম নিবারণ হতো এতকাল। এখন মাথার ওপরে ফ্যান। ফুরফুর করে ঘুরছে।
কেরানির পরনে বিয়ের জামাজোব্বা এখনো। বিছানার ওপরে অপেক্ষা করছে নাইলনের পাঞ্জাবি আর ধবধবে শাদা লুঙ্গি। গায়ের শেরোয়ানিটা খুলবে কি খুলবে না, কী তার করা উচিত এখন, মনস্থির করতে পারে না। নিজেকে কেমন অচেনা লাগে কেরানির। এ সবই তার জীবনে ঘটছে, একবার বিশ্বাস হয়, একবার হয় না। সে ঘামতে থাকে। শেরোয়ানি ভাড়া করা হলেও গরমটা তার নিজস্ব। বাইরের এবং শরীরের, উভয় পক্ষেই! কেরানি ঘামতে থাকে।
রাত বাড়তে থাকে। বিয়েবাড়ির কলরব থেমে গিয়ে স্তব্ধতাও যেন এখন দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে বরবধূর শুভমিলনের। কিন্তু রুহিতনের দেখা নাই। আর না পেরে কেরানি শেরোয়ানির গলার হুক আলগা করে, ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দেয়, রুমাল দিয়ে ঘাম মোছে। উৎসুক হয়ে থাকে দরোজার দিকে চোখ পেতে।
কিছুক্ষণ পরে আম্মার গলা পাওয়া যায়, আরে, এই মাইয়া দেহি জ্বালায়া মারবো! দামান্দে ঘরে একা রইছে! ঢং করিছ না!
কেরানি কান খাড়া করে। খিলখিল হাসি একটা কানে পশে তার।
রুহিতনেরই কি? সে ঠাহর করে উঠতে পারে না। তার সমস্ত শরীর মন উদগ্র হয়ে তাকে পিষতে থাকে। সে চঞ্চল হয়ে পড়ে। গলায় কাশি দেয়। অচিরে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। না আম্মার, না রুহিতনের। হঠাৎ খটাখট শব্দ ওঠে। না, দরোজা খোলার শব্দ নয়, ঘোড়ার আওয়াজ। বুলবুলমিয়ার ঘোড়া। ঘোড়াও বুঝি অস্থির হয়ে পড়েছে কেরানিরই মতো। আস্তাবলের শানের ওপর ঘোড়ার পা ঠোকার আওয়াজ ওঠে খটাখট। বাইরে উৎসবের লালনীল বাতি এখনো জ্বলছে নিবছে, জানালার ভেতর দিয়ে ঘরে এসে পড়ছে। আলোর সেই চোখ টিপুনির ভেতরে বসে বসে কেরানি রুহিতনের অপেক্ষায় ঘামতে থাকে।
বাসর রাত। এই বাসর আর সেই বাসর। হস্তিবাড়িতে। আর নববধূটি ছিলো মদিনা। মনে পড়ে যায় কেরানির। একটু আগেও মনে পড়ে নাই, এখন মনে পড়ে। শূন্য ঘরের শূন্যতা। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ে। পনেরো দিন আগের সেই রাত। সে ছিলো তার প্রথম বিয়ের বাসর। এই বাসরের মতো বাইরের রঙিন বাতির ঝাপটায় উদ্ভাসিত ঘর নয়। হস্তিবাড়ির সেই বাসরঘর ছিলো অন্ধকার। একটা লণ্ঠন মাত্র। আলোর চেয়ে অন্ধকারকেই যেন বিপুল করে রেখেছিলো লণ্ঠনের ওই আলো। কিন্তু ছিলো আজকের এই বাসরের মতোই আতর আর ফুলের গন্ধ জড়ানো। সে রাতেও ঘরে সে ঢুকেছিলো নওশা বেশে। তবে শেরোয়ানি নয়, পাঞ্জাবিতেই বিয়ের মজলিশে সে যায়।
বিছানার একপাশে গুটি মেরে পড়ে ছিলো মদিনা। লাল বেনারসি। শাড়ির পরতে পরতে নতুন কাপড়ের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। বাইরে সুমসুম করে বয়ে চলেছে রাত। সেই শব্দের ভেতরে আকাঙ্ক্ষার গান। শরীরের জন্যে শরীরের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তা প্রথম রাতে তো নয়, পরের রাতের কথা। প্রথম রাতে সে নিজেই গিয়েছিলো গুটিয়ে। বৌয়ের নাম মদিনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র পুণ্য শহরের নামের মিল দেখে কেরানির শরীরে নেমে এসেছিলো শীতলতা। সে রাতে মদিনাকে স্পর্শ করা তার হয় নাই।
তারপর, পরদিন নান্নার মুখে মনির মৃধার কাহিনী শুনে মদিনার সতীত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কাঁটা উঠেছিলো ফুটে। হয়তো সে কুমারী বধূ পায় নাই। মদিনাকে নিশ্চয় মনির নষ্ট করেছিলো। আহ্, নষ্ট কাকে বলে! নারী নষ্ট হয় কিসে! নারীর পবিত্রতা কি কেবল তার শরীরেই? তার হৃদয়ের কি কোনো ভূমিকাই নাই? না, এ সকল প্রশ্নের মীমাংসা আজও পৃথিবীতে হয় নাই।
প্রশ্নের অধিক বলবান হয় আমাদের রক্তের জোয়ার আর তাপ। পরদিন আবার অন্ধকার ঘরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই ভেতরে এক লাল উত্থান ঘটেছিল কেরানির। তখন সন্ধানী একটা হাত সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো মদিনার দিকে। নিতম্বের ওপর হাতটি গিয়ে থিতু হতেই মেয়েটি সরে গিয়েছিলো। পুরুষের প্রথম স্পর্শে শিহরিত হয়েই কি? না অন্য কিছু? হাত চ্যুত হয়ে পড়েছিলো। একটু পরে আবার হাতটি সে পাঠিয়েছিলো বুকের দুটি গোল ফলের দিকে। মদিনা আবার সরে গিয়েছিলো। আবার আবার। সরে সরে। সরে সরে। মদিনা বারবার সরে যাচ্ছিলো। সরতে সরতে একসময় দুড়ূম করে পড়ে গিয়েছিলো চৌকি থেকে মাটিতে।
তারপর ঢাকা ফিরে আসবার আগের সেই রাত। ইচ্ছে করেই এ রাতে অনেকটা রাত করে ঘরে এসেছিলো কেরানি। ঘরে ঢুকে দেখে মদিনা চৌকিতে নাই। তবে কি আসে নাই ঘরে? না! ওই তো! জানালার কাছে। মেয়েটি বুকের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে ছিলো।
বিছানায় আসো। _মদিনার সাড়া নাই। _আসো। _সাড়া নাই। _রাত অনেক হয়েছে। _তবু সাড়া নাই। _শেষ রাতে আমাকে রওনা হতে হবে। এই একটা রাত। কবে আর আসি ঠিক নাই। ছুটি পাই কি না পাই! বিছানায় আসো।
তখন জানালার কাছ থেকে মদিনা ধীর পায়ে সরে এসে চৌকিতে শুয়ে পড়েছিলো। তখন কেরানি তার পাশে বসে জানতে চেয়েছিলো, কি, তুমি এমন করো কেন?
মদিনার উত্তর নাই।
আজ তিন তিনটা রাত। কী! কথা কও না যে! তোমার কি কোনো সমস্যা? একটা কথা শুনছিলাম! খুব চিন্তার কথা।
মদিনা তৎক্ষণাৎ পা গুটিয়ে দলা পাকিয়ে গিয়েছিলো।
আশা করি সেই শালা মনির তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। নান্নার কাছে আমি সব শুনেছি।
মদিনার তখন খিনখিন কান্নার আওয়াজ পাওয়া গিয়েছিলো। অনেকক্ষণ তাকে কাঁদতে দিয়েছিলো কেরানি। তারপর হাত বাড়িয়ে মদিনার শরীরে সে রেখেছিলো। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা উঠে বসেছিলো। যেন সাপ! সাপ তার অঙ্গে উঠেছে!
আমাকে তোমার পছন্দ হয় নাই? বলো, পছন্দ হয় নাই?
মদিনা মাথা নাড়ে।
পছন্দ হলে এমন করছো কেন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝো না, বোঝার বয়স তো তোমার!
মদিনার মুখে ভাষা ফোটে। _আমাকে ছাড়ি দেও!
কী বেদনা মেয়েটার স্বরে। কেরানি তখন বলেছিলো, তোমার অনিচ্ছায় কিছু করবো না। আবার যখন আসবো, তখন হবে। নিদ যাও।
মদিনা ঘুমোতে যায়। কিন্তু ঘুম আসে না কেরানির। মদিনার পাশে সে রাত জেগে পড়ে ছিলো। তারপর শেষরাতে উঠে গোসল। আকাশে তখনো রাতের নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। গাছের পাতায় শিশিরের টুপটাপ।
কেরানি কান খাড়া করে ওঠে। কিসের যেন শব্দ। দরোজার বাইরে কারা যেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে অপেক্ষা করে। হাসির হররা ছোটে অকস্মাৎ। মেয়েদের হাসি।
দড়াম করে দরোজা খুলে যায়। রুহিতন ঘরের ভেতরে এসে আছড়ে পড়ে। তাকে ঠেলে ঘরের ভেতর পাঠিয়ে দিয়েছে মেয়েরা। তাদের কলকল হাসির তরঙ্গটাই যেন রুহিতনকে ঘরের ভেতরে এনে ফেলে।
আমরা একটু সময় নিই। সব কিছুই এখন স্থির। আমরাও কেরানির মতো দেখে নিই_ রুহিতন লাল শাড়িতে রঙিন পুতুলের মতো স্থির। আমাদের কেরানিও স্থির। যুবতীর এমন রূপ সে আগে দেখে নাই। মুখে অভ্রের গুঁড়ো, চুলে অভ্রের গুঁড়ো, হাতে চুড়ির লহর, গলায় সোনার হার, নাকে বেশর, নাকের ডগায় একবিন্দু ঘাম_ যেন হীরে!
কেরানির চোখে পলক পড়ে না। এই মেয়ে! এতদিন তাকে দেখেছে সে_ পাড়াবেড়ানি, কলকলানি, মেয়ে বলে হুঁশ নাই, যেন ব্যাটা ছেলেই একটা, ঘোড়ার গা দলাইমলাই করছে, আজ সেই মেয়ে তার বৌ! আর এই তার রূপ! স্বামীর সোহাগের অপেক্ষায় যেন তার শরীরে এখন রাজ্যের জড়তা!
ভুল! কেরানি সাহেব, ভুল! জড়তা কোথায় দেখলে হে? ওই দ্যাখো সে তোমার দিকে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তোমার বোঝার কথা নয়, রুহিতন যে স্থির দাঁড়িয়ে ছিলো, সে কেবল পাড়ার মেয়েদের দরোজার ওপার থেকে সরে যাবার অপেক্ষায়।
রুহিতন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, হইলো তো!
কী_কী_কী হইলো?
তুতলান ক্যা?
কেরানির মনে পড়ে যায় কবুল বলবার সময়ও সে তুতলেছিলো। ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করে সে কথাটা মনে পড়তেই। স্খলিত একটু হাসি তার মুখে ফোটা এখন উচিত ছিলো, কিছু একটা বলা উচিত ছিলো, কিন্তু বোবা হয়ে থাকে সে। কুলকুল করে ঘামতে থাকে। সে শেরোয়ানির বোতাম খুলতে থাকে।
রুহিতন শ্স্স্স্ করে ওঠে।
কান পাইতা আছে।
কে?
আর ক্যাঠা? মাইয়ারা! আগে দুয়ারটা দিয়া লন।
রুহিতন কেরানির অপেক্ষা করে না। নিজেই আলগোছে দরোজার খিল তুলে দেয়। তারপর ঝপাঙ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেরানির বুকে। ফিসফিস করে বলে, জজমিয়া! আপনেরে আমি পেয়ার করি। আপনে?
মানে?
আপনের দিলে পেয়ার নাই?
উত্তরের অপেক্ষা করে না রুহিতন। চকাস্ করে একটা চুমো দেয় কেরানির গালে। হি হি করে হেসে ওঠে। পরমুহূর্তেই বাইরে কানপাতা মেয়েদের কথা স্মরণ করে জিভ কাটে। কেরানি মোহিত হয়ে যায় টুকটুকে তার লাল ঠোঁট দেখে। আহ্, আর কিছুক্ষণ জিভটা বেরিয়ে থাক! কিন্তু চোখের পলকে জিভ চলে যায় মুখের ভেতরে। রুহিতন কেরানিকে ঠেলে বিছানায় নিয়ে যায়।
নিজের হাতে শোরোয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে রুহিতন বলে, আপনে কিন্তু আমারে চুমা দেন নাই! কার লগে বিয়া বইলাম! বব্বর হয়া আছে! আপনের কী হইলো?
কেরানির মুখে তখন ভাষা ফোটে।
তুমি আমাকে আপনি-আপনি বলছো কেন?
এই কথা! তুমার দিলে চোট লাগছে!
শেরোয়ানি থেকে মুক্ত হয়ে কেরানি বিছানার ওপর রাখা পাঞ্জাবির দিকে হাত বাড়ায়।
থাউক!
রুহিতন বাধা দেয়। কেরানিকে জড়িয়ে ধরে বিছানার ওপর গড়িয়ে পড়ে এরপর।
কী করছো!
চাপা খিলখিল হেসে উঠে রুহিতন বলে, যা করনের!
আমাদেরও বাসরে আর থাকার দরকার নাই। এটুকুই বলে এ রাত শেষ করি যে, কেরানি এরপর নিজেকে ছেড়ে দেয় রুহিতনের হাতে। যা করার রুহিতনই করে। একেবারে চূড়ান্ত সময়ে কেরানির একবার আবছা মনে পড়ে মদিনার কথা। মদিনাকে নষ্ট করেছিলো মনির। আর এই রুহিতন, তাকেও কি কেউ নষ্ট করেছে? নইলে এতশত জানলো সে কীভাবে?
কিন্তু এ প্রশ্ন কিংবা সন্দেহের কাঁটা কেরানির মনে স্থায়ী হয় না। সে শরীরের জলতরঙ্গে ভেসে যায়। আমরাও এতক্ষণে এই বাসর থেকে বেরিয়ে এসেছি নিশ্চয়।
রাত যায়, দিন যায়, মাস যায়। কেরানি সংসার করতে থাকে রুহিতনের সঙ্গে। বিয়ের তিন দিন পরে কেরানি যখন লঞ্চের ডিউটিতে যায়, তার শরীর লঞ্চে থাকলেও, মন পড়ে থাকে রুহিতনের কাছে। রুহিতনের সঙ্গে দিন ভিন্ন রাতে তার দেখা হয় না সপ্তাহের ছ’ছটা দিন। মাত্র একদিনই সে বাড়িতে রাতে থাকতে পায়। বাকি দিনগুলো_ ভোরে সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে রিকশা নিয়ে বাড়িতে, তারপর বিকেলে আবার সদরঘাটে গিয়ে বরিশালের লঞ্চে ওঠা। আবার সেই নদী। আবার সেই নদীর বুকে ছলছল করে পানি কেটে লঞ্চের যাত্রা। আবার সেই দিগন্তজোড়া অন্ধকারের বুকচিরে লঞ্চের সার্চলাইটের আলো। সেই লাল বিকন বাতি। যাত্রীদের সেই কলরব। সেই পানির বুকে দোলা। কেরানির মনে হয়, নদী তো নয়, রুহিতনের বুকেই সে ভাসমান!
মদিনা! মদিনার কথা কি তার মনে পড়ে না? মনে না পড়ে উপায় আছে? হস্তিবাড়ি থেকে বুবুর চিঠি আসে_ আবার কবে বাড়ি আসিবা? তার জবাব লিখে পাঠায় না কেরানি। ফোন আসে মোবাইলে_ এখন বিবাহ করিয়াছো, বাড়ির দিকে নজর দিও। কেরানি বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝালো গলায় উত্তর করে_ কেন? আমি কি নিয়মিত টাকা পাঠাই না! বাড়ির দিকে আমার খেয়াল আছে! আবার বুবুর চিঠি আসে_ টাকাই একমাত্র সম্পর্ক নয়। আমরা না হয় কেউ না, মদিনার কথা তোমার ভাবা উচিত।
তারপর একদিন মদিনার চিঠি আসে। ভোরে বরিশাল থেকে সাগর নীল-৩ লঞ্চ এসে ঘাটে ভিড়তেই কোম্পানির পিয়নের হাতে চিঠি পায় সে। খামের চিঠি। ওপরে অচেনা হাতের লেখা। মেয়েলি ছাঁদ। কেরানির বুক সুমসুম করে ওঠে। এ তো বুবুর হাতের অক্ষর নয়! হঠাৎ কানে তার হিহি হাসি আছড়ে পড়ে। তখন সে লঞ্চ থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো, থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
পাগলি! সেই পাগলি! পা ছড়িয়ে বসে আছে ঘাটের কিনারে লোহার পাটাতনের ওপর। পরনে তার শাড়ি। লাল শাড়ি! হলুদ ব্লাউজ! কিন্তু আব্রু ঢাকে নাই। বুকের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। আর, একি! পাগলির পেট যেন চোখে একটু উঁচু ঠেকছে! তার দিকে চোখ পড়তেই কেরানির কেমন খটকা লাগে।
কিন্তু এখন সে নির্ণয়ের সময় নয়। হাতে চিঠি। দেশের চিঠি। চিঠিটা খোলার আগেই কেরানির বোঝা হয়ে গেছে এ চিঠি মদিনার চিঠি। তার প্রথম বৌয়ের চিঠি। প্রথম চিঠি। কী লিখেছে, এক্ষুনি তা পড়ে ফেলা দরকার। কারণ এ চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরা চলবে না। বাড়িতে রুহিতন!
কেরানি বাড়ি ফিরে বরাবর বাড়িতেই নাশতা করে। বরাবর রুহিতন ময়জনমিয়ার হোটেল থেকে তেহারি আনিয়ে রাখে। কেরানি ঘরে ফিরলে গরম করে সমুখে ধরে। শুধু কি তাকেই খাওয়ায়? রুহিতন নিজেও তার সঙ্গে তেহারির নাশতা করে। তারপর রুহিতন প্লেট রেখে ঘরে এসে দড়াম করে দরোজা লাগিয়ে দেয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে কেরানির বুকে। এরপর চুমোয় চুমোয় কেরানিকে নাজেহাল করে রুহিতন ঝটাৎ উঠে পড়ে কেরানির পকেট ব্যাগ তালাশ করে দেখে।
না, কেরানি যে দেশের বাড়িতে আরেকটা বিয়ে করে বৌ রেখে এসেছে, এ কথা রুহিতন জানে না, বুলবুলমিয়া জানে না। রুহিতন যে পকেট ব্যাগ তালাশ করে_ কেরানিকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে নয়। সে টাকা-পয়সার সন্ধান করে। লঞ্চে গত রাতে উপরি কত রোজগার হয়েছে, রুহিতনের সেটাই দেখার বিষয়। বসে বসে সে টাকা গোনে। তুলে রাখে। সপ্তাহে একদিন সে বংশালের মোড়ে ব্যাংকে যায়, টাকা জমা দিয়ে আসে।
রুহিতন কেরানির পকেট হাতড়ে মদিনার চিঠি পেলে আর রক্ষা নাই। ভীষণ ভয় হতে থাকে কেরানির। বাড়ি ফেরার আগেই মদিনার চিঠি পড়ে ফেলতে হবে, ছিঁড়ে ফেলতে হবে। সদরঘাটে চেনা হোটেলে আসে কেরানি। রুহিতনের সঙ্গে বিয়ের আগে এই হোটেলের মালিক নিজামতমিয়ার কাছে রোজগারের উপরি টাকা জমা রাখতো। এখানে বসেই দেশে মানিঅর্ডার পাঠাতো। রুহিতনের সঙ্গে বিয়ের পর সে পাট তার উঠে গেছে।
আজ হোটেলে তাকে ঢুকতে দেখে নিজামতমিয়া কাউন্টার থেকে ডাক দেয়, আরে, আইজ সুরুজ মনে হয় পচ্চিমে উঠছে! বহুত রোজ পরে আইলেন মাস্টোর!
কেরানিও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বলে, হ, আইলাম!
নিজামতমিয়া চোখ সরু করে বলে, থোড়া বেচইন দেহি আপনেরে!
না, না, কিছু না।
কেরানি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তার চেহারায় কি এতই উদ্বেগ ফুটে উঠেছে যে দুনিয়ার নজর এড়ায় নাই! বসে পড়তে পড়তে সে হেসে বলে, বিবিছাবের শরীল ভালা না! কইছে, ঘাট থিকা নাশতা কইরা আইবা।
তয়, তার লাইগা ভি কিছু লয়া যান। অই, দ্যাখ মাস্টোরে কী চায়?
কেরানি ভেবে দেখে, মন্দ না। রুহিতনের কাছে মদিনার চিঠি যখন গোপন করতেই হবে, তখন তাকে একটু তোয়াজ করা ভালো। চোখেমুখে যদি উদ্বেগ থেকেই থাকে শেষ পর্যন্ত, তবে তার নাশতা নিয়ে আসার খুশিতে রুহিতনের সেটা চোখে পড়বে না। সে টানা পরোটা, মচমচে গরম পরোটা ভেজে দিতে বলে বাড়ির জন্যে, আর খাসির পায়া। হাঁ, রুহিতন খুশি হবে।
চিঠিটা খোলে কেরানি। খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বের করতেই ভুরভুরে একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। আতরের ঘ্রাণ! চিঠির ভাঁজ খুলতেই ঝরে পড়ে কয়েকটা শুকনো বকুল ফুল।
চিঠির প্রথম ছত্রেই লেখা_ শতকোটি কদমবুছির পর অধীনার আরজ এই, আপনার চরণদাসীর কথা কি একটুও মনে পড়ে না! এত দিবস গত হইলো, কোনো সম্বাদ নাই। পত্র লিখার কাগজ ও কালি কি এতই দুর্মূল্য। পথ চাহিয়া দাসীর চক্ষু এখন অন্ধ।
কেরানির চোখ ভিজে ওঠে। মদিনার মুখখানা ভেসে ওঠে তার ঝাপসা চোখে।
নিজামতমিয়া কাউন্টার থেকে নেমে আসে। কেরানির পাশে দাঁড়ায়।
কার চিঠি, মাস্টোর? দ্যাশ থিকা কুনো খরাব খবর নি?
কেরানি মাথা নাড়ে। সজোরে। চোখ থেকে তখন টপটপ করে পানি পড়ে কয়েক ফোঁটা।
নিজামতমিয়া পাশে বসে পড়ে। কেরানির কাঁধে হাত রেখে বলে, পুরুষমানুষ! চক্ষে পানি আনতে নাই। উপরে আল্লা আছে, সব তার হাতে, সব ঠিক হয়া যাইবো। দিলে সাওস আনেন।
[চলবে]