নায়কের সঙ্গে আমি

nayokerআমার নাম সুনয়ন চৌধুরী। এখন আমার বয়স ৪২। ১২ বছর আগে আমার বয়স যখন ৩০, আমি বিয়ে করি। আমার মনে হয়েছিল বিয়ে করার জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। আর, বিনুকেও আমার পছন্দই হয়েছিল। আমার স্ত্রীর নাম বিনু, নাসিমা আখতার বিনু। আমাদের ১ ছেলে ১ মেয়ে। মেয়েটি বড়, বয়স ১০, ওর নাম অনিন্দিতা, আমরা ওকে অনি বলে ডাকি। অনি যখন হলো, আমরা, আমি আর বিনু, ঠিক করলাম এই একটি সন্তানকে আমরা মনের মতন করে মানুষ করে তুলব। এ রকম, এই স্বাভাবিক ভাবনার ৩-৪ মাস পর টের পেলাম ব্যাপার অন্য রকম। বিনু বলল, দোষ আমার, আমি বললাম—বারে, তুমি খেয়াল করবে না! এই দ্বিতীয় সন্তানটিকে আমরা আনতে চাইনি। অনিন্দিতা তখন একেবারেই ছোট, তাকে সামলাতেই বিনুর যায় যায় অবস্থা! এ সময় আরও একটি সন্তানের কথা ভাবা যায় না। বিনু শারীরিকভাবেই ওই ধকল নিতে পারবে না। বাচ্চা বড় করে তোলারও ব্যাপার আছে।

বাচ্চাটাকে আমরা চাচ্ছি না এ কথা কাউকে জানাইনি। জানাইনি মানে, ও রকম একটা ঘটে গেছে, এটাও কেউ জানত না। আমরা কাউকে না জানিয়ে এদিক-ওদিক চেষ্টা চালালাম। লাভ হলো না। আমাদের অধিকাংশ জায়গা থেকে জানানো হলো, বাচ্চা বড় হয়ে গেলে। এখন ব্যাপারটা রিস্কি। বিনু আমাকে বলল—তোমার দোষ, তুমি খোঁজ-খবর নিতে দেরি করে ফেলেছ। আমি এটা মেনে নিলাম না, আমি বললাম— উঁহু, খোঁজ-খবরে নয়, আমাদের সময় নষ্ট হয়েছে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে। ২/১ জায়গায় অবশ্য বলল, তারা ব্যাপারটা সেরে নিতে পারবে, আরো অ্যাডভান্সড স্টেজের কাজও তারা সেরেছে, ভয়ের কিছু নেই, তবে পয়সা কিছু বেশি লাগবে। পয়সা বেশি লাগবে বলে নয়, আমরা সরে এলাম কারণ আমার কিংবা বিনুর কারোরই সাহস হলো না।

আমি বিনুকে জিজ্ঞেস করলাম—বিনু, একটা কাজ করবে?

বিনু আমার দিকে তাকাল। এমনভাবে তাকাল যেন ও জানতে চাচ্ছে আমি কী বলব। আমার ধারণা ও জানত আমি কী বলব। আমি বললাম—অনিন্দিতার যদি একটা সঙ্গী হয়, মন্দ কী, ধরে নাও, ব্যাপারটা এভাবেই নির্ধাতির হয়েছিল। স্রষ্টা হয়তো এভাবেই চাচ্ছেন।

বিনু কপট রাগ-রাগ চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল—অনির যদি একটা সঙ্গী হয়, তবে ব্যাপারটা মন্দ হয় না। শুধু ছোট একটা সমস্যা, কষ্ট যা কিছু আমারই হবে, তোমার কোনো ধকল সামলাতে হবে না।

আমি সামান্য হাসলাম—আমাকেও সামলাতে হবে। টেনশন।

সে তো তোমার জন্য ভালো। সিগারেট টানা আরো বাড়িয়ে দিতে পারবে।

শোনো, তাহলে নতুন বাবুটাকে আমরা আনছি।

আমাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই খুব মজা পেল। কিছু মন্তব্য আমাদের বেশ বিব্রতও করল। তবে নির্দোষ রসিকতাই বেশি। দু-একজন যে আমাদের পক্ষে দাঁড়াল না, এমনও নয়। যারা আমাদের পক্ষে দাঁড়াল, তারা বলল—এটা একটা ভালো ডিসিশন। একটু কষ্ট হবে ঠিক, কিন্তু এক ধাক্কায় দু বাচ্চা মানুষ হয়ে যাবে। ওরা যখন বড় হয়ে যাবে একসঙ্গে, তখন সুবিধাটা বুঝবে।

আমাদের দ্বিতীয় বাচ্চাটি ছেলে। ওর নাম আমরা রেখেছি সোম। চাঁদ—এই অর্থে সোম।

আমাদের এক বন্ধু কায়সার, বোকা বোকা ভাব ধরে বেশ ইয়ার্কি মারতে পারে, বলল—আচ্ছা, অনিন্দিতার নাম বদলে রবি রাখবে কবে?

বোকা বনে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, মানুষ এখানে অধিকাংশ সময় ঠেকেও শেখে না। মানুষ বারবার বোকা বনে, তারপর আবারও সেই একই ফাঁদে পা বাড়ায়। যেমন আমি জানি ওটা হয়তো কায়সারের ইয়ার্কিই, তবু ওর কথাটা আমি সিরিয়াসলি নিলাম। ভুরু কুঁচকে গেল আমার, আমি জিজ্ঞেস করলাম—কেন, বলো তো?

কায়সার বলল—নামের অর্থ বিচার করতে গেলে মানানসই হয়। রবি সূর্য সোম চন্দ্র, আবার…।

আবার কী—সেটা জানার জন্য আমি কায়সারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আবার দিনে দিনে তোমাদের বাচ্চা হয়, এটাও বোঝানো যাবে। রবিবারে একটা, সোমবারে একটা…মঙ্গলবারেরটা এখনো জানি না।

এ রকম আরো কিছু কথা আমাদের শুনতে হলো। তারপর দিন পার হলো বেশকিছু। এখন আমাদের কপালে প্রশংসাই জোটে বেশি। প্রায় সবাই বলে, তোমরা যে পরপর দুটো বাচ্চা নিয়ে নিয়েছ, এটা ছিল একটা ওয়াইড ডিসিশন। এখন অনিন্দিতা আর সোম বড় হয়ে গেছে। বড় হয়ে গেছে মানে একজন ফোরে পড়ে, অর একজন থ্রিতে। ওরা দুজনই হয়েছে এক কথায়—চমত্কার। আমাদের যত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই ওদের প্রশংসা করে। এ বয়সে এত গোছানো, এত কম কথার বাচ্চা নাকি হয় না। এসব মন্তব্য বিনু খুব উপভোগ করে। কারণ অনিন্দিতা আর সোমের পেছনে সত্যিই সে অনেক সময় দিয়েছে। আবার সেজন্যই সম্ভবত, কেউ যদি কখনো এ রকম মন্তব্য করে যে, তোমার তো দু বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতেই হয় না, ওরা এত ভালো, এত গোছানো—বিনু খেপে যায়। বলে আচ্ছা বলো তো, ওরা কি এমনি এমনিই এ রকম হয়েছে, ওদের কি আমি এভাবে বড় করে তুলিনি! আমার ক্রেডিটটা কেউ দিতে চায় না কেন?

অনি আর সোম পরপর দু বছরে হয়ে গেছে, এখন অনেকেই আমাদের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে। এ তথ্য অবশ্য এই একটু আগেই দিয়েছি। যারা প্রশংসা করে আমাদের এই সিদ্ধান্তের কিংবা যারা করেও না, আমরা তাদের কাউকে কখনো বলিনি, এ ব্যাপারটা আমাদের সিদ্ধান্তমাফিক ঘটেনি। বলিনি—এর পেছনে কারণ আছে নানা। ভাবলে প্রথম ধাক্কায়ই এটা একটা লজ্জার ব্যাপার…। আচ্ছা, সব কারণ বলার দরকার নেই। মূল কারণ বলি—আমরা যদি সবাইকে জানিয়ে দেই সোমকে কনসিভ করার ব্যাপারটা ছিল দুর্ঘটনা, সোম তাহলে হয়ে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান। সোম একসময় ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, এটা আমরাই ভাবতে চাই না, অন্য কাউকে কেন তা ভাবতে দেবো! তবে যদিও এটা আমরা ভাবতে চাই না কখনো, এই ব্যাপারটা আমাকে আর বিনুকে মাঝে মাঝে বিব্রত করে।

সোম হয়তো আমাদের কোনো কথা বলে হাসিয়ে গেল খুব। ও মানুষদের নকল করতে পারে দারুণ। আমাদের হেসে একাকার হতে হয়। কিংবা অন্য কিছু করেও হয়তো আমাদের উদ্ভাসিত করে তুলল, এসব সময়ে আমরা… না, আমরা না, বিনু কখনো ওই কথা নিজে থেকে তোলে না, যেকোনো ব্যাপারই মেয়েরা আসলে অনেক সহজে এবং আপাতনির্বিকারভাবে নিজের ভেতর রেখে দিতে পারে। বিনু বলে না, আমি ও রকম সময় হঠাত্ কখনো বলে ফেলি—বিনু, এই ছেলেটাকে আমরা আনতে চাইনি।

বিনু তড়িঘড়ি বলে—দেখো, আমরা কি জানতাম?

কিন্তু তোমার ভেতর যে একজন আছে, এটা জানতাম।

বিনু মৃদু গলায় বলে—দেখো, না-আনার সিদ্ধান্তটা আমরা দুজন মিলেই নিয়েছিলাম।

আমি তোমার ওপর কোনো দোষ চাপাচ্ছি না। না-আনার সিদ্ধান্তটা অমাাদের দুজনেরই ছিল। ঠিকই আছে। সিদ্ধান্ত একজন নিয়েছিলাম না দুজন মিলে, এটা ব্যাপার না, ব্যাপার হচ্ছে, ও রকম একটা সিদ্ধান্ত…।

বিনু কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

ও রকম একটা ঘটনা যদি ঘটে যেত, আমাদের সোম থাকত না।

তাহলে সোমের অভাবও আমরা অনুভব করতাম না।

সে বুঝি। তবু ভাবলে কেমন লাগে—এই যে সোম, ও পৃথিবীতে কোথাও নেই। ও এই পৃথিবীতে আসেইনি।

তুমি আর বোলো না, আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

কিন্তু বিনু, জীবন তাহলে কী! তখন যদি ঘটনাটা সম্ভব হতো, তাহলে সোমের এই জীবনটা থাকত না।

না-থাকলে কি আমরা বুঝতে পারতাম সোমের এই জীবনটা নেই?

তা পারতাম না।…আসলে বিনু আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।

আমি বিনুকে বোঝাতে পারি না। আমি যতই জীবনের রহস্য ও না-বোঝার দিকগুলোর দিকে যেতে চাই, ততই ও চলে আসে পারিবারিক পরিধির সীমিত পরিসরে। এক অর্থে এটাই ভালো, জীবনের রহস্য নিয়ে মাঝে মাঝে আমার মতো বিনুও বিব্রত বোধ করুক, এর দরকার নেই।

আমি নিজেও কখনো কখনো এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। হ্যাঁ এটা ঠিক কথা, সোম না থাকলে সোমের অনুপস্থিতি আমরা অনুভব করতাম না। কিন্তু এটা আমাকে কে জানাবে—আমাদের এই সোম যদি না আসত, তবে কোথায় যে, কোথায় থাকত!

সোমের কথা যাক, এবার কিছু অনিন্দিতার কথা বলি। অনিন্দিতা খুব সুন্দর গান গায়। সব ধরনের গান। বোম্বের সিনেমার গান দিয়ে শুরু। ওর যখন ৫ বছর বয়স, আমি একদিন অবাক হয়ে শুনি, ও ‘চিজ বড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত’ গাইছে। টিভি থেকে শুনতে শুনতেই ওর গান শেখা।

ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা বলে একটা ব্যাপার আছে, প্রকৃতিপ্রদত্ত আসলে সেটা অনিন্দিতার আছে। ওর সুর নিখুঁত, তাল-লয় জ্ঞান দারুণ। এর জন্য গানের মাস্টার রেখে দেওয়া হয়েছে, ও খুব মন দিয়ে গান শিখছে।

সাধারণত এ রকম হয়—মেয়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভালো হয় আর ছেলের সঙ্গে মা-র। আমাদের বাসার হিসাবটা ঠিক সে-রকম না। আমাদের ৪ জনের সম্পর্ক সমান সমান। অনিন্দিতা ওর সমস্যার কথা মাকে যেমন বলে, তেমনি বলে আমাকেও। সোমের আবদার আমাকে যেমন মেটাতে হয়, তেমনি ওর মাকেও। আমাদের ৪ জনের সম্পর্কটা আসলে দারুণ। সোম আর অনিন্দিতা একদম বন্ধুর মতো। সোম সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। ও অনিন্দিতার ছবি এঁকে দেয়। আর অনিন্দিতা, ‘আয় তোকে গান শেখাই’ বলে সোমকে গান শোনায়। সোম বসে থাকে অনিন্দিতা গান গায়—‘আকাশ ভরা চন্দ্র তারা..’। পাশের ঘরে বসে আমরাও সেই গান শুনি। গান শুনতে শুনতে কখনো বিনুর দু চোখ ভিজে যায়। আমি আর বিনু আমরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ যে কখনো আমারও ভেজে, পুরুষের অহমিকায় আমি সেটা বিনুকে বুঝতে দিতে চাই না।

বিনুর কথা কিছু বলা দরকার। বিনু মেয়েটা ভালো, এত ভালো যে আমি মাঝে মাঝে ওকে জিজ্ঞেস করি—আচ্ছা বিনু, তুমি কি বলতে পারবে তুমি এত ভালো কেন!

আমি এ রকম কোনো কথা বললে বিনু খুব লজ্জা পেয়ে যায়। আমার কথার পিঠে কথা না বলে কিংবা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ও তখন বারবার শুধু বলে—কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য!

ঠিকই বলছি। তুমি আশ্চর্য রকম ভালো।

আরে, এসব কী আরম্ভ করেছ তুমি!

বিনু যে সত্যিই খুব ভালো মেয়ে। এটা আমি যত না বলি, বাইরের লোক সম্ভবত তার চেয়ে বেশি বলে। কেউ কেউ এ রকমও বলে—বাবুর আর চিন্তা কী! ওর চিন্তাও নেই ঝামেলাও নেই। বিনু ওর সবকিছু সামলে রেখেছে।

এ কথা ঠিক, এ সংসার বিনু একার হাতেই সামলে রেখেছে। গোছানো মানুষ বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক সে-রকম নই। সাংসারিক বুদ্ধিও, আমি সেটা সময়ে অসময়ে নিজেই বুঝি, আমার যথেষ্ট কম। এই যে আমাদের সংসারটা গোছানো, এই যে আমাদের বাড়িতে ঢুকলে অনেকের চোখ জুড়িয়ে যায়, এর পুরো কৃতিত্ব বিনুরই। আমার ও বিনুর সম্পর্ক ঠিক প্রচলিত স্বামী-স্ত্রী ধরনের নয়। এখনকার অনেক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই বন্ধুর মতো, আমাদের সম্পর্কও অনেকটা ও রকম। আমরা দুজন দুজনকে ভালো বুঝি, একজনের সমস্যা আরেকজন শেয়ার করতে চাই এবং একজনকে অন্যদের সামনে বড় করেই তুলতে চাই। আমরা দুজন খুব ভালো জানি বাইরে আমাদের সম্পর্কে কী কথা প্রচলিত। আমরা নাকি আদর্শ জুটি, মেড ফর ইচ আদার।

আমি বিনুকে খুব ভালোবাসি, বিনুও আমাকে। আমরা বেড়াতে যাই, ঘরে থাকলে একসঙ্গে সময় কাটাই। ছুটির দিন বিকালে বারান্দায় বসে চা খাই, কোনো কোনো রাতে হুইস্কি। আমার হুইস্কি খাওয়া নিয়ে বিনুর কোনো আপত্তি নেই। তবে কাজটা ঘরে সারলে বিনু বেশি খুশি, আর খাওয়ার পরিমাণটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাক, এটা ও কখনো চায় না। আমি ওর ইচ্ছার মূল্য দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

বিনু অবশ্য একটু বোকা। এটা বাইরের কোনো লোক টের পাবে না। পাওয়ার কথাও না। তবে আমি বুঝি, এক ছাদের নিচে বাস করলে এ রকম অনেক কিছু বোঝা যায়। হয়তো আমাকে নিয়ে বিনুও অনেক কিছু বোঝে, যেটা বাইরের কারো চোখে ধরা পড়া দূরের কথা, আমার চোখেও ধরা পড়ে না। বিনু কিছুটা বোকা, কিছুটা বোকা বোধহয় সব মানুষই, তা ছাড়া বোকা কিছুটা হলে সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। যেমন বিনুকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় না। আমি শুধু মাঝে মাঝে টের পাই বিনু কিছুটা বোকা—এই এটুকুই। কিংবা এমনও হতে পারে বিনু আসলে বোকা না, ও খুব বেশি ভালো মানুষ বলে হয়তো কখনো কখনো ওকে বোকা মনে হয়। মানুষের ভালো মানুষীকে আমরা তো অনেক সময়ই বোকামি হিসেবেই বিবেচনা করি।

সে যাক, বিনু একটু বোকা হোক কিংবা অতিরিক্ত ভালো মানুষ; আমরা আমি আর বিনু ভালো আছি। কেমন ভালো আছি, তার একটা উদাহরণ দেই। ধরা যাক, কোনো রাতে একটু শীত শীত পড়ছে। আমি বারান্দায় বসে ছোট ছোট চুমুকে হুইস্কি খাচ্ছি। আমার পাশে বসে আছে বিনু। আমরা পরচর্চাসহ রাজ্যের গল্প করছি। কিছুটা হয়তো রাতও হয়েছে। চারদিকে চুপচাপ, আর আমাদের বারান্দাটা এমন জায়গায় বহুদূর পর্যন্ত চোখ যায়। রাতের আকাশের গায়ে ফুটে আছে অনেক অনেক তারা। কখনো আকাশের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি। তারপর হয়তো আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে আমি খুব গম্ভীর গলায় বিনুকে জিজ্ঞেস করি—আচ্ছা বিনু, আমরা কি সুখী?

আমার কথা শুনে বিনু হাসতে আরম্ভ করে।

হাসছ কেন?

এই তোমার ওসব কথা আরম্ভ হলো না?

আহা, বলোই না।

বিনুর হাসির শব্দ আমি আর শুনতে পাই না, কিন্তু ওর দিকে না তাকিয়েও আমি বুঝি উজ্জ্বল এক হাসিতে এ অন্ধকারেও উদ্ভাসিত হয়ে আছে। মৃদু গলায় ও বলে—এ কথা কি আর জিজ্ঞেস করতে হয়! আমরা যদি সুখী না হই, তবে সুখী কে?

আমরা কি সুখী? এই কথা আমি জিজ্ঞেস করি বিনুকে, বিনু যখন পাশে থাকে তখন, আবার কখনো, বিনু যখন পাশে থাকে না, তখনো এই কথা আমি জিজ্ঞেস করি।

দুই .

আমার নাম সুনয়ন চৌধুরী। আমার ডাক নাম বাবু। আমার বাবার নাম শফিউল্লাহ প্রধান। শফিউল্লাহ প্রধানের ছেলে কেন সুনয়ন চৌধুরী হবে, এটা আন্দাজ করা মুশকিল। তবে আকছার হচ্ছে। সে যাক, হয়েছে যখন, হয়েছে। মফস্বল শহরে আমার বাবা কবিরাজি প্র্যাকটিস করতেন। বেশ নাম ছিল তার, রোগীর অভাব কখনো হয়নি। মফস্বল শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে আমাদের বেশকিছু জমি ছিল। বাবা জমিজমার মানুষ নন, পৈতৃকসূত্রে পাওয়া তার জমিগুলো হেলাফেলায় পড়ে ছিল। ঐ জমির কিছু অংশ দখল করে নিল হুমায়ূন চৌধুরী। তিনি ধান-ভাঙানোর কল বসিয়েছেন, জায়গায় কুলোচ্ছে না, সুতরাং একটু ঠেলে অন্যের জমিতে ঢুকে পড়া। এই গল্প আমার জন্মের আগের, পরে আমি আত্মীয়স্বজনের মুখে এসব শুনেছি। তা হুমায়ূন চৌধুরী মাথা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে একসময় বাবার জমিতে তার পুরো শরীর ঢুকিয়ে দিলেন। এ ঘটনার বছর দুয়েক আগে হুমায়ূন চৌধুরীর ‘যায় যায় অবস্থা’ ধরনের জন্ডিস হয়েছিল। তাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন বাবা। হুমায়ূন চৌধুরী সুস্থ হয়ে উঠে বাবার দু হাত নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলেছিলেন—শফি সাহেব, আপনি আমাকে কিনে নিলেন।

সুস্থ করে তোলার প্রতিদান যখন এভাবে এল, বাবা কতক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন। তারপর আমার বড় মামাকে বললেন—ভাইজান, একটু চলেন তো, চৌধুরীদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

এর পরের গল্প বড় হয়ে বড় মামার মুখ থেকে শোনা।

বাবা বড় মামাকে সঙ্গে নিলেন, হুমায়ূন চৌধুরীর বাড়িতে গেলেন, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী সাহেব, কেমন আছেন?

জি ভালো, জি ভালো। আপনি তো আমাকে সুস্থ করে তুললেন।

তখন আপনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, মনে আছে?

কী বলেছিলাম শফি সাহেব, বলেন তো?

আপনি বলেছিলেন, শফি সাহেব, আপনি আমাকে কিনে নিলেন।

জি জি বলেছিলাম। আমি এখনো সে-রকমই মনে করি।

তা হলে আমার জমি না-কিনে দখল করে নিলেন কেন?

হুমায়ূন চৌধুরী চুপ করে থাকলেন।

আমি যখন আপনাকে কিনেই নিয়েছি, তখন আপনিও আপনার যেটুকু দরকার সেটুকু জমি আমার কাছ থেকে কিনে নিলেই পারতেন।

হুমায়ূন চৌধুরী হাসার চেষ্টা করলেন।

আপনি এ রকম বাজে লোক, এটা জানলে আমি আপনাকে ভালো করে তুলতাম না, বরং আপনি যেন ভালো না হন, সে চেষ্টাই করতাম।

হুমায়ূন চৌধুরী সামান্য হেসে বললেন—কথাটা কিন্তু একজন ডাক্তারের মতো হলো না।

আরে রাখেন, এসব নীতিকথা আমাকে শোনাবেন না। আগে আমি সাধারণ মানুষ, তারপর ডাক্তার।

হুমায়ূন চৌধুরী গম্ভীর হয়ে থাকলেন।

এখন এক কাজ করেন। বাকি জমিও আপনি নিয়ে নেন।

ওই লোক বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

বাবা বললেন—বাকি জমিও আপনি নিয়ে নেন। তবে দখল না কিনে নেন।

বাড়ির সবাই এবং পরিচিতজন যারা আছেন, তারা সবাই বাবার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন। কিন্তু বাবা ওই জমি রাখবেনই না এবং হুমায়ূন চৌধুরীকেই সে জমি কিনে নিতে হবে। হুমায়ূন চৌধুরী সে জমি কিনে নিলেন। বাজারে যে দাম তখন, তার চেয়ে বেশি দামে কিনলেন। হুমায়ূন চৌধুরীর এই আচরণে অনেকে অবাক হলেন। বাবা তার সঙ্গে যে ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তাতে স্বভাব-চরিত্র অনুযায়ী হুমায়ূন চৌধুরীর জন্য মানানসই হতো বাবার জমি দখল করে নেওয়া। ওই লোক অমন কিছু করলে বাবার জন্য তা সামাল দেয়া কঠিন হতো। তা ওই লোক সে-রকম কিছু করলেন না, বাবার সব জমি ভালো দামে কিনে নিলেন এবং বাবাকে বললেন—শফি সাহেব, আমি খুবই দুঃখিত।

বাবা তার পেশা কবিরাজির পাট চুকিয়ে ফেললেন। সবাই খুব অবাক হলো—আশ্চর্য ব্যাপার, এ রকম পসার থাকার পরও…। বাবা বললেন—বিরক্তি ধরে গেছে।

কিসের বিরক্তি? সবাই জানতে চাইলেন।

বাবা বললেন—চিকিত্সা করে কোনো লাভ হয় না। এক অসুখ সারে তো আরেক অসুখ থেকে যায়। সব অসুখের চিকিত্সা কি আমি জানি?

এ সময় আমার জন্ম হয়েছে। আমার আগে আমার এক ভাই ও এক বোন আঁতুড় ঘরেই মারা গেছে। আমি টিকে গেলাম, যদিও আমাকে ঘিরেও অনেকেরই ওরকম সন্দেহ ছিল। আমি শুধু টিকে গেলাম, নাম রাখলেন—বাবু। সবাই আমাকে ওনামেই ডাকতে আরম্ভ করলেন। বাবু খুব প্রচলিত নাম। প্রতি একান্নবর্তী পরিবারে একটি দুটি বাবু পাওয়া যাবে। বাবা আমার ভালো নাম রাখলেন সুনয়ন চৌধুরী। শফিউল্লাহ প্রধানের ছেলের নাম সুনয়ন চৌধুরী।

বাবা বললেন—আমি চাই আমার ছেলের নাম ‘সু’ হোক। ভালোটা দেখবে।

শুধু ভালোটাই দেখবে? সেটা হয়? না হওয়া উচিত?

না, খারাপটাও দেখবে। তবে যে ‘সুনয়ন’, সে ভালোটা করবে।

আর চৌধুরী? নামের শেষে কেন চৌধুরী লাগাতে হবে?

মানুষ হিসেবে চৌধুরীরা যে কতটা ভালো হয়, সেটা প্রমাণ করবে।

সব চৌধুরীই খারাপ, এটা কোনো কথা হতে পারে না।

আমি সবচেয়ে কাছ থেকে যে চৌধুরীকে দেখেছি, সে খুবই খারাপ।

কিন্তু তোমার ছেলে ভালো হলে এমনিতেই হবে, তাকে চৌধুরী হয়ে সেটা প্রমাণ করতে হবে না।

সে আমি জানি। কিন্তু এটা আমার একটা জেদ।

তোমার ছেলে ভালো হলেই চৌধুরীরা ভালো, এটা প্রমাণ হবে না। কারণ তোমার ছেলে প্রথম থেকে চৌধুরী নয়।

প্রথম থেকে কেউই চৌধুরী না।

অনেকের মনে হতে পারে আমার বাবার মাথায় কিছু সমস্যা ছিল। আমার সে-রকম কখনো মনে হয়নি। এমন হতে পারে, বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম, তাই সব সময় পাশে থেকেও বাবার সে-ধরনের কোনো সমস্যা আমার চোখে পড়েনি। কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো কাছে থাকলে বোঝা যায় না। আবার কিছু সমস্যা বুঝতে হলে কাছে থাকাটাই জরুরি। এমনও হতে পারে, আমি যদি বাবাকে দূর থেকে দেখার সুযোগ পেতাম, তার মাথায় অল্প হলেও সমস্যা আছে কি-না আমার পক্ষে বোঝা সহজ হতো। কাছে থেকেই হয়তো আমি বাবার ওদিকটার কিছুই দেখিনি।

আমার যখন ৩ মাস বয়স, বাবা মফস্বল শহরের পাট চুকিয়ে শহরে চলে এলেন। বাবার এই সিদ্ধান্তও সবার মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করল। বড় মামা বললেন—তুমি কবিরাজি বন্ধ করে দিলে, আবার ঢাকা শহরে যাচ্ছ!

বাবা বললেন—যাচ্ছি। এটাই ভালো হবে।

কী করবে ঢাকা যেয়ে?

চাকরি। বাবার ছোট উত্তর।

চাকরি করার কী দরকার? এখানে তো ভালোই আছ।

আছি।

তা হলে?

পুরনো জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় যাওয়া ভালো। মানুষের এই ইচ্ছাটা থাকা উচিত।

বেশ। বড় মামা আর কথা বাড়ালেন না। তোমার যা ইচ্ছা।

বড় মামার ইচ্ছা ছিল বাবা আর মা এখানেই থেকে যাবেন, ওই মফস্বল শহরে মামাদের পাশের বাড়িতেই। আমার বোঝার বয়স হলে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি—মামা তার ছোট বোনকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তিনি কখনো চাননি তার ছোট বোন তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাক। মাও সম্ভবত বাবাকে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে বুঝিয়েছিলেন। মা-র মুখে আমি পরে শুনেছি, বাবা বলেছিলেন—সুনয়নকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে।

মা রাগ আর অভিমানের সঙ্গে বলেছিলেন—এখানে থাকলে কি বাবু মানুষ হবে না? এখানে যারা আছে, তারা কি মানুষ হচ্ছে না?

হচ্ছে। তবে তাদের বড় হওয়ার সঙ্গে আমি যেভাবে সুনয়নকে বড় করে তুলতে চাই, তার পার্থক্য আছে।

মা এটা নিশ্চয় জানতেন, বাবার সঙ্গে কথা বলে পারা যায় না।

বাবা বললেন—সুনয়নকে মানুষ করার জন্য একটা জায়গা দরকার। তুমি দেখবে বাবুর মা, আমাদের সুনয়ন একদিন বড় হবে। তুমি আর সবার সঙ্গে ওর তুলনা করতে যেও না।

আমরা ঢাকা চলে এলাম। বাবা একটা চাকরি জোগাড় করে নিলেন। তখন চাকরি জোগাড় করা এখনকার মতো এত কঠিন ছিল না। আমার বাবার বিদ্যা ছিল। সে বিদ্যা অনুযায়ী একটা চাকরি হয়ে গেল। চাকরি যদি নাও হতো তাতেও কোনো অসুবিধা হতো বলে মনে হয় না। বাবার হাতে তার জমি বিক্রির টাকা ছিল। সে টাকা যদি নাও থাকত, বড় মামা ছিলেন। যদি এমন হতো, বাবা কিছুই করেন না, বছরের পর বছর বড় মামাকে আমাদের সংসার টেনে যেতে হচ্ছে, বড় মামা সেটা অম্লান বদনে করে যেতেন।

ঢাকা আসার বছর তিনেক পর আমার একটা বোন জন্মাল। বাবা ওর নাম রাখলেন সুদীপ্তা। বাবার মুখেই পরে শুনেছি, এতে আমার দু মামাই খুব খেপে গেলেন। ছোট মামা খুব চাঁছাছোলাভাবে কথা বলতেন। তিনি বললেন—শফি, তুমি কি হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নেবে ভেবেছ?

এ রকম কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন!

ছেলের নাম রাখলে সুনয়ন, মেয়ের নাম সুদীপ্তা। কেন, মুসলমান নাম কি পাওয়া যাচ্ছে না?

নামের আবার হিন্দু-মুসলমান কী?

শোনো, হিন্দু কিন্তু হওয়া যায় না। ইচ্ছা করলেই কেউ হিন্দু হতে পারে না।

শোনেন, আপনি বাংলা বাদ দিয়ে আরবিতে কথা বলতে আরম্ভ করেন না।

আমি কেন আরবিতে কথা বলতে আরম্ভ করব!

ছেলেমেয়ের নাম বাংলায় রেখেছি বলে আপনার যখন এতই আপত্তি…।

আমি এটা বেশ পরে বুঝতে পেরেছি যে বাবার আসলে ছিল জেদ। বাইরে থেকে এই জেদটা বোঝা যেত না। কিন্তু তাকে তার অবস্থান থেকে সরানোও ছিল প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। বাবা যেহেতু আমাদের দুজনের নাম রেখেছেন বাংলায়, সুতরাং এর পক্ষে তিনি অনড়। যদি এমন হয়েছে, আমাদের নাম রাখা হয়েছে আরবি ধরন অনুযায়ী, তাহলে ওর পক্ষেই বাবা অনড় থাকতেন। এই যে বাবা আমাদের নাম রেখেছেন সুনয়ন আর সুদীপ্ত, আমার ধারণা বাবার এটা একটা শখ। বাবা ভেতরে ভেতরে অনেকটাই শৌখিন মানুষ ছিলেন। আর ছেলেমেয়েদের নাম অন্যরকম, সবাই একটু না একটু অবাক হচ্ছে, বাবা এতেও খুব মজা পাচ্ছেন।

বাবা আমার ছোট বোনের নাম রাখলেন সুদীপ্তা, আমার মামারা ওকে ডাকতে আরম্ভ করলেন ‘বেবী’। আমার ডাকনাম বাবু। বাবুর ছোট বোনের নাম বেবী, এই হচ্ছে ব্যাপার। বেবী নামটাই ছড়াল। সুদীপ্তা নামটা কঠিন এবং অপরিচিত। সে তুলনায় ‘বেবী’ অনেক বেশি আপন ও পরিচিত। এই যে বেবী নামটাই ছড়াল বেশি, এ নিয়ে বাবার একটুও মন খারাপ হলো না। বরং বাবাও ওকে বেবী বেবী বলেই ডাকতে আরম্ভ করলেন। বাবার বক্তব্য ছিল এ রকম—বেবী হচ্ছে ঘরোয়া নাম, পারিবারিক পরিমণ্ডলে। অতি নিকটজনের কাছে হচ্ছে ‘বেবী’, আর সুদীপ্তা হবে ওর সামাজিক পরিচিতি। বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে ও হবে—সুদীপ্তা। দীপ্তি ছড়াবে।

বাবার কোনো যুক্তিই আমার কাছে অবান্তর মনে হয়নি। যুক্তি তৈরি করে নেয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল মানুষটার। আবার ছিলও না, যুক্তির বাইরে তাকে আমি অসংখ্যবার হাঁটতে দেখেছি, এই মানুষটাই একসময় নিজেই বলতে আরম্ভ করলেন—মানুষের জীবনে কোনো যুক্তি নেই, কোনো যুক্তিই নেই মানুষের জীবনে। এ অবশ্য বেশ পরের কথা। এ কথায় আমি পরে আসছি।

ঢাকা শহরে আমাদের জীবন ছিল চমত্কার। বাবা তো এখানেই খুশি, ছোটবেলায় বুঝতাম না—এ শহরে থাকাটা মা-র কতটা পছন্দের বা অপছন্দের, তবে বাবার মতো আমার আর বেবীর জীবনও ছিল খুশির। আমাদের বাড়িটা ছিল গলির ভেতরে। তবে এখনকার গলির সঙ্গে সে-সময়ের গলির তুলনা করলে ভুল হবে। গলি ছিল ফাঁকা, আমরা ওখানে কত কী খেলতাম! গলির শেষ মাথায় একদিকে ছিল বিরাট এক মাঠ, অরেক দিকে বেশ বড়সড় একটা পুুকুর। আর আমাদের ঠিক পাশের বাসারই ছিল অনেক বড় একটা বাগান। ফলের বাগান। গাছের মাঝে মাঝে অনেক জায়গা। ছোটবেলায় একা একা মাঠ বা পুকুর পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি পেতাম না। ওখানে যাওয়ার প্রয়োজনও পড়ত না। কৌতূহল মেটানো ছাড়া। আমরা সমবয়সীরা আমাদের পাশের বাগানে কত রকম মজা করে সময় কাটিয়ে দিতে পারতাম!

এসব হচ্ছে ছোটবেলার কথা। তবে ছোটবেলার কথা যদি আমি আরও কিছু বলি, পরে বলব। আমি এখন আমার বাবার কথা বলছি। আমার বাবা ও মা-র মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক মিল। তারা যে সব সময় বেশি বেশি গল্প করতেন নিজেদের মধ্যে, পাশাপাশি বসে থাকতেন—এরকম নয়। আমার আর বিনুর তুলনায় বাবা-মার মধ্যে কথা বলতে গেলে হতোই না। তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হাসি-ঠাট্টার চল তেমন একটা ছিল না। বাবা-মাকে তাই নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টাও করতে দেখিনি। কিন্তু তারা যে একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসেন ও অনুভব করেন, এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তারা দুজন দুজনকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। আমি আমার বাবাকে আমার মা সম্পর্কে কখনো কোনো কটূক্তি করতে শুনিনি। আমার একসময় মনে হয়েছে, মা-র মনে একটা চাপা ক্ষোভ আছে, পরিচিত মফস্বল শহর ছেড়ে আসায় কখনো এরকম মনে হয়েছে, কিন্তু এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমি কখনো লক্ষ করিনি।

বাবাকে খুব ভালোবাসলেও মা-র সঙ্গে আমার আর বেবীর সম্পর্ক ছিল কাছের। বাবা খুবই বন্ধুর মতো গল্প করতেন, আমাদের ভুলেও কোনোদিন ধমক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না, তবু আমি বেবী মা-র কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করতাম। মা খুব গল্প শোনাতেন আমাদের, কত রকম রান্না করে খাওয়াতেন আর সুযোগ পেলেই আমাদের মনে করিয়ে দিতেন—আমাদের দুজনকে নিয়ে বাবার কত কত আকাঙ্ক্ষা।

আমি যে-বছর ইন্টারমিডিয়েট, অর্থাত্ এইচএসসি পরীক্ষা দেবো, বেবী ক্লাস টেনে, আমাদের মা মারা গেলেন। আমি বিকালে মাঠে গিয়েছিলাম খেলতে, আমি মা-র মারা যাওয়ার সময় কাছে থাকতে পারিনি। বেবী বাসায়ই ছিল, কিন্তু মা কখন মারা গেছেন সেটা ও বুঝতে পারেনি। সেও টের পেয়েছে পরে। হয়তো একটু পরে, কিংবা বেশকিছু পরে। এটা নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি, আমি আর বেবী, কখন মারা গেছেন মা? কিন্তু আমরা একেকবার একেক রকম বলেছি, আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। বেবীর এক বান্ধবী এসেছিল। তার সঙ্গে ছাদে বসে বেবী অনেক গল্প করেছে। বান্ধবীর বিদায়ের পর কিছুক্ষণ নিজের ঘরে কাটিয়ে মা-র ঘরে এসে দেখে মা চেয়ারে বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেবী বলেছে, সেও হেসেছিল, তবে সেটা সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য। তারপরই মা-র হাসিটা তার স্বাভাবিক মনে হয়নি। মৃত্যুর আগে মা-র কিছু মনে হয়েছিল কি না কে জানে, এক টুকরো হাসি যে কারণেই হোক, লেগে ছিল ঠোঁটে।

বাবার বাইরে দাওয়াত ছিল। বাবা বলেছিলেন অফিস থেকে দাওয়াতে চলে যাবেন, বাবাকে খবর দিয়ে আনানো হলো। মাকে অবশ্য ততক্ষণে চেয়ার থেকে সরিয়ে বিছানায় শোয়ানো হয়েছে। আমাদের গলিতে এক ডাক্তার ছিলেন। আমরা তাকে কাকু বলতাম। আমারই এক কোনো বন্ধু সম্ভবত তাকে নিয়ে এসেছিলেন। ডাক্তার কাকুর অবশ্য কিছুই করার ছিল না। শুধু এটুকু বলা ছাড়া উনি বেশিক্ষণ আগে মরেন নাই। বেশি আগের ঘটনা হলে ওনাকে চেয়ার থেকে সরানো মুশকিল ছিল।

বাবাকে খবর দিয়ে আনানো হলো। বাবা খবর পেলেন বাড়ি ফিরে। বাবা কী করে বসেন, এই নিয়ে আমার ভয় ছিল। কিন্তু বাবা তেমন কিছুই করলেন না। কতক্ষণ মা-র দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—তোমার মা মারা গেছেন, না?

আমি এগিয়ে গিয়ে বাবার হাত ধরলাম।

বাবা এবার অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কেন?

আমি তখন এইচএসসির ছাত্র, আমি সহসা বাবার সেই প্রশ্নের মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারিনি। আমার শুধু খটকা লেগেছিল, নিজেকে ছাপিয়ে বাবার জন্য একটা হাহাকারও জেগেছিল। পাস থেকে মোক্তার কাকা এগিয়ে এসে বাবার কাঁঁধে হাত রেখেছিলেন—মফি, তুমি কি কিছু জিজ্ঞেস করতেছ?

বাবা তার দিকে একবার তাকালেন বটে, তবে কোনোদিকে না তাকিয়ে আবারও বললেন—কেন!

কী কেন, দেখি বলো তো আমাকে?

ও মরে গেল কেন?

বাবার ওই কথা ওই জিজ্ঞাসা, কত বছর হয়ে গেল, আজও আমার কানে বাজে, আমি যদিও আজও বুঝতে পারিনি, বাবার জানতে চাওয়া ওই ‘কেন’—ওটা কি বেদনা ছিল, কিংবা হাহাকার, নাকি ওটা অসহায় এক মানুষের অন্তর্যামীর কাছে অতি সরল এক প্রশ্ন ছিল।

পরবর্তী সময়ে আমি এ-ও টের পাই ওই প্রশ্ন ওই ‘কেন’ আমার ওপর গভীর এক ছাপ ফেলে গেছে। পরবর্তী সময়ে নানা প্রসঙ্গে আমি বহুবার নিজের কাছে জানতে চেয়েছি—কেন! বলাই বাহুল্য উত্তর পাইনি। তবে এই জিজ্ঞাসার ফাঁকে ফাঁকে এটুকু আমার জানা হয়েছে অনেক ‘কেন’র কোনো উত্তর নেই। উত্তর যে নেই এই কথা অনেকবার আমি নিজেকে বলেছিও। তার মানে এই নয়, ‘কেন’ থেমে গেছে, আমার জীবনে আরো বহুবার ‘কেন’ প্রশ্নটি চলে এসেছে, আমি জানি আরো বহুবার আসবে।

মা মারা যাওয়ার পর বাবা একলা হয়ে গেলেন। মা-র সঙ্গে বাবার ২৪ ঘণ্টার সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওই যে কথা, দুজন দুজনকে অনুভব করতেন। ওরকম দুজনের একজন চলে গেলে আরেকজন একা হয়ে যাবেই। এরই মধ্যে, মা মারা যাওয়ার ৬ মাসের মাথায় বাবা চাকরি ছেড়ে দিলেন। চাকরি ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাউকে, আমাদেরও কিছু জানালেন না। এক সন্ধ্যায় সহকর্মীদের দেওয়া শুভেচ্ছা উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরে হাসি হাসি মুখে বললেন—চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আমি আর বেবী ব্যাপারটা বোঝার জন্য বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

কী হবে ওসব চাকরিবাকরি করে! খামোখা। তার চেয়ে বরং আমরা তিনজন মিলেমিশে একসঙ্গে থাকি।

বেবী বিরক্ত বিরক্ত গলায় বলল—বাবা, আমরা কি মিলেমিশে একসঙ্গে নেই?

বাবা হাসলেন—কী যে বলিস না, একটা মানুষ বাসায় না থাকলে কি একসঙ্গে থাকা হয় নাকি?

বেবী আমাকে বলল—কী হবে জানিস? বাবা আরো একলা হয়ে যাবে।

আমি বললাম—হুঁ।

দাদা, তুই কি বাবাকে একটু বোঝাবি?

কী বোঝাব?

দেখছিস না চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

আমি হাসলাম—তোর মনে হয় আমার বোঝানোতে কাজ হবে?

বাবা সত্যি সত্যি বাসায় থাকতে আরম্ভ করলেন। অদ্ভুত ব্যাপার, সারাদিন বাসায়। ভার্সিটি যাই, বেবী কলেজে যায়, বাবা বাসায় একা একা দিব্যি সময় পার করে দেন। তাকে দেখে কখনোই মনে হয় না সময় কাটানো নিয়ে তাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। শুধু বাড়তি যেটুকু যোগ হলো, সন্ধ্যার পর বাবা হুইস্কি খাওয়া ধরলেন। আমাদের বাড়ির পেছনদিকে একটা বারান্দা ছিল, সন্ধ্যার পর বাবা বারান্দায় গিয়ে বসতেন। একা একা অনেকটা সময় ধরে হুইস্কি খেতেন। সব সময়ই একা একা খাওয়া, কখনো তার কোনো বন্ধুকে দেখিনি হুইস্কি খাওয়ায় সঙ্গ দিতে, তাকে দেখিনি বাইরে থেকে খেয়ে ফিরতে। পেছনের বারান্দায় বাবা যে বসতেন, হাসতেন না কাঁদতেন না একা একা কথা বলতেন না, কোনো রকম মাতলামি তার ছিল না, এটাকে আমি আর বেবী একসময় সহজভাবেই মেনে নিয়েছিলাম। আমার শুধু মাঝে মাঝে মনে হতো, বাবা আসলে মা-র মৃত্যুর আগেই মদ ধরব ধরব করছিলেন। যদি মা মারা না যেতেন, তবে হয়তো বাবা এমনিতেই সন্ধ্যার পর ওভাবে বসতে আরম্ভ করতেন। মা মারা গেছেন, বাবা মদ ধরার একটা উপলক্ষ পেয়েছেন। অবশ্য এটা আমার অনুমানমাত্র, আর মানুষের সব অনুমানের ভেতরই সেটা সত্য হওয়ার পাশাপাশি মিথ্যা হওয়ার আশঙ্কা সব সময়ই কিছু পরিমাণে থেকে যায়।

বাবা পেছনের বারান্দায় বসে থাকা অবস্থায় মাঝে মাঝে আমাকে ডাকতেন। আমি গেলে পাশে বসতে বলতেন। পাশে বসলে প্রথম যে কথাটা বলতেন, সেটা হলো—বুঝলে বাবু, তোমার মা-র মৃত্যুর পর আমার জীবন পশ্চাত্মুখী হয়ে গেছে।…তুমি কি বুঝতে পারছ কেন আমি এই কথা বলছি? বাবা এই কথা বলে খুবই আগ্রহের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

আমি জানতাম বাবা কেন এই কথা বলছেন। প্রথম দু-তিন বার জানতাম না। কিন্তু বাবার মুখে পরপর কয়েকবার শোনার পর ওটা আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবা এই প্রশ্ন আবার উঠালে আমি উত্তরটা না দিয়ে চুপ করে থাকতাম। আমার জানা ছিল বাবা ওটা আসলে নিজেই বলতে চান।

বাবা বলতেন—পশ্চাত্মুখী হয়ে গেছে আমার জীবন। দেখো না বাড়ির সামনের বারান্দা ছেড়ে আমি পেছনের বারান্দা বেছে নিয়েছি।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকতাম।

পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তোমার?

বাবা, এইচএসসির রেজাল্ট তো ভালোই। ভার্সিটিতে খুব বেশিদিন তো হয়নি…।

হ্যাঁ, তা-ও ঠিক। ভার্সিটিতে পরীক্ষাটরীক্ষা হলে কেমন হলো, আমাকে জানিও।

জানাব।

আচ্ছা, বেবী মানে সুদীপ্তা কেমন পড়াশোনা করছে? ওর পড়াশোনায় মন আছে তো?

বাবা, ও এসএসসিতে কত ভালো রেজাল্ট করল। ওকে নিয়ে একটুও চিন্তা কোরো না বাবা, ওর মাথাটা খুবই ভালো।

জানি।…আচ্ছা, তুমি আর বেবী কি জানো আমি তোমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি?

বহুবার বাবার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। এবং যতবারই দিয়েছি ততবারই আমার চোখ ভিজে গেছে। আমি মৃদু গলায় বলতাম—আমরা জানি বাবা।

জানা থাকা ভালো।… তোমাদের মাকেও আমি খুব ভালোবাসতাম।…জানানো হয়নি।

মা নিশ্চয় জানতেন।

কে জানে।…আসলে তার ওপর আমি খুবই একটা অন্যায় করেছি।

যেদিন বাবার এ কথা আমি শুনি, তার দিকে খুব অবাক হয়ে তাকাই।

অবাক হওয়ার কিছু নেই বাবু, এটাই সত্যি।

কী হয়েছিল বাবা?

তার জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক বড় একটা জায়গা। অথচ আমি তাকে খুব ছোট একটা জায়গায় আটকে রেখেছিলাম।

বাবা, তুমি তো মফস্বলের ওই ছোট জায়গা থেকে মাকে এই শহরে নিয়ে এসেছিলে!

শুধু জায়গার আকার আয়তন দিয়ে কি ছোটত্ব বড়ত্ব বোঝা যায়? প্রথম দিন বাবার এ কথার অর্থ আমি বুঝিনি। বোঝার জন্য তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আমি পরিবেশের কথা বলছি বাবু। তোমার মা-র জন্য একটা বড় পরিবেশের দরকার ছিল। সেটা আমি তাকে দিতে পারিনি।

অধিকাংশ দিন বাবা এখানে এসে কথা শেষ করে দিতেন। আমি যে পাশে বসে আছি, এটা যেন তার খেয়ালই থাকত না। তিনি অপলক তাকিয়ে থাকতেন দূরে, অন্ধকারের দিকে। এসময় হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতেন মুখ বিকৃত করে, যেন হইস্কি মুখে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তার।

এরই মধ্যে একবার দেখলাম বাবা ডায়রির মতো কিছু একটা জোগাড় করেছেন। অনেকটা সময় ব্যয় করেন ওটার পেছনে। ওটা খুলে কখনো লেখেন, কখনো ভাবেন। আমি ভাবলাম, ডায়রি লিখতে শুরু করলেন বুঝি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম—বাবা, ক-দিন হলো তোমাকে দেখছি কিছু একটা লিখছ। ডায়রি?

বাবা হাসলেন, নারে।

তা হলে?

তোর মাকে নিয়ে কোথায়-কোথায় ঘুরতে যাব, তার একটা লিস্ট বানাচ্ছি।

আমাকে থমকে যেতে হলো—বাবা…।

বাবা মুখ তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

বাবা…।

কী বলবি? তোর মা যে মারা গেছেন, এই কথা বলবি? এই কথা আমি জানি।

আমি আরো অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি জানি তোদের মা মারা গেছেন, কিন্তু মারা গেছেন, এইটা আমার ভাবতে ভালো লাগে না। তাই লিস্ট যা বানাচ্ছি, তা প্রেজেন্ট টেন্সে…না প্রেজেন্ট ইনডিফিনিট টেন্সে বানাচ্ছি। ভালোই হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর বাবা আবার মুখ তুললেন—খুব বেশি জায়গায় তো আর যেতে পারতাম না। ছোট লিস্ট কিন্তু আমি আবার বর্ণনা দিচ্ছি। তাই সময় লাগছে।

বর্ণনা…বাবা! কিসের বর্ণনা?

কোনো জায়গায় গেলে মঞ্জুর সঙ্গে আমার কী কথা হতো, এরকম। মঞ্জু কী বলত, আমি কী বলতাম। ওর আসামে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। বলেনি কখনো, আমি বুঝতাম, আসামের গল্প প্রায় করত যে…। বাবু, তুমি কি বলতে পারবে, আসামে নিয়ে গেলে তোমার মা কী বলত?

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

বাবা আর কিছু বললেন না। আমি দেখলাম তার চোখমুখ উজ্জ্বল, তিনি খসখস করে লিখে যাচ্ছেন। আমি নিঃশব্দে ওখান থেকে সরে এলাম।

আমার অনার্সের রেজাল্ট বের হওয়ার আগে বাবার শরীর হঠাত্ই খুব ভেঙে গেল। কেমন একটা অস্থির-অস্থির ভাব এল তার মধ্যে। শুধু ভেঙে যাওয়া জবুথবু শরীরের মধ্যে তার দু চোখ উজ্জ্বল হয়ে জেগে থাকল। আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন—তোমাদের সঙ্গে আমার জরুরি কথাবার্তা তেমন হচ্ছে না, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন হবে, বলো তো?

ভালো হবে বাবা। আমি বললাম। একটা পেপার খারাপ হয়েছে, সেটা বাবাকে আলাদা করে বলার দরকার নেই।

তোমার নাম কেন সুনয়ন রেখেছি, তা কি তুমি জানো?

জানি বাবা, মা আমাকে বহুবার বলেছেন। সুদীপ্তার ব্যাপারটাও ওকে বারবার বলে গেছেন।

সুদীপ্তা বোধহয় ছাত্রী হিসেবে তোমার চেয়ে ভালো?

হ্যাঁ বাবা, অনেক ভালো। ও বোধহয় সত্যিই দীপ্তি ছড়াবে।

সেটা বোধহয় আমার আর দেখে যাওয়া হবে না।

হবে না কেন বাবা…?

কয়েকটি দিন হলো আমার কী মনে হচ্ছে জানো?

কী বাবা? আমার মনে আছে ওই সময় ভেঙে যাওয়া ওই মানুষটাকে আমি আরো ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

নতুন জায়গায় যাওয়া ভালো—এই বলে তোমার মাকে আমি ঢাকা শহরে নিয়ে এসেছিলাম। তুমিও ছিলে আমাদের সঙ্গে।…তোমাকে মানুষ করার একটা ব্যাপার ছিল…কিন্তু বেশি ছিল…।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তবে তার চেয়ে বেশি ছিল নতুন জায়গায় আসার ব্যাপারটা।…আমি এখন মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না…।

আমি বাবার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম।

আমি এখন মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না, নতুন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টাটা মানুষের ভেতর থাকা উচিত কি-না…।

সে-সময় বাবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। আজও আছে বলে আমি নিশ্চিত করে জানি না। কারণ এই প্রশ্ন আজ আমাকেও মাঝে মাঝে তাড়িত করে, আমি উত্তর পাই না।

আমাকে ওকথা বলার সপ্তাহখানেক পর বাবা মারা গেলেন। আমি আর বেবী তখন বাসায়ই ছিলাম। কিন্তু বাবার মৃত্যু সময়মতো আমরা কেউই টের পাইনি। আমার ধারণা বিকালের পর যখন চারপাশের আলো একটু করে মরে আসছে, বাবার মৃত্যু সে-সময়। পেছনের বারান্দায়, চেয়ারে বসে, ‘পশ্চাত্মুখী অবস্থায়’। তার মুখে বিশাল এক হাহাকারের ছাপ ছিল।

তিন.

ছুটির দিন। না বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাশতা খাচ্ছিলাম। বিনু বলল—এমন ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তুমিই তো বলো, বিশেষ বিশেষ সময়ে আমার আচরণ নাকি ঘোড়ার মতো।

বিনু চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকাল—তোমার কি সব সময় নোংরা কথা বলতে খুব ভালো লাগে?

আমি ভদ্রগলায় বললাম—খুব।

একটা লোক সব সময় ওসব কথা কীভাবে বলে ভেবে পাই না! বসো।

আমার জন্য যত কম বসা তত ভালো।

বিনু এবার কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

ওভাবে তাকানোর দরকার নেই। আমি নিরীহ গলায় বললাম, আবার ভেবো না যে আমার পাইলস হয়েছে, সে-জন্য বসতে অসুবিধা।

আল্লাহ করেন তোমার তা-ই যেন হয়।

আমি বসতে বসতে বললাম—আমার জন্য কম বসা নিরাপদ কেন জানো? আমার বাবা ও মা, দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়।

আমি বিনুকে দেখে বুঝলাম ও আমার ওপর খেপে গেছে। আমার ইয়ার্কির ঠেলায় ও মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে পড়ে। ক্লান্ত গলায় বলে—আমি বুঝতে পারি না একটা মানুষ এত ইয়ার্কি কীভাবে মারে! আমি তখন দার্শনিক বনে গিয়ে বলি—বহু ভেবে বিনু আমি এই সত্যর সন্ধান পেলাম—জীবন আসলে একটা ইয়ার্কিই। এসবেও বিনু খেপে। তবে আমাদের বাসায় ইয়ার্কি মারা নিষিদ্ধ নয় বরং আমার ধারণা, ইয়ার্কি বিনু পছন্দই করে। শুধু একটি ইয়ার্কির ব্যাপারেই ও স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে—(আমার) মৃত্যু নিয়ে আমি কোনো ইয়ার্কিই মারতে পারব না। কিন্তু মানুষকে খেপানোর মধ্যে অদ্ভুত এক মজা আছে। এই এখন যেমন, বিনু খেপে গেছে দেখে আমি কিছুটা হলেও মজা পাচ্ছি। এই আনন্দের জন্যই ওকথাটা মাঝে মধ্যে না বলে পারি না।

বিনু গম্ভীর গলায় বলল—বাবু তোমাকে এই ইয়ার্কি মারতে না আমি বারণ করেছি!

এটা ইয়ার্কি না বিনু, এটা সত্যি কথা। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটা যেমন সত্যি…।

বিনু রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

দেখো, কথাটা যদি সত্যি না হয়, আমার মাঝে মাঝেই মনে হবে কেন! কথাটা যদি ইয়ার্কি হতো, আমি একবারের বেশি বলতাম না। ভেবে দেখো।

বিনু বলল—কথাটা সত্যি হোক মিথ্যা হোক, আধা সত্যি, আধা মিথ্যা যা-ই হোক, তুমি এই কথাটা আমাকে আর বলবে না।

আমি ভালো মানুষের মতো মাথা কাত করলাম—ঠিক আছে।…তবে মনে থাকলে হয়। বলেই আমি বিনুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তখনই বললাম—তুমি এক কাজ করো। আমি বারান্দায় বসছি, তুমি এক কাপ চা, না, চা না, তুমি এক কাপ কফি বানিয়ে আনো। আমরা বারান্দায় বসে গল্প করি।

খবরের কাগজ হাতে আমি বারান্দায় এসে বসলাম। খবরের কাগজে আমার প্রিয় বিষয় হলো বিজ্ঞাপন। কত রকম বিজ্ঞাপন যে থাকে। কত রকম পণ্য আর কত রকম সেবা, আর কত না তার বাহারি বার্তা! আমার ধারণা, বিজ্ঞাপনগুলো নিয়মিত পড়লে যেকোনো মানুষের মধ্যেই এক হতাশা জন্মাবে। হাতাশা জন্মাবে এ কারণে যে, তার মনে হবে এ জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই তার কেনা হয়নি, করা হয়নি অনেক কিছুই, তার জানাও হয়নি।

গত শুক্রবারই বোধ হয় আমি বিনুকে গম্ভীর গলায় বললাম—বিনু, আজ সকাল থেকে নিজেকে আমার খুব অপাঙেক্তয় মনে হচ্ছে।

বিনু খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল—কেন!

কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমার খুব লজ্জা লাগছে। খুব লজ্জা পাচ্ছি।

বিনু বারবার প্রতারিত, প্রতারিত—শব্দটা ঠিক হলো না, বিভ্রান্তি বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, বিনু বারবার বিভ্রান্ত হয়, তবে ওর মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য আছে, ও অতীত থেকে কখনো শিক্ষা নেয় না। কিংবা নিলেও সে শিক্ষা যথেষ্ট কার্যকর নয়, বিনু তাই বলল—তোমার কী হয়েছে, বলো তো?

আমি খবরের কাগজটা বিনুর সামনে মেলে বললাম—এই যে বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখ। ওরা একটা কোর্স অফার করেছে।

বিনু পড়ল, পড়ে আমার দিকে সন্দেহের চোখ তুলে তাকাল—কোর্স অফার করেছে তো তোমার কী হয়েছে! এটার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?

কিন্তু বিজ্ঞাপনটা পড়ে আমার যে মনে হচ্ছে এই কোর্স যে করবে না, তার জীবনই বৃথা। কী করি বলো তো, আমার যে সময়ই হবে না!

বিনু রেগে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে একদিকে ছুড়ে দিল।

গত কয়েকদিন হলো আমার বিশেষ লক্ষ্য অ্যাপার্টমেন্টের বিজ্ঞাপনগুলো। ইদানীং নাকি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় খুবই মন্দা যাচ্ছে। নানা রকম ডিসকাউন্টের প্রতিশ্রুতি আর কথার ফুলঝুরির পরও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বাঙালির অদ্ভুত এক স্বভাব আছে, ইনোবেশন অত্যন্ত কম, কেউ একটা ব্যবসা আরম্ভ করলে হাজার জন রাতারাতি সে-ব্যবস্থা আরম্ভ করে দেয়। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়েও সে-রকম হয়েছে, কয়েকটা বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়াবার পর এখন একের পর এক এদিক-ওদিক আরো অনেক বিল্ডিং উঁকিঝুঁকি মারছে। তা, যেগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বটে, তবে ভেতরে ভেতরে এই বিল্ডিংগুলো নিশ্চয় খুব লজ্জিত, তাদের কেউই কিনতে আসছে না। তা, আসবে কোত্থেকে। অত টাকা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার লোক সীমিতই।…কথাটা সম্ভবত ঠিক বললাম না। হয়তো হঠাত্ই দেখা যাবে, কেনার লোক আর সীমিত না। তাদের সংখ্যা এতই বেড়েছে, অ্যাপার্টমেন্ট বানানেওয়ালারা অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে আর কূল পাচ্ছে না। তারা অ্যাপার্টমেন্ট বানাচ্ছে আর সেসব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তারা যে দামই চাচ্ছে, উচ্চ স্বরে ক্রেতারা বলছে—হাজির।

আমি গলা তুলে বিনুকে ডাকলাম। কফি নিয়ে এল বিনু। আমার পাশে বসল, কফির কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি একটা বিজ্ঞাপন ওর সামনে মেলে ধরে বললাম—এই ২৬০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টটা আমার খুব কেনার ইচ্ছা।

এই যে আমি ২৬০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কথা বললাম, এটা পুরো ইয়ার্কি নয়। কেন পুরো ইয়ার্কি নয়, সেটা বলি। আমার সত্যিই একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ইচ্ছা। সত্য কথাটা এরকম ভাড়া বাসায় থাকি বটে, কিন্তু আমার গোছোনো সংসারের লোভ। এমনিতে, এখনকার জীবনে নিজের জন্য এবং অন্যকে দেখানোর জন্য যা যা লাগে, সবই আমাদের সংসারে আছে। একথা আমি আর বিনু মাঝে মাঝে বলাবলিও করি এবং সে-সময় টের পাই, আমাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এখন আমাদের একটা অ্যাপার্টমেন্ট দরকার। অ্যাপার্টমেন্ট হলে সংসার আরো গোছানো হয়, আর লোকজনকেও গুছিয়ে দেখানো যায়—দেখ দেখ। এদিকে আবার আমাদের যারা বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন, তারা আমাদের প্রায়ই বলছে, এরকম একটা পরামর্শ দিচ্ছে—অন্যান্য দিকের খরচ কমিয়ে হলেও আমাদের মাথা গোঁজার স্থায়ী একটা ব্যবস্থা করা উচিত।

দেখানোর ইচ্ছার পাশাপাশি ওরকম আমিও ভাবি। মাথা গোঁজার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা থাকলে অনেক সমস্যাই আর সমস্যা মনে হয় না। আমি যদি নাও থাকি, বিনু অনি আর সোমকে অন্তত আশ্রয় নিয়ে ভাবতে হয় না। একটা আশ্রয় থাকলে বাকি ব্যবস্থা কোনো না কোনোভাবে হয়েই যায়। একটা নিজের অ্যাপার্টমেন্ট হলে আবার বাড়ি বদলের চিন্তাটাও থাকে না। এখন তো ঘরে এসি লাগানোর সময়ও ভাবতে হয় একসময় এটা খুলে ফাঁকা জায়গা ভরাট করে দিতে হবে।

এই যে আমি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কথা বিনুকে বললাম, এর সঙ্গে আবার কিছুটা ইয়ার্কিও জড়িয়ে আছে। ইয়ার্কিটা এ রকম—অ্যাপার্টমেন্ট আমি কিনতে চাই, হয়তো কিনেও ফেলব, তবে ২৬০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট আমার পক্ষে কেনা সম্ভব না। অথচ আমি খুব স্বাভাবিক গলায়, যেন এরকমই হওয়ার কথা—এভাবে, ওই মাপের একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। ইয়ার্কি এই এটুকু।

আমাদের বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন বলে, তার চেয়ে বড় কথা আমি নিজেই টের পাই, আমার মধ্যে বিলাসিতা আছে যথেষ্ট পরিমাণে। যেমন আমাদের ১৪ সিএফটি’র ফ্রিজ হলে চলে, আমি বিনুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনলাম ২২ সিএফটি’র। সুখের কিংবা দুঃখের কথা, এসব ব্যাপারে বিনুও আমার মতোই, কখনো বরং আমাকে ছাড়িয়েই। সুতরাং অ্যাপার্টমেন্ট যদি কেনা হয়, কেনা হবে সে-রকমই।

অন্তত জায়গাটা কী রকম, সেটা মাথায় থাকবে পোক্ত। তা, জায়গা ও মনমতো একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে গেলে সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ৬৫-৭০ লাখ। আমি নানাভাবে আয় মন্দ করি না, আবার খরচও করি সে-রকম। ৭০ লাখ টাকা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হবে না। হঠাত্ মুফতে যদি কিছু টাকা জুটে যায়, সে অন্য কথা।

এই যে আমি বললাম ২৬০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কথা, বিনু এটাকে পুরো ইয়ার্কি হিসেবেই নিল। ও খুব সমঝদারের গলায় বলল—সবগুলো বিজ্ঞাপন দেখেছ?

আমি মাথা দোলালাম—হ্যাঁ। তবে এটাই আমার পছন্দ হলো।

ফোন করেছ? ফোন করে কথা বলে নাও। আমরা না হয় রানুদের বাসায় যাওয়ার বা ওখান থেকে ফেরার পথে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে আসব।

আমি ভালো মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম।

পারলে সঙ্গে কিছু টাকা নিয়ে নাও। বুকিং মানি। নইলে আবার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

আমি গরম চোখে বিনুর দিকে তাকালাম—তোমার একটা দোষ কী, জানো?

এবার বিনু ভালো মানুষের মতো দু পাশে মাথা নাড়ল। অর্থাত্ সে জানে না।

তুমি মাঝে মাঝে মহা হারামির মতো ইয়ার্কি মারো।

তোমার পাশে থাকতে গেলে না মেরে কী উপায়।… শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি যদি আর একদিন আমাকে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কথা বলো তোমার সঙ্গে আমার প্রচণ্ড ঝগড়া হবে।

ঝগড়া! আমি বিনুকে জিজ্ঞেস করলাম। বিনু একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, আমাদের কিন্তু অনেকদিনই তেমন ঝগড়া হয় না।

বিনু হাসিমুখে বলল—হওয়ার দরকার নেই।

না বিনু, মাঝে মাঝে হওয়ার দরকার আছে।

বিনু ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল।

বছরে অন্তত একবার একটা বড় ধরনের ঝগড়া হওয়া উচিত। এমন ঝগড়া, যেন পারলে দুজন দুজনের গলা টিপে ধরব, উত্তেজনায় দুজন থরথর কাঁপব। হাতের কাছ যা পাব তা-ই ভাঙব বা উল্টে ফেলব।

বিনু বলল—কোনো দরকার নেই।

দরকার আছে। এতে একটা বড় ধরনের সুবিধা আছে।

কী?

৪০ পেরিয়ে গেলে ডাক্তাররা পরামর্শ দেন বছরে দু বার থরো চেকআপের জন্য। ঝগড়াটাও সে-রকম। সম্পর্কটা চেক করা। বছরে একবার কোমর বেঁধে নামা দরকার।

আচ্ছা!

ঝগড়ায় শরীরও হালকা হয়, জড়তাও কাটে। আরো কয়েকটি দিন বেঁচে থাকার জন্য কিছু রসদও জোগাড় করে নেওয়া যায়।

তুমি মনে হচ্ছে খুবই বুড়িয়ে গেছ। শরীর মনে হচ্ছে খুবই ভারী হয়ে গেছে।

আরো একটা কথা আছে। বলি। এটা স্কুলে পড়ার সময় এক স্যারের মুখে শুনেছি। ওই স্যার ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাত্ একদিন জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা, তোদের বাবা-মার মধ্যে ঝগড়া হয়? তখন আমরা সিক্স বা সেভেনে পড়ি। স্যারের কথা শুনে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। ছি ছি স্যারের এ কী কথা, বাবা-মার ঝগড়া হবে কেন! আমাদের বাবা-মা কত ভালো! আমরা স্যারের প্রশ্নের জবাবে একসঙ্গে দু পাশে মাথা দোলালাম—না স্যার, আমাদের বাবা-মার কখনো ঝগড়া হয় না।…স্যার তখন কী বললেন, জানো?

বিনু বলল—জানি না, তোমার স্যার কী বলেছেন, তা আমি কী করে জানব?

বললেন, তাহলে তোদের বাবা-মা দুজনের মধ্যে কেউ একজন অশিক্ষিত। শিক্ষিত মানুষ পাশাপাশি থাকলে কিছু মতপার্থক্য হবে, কিছু কথা কাটাকাটি হওয়া অস্বাভাবিক না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তোদের সবার বাবা-মার মধ্য কেউ একজন করে অশিক্ষিত। সে শিক্ষিত জনের কোনো কথার মধ্যেই ভুল কিছু দেখে না, তাই ঝগড়াঝাটিও হয় না…বিনু, তত্ত্বটা কেমন?

তুমি এই তত্ত্বের মধ্য দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছ?

কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না, জানতে চাচ্ছি। আমাদের মধ্য ঝগড়াঝাটি প্রায় হয়ই না, তাই জানতে চাচ্ছি আমাদের মধ্যে কে অশিক্ষিত, তুমি না আমি?

এমনিতে তুমি কিছুটা। কিন্তু সেজন্য যে আমাদের ঝগড়াঝাটি হচ্ছে না, তা নয়। তোমার স্যার তত্ত্ব দিয়েছিলেন অনেকদিন আগে। ওই তত্ত্ব এখন আর কার্যকর নয়।

তা হলে কি আমাদের মধ্য ঝগড়াঝাটি হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই?

দেখা যাক। বিনু উঠে দাঁড়াল। একটা কথা শোনো, তুমি আমাকে আর কখনোই অ্যাপার্টমেন্ট কেনার কথা বলবে না। তুমি জানো আমি জমি কিনে বাড়ি করতে চাই।

তা বুঝলাম। কিন্তু আমাকে একা ফেলে কোথায় যাচ্ছ তুমি?

রেডি হতে। রানুদের ওখানে যেতে হবে না?

বেশি সময় নিও না।…আমাকে কিন্তু চেয়ারেই ফেলে গেলে। বিনু এবার কোনো উত্তর দিল না।

আমি কতক্ষণ খবরের কাগজে চোখ বুলালাম। তারপর তাকিয়ে থাকলাম বাইরের দিকে।

বিনুকে আমি সেভাবে বলি না কখনো, কিন্তু চেয়ারে বসে মৃত্যুর কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। এটা আমার ভেতর এমনভাবে ঢুকে গেছে, আমি কিছুই ভুলে থাকতে পারি না। তবে আমি ভয়ও পাই না। বরং চেয়ারে বসা অবস্থায় আমিও মারা যেতে পারি, এই চিন্তাটা এলেই আমার বাবা-মার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা-মার দুজনেরই যে চেয়ারে বসে মৃত্যু, এটা কি নিছকই একটা কাকতালীয় ব্যাপার? কাকতালীয়ই হওয়ার কথা, এর সঙ্গে আর কিসের সম্পর্ক থাকবে। বড়জোর এমন হতে পারে, মা-র মৃত্যু চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় হয়েছে বলে বাবাও ওরকম মৃত্যুই নিজের জন্য তীব্রভাবে চেয়েছেন। এবং চাইতে চাইতে এরকম মৃত্যুই বাবা পেয়েছেন। এরকম হতেই পারে, আবার নাও হতে পারে। এরকম হলেও কিছু এসে যায় না। আবার না হলেও কিছু এসে যায় না। সমস্যা হচ্ছে, এই চিন্তাটা আমি মাথার ভেতর থেকে বের করে ফেলতে পারি না।

একটু পর আমরা রানুদের বাসায় যাব। রানু বিনুর বড় বোন। এক বছরের বড়। ওদের সম্পর্ক যত না বোনের মতো তার চেয়ে বেশি বন্ধুর মতো। আর আমার সঙ্গে রানুর সম্পর্ক তুমি-তুমি। ওর স্বামী খুব বড় একটা চাকরি করে। একটু গম্ভীর ধরনের মানুষ, কথা কম বলে, কিন্তু মানুষটা ভেতরে ভেতরে খুব আন্তরিক। আমরা কোনো কোনো ছুটির দিনের পুরোটাই রানুদের ওখানে কাটাই। আজ যেমন, সকালে উঠেই অনিন্দিতা আর সোম চলে গেছে। রানুদের বাসায় যাওয়াটা ওদের দুজনের জন্য আনন্দের। বিনুর জন্যও। কথা বলার লোক পাই না বলে আমি মাঝে মাঝে অস্বস্তিতে পড়ি। তবে আমারও ও বাসায় মন্দ লাগে না। বাড়িটা অনেক দিনের পুরনো, আকারে বিশাল। একটা বড় পুকুর আছে বাড়ির ভেতর। পুকুরের পানি অবশ্য ময়লা হয়ে যেতে বসেছে। তবু ওই পুকুরের ঘাটলায় গাছের নিচে কিছু রোদ, আবার কিছু ছায়ার মধ্যে বসে থাকতে চমত্কার লাগে। এরকম আরো কিছু ব্যাপার আছে ওই পুরনো বাড়িতে। একটু মন খারাপ করে দেয়া ছায়া আছে। কোনোদিন কাউকে বলিনি, ওই ছায়াটা আমার খুব ভালো লাগে।

বিনু এসে এবার আমাকে তাড়া দিল—ওঠো।

তোমার কদ্দূর ?

প্রায় শেষ।

প্রায় শেষ মানে আরো প্রায় আধা ঘণ্টা।

আমি কিন্তু সত্যি প্রায় রেডি। বিনু চলে গেল।

আমার সময় লাগবে মিনিট পাঁচেক। সুতরাং এই এখনই না উঠলেও আমার চলে। আমার বরং এখন বাইরের রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। রানুদের বাসায় আবার অন্যরকম রোদ। এখানে রোদের সঙ্গে সব সময়ই একটু যেন ছায়া মিশে থাকে। একদিন আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রানুদের বাসায় রোদের সঙ্গে যে ছায়াটা মিশে থাকে, সে ছায়াটা কি রানু নিজে?

এর উত্তর আমার জানা নেই। কিংবা জানা আছে, আমার জানা আছে, শুধু আমি নিজেকে জানাতে চাই না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে ছোট একটা আড়মোড়া ভাঙলাম। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম—তারপর সুনয়ন চৌধুরী?

আমি উত্তর দিলাম—তার আর পর নেই।

হুঁ।…কী করবে এখন?

রানুদের বাসায় যাব।

তারপর?

সারাদিন থাকব ওখানে।

কী করবে?

কত কী!

তারপর?

ফিরে আসব।

ফিরে আসবে?

হ্যাঁ।

বলো তাহলে— ফিরেই যদি আসবে, তাহলে যাবে কেন?

চার.

সুদীপ্তার কথা আলাদাভাবে বলা হয়নি। আমি এখন সুদীপ্তার কথা বলব।

আমি যখন কিছুটা বড় তখন একটু একটু করে টের পাচ্ছি বড় মামা কী ভালোই না বাসেন তার ছোট বোনকে। আমার ইচ্ছা ছিল আমিও আমার ছোট বোনকে ওরকমই ভালোবাসব।

আমার তিন বছরের ছোট সুদীপ্তাকে আমি সত্যিই খুব ভালোবাসতাম। এর স্বভাবটা ছিল প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে। মা হয়তো জামা সেলাই করে দিয়েছে, কিন্তু ও মুখ গোমড়া করে বসেই আছে। মা জিজ্ঞেস করল কী রে, জামা বোধহয় তোর পছন্দ হয়নি…।

ও সরাসরি বলত—না, হয়নি।

কেন হয়নি, বল তো শুনি।

জামাটা আরো সুন্দর হতে পারত।

মা হাসত আর বলত—দেখিস তোর কপালে দুঃখ আছে।

আমি কখনো ওকে বলতাম—তুই যে সবার সঙ্গে ওভাবে কথা বলিস, এটা কি উচিত?

কেন উচিত না?

মানুষজন কষ্ট পায় না! আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম।

সুদীপ্তা খুব অবাক হয়ে যেত—কিন্তু আমি তো আমার মনের কথাটাই বলি!

এ দুটো ব্যাপার ছিল ওর মধ্যে। খুব খুঁতখুঁতে ছিল, কিছুই ওর পছন্দ হতে চাইত না, আর মানুষের মুখের ওপর সত্যি কথাটা ও বলে দিত।

ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ‘তুই-তুই’। আমি একটু মুরুব্বিয়ানা ফলাতে চাইতাম, কিন্তু ও আমাকে সে সুযোগই দিত না। বলত—আহা বাবু, তুই এমন কেন করিস বল তো!

আমি বলতাম—এসব তো আমি করবই। আমি তোর বড় না?

না, আমার সঙ্গে এরকম পুতুলের মতো করা চলবে না। আমার বিচ্ছিরি লাগে।

বিচ্ছিরি লাগলেও কিছু করার নেই। ছোটবোনকে দেখেশুনে রাখা বড় ভাইয়ের দায়িত্ব।

আহা, আমার বড়রে। মাত্র তো তিন বছরের…।

একটা সময় এল যখন সুদীপ্তাই আমাকে দেখেশুনে রাখতে আরম্ভ করল। ও যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে তখনই দেখা গেল ওর মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে রাখার ইচ্ছা। নিজে নিজেই, সারাবাড়ি ঘুরে এখানে এটা ঠিক করে ওখানে ওটা। আমার পড়ার টেবিল, আমার আলনা, বিছানা সবকিছুই ও গুছিয়ে টিপটপ রাখত।

ওর চেহারাটা ছিল সুন্দর। ছোটবেলায় ওকে একটা পুতুল মনে হতো। আমরা ভাবতাম বড় হয়ে ওর বোধহয় এই পুতুল ভাবটাই থেকে যাবে। সেটা থাকল না। বড় হতে হতে ওর চেহারা হয়ে গেল কাটা-কাটা। এই নিয়ে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন অনেকেই যেন বেশ দুঃখিত হলো। তাদের ভাবখানা—আহারে, কী ভেবেছিলাম আর কী হলো, কী হতে পারত মেয়েটা কিন্তু কী হলো!

আমার আর মা-র কিন্তু সুদীপ্তার ওই বদলে যাওয়া চেহারাটা ভালো লাগল। খুব কাটা-কাটা তীক্ষ একটা চেহারা, চেহারার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। এ কারণেই সম্ভবত ওকে সবাই খুব মানত। বাসায় তো বটেই, বাসায় ও যা বলত, ও যা চাইত, সেটাই চূড়ান্ত, বাইরেও আমি এ ব্যাপারটা লক্ষ করেছি। ও যা বলছে, সবাই সেটাই মেনে নিচ্ছে। আমার ধারণা, এরকম এক পরিস্থিতিতে ওর মধ্যে ক্রমশ এক সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ডেভেলপ করেছিল।

তা, সেটা বোধহয় খুব একটা অযৌক্তিকও নয়। মেয়েটির চেহারা সুন্দর, ঘরের কাজে চমত্কার, দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, প্রখর বুদ্ধি—হ্যাঁ, এসব থাকলে একজন নিজেকে কিছুটা সুপিরিয়র ভাবতেই পারে। সুদীপ্তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটাই আমি এড়িয়ে গেলাম। বলি সেটা—ও ছিল পড়াশোনায় ভালো। এত ভালো যে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম। পাঠ্যবইয়ের একটা কবিতা হয়তো একবার পড়ল, ব্যস, আত্মস্থ করা হয়ে গেল। না, মুখস্থ রাখতে পারত না, মুখস্থ বিদ্যাটা ছিল না ওর। ও বলত, এতসব কিছু দিয়ে মগজ ভরে রাখার কোনো মানে হয় না। ওর ছিল বোঝার ক্ষমতা। যেকোনো নিয়মের অঙ্ক ওকে একবার বুঝিয়ে দিলে ওর আর অসুবিধা হতো না। তবে পড়তে বসতো না ও, বসলেও আধা ঘণ্টা। ও বলত, কী দরকার, তা ছাড়া বুঝেছিস বাবু, সবকিছুর মধ্যে একটা নিয়ম আছে, এই নিয়মগুলো একবার তোর জানা হয়ে গেলে আর কোনো ঝামেলা হবে না। আমাদের সবার ধারণা ছিল ও লেখাপড়ায় দারুণ কিছু একটা করবে।

মা-র মৃত্যু ওকে ভেতরে ভেতরে কিছুটা সম্ভবত নড়িয়ে দিয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে বলছি এ কারণে যে বাইরে থেকে সেটা অনুমান করা সহজ ছিল না। ওর চোখে-মুখে তেমন কষ্টের কোনো ছাপ পড়েনি। বাইরে থেকে যেটুকু পরিবর্তন টের পাওয়া গেল, সেটার সাক্ষী শুধু আমি। সুদীপ্তা মাঝে মাঝে খুবই উদাসীন হয়ে যেত। আমরা হয়তো খাওয়ার টেবিলেই, সুদীপ্তা মুখে খাবার নিয়ে না চিবিয়ে কোনো এক দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম—বেবী, তুই কি কিছু ভাবছিস?

সুদীপ্তা আমার দিকে তাকিয়ে বলল—মা-র কথা খুব মনে পড়ে রে।

কিন্তু কী করবি। আমি মৃদু গলায় বললাম। মেনে নেয়া ছাড়া…।

মেনে তো নিয়েছি। মৃত্যু তো হবেই। কিন্তু…।

কিন্তু কী? আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলাম।

মা যে মারা গেছে, বাবু, ঠিক এই ব্যাপারটা না…। বাবু, আমি তোকে বোঝাতে পারব না।

পারবি, চেষ্টা করে দ্যাখ।

ধর, মা-র মৃত্যু যত কষ্টেরই হোক, মেনে নিতে হবে আমাদের। কিন্তু একটা ব্যাপার বাবু, আমি বুঝতে পরি না।

বল।

আফিয়া এসেছিল আমার কাছে। আমি আর আফিয়া ছাদে বসে গল্প করলাম। আফিয়া খুব একটা মজার কথা বলল। আমি ভাবলাম এই কথাটা মাকে বলতে হবে। মা-র কাছ থেকে সত্যমিথ্যা জেনে নিতে হবে। তারপর আফিয়া চলে গেল…।

থামিস না, বল।

আমি কথাটা মাকে বলতে এলাম। বলতে এসে আমি দেখি মা চেয়ারে বসে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ডাকলাম—মা।…কিন্তু বাবু, মা তখন আর বেঁচে নেই।

আমি মৃদু গলায় বললাম—মানুষ এভাবেই চলে যায়।

কিন্তু আমি যখন কিছু জিজ্ঞেস করতে এসেছি, তার আগেই মাকে চলে যেতে হবে কেন!

আমি চুপ করে থাকলাম।

মৃত্যুর পরও মা অমন হাসিমুখে তাকিয়ে থাকবে কেন!

আমি চুপ করে থাকলাম।

তুই একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস বাবু। আমি যার কাছে জানতে এসেছিলাম, তাকে আমি জীবিত ভাবলেও সে ততক্ষণে মৃত।…বাবু, আমি মৃত মানুষের কাছে প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলাম।…এই প্রতারণার কোনো মানে হয়, বল।

আমি চুপ করে থাকলাম। আমার অবশ্য চুপ করে থাকার কথা ছিল না, কারণ যে-কথাগুলো সুদীপ্তা বলছে, সে-কথাগুলো আমারও। আমারও কথা, সুতরাং আমরা অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করলাম না, আমি সুদীপ্তার কথা শুনতে-শুনতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার ধারণাই ছিল না, ওরকম কেনো ভাবনা সুদীপ্তাকে অস্থির করবে। ওকে আমার বরাবরই কিছুটা নিষ্ঠুর ও নিস্পৃহ ধরনের মনে হয়েছে। হঠাত্ এ কথায় অনেকে অবাক হতে পারে, কিন্তু আমার একথা ঠিক। বাইরের কোনো লোক কখনো বুঝতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না, বাবা-মাও সম্ভবত কখনো বুঝতে পারেনি। কিন্তু আমার সব সময়ই মনে হয়েছে সুদীপ্তার মধ্যে নিষ্ঠুরতা আছে। আমি কোনো উদাহরণ দিতে পারব না। উদাহরণ দিতে গেলে বরং ওর মমতার কথাই উল্লেখ করতে হবে। একটা ঘটনা আমার খুব মনে আছে। আমার একবার হাত কেটে গেছে, বেশ অনেকখানি। তাই দেখে সুদীপ্তার হু হু করে কান্না। বাসায় আর কেউ তখন ছিল না, সুতরাং অ্যান্টিসেপটিক লাগানো, বেঁধে দেওয়া, এসব দায়িত্ব সুদীপ্তাকেই পালন করতে হয়েছিল। আমি সে-সময় ওর নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলাম। একদিকে কাঁদছে ও, আমার হাত বেঁধে দিচ্ছে, অথচ ওর মধ্যেই অদ্ভুত এক নিস্পৃহতা। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

সুদীপ্তার ভেতরে যে নিস্পৃহতা, সে নিস্পৃহতার কারণে মা-র মৃত্যু নিয়ে ওই বোধ ওর ভেতরে তৈরি হওয়ার কথা না। নাকি আমিও ভুল? নাকি ওর ভেতরকার শীতলতাই ওই বোধ তৈরি করে দিয়েছিল? তাহলে আমার বেলায়? আমিও কি তাহলে নিস্পৃহ ও শীতল, কিছুটা নিষ্ঠুর? না-হলে ওই একই বোধ কেন আমার ভেতরও?

এসএসসির রেজাল্ট যেমনটা আমি ও বাবা আশা করেছিলাম, সুদীপ্তা তেমন করতে পারল না। ও অবশ্য পরীক্ষা দিয়েই বলেছিল ভালো হয়নি। তবু আমরা ভেবেছিলাম, প্রথম ২০ জনের মধ্যে থাকবে ও, ওর স্কুলের শিক্ষকদের ধারণাও ছিল এরকমই। কিন্তু ও লেটার পেল ৫ সাবজেক্টে, স্টার মার্কস পেল, প্রথম ২০ জনের মধ্যে থাকল না। রেজাল্ট বের হলে ও হাসতে হাসতে বলল—সবাইকে মনে হয় খুব নিরাশ করলাম।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম—এটা হাসির কোনো ঘটনা না।

হাসির না হোক, মজার।

তোর রেজাল্ট আমাদের মনমতো হয়নি, এটা মজার ঘটনা?

আমার জন্য মজার। বাবু, তুই জানিস না, লোকজনকে নিরাশ করার মধ্যে কী যে অদ্ভুত এক মজা আছে। নিরাশ হয়ে যাওয়া মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখিস তুই। দারুণ।

দ্যাখ বেবী, বাবার কিন্তু খুব মন খারাপ হয়েছে।

তা-ই! বেবীকে বেশ চিন্তিত দেখাল। আমি জানি এটা ওর ইয়ার্কি।

হ্যাঁ, খুব মন খারাপ করেছেন। কিছু বলেননি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।

আচ্ছা, তাহলে তোর ধারণা শুধু তুই-ই বুঝতে পারছিস, আমি এটার কিছু বুঝতে পারছি না?

তুই বুঝতে পারিস বলে আমার কখনো মনে হয় না।…বুঝতে পারিস?

বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই। দ্যাখ বাবু, আর যা-ই হোক, আমি তো নিজের মজাটা মাটি করতে পারি না। তবে বাবা বলে কথা। আবার মাও নেই…বাবাকে খুশিই করা উচিত, কী বলিস?

সেটাই উচিত।

আহা বাবু, অত উচিত-অনুচিত ভাবলে চলে না। ঠিক আছে দুটো বছর সময় দে আমাকে।

দু বছর পর কী হবে?

প্রায় বছর আড়াই পর সুদীপ্তার এইচএসসির রেজাল্ট বের হলো। কলেজ থেকে রেজাল্ট নিয়ে ফিরল, আমার কাছে এসে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল—আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম—কেমন হয়েছে?

সুদীপ্তা ছোট করে হাই তুলল—কম্বাইন্ডে সেভেন্থ। এরচেয়ে ভালো করা যেত, কিন্তু তুই তো জানিস বাবু, বেশি পড়তে আমার ভালো লাগে না।

আমি আদর করে ওর মাথায় হাত রাখলাম।

অ্যাই বাবু, তুই মুরুব্বিদের মতো করিস না, তুই এমন কোনো মুরুব্বি হোসনি।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম এই যে আমি ওর মাথায় হাত রেখেছি, এতে ও খুশি হয়েছে। কিন্তু এটা ও আমাকে বা কাউকেই বুঝতে দেবে না।

আমি বললাম—বেবী, আমি যে কী খুশি হয়েছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না।

তুই খুশি হলে আমার কী! সুদীপ্তা আমার দিকে তাকিয়ে ফাজিলের মতো হাসল। বাবা খুশি হবেন কি-না, তুই সেটা বল।

চল, বাবাকে রেজাল্টের কথা বলবি তুই।

বাবা যেদিন মারা গেলেন, তার পরদিন সুদীপ্তা আমাকে বলল—বাবার সঙ্গে আমার কথা খুব কম হতো। কিন্তু আমার কী মনে হচ্ছে জানিস? আমার কথা বলার লোক আরো একজন কমে গেল।

বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা আমাদের ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেল। বড় মামা খবর পেয়েই এসেছেন। তারও বয়স হয়েছে বেশ, শরীর সেই আগের মতো মজবুত না। তিনি চাইলেন ক-দিনের জন্য আমাদের নিয়ে যেতে। আমার আপত্তি ছিল না। বরং ওরকম কিছুই আমি চাচ্ছিলাম। এ বাড়িতে ভয় ভয় লাগে। শূন্য শূন্য মনে হয় নিজেকে, মনে হয় আমার চেয়ে একা বুঝি আর কেউ নেই এ পৃথিবীতে।

আমি যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়েই ছিলাম, সুদীপ্তা রাজি হলো না।

বড় মামা অনেক বোঝাল, বড় মামার মেয়ে মুনিরাও চেষ্টা কম করল না, আমিও। সুদীপ্তা রাজি হলো না। আমি ওকে বললাম—বেবী তুই রাজি হচ্ছিস না কেন ! ক-দিনের জন্য ঘুরে এলে কী হয়?

সুদীপ্তা সামান্য হাসল—এখন আমাদের কোথাও গিয়ে থাকা উচিত হবে না।

কেন?

এখন আমাদের আপনজন বলতে আমরা নিজেরাই, তা-ই না?

মামারা আছেন…।

তা তো আছেনই। কিন্তু আমরা একদম নিজেরা ছিলাম ৪ জন, এখন ২ জন। আমরা যদি ক-টা দিন একা থাকি, তবে বুঝতে পারব আমাদের দুজনের জন্য আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। অন্য কোথায় গিয়ে থাকলে ওই বোধটা আমাদের মধ্যে তৈরি হবে না।

আমি সুদীপ্তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম।

সুদীপ্তা বলল—এটা মনে রাখিস বাবু, শুধু তুই আর আমি আছি। আমার জন্য তুই, তোর জন্য আমি।

একথা বলার এক বছরের মাথায় সুদীপ্তা হান্নানকে বিয়ে করে চলে গেল। প্রেমের বিয়েই বলতে হবে, প্রেম ছাড়া হান্নানের সঙ্গে সুদীপ্তার যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই প্রেমের অর্থ আজও আমি বুঝতে পারিনি।

কিছু যখন বড় হয়েছে সুদীপ্তা তখন থেকে ওর প্রেমপত্র পাওয়া শুরু। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, এমনকি বাবার বন্ধু (তখন বুঝতাম না, পরে বুঝেছি) কে না প্রেম নিবেদন করত ওকে। এটা নিয়ে সুদীপ্তার ছিল বিরক্তির একশেষ। একটা করে চিঠি পেত, আর না পড়ে দলা পাকিয়ে সেটা ফেলে দিত। একটু যখন বয়স হয়েছে ওর, বলত—মানুষজন কী ভাবে বুঝতে পারি না। চিঠি লিখে কি প্রেম হয়? একজনকে চিনি না, জানি না, বুঝি না—তার পাঠানো চিঠি পড়েই আমাকে তার প্রেমে পড়ে যেতে হবে। এত সহজ? আমার ধারণা প্রেমের সম্পর্কটা ওর একমাত্র এহসানের সঙ্গে হয়েছিল। ওটাকে অবশ্য প্রেমের সম্পর্ক না বলে পারস্পরিক পছন্দের সম্পর্ক বলা উচিত। এহসান আমার বন্ধু। নিতান্তই ভদ্র, নিরীহ ছেলে বলতে যা বোঝায়, ও তা-ই। ওর চেহারায় উদাস-উদাস একটা ভাব ওই বয়সেই স্থায়ী ছাপ ফেলেছিল। ও থাকত আমদের সঙ্গেই, আবার আমাদের সঙ্গে থাকতও না। থাকতও না অর্থ—ও একটা দূরত্ব সব সময়ই বজায় রাখত। এটা যে ও ইচ্ছা করে করত, তা নয়। ওর স্বভাবটাই ছিল এরকম। ওর কাজ ছিল একটাই, আমরা খেলতাম, আড্ডা দিতাম, আরো কত কী—এহসান শুধু বই পড়ত।

বন্ধুদের মধ্যে আমার সঙ্গে এহসানের সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। আর কোথাও যেত না ও, আমাদের বাসায় আসত। সুদীপ্তার জন্য আসত, আমার কখনো এরকম মনে হয়নি। নাকি সুদীপ্তার জন্য আসত ও, শুধু আমকে কখনো বুঝতে দেয়নি? এহসান এসে চুপচাপ আমার পাশে বসে থাকত। আমি কোনোদিন জিজ্ঞেস করতাম—এহসান, তুই কেন এসেছিস, বল তো?

তোর কাছে এসেছি।

আমার কাছে এসেছিস তো আমার সঙ্গে কথা বলছিস না কেন? আমি তো একাই বকবক করে যাচ্ছি।

কিছু না বলে এহসান হাসত।

এহসান এলে সুদীপ্তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এটা আমি টের পেলাম বেশ পরে। সুদীপ্তা তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে। কিন্তু এহসানের মধ্যে আমি কোনো পরিবর্তন লক্ষ করিনি। এমনও হয়েছে, এহসান এসেছে, কোনো একটা উপলক্ষ বের করে সুদীপ্তা চলে এসেছে আমার ঘরে। এটা ওটা বলেছে আমার সঙ্গে এহসানের সঙ্গেও বলছে দু-একটা। এহসান শুধু সেসব কথার উত্তর দিয়েছে, একটু হেসেছে, এ পর্যন্ত। আগ বাড়িয়ে ওকে আমি কখনো সুদীপ্তার সঙ্গে কথা বলতে দেখিনি। তবে ও আসত, যখন-তখন আসত। এমনকি, আমি না-থাকা অবস্থায়ও কখনো, এসে কিছুই করত না, সুদীপ্তা বলেছে, চুপচাপ বসে থাকত।

আমি চাইতাম এহসান আর সুদীপ্তার সম্পর্ক হোক। আমার মনে হতো ওদের স্থায়ী সম্পর্ক হলে সেটা ওদের দুজনের জন্যই হবে মঙ্গলজনক। সুদীপ্তার জন্য যেমন এহসানের মতো ছেলে দরকার, এহসানের জন্য দরকার সুদীপ্তার মতো মেয়ে। ওরা কি দুজন সেটা বুঝবে?

ওদের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত অবশ্য হলো না। আমি ঠিক জানি না—হয়তো হতে হতে হলো না, কিংবা হওয়ার বহু আগেই ভেঙে গেল।

বাবা মারা যাওয়ার প্রায় বছরখানেক পরের এক ঘটনা। এক সন্ধ্যায় আমি বাসায় ফিরে দেখি সুদীপ্তার ঘর থেকে গোবেচারার মুখ করে এহসান বের হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ও প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে, প্রচণ্ড লজ্জাও। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল ও মুহূর্তের জন্য, তারপর পাশ কাটিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। আমার খটকা লাগল। আমি কয়েক পা এগিয়ে সুদীপ্তার দরোজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম সুদীপ্তা হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। আমার মনে হলো ও নিঃশব্দে কাঁদছে।

আমি একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ডাকলাম, সুদীপ্তা…।

সুদীপ্তা উত্তর দিল না, মুখ তুলে তাকাল না।

আমি দ্বিতীয়বার ওকে ডাকলাম না। আমার জানার প্রবল ইচ্ছা হলো বইকি—কী হয়েছে আবার আমার জানার ইচ্ছা হলোও না।

এর দিন বিশেকের মধ্যে হান্নানের হাত ধরে সুদীপ্তা চলে গেল। হান্নান একসময় আমাদের বন্ধুই ছিল। বিরাট ধনী লোকের ছেলে, চেহারাটাও রাজপুত্রের মতো—তবে এ পর্যন্তই। জীবনের কোনো গভীর বোধ ওর ভেতরে কখনো কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়নি। ‘গভীর বোধ’ ব্যাপারটা বোধ হয় ভারী হয়ে গেল। কিন্তু কেউ যে একটা ‘অস্তিত্ব’ এটা তো তাকে বুঝতে হবে। হান্নান সেটাও কখনো বুঝেছে, এমন কখনো বোঝা যায়নি। কিন্তু তারপরও বন্ধুত্ব হয়, হান্নানের সঙ্গেও আমাদের হয়েছিল।

ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় হান্নান সুদীপ্তাকে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠি অমি দেখেছিলাম। সুদীপ্তা এমনভাবে চিঠিটা রেখেছিল, কেউ যদি দেখতে চায় দেখতে পারে আবার না দেখলে না দেখবে। লুকাবারও কিছু নেই, প্রকাশেরও কিছু না। হান্নানের চিঠিটা ছিল স্থূল, অমার্জিত ও নোংরা একটা চিঠি। তবে ওই চিঠি নিয়ে হান্নানকে কিছু বলা হয়নি। সেটা সম্ভবত সুদীপ্তার কারণে। এই যে হান্নান ওরকম একটা চিঠি দিয়েছে, এটা যেন কোনো ব্যাপারই না।

এইচএসসিতে থার্ড ডিভিশন পাওয়ার পর আর লেখাপড়া করেনি হান্নান। ওর বাবার সঙ্গেও কী কী সব কারণে ওর বনিবনাও হয়নি। ‘হইসে, ট্যাকা পয়সা ক্যামনে কামাইতে হয়, এইটা আমিও জানি’, শোনা কথা—এ রকম কিছু একটা বলে হান্নান বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে নিজেই ব্যবসা শুরু করেছিল। কিসের ব্যবসা জানতাম না আমরা, জানার তেমন একটা কৌতূহল ছিল না তা-ও না, আমরা এটুকু শুধু এদিক-ওদিক করে জানতাম ওর ব্যবসাটা বৈধ বা শোভন না কিন্তু তাতে আমাদের কী, তবে ব্যবসায় ও কেমন করে সেটা দেখার একটা লুকানো ইচ্ছা আমার ছিল। দেখলাম ও অল্প কিছুদিনের মধ্যে বেশ টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেল।

এই হান্নানের হাত ধরে চলে গেল আমার ছোট বোন সুদীপ্তা। কেন? কেন—এই প্রশ্ন আমার মনে বহুবার এসেছে। বহুবার ভেবেছি এহসানকে জিজ্ঞেস করব। করা হয়নি, না এহসানকে না সুদীপ্তাকে। ওই ঘটনার পর দিন বিশেক বাসায়ই ছিল সুদীপ্তা। জিজ্ঞেস করলে আমি ওকেই করতে পারতাম। একটা প্রশ্ন কতভাবেই-না করা যায়। আবার আমার এরকমও মনে হয়েছে, আমি যদি সেদিন ২-৩ মিনিট পর বাড়ি ফিরতাম, আমার জানাই হতো না এহসানের সঙ্গে সুদীপ্তার কিছু একটা হয়েছে। যেটা হঠাত্ করে জানা হয়েছে, যেটা একটু এদিক-ওদিক হলে জানা হতো না, সে-বিষয়ে প্রশ্ন করে কী লাভ! তার চেয়ে বরং সুদীপ্তার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব, হ্যাঁ, অভিমান, মনে করব আমার কোনো ছোটবোন ছিল না।

কিন্তু তা-ই কি হয়? অভিমান বললেই কি অভিমান হয়? সুদীপ্তার সঙ্গে আমি আর কোনোদিন মুখোমুখি হইনি, হওয়াও হয়নি, হলে কথা বলব না। এখনো আমি ঠিক করে রেখেছি দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নেব। কিন্তু ওকে ভুলে যাব, ওর কথা আমার মনেই পড়বে না, তা-ই কি হয়? সুদীপ্তার খবর আমার কাছে মাঝে মাঝে এসে পৌঁছায়। বেশ নাকি আছে। বিশাল বাড়ি, বিশাল গাড়ি কয়েকটা, তিন ছেলেমেয়ে, সুদীপ্তার কাজ হচ্ছে দেশে-বিদেশে ঘুরেফিরে বেড়ানো আর শপিং করা।

আমি এটাও ঠিক করে ছিলাম যে এহসানকেও কখনো কিছু জিজ্ঞেস করব না। এই প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি। আমি একদিন এহসানকে জিজ্ঞেস করে বসলাম। এটা অবশ্য বেশ অনেক পরের কথা এবং ততদিনে এহসান অনেকটাই বদলে গেছে। যারা বহুদিন পর ওকে দেখবে, তারা ওকে চিনবে না। একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে বেশ বড় চাকরি করে, স্যুট-টাই পরে অফিসে যায়, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সরু ফ্রেমের চশমা, এহসান এখন কথা বলে প্রচুর, হাসেও অনেক। চারদিক কাঁপানো হাসি, আড্ডায়; অফিসে নিশ্চয় ও এভাবে হাসে না।

এই বদলে যাওয়া এহসানকে আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম—এহসান, তুই তো আমার ছোটবেলার বন্ধু, আমাকে একটা সত্যি কথা বলবি?

এহসান ওর এখনকার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে বলল—খুব কঠিন কিছু জিজ্ঞেস করবি বলে মনে হচ্ছে?

হুঁ, কঠিনই।…এহসান তুই বিয়ে করিসনি কেন, বল তো?

এহসান আমার দিকে তাকাল— করিনি, করা হয়নি।

কেন করিসনি?

আচ্ছা, এমন তো না যে সবাই-ই বিয়ে করে। আমি করতেও পারি।

আমাকে সত্যি কথাটা বলবি না? আমি তোর সেই কবেকার বন্ধু!

এহসান আমারই দিকে তাকিয়ে থাকল, চোখ ফিরিয়ে নিল না, চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করল না, আমি দেখলাম ওর এখনকার গাম্ভীর্য ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে, ও বলল—বাবু, তুইও আমার অনেক দিনের বন্ধু, এই প্রশ্নটা তুই আমাকে আর করিস না।

সুদীপ্তার সঙ্গে তোর সেদিন কী হয়েছিল?

এহসান এবার বোকার মতো অবাক হওয়ার চেষ্টা করল—সুদীপ্তার সঙ্গে?

আমি বললাম—হ্যাঁ, সুদীপ্তার সঙ্গে?

এহসান চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ও আবার আমার দিকে তাকাল, অপলক তাকাল, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকাল, বেশ কিছুটা সময় ওভাবে পার করল, তারপর আবার আমার দিকে তাকাল—সুদীপ্তার সঙ্গে, না বাবু?..হয়েছে কি বাবু আমি ভেবেছিলাম তুই কোনোদিনও আমার কাছে জানতে চাইবি না।…সুদীপ্তার সঙ্গে, না? দীপ্তা…। আমি দেখলাম এহসান হঠাত্ ভীষণ ভেঙে পড়েছে। ও একটু হাসার চেষ্টা করল, পারল না, বলল, আমি ওর সঙ্গে সেদিন বড় ধরনের একটা অন্যায় করেছিলাম।

আমি তাকিয়ে থাকলাম এহসানের দিকে।

এহসান বলল—তাই বলে ও এভাবে প্রতিশোধ নেবে, সেটা আমি একটুও বুঝতে পারিনি।

কার ওপর প্রতিশোধটা নিয়েছে ও? তোর ওপর?

আমার ওপর তো বটেই।…ওর নিজের ওপর আরও বেশি।

হুঁ…।

যেন আমি কষ্ট পাই। আমাকে বিশ্বাস করে হঠাত্ একদিন একটু যে ঠকেছিল, তার প্রতিশোধ নিচ্ছে জীবনভর, একটু একটু করে।…ও খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির মেয়ে। নিজে কষ্ট পাই, পাব, কিন্তু অন্যকেও যেন কষ্ট দিতে পারি, এরকম।

আমি চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি সেদিন কী অন্যায় করেছিলাম ওর সঙ্গে, তুই শুনতে চাস?

আমি এহসানের দিকে না ফিরেই মাথা নাড়লাম। না, কী হবে শুনে!

এহসান একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—বাবু, তুই কি এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস?

আমি হাসার চেষ্টা করলাম—আমি কখনো তোর ওপর রাগ করিনি।

আমি আমার দোষটা বুঝতে পারি। কিন্তু এটা বুঝতে পারি না একদিনের ভুলের জন্য জীবন চিরদিনের জন্য অন্যরকম হয়ে যেতে পারে!

পারে।…তোর জীবন বদলে গেছে।…সুদীপ্তারও। আমার গলা হাহাকারের মতো শোনাল না, কিন্তু কষ্টটা আমি লুকাতেও পারলাম না—না এহসান, আমি তোর ওপর রাগ করিনি…।

জীবন এ রকম…জীবন এ রকমই…।

সুদীপ্তার কথা আমি ভাবতে চাই না, সুদীপ্তার ভাবনা চলে আসে। মাঝে মাঝে এরকম ভেবে ভয়ংকর অবাক হয়ে যাই— হান্নানের ঘরে ও আছে কী কারে! তবে কি হান্নানের ঘরেই ও দীপ্তি ছড়াবে, ব্যাপারটা এভাবেই নির্ধারিত হয়ে ছিল? আমি এ হিসাব কখনো মেলাতে পারি না। অবশ্য আমি যখন এ হিসাব না মেলার কথা ভাবি, ভাবি ‘এ হিসাব মিলল না’, তখন হঠাত্ কখনো আমার হাসিও পায়, আমি নিজেকে বলি—তুমি এমনভাবে এ হিসাব না মেলার কথা বলছ বাবু, যেন জীবনের আর সব হিসাব মিলিয়ে বসে আছ!

পাঁচ.

আমার আর বিনুর জমি দেখতে যাওয়ার কথা। জমি কিনবে বিনু, বিনু জমি কিনবে, জমি কিনে বিনু সেখানে বাড়ি তৈরি করবে। বাড়ির মোটামুটি একটা প্ল্যান ওর মাথার মধ্যেই আছে। ভাড়া বাড়িতে থেকে যেসব অসুবিধার মুখোমুখি হয়, যেমন কিচেন ক্যাবিনেট ঠিক জায়গামতো না, ডেসিংরুমটা বেশি ছোট হয়ে গেছে, রান্নাঘরটা আরো আড়ালে থাকা উচিত ছিল, এসব সমস্যার কিছুই সে তার নিজের বাড়িতে রাখবে না। বাড়ির সামনে কী কী গাছ থাকবে, আর পেছনে কী কী, তা-ও সে ঠিক করে রেখেছে। আমাদের এক ফ্যামেলি ফ্রেন্ডের বড় ধরনের নার্সারির ব্যবসা আছে। তাকে বলেছে বিনু, সে বলেছে—গাছ নিয়ে ভাবতে হবে না।

বিনু আমার সঙ্গে যখন বাড়ির কথা বলে, ওর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি—এটা ওর জীবনের অনেক বড় দু-তিন স্বপ্নের একটা, নিজের একটা বাড়ি। আমার উচিত বিনুর এই স্বপ্ন বাস্তব করে তোলার চেষ্টা করা। স্বপ্ন বড় মূল্যবান মানুষের জীবনে, আবার একইসঙ্গে অর্থহীনও। তবে, স্বপ্ন অর্থহীন—এটা একেকজনের কাছে একেকভাবে; স্বপ্ন মূল্যবান—এটা সবার কাছে প্রায় একই রকম। সে যাক, আমি বিনুর এই স্বপ্ন নিয়ে ওর সঙ্গে কম খুনসুটি করি না। এই একটু আগেই যেমন, যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছি এমনভাবে বললাম, তবে বিনুকে শুনিয়ে শুনিয়ে অবশ্যই—জমি কিনতে যাওয়ার মানে অবশ্যই এই না যে জমিটা কিনেই ফেললাম।

বিনু, আমার খোঁচাটা ঠিকই বুঝল, তবে আমার কথার যে-রকম উত্তর হওয়া উচিত, সে-রকম উত্তরও দিল না। ও খুব ভালো মানুষের গলায় বলল—হ্যাঁ, তা তো বটেই। দেখা মানেই তো পছন্দ হওয়া না, পছন্দ না-ও হতে পারে। মনে হতেই পারে—না, এটা না।

আবার পছন্দ হলেও সব সময় হয় না। হয়তো পছন্দ হলো, কিন্তু হলো না।

কেন? হলো না কেন? বিনু চুল ঠিক করতে করতে আমার দিকে ফিরে তাকাল।

সে নানা কারণ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ধরে নাও—কিছু কিছু পছন্দ ইচ্ছা করেই পূরণ করতে হয় না।

বুঝেছি বাবু। এখন তো তুমি ওই কথা বলবে, না?

কোন কথা?

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তুমি এখন কথা ওই দিকে টেনে নিয়ে যাবে, ওই যে—জীবনে কিছু কিছু অতৃপ্তি ও অপ্রাপ্তি থাকা দরকার। না হলে জীবন সুন্দর হয় না।

ধরো, ওই কথাই বললাম।

জমি না কিনে একটা বাড়তি অতৃপ্তির কী দরকার! তোমার জীবনে তো এমনিতেই অনেক অতৃপ্তি। যেমন, আমাকে নিয়েই তোমার বড় এক অতৃপ্তি। তা-ই না? কথা শেষ করে বিনু মুচকি মুচকি হাসতে আরম্ভ করল।

তুমি আমার গভীর অতৃপ্তি বিনু। আমি বললাম। তুমি আমার গভীরতম অতৃপ্তি।

তোমার বলার ধরনটা কী রকম জানো?

কী রকম?

যেন তুমি তোমার কথাগুলো তোমার প্রেমিকাকে বলছ।

তুমি কি প্রেমিকা নও?

বিয়ের ১১-১২ বছর পর স্ত্রী কি আর প্রেমিকা থাকে?

তাহলে?

স্ত্রী হয়ে যায় একটা অভ্যাস, জীবনযাপনের অংশবিশেষ কিংবা একটা অঙ্গের মতো।

আমি হাসতে আরম্ভ করলাম—তুমি আমার কথাগুলোই আমাকে ফিরিয়ে দিলে। এ কথাগুলো তুমি দেখছি বেশ মনে রেখেছ!

বিনু হাসল—কী আর করব! মনে তো রাখতেই হয়। তোমার এত ভারী ভারী কথা কি এমনিতে আর আমার মাথায় আসে!

আমরা জমি দেখতে যাব রানুদের সঙ্গে। এরকম কথা হয়েছে—পছন্দ হলে আমরা পাশাপাশি দুটো প্লট কিনব। রানুর শ্বশুরবাড়ি যেটা, সেটার কথা বলেছি আমি, বিশাল। ওরকম একটা বাড়ি থাকলে কতভাবেই-না থাকা যায়। সমস্যা ভাবলে সমস্যা একটাই—এলাকাটা ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। শুক্রবার বা ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিন বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে ও বাড়িতে ঢুকতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। হয়তো বাস্তবতা হচ্ছে এদিকে ভিড় আরো বাড়বে এবং একসময় এ বাড়িটা বিক্রি করে দিতে হবে। ওরা অবশ্য ধানমন্ডিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট বুক করে কিস্তিতে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। সামনের বছর ওটা ওরা হাতে পাবে, তবে পাশাপাশি ওরা একটা জমিও রাখতে চায়।

ওদেরই পরিচিত এক লোক, জমির দালালিই যার পেশা, এ জমির খোঁজ এনেছে। বলেছে, এই এখনই দেখলে হয়তো এ জমি পছন্দ হবে না, নানা অসুবিধা চোখে পড়বে, এমনও মনে হতে পারে—আরে, এখানে কেউ জমি কেনে বাড়ি করার জন্য—এসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে রেখে জমিটা দেখতে হবে বছর দুয়েক পর ওই এলাকা কেমন হবে, সেটা ভেবে। আমি কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ঠিকই আছে, বছর এক-দেড়েকের মধ্যেই এ এলাকায় হাত পড়বে। এলাকা ঘিরে এদিক-ওদিক সরকারি রাস্তা যাবে, আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থাও তৈরি হয়ে যাবে, তখন এ জমিটাই হয়ে উঠবে দারুণ এক ব্যাপার। এখনই যে জমিতে বাড়ির কাজ আরম্ভ করা যাচ্ছে না, সেটাও একদিক দিয়ে ভালো। বিনুর স্বভাব আমি জানি। জমি কেনা হলেই বাড়ির কাজ আরম্ভ করার জন্য ও অস্থির হয়ে উঠবে। যদি সত্যিই ও জমিটা কেনা হয়, বছর দেড়-দুই সময় পাওয়া যাবে, এটা আমার জন্য স্বস্তির হবে।

রানু ফোন করল—কী ব্যাপার, তোমাদের দেরি হচ্ছে কেন!

কোথায় দেরি!

শোন বাবু, যত তাড়াতাড়ি আমরা বের হতে পারব, তত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব।

জো হুকুম মহারানি…আর কিছু বলবেন?

আপাতত না।

ঠিক আছে, যখন বলেন…অপেক্ষায় থাকলাম।

রানু বুঝল না, কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করল—অপেক্ষা করে থাকলে মানে?

তুমি আপাতত যে কথা বলছ না, সে কথা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।

রানু হাসল—বেশ।… শোনো, তাড়াতাড়ি চলে আস।

আমি তাড়াহুড়ো আরম্ভ করলাম। বিনুকে বারবার তাড়া দিলাম। বিনু বলল—আহা, আমার এতক্ষণে হয়েই যেত, কেন হচ্ছে না তা জানো?

কেন? আমি জানতে চাইলাম।

বিনু আমার সামনে এসে ওর গলার এক জায়গায় আঙুল তুলে দেখাল—দেখো, তুমি এখানে কী করেছ?

বেশ অনেকদিন পর গতরাতে আমার আর বিনুর পরস্পর আক্রমণাত্মক এক মিলন ঘটেছে। আমরা অবশ্য একটা দিনও প্রায় বাদ দেই না, কিন্তু সে মিলনগুলো হয় অভ্যাস মাফিক—একটু হওয়া দরকার, না? আস তাহলে—এরকম। কিন্তু কাল রাতেরটা ছিল তীব্র ও জেদি, যেন কে কাকে হারিয়ে দিতে পারে, এমন এক প্রতিযোগিতা হঠাত্ আমাদের শুরু হয়ে গেল।

রাতে আমাদের বাসায় একটা আড্ডা ছিল। এরকম আড্ডা প্রায়ই হয় আমাদের এখানে। খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু আসে। মদ্য পান হয় এবং নানা ধরনের গল্প, তারপর খেয়েদেয়ে টিপসি হয়ে যে যার বাসায়। গতরাতে বন্ধুরা বিদায় নিলে টুকটাক কাজ গুছিয়ে, বাকি কাজ পরের দিন গোছানোর জন্য রেখে আমরাও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। আমি বললাম, ঘটনাটা ঘটিয়ে তারপর না হয় উচিত অনুচিতের কথা ভাবা যাবে।

সাধারণতই এ অবস্থায় মিলন হয় এলোমেলো, আমাদেরটা হলো দীর্ঘমেয়াদি ও কিছুটা হিংস্র, যেখানে আগেই বলেছি, পরস্পরকে এক হাত দেখে নেয়ার চেষ্টা আছে। মিলন শেষে কিছুক্ষণ পর বিনু যখন উঠে যাচ্ছে বাথরুমে, তার আগে আলতো করে আমাকে একটা চুমু খেয়ে যেন নিজেকেই বলল—আচ্ছা, এই পাগলটাকে আমি এত ভালোবাসি কেন!

এই মিলন শেষে যা হলো, আমাদের ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেল। এই নিয়ে বিনুর কপট রাগ—সকালে তো তোমাকে লাফ দিয়ে উঠতে হবে না, সুতরাং তোমার ঘুম না এলে কী অসুবিধা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম—হুঁ, তারপর বললাম—আজকে আকবরের মাতব্বরী মার্কা কথাগুলো খেয়াল করেছ?

আমাদের পারিবারিক বন্ধু আকবর, সবই ভালো ওর, শুধু নিজেকে জাহির করার চেষ্টাটা ছাড়া। যেমন পৃথিবীর অধিকাংশ ব্যাপারই ওর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না, ‘আরে এটা তো এই’ কিংবা ‘ওটা তো এই ব্যাপার’ ওর মুখে লেগেই আছে। ও পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ও মাঝে মাঝে এমন একটা ভাব নেয়—যেন ওর মতো বড়মাপের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আগে জন্মায়নি। ওর স্ত্রী পানসি একটা এনজিও করে, ছোট আকার কুটিরশিল্পের মতো, তবে তারও খুব বুঝদারের মতো বড় বড় কথা। তবে এমনিতে এ পরিবারটি খুব আন্তরিক ও বন্ধুদের জন্য সব সময় হাত বাড়ানো।

বিনু আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকাল—শুধু আকবর ভাইয়ের কথা বলছ কেন! তুমি কি পানসির জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো শোনোনি?

হুঁ শুনেছি। মাঝে মাঝে একদম পিত্তি জ্বালিয়ে দেয়।

আমি অবশ্য এখন ওদের কথা বলে মুডটা নষ্ট করতে চাই না।

মুড এল কোত্থেকে?

আহা, আসবে না?! কতদিন পর ওভাবে হলো, বলো তো?

আমি কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম—কখনো কখনো একটা কথা আমার খুব মনে হয়।

বিনু আমার দিকে তাকাল।

বিশেষ করে এসব সময়ে। এরকম মিলন কিংবা অন্তরঙ্গ কোনো মুহূর্তে, যখন আমরা পরস্পরকে একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি, যখন আমরা অনেক আনন্দের মধ্যে থাকি…।

আমার দিকে তাকিয়ে থাকা বিনুর ভুরু কুঁচকে গেল।

এরকম মনে হওয়ায় মাঝে মাঝে আমার খুব অবাক লাগে। জীবন আসলে খুব আজব একটা জায়গা। ‘জীবন খুব আজব এক জায়গা’ বলে আমি চুপ করে থাকলাম।

বিনু বলল—কিন্তু কী মনে হয় তোমার সেটা তো বললে না!

তোমার আমার বিয়েটা প্রেমের না।

বিনু হাসল—কে জানে হয়তো প্রেমের হতে পারত। শুধু প্রেমের সুযোগটা পাওয়া যায়নি।

হ্যাঁ, হয়তো। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের বিয়েটা হয়েছে পারিবারিক পর্যায়ে।

হুঁ, কিন্তু তাতে কী? তাতে কি আমাদের ভালোবাসায় কমতি পড়েছে?

তা নয় বিনু। … ধরো, তোমার সঙ্গে আমার, আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা না-ও হতে পারত।

তো? বিনু আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

ধরো, অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হলো তোমার! আমি না, অন্য কেউ। তার সঙ্গেও তুমি আমার মতোই অন্তরঙ্গ হতে, মিলিত হতে, বলতে—আমাদের চেয়ে সুখী আর কে আছে। মিলনের পর কপালে চুমু খেয়ে বলতে—আচ্ছা, এই পাগলটাকে আমি এত ভালোবাসি কেন!

বিনু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—এই কথাটা তো তোমার বেলায়ও খাটে।

হ্যাঁ, অবশ্যই খাটে বিনু। তোমার সঙ্গে না হয়ে যদি অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হতো আমার, তাকে আমি এরকমই ভালোবাসতাম, তাকে বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে রেখে থাকতে পারতাম না। ভাবতাম—এই মেয়েটা আমার জীবন ভরিয়ে দিয়েছে।

বিনু আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল—তুমি হঠাত্ এ কথা বললে কেন? কিছু কি ঘটেছে?

এটা কি কিছু ঘটেছে বলে বলার মতো কথা?

আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

এমনি বলেছি বিনু, এমনি তবে হঠাত্ বলিনি।

হঠাত্ই বললে।

হঠাত্ না। বলেছি তো—মাঝে মাঝে এ চিন্তা আসে মাথায়।

কেন আসে?

বললাম না—জীবন আসলে অদ্ভুত একটা ব্যাপার।

বিনু সামান্য হাসল—হুঁ।… শোন বাবু।

বলো।

তুমি আর কখনো এই কথা আমাকে বলবে না।

কেন?

আমার শুনতে ভালো লাগেনি।…বাবু, আমি ভাবতে পারি না, ছিঃ…অন্য এক পুরুষের সঙ্গে…।

কিন্তু ওরকম হতেই পারে। আমাদের ক্ষেত্রেও হতে পারত।

পারুক। তবু তুমি বলবে না। বিনু জেদ জেদ গলায় বলল। তারপর হঠাত্ ও হাসতে অরম্ভ করল।

আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম—হাসছ যে!

আমার সঙ্গে না হয়ে তোমার ধরো পানসির সঙ্গে বিয়ে হলো।

আর তোমার আকবরের সঙ্গে।

আমরা দুজনই অনেকক্ষণ ধরে হাসলাম। বিনু বলল—তুমি বলেছ, আমাদের বিয়েটা প্রেমের নয় বলে আমাদের অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হতে পারত। আমার মনে হয় কী জানো—প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও কিন্তু এরকম হতে পারে।

আমি মাথা দোলালাম—তা তো বটেই। একজনের সঙ্গে প্রেম থাকলেও অন্যজনের সঙ্গে বিয়ে হতে পারে।

বিনু বলল—অমি ঠিক সে-কথা বলছি না। ধরো আমাদের দুজনের প্রেম। তারপর বিয়েও হলো আমাদের। ভালোবেসে বিয়ে। কিন্তু তোমার আমার প্রেম তো তোমার আমার সঙ্গে না হয়ে অন্য কারো সঙ্গে হতে পারত।

আমি অবাক চোখে বিনুর দিকে তাকালাম।

বিনু হাসল—ধরো, অন্য একটা ছেলের সঙ্গে আমার প্রেম হলো, অন্য মেয়ের সঙ্গে তোমার।

ধরলাম। এবং আমরা পরস্পরকে খুবই ভালোবাসতাম, তা-ই না?

প্রেম যখন করতাম, তখন ভালো তো বাসতামই।

নিশ্চয় তোমার মনে হতো ওই মেয়েকে না পেলে জীবন হবে অর্থহীন।

আর আমি ভাবতাম—ওই ছেলের মতো ছেলেই হয় না।

তাহলে তুমি ভেবে দেখ বিনু, জীবন আসলে কত হাস্যকর!

বিনু আমার দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল—হাস্যকর?

হাস্যকর নয়?

তোমার কি সেরকমই মনে হয়?

আমার মনে হওয়া, না হওয়ায় কিছু এসে যায় না বিনু। জীবন হাস্যকর—এটাই হচ্ছে ব্যাপার।

বিনু হেসে মাথা নাড়ল—না, জীবন হাস্যকর না। জীবন সুন্দর।

ওরকম ভেবে তুমি যদি সান্ত্বনা পাও, তবে তা-ই।

সান্ত্বনা যদি বলো তবে সান্ত্বনাই। তবে আমার কথা হচ্ছে, হয়তো ব্যাপারগুলো যেভাবে নির্ধারিত হয়ে আছে, সেভাবেই ঠিক ও সুন্দর।

আমি বিনুর দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য কিছুটা সময় নিলাম, তারপর বললাম—একটা কথা কি জানো বিনু, মাঝে মাঝে তুমিও ফিলোসফার?

এখন বিনু দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আঙুল দিয়ে ওর গলার দাগ দেখাচ্ছে। আমি বললাম—আরে ওটা কোনো ব্যাপার না। ওতে কিছু হবে না।

না হবে না! রানু দেখলে কী ভাববে বলো তো!

কিছুই ভাববে না।

ভাববে বুড়ো বয়সেও আমাদের এত!

ওরকম ভাবলে অসুবিধা কী! ওদের ফুরিয়ে গেছে বলে আমাদের থাকবে না?

ওদের ফুরিয়ে গেছে, এই অদ্ভুত তথ্য তোমাকে কে দিল?

কেউ দেয়নি। আমার মনে হয়।

বিনু আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন ওর জানাই আছে আমি আরো কিছু বলব। আমি বললাম—আমার মনে হয় রানুর স্বামী ওই কাজটা কখনোই ভালোভাবে পারেনি।

বিনু আমার দিকে অদ্ভুত চোখে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর হালকা গলায় বলল—অসভ্য অসভ্য কথা বলতে তুমি আসলেই খুব মজা পাও।

আমরা যে জমি দেখলাম, সেটা আমাদের পছন্দ হয়ে গেল। আমার, বিনুর তো বটেই, রানুদেরও। চারদিক থেকে যোগাযোগ খুব সহজ, মেইন রোড থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে, তবে সেটা কোনো সমস্যা না। ওপাশ দিয়ে যখন একটা রাস্তা হবে, রাস্তা হবে এটা আমরা জানি, তখন যোগাযোগ যাতায়াত আরো সহজ হয়ে যাবে। আমি বিনুকে বললাম—বিনু, জমিটা আমার পছন্দ হয়েছে।

বিনু হাসল—সে তো তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।

কিন্তু আমি কখনোই জমি কিনতে চাইনি জানো।

বাড়ি কিনতে চেয়েছ, এই তো? তা ওই একই ব্যাপার।

ঠিক একই ব্যাপার না বিনু। তৈরি জিনিস কেনা আর তৈরি করার মধ্যে পার্থক্য আছে।

বিনু মাথা দোলাল—হুঁ।

জমিটা আমার পছন্দ হয়েছে, আমার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে বিনুর, এটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কেমন ছেলেমানুষের মতো বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি নিশ্চিত ও বাড়ির একটা নতুন প্লানও এরমধ্যে করে ফেলেছে। আমি ওর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মনে হলো ওর একটু একা থাকা দরকার। ও বাড়ির কথা ভাবছে ওই ভাবনায় আমি, অনি আর সোমও আছি, তবু ওর একটু একা থাকা দরকার। সরে আসতে আসতে আমার মনে হলো—তৈরি জিনিস আর তৈরি করা, না? হুঁ তৈরি বাড়ি, বাড়ি তৈরি। তৈরি বাড়ি ও জমি। আচ্ছা, ব্যাপারটা কী এরকম—বাড়ি কিনলে অনেক সময় সেটা নিজের মনে না-ও হতে পারে, সেটা সারা জীবন ধরে শুধু থাকার একটা জায়গা, কিন্তু জমি অন্য ব্যাপার, ওর মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপার আছে?

আমাদের যে লোক জমি দেখাতে নিয়ে এসেছে, তার নাম নাজিরুল। জমির দালাল। নাজিরুল ইসলাম, এই নামটা জমির দালালের নাম হিসেবে ঠিক আছে, তবে নামটা মানানসই হলেও নাজিরুলের ভাবটা জমির দালাল হিসেবে মানানসই নয়। জমির দালালদের মধ্যে সব সময় একটা গদগদ ভাব থাকে, খুশি করার চেষ্টা থাকে, সেই চেষ্টার ছাপটা চোখে মুখে পড়ে যায়। নাজিরুলের মধ্যে ওসব কিছু নেই। বরং বেশ একটা ভারিক্কি ভাব আছে। যেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কথাও বলেন বেশ গম্ভীর গলায়, বইয়ের ভাষায়।

নাজিরুল ইসলাম বললেন—আপনাদের একটা সুসংবাদ দেওয়া আমার কর্তব্য।

আমরা সবাই তার দিকে ফিরে তাকালাম।

এই যে জমি, এই জমির পুরোটাই মুসলমান জমি।

মানে! আমরা নাজিরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

ওই পাশে অনেক জমি আছে। নাজিরুল ইসলাম হাত তুলে একদিকে দেখালেন। একটা কোম্পানি পত্রিকায় ওই জমির বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু আপনাদের জানা দরকার, ওই জমি হিন্দু জমি।

হিন্দু জমি, মুসলমান জমি—ব্যাপারটা কী বলেন তো ভাই!

লোকটা বললেন—এই জমি মুসলমান জমি, ওই জমি হিন্দু জমি—এই হচ্ছে ব্যাপার।

বিনু আর রানু আমার পাশে দাঁড়ানো, আমি মৃদু গলায় বললাম—আমার মনে হচ্ছে এই জমির খত্না হয়েছে আর ওই জমির খত্না হয়নি।

বিনু আমার ওপর রেগে গেল আর রানু হাসতে আরম্ভ করল। আমি নাজিরুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম—এর মানে কী সেটা আমাদের বলেন।

এই জমির মালিক মুসলমান, তিনি আছেন, মালিকদের সবাই আছে।

আর ওসব জমির মালিক হিন্দু?

জি। তবে সেইটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে তাদের কোনো খোঁজ নাই।

ভারতে চলে গেছে?

জি, বিভিন্ন সময়ে ভারতে চলে গেছে। তাদের জমি দখল করে নিয়েছে ওই হাউজিং কোম্পানি।

আপনি সে-কথা বলেন, মুসলমান জমি, হিন্দু জমি—এসব বলছেন কেন?

বললাম আর কী।…ওই হাউজিংয়ের জমি কিনলে আপনারা হবেন অবৈধ মালিক। শান্তি পাবেন না।

আজকাল বৈধ অবৈধ ব্যাপার নিয়ে কেউ আর অত মাথা ঘামায় না। ওদের জমি তো কিনছে লোকজন, কিনছে না?

জি, তা কিনছে। তবে ওই যে বললাম—ওই জমিতে মনের শান্তি থাকবে না।

থাকবে। এত অল্পতে আজকাল আর মনের শান্তি নষ্ট হয় না।

জি, তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।

শোনেন, নাজিরুল সাহেব, আপনার এই জমি আমাদের মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। তবে হুট করে তো কেউ জমি কেনে না। আমরা আরও জমি দেখব।

জি, তা তো দেখবেনই।

আপনিও দেখেন, আপনার মক্কেল কততে ছাড়বে…।

আমরা দুপুরে সবাই মিলে বাইরে খেলাম। বিনু খেতে খেতে হঠাত্ বিষম-টিষম খেয়ে একাকার—আমরা তাহলে কিছু মুসলমান জমি কিনলেও কিনতে পারি।

এই নিয়ে আমাদের কতক্ষণ হাসাহাসি হলো। রানু বলল—হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, কিছু জমি ওখানে আমি কিনতে চাই।

এ তো মোটামুটি ঠিকই হয়ে গেছে, জমি আমরা ওখানে কিনব। এখন শুধু অপেক্ষা—দাম কিছু কমানো যায় কি-না। আমরা উঠলাম। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোতে বেরোতে রানু মৃদু গলায় বলল—বাবু, তোমাকে একটা কথা বলব।

বলো।

তোমার স্বভাব তো আমি জানি, সেজন্য বলছি।…হঠাত্ দেখা গেল তুমি ওখানে জমি কিনতে চাচ্ছ না। কেন চাচ্ছ না—সেটা কাউকে বলবেও না।

তোমাকে বলব। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম।

রানু আমার ইয়ার্কিটুকু নিল না, ও আগের মতোই মৃদু গলায় বলল—তুমি… তোমার জমিটা কেনো।…পাশাপাশি থাকব।

আমরা, আমি, বিনু, অনিন্দিতা, সোম যখন বাড়ি ফিরে আসছে, বিনু বলল—আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

আমি তাকালাম বিনুর দিকে—একটা কেন, দশটাও করতে পার।

না, একটাই করব।

করো। আমি বিনুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আশা করি, তুমি সত্যি উত্তরটা দেবে।

দেবো।… তুমি কী জিজ্ঞেস করবে?

যেটা আমার জানা দরকার, সেটাই জিজ্ঞেস করব।…বাবু, তোমার কি জমিটা পছন্দ হয়েছে?

আমি সামান্য হাসলাম, আমার নিজের কাছে মনে হলো ওই হাসিটা স্বস্তির, আমি বললাম—তোমার কী মনে হয়, আমার পছন্দ হয়েছে কি হয়নি?

তোমার ব্যাপার যখন, তুমিই বলো।

আমার মনে হয় আমার পছন্দ হয়েছে। বেশ সুন্দর।

তুমি কি জমিটা কিনবে?

কেনাই তো উচিত, তা-ই না?

সরাসরি বলো বাবু—কিনবে কি কিনবে না।… তোমার স্বভাব তো আমি জানি।

আমার স্বভাব নিয়ে আবার টানাহেঁচড়া কেন!

পছন্দ হওয়ার পরও দেখা গেল তুমি কোনো এক অদ্ভুত কারণে জমিটা কিনলে না।

না, কিনব। আমি মাথা দোলালাম। ওই জমিটা কিনব।

সত্যি বলছ—কিনবে?

আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বিনু—ওই জমিটা আমি…আমরা কিনব।

বিনু গভীর তৃপ্তির সঙ্গে আমার হাত ধরল।

বাড়ির সামনে এসে যখন গাড়ি থামল, বিনু খুব হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামল। কিছু বলবে বলে আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমাদের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটা লোক। আমাদেরই বয়সী কিংবা কিছু ছোট। সুন্দর চেহোরা, সুবেশী। আমাকে লোকটা দেখল একপলক, তারপর প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে বিনুর পাশে এসে দাঁড়াল—বিনু, আমাকে চিনতে পারছ?

বিনু একটু চমকাল, লোকটার দিকে তাকাল বোকা বোকা চোখে তারপরই হাসিতে ভরে গেল ওর মুখ—জিলানী!

জিলানী নামের লোকটা হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল—ঠিক চিনেছ।

বিনু খুশিতে লাফাতে আরম্ভ করল—জিলানী, কবে ফিরেছ তুমি? তুমি কবে ফিরেছ জিলানী!

আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, তুমি আমাকে চিনতে পারো কি-না।

এটা একটা কথা বললে! আমি তোমাকে চিনব না!

তবু, বহুদিন পর তো…।

বিনু এবার আমার দিকে ফিরল—বাবু, তোমাকে কি আমি জিলানীর কথা বলেছি?

আমি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু বলার আগেই জিলানী এগিয়ে এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল—আমরা হচ্ছি ছোটবেলার বন্ধু। একই এলাকায় আমরা থাকতাম।

ও ছিল ডাকাত দলের সর্দার।…বাবু, কী ডাকাত যে জিলানী ছিল, ওর শয়তানিতে সবাই তটস্থ থাকত।

অনেক বদলে গেছি, অনেক বদলে গেছি। জিলানী হাসতে আরম্ভ করল।

কবে এসেছ, বলো তো?

গত সপ্তাহে। দশ বছর পর। তোমার ঠিকানা কার কাছ থেকে পেয়েছি, জানো?

উঁহু, কে দিল?

রুবি।…আমি এসে দেখি তোমরা নেই। চলে যাব…।

বিনু হাসতে হাসতে বলল—কপালে থাকলে জনাব, ঠিকই দেখা হয়।

আমরা বাসায় ঢুকলাম। কিছুক্ষণ ড্রইংরুমে বসে জিলানীর সঙ্গে গল্প করলাম। তারপর, ‘ঠিক আছে আপনারা গল্প করুন, অনেক গল্প নিশ্চয় জমে আছে’ বলে উঠে এলাম। আমার উঠে আসার একটু পরই এল বিনু। কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে বলল— ভাবছিলাম বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেব…। আমি একটু হাসলাম। বিনু পোশাক পাল্টে আবার ড্রইংরুমে ফিরে গেল।

আমি, অনিন্দিতা আর সোম টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে আরম্ভ করলাম। কার্টুন আমারও খুব ভালো লাগে। অনিন্দিতা আর সোমের খুবই পছন্দ। ওরা আমার দু’পাশে বসে আছে। আমি একটু পর ওদের দুজনের কাঁধে হাত রাখলাম—তোমরা জানো আজকে আমরা কোথায় গিয়েছিলাম?

অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকাল, সোম বলল—জানি বাবা, জমি দেখতে।

জমি আমাদের পছন্দ হয়েছে।

ওরা কিছু বলল না। ওরা কার্টুন দেখছে।

এরপর কী হবে বলো তো?

অনিন্দিতা জিজ্ঞেস করল—জমিটা তুমি কিনবে বাবা?

কিনব।… আমরা আর রানু খালামণিরা পাশাপাশি জমি কিনব। কেমন হবে?

দারুণ হবে বাবা।

হ্যাঁ, দারুণ হবে।…পাশাপাশি…।

ওরা কার্টুনের ভেতর আরও ডুবে গেল। ড্রইংরুমে গল্প করছে বিনু আর ওর শৈশবের বন্ধু জিলানী। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলাম—হুঁ, পাশাপাশি থাকা হবে।…বাড়ি উঠবে…।

তারপর?

বিনু মন খুলে বাড়ি গোছাবে, বাড়ি সাজাবে। আমি ওর পাশে থাকব।

তারপর?

বাড়ির বারান্দায় হালকা রোদের ভেতর বসে থাকব আমি।…বিনু থাকবে পাশে।…গল্প করার জন্য কখনো রানুও চলে আসবে।

তারপর?

ওই বাড়িতে নতুন জীবন এক। কত আনন্দ, কত গল্প, কত তৃপ্তি, কিছু মন কষাকষি, মান অভিমান…।

তারপর?

তারপর একটু একটু করে আমাদের বয়স আরও বেড়ে যাবে।

তারপর?

আর কী—একদিন আমি চলে যাব, তারপর বিনু। কিংবা আমার আগে বিনু, পরে আমি।

তারপর?

আমাদের ছেলেমেয়েরা কাঁদবে, অনেকদিন ওদের মন খারাপ হয়ে থাকবে।

তারপর?

তারপর ওদের কাছে আমরা একটু একটু করে ম্লান হয়ে যাব। ওরা ওদের নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওদের দোষ নেই—বিধান কিংবা ব্যবস্থা এরকমই।

তারপর?

আমি কিংবা বিনু কোনোদিনই জানতে পারব না আমাদের ছেলেমেয়েরা কেমন আছে।…আর, আমিও জানব না বিনুর কথা, বিনুও জানবে না আমার কথা।

তারপর?

তারপর এক এক করে আরও অনেকদিন পার হয়ে যাবে। আমাদের সোম থাকবে না, আমাদের অনিন্দিতা থাকবে না।…আমরা নিশ্চয় তখন কষ্ট পাব না, কারণ ওই বোধ আমাদের থাকবে না…অস্তিত্ব থাকলেই-না বোধ।

তারপর?

তারপর কী যে হবে জানি না। ৫০ বছর পর, ১০০ বছর পর, ২০০ বছর পর—উঁহু জানি না। মানুষ জানে না। যেমন জানত না, আমরা আজ হাসিমুখে যে লোকের জমি পছন্দ করে এলাম।

আমি অনিন্দিতা আর সোমের কাঁধে হাত রাখলাম। একটু জোরেই বোধহয় রাখলাম। ওরা দুজনই আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমি বললাম—কিছু না।…কার্টুনটা খুব মজার তো, তাই।

আমি হাসিমুখে কার্টুন দেখতে লাগলাম। আমার দু পাশে সোম আর অনিন্দিতা। ড্রাইংরুমে বসে গল্প করছে বিনু তার শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে। মাঝে মাঝে বিনুর হাসির শব্দ পাচ্ছি। মানুষের শৈশবে অনেক আনন্দের স্মৃতি থাকে। বিনুরও নিশ্চয় আছে।

সে-রাতে আমি নাজিরুল ইসলামের সঙ্গে আমার কথোপকথনের এক স্বপ্ন দেখলাম। যে জমিটা দেখে আমাদের পছন্দ হয়েছে, আমি আর নাজিরুল সে জমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। নাজিরুল গম্ভীর মুখে আমার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম—জমি তো আমার পছন্দ হলো।

নাজিরুল বললেন—এ জমি স্যার পছন্দ হওয়ার মতোই।

তা ঠিক। আপনি ঠিক জায়গায় এনেছেন।

মানুষকে ঠিক জায়গায় আনাই আমার কাজ।

মানে!

জমির কথা বলছি স্যার। এই যে ঠিক জমির কাছে আপনাদের আনলাম।

হুঁ। আপনি জমি চেনেনে।

স্যার, জমি চিনতে হয়।

জমি চিনতে হয়?

চিনতে হয় স্যার। না চিনলে জমি আপনার হবে কী করে?

খুব ঠিক কথা।…কিন্তু নাজিরুল সাহেব…।

জি স্যার, বলেন।

আপনি জমি বিক্রি করেন…।

বিক্রির জন্যও চিনতে হয় স্যার। কেনার চেয়ে বিক্রি কম বড় ব্যাপার না।

হুম।…নাজিরুল সাহেব…।

জি স্যার?

আপনি নিজের জমিটা খুব পছন্দ করে কিনেছেন?

আমার স্যার নিজের জমি নাই।

ও।… কেনেননি?

কিনব না স্যার।

কিনবেন না মানে! মানুষজনের কাছে জমি বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন…।

ওই যে স্যার, জমি চিনি স্যার, সেজন্য কিনব না।

মানে কী?

বললাম না স্যার—জমি চিনলে জমি আপন হয়, এইটাই সমস্যা।

বুঝিয়ে বলেন।

জমি চিনলে মায়া হয় স্যার আর জমি কিনলে বান্ধা পড়ে। আমি স্যার বান্ধা পড়তে চাই না।

এমনিতেই স্যার কত জায়গায় বান্ধা আছি। আবার স্যার জমিতে বান্ধা পড়া…কী দরকার?

দরকার নেই?

না স্যার, দরকার নাই।

ছয়.

আমি মুনিরাকে ভালোবাসতাম, মুনিরা আমাকে। মুনিরার মতো বুদ্ধিমান মেয়ে আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। হিসাবমতো ওর বুদ্ধিমান হওয়া কথা না। কারণ ওর বাবা কিংবা মা কাউকেই আমার কখনো তেমন বুদ্ধিমান মনে হয়নি। কিংবা আমারই হয়তো ভুল। হয়তো মুনিরার বাবা-মা দুজনই খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু আমার সঙ্গে তাদের ভালোবাসা দেওয়ার সম্পর্ক, তারা আমাকে ভালোবাসা দিয়ে গেছেন। তাদের বুদ্ধির ছোঁয়া আমি কখনো পাইনি, পাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। সে যাক, মুনিরা, আমার ধারণা, প্রায় শয়তানের মতো বুদ্ধিমান। ও আমাকে মাঝে মাঝে একটা কথা বলত—বাবু ভাই, আপনি কি খেয়াল করেছেন, মানুষের জীবন খুবই বৈচিত্র্যহীন।

আমি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু একটা বলতাম। হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলে মাথা ঝাঁকাতাম, কিংবা ‘না’ বলে মাথা নাড়াতাম। মুনিরা একেকবার মানুষের জীবনে বৈচিত্র্যহীনতার একেকটা উদাহরণ দিত। একবার ও বলল, মানুষ আসলে অধিকাংশ সময়েই প্রথার বাইরে যেতে পারে না।

আমি বললাম—সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

তাই বলে সবকিছুই প্রথামাফিক করতে হবে! এমনকি প্রেমও?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি কি আর সাধে বলি মানুষের জীবন বৈচিত্র্যহীন।

তুই আসলে কী বলতে চাস, সেটা বল।

এদেশের ছেলেমেয়েদের প্রেম কীভাবে হয় জানেন?

কীভাবে?

এদেশের ছেলেমেয়েদের প্রথম প্রেম হয় পাশাপাশি বাসায় থাকতে থাকতে। পাশাপাশি বাসায় যখন আছে, তখন প্রেম তো হবেই। এটা হচ্ছে প্রথমত…।

আর দ্বিতীয়ত?

দ্বিতীয়ত প্রেম হয় খালাত, মামাত, ফুপাত ভাইবোনের মধ্যে।

এটা তোর গবেষণা?

গবেষণা হতে যাবে কেন, আপনি নিজেই দেখেন না—আপনি আমার ফুপাত ভাই, আমি আপনার মামাত বোন—আমাদের প্রেম হয়েছে।

কথা শেষ করে একটা পাক্কা শয়তানের মতো হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে মুনিরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমরা যদি আমাদের জীবনে বৈচিত্র্য বাড়াতে চাই, তাহলে মুনিরা, একটা কাজ করা যেতে পারে।

বলেন শুনি, আপনি তো মাঝে মাঝেই খুব গম্ভীর কথা বলেন।

আমরা আমাদের প্রেমটা ভেঙে ফেললেই পারি।

তাহলে জীবনে বৈচিত্র্য বাড়বে?

বৈচিত্র্য না বাড়ুক, প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে।

বাবু ভাই, আমাদের প্রেমটা ভাঙতে হবে না।

কেন?

কারণ ওটা এমনিতেই ভেঙে যাবে।

কেন এমনিতেই ভেঙে যাবে?

ওটাই নিয়ম। খালাত-মামাত-ফুপাত ভাইবোনদের প্রেম যেমন এমনিতেই হয়, তেমনি এমনিতে ভেঙে যায়।

আমি আর মুনিরা যেভাবে বলতাম, আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ছিল না। তবে আমাদের ভেতর একটা সম্পর্ক ছিল। আমরা দুজনকে পছন্দ করতাম… হ্যাঁ, ভালোও নিশ্চয় বাসতাম। কিন্তু আমরা কখনো প্রেমিক- প্রেমিকার মতো আচরণ করিনি। আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি একসঙ্গে, পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হইনি, কোনো রকম শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। আমার আর মুনিরার সম্পর্ক ছিল অন্যরকম।

বড় মামা তার ছোট বোন, অর্থাত্ আমার মাকে ভালোবাসতেন খুব। আমরা যখন ঢাকা চলে এলাম, বড় মামা দু মাস পরপর তার ছোট বোনকে দেখতে আসতেন। এসে বেশ কিছুদিন থাকতেন। কখনো আবার সুযোগ হলে আমাদের সবাইকে নিয়ে যেতেন তার ওখানে। মুনিরা আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা যাওয়া-আসা ও পাশাপাশি থাকার মধ্য দিয়ে। সে হিসেবে ওটা খুবই গতানুগতিক সূচনা। কিন্তু ওই যে বলেছি, ঠিক প্রচলিত অর্থে প্রেম বলতে যা বোঝায়, সেরকম কিছু ছিল না আমাদের মধ্যে। মুনিরা বয়সে ছোট, তবে আমার ওপর খবরদারি করতে ভালোবাসত— বাবু ভাই, এই শার্টটা আপনাকে মানাচ্ছে না।

আর আমিও বোধহয় চাইতাম ও আমার ওপর খবরদারি করুক—মানাচ্ছে না?

না।

কী করব?

আশ্চর্য, কী আবার করবেন—শার্টটা বদলে নেন।… আর কখনো এই শার্ট পরবেন না।

মাত্র কিনেছি। এই নতুন শার্টটা এখন আমি কী করব?

বাতিল করে দেন। কাউকে দিয়ে দেন।

খুব বললি। এটা কিনতে পয়সা লাগেনি?

বোকার মতো কিনেছেন কেন!…ঠিক আছে, আমি নতুন একটা শার্ট কেনার পয়সা দেবো।

তুই পয়সা পাবি কোত্থেকে?

আপনি জানেন না, আমার বাবার কি পয়সার অভাব আছে?

কখনও আবার মুনিরা বলত—বাবু ভাই, এবার আপনি কোত্থেকে চুল কাটিয়েছেন?

কেন, যে সেলুনে প্রতিবার কাটাই, সেখানেই কাটিয়েছি।

একটা চেয়ারে বসে তো চুল কাটান তা-ই না?

হ্যাঁ! না হলে কীভাবে চুল কাটাব? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

যে চেয়ারে বসে চুল কাটিয়েছেন, সে চেয়ারের সামনে কি কোনো আয়না ছিল না?

থাকবে না কেন?

তাহলে চুলের অবস্থা এরকম হলো কীভাবে?

কী রকম হয়েছে?

আপনি বুঝবেন না—আপনার মুখের সঙ্গে চুলের এই স্টাইলে কি মানায়? এখন থেকে এক কাজ করলে হয়।

কী?

এখন থেকে আমি আপনার চুল কেটে দেবো?

হ্যাঁ। এছাড়া আমি তো আর কোনো উপায় দেখছি না।

আমারও সে-রকমই মনে হচ্ছে—আমারই কেটে দিতে হবে।

শোন, তুই অমার ওপর সব সময় এত খবরদারি ফলাস কেন?

আপনি তো সেটা পছন্দ করেন। করেন না?

আমি পছন্দ করি! তুই এত বুঝিস কীভাবে?

আপনার চোখ দেখে।

বাজে বকিস না। তুই মাতবরি কেন মারিস, সেটা বল।

আপনি চান বলে।

আবার বাজে কথা। সত্যি কথাটা বল।

আমি আপনাকে পছন্দ করি, তাই।

কী!

আমি আপনাকে পছন্দ করি, আপনাকে আগলে-আগলে রাখতে চাই—সেজন্য আপনার ওপর মাতবরি মারি।

ও।

আমি আপনাকে পছন্দ করি, এ কথা তো আপনি জানেন। জানেন না?

জানি। জানব না কেন?

তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?

তোর মুখ থেকে কথাটা শোনার ইচ্ছা হলো, তাই।

মুনিরা ছিল খেয়ালী। ওর যেটা করার ইচ্ছা, সেটা ও করে ছাড়ত।

আমার মাঝে মাঝে এটা ভেবে খুব অবাক লাগত যে বড় মামার মতো নির্বিরোধী, গতানুগতিক, গৃহী মানুষের ঘরে মুনিরার মতো একটা মেয়ে জন্ম নিল কী করে? মুনিরার মধ্যে একধরনের বুনো একটা ব্যাপার ছিল। ‘বুনো’ শব্দটা বোধহয় আমি ঠিক বললাম না। কিন্তু ঠিক কী শব্দ ব্যবহার করলে মুনিরাকে বোঝানো যাবে, তা-ও আমার জানা নেই। আমার মনে হয় ঠিক একটা, দুটো শব্দ দিয়ে ওকে বোঝানো যাবে না। ওকে কেউ বোঝাতে চাইলে, তাকে অনেক শব্দ ভেবে-চিন্তে, খুঁজে- পেতে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। তবে তারপরও ওকে কেউ পুরো বুঝতে পারবে, আমার মনে হয় না। ও মূল কিছু বিষয় ঠিক রেখে একেক সময় একেক রকম। এই আমিও কখনো দাবি করি না, ওকে আমি ঠিকঠিক বুঝতে পেরেছি।

মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়ে ওকে আমি জিজ্ঞেস করতাম—মুনিরা, তুই এমন কেন বল তো?

মুনিরা বুঝত ঠিকই, কিন্তু ভান করত অবাক হয়ে যাওয়ার—আমি কেমন?

সেটা তো তুই জানিস। জানিস না—তুই কেমন?

মুনিরা ‘না’ সূচক মাথা নাড়ত—না বাবু ভাই, আমি জানি না আমি কেমন।

তুই জানিস।

না বাবু ভাই, জানি না। পৃথিবীর কোনো মানুষই জানে না সে কেমন।

মুনিরার ওই কথা—পৃথিবীর কোনো মানুষই জানে না সে কেমন—আমাকে বহুদিন তাড়িত করেছে। আজও মাঝে মাঝে ওই কথা ভেবে হঠাত্ চুপ করে যাই। আমি আজও জানতে পেরেছি আমি কেমন!

মুনিরা ওরকম কথা প্রায়ই বলত। আমি ওকে জিজ্ঞেসা করতাম—তোর স্টক কি ফুরোবে না?

না। ফুরোবে না। কারণ আমি স্টক করে রাখি না।

তোর মাথায় এমনি-এমনি এসব কথা চলে আসে?

কী করব—এমনি-এমনিই তো চলে আসে।

এই এখনই আরেকটা বলতে পারবি?

পারব।

বল।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

এটা বড় মামার প্রিয় কথা। মামা এটা সব সময়ই বলেন।…এমনিতে কথাটা অবশ্য খুবই বস্তাপচা।

হোক। বস্তাপচা হলেই যে অপ্রয়োজনীয় হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না।

সে আমিও বলছি না। কিন্তু কথাটা এত পুরনো, এটার আর কোনো গুরুত্ব আছে বলে আমার মনে হয় না।

বাবু ভাই, আপনি একসময় বুঝবেন—এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা।

তা-ই বুঝি?

ইয়ার্কি না। আপনি একসময়-না-একসময় বুঝবেন, প্রতিটি মানুষের জীবনেই এ-কথাটা একসময়-না-একসময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ঠিক আছে, দেখব।

আমার দেখার সুযোগ হলো বছর কয়েক পর। বাবা মারা যাওয়ার মাস কয়েক আগের ঘটনা। বড় মামা ঢাকা এলেন বাবার সঙ্গে একটা বিষয়ের কথা বলতে। বিষয়—মুনিরার বিয়ে। বিয়ে আসলে ঠিক, মামা এসেছেন বাবাকে জানাতে, ভদ্রতা করে অনুমতি নিতে। শুনে খুব খুশি বাবা—আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ছেলে খুবই ভালো।

বড় মামা বললেন—হ্যাঁ, ছেলে খুবই ভালো। ভালো চাকরি, বংশ ভালো।

তাহলে আর দেরি করার দরকার নেই।

আমিও সে-রকমই ভেবে দেখলাম।

তবে ওর লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও পারতেন।

মুনিরার পড়াশোনায় মন নেই।

তাহলে ঠিকই আছে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

তোমাকে বলতে অসুবিধা কী—আমি মুনিরার বিয়ে নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম।

কেন কেন!

মেয়ের লেখাপড়ায় মন নেই, বৈষয়িক বুদ্ধিও তেমন নেই, রাগ খুব বেশি…।

আপনি খামোখা এসব কথা বলছেন। আপনার মেয়ে চমত্কার। ও খুবই লক্ষ্মী। ওকে আমার বিশেষ পছন্দ।

মামা টুকটাক কিছু কাজ সেরে দু দিন পরে ফিরে গেলেন। আমি তার সঙ্গে গেলাম। বললাম—একটু বেড়িয়ে আসি।

মুনিরা আমাকে দেখে হাসল, নির্ভেজাল হাসি, বলল—বাবু ভাই, আমি জানতাম আপনি আসবেন।

তোর বিয়ে?

বাবা ঢাকা গেলেন ফুপাকে খবর দেওয়ার জন্য, তারপরও জানতে চাচ্ছেন!

আমি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। আমাকে অমন তাকিয়ে থাকতে দেখে একসময় মুনিরার ভুরু কুঁচকে গেল— অমন করে কী দেখছেন?

মুনিরা, তুই এত স্বাভাবিক আছিস কী করে?

বিয়ের কথা শুনে লাজুক লাজুক ভাব নিয়ে থাকব, আপনি জানেন আমি সে-রকম মেয়ে না।

তুই জানিস মুনিরা, আমি সে-কথা বলছি না।

বাবু ভাই, আপনি কী কথা বলছেন?

সত্যি করে একটা কথা বলবি আমাকে? তুই এ বিয়েতে রাজি?

আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুনিরা ঠোঁট টিপে হাসতে আরম্ভ করল।

হাসছিল কেন? আমি তো হাসির কিছু বলিনি!

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

মানে!

আমি আপনাকে বলেছিলাম না—কথাটা মানুষের জীবনে কোনো-না-কোনোসময় যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা আপনি একসময়-না-একসময় বুঝতে পারবেন।

তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস—আমি তোকে নিয়ে এক রকম ভেবেছিলাম, কিন্তু হচ্ছে আরেক?

মুনিরা মাথা ঝাঁকাল—হ্যাঁ। তবে শুধু আপনার ব্যাপারেই না। আরও কিছু আছে।

আর কী আছে?

ওই কথাটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কি-না, সেটা আমি নিজেও একটু বুঝতে চাচ্ছি।

আমি বললাম—প্লিজ মুনিরা, একটু খুলে বল।

ওই যে আপনাকে একদিন কথাটা আমি বললাম, তারপর আমার মনে হলো আচ্ছা, খুব যে বাবু ভাইকে কথাটা আমি বললাম, ঠিক বললাম?…এখন বুঝতে পারছি কথাটা আমি ঠিকই বলেছি।

সেটা কী রকম?

কথাটা আমার জীবনেও মিলে যাচ্ছে বাবু ভাই। আপনাকে নিয়ে আমিও এক রকম ভেবেছিলাম, কিন্তু হচ্ছে আরেক।

সেটা তো তুই জোর করে করছিস।

উঁহু। মুনিরা মাথা ঝাঁকাল। আমি জোর করে কিছুই করছি না।

তুই এ বিয়েতে রাজি কেন হয়েছিস?

বারে, রাজি না-হওয়ার কি কোনো কারণ আছে?

তুই জানিস মুনিরা আমি তোকে কতটা পছন্দ করি?

বারে, জানব না কেন! আমি কি আপনাকে কম পছন্দ করি?

তাহলে এমন কেন করছিস?

মুনিরা চুপ করে থাকল।

বল তুই, কেন এমন করছিস?

সে নানা ব্যাপার বাবু ভাই, আপনি বুঝবেন না।

অন্তত একটা বল, আমি শুনি। বোঝার চেষ্টা করি।

আমি বাবাকে কষ্ট দিতে পারব না।

এটা তোর আগে মনে ছিল না?

মুনিরা চুপ করে থাকল।

মামা যদি শোনে আমরা দুজনকে পছন্দ করি, তাহলে কষ্ট পাবেন?

হ্যাঁ।…আমার স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাবে আর আপনার রুচি দেখে নিরাশ হবে।

আমি অবাক হয়ে মুনিরার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আপনি জানেন না আপনার সম্পর্কে বাবার কতটা উঁচু ধারণা। আপনি আমাকে পছন্দ করেছেন, এটা শুনলে কী যে অবাক হবে! ভাববে আমি আপনাকে হাত করেছি। বাবু ভাই, আপনি হচ্ছেন ‘সুনয়ন’, আপনি আমাকে পছন্দ করতে পারেন না।

আর তুই, আমাকে পছন্দ করতে পারিস?

পারি। তবে সেটা ভুল, সেটা স্পর্ধা, সেটা সাহস।

মুনিরা, এসব পাগলামো বাদ দে।

বাবা কখনোই আমার-আপনার সম্পর্ক মেনে নেবে না। আপনাকে এই ভুল বাবা কখনোই করতে দেবে না। আমার বাবাকে আমি চিনি না?

আমি তেতো গলায় বললাম—আর কিছু বলবি?

আরও অনেক কিছু আমার বলার আছে বাবু ভাই। তবে ওসব বাদ দিয়ে আমি আসল কথাটা বলি।…আপনার জন্য একটা গোছানো মেয়ে দরকার।

আমি মুনিরার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি তো আমাকে কিছুটা বুঝি। আমি আপনাকে ক্রমাগত অস্থিরই করে তুলব। আপনি আমাকে নিয়ে একটুও সুস্থির হতে পারবেন না।

মূল ব্যাপার হচ্ছে—তুই একটা এসকেপিস্ট। সমস্যা ফেস না করে জীবনের লোভ-লালসার কাছে পালিয়ে যাচ্ছিস। তুই আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই।

আমি কখনোই বলিনি আমি অসাধারণ। তবে একটা পার্থক্য আছে বাবু ভাই। আমিও একটা লোভে পড়েছি, তবে সেটা অন্যরকম লোভ। আপনাকে না-পাওয়ার কষ্টের লোভটা আমার কী যে তীব্র।

এসব অর্থহীন কথা, বাজে কথা।

বাজে কথা না, একটুও বাজে কথা না। আপনাকে না-পাওয়ার কষ্টটা আমি সত্যিই পেতে চাই।…আর, আপনাকে কাছে আনতেও আমার ভয় হয়। আমার কাছে আপনি আছেন আকাশে। আপনাকে যদি মাটিতে নামিয়ে আনি, যদি দেখি আপনিও আর সবার মতো—না, বাবু ভাই, সে বড় কষ্টের ব্যাপার হবে আমার জন্যে। সেই রিস্ক আমি কখনো নিতে পারি না।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম—এত বুঝিস তুই?

মুনিরা সামান্য হাসল—তবে আমি আপনারই থাকব বাবু ভাই।…কথাটা খুব ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল। তা-ই না? কিন্তু এ কথা সত্য বাবু ভাই, এ কথা সত্য। আমি আপনারই থাকব। আপনি যদি কোনো দিন আমাকে ডাকেন, আমি যেখানে থাকি না কেন, আমি চলে আসব। এই এখনো যদি আপনি ডাকেন, আমি চলে যাব আপনার সঙ্গে।…কিন্তু প্লিজ বাবু ভাই, আপনি আমাকে ডাকবেন না, আপনি আমাকে কখনো ডাকবেন না।

আমার মুনিরার কথা যেমন মনে হয়, রেবেকা আপার কথাও মনে হয়। রেবেকা আপারা থাকতেন আমাদের সামনের বাসায়। আমি যে-সময়ের কথা বলছি, তার বছর দেড়-দুই আগে রেবেকা আপার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী বিদেশ থাকে, রেবেকা আপাও একবার বিদেশে গেছেন, স্বামীর কাছে, কিন্তু বিদেশ নাকি তার ভালো লাগে না। দেশে ফিরে তিনি কখনো শ্বশুরবাড়ি থাকেন, কখনো নিজেদের বাড়ি। তাদের নিজেদের বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা। তার বাবা-মা বেশ বয়স্ক, বড় এক ভাই চাকরিজীবী, বেশ বয়স হয়েছে, কিন্তু তখনও বিয়ে করেননি।

রেবেকা আপা আমাকে বিকালের দিকে ডেকে নিয়ে গেলেন। এর কিছুদিন আগে বাবা মারা গেছেন, মুনিরার বিয়ে হয়ে গেছে আরও আগে, তবে স্মৃতিটা সতেজ, ওসময় আমি খুব মনমরা হয়ে থাকি। রেবেকা আপা আমাকে ডেকে নিয়ে ঘরে বসিয়ে বললেন—তুমি সব সময় এমন দুঃখী-দুঃখী চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াও কেন, বলো তো?

আমি চুপ করে থাকলাম।

তোমাকে সেই কবে থেকে চিনি। তোমাকে অমন চেহারায় যখন দেখি আমার খুব খারাপ লাগে। শোনো বাবু, তুমি রোজ আমার সঙ্গে গল্প করতে আসবে।…আমি একা একা থাকি।

আমি রোজ-রোজ রেবেকা আপার ওখানে যেতে আরম্ভ করে দিলাম। রেবেকা আপা আমাকে রোজ-রোজ বিছানায় নিয়ে যেতে আরম্ভ করলেন। ‘বিছানা’ শব্দটি অবশ্য একক হিসাবে ব্যবহার করছি। বিছানা ছাড়াও আরও নানাভাবে ব্যাপারটা ঘটল। ব্যাপারটা যে অত বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে সে ধারণাই আমার ছিল না। হয়ে যাওয়ার পর রেবেকা আপার একটা ধরাবাঁধা সংলাপ ছিল—তোমার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে বাবু, খুব খারাপ লাগে। তুমি অমন মনমরা হয়ে থাকো কেন! তোমার বয়সে ছেলেরা থাকবে হাসিখুশি, প্রাণবন্ত। আমি হাসিখুশি হতে পারলাম না, প্রাণবন্তও না, কিন্তু রেবেকা আপা আমার ভেতর তীব্র এক নেশা ঢুকিয়ে দিল। তার কাছে অবশ্য ব্যাপারটা ছিল খুবই সহজ। এ যেন শীতের মৌসুমে কোর্ট কেটে একটু ব্যাডমিন্টন খেলা।

রেবেকা আপা মাস ৬/৭ পর স্বামীয় কাছে চলে গেলেন। তার সঙ্গে বহুদিন পর আমার একবার দেখা হয়েছিল এক বিপণি বিতানে। বিনু ছিল আমার পাশে, অনি আর সোমাও ছিল। অনি তখন মাত্র হাঁটতে শিখেছে আর সোম কোলে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। রেবেকা আপার সঙ্গে তার সুঠাম সুদর্শন স্বামী।

হঠাত্ কাঁধের ওপর হাত, আমি ঘুরে দাঁড়াই, রেবেকা আপা জিজ্ঞেস করেন—এই ছেলে তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?

মুহূর্তের মধ্যে রেবেকা আপা চারপাশের চেহারা বদলে দিলেন। বিনুকে আদর করে, অনিন্দিতা আর সোমকে চুমু খেয়ে, তারই ফাঁকে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করে একাকার। বারিধারা থাকেন, ঠিকানা দিলেন, আমাদের বারবার যেতে বললেন। আর বারবার বললেন, কখনো বিনুর দিকে তাকিয়ে কখনো তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে যে তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আর আমিও নাকি ‘রেবেকা আপা’ বলতে ছিলাম অজ্ঞান। আমার সব আবদার ছিল তার কাছে, তিনিও নাকি হাসিমুখে আমার সব আবদার মেটাতেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন—কী বাবু, মনে পড়ে সেসব দিনের কথা? কী জ্বালাতনটাই না আমাকে জ্বালাতে।

তারপরই, বিনু যখন হঠাত্ কেঁদে ওঠা সোমকে সামলাতে ব্যস্ত, আর রেবেকা আপার স্বামী একটু এগিয়ে গেছেন, রেবেকা আপা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন—মাঝে মাঝেই আমার ওই দিনগুলোর কথা মনে হয়। তখন তোমাকে আবার নতুন করে পেতে ইচ্ছা করে। এই যে এতদিন পর তোমাকে দেখলাম, তোমাকে আমার ডাকার ইচ্ছা হবে।… আচ্ছা, বলো তো, আমি যদি আবার ডাকি তোমাকে, তুমি তো আসবে, আসবে না?

সাত.

এক আড্ডায় আমি কথাটা শুনেছিলাম—মানুষের জীবন তার মৃত্যু পর্যন্ত লম্বা।

আড্ডাটি ছিল আমাদের অফিসে, লাঞ্চ আওয়ারে। আমাদের এক কলিগ খুব আক্ষেপ করে বলল—এর কোনো মানে হয় বলো—মানুষ এত সৃজনশীল, অথচ তার আয়ু কি-না ৭০/৮০ বছর। আর কচ্ছপের আয়ু কি-না ৩০০ বছর। এ কথাটা আড্ডায় অনেকেরই পছন্দ হয়েছিল। সত্যিই তো, কচ্ছপের যদি এত আয়ু হয়, মানুষের আয়ু কেন অত কম!

তা বটে তা বটে। অনেকেই তখন বলেছিল।

প্রথমজন বলেছিল—প্রকৃতি যদি মানুষকে ৩০০ বছর আয়ু দিত, তবে অন্য সব ব্যবস্থা সেভাবেই গুছিয়ে দিত।

তা দিত। কিন্তু প্রকৃতিই মানুষকে ৩০০ বছর আয়ু দেয়নি, দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু প্রকৃতি মানুষকে কী দিয়েছে জানেন?

কী? সবাই তাকিয়ে থাকল বক্তার দিকে।

প্রকৃতি মানুষকে এমন একটা জীবন দিয়েছে, যে জীবন তার মৃত্যু পর্যন্ত লম্বা।

এ কথাটাও অনেকেরই পছন্দ হয়েছিল। হ্যাঁ, তা-ই তো—একমাত্র মানুষই বলতে পারে তার জীবন মৃত্যু পর্যন্ত লম্বা, কারণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে তার জীবনকে ব্যবহার করতে পারে। সেদিন আরও অনেক কথা হয়েছিল ওই আড্ডায়। মানুষ ছাড়া আর সব প্রাণীই সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট জীবনযাপন করে যায়। একমাত্র মানুষের জীবনই বিশাল, অতি বিশাল, একমাত্র তার মধ্যেই আছে মানিয়ে নেওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা।

আমার মাঝে মাঝেই ওই আড্ডার কথা মনে হয়।

ইতিমধ্যে আমরা ওই জমিটা কিনেছি। রানুরাও কিনেছে, আমাদের পাশেই, আমাদের বাড়ির কাজও অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আমরা, মাঝে মাঝে বেশ মজাই লাগে আমার, ওই অসমাপ্ত বাড়িটায় থাকতেও আরম্ভ করেছি। এটা অবশ্য হয়েছে বিনুর জেদাজেদিতে। অতদূর থেকে বাড়ির কাজ তদারক করা খুবই কঠিন। খুবই ধকল যায় শরীরের ওপর দিয়ে। ওরই যায়, কারণ কাজ যা, তা তো ও-ই করে। আমি বলে দিয়েছি—তুমি বাড়ি করতে চেয়েছ, সুতরাং এসব ঝামেলা তোমাকেই সামলাতে হবে। তাছাড়া তুমি তো জানোই, আমি একটু কাজচোরও বটে।

কাজ একাই সামলিয়েছে বিনু। তবে দুটো ঘর হওয়ার পরই ও আমাদের বাধ্য করেছে এখানে উঠে আসতে। ততদিনে অবশ্য এদিক-ওদিক বেশকিছু বাড়ি উঠেছে, লোকজন বেশ থাকতে আরম্ভ করেছে। নইলে এই নির্জন এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকার সাহস আমার হতো না। এখন আর আমার, আমাদের কারও ভয় লাগে না। অসমাপ্ত বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় না। বরং আমরা, বাড়ির সবাই অদ্ভুত এক মজায় জড়িয়ে যাই।

আমাদের পাশের প্লটে রানুদের বাড়িটাও আরম্ভ হয়েছে। আরম্ভ হয়েছে অনেক পরে, আর ওরা এগোচ্ছেও আমাদের চেয়ে ধীরগতিতে। ওদের কাজ দেখাশোনার ভারও বিনুর ওপর। রানু মাঝে মাঝে আসে, ছুটির দিনে বিশেষ করে। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। রানু আমাকে বলে—বাবু, তোমরা তাহলে বাড়ির মালিক হয়ে গেলে!

আমি হাসি—তোমরাও হচ্ছ।

নিজের হাতে বাড়ি করার মধ্যে একটা মজা আছে। আমি সেই মজাটা পাচ্ছি না।

কে তোমাকে পেতে বারণ করেছে?

কেউ করেনি। কিন্তু তুমি জানো ওসব কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।…আমি বিনুর মতো কাজের নই।

হুঁ। তা বটে।

মাঝে মাঝে আমার নিজেরই খুব অবাক লাগে। আমি কোনো কাজেরই না।

কিছুই তোমার ভালো লাগে না, না?

লাগে।

কী?

বসে থাকতে।…আচ্ছা বাবু, বলো তো, ছুটির দিনে নিজের বাড়ির সামনে কাঁচা রোদের ভেতর বসে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন?

সত্যি কথা হচ্ছে এ অভিজ্ঞতাটা কেমন, সেটা আমি নিজেই উপলব্ধির চেষ্টা করি। এমনও হয়েছে, সোম আর অনিন্দিতা স্কুলে গেছে, বিনুও কোনো কাজে বাইরে, বাসায় কেউ থাকবে না জেনে আমি কোনো এক অজুহাতে অফিসে যাইনি। তারপর বাসায় যখন কেউ নেই আমি চেয়ার টেনে বাড়ির সামনে একা বসে থেকেছি। চারপাশ চুপচাপ, মানুষজনের সাড়াশব্দ পাওয়াই যায় না, বাতাস বেশ ছুটে আসে, আর কাঁচামিঠা রোদ ওঠে—এর মধ্যে বাড়ির সামনে বসে থাকতে কেমন যে লাগে! আমার ঠিক পেছনেই আমাদের নিজেদের বাড়ি—এ ভাবনাটা থেকে আমি দূরে থাকতে চাই। এটা নিজেদের, ওই বিশালের মাঝে বসে ওরকম আমি ভাবতে চাই না। কারণ ওটা এখন আমাদের হলেও কিছুদিন আগে অন্যদের ছিল, তারও আগে হয়তো আরও কারও। তারপর আমাদেরও থাকবে না। যা থাকবে না, তার জন্য এতসব আয়োজন!

কোনো কোনো রাতেও আমি বাড়ির সামনে বসে থাকি। অধিকাংশ সময় বিনুও থাকে আমার পাশে। এসময় চারপাশ নির্জন হয়ে যায়। দিনের বেলা এদিন-ওদিক নানা ধরনের শব্দ থাকে। রাত একটু হলে চারপাশ একেবারেই নিস্তব্ধ। বিনুকে এখন অধিকাংশ দিনই খুব হাসিখুশি দেখায়। ক্লান্ত, কিন্তু হাসিখুশি। একরাতে গল্প করতে করতে ও বলল, দেখো বাবু, বাড়িটা তাহলে আমাদের হয়েই গেল…।

আমি মাথা ঝাঁকাই— হুঁ বিনু হয়েই গেল। তোমার জন্য হলো।

অথচ তুমি রাজি হচ্ছিলে না।

সেজন্যই বললাম, তোমার জন্য হলো। আমি জানতাম তুমি ঠিকই ম্যানেজ করে ফেলবে।

নিজের বাড়ি বাবু, ভাবতে কী ভালো লাগে, তা-ই না?

আমি হাসি।

‘নিজের’ এই শব্দটার মধ্যে খুব একটা আনন্দ আছে।

আমি আবারও হাসি। একসময় বিনু হাই চাপে—আর কতক্ষণ বসে থাকবে?

এই আর একটু।

তুমি এসো তাহলে। বিনু উঠে দাঁড়ায়। সামান্য আড়মোড়া ভাঙে। বলে, জিলানীর একটা চিঠি পেলাম গতকাল। ওর সংসার বোধহয় ভাঙতে যাচ্ছে।… বেচারা জীবনে সুখ পেল না। …বাবু, শোনো, তুমি যেন বেশিক্ষণ বসে থেকো না, ঠাণ্ডা লাগবে।

বিনু চলে যায়। আমি বসে থাকি। আমি বসে থাকি আর সে মুহূর্তে আমার একটা কথা মনে হয়, আমি বিনুকে একটা কথা বলতে পরব না। আমি ওকে ভালোবাসি, ওর ওপর আমি নানাভাবে নির্ভরশীলও, কিন্তু তারপরও একথা ঠিক—এই যে বিনু উঠে গেল আমার পাশ থেকে, এতে আমি স্বস্তিবোধ করলাম। মানুষ আসলে কিছু কিছু সময় সত্যিই একা থাকতে চায়। সে প্রায়ই, প্রায়ই না হলেও কিছু কিছু সময় কখনো কখনো শুধু নিজের সঙ্গে থাকতে চায়।

এই যে আমি ওপরের যে ঘটনার কথা বললাম এরকম প্রায় রাতেই ঘটে। কিছু গল্পের পর, কিছু বৈষয়িক ও অবৈষয়িক কথার পর বিনু হাই চাপতে চাপতে উঠে যায়। আমি আরও বেশ কিছুটা সময় বসে থাকি। একা বসে থাকতে থাকতে আমার নানা কথা মনে হয়। ওসময় আমার এক আড্ডার কিছু কথাও মনে হয়। অফিসের এক আড্ডায় একজন একবার বলেছিল—মানুষের জীবন তার মৃত্যু পর্যন্ত লম্বা।

খুব কি ভারী কথা একটা, খুব কি দামি? আমার তেমন মনে হয় না। তবে এই কথাটা আমার মনে হয় প্রায়ই। এর সঙ্গে মিশে আছে আর একটা কথা, সেটাও আমার মনে হয়, বেশি, বিশেষ করে এইসব রাতে কথাটা আমার খুব মনে হয়—মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ যে জীবনযাপন করে, সেটা কি তার নিজের?

একদিন বিনুও আমাকে বলেছিল—‘নিজের’ এই শব্দটার মধ্যে খুব একটা আনন্দ আছে।

আমি ওকে সায় দেই বটে, কিন্তু আমি ‘নিজের’ এই শব্দটার মধ্যে কোনো আনন্দ খুঁজে পাই না। কারণ, কিছুই আমার নিজের মনে হয় না। এই যে আমার জীবন—এটাও না।

আমার খুব ইচ্ছা করে এ ব্যাপারটা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার। কার সঙ্গে কথা বলব। শারীরিকভাবে আমার সবচেয়ে কাছে আছে যে, সেই বিনুর সঙ্গে? বিনুকে বলব—বিনু, এই যে আমার জীবন, এটা কখনো আমার নিজের মনে হয় না।

বিনু নিশ্চয় খুব অবাক হয়ে যাবে—ওমা, এ কী কথা! কেন?

এ জীবন আমার না বিনু, এমনকি তোমার যে জীবন সে জীবনও তোমার না।

কী যে তুমি বলো না। বিনু মুখে কিছুটা হাসি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সুতরাং বিনুর সঙ্গে ওই কথা আমার শেষ হবে না। তাহলে কাকে আমি ওই কথা বলব! নিজেকে বলব? কিন্তু ওসব আমি জানি। সুতরাং ওসব আমাকেও বলা হবে না, কাউকেই না। কাউকেই আমার এই কথা বলা হবে না যে—এ জীবন আমি যতই নিজের ভাবি বা ভাবার চেষ্টা করি না কেন, এ জীবন আসলে সহশিল্পীর।

সহশিল্পী—এ শব্দটা আমি খুব হঠাত্ করে পেয়ে গেছি এবং আমার খুব পছন্দ হয়েছে এটা। এক ছুটির দুপুরে আমি আর বিনু খুব মজা করে সিনেমা দেখছিলাম। নায়কের ও নায়িকার এক নাচের দৃশ্যে সহশিল্পীদের নিয়ে আমরা হাসাহাসি করছিলাম। আমরা দুজনই এরকম বলছিলাম যে—দেখ দেখ, সবারই কী আপ্রাণ চেষ্টা নায়ক ও নায়িকাকে অনুসরণ করার। সবাই নায়ক বা নায়িকার মতো হতে চাচ্ছে। কারণ ওদের সেরকমই বলা হয়েছে, ওদের নায়ক-নায়িকা হওয়ার মতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।…কিংবা ওরা ওরকম করলে বোধহয় নায়ক-নায়িকা আরো মূর্ত হয়ে উঠবে।

এরকম বলতে বলতে সহশিল্পী শব্দটা চলে এল আমার মাথার ভেতর। আমার মনে হলো, ওই যে, ওরা যদি হয়, আমরাও কি সহশিল্পী নই? আমাদের চেষ্টাও কি ওদের মতো নয়?

সেই থেকে শব্দটা আমাকে আর ছেড়ে গেল না। সেই থেকে নিজেকে আমার সহশিল্পী মনে হতে লাগল। সিনেমায় নাচের দৃশ্যে সহশিল্পীরা সবাই নায়ক বা নায়িকার মতো হতে চায়। সে-রকমই নির্দেশ তাদের ওপর। সে-রকমই বলা হয়েছে তাদের। আমাদের সে-রকম কিছু বলা হয়নি। আমরা বরং সবাই নিজেদের মতো হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা হওয়া হয় না আমাদের, আমরা সহশিল্পী হয়ে যাই। তাহলে নায়ক কে?

আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে এসব কথা বলে আমি বিনুকে বিরক্ত করে তুলি কিংবা ওর মন খারাপ করে দেই। মন খারাপ হলে বা কিছু ধরতে না পারলে বিনুকে খুবই অসহায় দেখায়। তবে এখন, আমার ওই কথা শুনে ওকে যদি অসহায় দেখায়, আমার জন্য একটা সুবিধা আছে। আমি ওকে বলতে পারব—এই যে বিনু, অসহায় দেখাচ্ছে তোমাকে, এরকমই অবস্থা আমাদের। সহশিল্পীরা অসহায়ই হবে, তা-ই না?

আমি জানি এ কথা শুনতে শুনতে বিনুও একসময় জানতে চাইবে—তাহলে বলো, নায়ক কে?

আমি বলব—জীবনে কত রহস্য বিনু।

বুঝলাম।

জীবনের কত কী আমাদের বোঝা হয় না।

ঠিক আছে।

এ জীবনের প্রায় কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।

এটাও ঠিক।

আমাদের চারপাশ ঘিরে ঘটনা শুধু ঘটে যাচ্ছে।

যাচ্ছে।

আর আমরা সে অনুযায়ী আচরণ করছি।

আমি জানি বিনু এসময় আমার দিকে তাকাবে—হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু আচরণগুলো আমাদের না, তা-ই না?

হ্যাঁ।

কেন!

আমাদের আচরণগুলো ঘটনা অনুযায়ী। ঘটনা অন্যের।

মানে?

বিনু, ঘটনা ঘটে, আমরা আচরণ করি। ঘটনা ঘটে, আমরা জীবনযাপন করি। ঘটনা ঘটে, আমরা ঘটনার সঙ্গে মিলে যাই।…তুমি একে সহশিল্পীর জীবন বলবে না?

আমি জানি বিনু হয় অসহায় হবে, না হয় বিরক্ত মুখে সরে পড়বে। আর আমি হয়তো ভেবে যাব, তাহলে ঘটনাই কি নায়ক, যে ঘটনা কখন কীভাবে ঘটবে কে জানে, সে ঘটনাই কি তবে নায়ক?

নিঝুম রাতে বাড়ির সামনে বসে বহুদূরে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে।