জয় বাংলার লোক

untitled-11_201829রাজাকার হবার জন্য কোনো ট্রেনিংয়ের দরকার ছিলো না। চোখ-কান-মুখ-হাত-পা থাকলেই হলো। সকালবেলা লাইনে দাঁড়াতে হতো। তারপর কয়েকবার লেফ্ট-রাইট করলেই ট্রেনিং শেষ। কারো হাতে গাদা বন্দুক, কারো হাতে শক্ত মোটা বেতের লাঠি ধরিয়ে দিয়ে সুবেদার ইসমত খান ডিউটি ভাগ করে দিতো ওদের বিশজনের দলটিকে।

রাজাকাররা যেসব ডিউটি করতো তার কোনোটিই পছন্দ ছিলো না আকবর শরীফের। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগতো যেদিন ওর ডিউটি পড়তো বিভিন্ন পাড়া থেকে মুরগি আর ছাগল ধরে এনে থানা হেড-কোয়ার্টারে জমা দেয়া। ও শুনেছিলো, পাঞ্জাবি মেজর ইকবাল ওমর প্রচুর মদ খেতো মুরগির রানের ফ্রাই দিয়ে। মদ খেয়ে খেয়ে লোকটা এমন মাতাল হয়ে যেতো যে, মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহ করে কাউকে ধরে তার সামনে নিয়ে এলে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করেই কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে দিতো। তারপর হাসতে হাসতে বলতো,

‘পাকিস্তান কে লিয়ে হাম সাব কুছ করেঙ্গা। নো ইন্ডিয়ান এজেন্ট কুড সারভাইভ হেয়ার। ইস মিট্টি কে লিয়ে খুন কা বহুত জরুরাত হ্যায়।’

ভিলেজ পলিটিক্স আর স্টেট পলিটিক্স এক জিনিস নয়। সত্তরের নির্বাচনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যদিও তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর নৌকাকে পাস করাতে হবে- এটাই ছিলো এ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় রাজনীতি। বিবিসি-আকাশবাণী এসব খবর প্রচার করতো। আকবর শরীফ তখন ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। ভোটার না হয়েও সবার দেখাদেখি সেও ভোট দিয়েছিলো নৌকা মার্কায়।

নির্বাচনের কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনায়েত হোসেন এসেছিলো গ্রামে, আকবর শরীফের দূর সম্পর্কের চাচা।

‘নৌকা মার্কায় ভোট দিলে কী হইবো চাচা?’

প্রশ্নটা একেবারে খুব কাঁচা হয়ে গেলেও এনায়েত হোসেন জানতো এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা গ্রামের ছাত্রদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। রেডিও পাকিস্তানের খবর আর সংবাদ-পর্যালোচনা শুনতে শুনতে যারা বড় হচ্ছে, তাদের কাছে স্টেট পলিটিক্স বা রাষ্ট্রীয় রাজনীতি বিশ্লেষণ করার সুযোগ কোথায়? শর্ট ওয়েভে প্রচারিত হতো বিবিসি। সবার রেডিওতে তার সিগন্যাল পাওয়াও ছিলো কষ্টকর। ফলে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আর স্বায়ত্তশাসনের দাবির মোটাদাগের বিষয়টাও গ্রামের মানুষের কাছে ছিলো দুর্বোধ্য। থানা আর মহকুমা পর্যায়ের নেতারা ওদের যে ব্যাখ্যা দিতো, তা হয়তো ভালো করে ওরা নিজেরাও বুঝতো না। বলতো, ‘পূর্ব পাকিস্তান থাইকা সবকিছু নিয়া চইলা যাইতেছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তোমরা নৌকায় ভোট দিলে যে কাগজ কিনতেছো দশ আনা দিস্তায়, তা চাইর আনায় কিনতে পারবা। চাউল খাইবা চাইর আনা সের।’

কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতো, ‘বাবাজি, ওরা কি চাউলও নিয়া যাইতেছে? শুনিছি ওরা রুটি খায়; চাউল নিয়া কী করে ?’

থতমত খেয়ে যেতো বক্তা এমন প্রশ্ন শুনে। কিন্তু গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে বোঝানো সহজ। এরা সবকিছু বিশ্বাস করতো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই।

‘চাউল তো ওরা খায় না। পূর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙালিদের ভুখা মাইরা ফালানোর জন্যে ওই চাউল ওরা রাইখে দেয় করাচি আর লাহোরের গুদামগুলানে। ওই চাউল পোকায় খাইলো, না ইঁদুরে খাইলো, ওইটা কোনো ব্যাপার না। বাঙালির প্যাটে না গেলেই হইলো।’

‘একদম সত্য কথা।’

গ্রামের মানুষজন এসব যুক্তি শুনে এ-ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতো।

তো, এইসব মানুষকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে এসে ছাত্রনেতা এনায়েত হোসেন যে আরো কাঁচা প্রশ্নের মুখোমুখি হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আকবর শরীফদের মতো তরুণ-কিশোর ছাত্রদের নানা কথায় শহুরে ভাষায় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো তাকে। স্থানীয় নেতারা গ্রামের মানুষদের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির গূঢ় মারপ্যাঁচ বোঝাতে না পারলেও হরতাল-ধর্মঘট-ব্যারিকেড-মশাল মিছিল জাতীয় কর্মসূচি ভালোভাবেই বোঝাতে পেরেছিলো।

সত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ভালোভাবেই হয়ে যায়। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী আর ন্যাপের লোকজন ভোটে দাঁড়ালেও মোটেই সুবিধা করতে পারেনি। নৌকা মার্কা একরকম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। জয়লাভের আনন্দ গায়ে মেখে নতুন ক্লাসে ওঠে আকবর শরীফরা। এনায়েত চাচা যাবার সময় বলে যায়, ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সংশোধন করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে।’

আকবর শরীফের বাবা রায়হান মোল্লা রাজনীতি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাতো না। যুবক বয়সে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করেছে। সেসব অনেক পুরোনো কথা। এখন জমিজমা আর মামলা-মোকদ্দমা করে সময় কাটে তার। মাঝে মাঝেই মহকুমা সদরে যেতে হয় কোর্টে হাজিরা দিতে। ডিসেম্বরে যখন আকবর শরীফরা দল বেঁধে মিছিল করতো, তখন সে তার জমিজমার কাগজপত্র নিয়ে বৈঠকঘরে উকিলের সঙ্গে বসে গভীর আলোচনায় মগ্ন থাকতো। মামারা আসতো মাঝে মাঝে। ফিস্ফিস্ করে কী সব গোপন শলাপরামর্শ করতো তখন। অনেক সময় বেশি রাত হয়ে গেলে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে মামাদের খেতে দিতো ওর মা। আকবর শরীফ ওর পড়ার ঘর থেকে সব দেখতে পেতো। হারিকেনের মৃদু আলোয় ও দেখতো ওর মধ্যবয়সী বাবার চক্চকে চোখ।

বাবার সামনে খুব কমই যেতো আকবর শরীফ। তার বাবা কখনো হেসেছে- এটা তার মনে পড়ে না। গম্ভীর প্রকৃতির লোক ছিলো তার বাবা। কোনো কিছু পছন্দ না হলে আরো চুপচাপ হয়ে যেতো। পৈতৃকসূত্রে অনেক জমিজমা পেয়েছিলো রায়হান মোল্লা। কিন্তু তার বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় একমাত্র সন্তান হিসেবে রায়হান মোল্লার কাঁধে এসে পড়ে এসব পৈতৃক সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ ও তা রক্ষা করার কাজ। অনেক জমির খাজনা দেয়া ছিলো না, অনেক জমির মিউটেশন বা নামজারিও হয়নি। ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরে অনেক হিন্দু পরিবার স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যায়। আকবর শরীফের দাদা ওই সময় বেশ ভালো পরিমাণ জমি হিন্দুদের কাছ থেকে কিনে নেয়, অনেকটা পানির দামেই। জমির দলিল আর কাগজে টিপসহি নিয়ে জমি হস্তান্তরের কাজগুলো হয়েছিলো। অনেক হিন্দু পরিবার তাদের দেশত্যাগের খবরটা ফলাও করে প্রচার করতে রাজি ছিলো না বলে জমি বিক্রির খবর অনেকেই জানতো না। সরকারের ভূমি অফিস তো দূরের কথা, প্রতিবেশীরাও টের পায়নি তাদের ভিটে ছেড়ে যাবার খবর। অনেক পরিবারই গেছে রাতের অন্ধকারে। মুসলিম লীগের গুণ্ডাপাণ্ডাদের নজর এড়িয়ে যে যেভাবে পেরেছে চলে গেছে।

তো, রায়হান মোল্লার বাবার কাজই ছিলো জমি কেনা আর সম্পত্তি বাড়ানো। লুকিয়ে লুকিয়ে এসব কাজ করতে হতো বলে ভূমি অফিসে গিয়ে কাগজপত্র মিলিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। তা ছাড়া আর্থিক দিক দিয়ে মোল্লা পরিবারের খ্যাতি থাকায় টাকার জোরে অনেক কিছু করা সম্ভব বলে তারা বিশ্বাস করতো। রায়হান মোল্লার বাবা এক সময় বুঝতে পারে, তার এ সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী দরকার। পাঁচ গ্রামের সুঠাম তরুণদের নিয়ে সে গড়েও তুলেছিলো তার বাহিনী। কিন্তু কোনোকিছু ঘটে যাবার আগেই লোকটা মুখে রক্ত উঠে মরে যায়। উত্তরাধিকারীদের জন্য জমিজমা বন্দোবস্ত করে রেখে যাবার সুযোগ সে পায়নি।

এসব জমিজমার সব কাজ এসে পড়ে ছেলের ঘাড়ে।

বাক্স খুলে পিতার সঞ্চিত কাগজপত্র দেখে মাথা ঘুরে যায় রায়হান মোল্লার। জমিজমার কাগজপত্র সে বোঝে না। কোথায় কী আছে- জমি না বাড়ি, বর্গাচাষি কে, কোথায় কী ফসল ওঠে, পুকুরগুলো কোথায়; মাছ চাষ হয়, নাকি পতিত, এসব তত্ত্বতালাশ করতে করতে দফাদার-উকিল তার প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে যায়।

ঢাকায় তখন সরকারের বিরুদ্ধে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সঙ্গে আরো অনেককে আসামি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিচার শুরু করায় ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করেছে পূর্ব বাংলার মানুষ। মিথ্যা মামলা বাতিল করে এবং সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দেয়ার দাবি উঠেছে ঢাকায়। আন্দোলনের সে ঢেউ ভিলেজ পলিটিক্সের নিচে চাপা পড়ে যায়। এ গ্রামে-সে গ্রামে হিন্দুদের রেখে যাওয়া জমির অনেক মালিক দাঁড়িয়ে যায়। অনেকে মামলা করে বসে আদালতে। যারা জমির মালিকানা দাবি করেছে, তাদের দলিলও একই রকম। আসল-নকল বুঝতে গিয়ে নিজেই হিমশিম খেয়ে যেতো রায়হান মোল্লা। শত শত বিঘা জমির মালিকানা নিয়ে সংগ্রাম করাটাই প্রধান হয়ে উঠেছিলো তার কাছে। তাই নিয়মিত তাকে ছুটতে হতো আদালতে। বাবার তৈরি করা লাঠিয়াল বাহিনী তাকে পাহারা দিয়ে রাখতো। রায়হান মোল্লা বুঝতো, জমির মালিকানা নিয়ে এসব মামলা-মোকদ্দমা জীবনকে সুতোর উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। এই সুতো ছিঁড়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তেই। এভাবেই দোরগোড়ায় এসে যায় একাত্তর।

আকবর শরীফ কীভাবে কীভাবে জানি শুনেছিলো, তার সহপাঠী জমিরের বাবা তাদের জমির মালিকানা নিয়ে মামলা করেছে।

একদিন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিছিল শেষ করে ফেরার পথে আকবর শরীফ জমিরকে বলেছিলো,

‘শোনো জমির, তোমার বাবা নাকি আমাদের জমিজমা নিয়া মামলা করেছেন?’

‘ওইটা বাবায় বলতে পারে।’

‘তোমার বাবাকে তুমি বুঝাও জমির। উনি যা করতেছেন তা ঠিক না। দেখো, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। স্টেট পলিটিক্স আমাদেরকে এক ছাতার নিচে নিয়া আসছে। আমাদের ভিতর দলাদলি কি ভালো?’

জমিরের কথাবার্তা ছিলো বাইন মাছের মতো পিছলা।

‘আমার বাবা আমার কথা শুনবো_ এইটা তোমারে কে কইলো কও? তোমার-আমার ফ্রেন্ডশিপ কি বাবার কাছে কোনো বিষয় হইলো?’

আকবর শরীফ তবুও বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো জমিরকে। কিন্তু স্কুলপড়ূয়া এসব তরুণের কথার দাম কে দেয়? জমিরের বাবা কাশেম সর্দারের প্রতাপ এলাকায় মোটেও কম ছিলো না। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এবং তার কেনা জমির পরিমাণ এলাকার মিঞা-চৌধুরীদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। কাশেম সর্দারের বাড়তি একটা সুবিধা ছিলো, ডিসেম্বরের গণপরিষদ নির্বাচনে তার এক দূর সম্পর্কের ভায়রা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলো পাশের মহকুমার নির্বাচনী এলাকা থেকে। সেই সূত্রে তার একটি প্রভাব বলয়ও তৈরি হয়েছিলো লোকজনের ভেতর। সেও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে চলতো এলাকায়।

২৫ মার্চের মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সশস্ত্র সেনাদের হামলা শুরুর মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার চেহারা পাল্টাতে শুরু করে। শহরগুলোর এখানে-ওখানে ছোটখাটো প্রতিরোধ ইপিআর-পুলিশ আর বাঙালি সৈন্যদের মাধ্যমে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তারা আর দাঁড়াতে পারেনি। নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে এপ্রিলের মধ্যে সারা দেশ পাকিস্তানি সৈন্যরা দখল করে নেয়। নানা রকম আইন এবং ফরমান জারি করে একটা স্বাভাবিক অবস্থা বহাল আছে_ পৃথিবীকে দেখানের জন্য সবরকম চেষ্টা তারা নেয়। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় পায় শরণার্থী শিবিরে।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া তরুণ ছাত্র-যুবকদের প্রায় সবাই দেশত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়া শুরু করে। তার বন্ধুদের সবাই চলে যায়, কিন্তু আকবর শরীফ ভারতে যায় না। ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটিকে সে বুকের ভেতর খাঁচায় বন্দি করে রাখে। সময় হলে খাঁচা খুলে দেবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার জন্য সরকার রাজাকার বাহিনী গঠন করে।

আকবর শরীফ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে বিছানায়। একটা দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে প্রতিদিন। সময় বুঝে আকবর শরীফ একদিন রাজাকার বাহিনীতে নিজের নাম লেখায়। বুকের ভেতর তার প্রতিশোধের আগুন- তার শত্রুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে। হত্যাকারীদের হত্যা করার জন্য এটাকেই একটা চমৎকার সুযোগ হিসেবে বেছে নেয় সে।

জানুয়ারির দিকে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলো রায়হান মোল্লা এবং কাশেম সর্দার। আদালতের ভেতরে উকিলদের উত্তপ্ত কথাবার্তার সূত্রে বাইরে দুই পক্ষের লাঠিয়াল বাহিনী জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। বেশ ক’জন আহত হয়, পুলিশ কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যায়। কয়েকটা মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয় লেঠেলরা। হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিন নাকি কাশেম সর্দার চিৎকার করে বলেছিলো, সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেবে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে এলাকাবাসী ধরেছিলো উভয়কে ডেকে এনে বিষয়টার একটা মীমাংসা করে দেয়ার জন্য। চেয়ারম্যান দুই ঘণ্টা তার লোকজন নিয়ে সালিশ-বৈঠকের জন্য বসে থাকলেও রায়হান মোল্লা-কাশেম সর্দার কেউ সে সালিশিতে উপস্থিত থাকেনি।

জানুয়ারির শেষদিকে এক রাতে মোল্লাবাড়িতে খবর আসে_ রায়হান মোল্লা খুন হয়েছে। বগা বিলের ধানক্ষেতে পড়ে আছে তার রক্তাক্ত লাশ। কাশেম সর্দারের দিকে সন্দেহের আঙুল ওঠাতে গিয়ে থেমে যায় পুলিশও। কেননা, যেদিন রায়হান মোল্লা খুন হয়েছে সেদিন কাশেম সর্দার ঢাকায় গিয়েছিলো ভায়রাকে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু পুলিশ কাশেম সর্দারের হুমকিটাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে না। তার নির্দেশে রায়হান মোল্লাকে খুন করা হয়েছে_ এমন সিদ্ধান্তে আসার আগে খুনের চাক্ষুষ প্রমাণ দরকার। ভাড়াটিয়া খুনির পেট থেকেও পুলিশ সব তথ্য বের করার টেকনিক জানে।

বাবার মৃত্যুর পর শান্ত হয়ে যায় আকবর শরীফ। এক ধরনের বেদনাবোধ তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। কষ্ট আর দুঃখ তাকে প্রতিদিন টেনে নিয়ে যায় অলৌকিক পৃথিবীতে। খুনিকে ধরার জন্য সে প্রাণপণে ছুটছে, তার হাতে চক্চক্ করছে সদ্য ধার দেয়া হেঁসো। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তাড়া করতে করতে সে বুঝতে পারে সামনে যে লোকটা ছুটে পালাচ্ছে, সে আর কেউ নয়- কাশেম সর্দার। সে-ই তার বাবাকে খুন করেছে। মাথায় রক্ত উঠে যায় আকবর শরীফের। সে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকে গ্রামবাসীকে। কিন্তু সে চিৎকার গলায় এসে আটকে যায়। সে ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। এই শীতের রাতেও তার কপাল, মুখ, গলা দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটতে থাকে। প্রতিদিন এই একই স্বপ্ন দেখে সে। এটা কি স্বপ্ন? নাকি ঘোরের ভেতর সে প্রতিরাত তাড়া করে কাশেম সর্দারকে? এই কথাগুলো সে কাউকে বলতে পারে না। মানুষ প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখে_ এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। অথচ বাবার হত্যাকারীকে সে ছেড়েও দেবে না।

এপ্রিলের দিকে জেলা সদরে এসে গিয়েছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর প্লাটুনে প্লাটুনে ভাগ হয়ে মহকুমা শহরগুলোতে ঘাঁটি গেড়ে নিয়েছিলো। একদিন শুনতে পেয়েছিলো ওরা, থানা সদরে ক্যাম্প করে পাকিস্তান রক্ষায় মারমুখী সৈন্যরা কালো পতাকা নামিয়ে আবার উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের পতাকা। নির্বিচারে মানুষ হত্যা আর ঘরবাড়িতে অগি্নসংযোগের আশঙ্কায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া মানুষগুলো এলাকা ছেড়ে সীমান্তের দিকে চলে গেছে। অরক্ষিত জনপদে মুসলিম লীগ আর জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা বুক ফুলিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। অনেকে থানা সদরে গিয়ে মেজর সাহেবের সঙ্গে কোলাকুলি করে এসেছে।

আকবর শরীফ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া তরুণ। তার বন্ধুরা সবাই ওপারে চলে গেছে, সে যেতে পারেনি। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবিশ্রান্ত গুলির আওয়াজ আর সন্ধ্যেবেলা দিগন্তে আগুনে পোড়া ঘরবাড়ির জ্বলন্ত শিখা তার মধ্যে এই দুঃখবোধটা জাগিয়ে দেয়। তবুও পাকিস্তানি সৈন্যরা যে তাকেও গুলি করে মেরে ফেলতে পারে- এমন শঙ্কা সে মন থেকে একটু একটু করে তাড়িয়ে দেয়। বহুদিন পর বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে আসে সে। হাত দুটোকে পিঠের ওপর নিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। অনেকদিন চুল-দাড়ি না কাটায় সে নিজে নিজেই কাঁচি-ব্লেড দিয়ে চুল ছোট করে, গোঁফটা কামিয়ে ফেলে। দাড়ি রাখা সুন্নত। সে দাড়িটা রেখে দেয়। মাথায় টুপি চড়ায়। তার বাবার লাঠিয়াল বাহিনীর অনেকেই দেশত্যাগ করেছে, যে দু’চারজন আছে তাদের খবর দেয় সে।

যুদ্ধের আতঙ্ক বিধবা মায়ের চোখেমুখে। সে শুনেছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি মেয়েদের ওপর যৌন-নির্যাতন করছে, ধরে নিয়ে আটকে রাখছে ক্যাম্পে। জয় বাংলার লোক পেলেই গুলি করে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে।

একদিন আতঙ্ক নিয়ে মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে,

‘বাজান, সবাই তো ওইপারে যাইতাছে শুনতাছি। আমরা যামু না?’

আকবর শরীফ মায়ের দিকে চোখ তুলে বলেছিলো,

‘অবশ্যই যামু মা। কিন্তু কিছু কাজ যে অহনও বাকি। কাজগুলান শ্যাষ করতে দেন, তারপর যুদ্ধে যামু।’

আকবর শরীফ বিশ্বস্ত রাজাকার হয়ে যায়। ইসমত খানকে ক্যাপস্টেন সিগারেটের প্যাকেট মুফতে দিয়ে দিয়ে হাতে লাঠির বদলে বন্দুক বরাদ্দ নেয়। বন্দুকটাকে গামছা দিয়ে বেল্টের মতো বেঁধে পিঠে খাড়া করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জুন-জুলাইয়ের দিকে আকবর শরীফ বুঝতে পারে, বাঙালিরা ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে। গেরিলা দল ঢাকা এবং বড় বড় শহরে অপারেশন শুরু করেছে।

এনায়েত চাচা একদিন ওইপার থেকে গ্রামের খবর নিতে এসে মধ্যরাতে দেখা করে আকবর শরীফের সাথে। চাচা জানিয়েছিলো, সে অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে কাজ করে। যুদ্ধের ট্রেনিংও নিয়েছে। ফিসফিস করে বলেছিলো,

‘তুমি নাকি রাজাকার হইছো?’

‘জি চাচা।’

‘ক্যান? তোমার তো মুক্তিবাহিনী হওয়ার কথা!’

‘রাজাকার হইলে টাকা পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় একটা বন্দুক।’

‘মুক্তিবাহিনীও বন্দুক-রাইফেল-মেশিনগান পায়।’

‘মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র দিয়া মুক্তিবাহিনী খুন করা ঠিক না।’

চাচা যেন একটু অবাকই হয়েছিলো।

‘তার মানে? তুমি কী বলতে চাইতেছো?’

‘আমি তো একটা খুন করুম চাচা। আমাকে আপনারা মাফ কইরা দিয়েন।’

‘কারে খুন করবা?’

‘সময় হইলে জানতে পারবেন। আর আপনের ঠিকানাটা দিয়া অহন যান, বিলের কিনার দিয়া যাইবেন না। ওইখানে রাজাকাররা পাহারা দেয়। খালপাড় দিয়া চইলা যান।’

এনায়েত হোসেন দ্রুত সরে গিয়েছিলো গ্রাম থেকে।

ইসমত খান একদিন বলে,

‘শরীফ সাহাব, হাম মুক্তি লোগ চাহিয়ে। কুছ তো কারো।’

আকবর শরীফের মগজে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ওঠে, কিন্তু হাতে তার পাকিস্তান রক্ষার বন্দুক। ও ঘুরে বেড়ায় এ গ্রাম-সে গ্রাম। তার লাঠিয়ালদের সে গুপ্তচরের কাজে লাগায়। ওর হাতের বন্দুক কোনো মুক্তিবাহিনী নয়, খুঁজে বেড়ায় কাশেম সর্দারকে, ওর বাবার হত্যাকারীকে। একটি মাত্র পাকিস্তানি গুলি সে খরচ করবে তার বাবার হত্যাকারীর জন্য। তার আর কোনো ইচ্ছে নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই। এই বন্দুকটা পাওয়ার জন্য সে রাজাকার হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে হত্যা করা কোনো খুনের কাজ নয়। এ জন্যে ফৌজদারি মামলা হয় না, হাতে হাতকড়া পড়ে না, থানা-পুলিশ-আদালত-কারাগার কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। সব মাফ।

কাশেম সর্দারের বাড়ির আশপাশে ঝোপ-ঝাড়ে রোজ রাতে বসে থাকে ও। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে। বন্ধ চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ে পানি। সেই পানি একটা বিশাল নদী হয়ে যায়। যেন স্বপ্নের নদী। তার স্বপ্নের নদীতে ভাসতে থাকে মুক্তিবাহিনীর নৌকা। সে ওই নৌকার ছইয়ে বসে চারিদিকে তাকায়। বর্ষার জলে ভেসে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জল দেখে ভয় পাওয়া মেজর ইকবালরা গুটিয়ে থাকে ক্যাম্পের ভেতর।

স্বপ্নটা ভেঙে যায় একটা খুটখাট আওয়াজে। কাশেম সর্দারের বাড়ির ভেতরে মানুষ চলাচলের শব্দ পায় ও। এই মাঝরাতে কে ওই বাড়িতে?

নিশ্চয়ই তার শিকার।

এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যায় আকবর শরীফ।

অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারে ওর শিকার।

মাত্র একটা গুলির শব্দ হয়।

সবাই শোনে।

গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙে কাকগুলো কা-কা করে ওঠে অন্ধকারে।

তিন দিন পর বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত আকবর শরীফ কলকাতায় অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে গিয়ে এনায়েত চাচার সঙ্গে দেখা করে।

‘চাচা, আমি আইসা পড়ছি।’

আকবর শরীফকে দেখে চমকে ওঠে এনায়েত হোসেন।

‘চাচা, আমারে মেঘালয়ে পাঠায়া দেন, যুদ্ধের ট্রেনিং দেন। আইজ থাইকা আমি মুক্তিবাহিনী। আর দুইটা সাবান কিইন্যা দেন। শরীর থাইকা রাজাকারের গন্ধ সরাইতে দুইটা সাবানে হয় কি-না সন্ধ আছে। তবুও দেন।’

সাবান লাগে না। এনায়েত হোসেন দেখে, চকচকে চোখের আকবর শরীফের শরীর থেকে একটু একটু করে খসে পড়ছে রাজাকারের পলেস্তারা।