ফারুকীর ডুব এবং বাক স্বাধীনতা

২৪ বছর আমি দেশে নেই। এই ২৪ বছরে অনেক নতুন শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকার চলচ্চিত্র নির্মাতা বাংলাদেশে বিখ্যাত হয়েছেন, আমি সবার নাম জানি না। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নাম আমি প্রথম শুনি আমার বোনের কাছে। ফারুকীর কিছু নাটক ও আমাকে দেখিয়েছিল। নিউইয়র্কের বাঙালিরা জ্যাকসন হাইটসের দোকান থেকে বাংলা নাটকের সিডি ভাড়া করে নিয়ে আসে। আমার বোনও তাই করে। ভাড়া করা সিডির কিছু নাটক দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। ফারুকীর নাটকগুলো দু’বোন মিলে বেশ আনন্দ করেই দেখেছিলাম। নাটক দেখার কিছুকাল পর হঠাৎ ফারুকীর একটি চিরকুট পাই। তাঁকে জানালাম তাঁর নাটক আমার ভালো লেগেছে। উনি এরপর লিখলেন, ——— ‘ আপনার তড়িৎ উত্তর পেয়ে খুবই ভালো লাগলো। আমার দুএকটা কাজ আপনার দেখা হয়েছে জেনে ভালো লাগলো। আপনার পোস্টাল এড্রেস পেলে আমার বাছাই করা কিছু কাজ পাঠিয়ে দিতে পারবো। প্রথমে একটা কথা বলে নিই, আপনি যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তখন আমরা ছোট, ফলে আমাদের কথা বলার কোনও সুযোগ ছিল না। আজকের দিনে হলে হয়তো আপনার পাশে অনেক তরুণকে পেতেন। কারণ আপনার লেখা নিয়ে আমার হাজারো সমালোচনা থাকতে পারে, বিরুদ্ধ মত থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য আপনাকে কতল করতে হবে, তা হতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে ওই হুজুরদের চেয়েও বড় অপরাধি সেই সব প্রগতিশীল সুবিধাবাদী বড় ভাইয়েরা যারা সেদিন নির্বাক ছিলেন। আপনি জেনে রাখবেন একদিন এই কথাগুলো আলোচিত হতে শুরু করবে। যাই হোক, অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়ত হঠাৎ দেখা হওয়ায় আবেগ সামলাতে না পেরে জমানো কথাগুলো উগড়ে দিলাম। সে যাই হোক, আমি একটা নতুন ছবি বানাচ্ছি, নাম ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’। এটা ঢাকা শহরে বসবাসরত একটা একা মেয়ের গল্প। ছবিটার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়ে গেলে আপনাকে দেখাতে চাই। বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। দলে দলে মেয়েরা চাকরিতে যাচ্ছে। মেয়েরা এখন তাদের মত এবং পছন্দের মূল্য দিতে পারছে। তারপরও আসলে কতদূর এগিয়েছে? আপনার ফেলে যাওয়া ঢাকা এখন কেমন আছে? এইসব একটু আপনাকে দেখাতে চাই।’
ফারুকীর চিঠি আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তিনি কথা রেখেছিলেন, আমাকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবিটির সিডি। ফারুকির এই ব্যক্তিগত চিঠিটি জনসমক্ষে আজ তুলে ধরার কারণ, আমি বোঝাতে চাইছি মানুষের কিছুই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত নয়। ফারুকীও তাঁর কাছে লেখা যে কারও চিঠি পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতে পারেন। আমিও আমার জীবনের কাহিনী নিয়ে বই লিখতে পারি, সে বইয়ে আমি যাদের সঙ্গে উঠেছি, বসেছি, শুয়েছি, হেসেছি, কথা বলেছি, তর্ক করেছি, তাদের কথাও লিখতে পারি। ফারুকীও পারেন যে কারোর জীবন নিয়ে ছবি বানাতে। ‘ডুব’ ছবিটি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নাকি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নয় – এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। ফারুকী এক সময় কোনও কোনও পত্রিকায় বলেছিলেন, ছবিটি হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে। এখনও তিনি তাই বলতে পারেন। তবে এটি নিশ্চিতই বায়োপিক নয়। বায়োপিক হলে ছবির প্রধান চরিত্রের নাম জাভেদ হাসান হতো না, হুমায়ূন আহমেদ হতো। বায়োপিক না হলে হুমায়ূন আহমেদের কোনও আত্মীয়ই ছবি বন্ধের দাবি করতে পারেন না। বায়োপিক বা জীবিনভিত্তিক ছবি হলে বড়জোর তাঁরা হয়তো টাকা দাবি করতে পারেন, কিন্তু স্ক্রিপ্ট তাঁরা লিখে দেবেন বা গল্পটা কী হবে তা বলে দেবেন— এমন আবদার করতে পারেন না। বায়োপিকে যদি মিথ্যে গল্প থাকে, তাহলে সে নিয়ে বিতর্ক, মামলা বা যা কিছুই যে করতে চায়, করতে পারে।
কলকাতার বিখ্যাত চিত্রপরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি এবং চূর্ণী গাঙ্গুলি আমার ওপর একটি ছবি বানিয়েছেন, ‘নির্বাসিত’ নাম। ছবিটি বানানোর আগে চারদিকে এটিই প্রচার হয়েছে ছবিটি আমাকে নিয়ে তৈরি। ছবি বানানোর আগে ওঁরা আমার কাছে এসেছেন, ছবির গল্প নিয়ে কথা বলেছেন। ছবিটি ওঁরা চাইছিলেন নির্বিঘ্নে মুক্তি পাক, তাই আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু ওঁরা তুলে ধরেননি। ছবিটির শতকরা ২০ ভাগ আমার গল্প, ৮০% ভাগ বানানো। তারপরও সবাই জানে ওটি আমাকে নিয়ে তৈরি। নির্বাসিত যেদিন শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়, আমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। নির্বাসিত’র ৮০% আমার জীবনের কাহিনী নয়, সে কারণে ছবিটিকে আমার বায়োপিক হিসেবে অফিসিয়ালি দাবি করা হয়নি। নির্বাসিত ছবির প্রধান চরিত্রকে তসলিমা নামেও ডাকা হয়নি, তাঁকে ডাকা হয়েছে লেখিকা বলে, উনি বলে, তিনি বলে, মহিলা বলে। যদি তসলিমা নাসরিন হতো তাঁর নাম, যদি ছবিটিকে আমার জীবনকাহিনী বলে অফিসিয়ালি প্রচার করা হতো, এবং সে নামের লেখিকাকে দেখানো হতো এমন উদ্ভট কিছু করছে যা আমি কশ্মিন কালেও করিনি, আমার আদর্শ ও বিশ্বাসের বিপরীত কাজ যদি ছবির আমি চরিত্রকে দিয়ে করানো হতো, তবে আমি নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করতাম, মামলা টামলা কখনও কারো বিরুদ্ধে আমি করিনি, হয়তো নিরূপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নিতাম।
ফারুকীর ‘ডুব’ ছবির প্রধান চরিত্রের নাম জাভেদ হাসান। এটি হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয়। বায়োপিক দাবি করে ফারুকী কোনও মিথ্যে গল্প ফাঁদছেন না, তবে আপত্তি উঠছে কেন? ফারুকী বরং বায়োপিক দাবি না করেও হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সত্য গল্পটাই বলছেন। তিশা আর পার্নো যদি হুমায়ূন আহমেদের কন্যা এবং কন্যার বান্ধবীর চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, আমি তো বলবো, ওঁরা একটু বেশি বয়সেই ওদের অভিনয় করেছেন, বাস্তবে কন্যা এবং কন্যার বান্ধবীর বয়স তখন হয়ত আরো কম ছিল। হুমায়ুন আহমেদের ‘কিশোরি ফেটিশ’ থাকতে পারে, কিন্তু এটা বললে দোষ? বিখ্যাত লোকদের চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ পৃথিবীর সর্বত্র হয়, হচ্ছে। দুই বাংলাতেই দেখছি পুরুষ লেখকদের দেবতার আসনে বসিয়ে রাখার একটা অশ্লীল প্রবণতা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সুযোগ পেলে মেয়েদের বুক টুক খামচে ধরতেন – এ কথা একদিন যেই না বলেছি, হৈ রৈ করে আমাকে মারতে এলো একপাল সুনীলতান্ত্রিক গ্যাং। পারলে আমাকে ওরা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ওরাও কিন্তু জানে সুনীলের চরিত্র। ওরা জানে আমি সত্য কথা বলেছি, কিন্তু ওরা মনে করে সত্যটা বলা যাবে না, ওরা মনে করে সবসময় সত্যটা বলা উচিত নয়। আমি কিন্তু মনে করি সবসময় সত্যটা বলা উচিত। সত্যটা জানাজানি হলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, এই আশংকাও যদি থাকে, তারপরও বলবো, সত্যের কোনও বিকল্প নেই।
সত্য কথা লিখেছি বলে আমার বেশ কয়েকটি বই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার সত্য শুনতে পছন্দ করেন না। মানুষও পছন্দ করে না, তাই বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দেশে কোনও মানুষ প্রতিবাদ করে না। যেদিন মানুষ বাক স্বাধীনতার মূল্য বুঝবে, সেদিন বই নিষিদ্ধ হতে দেবে না। যেদিন সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা সত্যিকার শিক্ষিত হবে, সেদিন কোনও ছবি আটকে রাখবে না। সরকার যেদিন সত্যিকার গণতন্ত্রের মানে বুঝবে, সেদিন থেকে মানুষের ভিন্ন মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অসম্মান করবে না।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textতসলিমা নাসরীন- র আরো পোষ্ট দেখুন