কেউ ভোলে কেউ ভোলে না

শহর থেকে ভার্সি’টিগামী শাটল ট্রেন। সকাল ৭টা বাজতে তখনো মিনিট দশেক বাকী। অামার পাশের সীটে একজন বসার মতো জায়গা অাছে। লক্ষ্য করলাম, হন্তদন্ত হয়ে সে সীটে একজন ছাত্রী বসে পড়ল একেবারে অামার গা ঘেঁসে। একসময় তার শরীরের উত্তাপ ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ল অামার শরীরে। অামিতো কিংকর্তব্যবিমুড় ! কিছুটা শিহরণ, কিছুটা লজ্জায় একেবারে নীরব, নিথর।
নীরবতা ভাঙলো প্রথমে সে, “‘ভাইয়া, অাপনাকে বাংলা বিভাগের সামনে দেখেছিলাম। অাপনি কি বাংলা বিভাগে পড়েন “। অামি বললাম, “হাঁ, তৃতীয় বর্ষে পড়ি “। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ” অাপনি ? “। সে বলল, ” দর্শনে, দ্বিতীয় বর্ষে “। পুনরায় সে বলল, ” অামাকে ‘অাপনি’ বলবেন না। অামিতো অাপনার চেয়ে ছোট। অামাকে ‘তুমি’ বললে ভাল লাগবে “। সে-ই প্রথম কথা এবং পরিচয়।
কিন্তু ‘ অামাকে তুমি বললে ভালো লাগবে ‘ — তার কথাটি অামার মনোজগতে প্রচণ্ড ঝড় তোলে।
প্রথম দর্শনেই ‘ তুমি’ বলার অধিকার দেয়া, অাবার এর সাথে ‘ভালোলাগা’র কথা জুড়ে দেয়া — এটা কি তার বিনয়, নাকি অামাকে নিয়ে সত্যিকার কোন ভাললাগা-ভালবাসা তার মনের গহীনে জায়গা করে নিয়েছে। ধ্যাৎ, এসব অামি কি ভাবছি! অামি কেমনই বা সুন্দর-সুদর্শ’ন রাজপুত্তুর যে অামাকে তার ভাল লাগবে।
তারপর প্রায় মাসখানেক সময় কেটে গেল। একদিন দেখি, সে অামার বাংলা বিভাগের সামনে হাজির।
সে-ই প্রথম মুখ খুললো, ” অাপনার সাথে একান্তে অামার কিছু কথা ছিল। অাপনি কি একটু সময় দেবেন”?
অামি অপ্রস্তুত অবস্হায় অনেকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলেই ফেললাম, ” অামার সাথে তোমার অাবার কি কথা ! ”
পাশেই দাড়িয়ে থাকা সুপুরুষ তমিজ বললো, ” তুই বুঝিস না দোস্ত ! কথা না বাড়িয়ে যা’তো উনার সাথে “। অগত্যা তথাস্হ।
মেয়েটি বললো, ” অামার নাম কবিতা, কবিতা নন্দী। অাপনার নাম ? ”
অামি বললাম, ” অামার নাম সুদীপ্ত- সুদীপ্ত সেন “।
তারপর অনেক কথা হল। সেই থেকে অামরা দুজনে- দুজনার। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে অবসর পেলেই সে ছুটে অাসে কলা অনুষদের চতুর্থ’ তলার দর্শন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় তলার বাংলা বিভাগের বেলকনীতে। চঞ্চলা হরিণীর মতো ওড়নী উড়িয়ে তার সে উদ্দাম ছুটে চলা তখন ছিল নিত্য রুটিন। এভাবে কেটে গেল অনেক সময়।
এক পর্যায়ে অামার শিক্ষা জীবন শেষ হলে ত্যাগ করি ভার্সিটি অঙ্গন। চাকরীর সুবাদে চলে যাই সুদূর কানাডায়। ‘ কবিতা’ অামার হৃদয়ে চির-জাগরুক থাকলেও জীবনের প্রয়োজনে এক সময় বিয়ে করি এক বিদেশীনিকে। কানাডায় অামার জীবন-সংসার ভালই যাচ্ছিল।
এগার জানুয়ারী ২০১৪। বুধবার রাত ০৯ টা। বাংলাদেশ থেকে অামার মোবাইলে ফোন অাসে হাশেমের নাম্বার থেকে। হাশেম-লিয়াকত সম্ভবত পাশাপাশি ছিল। দুজনার সাথে কথা হল। তারা জানায়, অাগামী মার্চে তারা ‘চূসা–৭৮’ ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন’ এর অায়োজর করছে। কানাডা থেকে প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ যেতে অনেক দিন ধরেই মনটা অাকুলি-বিকুলি করছিল। সঙ্গত কারণেই লুফে নেই তাদের অামন্ত্রণ। বিদেশী স্ত্রী ও কন্যারা ব্যক্তিগত কাজ থাকায় রাজী না হলেও অামি কিন্তু ঠিকই চলে অাসি বাংলাদেশে এবং নিদ্দিষ্ট সময়ে স্বশরীরে পৌঁছে যাই অনুষ্টান স্থলে ।
দিনটা ছিল ৩০ মার্চ ২০১৪। স্মৃতির ক্যাম্পাস সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে অায়োজন করা হয় পারিবারিক পুর্নমিলনীর। নিদিষ্ট সময়ে সেখানে পৌঁছেই অামার চোখ ছানাবড়া, একি ! সামনে যে একাকী কবিতা, কবিতা নন্দী ! পৌড়ত্বের ছাপ, চুলে পাকন ধরেছে। তাকে দেখেই বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে ওঠে। উভয়ে উভয়ের চোখে চোখ রেখে নিস্পলক তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কারো মুখে কোন রা-শব্দ নেই। রাজ্যের বিষন্নতা- নীরবতা যেন জেকে বসেছে অামাদের দু’য়ের মাঝে। একটু ঢোক গিলে ও’ প্রথমে বললো, ” খুব নার্ভা’স হয়ে পড়েছ মনে হয় “।
“নার্ভাস, অামি……… না মানে…….. ” অামার অপ্রস্তুত ভাব দেখে কবিতা নন্দী হঠাৎ ঁহাসিতে ফেটে পড়ে।
এ হাঁসি যেন বাঁধভাঙ্গা বন্যা, কোন কালেই থামবার নয়। কিছুটা ঘৃণা, কিছুটা অনুরাগ, কিছুটা বিলম্ব দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। এ যেন এক অন্যরকম দর্শন , অন্য অনুভুতি………. । হঠাৎ থেমে যায় কবিতার হাসি। চোখ থেকে নেমে অাসে ফোটা ফোটা নদী।
অনুযোগ করে বলে, ” তুমি কি জানো, অামি এখনো বিয়েই করিনি। স্মৃতির এলবাম ওল্টাই অার তোমাকে খুঁজে ফিরি । তুমিতো একবার অামার খোঁজও নিলে না। পুরুষরা অাসলে বড়ই স্বার্থপর ! ”
সেদিন তার সব কথা শুনেছি। অামিও বলেছি , অামার চাকুরী-বিয়ে-সংসার-সন্তান-সন্ততির কথা। পরে অামি অাবার কানাডায় ফিরে অাসি । কিন্তু প্রচণ্ড এক পাপবোধ অামাকে সর্বক্ষণ তাড়া করছে। ছাত্র জীবনে যৌবনের ঘোর লাগা এক তরুণীকে স্বপ্নের ঘোরে রেখে এ অামি কি করলাম ! তারওতো একটা সফল জীবন থাকতে পারতো। থাকতে পারতো স্বামী-সংসার-সন্তান-সন্ততি— যাদের নিয়ে এই পড়ন্ত বিকেলে মেতে থাকতো সে। অামি অার ভাবতে পরছি না। প্রচণ্ড পাপবোধ, প্রচণ্ড কান্না অামাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। স্ত্রী-সন্তান-সন্ততি– সবকিছু এখন অামার কাছে বিষবৎ। বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তার কছে……….।