ফুটবল আর আমি

Golpo5-300x181কাণ্ডটা ঘটেছিলো এই ঢাকা শহরেই। বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ঘটলো যে একেবারে আমার চোখের সামনে। তাহলে বিশ্বাস না করি কেমন করে বলো?
ব্যাপারটা খুলেই বলি। ক’দিন ধরে বিশ্ব ফুটবলের মাতামাতি নিয়ে একেবারে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাবার জোগাড়। স্কুলে যাবার সময় দেখি দোকানে সাজানো কত কাপ-পেয়ালা, তাতে নানা দেশের ছবি। খেলোয়াড়দের ছবি আঁকা ক্লিপ, কাপড়ের ব্যাজ, তৈরি করে দোকান বোঝাই করে সাজানো। আমাদের বাড়িতেও মহা হইচই। আব্বার পছন্দ ব্রাজিল আর সাউথ আফ্রিকা, আমার প্রিয় জার্মানি- সেই মত একটা ঢাউস দেয়াল জোড়া ছবি এনে আব্বা আমাদের পড়ার ঘরের দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, বল, আর কী চাস? সবাইকেই তো এর মধ্যে পাবি তাই না? ফুটবলের রাজপুত্রদের মন ভরে দ্যাখ।
– কিন্তু আব্বা, বিশ্বজয়ী খেলোয়াড় পেলে? পেলের আলাদা ছবি তো নেই। আর মেসি? মেসিও তো খুব ভালো খেলেন আব্বা! তা ছাড়া জিদান, তিনি তো বিখ্যাত!
– ওই হলো তো! বাবা আর ছেলে মিলে আমার বাড়িটা একেবারে ভূতের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে! নিজেরা তো খেলাধুলোয় লাড্ডু। ওদিকে সারাক্ষণ টেলিভিশন চলছে আর চিৎকারে কান ঝালাপালা। আম্মা রেগে রেগে বলেন।
– কেন বকছো ছেলেটাকে! না হয় না-ই খেলা পারলো। কিন্তু হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে তো আমরা গর্বিত হতে পারি! আব্বার কথায় আমার খুব ভালো লাগে। আম্মার আর কী! নাটক, রান্না এসব ছাড়া কিছু ভালো লাগে না তার। এইতো দেখতে দেখতে ফুটবল খেলার দিন চলে যাবে। তখন আবার অঙ্ক, ইতিহাস ও ইংরেজি। ওরে বাবা, অঙ্কের স্যার যা কড়া। ভুল করলে আর রক্ষা থাকবে না। না, পড়াশোনা করতেই হবে। স্যারের কথা না শুনলে আর ক্লাস সিকসে উঠতে হবে না! কাজেই যতো ভালোই বাসো না কেন, ফুটবলের পাশাপাশি অঙ্কের সংখ্যাগুলো মনে না রাখলে চলবেই না।
সেদিন একটা ভারি মজার কাণ্ড ঘটে গেল, আমাদের বাসায় একটা ঝুড়ি ভরে কমলা নিয়ে বিক্রি করতে এসেছিল একটা ছেলে। প্রায় আমাদেরই বয়সী। ওর ঝুড়িতে বাতাবি লেবুও ছিলো। আম্মা বললেন, বাতাবি লেবুগুলো মিষ্টি আর ভালো। আমি বললাম, দেশী ফল না রেখে বিদেশী কমলা আর সবুজ লাল মাল্টা রাখো না কেন? ছেলেটা কেমন যেন জিদ করে বললো- না, বাতাবি লেবুই বেশি ভালো। আমিও কম যাই না। বার বার বলছি, লাল, কমলা আর সবুজ মাল্টাই ভালো।
– আমাগো গাছে জাম্বুরা হয়, হগলের চাইয়া মিঠা। ভাইজান একটা লন না, খুব স্বাদ! দেখলাম আম্মা ওর কথা শুনে বেশ পছন্দ করেছেন। ওর ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে দুটো জাম্বুরা, বড় বড় আমড়া কিনে বললেন, ঠিক আছে তোর কথাই রাখলাম। আজকাল রোজার দিন, জাম্বুরা খেতে ভালো লাগবে। দুটো মাল্টাও অবশ্য রাখা হলো।
ছেলেটা হাসিমুখে সালাম জানিয়ে চলে গেল।
– দেশী ফলের স্বাদই আলাদা! মজা করে লবণ-মরিচ মাখানো জাম্বুরা খেতে খেতে বললেন দাদাজান। সবাই মিলে ইফতারিতে বসেছি, তাই আমি আমার রাগটা চেপে গেলাম। দেশী ফলের ওপর এত কী আদর শুনি? বলা যায় কিছুটা হিংসেই হলো আমার। সি ভিটামিনে ভরা জাম্বুরার গুণগান শুনতে শুনতে রাগ হলেও কিছু বলার ছিলো না আমার। ভালো মানুষটি হয়ে পড়ার টেবিলে বসতে হবে।

সেদিন হঠাৎ একটা মজার কাণ্ড ঘটলো। ঘুমটা বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় দেখি কী পড়ার টেবিলের পাশে বই রাখা সেলফে বসে কারা যেন গুন গুন করে গান করছে।
আরে! সত্যিই তো! আমার ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল এমনকি পেন্সিলগুলোও আরাম করে বসে পা দোলাচ্ছে দেখি! লম্বা লম্বা ঠ্যাংগুলো প্রায় আমার নাকে এসে ঠেকে আর কি! আমি বলে উঠলাম, কে রে তোরা? আমার পড়ার ঘরে কী করিস?
ওরা এক সঙ্গে গাল ফুলিয়ে সুর করে বলে উঠলো- আমাদের না চিনলে তোমার চলবে কী করে? খেলার নেশায় পড়ায় ফাঁকি চলবে না, চলবে না। নিজেতো একটা গোলও করতে পারো না, খালি খালি বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে চেঁচামেচি করলে চলবে? জিততে হলে খাটুনি করা চাই। বুঝেছো? আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি!
যে বইগুলো বসে পা দোলাচ্ছিলো, তাদের মধ্যে একটা পেট মোটা বই আমার নাকের ডগায় আঙুল দুলিয়ে মোটা গলায় গেয়ে উঠলো- সারা দুনিয়ার যত খেলা আর যত খেলোয়াড়, সবাইকে ভালোবাসো, নিজের দেশের খেলোয়াড়দের খবর কি তুমি রাখো?
– রাখি তো! মিঁউ মিঁউ করে উত্তর দিলাম আমি।
– সারা গায়ে পতাকা জড়িয়ে স্টেডিয়ামে যেতে না পারলেও টেলিভিশনের সামনে বসে ওদের উৎসাহ দিই। তোমরা কি তা-ও পছন্দ করো না?
– না, করি না। লম্বা ঠ্যাং দুলিয়ে উত্তর দেয় অঙ্ক বই।
– পড়া ছেড়ে বসে বসে গোল খাওয়া ছাড়বে, সময়ে করবে কাজ, হোম ওয়ার্ক সবটাÑ নইলে কপালে আছে বড় চড় চাপটা। রাত জেগে খেলা দেখে ঝিমাবে, সকালে ভেবেছো কি স্কুলে কি আদর জুটবে কপালে?
না: আমার সুখের ঘুমটা যে রসাতলে যাচ্ছে এখনই! চারদিকে বড় বড় চোখ করে বসে বসে বইগুলো খুব যেন মজা পাচ্ছে আমার দুরবস্থা দেখে। কী যে করি! এর মাঝে আবার আমার নাকের ডগায় এসে লাফাতে শুরু করলো একটা মস্ত গোল বল। একটা কোথায়? এক ডজন বলের ঘুষোঘুষি, লাফালাফির শব্দে আমি চোখ ছানাবড়া করে বসে আছি!
অঙ্ক বই, ভূগোল বইকে বললো, ও যে আজ আম্মার কাছে আবদার ধরেছিলো…
– আমি? কই না তো। আমি চিৎকার করে উঠি।
– না, মানে? তুমি বললে না, আম্মা আমার ব্রাজিলের ছবিওয়ালা গেঞ্জি চাই, কোরিয়ান ছবিওয়ালা ক্যাপ চাই, জার্মানির গ্লোব চাই। চাই। চাই। নইল চেঁচামেচি জুড়বো। করোনি মাকে জ্বালাতন? হুংকার দিলো সে।
– ওরে বাবা, থামো থামো না তোমরা! ফুটবল খেলা আমি ভালোবাসি বলেই তো এসব করেছি! তা আর না হয় জানো, আমার সব বন্ধুর ফুটবল খেলোয়াড়দের ছবিওয়ালা জামা, ক্যাপ, স্টিকার, মগ, ক্যালেন্ডার সব আছে। আমরা সবাই ওদের মতো ভালো প্লেয়ার হতে চাই। তাইতো সব কিছু চোখের সামনে সাজিয়ে রাখতে হয়।
– আচ্ছা, বাছাধন বলতো এইটা কি তোমার চোখের সামনে? মস্ত বড় সবুজ বন, পাহাড়, গাছপালাঘেরা একটা ছবি চট করে মেলে ধরে ইতিহাস বই। খটাস করে বুটে বুট ঠুকে বললো, বল দেখি বাবু এটা কোন্ জায়গা, কোন্ দেশ?
আমি থতমত খেয়ে খুব ভালো করে লক্ষ করে বললাম, কেন চট্টগ্রামের ফ’য়স লেকপার্ক।
– তোমার মাথা! এটা হলো নীলগিরি। বান্দরবান। নিজের দেশটাও তো ভালো করে চিনে উঠতে পারোনি। আচ্ছা, এই লোকটা কে?- বলো দেখি! মাথায় পাগড়ি পরা লোক দেখলেই আমার মনে পড়ে মীর কাসিম! চেঁচিয়ে বলি আমি।
– বোকার মতো কথা বলবে না। ইনি হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব, সিরাজউদ্দৌলা। আমার কানের মধ্যে এতক্ষণে বিন বিন করছে। ভাবছি, এরা যাবে কখন। এক সময় অঙ্ক বই লম্বা ঠ্যাংটা দুলিয়ে বললো, নিজেকে আগে ভালো করে গড়ে তোল বাবু, নইলে বলের ঘোরেই ঘুরপাক খাবে।
– আর হ্যাঁ, ঐ যে ছেলেটা তোমাদের পাড়ায় জাম্বুরা বেচতে আসে, ওকে তোমাদের খেলায় নিও। পারলে, তোমার সাতটা গেঞ্জি থেকে একটা ওকে দিও কিন্তু। ভুলে গেলে আমরা আবার আসবো।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ইংরেজি বই তার কোটটা টেনে টুনে নিয়ে আমার কাছে এলো। বাংলা ব্যাকরণ এতক্ষণ কটমট করে তাকালেও এখন তার মুখটা বেশ হাসি হাসি দেখাচ্ছে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বললো, কথাগুলো মনে রেখো, তাহলেই চলবে। কেমন? এখন ঘুমিয়ে পড়ো।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে আমারও চোখ ভেঙে এলো। ঘরটা জুড়ে রিমিঝিমি কুয়াশা আর ঠাণ্ডা বাতাস।

– লেবু লইবেন নি লেবু? জাম্বুরা লইবেন ভাইজান!
আরে এতো ঐ ছেলেটাই, গায়ে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। কিন্তু মুখটা ভারী হাসিখুশি। আমার কী যে হলো! ড্রয়ার খুলে সুন্দর একটা গেঞ্জি বের করে আম্মাকে বললাম, আম্মা, ওকে দিই?
– সে কি রে, কাউকে কিছু দিতে তো তোর মন ওঠে না। হঠাৎ এতো শখ! পরে আবার নিয়ে নিবি নাতো।
আমার বন্ধু রনি বললো- ওই ছেলেটা না খুব ভালো বল খেলতে পারে। আমি সেদিন দেখেছি, ঐ মাঠের ধারে। ধাঁই ধাঁই করে গোল করে।
– তাহলে তো ওকে শেখার সুযোগ করে দিতে হবে। বললেন আব্বা।
– কিন্তু ওর লেবু বিক্রির কী হবে?
– কেন, সারাদিন বিক্রি করবে। বিকেলে হাত-মুখ ধুয়ে তোদের লিটল ক্লাবে খেলবে। আবার কী! আমি তোদের ওস্তাদের সঙ্গে কথা বলবো।
– ছেলেটা বলে কি জানেন চাচা? বলে বিদেশী ফল তো বেচি ঠিকই কিন্তু আসলে আমাগো জাম্বুরাই ভালো। খাইতেও মিঠা, খেলতেও যেন ফুটবলের নাহাল।
ফুটবলের হৈ হৈ রৈ রৈ কিছুটা কামে এসেছে। কিন্তু আমাদের এখানে দারুণ জমজমাট হয়ে উঠেছে। খেলার দাপটে সারা পাড়া সরগরম। লেবু নিয়ে সাবু হাসিমুখে হাজির হয় সকালে। আর যেদিন ওর কাজ থাকে না, বিকেলে আমার দেয়া গেঞ্জি পরে হাসিমুখে হাজির হয় সে। সবাই বলে বড় হয়ে ও নাকি ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হবে। আর একটা কথা তো না বললেই নয়। আবদার না করে আমি মন দিয়ে পড়া তৈরি করছি। তবে এ কথাও সত্যি, মাঝে মাঝেই মনে হয় রাতের বেলা, কারা যেন লম্বা লম্বা পা দুলিয়ে বসে আমাকে দেখছে, আমি ঠিকমতো ঘুমাচ্ছি কি না। সাধে কি আম্মা বলেন, লক্ষ্য করেছো আমাদের ছেলেটা এখন খুব নিয়ম মেনে চলে। আব্বা মুচকি হেসে বলেন, হু, বটেই তো।