মা-শালিকের জন্য শোকগাথা

HOQশালিক পাখিটা দুটো বাচ্চা দিয়েছে।
বাবলাগাছের পাতার নিচে, ডালের জোড়ে, খড়কুটো এনে কত কষ্ট করে মা পাখিটা যে বাসা বানাল। ঠোঁটে করে করে কুড়িয়ে আনল একটা করে খড়। একটা করে শুকনো পাতা। একটা করে শুকনো ভাঙা সরু ডাল। নারকেলের ছোবড়া।
পেটভরা ডিম। মা-শালিকের নড়তে কষ্ট হয়। চড়তে কষ্ট হয়। তবু তাকে নড়তে হয়। তবু তাকে চড়তে হয়। তবু তাকে উড়তে হয়। বাসা বানাতে হয়।
বাসা বানানো হয়ে গেলে মা-শালিক দূর থেকে সেই বাসাটার দিকে তাকায়। বাহ্। খুব সুন্দর। বাবা-শালিকটাও তখন তার পাশে এসে বসে। বাহ্, তোমার বাসাটা বড় সুন্দর হয়েছে বউ।
মা-শালিকটার রাগ হয়। এতক্ষণ সে কত কষ্ট করছিল, বাবা-শালিকের দেখাই ছিল না। আর এখন সে এসেছে মিষ্টি মিষ্টি কথা নিয়ে।
যাও। তোমার কথা কে শোনে? মাথা ঝাপটায় মা-শালিক।
বাবা-শালিক বলে, রাগ কোরো না, রাগ কোরো না, আমি তোমার জন্য কুড়িয়ে কুড়িয়ে কী এনেছি দেখো। বাবা-শালিক তার ডান পায়ের নখগুলো মেলে ধরে। কতগুলো পোকা।
এই পোকা মা-শালিকটার বড় প্রিয়। সে রাগ ভুলে যায়। বাবা-শালিক বউয়ের ঠোঁটে তুলে দেয় ধরে আনা পোকাগুলো।
তারপর বলে, তোমার বানানো বাসাটা সত্যি সুন্দর হয়েছে।
মা-শালিক ক্লান্ত স্বরে খুশি ফুটিয়ে তুলে বলে, সত্যি সুন্দর হয়েছে!
হুঁ। খুব সুন্দর।
মা-শালিক ডিম পাড়ে। দুটো ডিম। একটু নীলচে সাদা ডিম।
তারপর সে বসে তা দিতে। তার পালকগুলো ফুলে ফুলে ওঠে। রাজ্যের ওম এসে ভর করে তার শরীরে। সেই ওম সে একটু একটু করে সঞ্চারিত করে ডিম দুটোয়।
বাবা-শালিক তখন আবারও বেরোয় বাইরে। বউয়ের জন্য খাদ্য জোগাড় করতে।
পিঁপড়ের ডিম আনে।
ছোট ছোট পোকা আনে।
আর আনে শস্যকণা।
মা-শালিক নিজের বাসায় ডিমের ওপরে বসে খাবার খায়। বাবা-শালিক তাকে ঠোঁটে তুলে তুলে খাওয়ায়। মা-শালিকের বড় ভালো লাগে।
বাবা-শালিক ঘরের বাইরে বসে থাকে। কেউ যেন না আসে এই বাসার আশপাশে।
কাক এসে ডিম খেয়ে ফেলতে পারে। আসতে পারে বনবিড়াল। দুষ্টু ছেলের দলও হামলা করতে পারে।
ঝড়বৃষ্টি যেন না হয়।
তারপর একদিন ডিমের খোলস ভেঙে মাথা বের করে দুটো ছানা।
যেটা আগে বেরোয়, তার নাম ওরা দেয় বড়ছা। যেটা পরে বেরোয় তার নাম ওরা দেয় ছোটছা।
বাবা–শালিক খুশিতে গান গাইতে থাকে।
আমার ঘরে এখন দুটো ছানা
তাদের আছে দুটো করে ডানা।
আমার ঘরে আসতে তোদের মানা।
ছানা দুটো খাচ্ছে এখন খানা।
ছানা দুটোকে মা-শালিক ঠোঁটে করে খাবার খাওয়ায়।
মুখের ভেতর বাছাদের খাবার ঢুকিয়ে দিতে হয়।
একটু একটু করে বড় হতে থাকে বড়ছা। একটু একটু করে বড় হতে থাকে ছোটছা।
মা-শালিক তাদের কথা বলতে শেখায়। তারা চিঁচিঁ করে গান করে।
আমরা হলাম শালিক পাখি,
বাবলাগাছের ডালে থাকি।
ছানা দুটোর পা শক্ত হতে থাকে। ডানা শক্ত হতে থাকে। আরেকটু বড় হলেই তারা উড়তে শিখবে।
এরই মধ্যে বাবা-শালিক উড়ে চলে যায় দূর দেশে। কত দিন আর বাসার সামনে বসে বসে থাকা যায়।
মা-শালিক তো আর বাছাদের ছাড়তে পারে না। এখনো ওরা ভালো করে হাঁটতে শেখেনি। ওদের ডানায় জোর হয়নি। ওরা যে উড়তে শেখেনি।
মা-শালিক বাইরে যায়। খাদ্য কুড়োয়। তারপর সেই খাবার নিয়ে আসে। ছানা দুটোকে খাওয়ায়।
তাদের আস্তে আস্তে উড়তে শেখাতে হবে।
তাই তাদের আজ বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
বড়ছা বলে, ছোটু, আজ কিন্তু আমরা বাইরে যাব।
ছোটছা বলে, কী মজা। আমরা আজ বাইরে যাব।
বড়ছা বলে, ছোটু, আজ আমরা উড়তে শিখব।
ছোটছা বলে, বড়ু, আজ কী মজাই না হবে। আজ আমরা উড়তে শিখব।
দুই ছানার কত যে কথা। তাদের মনে কত-না খুশি।
মা ও মা, আমরা কখন বাইরে যাব। মা ও মা, আমরা কখন উড়তে শিখব।
মা বলেন, এই তো বাছা। আরেকটু পরে। রোদটা একটু উঠুক। বাতাসটা একটু কমুক। তারপর।
বড়ছাকে দুপায়ে ধরে মা-পাখি নিয়ে যায় গাছের নিচে, মাটিতে।
ছোটছা মাথা বাড়িয়ে দেখে। বড়ু তো আকাশ দেখে ফেলল। বাতাসে ভর করে একটা উড়াল দিয়ে ফেলল।
কখন আসবে তার পালা?
বড় ছানাটাকে মাটিতে রেখে মা পাখি উড়ে আসে গাছের ডালে, তার বাসায়। ছোটটাকেও ধরে নিয়ে চলে যায় মাটিতে।
দুই ছানা এখন একটু একটু করে উড়তে শিখুক। খানিকক্ষণ হাঁটলে পা দুটো শক্ত হবে। ডানা দুটো মেলে ধরে ওরা নাড়ুক। ডানা শক্ত হবে।
মা মা, আমি হাঁটতে পারছি। বড়ছা চিৎকার করে ওঠে।
বাহ্। খুব ভালো।
মা মা আমিও হাঁটতে পারছি। ছোটছাও চিৎকার করে হাসতে হাসতে বলে।
মা-পাখি পাখাতালি দিয়ে ফেলে।
এই সময় একটা কাক আসে কোত্থেকে।
আকাশে এক চক্কর দিয়ে বড়ছাটার দিকে ছোঁ মারতে দেয় এক উড়াল।
মা-শালিকের চোখ পড়ে যায় সেদিকে। তার বুক ওঠে কেঁপে।
সে ছুটে যায় বড়ছার দিকে। এক লহমায় বড়ছাকে তুলে নিয়ে সরে যায় আরেক দিকে।
তাকে বুকের নিচে আগলে রাখে।
কাকের প্রথম আক্রমণটা নিষ্ফল হয়। তখন সে নিশানা করে ছোটছাকে।
মা-শালিক সে মতলবও বুঝে ফেলে।
বড়টাকে এক পায়ে ধরে ছোটটাকে আরেক পায়ে তুলে নিয়ে আসে খানিকটা দূরে। সেখানে একটা ভাঙা হাঁড়ির নিচে দুটো ছানাকে রেখে দেয় মা-শালিক।
তারপর বাইরে এসে পাহারা দেয়। দেখি কে মারতে আসে আমার ছানা দুটোকে।
কাকটা তো ছাড়ার পাত্র নয়। এই শালিকটা তো বড় ফাজিল। আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়।
দাঁড়া আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন। কা-কা করে সে চিৎকার করে ওঠে।
বড়ছা ভয়েই জড়সড়।
ছোটছা চিঁচিঁ করে কাঁদে। মা তুমি পালাও। তোমাকে মেরে ফেলবে।
মা বলে, বাছারে, তোদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। আমি এই দাঁড়িয়ে আছি হাঁড়ির মুখে।
কাকটা আসে। ভীষণ তেড়ে।
মা-শালিকের মুখে ডান পায়ের নখর বসায়। বঁা পায়ের নখর দিয়ে খামচে ধরে মা-শালিকের পিঠ।
তারপর ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাতে থাকে মা-শালিকের ঘাড়।
ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়।
বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে ওঠে মা-শালিক।
ছোটছা বলে, বড়ু, মাকে তো ওই কাকটা মেরে ফেলল।
বড়ছা বলে, হায় হায়, মার শরীর থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।
তারা দুজনে ভয়ে সেটিয়ে যায়। তারা থরথর করে কাঁপে। তারা চোখ বন্ধ করে স্রষ্টাকে ডাকে। হে প্রভু, আমাদের মাকে তুমি বাঁচাও। আমাদের মাকে তুমি রক্ষা করো।
কাকটা মা-শালিকের মাথাটা আলাদা করে ফেলে ধড় থেকে। তখন ওই ছিন্ন কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে, ছোটছা, বড়ছা, আমি চললাম। তোরা ভালো থাকিস।
মায়ের নিথর শরীর পড়ে থাকে মাটিতে। তার ছিন্ন মস্তকটাও পড়ে আছে একটু দূরে। সেই মাথায় দুটো চোখ। হলুদ ঠোঁটের একটু ওপরে চোখ দুটো তখনো খোলা।
কাকটা চলে যায়।
বড়ছা তাকিয়ে থাকে মায়ের রক্তাক্ত শরীরের দিকে।
ছোটছা তাকিয়ে থাকে মায়ের ছিন্নভিন্ন শরীরের দিকে।
তাদের রক্ত হিম হয়ে আসে। তাদের এতটুকুন বুক থরথরিয়ে কাঁপে। তারা কাঁদে।
তারা বলে, প্রভু, আমরা এখন কোথায় যাব? প্রভু। আমাদের মাকে কেন হত্যা করা হলো? প্রভু, আমাদের মাকে ফিরিয়ে দাও।
তাদের সেই করুণ রোদনে কাঁদতে থাকে গাছের পাতাও। কাঁদতে থাকে ওই গাছতলার সব পাখি পতঙ্গ প্রাণীরা।
কিন্তু সবার কান্নাও ওই মৃত মা-শালিকের নিথর শরীরটাকে একটুখানি নড়াতে পারে না।
পাখি পতঙ্গ প্রাণীরা বলাবলি করে, এই ছানা দুটোর এখন কী হবে।
আর ছানা দুটো কিছুই বলে না। তারা ভয়ে, শোকে স্তব্ধবাক হয়ে যায়। যতবার মনে পড়ে সেই কথাটা, মায়ের মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে মা বলছিল, ছোটছা ভালো থাকিস, বড়ছা ভালো থাকিস, ততবার তারা বেদনায় নীল হয়ে যায়।
(প্রিয় পাঠক, আপনাদের কি একটুখানি বেদনা হচ্ছে এই মা-শালিকের জন্য? স্কুলগামী শিশুর হাত ধরে থাকা মানুষ-মায়ের জন্যও নিশ্চয়ই আপনাদের শোক হয়ে থাকে।)

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আনিসুল হক- র আরো পোষ্ট দেখুন