কেরানিও দৌড়ে ছিল

১৩
রুহিতন, নাকি মদিনা; সেই বউ আর এই বউ; কে তার কাছে বেশি সত্য_ কেরানি এ প্রশ্ন নিয়ে খুব যে ভাবে, তা নয়। প্রশ্নটা হঠাৎ একেকবার মনের মধ্যে নদীর শুশুকের মতো ভুস করে উঠেই তলিয়ে যায়। তবে এ রকম ঝুলে থাকাটাও কাজের কথা নয়। দেশের বাড়িতে এক বউ, শহরে আরেক বউ, মীমাংসা একটা করে ফেলতেই হয়। কেরানি ভাবে। হ্যাঁ, জীবনে সে কখনও কোনো বিষয় নিয়ে ভাবেনি। জোয়ারের হাতে নিজের জীবনকে ছেড়ে দিয়ে এতদূর সে এসেছে। নদীর পানিতে চর আছে, চরের মুখে নৌকাকে থমকে যেতেই হয়। কোনদিকে বাঁক নিলে চলাটা সুসার হবে, নির্ণয় করে নিতে হয়। জীবনপ্রবাহেও এমন চর দেখা দেয়। কেরানি তার জীবনে এই প্রথম চরের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে পড়ে।
কী তার কর্তব্য? সিদ্ধান্ত হঠাৎ করেই তার মনে একদিন এসে যায়। কিংবা হঠাৎ নয়। সে কথাটাই তবে হোক। রাত তখন অনেক। আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই লঞ্চ বরিশাল ঘাটে পেঁৗছবে। চারদিকে নদী কালো কুট্টিম। আকাশেও তারা নেই। মেঘ গুরুগুরু করছে। নিজের কোণে বসে ঝিমোচ্ছিল কেরানি। মেঘের একটা গুরু ডাকে তার চটকা ভেঙে যায়। উঠে পড়ে সে ভাবে, একবার টহল দেওয়া যাক ডেকে।
যাত্রীরা সবাই ঘুমে। একপাশে জনা চারেক বসে তাস পিটছে এই শেষ রাতেও। বোধহয় পয়সা বাজি রেখে খেলা, তাই এত রাতেও তাস! কেরানি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই খেলোয়াড় একজন বলে, বিষ্টি নামবে মনে হয়।
এ কথার কোনো মানেমুণ্ডু নাই। মেঘ ডাকছে, বিষ্টি তো হতেই পারে! বিশেষ করে বলার কী আছে? কেরানিও হাই তুলে বলে, নাহ্, বিষ্টির দেরি আছে। তার আগেই ঘাট পাব।
খেলোয়াড়টি তখন তাস পিটতে পিটতে কেরানিকে এক সংবাদ দেয়।
কেরানি সাব, উইদিকে এক মাতারি তখন থিকা কানতাছে। সেই লঞ্চে উঠছে থিকা কানতাছে। কানতেই আছে। খিনখিন খিনখিন। ব্রিক্ত কইরা মারলো।
কেরানি পা বাড়ায়। তার কৌতূহল হয়। কে কাঁদে? কেন কাঁদে? আবার সন্ত্রস্তও হয় সে। লঞ্চে কোনো একটা ভেজাল ঘটনা না হয়ে দাঁড়ায়! দেখাই যাক। হাঁটতে হাঁটতে সে অকুস্থলে পেঁৗছায়। হ্যাঁ, সত্যি! কাঁদছে! এক নারী মাথা-মুখ পুরোপুরি ঘোমটায় ঢেকে বসে আছে, আর সেই টোপের ভেতর থেকে কান্নার খিনখিন শব্দ ভেসে আসছে। নারীটির বয়স নির্ণর্য় করবার উপায় নাই, কারণ আগাগোড়াই সে শাড়িতে লেপ্টানো। তার পাশে কিশোর একটি ছেলে সজাগ হয়ে বসে আছে। কিশোরকালে ঘুমের বড় দাবি। তা সত্ত্বেও কিশোরটি ঘুম যায় নাই।
কেরানি কিশোরটিকেই জিগ্যেস করে, এই, কী? কী হইছে? ব্যাপার কী? কান্দে ক্যান? কে হয় তুমার?
মোর বইন।
তোমার বোন?
কান্দে ক্যান? আরে, কইবা তো? শুনলাম সন্ধ্যাকাল থিকা কানতাছে!
এই জিজ্ঞাসাবাদে নারীটি কান্না থামায়। এমনকি তাকে কৌতূহলীও করে। নারী মুখের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল সরায়। চেহারার আধখানা প্রকাশিত করে সে তাকায়। কেরানির গলায় অবাক অস্টম্ফুট স্বর ফোটে। এমন সুন্দরী নারী সচরাচর চোখে পড়ে না। কী চোখ! কীবা টকটকে গোলাপি ফর্সা রঙ! থুতনিতে ছোট্ট একটা ভাঁজ। এতে আরও রমণীয় হয়ে উঠছে মুখখানা। মুখ দেখে বয়সটাও এবার অনুমান করা যায়। খুব বেশি হলে তিরিশের ওপরে হবে না!
কেরানি এতক্ষণ ধমকের সুরেই জেরা করছিল। নারীর এমন রূপ দেখে তার কণ্ঠে মধু ঝরে পড়ে। সম্বোধনেও সম্মানের গতিক আসে। সে বলে, আপনি কান্দেন কেন? কী হয়েছে আপনার?
নারী এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত মুখ ঢেকে ফেলে শাড়ির আঁচলে। আর সেই সঙ্গে নতুন তোড়ে কান্নার শব্দ ওঠে তার। ব্যাপার দেখে কেরানি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিশোরটির দিকে সে নীরব জিজ্ঞাসায় ভ্রূ তোলে। কিশোরটি তখন উঠে দাঁড়ায়। এবং কেরানিকে বলে, দুলাভাই তারে তালাক দিছে।
তালাক! বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে ওঠে কেরানির মনের মধ্যে। আকাশেও মেঘ গর্জন করে ওঠে। তালাক! শব্দটা অজানা নয় তার, কিন্তু এর অর্থটা কখনও তার বোধে ধরা পড়ে নাই। শব্দটা শোনামাত্র এখন তার কানে ঝনঝন করে বাজতেই থাকে। তালাক! তালাক!
শেষরাতের আঁধারে বরিশালে লঞ্চ ভেড়ে। আবার রাতের বেলা ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। কেরানির মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করে। ওই যে ওই যাত্রী নারীটি, যুবতী, অনিন্দ্যসুন্দরী_ রূপও তবে কিছু নয়? এত রূপও স্বামীকে তার ধরে রাখতে পারে নাই! তালাক দিয়েছে! এখন ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
কিন্তু ওই যে কাঁদছে! কেন কাঁদছে? তবে কি নারীটির কোনো দোষ ছিল না? তাই সে কাঁদছে। বিনা দোষে তালাক! কিন্তু এ নিয়ে আর অধিক ভাবে না কেরানি। ততক্ষণে তার মনের মধ্যে কথাটা উঠেই পড়েছে যে, তার নিজের জীবনে সমাধানের পথই হচ্ছে_ তালাক!
কিন্তু কাকে? রুহিতনকে, না মদিনাকে? প্রশ্নটা কেরানির মনে আদৌ ওঠে নাই। রুহিতনের সঙ্গেই সংসারের সব স্বাদ পেয়েছে সে; মদিনার সঙ্গে নয়। কেরানি বড়বুবুকে চিঠি লেখে। সে চিঠির সারকথা এই_ আমার জীবন লইয়া আপনারা ছিনিমিনি খেলিয়াছেন। সেই খেলার অবসান ঘটাইতে চাই। মদিনাকে তালাক দিবার বিষয়ে মন শক্ত করিয়াছি। ইহাতে উভয়ের মঙ্গল।
চিঠিটা পাওয়ামাত্র হস্তিবাড়িতে হুলস্থূল পড়ে যায়। পরিবারের ভেতরে একেকজনের একেকরকম প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ মদিনার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। কেউ ভাবে, কেরানি এরপর দেশের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না। টাকা-পয়সা পাঠাবে কি পাঠাবে না। বড়বুবু কেরানিকে চিঠির পর চিঠি লেখে, মোবাইল ধার করে ফোন করে। তাকে সে বোঝায়_ না ভাই, দোহাই লাগে, এমন করিও না। আর কাহারো কথা বলি না, অবলা নারী মদিনার কথা অন্তত একবার ভাবিয়া দেখিও। তাহার কী দোষ?
কেরানি এসব কানেই তোলে না। তালাক সে দেবেই। কিন্তু ইচ্ছা এক, আর কাজে পরিণত করা আরেক। তালাক দেওয়ার জন্য কার কাছে সে যাবে? কে তাকে সাহায্য করবে? তাছাড়া বিষয়টা তো জটিল। ঢাকায় সবাই জানে রুহিতনই তার বৌ। মদিনাও যে আরেক বৌ_ কেউ জানে না। তালাক দেওয়াটা তাই গোপনে সারতে হবে। অবশেষে একদিন সে সদরঘাটের বিসমিল্লাহ হোটেলের মালিক নিজামত মিয়ার কাছে সমুদয় খুলে বলে।
সেদিন হরতাল ছিল। সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। বরিশাল থেকে ফিরে রুহিতনকে ফোন করে দিয়েছিল, আজ আর বাসায় ফিরবে না, লঞ্চেই থাকবে। সন্ধ্যায় লঞ্চ নিয়ে আবার যাত্রা করবে। হরতালের জন্য নিজামত মিয়ার হোটেলে নাশতার ভিড় অন্যদিনের চেয়ে বেশি। যাত্রীরা সব আটকে পড়েছে। কিন্তু একসময় তারাও যখন পায়ে পায়ে গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে যায়, তখন গোটা সদরঘাট অস্বাভাবিক রকম নির্জন ও থমথমে হয়ে পড়ে। কেরানিরও মনের মধ্যে মদিনা আর তাকে তালাক দেওয়া নিয়ে জটিলতা ভূত হয়ে দেখা দেয়। লঞ্চের দোতলায় সে থম মেরে বসে থাকে। হঠাৎ দেখে নিজামত মিয়া। তার পাশেই।
আইলাম, সারেং সাবের সাথে গপসপ কইরা নাইমা যাইতাছি। দেখলাম আপনে চুপ কইরা বইসা আছেন। সেদিন আপনেরে বড় অস্থির দেখছিলাম। বাড়ির খবর সব ভালা তো?
কথার শুরু সেই থেকে। কেরানি বলে, বড়ভাই, আমি এক বিপদে পড়ছি। আপনি আমার বড়ভাই। তবে তার আগে কেরানি নিজামত মিয়ার কাছ থেকে কসম আদায় করে নেয়, এই কথা জীবনে আপনি প্রকাশ করবেন না। এই কথা প্রকাশ হলে রুহিতন আমারে কাইটা ফেলবে! আপনি ছাড়া দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। আমাকে বাঁচান।
বাঁচানের মালিক আল্লাহ। বিষয়টা কী?
চলেন তবে ফাঁকে যাই।
ফাঁকে মানে কেরানি নিজামত মিয়াকে নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে এসে নদীর পাড় ধরে।
চলেন একটা নৌকা ধরি।
নৌকা?
পানির ওপরে নিরালা পাব। চারদিকে মানুষের কান। আমার কথাটা বড় গোপন।
একটা কেরায়া নাও ভাড়া করে নিজামত মিয়া আর কেরানি বুড়িগঙ্গার বুকে যাত্রা করে। মাঝিকে নিজামত বলে, মিয়া, লাহরে লাহরে বায়া যাও। খানিক ঘুরুম ফিরুম।
পানির বুকে ছোট ছোট ঢেউ। কেরানির বুকে আছাড়-বিছাড়। পানির বুকে তলতল ধারা। কেরানির বুকে খলখল সর্বনাশা বান। কেরানি মদিনার কথা বলতে শুরু করে।
সব শুনে নদীর বুকে কেরায়া নৌকায় হতভম্ব হয়ে বসে থাকে নিজামত। নৌকার মাঝি অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীন নৌকা বাইতে বাইতে ক্লান্ত হয়ে বলে, হেইপার যাইবেন নি?
ধন্দ ভেঙে নিজামত মিয়া দার্শনিক কণ্ঠে বলে, হেইপার? হ, হেইপারই তো যাওন লাগবো, ভাই। এইপার আর হেইপার_ ভালাই কইছো মিয়া! হেইপার যাইতে পারে কয়জন?_ তারপর কেরানিকে বলে, যা করছেন যা হইছে, অহন বাঁচনের একটাই রাস্তা যা আপনে লইছেন_ তালাক!
নিজামতের কথায় ধড়ে প্রাণ ফিরে পায় কেরানি। অতঃপর নিজামতই সব ব্যবস্থা করে দেয়।
কেরানি মদিনাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের সাহস নাই যে, এরপর আমরা হস্তিবাড়ি যাই কি মদিনার সমুখে দাঁড়াই। তালাকের কাগজ পাওয়ার পর মদিনার কী হয়, তা দেখার মতো পাষাণ এখনও আমরা হতে পারি নাই। দোষী বা নির্দোষ, নারী যখন তালাকের পত্র পায়, তিন তালাক যখন উচ্চারিত হয়, তখন কান্নার স্রোত বয়ে যায়। কারণ অধিকাংশ নারীর বিবাহ ভিন্ন জীবন নাই, বিশেষ করে মদিনার মতো নারীর।
বড়বুবুর ফোন আসে। তার নিজের ফোন নাই। চেয়ারম্যানের ছেলের ফোন ধার করে সে ভাইকে ফোন করে।
এ তুই কী করলি, ভাই?
কেরানি কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
আবার ফোন আসে।
মদিনার কথা একবারও তুই ভাবি না দেখিলি রে?
কেরানি এবারও ফোন কেটে দেয়।
দুইদিন পরে আবার যখন ফোন আসে, কেরানি আর ধরে না।
অবশেষে মদিনার চিঠি আসে।
অবাগির আর বাছিয়া থাকিবার ইছ্যা নাই। গলায় কলোসি বান্ধিয়া নদীর পানিতে ডুব দিব। নদীর বুকেও পানি নাই। সমুদয় খরা। যেই দিকে চায়া দেখি ঝামার মতো সকলে পুড়ি অংগার হয়া গেছে। আমার দোষ কিবা জানিলাম না। পতি বিন্ন নারীর গতি নাই। পতি সার করিয়া আমার গতি কী হইলো?
চিঠিখানা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে কেরানি। তালাক দেওয়ার পর তার বুক থেকে পাষাণ নেমে গেছে। রুহিতনের বুকে সে এখন দুগ্ধ পান করে প্রফুল্ল সতেজ। রুহিতনকে নিয়ে সে ছুটির দিনে এখন শহর বেড়াতে বেরোয়। হাইকোর্টের মাজারে যায়। আহসান মঞ্জিলে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়। একদিন বুলবুল মিয়ার ঘোড়ার গাড়িতেও রুহিতনকে নিয়ে ওঠে। প্রথমে একটু ইতস্তত লাগছিল কেরানির। বুলবুল মিয়া বলে, আরে, অ্যাতো মানুষ নিয়া সওর করি, মাইয়া দামাদরে লিয়া যামু, শরম কিয়ের!
রাতে কেরানির কাছে আদরের আধিক্য পেয়ে রুহিতন একদিন বলে, মিয়া, আপনে দেহি ঝাণ্ডা উড়ায়া দিছেন?
ঝাণ্ডা? অবাক হয়ে যায় কেরানি।
হ, পেয়ারের ঝাণ্ডা! এমুন সোহাগ আপনে কুনোদিন করেন নাই।
আরে, পাগলি! বৌরে সোহাগ করবো না তো রাস্তার মাতারি ধইরা চুমা খাবো?
দিন যায়, দিন যায়, দিন যায়। কিন্তু ওই যে পাগলি আর মাতারি কথা দুটো কী কুক্ষণেই মুখ থেকে তার বেরিয়েছিল, এবার কাহিনীর গতি আমরা দেখব সেই দিকেই ফেরে। অকস্মাৎ ফেরে!
আমরা কি ভুলে গিয়েছি সদরঘাটের সেই পাগলির কথা। আমরা তার গর্ভ উঁচু পেট দেখেছি। পাগলি সেই সন্তান প্রসব করে একদিন। সাড়া পড়ে যায় সদরঘাটে। পাগলি সন্তান প্রসব করে সাগর নীল-৩ লঞ্চেরই নিচের পাটাতনে এক ঘুপচিতে।
আরে, পাগলির পোলা হইছে!
পোলা হইছে তো হইছে, এই লঞ্চে ক্যান?
আর ক্যান? লঞ্চের মানুষই তো এর প্যাট বাধাইছে!
লঞ্চের মানুষ?
আর ক্যাঠা!
পাগলিকে টেনেহিঁচড়ে লঞ্চ থেকে নামানো যায় না। সারেং সুখানি বড় কেরানি কুলি সবাই হিমশিম খেয়ে যায়। না, পাগলি নামবে না। রক্তে ভাসা পাটাতন আঁকড়ে পড়ে থাকে পাগলি। কোলে তার সন্তান। চোখ বুজে বাসি ফুলের মতো লাল টকটকে পড়ে আছে পাগলির কোলে। কেউ তার দিকে এক পা এগোলেই তার স্বরে চিৎকার করে উঠছে, হেই! হেই! আমার পোলা! আমার পোলা!
ভোরে লঞ্চ ঘাটে ভেড়ার পর আমাদের কেরানি নিত্যদিনের মতো বাসায় চলে গিয়েছিল। বিকেল সাড়ে ৩টায় সে এসে পাগলিকে পায় পাটাতনে। সেও বড় আতান্তরে পড়ে যায়। এ কী কাণ্ড! তারই লঞ্চে ঘটনা! সেও পাগলিকে সরাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর সকলের সঙ্গে। কিন্তু ব্যর্থ হয় সেও। পাগলিকে নড়ায় সে সাধ্য তারও নেই। পাগলি বরং কেরানিকে দেখে খিনখিন করে বলে, আইছো! দ্যাহো পোলাটা সোন্দর হইছে না!
চারদিকে ভিড়ের ভেতরে তখন একটা গুঞ্জন ওঠে।
আরে, পাগলি যে এত চিল্লাইতেছিল, কেরানিরে দেইখা এমুন মিঠা বোল্!
বড় কেরানি তখন গম্ভীর গলায় বলে, মিঠা বোল্ তো হইবোই। হে তারে তেহারি মেহারি নিত্য খাওয়াইছে না!
আমাদের কেরানি রুখে উঠে বলে, কিয়ের তেহারি মেহারি? একদিনই তো! পাও জড়ায়া ধরছিল, দিছি।
আমাদের মনে পড়বে, এক ভোরে, মদিনার প্রথম চিঠি পাবার পর কেরানি যখন নিজামত মিয়ার হোটেলে বসেছিল চিঠিটা পড়বার জন্যে, পড়তে পড়তে যখন তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল, তখন নিজামত মিয়া তার কাছে এসে বসেছিল, তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। বলেছিল বাড়ির খারাপ খবরের জন্যে মন খারাপ করতে নেই। নিজামত মিয়া সেদিন তার কাছ থেকে নাশতার পয়সা তো নেয়ই নাই, বরং রুহিতনের জন্যে তেহারি প্যাকেট করে দিয়েছিল। সেই প্যাকেট শেষ পর্যন্ত পাগলিকে দেয় কেরানি। কারণ পাগলি তার পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, খিদা!
কিন্তু মাত্র একদিনই তো! বড় কেরানি এখন বলছে, নিত্য!
কেরানি সমূহ বিপদ অনুভব করে ওঠে। আবারও সে চেঁচিয়ে বলে, আপনি এটা কী বলেন! আমি একদিনই তাকে দিছি!
বড় কেরানি তখন চোখ ফিরিয়ে ঠাণ্ডা গলায় জনতার উদ্দেশে বলে, একদিন কি মেলা দিন, বুইঝা দ্যাখেন আপনেরা।
খবর পেয়ে লঞ্চ কোম্পানির মালিক আহমদউল্লাহ জরুরি এসে হাজির হয়। ব্যাপার দেখে তারও চক্ষু চড়কগাছ। কিছুক্ষণ থম ধরে থেকে আর কাউকে নয়, কেরানিকেই সে প্রশ্ন করে, হইলো কেমতে?
কেরানি কী উত্তর দেবে? কেরানি অনুভব করে, সবার চোখ তারই দিকে। তার পিঠ দিয়ে বুড়িগঙ্গার তল থেকে শীতল পানি উঠে এসে ধারায় বয়ে যেতে থাকে। নির্নিমেষে সে তাকিয়ে থাকে পাগলির দিকে। পাগলির কোলে সদ্যোজাত শিশুটির দিকে। জগৎ তার দৃষ্টি থেকে মুছে যায়। তার ভেতরে বিস্ময় জাগে। পথের এক পাগলি, কার কারণে সে গর্ভবতী কে জানে! শিশুটি কী সুন্দর, যেন এক ফেরেশতার জন্ম দিয়েছে। চোখ বুজে আছে শিশুটি। যেন এই শিশু জগতের কোনো মন্দ তার নবীন চোখে দেখতে নারাজ। তাই সে চোখ বুজে আছে।
আহমদউল্লাহ বলে, একদিষ্টে দ্যাখো কী!_ দুম করে বলে বসে, এই সন্তান কি তোমার?
আমূল চমকে ওঠে আমাদের কেরানি।
মালিক আবার প্রশ্ন করে, তোমার কীর্তি? তোমার সন্তান?
না!!
তবে?
আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না।
সুখানি তখন ফিসফিস করে মালিকের কানে মন্তব্য ঢালে, গলায় তার এত ঝংকার? বোঝেন তবে, অ্যাতো ধামাল করি পরতিবাদ যখন করে তখন ওরই এ কাম!
ততক্ষণে যাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। লঞ্চ তৈরি হয়ে আছে যাত্রার জন্যে। কুলিরা পাইকারি মালের বড় বড় বস্তা, বাক্স লঞ্চে তুলতে শুরু করে দিয়েছে।
আহমদউল্লাহ আর সময় নষ্ট করে না। চোখের পলকে কষে একটা লাথি বসায় কেরানিকে। কেরানি ছিটকে পড়ে পাটাতনে। তখন দ্বিতীয় আর একটা লাথি ঝাড়ে আহমদউল্লাহ।
শালার শালা। হারামজাদা। কুত্তার জাত।
কেরানি হতচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকে। তার বিস্ময় কাটে না। তার মনে হতে থাকে_ না, এসব তার জীবনে ঘটছে না। না, সে নয়, অন্য কেউ অভিযুক্ত হচ্ছে পাগলিকে গর্ভবতী করবার জন্যে। সে শুধু তামাশাটা দেখছে।
আহমদউল্লাহর নির্দেশে বলবান দু’জন কুলি পাগলিকে কোলপাঁজা করে পাটাতন থেকে তুলে পাড়ে ধপ করে ফেলে রেখে আসে। তারপর আহমদউল্লাহরই নীরব নির্দেশে কুলিরা এবার কেরানিকেও চ্যাংদোলা করে ওঠায়। তারা নীরব ভাষায় জানতে চায়, এবার একে কোথায় রেখে আসার হুকুম?
আহমদউল্লাহর মুখে এবার ভাষা ফোটে।
ফ্যাল, ওই পাগলির পাশে ফালায়া দে।
কেরানি যেন ঘোরের ভেতরে শুনতে পায় কথাটা। তার এখনও মনে হয়_ না, এসব তার জীবনে ঘটছে না। অতএব সে প্রতিবাদ করে না। হাত-পা নড়ে না তার। সে চ্যাংদোলায় বাহিত হতে থাকে। তারপর সেও ধপ করে পাগলির পাশে গিয়ে পড়ে।
নদীর পাড় এখানে কাদায় আবিল। এখানে স্তূপাকার ও ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত ডাব-নারকোলের খোসা, খালি বোতল, চানাচুর, বিস্কুটের খালি প্যাকেট, মুরগির পা ঝুঁটি পালক। তারই ভেতরে পাগলি। তখনও শিশুটি তার বুকে। পাগলি আঁকড়ে ধরে আছে। তার পাশে কেরানির দেহ এসে পড়তেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
কিন্তু কেঁদে ওঠে শিশুটি।
শিশুর কান্না আর তার মায়ের হাসিতে রণিত হয়ে ওঠে চারদিক।
কেরানি উঠে বসে। লাথির দাপটে তার শরীর কনকন করে ওঠে। তবু সে ওঠে। উঠে চারদিকে তাকায়। পাড়ে ওই মানুষের ভিড়। ঘাটে ওই তার লঞ্চ। সাগর নীল-৩। যাত্রার জন্য প্রস্তুত। ওই বেজে উঠল লঞ্চের ভোঁ। ওই ঘুরছে প্রপেলার। ওই পানি মথিত হয়ে উঠছে। সাগর নীল-৩ ওই একটু একটু করে নড়ে উঠছে। ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। এবার সমুখের দিকে গলুই ফেরাবে। সমুখে জলরাশি। সমুখে গন্তব্য।
কেরানি উঠে বসে শিশুটির দিকে তাকায়। শিশুটি একবার চোখ খুলে যেন তাকে দেখে। তারপরই আবার চোখ বোজে। পাগলি বুকের বোতাম খুলে শিশুটির মুখে স্তন গুঁজে দেয়।
কেরানি ধপ করে আবার শুয়ে পড়ে পাড়ের কাদায়। তার তৃষ্ণা বোধ হয়। আহ্, কেউ যদি তার ঠোঁটে এখন এক আঁজলা পানি ঢেলে দিত! তার ঠোঁট নড়ে ওঠে। জিভ দিয়ে সে নিজের ঠোঁট চাটে। লঞ্চের ভোঁ বেজে ওঠে আবার। এখন আর ফেরা নাই। এখন শুধু সমুখের দিকে।
[চলবে]