অভিমানী আঙুল আমার

সহস্র অভিমানী জীবন আমাদের। হাজারো পরিচয় আর সম্পর্কের বেড়াজালে বেড়াতে বেড়াতে ভুল হয়ে যায়। কিছু ভুল থেকে যায় মনের আড়ালে। অনেক না পাওয়া, অনেক ভুল বোঝাবুঝি আর অনেক আকাঙ্ক্ষার মৃত্যুতে সেসব সম্পর্কগুলো অভিমানের জন্ম দেয়। আমরা অভিমানী হয়ে যাই হাজারো নিয়মে। কখনও কখনও অনিয়মেও। পৃথিবীর কোনো সূত্র, কোনো মনোবিজ্ঞান দ্বারাই হয়তো সে অভিমানের আঙুল ছুঁতে পারি না।
একদিন মৃত্যুর প্রতি অভিমান ছিল।
মানুষ কেন মরে যাবে! জীবনের লেনদেন চুকাতে গিয়ে অভিমানের খেয়ায় চেপে, মৃত্যুর প্রতি অভিমানও একদিন জন্মের দীর্ঘতর অভিমানের কাছে হার মেনে যায়। অভিমান নিয়ে কেউ কেউ দূরে চলে যায়। নিকট আপন কেউ অন্তরের গভীর দেয়ালে টোকা মেরে জীবনের ওপারে চলে যায় জলজ্যান্ত অভিমান পাশে ফেলে। এ অভিমান আমার জীবনের সব অভিমানকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। তবুও অভিমান থেকে নিস্তার নেই।
মাঈন উদ্দীন। কৈশোরে একমাত্র বন্ধু আমার। দারুণ এক প্রতিভাবান বালক_ কী এক নিদারুণ অভিমানে চৌদ্দ বছর বয়সেই আত্মহত্যা করে। জীবনের অভিমান থেকে নিষ্কৃতি পেতে মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরে মানুষ কী সহজে! অভিমান থেকে থেকে আমাদের সাহসীও করে তোলে। আমরা আপনের দেওয়া কষ্টে, অভিমানে জীবনের কাছে পর হয়ে যাই কেউ কেউ। কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াই। সকলেই মনের ভেতরে নিজ নিজ অভিমান নিয়ে দিনাতিপাত করে; আবার অনেকে ভুলতেও পারে।
কিছু কিছু অভিমান থাকে প্রকাশ না করা পর্যন্ত তা পূর্ণতা পায় না। কিছু অভিমান গহিন অন্তরালে চলে যায়; প্রকাশের ধার ধারে না। অভিমান আমাদের কখনও কখনও অস্থির করে তোলে। ভরপুর অস্থিরতায় আর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় কেউ। কেউ কেউ চিরতরে চুপ হয়ে যায়।
এ জীবনে অভিমান ছিল তোমার প্রতি। আমার প্রতি হাজারো অভিমান জমা হয়ে আছে তোমার ও তোমাদের। সব অভিমানে নিজেই নিজের প্রতি চূড়ান্ত অভিমানী হয়ে গেছি কোন ফাঁকে, জানা নেই। কিছুটা অভিমান ছিল কবিতার প্রতি। আরাধ্য শব্দের অপ্রাপ্তিতে কতবার কত রাতে অভিমানী থেকেছি। শব্দহীন বিষণ্ন অভিমানে আমার দিনগুলো বুঁদ হয়ে থেকেছে।
মনে হয়েছে_ কী দুঃসহ এই শব্দহীন রাত! এর প্রতিটি মুহূর্তে আমি দগ্ধ হতে থাকি। রাত্রি ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে চললে আমার দম আটকে আসতে থাকে। চিৎকার করে চারপাশের ঘুমকাতর নগরকে জানাতে ইচ্ছে জাগে : তিলে-তিলে দগ্ধ হচ্ছি, হে নিষ্ঠুর নগর, দ্যাখো, এক গোপন আগুনে জ্বলে-পুড়ে আমি ছাই হয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি ম্যানশনের বন্ধ দরজা ভেঙে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হয় : হে নর, হে নারী, দ্যাখো একটা মানুষের ঘুম নেই, রাত্রি কেড়ে নিয়েছে নিদ্রা তার_ আর, তোমরা কী মজা লুটছো! একটি মানুষ তার কণ্ঠমণি সাঁড়াশির মতো হাতে চেপে ধরছে, বেদনায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, একটা ভোঁতা ছুরিতে তার সবজি-আত্মাকে দ্বিখণ্ডিত করছে, ট্রাক-চাপা পড়া কুকুরের মতো থেঁতলে যাচ্ছে; অথচ তোমরা, হে নারী, হে নর, স্বার্থপর নিষ্ঠুরতায় তাকে উপেক্ষা করছো।
অভিমান নিয়েই আমি বেরিয়ে পড়েছি অনাত্মীয় রাস্তায়। কোনো কোনো দিন চাঁদের ওপর অভিমান হয়েছে খুব কোনো ঘোর অমাবস্যা রাতে। আবার অন্ধকারকে নির্বিবাদে ভালোও বেসেছি। কেননা আমার সর্বগ্রাসী অভিমানের ঘড়ির কাঁটাগুলোকে একমাত্র আশ্রয় দিয়েছে, দেয় এই অন্ধকার। আর কেউ তো খুলে রাখেনি এমন নিঃস্বার্থ দুয়ার।
অন্ধকার, আমাকে আগলে রেখেছে। আমার মতো অনেককেই আগলে রাখে। সব অভিমানীদের ডেকে ডেকে সে, নিঃশব্দে তুলে রাখে নিজস্ব বুকে। আর আমরা কিছুক্ষণ ভুলে থাকি মায়া। ডুবে থাকি মদিরায়। ডুবে ডুবে অভিমান ভুলে যেতে চাই।
তবু অভিমান ছাড়ে না। অভিমানে অভিমানে বেলা চলে যায়।
এ যেন বেদনার প্রতিবেশী। দুঃখের কক্ষবাসী কালো মেঘ। মনকে আঁধার করে রাখে।
নিজের প্রতিও কিছু অভিমান ছিল। আমার প্রতিও ছিল নিকট অথবা দূরের কারও। নিতান্ত নির্ভুলভাবে কোনো কাজ করতে পারিনি। দিন চলে গেছে। পানশালার মুহূর্তগুলো বেড়ে গেছে।
ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে কতবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে, অভিমানী মন নিয়ে ফিরে এসেছি। খালি হাতে ব্যথিতচিত্তে ফিরে এসেছিলাম।
চারদিকে অবিরল আলোকিত স্রোত বয়ে যায় দেখেও_ আমি একাকী নিমজ্জিত থাকি অন্ধকারে। কোন অভিমানে, কোন সেই ভুলের মাসুলে।
একদিন বলেছিলাম, তোমাদের স্বার্থে দীর্ঘদিন অন্ধকারে রেখে দাও। তবুও সামান্য আলোর কণা যদি দেখে ফেলি_ মানবিক পরিপাশর্ে্ব সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এতসব অভিমানের ভারে অনেকের জীবন থমকে যেতে চায়। আসলে থামে না। জীবন তো অভিমানের পরোয়া করে না। শুধু নীরবে নিভৃতে অভিমান, জীবনকে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। কেউ কেউ খাঁটি হয়_ অনেকেই অধিক হারায়।
অনেক সময় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে পুরনো শৈশবে, পুরনো নামে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা-মার দেয় বৈশিষ্ট্যবিহীন সেই নামে খুব সাধারণভাবে সুখী হওয়া যেত। অভিমানের পাল শেষ হয়ে হেসে উঠতো শরতের নির্মেঘ আকাশ। দুঃখ পেলেও তা হতো খুবই নগণ্য, ক্ষণস্থায়ী।
অথচ বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ফেলে নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে, কী করে যে কবে বেছে নিলাম দুঃখময় এই উদ্বিগ্ন জীবন। কী করে কখন যেন অসামান্য তৃষ্ণা জেগে গেল মনে ও শরীরে। আমি শব্দবন্দি হয়ে গেলাম। এক সময় শব্দ শব্দ চতুর্দিকে শব্দ কেবল।
তাই মাঝে মধ্যে এখনও আমারই কবিতার মতো বলতে ইচ্ছা করে_

হে আমার পরিপার্শ্ব, আজ থেকে আবার আমাকে
বাবা-মা’র দেয়া নামে ফিরে যাবার সুযোগ দাও না…
খুব ভালো হয় সেটা, নির্ভার আনন্দে পুনর্বার
‘জীবন’টা শুরু করা যায়!
বাবা-মা আমাকে জীবন বলেই ডাকত। বাবা-মায়ের সে জীবন অভিমান পেরিয়ে পেরিয়ে আজ বড় বেশি মৃত্যুর নিকটাত্মীয় হয়ে গেছি।

এখন আমার হাত
আর কিছুই ধারণ করতে পারছে না,
বদ্ধ অঞ্জলি থেকে গড়িয়ে প’ড়ে যায় পানীয় জল_
আমার তৃষ্ণা মেটে না;

এখন আমার এই হাত
আর কিছু ধারণ করতে পারছে না,
অবশ আঙুল থেকে ঝ’রে যায় ডটপেন,
শুকনো শাদা খর্খরে কাগজেরা শুধু
মুখ ব্যাদান ক’রে জেগে থাকে;

এখন আমার হাত
আর কিছুই ধারণ করতে পারছে না,
এই হাত শিশুর চিবুক স্পর্শ করতে আজ অপারগ,
ফিরে আসে ব্যর্থ হাত!

এখন আমার হাত
আর কিছুই ধারণ করতে পারছে না_
এই হাতে হয়তো আর কোনো গোলাপ ফুটবে না।

আমার আঙুলগুলো জীবনের আদিম ভারে অভিমানী থেকে যায়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রফিক আজাদ- র আরো পোষ্ট দেখুন