কেরানিও দৌড়ে ছিল

test
১২
আমাদেরও চোখ ভিজে আসার কথা। স্বামী পত্র পেয়েছে স্ত্রীর। প্রথম লেখা পত্র। নারী বিরহ কাতর। কোন পাষাণের না হৃদয় গলে যাবে। আরও যদি স্মরণ করি, এ সমাজে আমাদের অধিকাংশ নারীর স্বামী ছাড়া গতি নাই। স্বামী কেরানি যে বিয়ের পর বধূটির দেহস্পর্শ পর্যন্ত করে নাই, ভালো করে কথা বলে নাই, বিদায়কালে বলে আসে নাই, তাতে কী! সড়কে নামার আগে স্বামী ওই যে একবার ফিরে তাকিয়েছিল, সেই ছবিটি স্ত্রী ভোলে নাই। মাসাবধি অপেক্ষা করেছে সে, স্বামী খোঁজ নেয় নাই। মানি অর্ডারের ফরমে এক লাইনও তার জন্যে লেখে নাই। তখন হয়তো বড় ননদের পরামর্শেই স্ত্রী এই পত্র লেখে। পত্রের খামের ওপরে ননদের হাতে ঠিকানা লেখা দেখেই তা বোঝা যায়।
তবে, পত্রের ভাষা যে স্ত্রীর নিজস্ব নয়, এমনকি বড় ননদেরও মুসাবিদা নয়, তা পাঠ থেকেই পরিষ্কার হয়। চরণদাসী বইয়ের কথা। স্বামী বিরহে চক্ষু অন্ধ হয়ে যাওয়াটাও বই-ভাষা। বাজারে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমপত্র নামে বই পাওয়া যায়। কেরানির কাছে যে পত্রটি মদিনা লিখেছে, তা সেই বই থেকে নিশ্চয় নেওয়া। নইলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কোনোমতে গুঁতিয়ে পড়া মেয়ের কলমে এমন ভাষা ফোটা অসম্ভব। এমনকি পত্রের কাগজে আতর মাখানোর বুদ্ধিটাও বই থেকে ধার করা। বকুল ফুল পত্রের ভাঁজে পাঠানো, এটিও বইয়ের পরামর্শেই_ সময়ের কোনো সুগন্ধ ফুল শিলের নিচে কয়েকদিন চাপিয়া চ্যাপটা করিবেন, তারপর শুকানো ফুল পত্রের ভাঁজে রাখিবেন, ইহাতে স্বামী বুঝিবেন আপনি তাহাকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন। মদিনাও তাই করেছে। মোল্লাবাড়ির বকুলতলা থেকে বকুল কুড়িয়ে এনেছে। তবে পত্রের একেবারে শেষভাগে যে সে লিখেছে_ ষামনের মাশে বারি আসিবেন অবাগি প্রাণ বাছিবে না_ এটা বইয়ের নকল নয়, মদিনার নিজের কথা। তার বানানের অজস্র ভুল দেখে হেসে উঠবো, এমন পাষাণ আমরা নই।
পাষাণ আমাদের কেরানিও নয়। বানানের ভুল ছাপিয়ে সে মদিনাকে প্রত্যক্ষ করে ওঠে। মদিনা, তার স্ত্রী। এই স্ত্রীকে এতদিন তার মনে পড়ে নাই। রুহিতনের মতো শহুরে খর যুবতী স্ত্রীর উচ্ছল সোহাগে সুভোগে সে ভেসে গিয়েছিলো, যাচ্ছিলো_ যেন মেঘনার মতো নদীর তুমুল ঢেউয়ে। হঠাৎ বাধা পায় সে তরঙ্গস্রোত_ মদিনার চিঠিতে। রাতের অন্ধকারে বরিশালগামী লঞ্চ যেন চরে আটকে যায়। লঞ্চের সারেং যেন চোরা চরের মুখে সাবধানী বিকনবাতিটির লালচক্ষু লক্ষ করে নাই।
নিজামতের রেস্টুরেন্টে কেরানি নাশতা সমুখে বসে থাকে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা পানির ধারা যেন বহে যায়। নিজামত তাড়া দেয়।
আরে, নাশতা যে ঠাণ্ডা হয়া যায়। কী হইলো? খান।
কেরানি পরোটা ছেঁড়ে। মুখে তোলে।
ভাবীসাবের লাইগা কী দিমু?
দ্যান।
তেহারি দেই। আর ভুনা ডিম লগে। কী কন?
দ্যান।
কোনোরকমে আধখানা পরোটা মুরগির লটপটির সাথে খেয়ে ওঠে কেরানি। তারপর কাউন্টারে গিয়ে পয়সা দেয়।
থাউক না। থাউক। বহুৎ রোজ বাদে নাশতা করলেন। পয়সা না-ই দিলেন।
কেরানি জোর করে না।
নিজামত বলে, বাড়ির খবর লিয়া চিন্তা কইরেন না। সংসার থাকলেই উলোটপালোট আছে। ঝামিলা ছাড়া দুনিয়া নাই!
ঝামেলাই বটে। দেশে এক বৌ, টাউনে এক বৌ। কিন্তু এ কথা এখানে কেউ জানে না। কাউকে বলাও যায় না। কেরানির একবার মনে হয় নিজামতমিয়াকে সব খুলে বললে হয়তো একটা পরামর্শ তার কাছে পাওয়া যেতে পারতো। কিন্তু পরক্ষণেই এ চিন্তা মন থেকে সে মুছে ফেলে।
রেস্টুরেন্ট থেকে রুহিতনের জন্যে তেহারির প্যাকেট নিয়ে বাসার দিকে রওনা হবার মুখে কেরানির হঠাৎ মনে হয়, পকেটে তার মদিনার চিঠি। পকেটে থাকা বিপজ্জনক। রুহিতনের হাতে পড়তে পারে। ছিঁড়ে ফেলবে? না। কথাটা ভাবতেই তার বুকের ভেতরে টনটন করে ওঠে। তাহলে? চিঠিটা নিয়ে এখন তবে সে কী করে?
তার চেয়ে চিঠিটা লঞ্চে তার নিজের ড্রয়ারে রেখে আসা ভালো। আরেকবার সে পড়বে। রাতে যখন লঞ্চ চলবে বরিশালের দিকে অন্ধকার নদীর বুকে, যাত্রীরা সব ঘুমে, তখন সে আবার পড়বে। হ্যাঁ, লঞ্চেই রেখে আসা যাক। কেরানি লঞ্চের দিকে ফেরে।
লঞ্চ এখন যাত্রী নামিয়ে পেছনে সরে গেছে। ঘাটের মুখে এখন অন্য লঞ্চ। তিন-তিনটে লঞ্চের ওপর দিয়ে কেরানিকে এখন যেতে হবে তার নিজের লঞ্চ সাগর নীল ৩-এ। কেরানি টপকে টপকে চলে। তারপর নিজের লঞ্চে নিজের ড্রয়ারে চিঠিখানা রেখে সে পাড়ের দিকে ফেরে। ঘাটের পাটাতনে পা রাখতেই দেখে পথজুড়ে বসে আছে সেই পাগলি। পা ছড়িয়ে, উঁচু পেট উদাম খুলে বসে আছে পাগলিটা। কেরানির মর্মমূল পর্যন্ত চমকে ওঠে। আগেও সে দেখেছে, কিন্তু তার মনে হয় নাই, এখন তার চোখে পড়ে, পাগলি গর্ভবতী!
ঘাটের পাগলি গর্ভবতী? হ্যাঁ, তাই তো। কোনো সন্দেহ নাই। আরো সে লক্ষ করে, পাগলি আর সেই পাগলি নাই। অশান্ত খিলখিল হাসি নাই। মুখে অশ্লীল বাক্য নাই। শান্ত হয়ে বসে আছে। কেরানি তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো, পাগলি তার পা জড়িয়ে ধরে।
খাওন দে!
আরে রে, পা ছাড়।
খিদা!
কেরানি তিলমাত্র দেরি করে না। রুহিতনের জন্যে আনা তেহারির প্যাকেটটা সে পাগলির কোলের ওপর ফেলে দিয়ে পালায়। প্রায় দৌড়ে সে সদরঘাটের রাস্তার ওপরে ওঠে। সে লক্ষ করে নাই বড় কেরানিকে। তারই লঞ্চের বড় কেরানি নিজামতের রেস্টুরেন্টের সমুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাদের কেরানিকে সে ডাক দেয়।
কী মিয়া, পাগলিরে কী দিলা?
হকচকিয়ে যায় কেরানি। আমতা আমতা করে।
বড় কেরানি তখন ঈষৎ হেসে অদ্ভুত ছলছলে গলায় বলে, দিছো, দিছো, ভালা কাম করছো। তার লাইগা এতো আতুরবাতুর ক্যাল্লা?
আমাদের কেরানি না ওই আতুরবাতুরের অর্থ বোঝে, না বড় কেরানির মুখের হাসিটা পছন্দ করে। সে টপ করে একটা রিকশায় উঠে বসে।
লঞ্চ থেকে বাসায় সে পায়ে হেঁটেই যায়, আজ রিকশা নেওয়াটা তোড়ের মুখে। রিকশা কিছুদূর গেলে কেরানি ফিরে তাকায় একবার। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলো তাই। বড় কেরানি তাকিয়ে আছে তারই দিকে। কেন তাকিয়ে আছে? ব্যাপারটা তাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। না, আমাদের কেরানির স্বভাবে নাই উদ্বিগ্ন হওয়া, কিন্তু আজ সে হয়। আজ সকালের সবটা তালগোল পাকিয়ে তার কাছে মহা উদ্বেগের হয়ে ওঠে। প্রথম, মদিনার চিঠি। দ্বিতীয়, পাগলি। তৃতীয়, তেহারির প্যাকেট পাগলিকে। চতুর্থ, বড় কেরানির দেখে ফেলা। পঞ্চম, তার নিজেরই হঠাৎ রিকশায় উঠে পড়া। কেরানির গা শীতল হয়ে আসে।
বাসায় ফিরে দরোজাতেই রুহিতনের মুখে পড়ে।
আইলা?
রুহিতন কেরানির কাঁধ থেকে ব্যাগটা নেয়। প্রতিদিনই নেয়। আজ কেরানির মনে হয় রুহিতনের নেওয়াটা যেন টান মেরে। কেরানি একটিও কথা না বলে ঘরে যায়। ঘরে গিয়ে সোজা শুয়ে পড়ে বিছানায়।
এমনটা তার নিত্য নয়। নিত্য সে সদরঘাট থেকে ঘরে এসে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। রুহিতন গেলাশে করে চা এনে ধরে। রুহিতন নিজেও নেয়। ধপ করে স্বামীর পাশে বসে। দুজনে গল্পগাছা করে। রুহিতনের শরম-ভরম নাই। উঠানের ওপারে মা আছে কি বাবা আছে, পরোয়া নাই। স্বামীর সঙ্গে কলকলিয়ে কথা বলে। লঞ্চে নিত্যই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে যাত্রীদের নিয়ে, কেরানিও তা সবিস্তারে বলে।
কিন্তু আজ সেসব কিচ্ছু না। দু’হাতে দুটি চায়ের গেলাশ এনে রুহিতন দরোজার মুখে ছবি হয়ে দাঁড়ায়। দ্যাখে, কেরানি বিছানায়।
কী হইলো?
শরীর ভালো নাই।
চায়ের গেলাশ তড়িঘড়ি নামিয়ে রুহিতন কেরানির কপালে বুকে ছটফটে হাত রাখে।
কই, না! গাও তো গরম না!
কী জানি। ভালো লাগতেছে না।
রুহিতন স্বামীর গা ঘেঁষে বসে পড়ে। কেরানির ভেতরটা ছলকে ওঠে। এ রকম তার কখনো হয় নাই। পাশে রুহিতন, কিন্তু তার মদিনার কথা মনে পড়ে।
চা খাইবা? না লয়া যামু?
নিয়া যাও।
কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে রুহিতন। তারপর ঝটাৎ করে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, আমি ওষুধের দুকানে যাই। ট্যাবলেট লয়া আহি। গাও গরম নাই, হইতে কতক্ষণ! বিকালে আবার ডিউটি আছে।
বিকালে ডিউটি তো ভারী লক্ষ রুহিতনের! দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রুহিতনের বিছানায় আসা চাই। শরীরের ক্ষুধা মেটানো চাই। সপ্তাহে তো সাতদিনের একদিন মাত্র রাতে পায় স্বামীকে, তাই বলে দিনের সময় বহে দিতে সে নারাজ। তার শরীরের ক্ষুধা অসীম।
কেরানি শঙ্কিত হয়ে একা ঘরে বিছানায় পড়ে থাকে। আজও রুহিতন দুয়ার বন্ধ করবে। তারপর তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নিত্য সে এরই অপেক্ষা করতো। রুহিতনের যদি আব্বা আম্মা আছে বলে শরম নাই, তবে কেরানিরও শরম কেটে গিয়েছিলো বিয়ের পরপরই। সেও মেতে উঠতো বৌকে নিয়ে। কিন্তু আজ কেরানির গতিক অন্যরকম।
মনে মনে একটা তুলনা আসে কেরানির মনে। মদিনা আর রুহিতন। রুহিতন চায় তাদের বাচ্চা হবে, সংসার ভরে উঠবে, তার জন্যে কেরানির প্রতিদিনের উপরি রোজগার সে ব্যাগ থেকে তুলে নিয়ে ব্যাংকে জমাচ্ছে। আর, মদিনা? চরণদাসী হয়ে থাকবার জন্যে পথ চেয়ে আছে। মদিনা ভালোবাসা চায়। রুহিতনও কি চায় না? কী জানি! শরীরের ক্ষুধাটাই যেন প্রবল তার। মদিনার শুধু হৃদয়! প্রাণ! ভাবতে ভাবতে কেরানি আর দিশে পায় না।
রুহিতন ঘরে আসে। পানির গেলাশ হাতে।
লও, টপ কইরা খায়া ফালো। তুমার কিচ্ছু হয় নাই।
তারপরই রুহিতন খিলখিল করে হেসে ওঠে।
কেরানি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
রুহিতন বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, পুরুষপোলার ওষুধ আমার জানা আছে।
কেরানির জামার বোতাম খুলতে থাকে রুহিতন।
আরে, করো কী!
আইজ তোমারে সোন্দর লাগতাছে!
বলে কী মেয়েটা! সুন্দর লাগছে! কেরানি দিশেহারা বোধ করে। সে ভেবেছিলো প্রতিদিনের মতো আজও রুহিতন প্রথমেই তার ব্যাগ থেকে টাকাপয়সা বের করে গুনবে, পাটপাট করে রাখবে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখবে। কিন্তু কই? আজ টাকার দিকে নজর নাই রুহিতনের। নজর স্বামীর দিকে। তাও এই সকাল দশটা-এগারোটায়।
কেরানি বলে, সরো! ভাল্ লাগতাছে না।
রুহিতন স্বামীর গালে চকাস করে একটা খেজা চুমো দিয়েই মাথা তুলে বলে, ভাল্ লাগতাছে না! পুরান হয়া গেলাম?
না, না।
তয়?
আম্মা আছে। সরো!
আমারে ঠেলা দিলা যে!
কই, না! শঙ্কিত গলায় কেরানি বলে।
দিছো! আইজ তুমার কী হইছে? নাশতা ভি চাইলা না!
নাশতা করে আসছি।
ক্যাঠা খাওয়াইলো? কুন দরদী তুমারে নাশতা করাইলো?
কেরানির মনে পড়ে যায় নিজামতমিয়া রুহিতনের জন্যে তেহারি দিয়েছিলো আর সেটা সে ঝোঁকের মাথায় পাগলিকে দিয়ে এসেছে। পাগলির গর্ভ উঁচু পেটটাও তার চোখের সমুখে ভেসে ওঠে।
কেরানি তখন উঠে বসে। না, এসবের কিছুই রুহিতনকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।
উঠে বসে কেরানি রুহিতনের গালে টিপ দিয়ে হেসে বলে, দরদী তোমার চেয়ে বেশি কে? আমি তোমারে নিয়ে সুখী। খুব সুখী!
রুহিতনও বুক সরিয়ে গালে আঙুল রেখে বলে ওঠে, ও মা! মা! কী কইলা! সুখী! আবার কও।
সুখী! সুখী! সুখী!
আমি ভি সুখী!
আমরা কি একবার থেমে দেখে নেবো দু’জনের মনের ছবি। তবে দেখে নিই। সুখী রুহিতন। মন থেকেই কথাটা বলেছে সে। কেরানিকে পেয়ে তার সুখের সীমা নাই। একদিন তো বাড়ি পালাতেও সে চেয়েছিলো কেরানির জন্যে। কিন্তু কেরানি? সে যে রুহিতনকে নিয়ে সুখী, কথাটা কি তার অন্তরের কথা? হয়তো এতকাল অন্তরের কথাই ছিলো, কিন্তু আজ আর তা বলা যাবে না। মদিনার চিঠি পাবার পর সব তছনছ হয়ে গেছে। যেন এতকাল একটা ঘোরের ভেতরে ছিলো, ঘোরটা কেটে যেতেই মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েছে।
বাস্তবতা এখন কেরানিকে তাড়িয়ে ফেরে। দিনের পর দিন। সেই তো এক রুটিন। সপ্তাহে ছ’দিন লঞ্চ নিয়ে বরিশাল যাওয়া, বরিশাল থেকে ফেরা। ভোরে ফিরে বাসায় আসা। বাসায় রুহিতনের সঙ্গে নাশতা করা। রুহিতন না খেয়ে তারই জন্যে বসে থাকে। নাশতার পর একটু বিশ্রাম, চোখ একটু ঘুম ভার-ভার, একটু খুনসুটি, একটু গল্পগাছা। তারপর কুয়ার পানি তুলে গোসল করা। খেয়েদেয়ে বিছানায় যাওয়া। পা টিপে এসে দরোজা বন্ধ করা রুহিতনের। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়া। শরীরের সুখ আলসে তারপর ঘুমিয়ে পড়া। ঠিক চারটের সময় রুহিতন তাকে জাগিয়ে দেয়। তখন আবার সদরঘাটের দিকে বেরিয়ে পড়া।
আবার সেই লঞ্চ। আবার সেই যাত্রীর কোলাহল। আবার সেই যাত্রা। সন্ধ্যা পার, তবু আকাশ লাল। নদীর পানি বেগুনি। এ নদী থেকে সে নদী। সার্চলাইট। বিকনবাতি। আকাশে লক্ষ তারা। কোনো কোনো রাতে পূর্ণিমা। কোনো কোনো রাত অমাবস্যার। জীবনও তাই। অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় জীবন। টলমল টলমল। নদীর বুকে ভাসতে ভাসতে চলা। লঞ্চের সাইরেনে ভোঁ শুনে যাত্রার ঘোর থেকে আছড়ে পড়া।
দেশ থেকে মদিনার চিঠির পর চিঠি। পত্রের পর পত্র। সেই প্রথম পত্রের পর প্রতি সপ্তাহে একখানা করে পত্র। হ্যাঁ, চিঠি নয়, পত্র! পত্রই! প্রবাসী স্বামীর কাছে স্ত্রীর পত্র। প্রথমদিকে স্বামী-স্ত্রীর আদর্শ প্রেমপত্র থেকে বয়ান তুলে দেওয়া। ক্রমে মদিনার পত্র হয়ে চিঠি। বই থেকে আর নয়, তার নিজের মন থেকে চিঠি। তাই এখন চিঠি। ভুল বানানে লেখা চিঠি। চিঠি আর চিঠি।
আপনার যন্যে মণ কান্দে।
অবাগি পথ চাহিয়া আছে কবে আশিবেন।
অবাগির আপুনি বিন্ন কেহ নাই।
গাছে জলপি ধরিয়াছে। আপনার জইন্যে আছাড় বানাইয়া রাখচি।
পাশান পরানে আমার কথা কি আপনার শরন হয় না?
অবাগিকে যুদি ভুলিয়া থাকেন তবে আর এ জীবনে বাছিবার আসা নাই।
মোললা বারির বকুলতলা আর যাই নাই। ফুলের সখ আর নাই। জীবনের ফুল শুখাইয়া গেইচে।
এই শেষ কথাটি_ জীবনের ফুল শুকিয়ে গেছে_ কেরানিকে কাঁদায়। হ্যাঁ, সে কাঁদে। বরিশালের পথে লঞ্চ যাত্রায় অন্ধকার ছলোছলো নদীকে মনে হয় তারই অশ্রু নিয়ে বহে চলেছে। না, এ কথা তবে সত্য নয় যে, কেরানির ধাতে নাই ভাবনাচিন্তা করা। আর দশজনের মতো তারও তবে ভাবিত একটা মন আছে। মানুষ বোধ হয় এভাবেই নিজের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায়।
মদিনার জন্যে কেরানির মন এখন কেমন করতে থাকে। অনবরত। অবিরাম। মদিনার কথা তার মনে পড়ে। মনে পড়ে। মনে পড়েই চলে। মুখখানা ভালো করে মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে। একটা অনুভব মাত্র। আর কিছু না। কোনো ছবি নয়।
ছবি! কেরানি খুব অবাক হয় যেদিন চিঠির ভেতরে মদিনার ফটো সে পায়। কী করে হস্তিবাড়ি যে এতদূর সেই দূর থেকে মদিনা বুঝে যায় যে তার মুখের স্মৃতি কেরানির মনের পটে নাই। কিংবা থাকলেও তা আবছায়া মাত্র।
নাকি মদিনা নিজে বোঝে নাই? এসবই কেরানির বড় বোন বড়বুবুর কাণ্ড বলে মনে হয়েছে। বুঝি বড়বুবুই একদিন মদিনাকে নিয়ে জলেশ্বরী গেছে ফটো তুলতে। চিঠির ভেতরে ফটো। মদিনা আর বড়বুবু দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে একটা রাজবাড়ির ছবি। নীল আকাশ। নীল দালান। শাদা সিঁড়ি। ময়ূর। ঝর্ণাধারা। বড়বুবুর হাতে বই। মদিনার হাতে ফুলের গোছা। ফটোর পেছনে স্টুডিওর সিলমোহর_ বকুল রঙীণ স্টুডিও। হ্যাঁ, ফটোটাও রঙীণ।
কেরানি এখন মাঝেমাঝেই ছবিটা বের করে দেখে। ছবিটা লঞ্চে তার ড্রয়ারে রাখা থাকে। মাঝরাতে যখন নদীর পানি কেটে লঞ্চ চলছে, নদীর বুকে তারারা ঝিলমিল করছে, তখন ছবিটা সে সন্তর্পণে বের করে আনে। আশেপাশে কেউ থাক বা না থাক, লুকিয়ে সে দেখে। দেখতে দেখতে তার মনের ভেতরে টান জাগে মদিনার জন্যে। একদিন ছবিতে মদিনার ওপর সে ঠোঁট রাখে। পরমুহূর্তেই ছবিটা সরিয়ে নেয়। পাশেই যে বড়বুবু! হোক ছবি, তবু তো বড় বোন! তার পাশে বৌকে চুমো খাওয়া! ছী!
একদিন ছবি থেকে বড়বুবুকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলে কেরানি। কাটবার পর একহাতে বড়বুবু আরেক হাতে মদিনাকে নিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। কেটে ফেলে দু’জনকে এভাবে আলাদা করে সে মনে ঠিক স্বস্তি পায় না। কাটা অংশের মদিনার দিকে চোখ ফিরিয়ে সে মনের মধ্যে দংশন অনুভব করে। রুহিতন তবে কে? রুহিতনের চেয়ে মদিনাই তবে সত্য তার কাছে?
কয়েকদিন পরে ছবির দুটি টুকরোই সে কুটিকুটি করে ছেঁড়ে। চলমান লঞ্চের ডেক থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নদীতে। ফটো তো কাগজ মাত্র। আর, কাগজ বড় হালকা। নদীতে ছুঁড়ে ফেললেও পানিতে তৎক্ষণাৎ ডুবে যায় না। ভাসতে থাকে। নদীর বুকে ছবির কুচিকুচি টুকরোগুলো ভাসে। ভাসতেই থাকে। কালো পানির বুকে যেন তারাফুল। লঞ্চ এগিয়ে চলে। কুচিগুলোও যেন পাশে পাশে চলে। তারপর একসময় পিছিয়ে পড়ে। আর দেখা যায় না।
[চলবে]