কেরানিও দৌড়ে ছিল


৭.
নান্না ভেবেছিলো, দুপুরের পাতে বসে গল্পগুজবে কথাটা ভুলে যাবে তার বন্ধু। কিন্তু না। ভাত খেয়ে ওঠার পরপরই নান্নাকে টেনে বাইরে আনে কেরানি। বাইরে মানে একেবারে বাড়ির বাইরে, সড়ক ছাড়িয়ে জংগলের দিকে। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে নান্নাকে কাঁধের ওপর খামচে ঘুরিয়ে ধরে কেরানি বলে, বলো এখন। হাকিমদ্দি কেন আসে নাই? ঘটনা কী?
কেরানির খপ্পর ছাড়িয়ে ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরায় নান্না। কেরানিকে বলে, খাও একখান? না এলাও ধরো নাই?
না, নেশার অভ্যাস নাই। ঘটনা বলো।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে নান্না হাতের সিগারেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ তুলে রহস্যময়ভাবে হাসতে থাকে। তারপর বলে, এই নিশা তো নিশা নয়। নারীর নিশাই বড় নিশা! আসল নিশা! সেই নিশায় যাকে পায় তার হুঁশজ্ঞান চলি যায়। ঘটনা তোমার মদিনাকে নিয়া!
কেরানি হতভম্ব হয়ে যায় নান্নার কথা শুনে। বিয়ের একটা দিনও পার হতে পারে নাই, এরই মধ্যে কী এমন ঘটনা তার সদ্যবিবাহিত বৌকে নিয়ে! কেরানির মাথার ভেতরে সব গোলমাল হয়ে যায়। মদিনা! ঘটনা! আজ সকালে হাকিমদ্দির না আসা! একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দিয়ে উঠতে পারে না। শুকনো গলায় সে বলে, বিষয়টা তবে কী? আমাকে খুলিয়া বলো।
হাকিমদ্দি মান্দারবাড়ি গেইছে।
কেন?
মকবুল মৃধার নাম মনে পড়ে?
কোন্ মকবুল মৃধা?
আরে, সেই যে তোমাকে বলিছিলোম একবার, মান্দারবাড়ির মকবুল মৃধা, হামার সাথে বর্ডারের কারবার করিতো।
কেরানির মনে পড়ে না। আজ তিন বছরের ওপর সে দেশছাড়া। প্রথমে রংপুর, তারপর পার্বতীপুর, মাঝখানে গফরগাঁয়ে, টঙ্গীতে; তারপরে ঢাকায়! দেশবাড়ির অনেক খবরই তার জানা নাই। আর অনেক জানা খবরও তার আর স্মরণে নাই। মানুষ যখন ছোট জায়গা থেকে ক্রমে বড় জায়গায় যায়, পেছনের অনেক কিছুই ভুলতে ভুলতে সে অগ্রসর হয়। আবার এমনও হয়, বড় জায়গার হৈহুল্লোড়, শান-শোভায় ছোট জায়গার কথা মানুষ আর মনে রাখতে চায় না।
মকবুল মৃধাকে মনে নাই দেখে নান্না তখন বিশদ করে বলে, মনে কি নাই, মকবুল মৃধা তোমার বাপের ওষুধ ইন্ডিয়া হতে আনি দিছিলো একবার?
হ্যাঁ, মনে আছে। মনে পড়েছে।
নান্না বলে, বর্ডারের কারবার করিতে করিতে মকবুল মৃধা ইন্ডিয়ার বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে। তারপর হতে তার আর কোনো সংবাদ নাই। ইন্ডিয়ার জেলে আছে বলিয়াই ধারণা।
কেরানির মনের মধ্যে আঁচড় কাটে তীক্ষষ্ট নখ_ তো সেই মকবুল মৃধার সঙ্গে মদিনার ঘটনার জোড় কোথায়?
বাঙালির এও এক ধরন আমাদের অজানা নাই। এক কথা বলতে গিয়ে চোদ্দ কথা উত্থাপন করে। কথার পর কথা বলতে বলতে এক অরণ্যই তারা রচনা করে বসে। তারপর সেই অরণ্য ভেদ করে আসল কথার দিকে যাত্রা শুরু হয়।
নান্না বলে, সেই মকবুল মৃধার বেটা মনির। বড় বাউণ্ডুলা, বড় দুর্ধরষো, হারামজাদার এক শ্যাষ ওই মনির। মান্দারবাড়ি গেইলে মনিরের তুমি সকল বিত্তান্তই জানিতে পাইরবে।
অধৈর্য হয়ে পড়ে কেরানি। বলে, এত ঘোরপ্যাঁচ না করে আসল কথাটা কও।
কেরানি মুখে বলে বটে, মনের মধ্যে তার মদিনার জন্যে ধুকধুক করতে থাকে। একেই বুঝি লোকে বলে_ টান! বৌয়ের জন্যে টান! একদিনও হয় নাই মদিনা তার বৌ। তবু তারই জন্যে মনের মধ্যে এত উথাল-পাথাল! কেরানি নিজেও তা লক্ষ করে ওঠে নাই।
লক্ষ করে নান্না। সে হেসে বলে, বৌ তোমার ঠিকে আছে। এত ব্যস্ত না হও। এ সকল কথা বলিতে টাইম লাগে। বিশেষ তোমার নত্তুন বৌ। ভাবিচিন্তি দিকদিশা ধরি কথা না বলিলে তুমিই বা কী বুঝিবে, আর কথাটা বলিয়া আমিই বা কোন্ ফ্যাকোরে পড়ি তারই বা কি ঠিক আছে! তবে তোমার ভালোর ঝইন্যেই হাকিমদ্দি মান্দারবাড়ি গেইছে আইজ ফজরে।
কেরানি নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে। মনিরের নানা বেচাল-কুচালের কথা বলে চলে নান্না। বলতে বলতে সেও পথ হারিয়ে ফেলে। আবার কথার খেই ধরে অগ্রসর হয়। অচিরে কথার অরণ্য ভেদ করে আলো দেখা দেয়।
মনির মাঝে মাঝেই হস্তিবাড়ি আসিতো। হেথায় তার মামার বাড়ি। বেড়াইতে আসিতো। কোন্ পাকে কখন যে মদিনার দিকে তার চোখ পড়ে জানা নাই। গরীব ঘরের বেটি তো মদিনা, কাঠ কুড়াইতে জংগলে যায়। বেশিদিনের কথা নয়, বছরখানেক হইবে। জংগলের মইধ্যে মনির উয়াকে পাকড়াও করে।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কাকে পাকড়াও করে মনির, তবু কেরানির মুখ থেকে প্রতিধ্বনির মতো প্রশ্ন ফসকে পড়ে, কাকে?
আর কাকে? মদিনাকে!
হৃৎপিণ্ড ধ্বকধ্বক করে ওঠে কেরানির।
তার বাদে পাছড়াপাছড়ি। প্রায় বিবস্ত্র করি ফালাইছিলো, ইয়ার মইধ্যে আল্লার কী কাম দ্যাখো_ হাকিমদ্দি আসি যায়!
কেরানির কণ্ঠে আবার প্রতিধ্বনি_ হাকিমদ্দি?
হয়, হয়, তোমার দোস্তো হাকিমদ্দি।
তার বাদে?
কেরানির মনের মধ্যে ঝড় বয়। মদিনার ইজ্জত কি লুণ্ঠিত হয়? মাত্রই গতকাল যাকে সে কলমা পড়ে বিয়ে করেছে, সেই নারী তবে অন্যের ভোগে গিয়েছিলো? হাকিমদ্দি হঠাৎ এসে মদিনাকে বিবস্ত্র করতে দেখে কি বাধা দিয়েছিলো? না, মনিরকে সাহায্য করেছিলো পুরো বিবস্ত্র করতে? তারপর তারা দু’জনেই কি মদিনাকে ভোগ করেছিলো জংগলের মধ্যে?
কেরানি প্রশ্ন করে বসে, মদিনাকে নষ্ট করে মনির?
মাথা নাড়ে নান্না।
কেরানি দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, হাকিমদ্দি?
নান্না তিরস্কার করে ওঠে, পাগল হইছো? দোস্তোকে সন্দেহ করো। সে যদি নষ্ট করিতো তবে সে তোমার বিয়াতে আসিতো?
সেটাও তো একটা কথা! কেরানি চিৎকার করে ওঠে, তবে? হাকিম কেন আজ মান্দারবাড়ি যায়?
মনিরের সাথে দেখা করিতে।
মনিরের সাথে? কেন? কী জন্যে?
শাসন করিতে।
শাসন করিতে?
মনিরকে শাসন করিতে। তুমি সমুদয় না শুনিয়াই চিল্লাইলে!
বলো তবে সমুদয়।
কেরানি শান্ত করে নিজেকে। ধৈর্য ধরে। সড়কের ওপর রাস্তার মাইল লেখা ফলক। সেই ফলকের ওপর হাত রেখে সে শরীরের টলমলানি সামলায়। নান্না ইতিহাস বলে চলে।
ইতিহাস তো এই_ বাজার থেকে বিলপাড়ে যাবার পথ সংক্ষেপ করবার জন্যে হাকিমদ্দি জংগলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ তার কানে পশে চিৎকার-চেঁচামেচি। নারীকণ্ঠের। সে থমকে দাঁড়ায়। কোথায়? কোনদিক থেকে? নির্ণয় করে ওঠার আগেই হাকিমদ্দির সমুখে ছুটে এসে আছড়ে পড়ে এক যুবতী। মদিনা! না, মদিনাকে চিনতো না হাকিমদ্দি। গাঁয়ের এক গরীব বাড়ির কন্যাকে চেনার কোনো কারণ নাই তার।
বাঁচান গো! বাঁচান!
কন্যার আধেক শাড়ি তার অঙ্গে নাই, ব্লাউজ ছিঁড়ে ঝুলঝুল করছে, বেরিয়ে পড়েছে স্তন। হাকিমদ্দি আহ্ করে উঠে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর বুনো দাঁতালের মতো ডাক ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনিরের ওপর। পেটাতে পেটাতে তাকে আধমরা করে ফেলে।
শালার শালা জারুয়া কোনঠেকার? মায়ের গব্বে জন্ম হয় নাই তোর? বল্ তুই কাঁই? কোন্্ বাড়ি? কার ব্যাটা তুই? হস্তিবাড়িতে আগে তো তোকে দ্যাঁখো নাই।
ক্রমে জানা যায় বর্ডারে চোরাচালানকারীদের একজন_ মান্দারবাড়ির মকবুল মৃধা, তারই ছেলে এই মনির, হস্তিবাড়িতে মামার কাছে বেড়াতে এসেছে।
শালার শালা, এতবড় তোর সাহস! ভিন গাঁও হতে আসিয়া হামার ঘরের ইজ্জতনাশ!
আমরা কি একটু থেমে এখন ভেবে দেখবো, মানুষ কী বলতে কী বলে বসে। ওই যে মনিরকে পেটাতে পেটাতে হাকিমদ্দি বলেছে, ভিন গ্রাম থেকে এসে এ গ্রামের মেয়ের ওপর চড়াও হয়েছো!_ যদি সে এ গ্রামেরই হতো, তাতে কি অপরাধটা লঘু বলে বিবেচিত হতো? যাক সে কথা!
ঘটনা অতঃপর এই দাঁড়ায়, মনিরকে এনে চেয়ারম্যানের বাড়িতে তোলা হয়। সেখানে তার বিচার হয়। বিচারে তাকে আচ্ছা করে জুতাপেটা করা হয়। তারপর গলায় ছেঁড়া জুতার মালা পরিয়ে মনিরকে হাঁটিয়ে হস্তিবাড়ি থেকে মান্দারবাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
ক্যান বাহে, গলায় কেসে জুতার মালা?
আর ক্যানে? পুছ করেন তাকে!
পথে যে যেখানেই এ প্রশ্ন করেছে, সেখানেই মনিরকে থেমে নিজমুখে বয়ান করতে হয়েছে কী সে করেছিলো।
এই শাস্তি আর অপমান ভোলে নাই মনির। মদিনার বিয়ের সংবাদ তার কানে যায়। প্রতিশোধ নেবার সুযোগ দেখে সে। সে ঠিক করে, হস্তিবাড়ি এসে মদিনার স্বামীকে বলবে, তুমি যাকে বৌ বলে ঘরে তুলেছো, আমিই তার কুসুম ভাঙি প্রথমে! মনিরের মতলবটা গতরাতেই হাকিমদ্দি জানতে পারে। ভোরেই সে মান্দারবাড়ি রওনা হয়ে যায় মনিরকে শাসন করতে।
তাহলে বৃত্তান্ত হচ্ছে এই। নান্না বলে, দরকার হইলে মনিরকেও ইন্ডিয়ার বিএসএফের হাতে তুলি দিবার বন্দোবস্ত হামরাই করমো। যাউক শালা ইন্ডিয়া যায়া জ্যালের ভাত খাউক।
শরীর অবশ হয়ে আসে কেরানির। মনিরের কী শাস্তিবিধান করবে হাকিমদ্দি_ কেরানির তাতে মন নাই। সে আসল কথা জানতে চায়। যেন আসল কথা নান্না তাকে এখনো বলে নাই। ঘটনা কি কেবল তার কাপড় ধরে টানাটানিতেই শেষ? কাপড় টানার মুখেই হাকিমদ্দি এসে পড়েছিলো? নাকি মদিনাকে বিবস্ত্র করে তার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেছিলো মনির? আর সেই ইজ্জতনাশের পরেই কি হাকিমদ্দি এসে পড়ে নাই?
কেরানির সন্দেহ হয়, ইজ্জতনাশ পুরোটাই হয়। বন্ধুর প্রতি দয়াবশতই কেবল নান্না সে কথা প্রকাশ করে নাই। মাইলফলকের ওপর দু’হাত ফেলে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কেরানি। মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন নিশ্চল হয়ে থাকে সে, একটা শালিক পর্যন্ত নির্বিঘ্নে তার পা বরাবর এসে মাটি থেকে বীজ খুঁটে খায়, মানুষটাকে ভয় পায় না।
ভীত হয়ে নান্না বলে, কী হইলো দোস্তো? ভয় না করো। মনিরের সাইধ্য নাই তোমার কি ভাবীজানের ক্ষতি করে।
ভাবীজান! সম্বোধনটা বোলতার মতো গুঞ্জন করে ওঠে কেরানির কানে। মদিনা আর নয়, নান্নার কাছে মদিনা এখন ভাবীজান! হঠাৎ এই সম্মান প্রদর্শনের কারণ? এতক্ষণ তো মদিনাকে মদিনা বলেই উল্লেখ করছিলো নান্না। এখন কেন মুখে তার ভাবীজান? তবে কি মদিনার ইজ্জত মনির সেদিন সত্যি সত্যি সর্বাংশে লুটেছিলো! আর সেই কঠিন সত্যকে রঙিন কাগজে মুড়িয়ে গোপন করবার জন্যেই ভাবীজান বলে তাকে এখন উল্লেখ করা?
মাতালের মতো টলতে টলতে কেরানি বাড়ি ফেরে। বড়বুবু আবার তাকে তিরস্কার করে ওঠে, তোর আক্কেলখানা কী! ফজরে উঠিয়া উধাও। ফির দুফরে খায়াদায়া বন্ধুকে নিয়া সেই যে গেলু, এই সানঝের কালে আসা হইলো!
মোর কিছু মনোতে না খায়!
দেশের বুলি ছেলের মুখে শুনে আজমতউল্লাহ্ বড় খুশি হয়। বলে, হামার কাছে আয়। বসিয়া একনা দুকনা গপ্প কর। জাহাজ কোনোদিন মুঁই দ্যাখো নাই। জাহাজের কথা ক্যাবল তোর মুখেই শুনিছোঁ। জাহাজকে বলে লঞ্চ কয়? লঞ্চে একবার চড়িতে ইচ্ছা করে। হাঁরে, একবার গেইলাম হয় ঢাকা। চিকিচ্ছাও করিতাম শূলবেদনার, লঞ্চেও উঠিনু হয়। নদীর নাম বুঝি বুড়িগঙ্গা? হামার হেথায় আধকোশার চায়াও বড় নদী কি বুড়িগঙ্গা?
কেরানি দাওয়া ছেড়ে পেছনবাড়িতে যায়। অনেকক্ষণ ধরে নির্জনে বসে থাকে টাট্টিঘরে। তারপর হাত ধুয়ে বদনা নামিয়ে রাখতেই দেখে একটা ভেঙটি সাপ। সবুজ হিলহিলে। বিষ নাই। ছোটবেলায় কত ধরেছে! লেজ ধরে মাথার ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টপ্ করে ছুড়ে দিয়েছে দূরে। সাপটা কোমরভাঙা হয়ে থুপ করে পড়েছে। চলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারে নাই। একদিন দু’দিন পরে গিয়ে দেখেছে মরে পড়ে আছে সাপটা, আর তার চারদিকে পিঁপড়ের সার। সময়ে সাপও হয় পিঁপড়ের খাদ্য।
আজ সাপটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে কেরানি। সবুজ একটা শরীর। জীবন্ত একটা শরীর। কিন্তু তার নিজের শরীরে কোনো সাড় নাই। সে কি বেঁচে আছে? সে কি একটা মানুষ? তার কি যৌবন আসে নাই? গতরাতে বাসরেও সে জাগরণ পায় নাই। কেন পায় নাই! সে কি শুধু ওই মদিনা_ পবিত্র মদিনার নামে নামটির জন্যেই, নাকি আরো কোনো কথা আছে? নাকি এমন যে, আগাম সংবাদ তার কাছে পেঁৗছে গিয়েছিলো যে, মদিনা আর সতী নাই! হস্তিবাড়ির জংগলের মধ্যে একদিন সে সতীত্ব হারায়!
সত্য কোথায়? সত্য কী? সত্য যখন প্রকাশিত হয় তখন কীভাবে তা গ্রহণ করতে হয়? সত্য যদি চিরতার মতো তিতোও হয়, তবু মিষ্টবোধে তা গ্রহণ করতে হয়? সত্য আর মিথ্যা। বাবার অসুখের কথা মিথ্যা করে বলেই তো সে ছুটি নিয়ে এসেছে। সেই মিথ্যার পাপ কেন তার অনুভবে নাই? রুহিতনের কাছে কোনো প্রতিজ্ঞা সে করে নাই যে, তুমি আমার নারী। অথচ তার কাছেও সে নিজের বিয়ের সংবাদ গোপন করে_ কেন করে? এটাও কি পাপ নয়? নবীর শহর মদিনার কথা স্মরণ হয় বলে মদিনা নামের নারীকে স্পর্শ করতে শরীর তার শিউরে ওঠে_ এতটাই প্রখর তবে তার পাপ-পুণ্যবোধ।
পেছনবাড়ি থেকে উঠোনে আসতেই কেরানি দেখতে পায় বড়বুবুকে। দুই ঘরের মাঝখানে সরু পথটায় দাঁড়িয়ে আছে সে। তার ভঙ্গিতেই বোঝা যায়, ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করে আছে সে।
আয়। আমার ঘরে আয়।
ভাইয়ের হাত ধরে ছনের চালাঘরের ভেতরে নিয়ে যায় বোনটি। বাইরে বিকেলের আলো মরে আসছে, কিন্তু সন্ধ্যা ঘোর হতে এখনো অনেক দেরি। ঘরের আলোটি এখনই সন্ধ্যার এবং বিষণ্ন। মাটির মেঝে। দুদিকে দুটি চৌকি। একটিতে বড়বুবু, আরেকটিতে ছোটবোন শোয়। আহ, কতদিন পরে এই ঘরে আবার এলো কেরানি! দেশের বাড়িতে মাঝেমাঝেই এসেছে, কিন্তু বোনদের কুটিরচালায় তার ঢোকা হয় নাই।
ভেতরে ঢুকে কেরানি চারদিক তাকিয়ে দ্যাখে। দুদিকে দুটি বিছানা। টানটান করে নীল চাদর পাতা। ছোট্ট একটা টুলের ওপর পানির জগ-গেলাশ। দেয়ালের বেড়ায় হাতপাখা গোঁজা। তার পাশে আয়না। আয়নার নিচে তাকের ওপর স্নো’র কৌটা, চিরুনি, চুলের ফিতা। কেরানি বোনকে বলে, বড় গোছ করি রাখিছো ঘরখান।
বোন তখন ভাইটিকে বিছানায় হাত ধরে বসায়। অনেকক্ষণ ভাইবোন চুপ করে বসে থাকে। যেন নীরবে তাদের কত কথা হয়ে যায়! পাশের বিছানা যে ছোটবোনের, সে এখন ঘরে না থাকলেও যেন আছে_ তার বিছানার ওপর ছবিঅলা মাসিক পত্রিকা পাতাখোলা উপুড় পড়ে আছে। কেরানি যেন অনুভব করে সেই ছোটবোনটিও তার দিকে চোখ পেতে আছে বিছানার শূন্যতার ভেতর থেকে।
বড়বুবু ভাইয়ের হাত ধরে আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে নীরবতা ভেঙে ফিসফিস গলায় বলে, হ্যাঁ রে, বৌ তোর পছন্দ হয় নাই? আমার কাছে না লুকাস, ভাই। খুলিয়া বল, পছন্দ হইছে, কি হয় নাই?
উত্তর নাই।
বড়বুবু আবার বলে, বুবুর কাছে বলিতে দোষ নাই। এত দেখিয়া পছন্দ করিয়া গুণ বিচার করিয়া বৌ আনি দিলোম। তোর মুখখান ভার কেনে রে? বৌ বা তোর মুখ ভার করি আছে কেনে? দুফরে নিয়া পাতে বসিলোম, তাই স্পর্শ করি দেখিলে না সালোন ব্যঞ্জন। নত্তুন বৌয়ের শরম থাকে, মুখে গরাশ তুলিতে চায় না। না, ইহা তো তা নয়, ভাই! মনেই তার কী কথা! সেই কথার তল উদ্দিশ করিতে কত সওয়াল করিলোম, কত কৌশল করিলোম, মুখ না ফুটিলো তার। বিষয় কী, ভাই?
উত্তর নাই।
রাইতের কালে কি কথা হয় নাই?
না। কেরানির মুখে ভাষা ফোটে নাই।
বড়বুবু হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে। শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে তার। আহা, আমাদেরও কি বোন নাই? আমাদের জন্যে কেঁদেছিলো, আমরা তো এখনো ভুলি নাই। নাকি, আজকাল ভাইয়ের জন্যে বোনের পরান কেঁদে ওঠে, এমন বোন আর নাই? কে বলে নাই? এই যে এখানে_ এই যে নীল সাগর-৩ লঞ্চের কেরানি আর হস্তিবাড়ি প্রাইমারি ইশকুলের সেকেন্ড টিচার_ এই দুটি মানুষ, ভাই আর বোন_ এই যে তাদের একজন কাঁদছে। বোনটি কাঁদছে ভাইয়ের হাত ধরে।
ভাইটি কি কাঁদে নাই? আমরা কি দেখি নাই?
না, আমরা দেখি নাই। ঘরের ভেতরে সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা, তাই আমাদের চোখে পড়ে নাই। যদি আলো থাকতো, তাহলে আমরা দেখতে পেতাম ভাইটির চোখও শুষ্ক নাই। সজল। ছলছল। নদীর পানির কথা কেরানির মনে পড়ে। নদীর পানি তো মানুষের অশ্রুর মতোই ছলছল করে। কেন কেরানি এখন কাঁদে_ সে নিজেও ঠাহর করে উঠতে পারে না।
(চলবে)