কেরানিও দৌড়ে ছিল

কেরানিও

১.
তাকে তবে কেরানিই বলা যাক, কেরানি বলেই ডাকা হতে থাক। একটা ভালো নাম আছে, ডাকনামও আছে বা ছিলো_ কিন্তু কেরানিটাই বহাল হয়ে যায় তার নাম হিসেবে। লঞ্চের চাকরিটা ছেড়ে দেবার বা চলে যাবারই বহু বহু দিন পরেও, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই কেরানি লেজুড় তাকে ছাড়ে না। প্রকাশ্যে হয়তো কেরানি কেউ উচ্চারণ করে না, কিন্তু মানুষের মনে যা থাকে সেটাই তো আসল। এ আসলের খবর গোপন থাকে চিরকাল, মিশে যায় কবরের মাটিতে।
তবে এ রকম গল্পও বহুদিন থেকে মানুষের সমাজে বিখ্যাত এক প্রজা দেখেছিলো রাজার কান লম্বা, সে সত্য প্রকাশ করলেই গর্দান যাবে, কিন্তু কথাটি তার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করতেই থাকে, পেট ফুলে ঢোল হয়ে যায়, তখন সে নদীর পাড়ে বিজনে কাশের বনে যায়, কাশবনের কানে কানে কথাটা ফিসফিস করে বলে সে হালকা হয়, আর যুগের পর যুগ চলে যায়, কাশবনে যখনই হাওয়া বয়, একেকটা কাশের ডগা দোলে আর বলে রাজার কান লম্বা!
না, সত্যের হাত থেকে রেহাই নেই। কেরানি নাম থেকেও তার নিস্তার নেই।
জন্মের সময় জরুল নেই, পরে দেখা দিয়েছে হয়তো মুখেই! সুন্দর একটি মুখ, মেজেঘষে আরো সুন্দর, সেখানে বাঁ গালে চোখের নিচেই যদি জরুলটি দেখা দেয় তা আর যায় না। দিনে দিনে বড় হয়ে বেশ একটা পয়সার মতো হয়_ চেহারার মার্কা হয়ে পড়ে। আর কিছু না হোক, পাসপোর্টের ছবিও তখন বদল করতে হয়। সে বদলের আগে একবার চেষ্টা যদি করতে সাধ হয় হঠাৎ গজানো জরুল তো আর কারো পছন্দের হতে পারে না! আর জন্মের সময় থেকেই ওটা থাকলে না হয় কথা ছিলো; এক বিকেলে ডাক্তারের কাছে গেলেন। মোটা ফিস নিলেন দেশখ্যাত তিনি, কিন্তু বললে বলবেনই তো!কারণ তিনি সহৃদয়, লেজার চিকিৎসার নামে মোটা টাকা আপনার পকেট থেকে খসাতে পারতেন, তবে টাকা তাঁর অনেকেই হয়েছে, একবার হজ্ব আর দু’বার ওমরাহ্ করে এসেছেন, করুণা মেশানো গলায় আপনাকে পরামর্শ দিলেন আপনার এ জরুল অপারেশনে উঠিয়ে দেয়া যায়, খুবই যায়, কিন্তু। কিন্তু আবার কী? তিনি থামলেন ও বললেন, খোঁচাখুঁচি করলে অনেক সময় ক্যান্সার হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়! ও বাবা! তবে থাক। চমকানো পিলে নিয়ে জরুলসহ আপনি বেরিয়ে এলেন। অতঃপর কেরানিও কেরানিই থেকে যায়।
হ্যাঁ, কেরানি নামটা ঘোচাবার চেষ্টা করা যেতো বৈকি! কিন্তু মনের মধ্যে নানা সংস্কার উঁকি দেয়। কেরানির চাকরিটা চলে যাবার পরেই না তার ভাগ্য পালটাতে শুরু করে। হ্যাঁ, ভালোর দিকেই। এত ভালো যে গল্প করার মতো। কেরানি নামটা ঘুচিয়ে দিলে যদি ভাগ্য পালটাতে শুরু করে। এবার খারাপের দিকে! না, বাবা, দরকার নেই। কেরানি মানে এখন তো আর আসলেই সে কেরানি নয়।
কিন্তু এসব পরের কথা। অনেক পরের। এখনকার কথা এখন। তবে আগেপরের আগেই একটি কথা  তার জীবনে তিন সংখ্যার একটা ভূমিকা লক্ষ করা যেতে পারে। এটা সে অনেক পরেই আবিষ্কার করে। এখনি না হয় সে কথাটিও হয়ে থাক। চিন্তাশূন্যতা, চেহারা আর মেয়ে এই তিন।
এক : কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করা, ভাবিত হওয়া, বিষয়ের আগেপর কী হতে পারে তা নিয়ে মাথা ঘামানো_ এ তার কোষ্ঠিতে নেই। যা হয় হবে! দেখাই যাক না কী হয়! কিংবা এ সবও নয়। বিনা প্রশ্নে গা ভাসিয়ে দেয়া। তাতেও ব্যাপারটা বিশদ হচ্ছে না। হয়তো দুশ্চিন্তা তার গড়নের মধ্যেই নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, দুশ্চিন্তা আছে তাদেরই তো যাদের ভাবনা আছে ভবিষ্যতের? দুশ্চিন্তা যদি নেই তবে এ কেরানি কি কখনোই নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিত হয়নি? ভাববে সে। ভাববে অনেক পরে। সে বৃত্তান্ত পরে পরে, যথাসময়ে।
তিনের মধ্যে প্রথমটা তো এই, এবার দ্বিতীয়টি তার চেহারা। সৃষ্টিকর্তা মেয়ে গড়তে বসেছিলেন, খাঁচাটাচা সব তৈরি হয়ে গেছে, এখন লিঙ্গ দেবার কাজটা বাকি। লক্ষ বছর ধরে মানুষ বানাতে বানাতে হাত ভেড়ে এসেছিলো বিধাতার, খানিক বোধহয় বেখেয়ালও হয়ে পড়েছিলেন। বিধাতা তো তিনিই যাঁর হাতে সকল বিধান। কী ছিলো তাঁর মনে, দেহের খাঁচাটা বানিয়ে আনমনে কী একটা জুড়ে দিয়েই প্রাণ যখন দিলেন ফুঁকে, নড়েচড়ে উঠলো ব্যাটাছেলেই একটা। এই যাহ্! বিধাতা তখন নিশ্চয় জিভ কেটেছিলেন নিজেরই ভুল দেখে। কিন্তু ওই যে বিধান! একবার যখন হয়ে গেছে বদলাবার আর জো নেই। বিধাতারও নেই!
মায়ের কোলে শিশুটিকে দেখেই লোকেরা বলে ওঠে, বাহ্, আপনার মেয়েটি তো বেশ দেখতে। হাজারবার হাজার জনে মাকে শুধরে দিতে হয় নাগো! না! এ আমার মেয়ে নয় ছেলে! লোকে তখন বিস্ময়ে শিস্ কাটে। তাই বুঝি! তবে তো দেখছি এ ছেলে বড় হলে নাগর একটা হবে! ভবিষ্যদ্বাণীটা মনে মনেই তারা করে। নারীরা তাদের স্বামীদের রুখো ধ্যাবড়া চেহারা মনে করে তখন দীর্ঘশ্বাসও ফেলে নিশ্চয়। কেউ কেউ তো শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে চুমো খেতে শুরু করে ধড়াদ্ধর। হয়তো শিশু নয় আগামীর যুবকটিকেই তারা চুমো খায়, কেননা অমন চুমোয় অঙ্গে তাদের কামরস চুইয়ে পড়ে।
নারীর কথা যখন উঠে পড়লো, তিন নম্বরে নারী! নারীও নয়, মেয়ে বলেই একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের ওই প্রজাতিকে। জননী তার নারী তো নিশ্চয়, সে নারী আমাদের কেরানি প্রসঙ্গে আসে না। আসে তারাই কোরানে যাদের থেকে তফাত থাকবার তাগিদ মেয়েদের বেলায় করা আছে। পুরো তালিকাটি দ্রষ্টব্য; তাহলেই পরিষ্কার হবে কেরানির জীবনে এই শেষ তিন নম্বরের কারা রেখেছে ভূমিকা। ভূমিকা শব্দটা বোধকরি খুব পোশাকি হয়ে গেলো। বলা যাক, ছাপ! বলা যাক এ ঘটনপটীয়সী পাত্রী ছিলো তারা। আরে না! এ পাত্রী সে পাত্রী নয়  বিয়ের বেলায়, বিয়ের কথাবার্তায়, ঘটকের রসালো বর্ণনায় পাত্রী যাদের বলা হয়!
বিয়ের প্রসঙ্গটা যখন উঠে পড়লোই, পাত্রী দিয়েই কেরানির কথা শুরু করা যাক। আখ্যানে একটি মেয়ের অবতারণা না করলে লোকে কান ফিরিয়ে নেয়, কৌতূহল হারিয়ে যায়। আখ্যানটা তখন মাঠে মারা যায়। রামায়ণের গল্পে সীতার কথাটা গোড়াতেই পাড়া হয় মহাভারতে দ্রৌপদী, অডিসিতে হেলেন! আলিফ লায়লায় শাহেরজাদী! বিষাদসিন্ধুতেও জয়নাব! কেরানির জীবনে এক নয় একাধিক! তাদের নাম পরেপরে আসবে। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্যহীন এখনকার মানুষ, স্থিরতা নেই, ধীরতাও দূরস্থান। অতএব আশ্বস্ত করতে হচ্ছে মেয়ে আছে, খুব পটীয়সী রকমেই তাদের আমরা দেখতে পাবো কেরানির জীবনে।
তবে তার আগে আরেকটি কথা বলে নিতে হয়। ওই তিন! কেরানির জীবনের প্রথম চাকরিটার সঙ্গে ওই তিন সংখ্যাটির যোগ ছিলো। ঢাকা-বরিশাল লঞ্চ সার্ভিসের যে কোম্পানিতে সে ঢোকে, তার জাহাজের সংখ্যা সাত। নীল সাগর নামে সাত সাতটি জাহাজ। কেরানি কাজ পায় নীল সাগর ৩-এ! সূচনার ওই ৩ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কেরানির চোখে পড়ে। নীল সাগর ৩ তখন বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে পচে কংকালপ্রায়। নাট-বল্টু পাটাতন দরোজা সিঁড়ি চোঙ পাইপ ইস্পাত তখন কালের কাক শকুনের দখলে। নীল সাগরের মালিক আহমদউল্লাহ্ও তখন পচছে কবরে নয়, জেলখানায়। কিন্তু সে কথা পরে। আর আহমদউল্লাহ্র একমাত্র মেয়েটি যে না! সে কথাও পরে, আরো পরে।
কেরানির চাকরি জীবন শুরু হয়েছিলো লঞ্চে। যাত্রী ওঠানো আর লঞ্চ ছেড়ে দেবার পর তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের কাজটা তাকে করতে হতো। সে একা নয়, আরো তিনজন তার সঙ্গে ছিলো। ওই দ্যাখো, ৩ সংখ্যাটি আবার এসে গেলো! তাকে নিয়ে তারা চারজনই_ কিন্তু সে ছিলো নতুন আর বেতন বা খাতিরের দিক থেকে সবার তলায়। তাকে বলা হতো ছোট কেরানি। তার কাজের পদ-বর্ণনাটি হওয়া উচিত ছিলো টিকেট মাস্টার। কিন্তু ওসব ইংরেজি খেতাব ইংরেজের হাতে গড়া ট্রেনের বেলায় খাটে। নৌকো আর নদীর দেশ বাংলাদেশে জলেভাসা লঞ্চের বেলায় অতটা সমীহ উদ্দীপক ইংরেজি খেতাব অচল। আমরা সংস্কৃতি ভুলিনি। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষাও তো বটে! তাই কেরানি শুধুই কেরানি! নবাবী বাদশাহী আমলে ছিলো মুনশী, ইংরেজ তাকে বানালো কেরানি। আদর করে তারা বাবু বলেও ডাকতো তাদের। কেরানিবাবু! কিন্তু মুসলমানের জবানে বাবু-টা নেহাত আসে না, তাই বাবু উড়ে গেছে, পড়ে আছে শুধুই কেরানি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা, ইংরেজের আমল থেকে এ যাবত গাধার গাধা মাছিমারা বলে শতাব্দীর পর শতাব্দী উপহাসের এবং করুণার পাত্র  কেরানি!
তবু তো একটা চাকরি! মাস গেলে বাঁধা বেতন তা যৎসামান্যই হোক। উপরিও কি নেই?  আছে! যাত্রীদের কাছ থেকে অধিক ভাড়া নিয়ে ন্যায্য ভাড়ার উপরিটা পকেটস্থ করা, কিংবা পুরোটাই বেমালুম মেরে দেয়া, বা নগদ যা পাও হাত পেতে নাও ধরনে যাত্রী যা দিতে পারে তাই সই এবং সেটিও গাপ্ করে দেয়া, এ সব সবাই জানে। চাকরির প্রথম দিনেই এ সবক সে পেয়ে যায় পুরনো কেরানিদের কাছ থেকে।
ভাড়ার ওই তছরুপ_ বাইরে থেকে জগতের জানা এক কথা, লঞ্চ মালিকের জানা আরেক কথা। চুরি করলেও কাঠগড়ায়, না করলেও সন্দেহবশেই! অতএব, মালিকের অফিসে তার ঘাগু আর বলবান অন্য কর্মচারীর হাতে কানমলাটা, লাথি খাওয়াটা, ঈদ পরবে যাত্রীরা যখন ঠেসে লঞ্চে ওঠে দিনান্তে তখন হিসেব দিতে গিয়ে রক্তারক্তি মার খাওয়াটা_ আমাদের কেরানির কপালে খুবই জোটে।
লোকে বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়! এ সবকও পুরনো কেরানিরা তাকে দেয়।
দেশের বাড়িতে বাবা, মা, দুটি বিবাহযোগ্য বোন আর এক ভাই। ভাইটি গাঁজাখোর। বোন দুটির বড়টি গ্রামেরই প্রাইমারি ইশকুলে অংক আর বাংলা পড়ায়। পড়াতে পড়াতে এখন পাকা মাস্টার। চুলেও একদিন দু’এক গাছি পাকা চুল দেখা দেয়। পাকা কুমড়োর মতো দীর্ঘ অবিবাহিত জীবনটাকে মনে হয় সে মেনেই নিয়েছে। সংসারে মায়ের জায়গা দখল নিয়েছে সে। একবার কঠিন এক বজ্রপাত হয়েছিলো বাড়ির কাছেই। তার আওয়াজে ও তরাসে মায়ের কানের তালা ফেটে যায়। মা এখন পুরোপুরি বধির লোকভাষায় বয়রা। চালচলনও পাগলীর মতো হয়ে যায়। বজ্রপাতে মনটাই তার তছনছ হয়ে যায়। সংসারে এমন হলে মায়ের জায়গায় মেয়ের না এসে উপায় থাকে?
ছোট বোনটি একেবারে এর বিপরীত। সারাদিন গুনগুন গান তার লেগেই আছে। চুলেরই বা কত রকম ফ্যাশন তার। কোনোটাই পছন্দ হয় না। এই খোঁপা করলো তো বিকেলেই বেণী বাঁধলো। পায়ে আলতা দিলো সকালেই কি বিকেল বেলা ঘষে ঘষে সে আলতা তোলা হলো। এই শাড়ি, এই সালোয়ার। আর পাড়া বেড়ানো! বাজারেও গিয়েও এ দোকানে সে দোকানে আড্ডা। কিছুদিন থেকে চেয়ারম্যানের যুবক ছেলেটার সঙ্গে তার ঘুসুরঘাসুর। কী, না দুবাই যাবে! যুবক তাকে কি মন্ত্র দেয়, ঠোঁটে লিপস্টিক ওঠে। গ্রামে এখন জোর গুজব, চেয়ারম্যানের যুবক ছেলেটির সঙ্গে রাতবিরেতে তাকে দেখা গেছে।
বাবা নিজেই তার নিজের দারুণ শূলব্যথা নিয়ে পাগলপ্রায়। সে ব্যথা কিছুক্ষণের জন্যে বশে থাকে সোডা খেলে। সোডার পয়সা পেলেই তার আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ছোট মেয়েটিকে শাসন করবে কি, সোডার জোগান দিয়ে বাবাকে সে হাত করে রেখেছে। সোডার পয়সাই বা সে নিষ্কর্মা পায় কোথা থেকে, জিগ্যেস করা বৃথা। চেয়ারম্যানের একটা বড় বেনেতি দোকান আছে বাজারে, হয়তো সেখান থেকেই! আর ওই যুবক! অংকটা সরল। দুবাই, সোডা, যুবক, যুবতী অংকটা মেলাতে কষ্ট হবার কথা নয়।
কেরানি নিয়মিত টাকা পাঠায় বাড়িতে। বেতন, উপরি, যাবত যা কিছু তার উপায়, নিজের খাইখরচ বাসাখরচ বাদে সবই সে বাড়িতে পাঠায়। এ যুগে এমন ছেলে বড় একটা দেখা যায় না। পিতৃভক্ত বলে তার সুনাম গ্রামে সবার মুখে মুখে। সপ্তাহান্তে শুক্রবারের জুমায় যায় বাবা। ওয়াক্তি নামাজ পড়ে কি পড়ে না, জুমা তার কামাই হয় না। নামাজ অন্তে বাতাসা বিলি হয় মুসলি্লদের মধ্যে। লোকের মুখে বাতাসার মিষ্টি স্বাদ, মুখেও তখন মিষ্টতা ভর করে। তখন এমন একটি সোনার ছেলের জন্যে মুসলি্লদের মনে জোয়ার ওঠে। তারা কেরানির বাবাকে ছেলেটির ভালোমন্দ খোঁজ নেয়। বাড়ি কবে আসবে? চিঠিপত্র লেখে তো? ঢাকায় ভালো আছে তো? চাকরিতে উন্নতি কেমন? আর  আর  বিয়েটা দেবেন কবে?
আগে ছেলেটার আরো ভালো চাকরি হোক, তবে তো! বেতন আরো বাড়ূক, নইলে বৌ পালবে কী করে? বৌ এলে দু’দিন বাদে ছেলেপুলে হবে, তখন? দেবো, ছেলে বিয়ে দেবো  আর কটা দিন পরে। মসজিদের মোয়াজ্জিন বলে, ওটা কোনো কথা নয়! হাদিসে আছে, বিবাহ করিয়া জীবিকা সন্ধান করো। রসুলের সে কথা স্মরণ করো, চাচা। -হাঁ, সেটাও এক কথা। তবে, ছেলের বিয়েটা এবার দিতেই হয়। ঘরে যে অবিবাহিত দু’দুটি মেয়ে শূলব্যথার দাপটে আর সোনার ছেলের প্রশংসায় সে উদ্বেগ বুড়োর মনে ঠাঁই পায় না। বলে, দ্যাখো তবে, তোমরা পাত্রী খোঁজ করো। আমার যে বেহাল দশা, তোমরাই ভরসা!
ভরসা বলে ভরসা। কার ঘরে না বিবাহযোগ্য মেয়ে! তার ওপরে এমন ছেলে! ঢাকায় চাকরি করে! লঞ্চের চাকরিতে কত উপরি রোজগার! আর পল্লী ডাকঘরের পিয়নের কাছে তো শোনাই যাচ্ছে, মাসে একবার তো বটেই, কোনো কোনো মাসে দু’বারও টাকার মনিঅর্ডার আসছে ঢাকার সদরঘাট পোস্টাপিস থেকে। পাঁচশো, সাতশো, কখনো হাজার দেড় হাজার। আর, বাড়িতে যখন আসে তখন তার সুটকেস বওয়াতে কুলির দরকার হয়। সে সুটকেসে রাজ্যের জিনিস। মা বাবা দুই বোন সবার জন্যে। পড়শির বাচ্চাদের জন্যেও মিঠাই বেলুন ছবির বই। এমন পাত্র হাতছাড়া করা যায়?
বরিশাল থেকে নীল সাগর ৩ লঞ্চটি ভোরে এসে ঢাকার সদরঘাটে নোঙর করে। ভোরের আকাশটা সবে রাঙা হয়েছে। নদীর বুকেও লাল রঙটি টলমল করে। বুঝি মানুষের মনও রাঙা-রাঙায় ছুপিয়ে ওঠে। শুধু মানুষ কেন? মাথার ওপরে কাকের দল। তাদের অবিশ্রান্ত চিৎকারও আর তেমন কর্কশ মনে হয় না। মোটঘাট বৌবাচ্চা নিয়ে যাত্রীদের কলরব সামাল, সামাল তাও যেন গানের মতো শোনায়, পাড়ের হোটেল আর রেস্টুরেন্ট থেকে উচ্চরবে ছড়িয়ে পড়া লাইডস্পিকারের গানের সঙ্গে মিলে মিশে বুকের মধ্যে জীবনের কলতান হয়ে যায়।
লঞ্চ ভেড়ার পরপরই মালিকের অফিসের একজন কেরানিকে বলে, তোমার চিঠি আছে। চিঠি মানে তো বাড়ির চিঠি। চিঠি আর আসবে তার কোথা থেকে! কিন্তু চিঠি? চিঠি লেখার মতো বিদ্যা আর কার আছে তার সেই প্রাইমারি ইশকুলের বোন ছাড়া? সেও তো কখনো চিঠি লেখে না! কেরানি বড় আতান্তরে পড়ে যায়। তার মন দুরদুর করে ওঠে। তবে কি খারাপ কোনো সংবাদ? বাবা বুঝি আর নাই! নাকি, মা! মায়েরই কিছু!
কই দেখি, চিঠি দেখি। চিঠি অফিসে। অফিসে? অস্থির হয়ে পড়ে কেরানি। সারেংয়ের কেবিন থেকে ঘুরে আসে খবরদাতা। তারপর কাঁধের কাগজপত্রের ঝোলা থেকে চিঠিটা বের করে বলে, না, না, আমার সাথেই আছে। -কই! দেখি!
চিঠির অক্ষরগুলো নাচ করে ওঠে। ভোরের রাঙা আলোটি এখন ঝকঝকে সোনালি। রোদ্দুরে ঝলসে ওঠে চিঠির পাঠ। বাবাজীবন, তোমার বিবাহ স্থির করিয়াছি। আগামী শুক্রবার বাদজুম্মা শুভকাজের দিন ধার্য হইয়াছে। পত্রপাঠ বাড়ি চলিয়া আসিবা। মঙ্গবারের মধ্যে পঁহুছাইবা। ফর্দমতো সমুদয় দ্রব্য আনিবা।
বাবার জবানীতে তার ইশকুল মাস্টারনি বোনটির লেখা চিঠি। সোনালি রোদ্দুর। কিন্তু কী কাণ্ড দ্যাখো, ভোরের সেই রাঙা আলোটি যেন ফিরে এসে চিঠির ওপরে পড়ে।
কেরানি বুড়িগঙ্গার বুকে ঝাঁপ দেয়।
[চলবে]