প্রেমিকা

52e144e172fa2-Untitled-12এই গল্প-প্রবন্ধটি দুঃখের অথবা কৌতুকেরই কি না, বর্তমান লেখকের জানা নাই। এর বিবরণটি যখন মিসেস রাহনুমা দিয়েছিলেন, তখন খুব হালকাভাবেই ঘটনাটিকে গ্রহণ করা গিয়েছিল, কিন্তু এখন যতই দিন যাচ্ছে, ততটা হালকা আর মনে হচ্ছে না। বিতর্কের চেয়ে গল্পটিতে বরং প্রবেশ করা যাক। সবটাই মিসেস রাহনুমার কাছ থেকে শুনে বয়ান করা নয়, তিনি তো বয়ান করেছেন কবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ঘটনা, আর আমরা আমাদের কল্পনা প্রয়োগ করে কবির অবস্থান থেকেই শুরু করছি।
এখন ঘুম ভেঙেছে কবির। ঘুম ভাঙার কথা বললেই ভোরের কথা আমাদের মনে হবে। কিন্তু না! কবির ঘুম ভাঙে বিকেলবেলায়। দুপুরে কাচকি মাছ আর পাতলা ডাল সহযোগে ভরপেট ভাত খেয়ে কবি একটা লম্বা ঘুম দিয়েছিলেন। ঘুণে ধরা আমকাঠের সস্তা চৌকিতে পাতলা চিটচিটে তোশক, কবির চালাঘরের টিনের বেড়ায় রোদের তাপে দোজখের হলকা, টিনের চালে কাকদের অবিরাম উড়ে এসে বসা, কা-কা কলরব, বাইরে পাড়ার পোলাপানদের কান্না কিংবা উল্লসিত চিৎকার, অদূরে টিনের কৌটো বানাবার কামারশালা, সেখান থেকে অবিরাম ঠং ঠং শব্দ আর মিস্তিরি যে ক্ষয়রোগী, তার কাশির খং খং খক, ওদিকে গলির পরেই যে মহাসড়ক, সেখান থেকে ট্রাক-বাস ছুটে যাওয়ার ঝড়—এসব সত্ত্বেও ঘুমাতে কোনো কষ্টই হয় না কবির।
ঘুম তার এমনিতেই হাত-বাঁধা। ঘুমিয়ে পড়লেই হলো। তেল চিটচিটে কবেকার পাতলা বালিশে মাথাটি রাখামাত্র ঘুম টুক করে নিত্যই তাঁর চোখের পাতায় নামে। বাড়িতে বউ-ছেলেমেয়ের চেল্লানিতে ঘুম নড়চড় হয় আর সকলের, সে থেকেও আমাদের কবি মুক্ত, কারণ তাঁর পরিবার সঙ্গে থাকে না, বুড়িরচর থেকে কবি তাদের রাজধানীতে আনেন নাই।
রাজধানীই বা বলি কী করে? কবি তাঁর বাসা নিয়েছেন রাজধানীর প্রান্তে গলি তস্য গলির এক টিনের ঘরে। আজ বহু বৎসর থেকেই তিনি এখানে। নগরের আর একটু ভেতরে আর একটু বিলাসী ঘরে বাসা নেবেন, এ পর্যন্ত তাঁর সেই সংগতি হয়ে ওঠে নাই, তেমন সংগতি অর্জনেরও চেষ্টা তিনি কোনোকালে করেন নাই। কিংবা সে রকম উদ্যোগের কথা তাঁর মনেই আসে না। তিনি এক পুস্তক প্রকাশকের প্রুফরিডারের কাজ করেই তাঁর জীবনের অন্ত পর্যন্ত পৌঁছুবেন—এটাও তাঁর সজ্ঞান সিদ্ধান্তে নয়, বরং জীবনস্রোতের টানেই গা ভাসিয়ে চলা! প্রকাশকের পিয়ন তাঁকে পৌঁছে দেয় প্রুফের তাড়া, তিনি প্রুফ কেটেকুটে দেখে রাখেন, পিয়নই এসে নিয়ে যায়, পিয়নের মারফতেই নগদ মজুরি হাতে আসে তাঁর, ক্বচিৎ কদাচিৎ তিনি প্রকাশকের অফিস বাংলাবাজারে যান।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, চালাঘরের ঠিকানা থেকে কবির বেরোবার কোনো দরকারই পড়ছে না। না, অতটা গুহাবাসী তিনি নন। কবিতা! কবিতা যে লেখেন, ছাপাও যে হয় পত্রিকায়, দৈনিকের সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতায় কি মাসিকে—সে বেলায়? হ্যাঁ, তিনি পত্রিকা অফিসে যান, কবিতাটি দিয়ে আসেন, কবিতা ছাপা হলে টাকাটা তিনি নিজেই নিয়ে আসেন, যে পত্রিকা নগদে নয় চেকে টাকা দেয়, চেকটি তিনি জমা দিতেও যান মহাসড়ক থেকে একটু নামায় ঝকঝকে একটা ব্যাংকে।
এই তাঁর যাতায়াতের বিররণ, নিত্য নয়, মাঝে মাঝে। বাকি যে দিনগুলো, দিনের রাতের যে সময়গুলো, উদ্ভিদের মতোই তিনি শেকড়বন্দী আছেন কত বৎসর এই টিনের একচালা ঘরে। আজকাল কবিতার কত উৎসব, কত কবিতা পাঠের আসর—একটিতেও তিনি আজ পর্যন্ত যান নাই, যদিও ডাক এসেছে কয়েকবারই। সম্ভবত একটা কুণ্ঠা কাজ করে তাঁর মনের ভেতরে।
কবিদের ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়, কবি সমাবেশের ছবি দেখা যায়—কোনো কবি নবাব আলিবর্দী খাঁর মতো বুকপাটায় কারুকাজ করা রঙিন সিল্কের পাঞ্জাবি-শোভিত, কেউ মড়মড়ে মাড় দেওয়া খদ্দরের জানুলাঞ্ছিত পাঞ্জাবিতে, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা, আবার কেউ নীল জিনসের ট্রাউজার আর মোটা সাফারি শার্টে। আমাদের এ কবির কুণ্ঠা বোধহয় তাঁর জামা-কাপড় নিয়েই! অথবা নিজেকে জনসমক্ষে হাজির করবার ঘোর একটা অনীহা থেকেই।
সারাক্ষণ ঘরেই থাকেন বলে লুঙ্গি আর বোতাম খোলা হাফ শার্টটাই তাঁর স্বাভাবিক পরিচ্ছদ, প্রায় দ্বিতীয় ত্বক তাঁর। ওই কালেভদ্রে নগরিতে যেতে হলে পরনে একটা বাদামি রঙের ট্রাউজার আর ওই পুরো হাতার ডোরাকাটা শার্ট—লজ্জাটা নিবারণ করা আর কি! বড় সন্ত্রস্ত কুণ্ঠিত থাকেন তার পরও—ভাবেন, হয়তো যথেষ্ট ভদ্রস্থ হলো না। কিন্তু উপায় কী! টাকা তাঁকে জমাতে হচ্ছে। নিয়মিত টাকা পাঠাতে হচ্ছে বউয়ের কাছে। দেশের বাড়িতে মেয়েটা তেরো থেকে চৌদ্দয় পড়েছে, ধাঁ ধাঁ করে বাড়ছে, তার বিয়ের আর দেরি কতই বা, ছেলেটারও নানা বায়না আর ইশকুল খরচ, প্রুফ দেখা আর কবিতা লিখে ক’ টাকাই বা আসে? নিজেরও রাজধানীর বাসা-খরচ খাই-খরচ আছে, ভদ্র শোভন পোশাকের পেছনে, কবিতার আসরে বাসরে যাবার মতো পাঞ্জাবি বা জিনসের শার্ট-ট্রাউজারের পেছনে টাকা খরচ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।
এতক্ষণে বোধহয় আমাদের কবিকে আমরা বেশ স্পষ্ট করেই দেখতে পাচ্ছি। আর এ কথাটাও এখানে বলে রাখা যায় যে তাঁকে কেউ বড় একটা চোখে না দেখলেও তাঁর কবিতার বেশ নাম আছে। প্রধানত প্রেমের কবি বলেই তাঁর যা কিছু খ্যাতি। প্রেম নামে এই একটি বিষয় ছাড়া আর কোনো প্রসঙ্গের অবতারণা তাঁর কবিতায় আমরা দেখি নাই। না, মুক্তিযুদ্ধ, না রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন, না কোনো শহীদকে নিয়ে রক্তমাখা উচ্চারণ—এ পর্যন্ত তাঁর কবিতায় আসে নাই।
আজও একটি প্রেমের কবিতা তিনি লিখে ওঠেন—কাক ভোরে! লিখে ওঠেন মানে তরতর করে লেখা হয়ে ওঠে না, প্রথম একটি পঙিক্ত কোথা থেকে উড়ে এসে তাঁর করোটির ভেতরে ডানা ঝাঁপটায়। আমাদের কবি মানুষের সাধারণ একটি ধারণা দেখেন আর হাসেন—কবিতা এক টানেই হয়ে পড়ে! এক টানে আসে একটি কি দুটি পঙিক্ত, তারপর বাকিটা ভাবতে একটা যুদ্ধই করে উঠতে হয়, বাকিটা আর প্রেরণায় চলে আসে না, রীতিমতো মিস্তিরির মতো খাটতে খাটতে সেই একটি পঙিক্তর পিঠে পিঠে বাকি পঙিক্তগুলো নামাতে হয়। তবে হয় কবিতা!
আজ সকালে সেই যে একটি পঙিক্ত এসেছিল, করোটির ভেতরে সেই পঙিক্ত ঝটপট হয়ে উঠল দুর্মর, কলমে লিখে ফেললেন দ্রুত হাতে, তারপর বেলা বারোটা পর্যন্ত, ভোরের নরম আলোটি খর রোদে পরিণত হয়ে শরীরে দরদর ঘাম বহানো না পর্যন্ত তিনি ওই একটি পঙিক্ত—‘ভুলেই গেছি কবে তোমাকে বলেছিলাম—আসছি!’—ওটার আগে-পরে পঙিক্ত কী কী হতে পারে—কত লিখলেন আর কাটলেন, শেষে বেলা পৌনে একটা নাগাদ কবিতাটি পুরো হলো! কী শান্তি! মাত্রই আট পঙিক্তর কবিতা। কী শান্তি!
ভুলেই গেছি কবে তোমাকে বলেছিলাম—আসছি!
এই দ্যাখো না এখনো আমি তোমার দিকেই যাচ্ছি!
তোমার দিকে কখন থেকে মনে পড়ে না আর—
ছায়ার মতো হাতছানিটি সবুজ মাঠের পার—
যে-মাঠে আমি একটি জীবন তোমার দিকে হাঁটছি!
শেষ কথা যে পৌঁছে যাওয়া তোমার কাছে—তোমার!
সব ভুলেছি, তবু কী আর ভুলতে আমি পারছি—
সেই যে আমি বলেছিলাম তোমার কাছে আসছি!
কবিতাটির খসড়া করতে করতে প্রায় ছত্রিশটি পঙিক্ত এল আর গেল, কাটতে কাটতে ছাঁটতে ছাঁটতে রইলো শুধু আটটি, নতুন পাতায় নতুন করে লিখে নিলেন কবি। আর ঠিক তক্ষুনি পাড়ার খালা এসে টিফিনকারিটি নামিয়ে রাখল।
আপনের খাওন।
মনে হলো কবিতাটি শেষ করে উঠবার পুরস্কার পেলেন কবি।
খালা মধুর গলায় এটাও বলে গেল, দেরি কইরেন না। মাথায় পানি দিয়া খায়া লন। বৈকালে আইজ তালের বড়া করুম। চায়ের লগে খাইয়েন।
আহ্, তালের বড়া! গ্রাম মনে পড়ে গেল কবির। মনের ওপর মিঠে একটা হাওয়া বহে গেল। আর মনে পড়ে গেল একটি বাড়ি। দেওয়ানদের বাড়ি। সেই কবে, সেই কতকাল আগে, একটি মেয়ে! দেওয়ানবাড়ির বড় মেয়েটি! রহিমা! রহিমা একদিন হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে তার মুখে গরম একটা তালের বড়া গুঁজে দিয়েই দৌড়ে পালিয়েছিল!
সেই মেয়েটিই কি এই কবিতায়, আজ সকালের কবিতার পঙিক্ততে ছুটে এসেছিল আবার! আরও একবার!
না। না বোধহয়!
তবে সেই মেয়েটিই কি? কবি যখন বুড়িরচর থেকে রংপুরে এসে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, জায়গির ছিলেন মাহীগঞ্জে, সেই জায়গিরবাড়ির মেয়েটিই কি? আমাদের কবি তখন সবে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। কাঁচা পদ, কিন্তু বিষয়টা তখনই—পরেও যা—এতকাল লিখবার পরেও ওই—প্রেম! রূপবতী ওগো রহিমা, তব কাছে বাড়িছে গোপনে হূদয়ের দেনা, আজও তুমি জানিলে না! কী করে এই পদ্য পড়েছিল মেয়েটির হাতে। আহা, খুশিতে কী লাল হয়ে উঠেছিল মেয়েটির মুখ! তারপর, চুরি করে কতবার তার হাত ধরা। চোখে চোখে কত কথা! স্কুলের পড়ার পাঠ দিতে দিতে কতবার কত অর্থপূর্ণ নীরব হয়ে যাওয়া। তারপর, একদিন বড়লোকের সেই ঝি, যে তাঁকে বাপের সিন্দুক থেকে কড়কড়ে পাঁচ শ টাকার একটা নোট চুরি করে এনে দিয়েছিল, বলেছিল—কী গরিবের মতন কাপড় পিন্দেন! টাউনের ভালো দোকান হতে একখান শার্ট-প্যান্ট কিনিবেন!
আহ, বাপের কাছে ধরা পড়ে রহিমা। টাকা চুরি! ক’ তুই ট্যাকা নিয়া কী করিছিস! ওদিকে যার জন্যে চুরি করা, তার নতুন শার্ট-প্যান্ট কেনা সারা। গায়েও উঠেছে তার। মারের চোটে রহিমা বলে দিয়েছিল—মাস্টারকে দিছোং! আর যায় কোথায়! মাস্টারের পিঠে তখন! সেই নতুন শার্ট-প্যান্টের ওপরেই মার! মারের চোটে জ্বর উঠে গিয়েছিল। জায়গির ছাড়তে হয়েছিল সেই সন্ধ্যাকালেই। কলেজও! লেখাপড়ার ওখানেই ইতি। আর রহিমারও! রংপুর থেকেও আমাদের কবিকে সেদিন পালাতে হয়েছিল।
কিন্তু এ সবই অনেক আগের কথা। ভালো করে কবির মনেও নাই আর। কেবল মাঝে মাঝে পিঠের সেই মার, থানা হাজতে দারোগার মতো মার, তাঁর মনে পড়ে। বাকি সবই গাঢ় এক মধুরতা শুধু। মধুর রহিমা, রহিমার মুখ, তাঁর কবিতার কাঁচা পঙিক্তটি পড়ে লাল হয়ে ওঠা সেই মুখ! আজ দুপুরেও আমাদের কবি আছেন অপরূপ এক মধুরতায়। আজ তাঁর এ মধুরতা ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত করোটির ভেতরে কবিতাটি নিয়ে যুদ্ধ করে করে একটি কবিতাকেই খাতার পাতায় ধরে ওঠার তৃপ্তির কারণেই! আর তাই, খালার কথায় নয়, কবিতাটি শেষ করার আনন্দেই কবি তাঁর গোসলটি তাড়াতাড়ি শেষ করে কাচকি মাছ দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েন চৌকিতে।
ঘুমের ভেতরে সাঁতার কাটতে কাটতে ছোট একটা বিঘ্ন তাঁর ঘটে। ঘুমের ব্যাঘাত এতে হয় না, কিন্তু নাছোড় খোঁচাতে থাকে। যথা, কবিতাটি যে তিনি শেষ হয়ে গেছে ভেবে পেট পুরে ভাত খেয়ে চৌকিতে গড়িয়ে পড়লেন, হয়তো শেষ ঠিক হয় নাই। হয়তো আরও দু-একটি পঙিক্ত দরকার ছিল। যথা, যার দিকে লক্ষ রেখে একটা জীবন হেঁটে যাওয়া, তার কাছে পৌঁছুবার পর? অথবা, পৌঁছানোটাই কি সব? না, তার পরেও কিছু আছে? থাকলে সেটি কী? উড়ে আসা একটি-দুটি পঙিক্তর পর কবিতার বাকিটা মিস্তিরির কাজ! সে মিস্তিরি কি আর বসে থাকে? কাঠমিস্তিরিও চেয়ারটি তৈরি করে অনেকক্ষণ কি তাকিয়ে থাকে না খুঁত আবিষ্কার করতে!
কবি এপাশ-ওপাশ করেন ঘুমের ভেতরে। যদি আরও দুটি পঙিক্ত লেখার দরকারই হয়, তবে তার মিল তিনি দেবেন কি কবিতাটির ওই ‘আসছি’র সঙ্গে, নাকি ‘মাঠের পার’-এর সঙ্গে? প্রায় একটা কিছু ঠিক হয়ে আসছিল, এর মধ্যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। ঘুম থেকে তিনি তড়বড় করে জেগে ওঠেন তাঁর নিত্যদিনের খাবার যার হাতে, সেই খালার ডাকাডাকিতে।
আনন্দ খলখল চিৎকার খালার, ওঠেন ভাই! ওঠেন!
কবি দরোজা খুলে বেরিয়ে আসেন। না, খালার হাতে তালের বড়া বা চা নাই।
তাঁকে দেখেই খালা শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলে, ভাই! মেহমান!
মেহমান!
চমকে ওঠেন কবি। মেহমান! কে মেহমান! তাঁর ঠিকানায় তো প্রকাশকের পিয়ন ছাড়া আর কেউ আসে না এবং সে পিয়নকে তো খালা বলবে না মেহমান!
চালাঘরের সামনেই শিমের জাঙাল। জাঙালের ওপারে বেড়া। বেড়া ঠেলে কবি বাইরে এসে দেখেন—দেখেন কি, প্রথমেই নাকে তাঁর ভুরভুর করে এসে লাগে কড়া সুগন্ধের ঘ্রাণ, আর ছবি! ছবির মতো দাঁড়িয়ে এক নারী! নারীটির পরনে লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের রঙিন ছবির মতো শালোয়ার-কামিজ, পায়ে গোলাপি স্যান্ডেল, হাতের নখে লাল টুকটুকে পলিশ, বয়স কিছু অধিক হলেও দেখাচ্ছে টেলিভিশনের নাটকে দেখা নায়িকার মতো। ধন্দ লেগে যায় কবির।
নারী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আমি রাহনুমা!
কবি তার বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে গুটিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কি হ্যান্ড শেক করার জন্যে? মাথা ঘুরে যায় কবির।
আপনিই তো রেজানুর হোসেন—কবি?
ঢোঁক গিলে কবি বলেন, আমি! মাথাটি নেড়ে নীরব সায় দেন—হ্যাঁ, আমিই!
উহ! যা আপনাকে খুঁজেছি! কত কষ্ট করে ঠিকানা পেয়েছি! এই এখানে থাকেন!
আমি—আমি—আমি তালের বড়া লয়া আসি।
পাখির মতো উড়ে যায় খালা। এমন দামি মেহমান, তা-ও এমন এক নারী! খালার এখন চিন্তা ভালো থালা-বাসন, চায়ের কাপ চাই যে! আর এদিকে, কবি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নারীটির সমুখে। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না জেগে আছেন, নির্ণয় নাই। গায়ের বিলাসী সুবাসে যে নীল একটা মোটা মাছি উড়ে এসে নারীটির মুখে কপালে বসবার চেষ্টা করছে, কবি ভীষণ ব্যস্ত নাচার হয়ে দেখছেন কিন্তু হাত উঁচিয়ে মাছিটাকে উড়িয়ে দেবার মতো সম্বিৎ নাই তাঁর।
এই গতিকে ঠিক এইখানে আমরা মিসেস রাহনুমার ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করছি।
তিনি বলছেন, হ্যাঁ, আমার কবি! আমার ভালো লাগার কবি! মাই পোয়েট! আমার দিন-রাত তোলপাড় করা কবি! আমার প্রেমের কবি! এই নোংরা ঘিনঘিনে জায়গায়! আমি তো অবাক—তিনি এখানে থাকেন! এই বাড়িতে! বাড়ি বলছি কাকে! বস্তি! বস্তির পাশে টিনের ঘর! রাস্তার নাম নেই। ঠিকানার নম্বর নেই। পত্রিকা অফিসে ঠিকানা জোগাড়! তারাও ভালো করে ঠিকানা বলতে পারে না। বলে নাকি গোরানের দিকে। মতলুব মাস্টারের বাড়ির কাছে! গোরান? গোরান কোথায়? ঢাকায়! হ্যাঁ ঢাকাতেই তো! খুঁজতে খুঁজতে, আমার ড্রাইভার শেষে বলল, গাড়ি আর যাবে না, আমারও জেদ চেপে গেছে, গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে, বস্তির পর বস্তি, একে-ওকে-তাকে জিগ্যেস করতে করতে, অবশেষে! এই বাড়ি! কবির বাড়ি! আর এই পোশাকে! ময়লা একটা লুঙ্গি! গায়ে গেঞ্জি! স্পঞ্জের স্যান্ডেল! গালে না-কামানো দাড়ি! কাঁচা-পাকা, প্রায় সবটাই পাকা! ভেবেছিলাম তরুণ কেউ। দেখি বুড়ো! বয়সের আগেই বুড়ো! এই সেই আমার কবি! প্রেমের কবি! এরই কবিতা পড়ে আমার মনের মধ্যে এতকাল এত ফুল ফোটার ছবি! এত কল্পনা করেছি! ভেবেছি, কবিতা আর নয়, কবিকে একবার চোখে দেখব। বলব, আপনি আমার মনের কথা এত জানলেন কী করে! যখন কবিকে পেলাম, খুঁজে খুঁজে তাঁর কাছে গেলাম, দেখে আমি তো থ!
মিসেস রাহনুমাকে আমি অনেক দিন থেকেই জানি, তাঁর বাড়িতে বহু দিন আমি পার্টিতেও গিয়েছি, গুলশানের বাড়িতে সে কী চমৎকার আসবাব, সে কী সাজানো-গোছানো, ঝকঝকে গাড়ি, উর্দি পরা দরোয়ান-বেয়ারা, স্বামীটিও চমৎকার এক ভদ্রলোক, কী স্মার্ট দুটি সন্তান, ইংরেজি ছাড়া কথাই বলে না, মাঝেমাঝেই বিদেশে হলিডে, মনে হতো জীবনে তাদের না-পাওয়া কিছুই নাই, আর এই মিসেস রাহনুমাই কিনা প্রেমের কবিতা—তাও বাংলায়—পড়ে পড়ে মনের মধ্যে দেখেছেন ফুলের ফুটে ওঠা! তবে কি এ নারী এত পেয়েও কিছুই পান নাই? প্রেম! পান নাই তবে? তৃষ্ণার্ত তবুও! এতটাই যে কবিতা পেরিয়ে কবিকেই স্পর্শ করবার এতখানি উদ্দীপন তাঁর ভেতরে যে খুঁজে খুঁজে তাঁকে বের করা!
আপনি কি আশাভঙ্গ হয়েছিলেন? আমি জিগ্যেস করলাম।
জানি না!
উঠে গেলেন মিসেস রাহনুমা। তাঁর ড্রয়িংরুমের শেষ প্রান্তে ড্রিংকসের ক্যাবিনেট, সেদিকে যেতে যেতে আমার দিকে ফিরে স্খলিত একটি হাসি ছুড়ে বললেন, আমি একটা মার্টিনি নিচ্ছি। আপনাকে?
না, এই বিকেলবেলায় নয়! আমাকে বরং একটা জুস দিন।
মিসেস রাহনুমা আমার জন্যে আনারসের জুস আর নিজের জন্যে সুইট মার্টিনি নিয়ে ফিরে এসে বসলেন। বিষণ্ন গলায় বললেন, কী যে ভূতে পেয়েছিল আমাকে! খুঁজতে গিয়েছিলাম কবিকে! না গেলেই বোধহয় ভালো ছিল!
আমি চুপ করে রইলাম।
মার্টিনিতে একটা চুমুক দিতেই বিষণ্নতাটি ঝপ করে কেটে গেল মিসেস রাহনুমার। বললেন, আমার মায়া হলো!
মায়া!
হ্যাঁ, মায়া। অন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। মায়া! মায়াই!

করুণা নয় তো? সতর্ক গলায় আমি বলে উঠলাম।

করুণা?—মিসেস রাহনুমা খানিক ভাবলেন, আরেকটা সিপ নিলেন মার্টিনির, ঠোঁট মুছলেন টিসু দিয়ে, তারপর পালটা প্রশ্ন করলেন, করুণা মানে দয়া তো?

আমি চুপ করে রইলাম।

তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, দয়া নয়! দয়া যদি করতে হয় তো আমার নিজেকেই করতে হয়। বলতে হয়, রাহনুমা, তুই একটা ভিখিরি, তুই একটা স্বপ্নখোর টিন এজার! তোর কী নেই যে তুই এমন পাগলি হয়ে উঠেছিলি একটা কবির জন্যে! সে তোকে কী দিতে পারত!

আমি টের পাই, মিসেস রাহনুমার মগজে এখন নেশা কাজ করছে মার্টিনির। আমার সন্দেহ হতে লাগল যে আমার আসবার আগেই তিনি পান শুরু করে দিয়েছিলেন, নইলে—ভিখিরি!—একটা মার্টিনির দু-তিন চুমুকেই এমন সংলাপ তো তাঁর মুখ থেকে বেরুবার কথা নয়!

লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিসেস রাহনুমা বললেন, দয়া মায়া করুণা ফরুণা কিচ্ছু না! কবিকে বললাম, কই আমাকে বসতে বললেন না? তিনি বেসামাল হয়ে পড়লেন। বুঝেই পেলেন না কোথায় আমাকে বসাবেন। আমিও বুঝতে পারছিলাম, বসাবার মতো কোনো ব্যবস্থাই তাঁর নেই। তবু ঠেলে তাঁর ঘরে ঢুকলাম। তাঁর চৌকিতে বসলাম। ভাবতে পারেন, কী ময়লা চাদর-বালিশ! ওখানেই বসলাম। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বললাম, আপনিও বসুন। ঘরে একটা টেবিল—বই-খাতা এক স্তূপ, হাতলছাড়া একটা চেয়ার। হাত তুলে ইঙ্গিত করেছিলাম আমার পাশে বসতে, কবি চেয়ারে বসলেন। দুঃখ পেলাম কি? জানি না। বললাম, কবিতা শোনাবেন প্লিজ একটা? তিনি সাগরে পড়ে গেলেন! বললেন, কবিতা! এমন গলায় বললেন, যেন কবিতা কী বস্তু, তিনি জানেনই না! বললাম, শোনান না একটা, যেটা সবশেষ লিখেছেন, এখনো ছাপতে দেননি, শোনান! তিনি তখন ত্রস্ত হাতে টেবিলের ওপর একটা খোলা খাতা বন্ধ করে একটা মোটা বইয়ের তলায় লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। আমি তো বুঝে ফেললাম ওটাই তাঁর কবিতা লেখার খাতা। উঠে গিয়ে খাতাটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিলাম। কাড়তে গিয়ে তাঁর হাতের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল। এই সেই হাত! যে হাত দিয়ে অমন কবিতা! প্রেমের কবিতা! তাকিয়ে যে দেখছি তাঁর হাড়সর্বস্ব হাত, বুড়োটে আঙুল, বড় বড় নখ, নখের নিচে ময়লা—ওই যে আমার হাত থেকে খাতাটা কাড়তে গিয়ে তিনি প্রায় খামচেই দিলেন আমার হাত, যেন মানুষ নয় জন্তুর একটা নখ-নখর, আমি মেলাতে পারলাম না এ হাতের সঙ্গে তাঁর কবিতাকে। খাতাটা মেলে ধরতেই দেখি—কবিতা! নিচে সেদিনেরই তারিখ! লাইনটা এখনো মনে আছে—ভুলেই গেছি কবে তোমাকে বলেছিলাম—আসছি!

মিসেস রাহনুমা উঠে পড়লেন। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে আধো দেয়াল রচনা করে আছে বইয়ের একটি লম্বা নিচু আলমারি। সারি সারি বই। চাবি ঘুরিয়ে আলমারিটা খুলে তিনি একটি পাতলা বই বের করলেন। দূর থেকেই মলাটটি আমাকে তুলে দেখালেন।

কবির নতুন বই। আর বইয়ের প্রথম কবিতাটিই সেই কবিতা।

আমার হাতে বইটি দিয়ে মিসেস রাহনুমা ড্রিংকসের ক্যাবিনেটের কাছে গেলেন, আরও খানিক মার্টিনি নিয়ে ফিরে এসে বসলেন আমার সমুখে। ততক্ষণে কবিতাটি আমার পড়া হয়ে গেছে।

পড়লেন?

হ্যাঁ পড়লাম।

কেমন লাগল?

মন্দ নয়।

ভ্রু কুঁচকে মিসেস রাহনুমা তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, মন্দ নয়! বলেন কী! অসাধারণ! আমি তো মনে করি অসাধারণ!

মনে মনে বললাম—না, ম্যাডাম, খুবই সাধারণ একটা কবিতা! কিন্তু মুখে উচ্চারণ করলাম না।

মিসেস রাহনুমা বললেন, আপনি কি কখনো এরকম হয় মনে করেন না, যে, কারও জন্যে আপনার এত ভালোবাসা যে জীবনে শুধু একমাত্র তাকেই ভালোবেসেছেন, তাকে পাননি, কিন্তু তারই দিকে এখনো প্রতিদিন একটু একটু করে এগোচ্ছেন?

আমি কবিতাটির চেয়ে মিসেস রাহনুমার কথাই ভাবছিলাম। তিনিও কি তবে কাউকে ভালোবেসেছিলেন? এমন কাউকে, যাকে তিনি পাননি, কিন্তু তারই দিকে মুখখানি তাঁর ফেরানো আছে আজও, তারই দিকে মনে মনে তাঁর একটু একটু করে প্রতিদিনই এগিয়ে যাওয়া?

চমক ভাঙল মিসেস রাহনুমার কথায়। তিনি বলে উঠলেন, আশাভঙ্গ!

প্রতিধ্বনি করে উঠলাম আমি, আশাভঙ্গ!

মনে হলো, তাঁর ব্যক্তিগত গোপন প্রেমের প্রসঙ্গেই কথাটা তিনি ভরলেন। সম্ভবত। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকালাম। হয়তো এর পরেই তিনি তাঁর গোপন কাহিনিটি বলবেন।

কিন্তু না! তিনি বললেন, জানেন, কবি আমাকে ভীষণ একটা আঘাত করেছেন। আমি বুঝতে পারছি না, কেন তিনি এমনটা করলেন?

কী করলেন?

আমি ওই দিন তাঁকে বলেছিলাম, আপনি বাসাটা বদল করুন। আমার একটা ছোট ফ্ল্যাট আছে সেগুনবাগানে। পড়েই আছে। খালি। একেবারে খালি। আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে চাই। তিনি না-না করে উঠলেন। কয়েকবার বললাম, তিনি বললেন—না, এখানেই তাঁর মন বসে গেছে, এখানেই তিনি বেশ আছেন, এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। বললাম, ফর আ পোয়েট লাইক ইউ দিস ইজ নট ইয়োর প্লেস! এ পরিবেশ আপনার জন্যে নয়। বললেন, আমি এখানেই ভালো আছি। বললাম, ইউ উইল নট বি আ টেনান্ট। ইউ উইল বি মাই গেস্ট। আই উইল বি অনার্ড। আপনার ভাড়া দিতে হবে না। তিনি ঘাড় শক্ত করে রইলেন। বললাম, আমি আপনার কবিতার ফ্যান। তিনি মাটির দিকে মুখ নিচু করে বসে রইলেন। বললাম, কী? যাবেন সেগুনবাগানে? তিনি মাথা নাড়লেন। যখন দেখলাম তিনি কিছুতেই আমার দেওয়া ফ্ল্যাটে উঠবেন না, তখন আমি বিদায় নেবার সময় বললাম, আপনাকে তবে একটা মোবাইল দিতে পারি কি? আপনার তো মোবাইল নাই, ক্যান আই প্রেজেন্ট ইউ উইথ আ সেট? আমি আপনার কবিতা খুব ভালোবাসি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। মোবাইল তো নেবেন?

মহিলার উপহার দেবার জেদ দেখে বিস্ময়ে আমি হালকা শিস দিয়ে উঠলাম।

মিসেস রাহনুমা আমার শিসটিকে উপেক্ষা করে বলে চললেন, কবি ঘাড় গোঁজ করে রইলেন। বুঝলাম, মোবাইলও তিনি নেবেন না। দেন আই ফেল্ট ভেরি ব্যাড। আমার খুব কষ্ট হলো তখন। ভেরি ডিজঅ্যাপয়েন্টেড আই ওয়াজ। এত পছন্দ করি যে কবিকে, কেন তিনি বুঝছেন না যে তাঁর জন্যে কিছু করতে পারলে আমার কত ভালো লাগবে। উপহার হিসেবেও কি কেউ কাউকে কিছু দিতে পারে না? ক্যান আই নট টু মাই ফেভারিট পোয়েট? গাড়ি পর্যন্ত তিনি আমাকে এগিয়ে দিলেন। বস্তির ভেতর দিয়ে নীরবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন গাড়ির কাছে, গাড়িতে বসতে বসতে কবিকে বললাম—আমি কিন্তু কিছু একটা আপনাকে দিতেই চাই। বেশ তো, আপনি মোবাইল নেবেন না, সেগুনবাগানেও যাবেন না, আমি আপনাকে একটা খাট আর বালিশ-চাদর, একটা সোফাসেট পাঠিয়ে দেব, না করতে পারবেন না কিন্তু। প্লিজ! সোফাসেটে আপনি না বসুন, আমি এসে তো মাঝে মাঝে বসতে পারব, গল্পটল্প করতে পারব! এই বলে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললাম ড্রাইভারকে কবিকে না বলবার কোনো সুযোগ না দিয়ে। একবার পেছন ফিরে দেখলাম—তিনি তখনো পথের ওপরেই দঁড়িয়ে আছেন! না, আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নয়, মাথা নিচু, মাটির দিকে চোখ। ইয়েস, তখনি আমার বোঝা উচিত ছিল।

আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা গড়িয়ে পড়ল, কী? কী বোঝা উচিত ছিল?

যে, এসবও তিনি নেবেন না। নেবেন না তো এমন এক কাণ্ড করবেন, যা আমি ভাবতেও পারিনি। বেয়োন্ড মাই ওয়াইলডেস্ট ড্রিম।

তার মানে?

মানে আর কী! আমার কেয়ারটেকার ট্রাকে করে খাট তোশক গদি বালিশ চাদর সোফাসেট নিয়ে সেই বস্তিতে গিয়ে দ্যাখে কবি সেখানে আর নেই।

নেই মানে?

লেফ্ট! চলে গেছেন! পরদিনই বস্তি ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন, কাউকে ঠিকানা দিয়ে যাননি! একেবারে রাতারাতি! কী কাণ্ড বলুন তো! যে বস্তিতে তাঁর মন বসে গেছে, যে বস্তি থেকে জীবনেও যিনি নড়তে চাননি, সেই বস্তি থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে গেলেন? স্ট্রেঞ্জ!

আমাকে বলতেই হলো, বললাম, ম্যাডাম, আপনি যাকে বস্তি-বস্তি বলছেন, ওটা হয়তো আপনার কাছে বস্তিই মনে হয়েছে, আসলে হয়তো নয়, কম রোজগারি মানুষদের একটা পাড়া। গুলশানের তুলনায় বস্তি মনে হতে পারে, আসলে নিশ্চয় নয়, আই অ্যাম অলমোস্ট সার্টেন।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল, আমিও ঈষৎ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ছিলাম, বললাম, এবার আমাকে না হয় আপনার ওই সুইট মার্টিনিই একটু দিন। জাস্ট আ ড্রপ! আহ, হোয়াট আ স্টোরি!

ইয়েস, হোয়াট আ স্টোরি। অ্যান্ড হাও ফুলিশ অব মি টু চেজ আ পোয়েট!

আমি বললাম, আপনি খামোকা উতলা হচ্ছেন। বরং আপনি—ইউ ডিজার্ভ মাই প্রেইজ যে আপনি বাংলা কবিতা পড়েন, কবিতা ভালোবাসেন।

মিসেস রাহনুমা টলোমলো গলায় গাঢ় উচ্চারণ করলেন, ইয়েস! আমি পড়ি! মনের ভেতরে একটা সান্ত্বনা পাই। সান্ত্বনা আনে কবি যে পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা আছে।

অ্যান্ড—বিচ্ছেদও আছে, না-পাওয়াও আছে!

আমি বুঝতে পারছি সুইট মার্টিনি আমার ভেতরে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে।

অফকোর্স! না-পাওয়া! কত না-পাওয়া! টেল মি, কবিরা কি সব বানিয়ে লেখেন?

কবিকেই আপনার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আমি তো আর কবি নই!

আমি একের পর এক পান করে চলি। বেয়ারা এসে কাবাব-সমুচা রাখে। আমি চিবিয়ে চলি। হাত বাড়িয়ে শূন্য পাত্রটা তুলে ধরে বলি, ক্যান আই হ্যাভ ওয়ান মোর?

তারপর কী হয়, পান করতে করতে আমার ভেতরে কবি রেজানুর হোসেনের সেই রংপুরের মাহীগঞ্জ জেগে ওঠে, জায়গিরবাড়ির সেই মেয়েটির ছবিও। হয়তো রাহনুমার সঙ্গে রহিমা নামের খানিক মিলটাও অবেচেতন মনে আমি দেখে উঠি একসময়। চমকে উঠি। আর তখনই আমি এই অনুমানে এসে পৌঁছোই—সেদিন মিসেস রাহনুমা চলে আসার পর রহিমার কথা কবিরও মনে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়! অনুমান কেন, নিশ্চয় করেই আমার মনে হতে থাকে যে চোরের মার দ্বিতীয়বার খাবার ইচ্ছে আমাদের এ কবির ছিল না, তাই এবারও তিনি পালিয়েই গেলেন!