একটি জাদুদ্বীপ ও পাঠকের জন্ম

সাহিত্য ক্ষেত্রে হুমায়ূনের আগমনটা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। সে একটা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। যার প্রথম ‘নন্দিত নরকে’তে সে বৈশিষ্ট্য টের পাওয়া গিয়েছিল। প্রথম বইটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তার মধ্যে একটা পূর্ণতা ছিল প্রথম থেকেই। হুমায়ূন বেশ সচেতনভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সাহিত্যে এসেছিল এবং অতি অল্প সময়েই সাহিত্য ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে বিজয়ীর মতো চলে গেছে।

হুমায়ূনের একটা আগ্রহ ছিল জাদুর দিকে। সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে সে জাদু দেখিয়েছিল। তার সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেও এই জাদুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় প্রচণ্ড জোরালোভাবে। তার লেখার জাদুকরী একটা ক্ষমতা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে, সে তার লেখায় অপ্রত্যাশিত বিষয়কে নিয়ে আসে। প্রচণ্ড চমক সৃষ্টি করে। পাঠকের কাছে অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর সব ঘটনাকে সে অনায়াসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারত। একজন লেখকের এ এক বিরাট গুণ। লেখকের এই ক্ষমতা পাঠকের অবিশ্বাসকে সাময়িকভাবে হলেও স্থগিত করে ফেলে। কারও অনুকরণ না করে, সহজভাবে গল্প বলার এক অসাধারণ জাদুকরী ক্ষমতার নামই হুমায়ূন আহমেদ। এ কথা হুমায়ূন অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে গেছে। খুব সহজ বা বলা যায় কথকতার একটা ভঙ্গি হুমায়ূন রপ্ত করেছিল দারুণভাবে। কথকতার মধ্যে যে একটা প্রলম্বিত ব্যাপার থাকে- অল্প কথায় এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা প্রবহমানতা তৈরি করা গল্পের মধ্যে; এটা তার একটা বড় গুণ। পাঠকরা যতক্ষণ পড়ছে ততক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকছে, আনন্দের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে- এটা হুমায়ূন পাঠের একটা বিশেষ দিক।

হুমায়ূন এমন একটা সময়ে আবির্ভূত হয়েছিল যখন বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। চারদিকে একটা শূন্যতা। কথাসাহিত্যেও সেই শূন্যতা বিরাজ করছিল। তখন আমাদের যারা প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক ছিলেন তারাও প্রবীণ হয়ে গেছেন বা কেউ কেউ লিখছেন না, কেউ অল্প লেখেন। এমন একটা সময়ে শূন্য জায়গাটিতে এমন একজন লেখকের প্রয়োজন ছিল। আরেকটা দিক হলো নতুন দিনের পাঠকদের জন্য তেমন নতুন ধরনের লেখক ছিল না। সে চাহিদা এবং সুযোগ খুব ভালোভাবেই মিটিয়েছিল হুমায়ূন। নতুন প্রজন্মের পাঠকরা ঠিক যেন তার মতো একজন লেখকেরই প্রত্যাশায় ছিল। তাকে দিয়ে তারা তাদের প্রয়োজন অত্যন্ত সুন্দরভাবেই মিটিয়ে নিতে পেরেছে। আর এর দৃষ্টান্ত তো আমরা সকলেই দেখেছি। কি বিপুল জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেছে হুমায়ূন। নতুন পাঠক এবং সময়ের প্রত্যাশা হুুমায়ূন মেটাতে পেরেছিল। তার এ কাজে আর যে বিষয়টি সহায়তা করেছিল, সেটি হলো টেলিভিশন। সেখানেও একইভাবে শূন্যতা ছিল একজন ভালো লেখকের, নির্মাতার। সেখানেও একইভাবে সফল হয়েছে হুমায়ূন। দর্শক সেখানেও হুমায়ূনের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশের টেলিভিশন মাধ্যমও তার হাত ধরে এগিয়ে গেছে। আর টেলিভিশনের মাধ্যমেও তার জাদুময়তা দর্শকের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তার সৃষ্টি করেছে।

পাঠকের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল কাজ করে। হুমায়ূনের সব গল্পেই এ কৌতূহল বিদ্যমান থাকত অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবেই যে, পরিণতিটা কী হবে! গল্প কোথায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! সেই কৌতূহলটাকে সে খুব সুন্দরভাবে মেটাতে পারত। কৌতূহল সৃষ্টি ও বিনাশে হুমায়ুনের জাদুময় এক ক্ষমতা ছিল।

তারপরে সে চলচ্চিত্রে এসেছে। সেখানেও তার একটা প্রায়োজনীয়তা ছিল।

হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি বিশেষ দিক ছিল- সে এমন একজন লেখক, যে অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, বিদেশ থেকে ডক্টরেট করে এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছে। একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং পরে সার্বক্ষণিক লেখক হয়ে গেছে। এমনটা আমাদের দেশে দ্বিতীয়টি নেই। এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার। কারণ আমাদের দেশে দারুণভাবে পেশাদার লেখকের অভাব আছে। লেখালেখির ওপরে নির্ভর করে এমন লেখক খুব কমই আছেন। সে জায়গায় হুমায়ূন একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতীয়মান করেছে নিজেকে।

তার চরিত্রের আরেকটি বিশেষ দিকের কথা আমার খুব মনে পড়ে। সেটি হলো তার স্মৃতিশক্তি। হুমায়ূন যে কোনো ঘটনা, লেখা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্মরণে রাখতে পারত এবং তাকে পুনর্গঠনও করতে পারত। এ শক্তি তার লেখনীতেও নানা সময়ে স্পষ্ট হতে দেখেছি। স্মরণশক্তির ওপর ভর করে নিতান্ত সাধারণ ঘটনাকে সে অসাধারণ ঘটনায় রূপ দিতে পারত অনায়াসে। একদিকে বৈজ্ঞানিক চেতনা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, আরেকদিকে এই স্মরণশক্তি তার কাজে লেগেছিল।

একটা কথা মনে করা হতো_ সাহিত্য ক্ষেত্রে হুমায়ূন পাঠক তৈরি করছে। এ কথা সত্ত্বেও হুমায়ূন নিজে বলেছিল যে, ‘তার পাঠক কেবল তারই পাঠক।’ এই পাঠক আবার অন্য সাহিত্যপাঠে আগ্রহী হবে না। কিন্তু এই পাঠক হয়তো তৈরিই হতো না, যদি হুমায়ূন না থাকত। সে হিসেবে এই পাঠকদের বইয়ের দিকে টেনে আনা- এটা হুমায়ূনের একটা অবদান। তার গল্প বলার ভঙ্গি এবং গল্প তৈরির নিজস্ব ক্ষমতাটা এমন যে, এক্ষেত্রে তার কোনো অনুকারী তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে তার জায়গায় দ্বিতীয় কারও দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।

আরেকটা বিষয় দেখতে হবে যে, হুমায়ূন মধ্যবিত্তের লেখক। যে মধ্যবিত্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। তারা টেলিভিশন দেখতে চায়, পছন্দসই বই পেলে পড়তে চায়। হুমায়ূন তাদের জন্যই লিখেছে_ তাদের কাছে হুমায়ূন খুবই প্রিয়। সে জন্য নতুন যে প্রজন্ম এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হচ্ছিল তাদের ভেতরে হুমায়ূনকে প্রচণ্ডভাবে আবিষ্কার করেছি আমরা। এদের মধ্যে যাদের অবসর আছে এবং বিনোদনের চাহিদা আছে, তারা হুমায়ূনকে লুফে নিয়েছে। হুমায়ূন তাদের প্রয়োজনীয়তাকে, আগ্রহকে নিজ ক্ষমতায় অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত জাদুময়তার মাধ্যমে মেটাতে সক্ষম হয়েছিল এবং এ নতুন পাঠকদের সে বইয়ের দিকে টেনে এনেছে। গল্পের দিকে টেনে এনেছে। তবে তার পাঠক, তারই পাঠক।

হুমায়ূনের সব গল্প বলার মধ্যে একটা কৌতুকের বোধ আছে। মজা করে এক ধরনের লেখার ঢঙ হুমায়ূনের ব্যক্তিগত। খুবই কঠিন রহস্যময় ব্যাপারকেও সহজভাবে নেওয়ার একটা দৃষ্টিভঙ্গি হুমায়ূন তার লেখার অনেক জায়গাতেই প্রবেশ করিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি হুমায়ূন নিজের জীবনেও এ ধরনের আচরণ চর্চা করত। এটা অনেকটাই তার স্বভাবজাত।

অপ্রত্যাশিত সব সংলাপ সৃষ্টি করেও হুমায়ূন পাঠককে আকর্ষণ করত। যে সংলাপগুলোর মধ্যে বিস্ময় থাকে, কৌতূহল উদ্দীপনা থাকে। সেসবের সব কিছু মিলিয়ে একধরনের প্রসন্নতা কাজ করে হুমায়ূনের জগতে। এ প্রসন্নতাটাও দরকার ছিল। কারণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মানুষ এখানে দুঃখ-দুর্দশা আর দুর্ভিক্ষ দেখেছে। আনন্দ বলতে কিছু নেই। এখানে চারদিকে মানুষের জীবনে বিভীষিকা। এমন বিষণ্ন জাতীয় আবহাওয়া মানুষ অনেকটা আনন্দের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে হুমায়ূনের লেখার মধ্যে। ঠিক যেন একটা সবুজ দ্বীপ, যেখানে জাদু আছে, আনন্দ আছে, কৌতূহল আছে, জীবনকে সহজভাবে নেওয়ার একটা শক্তি আছে। নতুন দিনের মানুষ সে দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করল। সে দ্বীপে লাখ লাখ মানুষ যেন জাদুগ্রস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল অনেকটা দিন। কিন্তু হুমায়ূনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে দ্বীপটির দরজা বাঙালি পাঠকের জন্য চিরতরে খুলে গেছে। যে সবুজ দ্বীপ সে রচনা করেছে; তার লয় নেই।

হুমায়ূনের সৃষ্টির এ প্রসন্নতা খুবই স্মরণীয়, কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে- মৃত্যুর সম্ভাবনাও আছে; কিন্তু কোনো কিছুতে কখনোই সে তার এই প্রসন্নতা হারায়নি। ব্যক্তিগত জীবনে সে অনেক দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে, অল্প বয়সে তার পিতাকে হারিয়েছে, তার ওপর পরিবারের অনেকটা দায়িত্বও ছিল; তারপর তার পরিবারও ভেঙেছে। কিন্তু এত সবকিছু সত্ত্বেও সে তার মধ্যে একটা প্রসন্নতা বজায় রেখেছে সব সময়।

হুমায়ূন একমাত্র তার নিজের মতনই। সে অন্য কারও মতো নয়। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রশান্ত একটা উপনিবেশেরই যেন পরিসমাপ্তি ঘটল। যে উপনিবেশ আর কারও পক্ষেই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে এই জাদুদ্বীপ থাকলো অনন্তকালের পাঠকের জন্য।

সাহিত্যিক ধারায় হুমায়ূনের সৃষ্টি বেঁচে থাকবে কী থাকবে না এ বিষয়ে গবেষণা-আলোচনাটাই আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক। হুমায়ূন আসলে নিজের মতোই। নিজস্ব স্বভাব, ক্ষমতা এবং ভালোবাসায় সে নিজের একটা জগৎ নির্মাণ করেছে। যে জগতে সবার জন্যই আনন্দ উপভোগের সুযোগ আছে। সে সহজ-নিজস্ব ভঙ্গিতে গল্প বলেছে। তার সাহিত্য সে তার নিজের মতোই সৃষ্টি করে নিয়েছে।

হুমায়ূন আমার খুব স্নেহভাজন ছিল। সে আমাকে একটা বই উৎসর্গ করেছে, আমিও তাকে একটা বই উৎসর্গ করেছি। তার আকস্মিক চলে যাওয়াটা আমার জন্য হৃদয়বিদারক ছিল। শেষবার যখন ঢাকায় এলো- বাসায় গিয়েছিলাম। মায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় আমার প্রসঙ্গে মাকে বলেছিল- উনি খুব কঠিন লেখেন। বুঝবে না মা। তখনও দেখেছি তার প্রসন্নতাটা একই রকম ছিল তখনও। আমার মনে হয়নি সম্ভাব্য মৃত্যু বিষয়ে সে খুব বেশি চিন্তিত। তখন দেখেছি সে ছবি আঁকছে। ছবিগুলো দেখলাম। সে ছবিগুলোর মধ্যেও একটা প্রসন্নতা বিরাজ করে যেন।

তবে হুমায়ূনের বিশাল জনপ্রিয়তা হুমায়ূনকে ভীষণভাবে ব্যস্ত রেখেছে দিনের পর দিন। তাকে চিন্তা করার পর্যাপ্ত অবকাশ দেয়নি। তার প্রকাশকরাও হয়তো তার আরও যতদূর সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারত- ততদূর হওয়ার ফুরসত দেয়নি। হুমায়ূনের জন্য এটি ক্ষতিকর হয়েছে। আরেকটু অবকাশ পেলে সে হয়তো তার সাহিত্যিক বিকাশ আরও সম্প্রসারিত করতে পারত। সব বড় লেখকই অসন্তুষ্ট থাকে। হুমায়ূন খুব বেশি অসন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ পায়নি। সে তার লেখাকে নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবার সময় ও সুযোগ তার নিজস্ব পাঠকদের মধ্যেই বিলিয়ে দিয়েছে। দিয়েছে জাদুময় এক আনন্দের মধ্য দিয়ে। আগামী দিনে যারা হুমায়ূন ভুবনে পা দেবেন তারাও তাকে প্রিয় করে নেবেন; নির্দ্বিধায় তা বলা যায়।