জহির রায়হানের নীল টয়োটা

চৈত্রের খররোদ মাথায় করে বাতাসে উড়তে উড়তে এসে থামলো
জহির রায়হানের নীল রঙের টয়োটা, রাস্তার ধুলো কুয়াশার মতো
আস্তর বিছিয়ে ঢেকে দিয়েছে নীলরঙ, উইন্ডশিল্ডে আটকে আছে
ওয়াইপারের বেদনার্ত চুম্বন, দরোজা খোলার শব্দ ছড়িয়ে পড়লো
মেশিনগানের ঠা-ঠা আওয়াজ হয়ে, বললেন, এক কাপ চা খাবো।
সিটের ওপর পড়ে থাকা ক্যামেরা আর কাঁচা ফিল্মের রোল দেখে
বললাম, অবশ্যই। তবে যাচ্ছেন কোথায়? সানগ্গ্নাস খুলতেই তার
চোখ থেকে লাফিয়ে পড়লো ঝাঁক ঝাঁক স্বপ্ন, দিকচিহ্নহীন তর্জনী
তুলে বললেন, এই তো এদিকে, কোনো হাসপাতাল আছে নাকি?
আমি তাকিয়ে দেখলাম তার গাড়ির ভেতরে বিধ্বস্ত ঢাকা, ছিন্নভিন্ন
লাশের স্তূপ, আর্তনাদ-গোঙানি, পোড়া সংবাদপত্র, কারফিউ আর
হায়েনা মিলিটারির শক্ত বুটের আওয়াজ জমাট হয়ে লেপ্টে আছে
মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত। কায়েৎটুলির গুলিবিদ্ধ বাড়িটা কাত হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে ড্যাশবোর্ডে, সাপের মতো স্টিয়ারিং পেঁচিয়ে আছে
‘জীবন থেকে নেয়া’র দেড় লক্ষ ফুট পজিটিভ। ঝুলবারান্দায়
তখন চৈতি মেঘের ছায়া, সেখানেই বসলেন, তারপর চায়ে চুমুক
দিয়ে বললেন, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছুঁয়েছে আকাশ, ইকবাল হলের ফ্লোরে
পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ স্লোগান, তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ছে লক্ষ লক্ষ
পোস্টার, রাজারবাগ নত হয়েছে মাটিতে, মধুদা’র চায়ের পেয়ালায়
সাঁতার কাটছে স্বাধীনতার পতাকা। আমি আর কোথায় যাবো বলুন?
এই যে আমার শার্টের পকেটে পঁচিশে মার্চের কালরাত, আর বাঙালির
কাছে ফেরি করবার জন্য অবশিষ্ট আছে রেসকোর্সের উদ্বাস্তু কণ্ঠস্বর।
আমি বললাম, জহির ভাই, আমিও যাবো আপনার সাথে। স্মিত
হেসে জহির রায়হান তার নীল টয়োটার দরোজা বন্ধ করতে করতে
বললেন, এ গাড়ির ভেতর আহত বাংলাদেশ, রক্তক্ষরণে ক্রমশ নিস্তেজ
হয়ে আসছে তার শরীর, এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। কোনদিকে
যাবো? কালো ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে নীল টয়োটা ক্রমশ দূরে চলে
গেলো, এলোমেলো বাতাস ভেঙে আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো
গুলিবিদ্ধ বাঘের বেঁচে ওঠার আকুল কান্না। জহির রায়হান নীল টয়োটায়
বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ, আর ময়মনসিংহে আমার বাসার সামনে
আমি কাকতাড়ূয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম নীল টয়োটার পাহারায়।