আগস্টের একরাত

ইতিহাসের ঘটনা শুধু ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেইসব ঘটনা ইতিহাসের সীমানা পেরিয়ে গভীর মানবিক উপাখ্যানে পরিণত হয়। ‘আগস্টের একরাত’ মানবিক উপাখ্যানের চিরায়ত গল্পকথা, যেখানে জীবন-মৃত্যুর পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে মানুষের জঘন্যতম নৃশংসতা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে রচিত হিউম্যান ট্র্যাজেডির উপাখ্যান ‘আগস্টের একরাত’। লেখক একদিকে গল্প বানিয়েছেন; অন্যদিকে জবানবন্দী উপস্থাপন করে ঘটনার বিবরণ সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে উপন্যাসে সাধু ও চলিত ভাষার ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ভাষার এই দুই ধারা উপন্যাসের আঙ্গিকে ভিন্নতা এনেছে—এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

রাতের শেষ প্রহর

বাইরে প্রবল গুলির শব্দ। চৌচির হয়ে ফেটে যাচ্ছে দিনের প্রথম প্রহর।

সেই শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় বঙ্গবন্ধুর। তিনি বিছানা থেকে নেমে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখেন বাড়ির সামনের রাস্তায় আর্মির গাড়ি এবং ট্যাংক। বাড়ির দক্ষিণ দিকেই রাস্তা আছে। বাকি তিন দিকেই অন্যদের বাড়ি। রাস্তার পাশে আছে ধানমন্ডি লেক। রাতের শেষ প্রহরে ওরা পুরা রাস্তা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বোঝা যায়।

তিনি একমুহূর্ত ভাবেন।

আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধুর করোটিতে ফুলের সুবাস ছড়াতে থাকে। করোটির কোষে কোষে সুবাসের তীব্রতা বাড়ে। তাঁর মনে হয় টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির শিউলি গাছটি অজস ফুলে ভরে আছে। এই মুহূর্তে ওই গাছে একটিও পাতা নেই। শুধুই ফুল। সাদা পাপড়ির সঙ্গে লেগে আছে কমলা রঙের বোঁটা। টুপটাপ ঝরছে শিউলি। টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির চারপাশে শুধু নয়, গ্রামজুড়ে ফুলের গন্ধ ম-ম করছে। এক মুহূর্ত আগে তাঁর শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। পর মুহূর্তে শ্বাস ফেললেন। শ্বাস টানতে গিয়ে টের পেলেন বুকের ভেতর শিউলি ফুলের গন্ধ। আশ্চর্য! এখন তো শিউলি ফোটার সময় নয়। তবে চারদিকে এত গন্ধ কেন?

ডাকলেন, রেণু।

এই ডাকের উত্তর কোথাও থেকে আসে না।

রেণু।

রেণু স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর পৃথিবী তোলপাড় করছে। পাশে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি তাঁকে ডাকছেন তার উত্তর দেয়ার জন্য ভাষা খুঁজছেন রেণু। তিনি কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রতিটি গুলির শব্দ শিরা-উপশিরায় ঝনঝন শব্দ তুলছে। কোন ছোটবেলায় মুখে ভাষা ফুটেছিল তা ভুলে গেলেন তিনি। কি ভাষা শিখেছিলেন তাও মনে পড়ছে না।

বঙ্গবন্ধু আবার ডাকেন রেণু।

তিনি সাড়া দেন না। নিজেকেই বলেন, এই তো আমি তোমার কাছে দাঁড়িয়ে আছি।

কথা বলছ না যে?

সেই তিন বছর বয়স থেকে আমি তো তোমার সঙ্গেই কথা বলছি। অনেক কথা, অনেক। সেজন্য এখন আমি যা কিছু বলছি তুমি শুনতে পাচ্ছ না। কারণ, আমাদের চারদিকে শুধুই গুলির শব্দ। আমরা আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না।

তখন বেজে ওঠে টেলিফোন। সেই শব্দে দুজনে চমকে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু বাম হাত বাড়িয়ে ফোনের রিসিভার ওঠান।

হ্যালো।

আমি সেরনিয়াবাত। আমার বাসা দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। বাড়ির চারদিক থেকে গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। আর্মির গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির গেইটে।

লাইন কেটে যায়।

তিনি ফোন করেন বাড়ির নিচতলায় রিসেপশনিস্ট মহিতুল ইসলামকে। ফোন ধরে টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন।

হ্যালো।

স্যার, আমি মতিন।

মহিতুল কোথায়?

তার ঘরে স্যার। ঘুমিয়ে পড়েছে।

ডাক।

আবদুল মতিন দ্রুত গিয়ে মহিতুলকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য গায়ে ধাক্কা দেয়। তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলেন, কি হয়েছে?

প্রেসিডেন্ট আপনাকে ফোনে ডাকছেন।

মহিতুল টেলিফোন ধরে।

স্যার, আমি মহিতুল।

জলদ গম্ভীর স্বরে তিনি দ্রুতকণ্ঠে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন লাগা।

কথা বলে তিনি রিসিভার রেখে দেন।

রেণুর উদ্বেগ কণ্ঠ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কি বলেছেন তা তিনি শুনেছেন। তারপরও জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ সময়মতো পৌঁছাতে পারবে তো?

বঙ্গবন্ধু নিশ্চুপ থাকেন। ভাবেন, ঠিকমতো পৌঁছালে বাড়িটা ছোটখাটো রণক্ষেত্র হয়ে না যায়। আর কি করবেন তিনি? দেখা দরকার মহিতুল পুলিশ লাইনে কথা বলতে পেরেছে কিনা। তিনি একমুহূর্ত ভাবেন। তারপর দরজা খোলার জন্য সিটকিনিতে হাত দেন।

রেণু আঁতকে উঠে কাছে এসে বলেন, দরজা খুলছো কেন?

নিচে যাব।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন