প্রস্তুতিবিহীন যাত্রা

অনেকটা প্রস্তুতিবিহীনভাবে চলে গেল আমার বন্ধু খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আমাদের কালের প্রায়-অশনাক্ত এক কাব্যনায়ক। আমার সহপাঠী ও বহুমাত্রিক এক সৃষ্টিযাত্রী। আজ থেকে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। আমরা দু’জনেই ভর্তি হয়েছিলাম অনার্স প্রথম বর্ষে। তখন তার পদচারণা ছিল প্রায় নিঃশব্দ। ক্লাসে নিরীহ ও মনোযোগী এক ছাত্র। সাধারণত তরুণ কবিরা যে-রকম আউলা-ঝাউলা মাস্তানি চেহারা ধারণ করে থাকে, তেমন নয়। আসলে সেই শুরুর সময়ে আশরাফ যে কবিতা লিখত, সেটিই আমাদের কারও জানা ছিল না। মোতালেব, ওয়ালি, ফয়েজ ও আশরাফ মিলে ছিল এক নিবিড় বন্ধু-চক্র। এর মধ্যে মোতালেব আর আশরাফ অকালেই স্মৃতি হয়ে গেল। এই চার বন্ধুর কেন্দ্রে ছিল আশরাফ। তার ক্লাসনোট, রুটিন, জীবনযাপনের শৃঙ্খলা ইত্যাদির অনুসারী ছিল বাকি তিনজন। একসঙ্গে ক্লাস করা, খাওয়া-দাওয়া, হোমওয়ার্ক, লাইব্রেরি-ওয়ার্ক, এমনকি ভ্রমণবিহারেও অভ্যস্ত ছিল চার সুহৃদ। আমিও যে তাদের দলে মাঝে-মাঝে যোগ দিইনি এমন নয়। কিন্তু যে প্রস্তুতিময় নিয়মের নিগড়ে হাঁটাচলা করত তারা সবাই, তা আমার পক্ষে হয়ে ওঠেনি। তাই এই চার বন্ধু মহাবিদ্যালয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বেছে নিলেও শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে ধারাবাহিকভাবে এই পেশায় নিবিষ্ট থাকা সম্ভব হয়নি। এই ধারাবাহিকতার সুফল যে দু’জন তুলনামূলকভাবে বেশি পেয়েছে তারা আশরাফ ও ফয়েজ সিরাজ। বেশ আগেই ফয়েজ সিরাজ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছিল। তারও বহু পরে মাত্র এ-বছর মে মাসে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিযুক্ত হলো আশরাফ। আশরাফ তার যোগ্যতার মাপকাঠিতেই এই পদে বৃত হয়েছিল। কেননা তার কর্মে ও জীবনায়নে সে এ-ধরনের পদ ও মর্যাদার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি একাডেমিকভাবেই সম্পন্ন করেছিল। যেমন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজি ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে পড়াশোনার পর ডিগ্রি লাভ, অধ্যাপনা করার ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন, হলে প্রভোস্ট হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, ইংরেজি বিভাগে প্রফেসর ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন ইত্যাদির পাশাপাশি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সাম্প্রতিক সাহিত্যের দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রবণতাগুলো যথাসম্ভব অনুধাবন ও পুনর্মূল্যায়ন। সেই সঙ্গে উল্লেখ্য নতুন কাব্যান্দোলনের মুখপত্র ও তারই সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘একবিংশ’। আমাদের যে-ক’জন বন্ধু একাডেমিক সিদ্ধতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও শৈল্পিক দ্রোহিতায় নিদ্বর্িধায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে, আশরাফ তাদের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম।
অথচ ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ঘরে-বাইরে-বিশ্ববিদ্যালয়ে আশরাফ ছিল এক নিয়মতান্ত্রিক সুগৃহী। বলা বাহুল্য, আমার এই বন্ধুটি গার্হস্থ্যধর্মেও আমাদের সবার চেয়ে এগিয়ে। ছাত্রাবস্থাতেই তার সংসারের শুরু। মাত্র বছরখানেক আগেই পরলোকগমন করেছেন তার সেই সুযোগ্য সহধর্মিণী। সংসারধর্ম তুলনামূলকভাবে আগে শুরু করার কারণে যথাসময়ে ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারার কৃতিত্বও প্রাপ্য এই মহিয়সীর। সে যা-ই হোক, আজকে আমি আমার যে সৃষ্টি-সহযাত্রী আশরাফের কথা বলতে শুরু করেছি, সেই আশরাফের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরে।
মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই আশরাফ মাঝে মাঝে বলত, সে-ও কিছু কবিতা লিখছে। তবে তার মান সম্পর্কে নিশ্চিত নয় বলে সে তা ছাপতে দিচ্ছে না। একদিন আমাকে একটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের কবিতা দিয়ে বলল, ‘পড়ে দেখ আর তোমার মতামত দাও।’ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির করিডোরে দাঁড়িয়ে আমি কবিতাটি পড়লাম। নিটোল অক্ষরবৃত্তে লেখা তিরিশি ঘরানার এক সুপাঠ্য কাব্য-ভাষ্য। বর্ণনা ও চিত্রকল্প তৈরিতেও বেশ মুনশিয়ানা আছে। আমি বললাম, ‘তুমি কি অক্ষরবৃত্ত পড়ে শিখেছ, না শুনে শিখেছ?’ সে বলল, ‘না পড়ে আমি কিছুই শিখি না।’ অন্যান্য ছন্দ সম্পর্কেও আলোচনা করে বুঝলাম ছন্দে ও অলঙ্কারশাস্ত্রে মোটামুটি ভালো পাঠ ও প্রস্তুতি নিয়েই আশরাফ কবিতা লিখতে এসেছে। না, তাকে ঠেকানো যাবে না। আমি বললাম, ‘কবিতাটি আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় দেব।’ খুশিতে নেচে উঠল তার চোখ। ‘ছাপবেন তো সায়ীদ ভাই?’ আমি বললাম, ‘সে দায়িত্ব আমার।’ কবিতাটি সেবার ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তারই সঙ্গে সঙ্গে সত্তরের দশকে আবির্ভূত হলো এক শক্তিমান কবিকর্মী। কিন্তু না, সাহিত্যের দিক থেকে কৌশলগত কারণে আশরাফ তার কাব্যিক আবির্ভাবকে ‘সত্তর’ থেকে ‘আশি’তে স্থানান্তরিত করল। বিষয়টি আমাদের কাব্যজগতে এখনও বেশ কৌতূহলের কারণ হয়ে আছে। কোনো কোনো সময়ে এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তার যুক্তি অগ্রাহ্য করার মতো নয়। সত্তরের দশকের শুরুতে বা সারা সত্তর দশকজুড়ে মাঝে মাঝে তার কবিতা প্রকাশিত হয়ে থাকলেও আসলে সে স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী অঙ্গীকৃত কবি ও আন্দোলনকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আশিতেই। উপরন্তু বয়সী তারুণ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার একটি দুর্দমনীয় জেদও তার মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখেছি। আশিতে এসে বাংলাদেশের কবিতার ধারা একটি প্রমিত বৃত্তে ও স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছিল। আশরাফ তার নান্দনিক পঠন-পাঠন ও বীক্ষণ দিয়ে তাকে শনাক্ত করেছিল। তাই সে তার কবিতার এক নতুন স্বর ও কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিল সযত্ন লালনে ও তর্কাতর্কে। এ-সময়ে আশরাফ কবিতার পাশাপাশি আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তিরিশোত্তর কাব্যাঙ্গিক, শেকড়সন্ধান, লোকসাহিত্য, নব্যজসীমিজম, মিথ-লিজেন্ডসহ নানা পরিপ্রেক্ষিতকে আত্মস্থ করে কবিতার স্ব-কৃত চেহারা দাঁড় করার চেষ্টা করেছে। গদ্য, পদ্য, বাংলা, ইংরেজি, বক্তৃতা, নান্দনিক প্রতিবাদ ইত্যাদি নানা পথে নিজের সৃষ্টিসত্তার অবয়ব নবায়ন করার চেষ্টা করেছে। সে প্রচেষ্টা যখন সুফলা হয়ে উঠছিল, সেই মুহূর্তেই হঠাৎ বিনা নোটিশে নিভে গেল তার সৃষ্টিপ্রভা। বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার জন্য এ ক্ষতি সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ভালো কবির সন্ধান হয়তো পাওয়া যায় অনেক, কিন্তু একজন মেধাবী, মননশীল ও নিত্যনবায়নপ্রবণ কবির দেখা সহজে মেলে না। মনে রাখা প্রয়োজন, আশির পরে আশরাফ সচেতনভাবেই নিজের আবির্ভাবকে বাংলা কবিতার জগতে অনিবার্য করে রাখতে নানাভাবে কাজ করে গেছে। এই সময়ের আশরাফ ষাট-সত্তর দশকের ভদ্র ও অন্তর্মুখী কোনো ব্যক্তি নয়। বরং বিশ্লেষণশীল, প্রতিবাদী, তার্কিক ও আপসহীন এক নন্দনযাত্রী। কালে কালে সে ঢাকার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আবির্ভূত হলো। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে তার এই সংগ্রাম অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকতাও তাকে তার প্রাপ্য দেয়নি যথাসময়ে। এমন এক মেধাবী কবি, প্রবন্ধকার, ভাষাতাত্তি্বক, অনুবাদক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ইত্যাদি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাংলাদেশের কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান [যেমন বাংলা একাডেমী] সম্মানিত করেনি কোনো পুরস্কারে। আমাদের প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার-পদক এমন সব পাত্রে দেওয়া হয়, যার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আবিষ্কার মাঝে মাঝে অসম্ভব হয়ে পড়ে। গতবার বাজারে সরব গুজব ছিল, আশরাফ কবিতায় পুরস্কার পাচ
্ছে। পেলে কার কী ক্ষতি হতো জানি না, অন্তত আজ তার তিরোধানের পর আমরা নিজেরাই সম্মানিত বোধ করতাম।
মানুষ হিসেবে আশরাফ যেমন বন্ধুবৎসল, তেমনি মানবিক ও অনাপসী। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। সুযোগ পেলেই আমরা একে অপরের রচনার নানা প্রবণতা নিয়ে তর্ক করতাম। আমার ‘শুক্লা শকুন্তলা’ কাব্য ও ‘ফ্লেমিং ফ্লাওয়ার্স : পয়েটস রেসপন্স টু দ্য ইমার্জেন্ম অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থ দুটির সুদীর্ঘ আলোচনা করেছিল আশির দশকেই। এগুলো শেষ পর্যন্ত তার গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে। সমকালের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের পাঠ ও তার করণীয় নির্ধারণে এভাবেই আশরাফ সতর্ক পুনর্পাঠে স্বেচ্ছা-নিযুক্ত হতো। এটি ছিল শিল্পী হিসেবে তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিরও পরিচায়ক। এই দৃষ্টি দিয়ে সে যা দেখেছে ও লিখেছে, তার প্রায় সবটাই অমূল্য। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তার গ্রন্থসংখ্যা পঁচিশ কি ছাবি্বশ। বাংলাদেশের ও বাংলা ভাষার কবিতায় পাশ্চাত্য প্রভাবের ওপর আশরাফ যে থিসিস করেছে, সেই একাডেমিক গ্রন্থটিও সৃষ্টিশীল অন্তর্বীক্ষণ ও তুলনায় ঋদ্ধ। অর্থাৎ আশির-পরবর্তী আশরাফ যে কোনো বিচারে আমাদের সমকালীন সৃষ্টিশীলতার জন্য এক অপরিহার্য চেতনা। নিজের এই শক্তি সম্পর্কে অনবহিত ছিল না আশরাফ। তাই অতিকথনের ছলে তার রহস্যমধুর বক্রোক্তি : ‘পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি, অহংকার আমার কবিতা’। জানি, তার পরে আরও কবি আসবে, কিন্তু যে অহঙ্কারের স্বঘোষিত নাম খোন্দকার আশরাফ হোসেন, হুবহু তেমন কবি আর আসবে না দূরতম ভবিষ্যতেও। আশরাফের এই অনন্য সৃষ্টি-অহঙ্কারকে বুঝতে হলে বারবার পাঠ করতে হবে তার অসামান্য কবিতা ও গদ্যবয়ান। আমাদের পাঠ ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই বারবার জন্ম নেবে আশরাফের ব্যক্তিতা ও সৃষ্টিদ্রোহিতা।