নান্দনিক সৃষ্টিসত্তা

দূরত্বটা যে কত কম বা কত বেশি, তা মাপার কোনো উপায় নেই। হয়তো তা মুহূর্তমাত্র, হয়তো তা অনন্তকাল। যে ভুবনে হুমায়ূন প্রবেশ করেছে, তা থেকে ফেরারও কোনো উপায় নেই। স্বীকার্য, হুমায়ূন সেখানে গেছে আমাদের সকলের আগে। যাব; আমরাও যাব। কিন্তু কখন যাব, কীভাবে যাব আমরা জানি না। শেষ পর্যন্ত তার যুদ্ধটা চলছিল ঠিকই; কিন্তু যে যুদ্ধে আজ পর্যন্ত জেতেনি কোনো মানব-মানবী, তেমন একটি অসম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সীমিত জীবন থেকে মহাজীবনে প্রবেশ করেছে হুমায়ূন। আমাদের সকলের সর্বোচ্চ কামনা ও প্রার্থনা অপ্রতুল প্রতিভাত হয়েছে। তাঁকে যেতে হয়েছে এমন এক লোকে, যেখানে তাঁর পার্থিব প্রিয়জন বলতে আর কেউ নেই। আমাদের এবারের প্রার্থনা, সেখানে করুণাময় স্রষ্টার আনুকূল্যধন্য হোক এই মানবতাবাদী মহান লেখক, যার জীবনসাধনা ও কর্মসাধনা মানবজাতির সামগ্রিক মাঙ্গলিকতায় পূর্ণ সমর্পিত। আসলে পৃথিবী নামক এই নন্দিত নরককেই হুমায়ূন রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল এক বাসযোগ্য স্বর্গে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার ৩২২টি গ্রন্থ, আর আছে বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা। হুমায়ূন তার যাপিত জীবনের নানাকৌণিক উপলব্ধি পুনর্নির্মাণ করেছে তার গল্প-উপন্যাস-নাটকসহ সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে। আজ বাংলা ভাষাভাষী সর্বাঞ্চলে হুমায়ূন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথক। সহজ অথচ জাদুকরী এক বর্ণনাশৈলী তাঁকে করে তুলেছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও মনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম। অদূর ভবিষ্যতে তাঁর জনপ্রিয়তার স্থান আর কেউ দখল করতে সমর্থ হবে, এমন সম্ভাবনাও সহজদৃষ্ট নয়। চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা, চিরকাল অসাম্প্রদায়িক, চিরকাল সত্যসন্ধ হুমায়ূন কোনোদিন আপস করেনি কোনো ক্ষমতাপ্রভু তথা প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে। তাঁর রচনার নান্দনিক মূল্যায়নও অপেক্ষাকৃত কম। অথচ এ নিয়ে তাঁর মুখে কোনো আক্ষেপ শুনিনি। বরং নিন্দুকের প্রতি সপ্রশংস কটাক্ষপাতই ছিল তার রসঘন অস্ত্র। আমি তাকে চিনি সেই ১৯৬৭ থেকে, যখন আমরা দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ও হলজীবনে প্রবেশ করি। কবিতা লিখতে শুরু করেও শেষ পর্যন্ত থিতু হলো কথাসাহিত্যে, পরে নাটক ও সিনেমায়। আসলে সফল লেখক হিসেবে এটি ছিল তাঁর সচেতন আত্মশনাক্তি। আজ এক্ষেত্রে তাঁর অর্জন প্রত্যাশারও অধিক। তবে মানুষের সব প্রত্যাশাই তো আর পূরণ হয় না। এমন একটি হলো চাঁদনী পশর রাইত। না, হুমায়ূন তেমন রাতে পরপারে পাড়ি জমায়নি। তবে এ কথা তো সত্য, তাঁর পুরো জীবনটাই সাফল্যের পূর্ণিমায় উদ্ভাসিত। কালে কালে তাঁর সাহিত্যেরও যথার্থতর বিচার আর পুনর্পঠন হতে থাকবে। ভাবীকাল অবশ্যই হুমায়ূনকে তাঁর প্রাপ্য নান্দনিক স্থানটি দেবে। হুমায়ূনের দ্বিতীয় কামনাটি প্রকৃতিগত বিচারে সামষ্টিক ও সামাজিক। সুস্থতাপ্রিয় হুমায়ূন তার অতিপ্রিয় নুহাশ পল্লীতেই একটি ব্যতিক্রমী ওষধি বাগান প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারপর বছরখানেক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হুমায়ূন আমেরিকায় গিয়ে এই কালব্যাধির হিংস্রতা ও তার চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা বিশেষভাবে টের পেয়েছিল। তাই এই বাংলাদেশেই সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অর্থায়নে এমন একটি সর্বাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল, যেখানে ধনী-গরিব সকলেই সমভাবে চিকিৎসা-সুবিধা পাবে। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর পক্ষে তা করা হয়ে উঠল না। তিরোধানের পর তাঁর অগণিত ভক্ত, অনুরাগী আর সরকারি-বেসরকারি তাবৎ উদ্যোগের সমন্বয়ে আমরা কি তাঁর স্মৃতিতে তাঁরই স্বপ্নাশ্রিত ‘হুমায়ূন ক্যান্সার হাসপাতাল’ বা তজ্জাতীয় একটি অনন্য আরোগ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি না? আমার মতে, সেটিই হবে জাতীয় স্তরে তাঁর প্রতি আমাদের স্থায়ী শ্রদ্ধা। আসুন, আমরা তাঁর এই অসমাপ্ত স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করি। চিরজীবী হোক হুমায়ূন আহমদ