কেন লিখি

কেন লিখি? এটিকে যদি একটি গ্রাহ্য প্রশ্ন ধরা হয়, তাহলে আমি পুরোপুরি নিরুত্তর। এই ষাটোর্ধ্ব জীবনেও এ নিয়ে কোনো মীমাংসায় পৌঁছুতে পারিনি। বাকি জীবনে যে পারবো, এমনটিও আশা করি না। তবে দায় সারার জন্যে দিতে পারি এক বৈপরীত্যমূলক উত্তর। আর সেটি হচ্ছে, কারণেও লিখি, অকারণেও লিখি।

কারণে লিখি বললে কারণগুলো অন্ততপক্ষে তালিকায়িত করার প্রশ্ন আসে। আর অকারণে লিখি বললে তার কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না। প্রায় চার যুগ আগে একবারে কবিতাকারে এই কারণগুলো বিবৃত করার চেষ্টা করেছিলাম। আজ তার কোনো কপি আমার হাতে নেই। থাকলে ভালো হতো এই যে, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আরো কিছু কথা যোগ করা যেতো। এখন তার কোনো সুযোগ নেই। বরং এখন হয়তো এমন কথা বলতে পারি যা আগে ঠিক ভিন্নরূপ বলেছিলাম। অবশ্য তার জন্যেও কৈফিয়ৎ আছে।

বয়স ও দিনযাপনের বাঁকে বাঁকে একজন ব্যক্তি ও কবির কাব্যভাবনা তো পাল্টে যেতেই পারে। আমারও যে যায়নি এমন নয়। এখন আমি ভাবি কিভাবে জন্ম নেয় একটি আনকোরা কবিতা। বিস্ময়ের গভীরতম উৎস থেকে, নাকি ব্যাখ্যাহীন আকস্মিকতা থেকে? যেভাবেই হোক, উৎসজাত কবিতাটি পূর্ণ কবিতা হিসেবে বিকশিত করার প্রক্রিয়াটি যে সচেতন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার ক্ষেত্রে সচেতন-অবচেতন-অচেতনে বা অন্যচেতনের এই ধ্বনি-দৃশ্যময় এই উচ্চারণ-ব্যঞ্জনা শুরু হয়েছিল আসলে শৈশব থেকেই। আমার এখন ধারণা, ‘অনুপ্রাণিত বোধের সযতœ, সশ্রম ও সচেতন নির্মাণের নাম কবিতা। অচেতন, অবচেতন বা অন্যচেতন যে উৎস থেকেই উৎসারিত, রচিত বা নির্মিত বা নিষ্কৃত হোক, কবিতা মাত্রেই চেতন কবিতা।’

সে যা-ই হোক, আমিও এখানে কারণগুলো তালিকায়ন না করে যতোদূর সম্ভব অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংক্ষেপে বর্ণনা করার চেষ্টা করবো। আর তার পুরোটাই যে স্মৃতিনির্ভর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

গ্রামের পাঠশালা, যাকে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় বলি, তাতে ভর্তি হয়ে বছর দুই যেতে না যেতেই পরিচিত হই ছন্দবদ্ধ বাণীর সঙ্গে। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বা আমাদের ছোটনদী এঁকেবেঁকে চলার কথা। শিশুমন আনন্দে নেচে উঠলো, আর একপায়ে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যেস শুরু। কিংবা স্কুল ছুটির পরপরই সামনের ক্ষীণ¯্রােতা নদীতে নেমে তোলপাড় করা শুরু করলাম। সেই ফাঁকে কখন আমজাম, খালবিল, নদীনালা, চড়–ই, শামুক, লাটিমসহ প্রতিদিনের দেখা বিষয়গুলো নিয়ে প্রায় খেলাচ্ছলে পদ মেলাতে শুরু করেছিলাম টের পাইনি। আমার ছোট্ট খাতার নানান পাতায় এসব পদ লিখিত হলো। আর বিপদ হলো তাতেই। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন সেই খাতা আগাগোড়া উল্টেপাল্টে দেখলেন। জানি, এর পরেই সেই প্রিয় শাস্তি আসবে। আমাকে হয়তো স্যারের নির্দেশে একপায়ে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘণ্টাখানেক। আর তাতে তো আমার আপত্তি নেই। এ-তো আমাদের এক প্রিয় খেলা।

কিন্তু স্যার আমার পিঠে ¯স্নেহের থাপ্পড় দিতে দিতে বললেন, ‘সাবাস, তুই তো দেখি এক ক্ষুদে কবি রে।’ বলেই তিনি আমার ‘মিথ্যা বলার ফল’ শীর্ষক বাঘ-রাখালের কাহিনীনির্ভর লেখাটি পাঠ করে শুনালেন সবাইকে। বললেন, মিল-টিল মোটামুটি চলে, তবে কবিতার ভেতর ছন্দ প্রয়োগটা ভালো করে শিখে নিতে হবে। তবে তুই যে একদিন কবি হবি, আমি নিশ্চিত। বলে রাখা ভালো, স্যার নিজেও কবিতা চর্চা করতেন। স্যারের এই মোহন প্রশ্রয় আমার লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ।

নিজের ভেতরে যে কারণটি ছিল সেটি অবশ্যই এক ধরনের সৃষ্টিশীল অনুকারিতার। যে গাছ দেখছি তুলির বদলে কথা দিয়ে তাকে আঁকাতেই আমার আনন্দ। অর্থাৎ যা কিছু দেখছি বা অনুভব করছি তার কথাচিত্র, বাণীচিত্র বা ছন্দচিত্র তৈরি করা। এ যেন এক অন্তহীন খেলা। খেলা আর লেখা, লেখা আর খেলা। তাই বলতে হচ্ছে করে, খেলি বলেই লিখি, লিখি বলেই খেলি।

এভাবে চলতে চলতে আরো কিছু কারণ সামনে এস দাঁড়ায়। একসময়ে বুঝতে পারি আমার লেখাটি ভালো হোক মন্দ হোক, আমার মতোই হতে হবে। অর্থাৎ থাকতে হবে আমি-মুদ্রার ছাপ। এ-বড় কঠিন ব্যাপার। তবু সেই চেষ্টা থেকে বিচ্যুত হওয়ার উপায় নেই। তার পর আসে ব্যক্তি-আমার কারণের পথ ধরে সমষ্টি-আমার কারণ। সমষ্টি আমি মানে আমার সংশ্লিষ্টতা অন্যের সঙ্গে। অন্য ব্যক্তি, অন্য গোষ্ঠী, অন্য জাতি আর সবশেষে গোটা মানবগোত্রের সঙ্গে। তখন আমার লেখার প্রকরণের পাশাপাশি বিষয়টাও গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। রচনায় নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয় মানবিকতা। আমর রচনার অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষ। মানুষের দুঃখকষ্ট, অপূর্ণতা, বিত্তবৈভব বা চিত্তসৌন্দর্য দেশকাল ও সীমানা পেরিয়ে আমার লেখার নিরীক্ষাপ্রবণ কারণ হয়ে ওঠে। এই নান্দনিক ও মানবিক সৌন্দর্যের অন্বেষণই আমার এই সময়ের লেখালেখির মুখ্য উৎস। আমি যেমন চলছি একলা, তেমনি চলছি সকলের সঙ্গেও। যে ডাক শোনে তার সঙ্গে আমি তো অবশ্যই আছি, যে ডাক শোনেনি তার সঙ্গেও আমি বিযুক্ত নই। আসলে এই যুক্ততাই আমার লেখালেখির আসল মুক্ততা।