কষ্ট (সবুজ সার্ট )

আর কারও জন্য নয়
শুধু আমার শৈশবের সেই সবুজ শার্টটার জন্য
খুব কষ্ট হয়-
আহারে শার্টটা যে এখন কোথায়,
আমার সমস্ত শৈশবের বাগান ঝোপঝাড়
আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে
সেই শার্টটির পুরো দশটি বোতাম,

বোতামহীন শার্টটার ফাঁক গলে
রৌদ্রের ক্ষরতাপ আলো ক্ষয়িষ্ণু বাতাসে
আমার নধর শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম
সবুজ আস্তিনটা কি যে মমতায় মুছে দিত

কাঁচপোকা ব্যাঙ্গাচি ছেঁকে ধরা মাছ বড়শি সুতো
খুচরা পয়সা আধখাওয়া বিস্কুট বিস্কুটের গুঁড়া
আমার ছোট্ট পৃথিবীর অমূল্য এই সবকিছু
এক সাথে নির্দ্বিধায় জায়গা করে নিত
শার্টটার পকেটে।

আমার চামড়ার ওপর আর এক স্তর চামড়ার মতো লেগে থাকা
আজন্মের আধোয়া সেই শার্টটার গায়ে
সহপাঠীরা চিমটি কেটে ময়লা তোলার রসিকতা করত
ব্যথা পেতাম আমি, ব্যথা পেত সেই শার্ট।

আকাশের বুকে বনবন করে প্যাঁচ কষছে
এক একটা নতুন দোবাজ ঘুড়ি
আমার লোভাতুর চোখের ঝকঝকে দৃষ্টি
লেপ্টে থেকেছে ওই দূর আকাশে ওড়া ঘুড়ির বুকে,
পরাজিত কাটা ঘুড়ি
মাতাল বাতাসে সহসা উড়ে যায় দিগবিদিগ
ঢেউ খেলে ধীরে ধীরে নেমে আসে ঘুড়ি মাটির টানে,

আর দুর্বল রুগ্ন এক রত্তি সেই আমি
পাটকাঠি হাতে ছুটে যাই সেই ঘুড়ির পিছে-
পিছে ফেলে যাই দিঘির বাঁধানো ঘাট
কুয়াপাড়া মাসীর উঠান জুম্মাঘর, ভাঙা মন্দির
কাঠের ব্রিজ রেলের রাস্তা,
খয়ে যাওয়া পথের উঁচু ইটের সাথে
হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি
রাঙা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে
আমার সবুজ শার্ট
উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাতে ঝেড়ে আবার ছুটে গেছি
ঘুড়ির পিছু পিছু
বিস্তীর্ণ দিগন্তে থেমে পড়ে থাকা সবুজ ধানক্ষেত
তার মাঝখান দিয়ে আর এক টুকরো সবুজের মতো
ছুটতে ছুটতে ছুটতে আমি পৌঁছে গেছি
সাপের জঙ্গলে-
জঙ্গলে বেতের লকলকে কাঁটায়
আমার পুরো শৈশবজুড়ে
সেই একটা মাত্র শার্ট
কতবার যে ছিঁড়ে গেছে,
অথচ সেই কাটা ঘুড়িটা আমি
কোনো দিনও ধরতে পারিনি।

আমার আগেই বাঁশের লম্বা লগি হাতে
শক্ত-সামর্থ্য বালকেরা
পৌঁছে গেছে সাপের জঙ্গলে।

বুকের মাঝে দলাপাকানো কষ্টগুলো
সেদিন সেই ছেঁড়া শার্টটা ছাড়া
আর কেউ বোঝেনি।