আমি তো আমার গল্প বলেছি তুমি কেন কাঁদলে

image_1399_213664বাড়িটা একেবারে আগের মতোই আছে। ইটের ওপরে পলেস্তারা দেয়া দেয়াল মলিন। রুক্ষ্ন, কর্কশ রোদ্দুর এসে রোজ সকাল-বিকাল সেখানে দাঁত বসিয়ে যায়। কিন্তু অযত্নে মলিন নয়। বাড়ির মানুষের ইচ্ছে অনুযায়ী বাড়িটা এই রকম। সবচেয়ে যেটা চোখে লাগে, তা হলো চারপাশে বাড়িটার বাকি অংশ নিয়ে বড়সড় দশতলা বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে। আধুনিক, মজবুত নকশায় বাড়িগুলো বেশ নজরকাড়া। মেটাল প্লেটে কাঠের ফ্রেমে জ্বল জ্বলে নামের ঘোষণাগুলো জানান দিচ্ছে তাদের মালিকের গর্বিত পরিচয়_ ‘অরিন্দম’ ‘স্বপ্নআবাস’ ‘শুকতারা’। সেগুলো ছেড়ে এগিয়ে গেলে একটু কোণার দিকে দাঁড়িয়ে একটি দুই ধারের বারান্দাওয়ালা দুইতলা বাড়ি। সাদাসিধে পরিচ্ছন্ন, উন্নত চেহারায় একটা পুরনো আভিজাত্য যেন বাড়িটার গেরুয়া রঙের দেয়ালে মিশে আছে। নিরাভরণ কাঠের চওড়া তক্তায় ফুটে আছে তার আত্মপরিচয়_ স্বাধীন। বাড়ির নামকরণের সময় কতরকম আলোচনা, আনন্দ-অনুভূতি নিয়ে হাশেম সাহেবের ছেলেমেয়েরা একটা পুরোদিন মেতে উঠেছিল। একমাত্র মেয়ে যখন তার বাড়ির দেয়ালে ঝুলিয়ে দিল ‘স্বাধীন’ নামের ঘোষণা সেদিন সবাই মিষ্টিমুখ করে মুগ্ধতার পাশাপাশি স্পর্শ করেছিল শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। তারপর চলে গেছে দীর্ঘ সময়ের নীরব প্রবাহ।
স্বাধীনতার দশ বছর পরে বাড়িটা বদলে ফেলার চিন্তা করেছিলেন হাশেম সাহেব। স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না। দুই ছেলে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সেই অপরাধে শেষের দিকে তাকে ধরে নিয়ে যায় সরকারি লোকজন। একেবারে সেটা শেষ দিনগুলোর অন্তিমে সাদেক সাহেবের চাপরাশি তাকে বন্দিদশা থেকে বাঁচিয়ে বাড়িতে পেঁৗছে দেয়। মুক্ত স্বাধীন দেশে তারও পনেরো দিন পরে ছেলেদের ফিরে পান তারা। ফিরে পেলেও ভগ্ন স্বাস্থ্য সাদেক সাহেব অফিসে যোগ দিয়েছিলেন। ঘরবাড়ি মেরামত করায় সহায়তা তেমন পাননি। স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেন।
বাড়িগুলো বানাতে খুব কষ্ট হয়নি সাদেক সাহেবের। দুই ছেলে দ্রুত উন্নতি করেছে।
বাড়ি বানাতে অনেক সময় লাগে। সাদেক সাহেবের ছেলেরা পরিশ্রমী ও সৎ। তারা আশ্বস্ত করল বাবাকে। মুক্তিযুদ্ধের লালিত স্বপ্ন নিয়ে গড়ে তুলল মা-বাবার জন্য স্বপ্ন-আবাস। না, সাদেক সাহেবের বাড়িতে অতি উচ্ছাঙ্ক্ষার ব্যাধি স্পর্শ করেনি। একটি বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিল ছেলেরা। বলল_ আমাদের প্রয়োজন মিটে গেলেই চলবে আব্বা আপনি কি বলেন?
_’তোরা যা ভালো বুঝিস তেমনই হলে চলবে।’ তার মৃত্যুর পর কেটে গেছে দীর্ঘ কুড়ি বছর। রাস্তার দিকে জানালা খোলা। শেষ বেলায় সূর্য ডোবার সময় লাল গেরুয়া রং এসে নরম আলোর আদর ছুঁইয়ে দিয়ে যায়। বারান্দায় বসে সন্ধ্যার নিঃসঙ্গতাকে নিঃশ্বাস দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় রুবাইয়াত। দিনগুলো কাজে আর ব্যস্ততায়, স্বপ্নে আর দুঃস্বপ্নে কেটে যায়। সামনের এক টুকরো সবুজ জমিতে বাড়ির ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলছে। পাশের টিপয়ে মেলে রাখা দৈনিক সংবাদপত্রের রাশ। রোজ এখানে বসে কাগজগুলোয় তন্ন তন্ন করে চোখ বোলায় রুবাইয়াত। কাগজগুলোয় দেশের-বিদেশের শত শত খবর। আশার-নিরাশার, জন্ম-মৃত্যুর, হত্যাকা- আর বিচারের। মা এসে মাথায় হাত রেখে কি যেন ভাবেন।
_মা, কিছু বলবে? রুবাইয়াত জানতে চায়।
মা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন, _ঘরে যাবি না?
_যাচ্ছি মা। রঞ্জু ভাই, রফিক ওরা সবাই ফিরেছে?
_হ্যাঁ, আয় তাহলে। ঘরের ভেতরে ফিরে গিয়ে একটু দাঁড়াল আসেফা। এই ঘরের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে ঝোলানো একটা বড়সড় বাঁধানো ছবি। স্বচকিত গন্ধরাজ ফুলের গুচ্ছ দিয়ে সাজানো খোঁপায় অপরূপ এক তরুণীর খোঁপার ছবি।
ছেলেবেলা থেকেই রুবাইয়াত গন্ধরাজ ফুলের নেশায় একেবারে বিভোর। মোটা মোটা সাদা সাদা শুভ্রতার মাখন মসৃণ পাপড়িগুলো যেন স্বপ্নের মতো সুন্দর। গোপন ভালোবাসার মতো সুরভিত যেন। রুবাইয়াতের জীবনে ভালোবাসার সি্নগ্ধ আবির্ভাবের মতোই গন্ধরাজের স্তবক তাকে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিত।
রুবাইয়াতের স্মৃতিতে সে সময়টা ছিল ভালোবাসার আর স্বপ্নের। যুদ্ধের আর নিষ্ঠুরতার।
এক শহরে, এক মিছিলে এক দুর্গম ভালোবাসর রাজ্যে দেখা হয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর বিস্ময় আর কি থাকতে পারে? নাইবা হলো জীবন গড়া।
সরকারের বড় চাকরি করেও আরাম পাননি সাদেক সাহেব। শান্তি সুবোধ ছেলেমেয়েরা পথে পথে গান গেয়ে মুক্তির গান ছড়িয়ে দিত_ কা-ারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। সময়ের সেই পারাবার অতিক্রম করে এ গান যেন নিয়ে চলেছে ঢেউয়ের ওপারে।
পাড়ার ছেলেমেয়েরা এবার স্বাধীনতা উৎসবে রচনা প্রতিযোগিতা করছে। সবার আবদার রুবাইয়াত আপাকে রচনাগুলো যাচাই করে দিতে হবে। হাসিমুখে দায়িত্বটা নেয় রুবাইয়াত।
বিকালে লেখাগুলো নিয়ে পড়া শুরু করে রুবাইয়াত। বেশ লেখে আজকালকার ছেলেমেয়েরা। দেশকে ভালোবেসে শিশু মনের মায়া ঝরে পড়েছে সব লেখার মধ্যে। একসময় একটি লেখা নিয়ে পড়তে গিয়ে চমকে ওঠে রুবাইয়াত। ‘গন্ধরাজের কান্না’ এ নামের লেখায় একটি মেয়ে লিখেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে কেমন করে সৈন্যরা তার বাবা-মা আর শখের গন্ধরাজ ফুলের বাগানটিকে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। পড়তে পড়তে হাত কাঁপে রুবাইয়াতের। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে চাপা চিৎকারে আর্তকণ্ঠস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে_ দু’হাতে চোখ ঢেকে বলে ওঠে না, না না।
কী হলো আপা? পাশের ঘরে বসে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হকচকিয়ে উঠে আসে ছোট ভাইয়ের বউ।
_এই লেখাটা, এই লেখাটা, কি ভীষণ নিষ্ঠুর ঘটনা নিয়ে লেখা ভাবী। আমি জানি। কিন্তু এতটুকু মেয়ে এ ঘটনা পেল কোথায়? ঝর ঝর করে কান্না ঝরে পড়ে রুবাইয়াতের চোখ থেকে।
_ এ কাহিনী আমি জানি। তুইও জানিস। কিন্তু যেদিন এ ঘটনা ঘটে, ওই বাড়ির মেয়েটা তার আগের দিনই মামারবাড়ি গিয়েছিল। সে তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। যুদ্ধের বিপদে ওকে দুদিন আগে মামারবাড়িতে পাঠিয়ে দেয় ওর আব্বা। আর ফিরে আসতে পারেনি।
_ তারপর?
তাদের কথার মাঝখানে দরজায় এসে দাঁড়ায় রঞ্জু এ বাড়ির বড় ছেলে।
আম্মা, রুবাইত, এ ঘটনার কিছুটা আমি জানি। রনি ছিল আমাদের বন্ধু, আসিকের ছোট বোন সেই যুদ্ধের দিনে আমরা তিন বন্ধু ছিলাম এক সঙ্গে। আন্দোলনের প্রথম দিকে পথে পথে মিছিল আর সস্নোগানে উত্তাল ছিলাম আমরা সবাই। … অবশ্য রুবাইয়াতের এতটা যুক্ত হওয়া পছন্দ করেননি। কিন্তু আমাদের গোটা জেনারেশন তখন যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপ্নে অস্থির। মনে পড়ে না রুবা? আসেফা বলেন_ তোদের প্ল্যাকার্ড লেখার সময় আমাকে রোজ রাতে ভালো চা বানাতে হতো।’ মায়ের গলাটা বাতাসের মতো সি্নগ্ধ।
_নিষ্ঠুর সেই যুদ্ধের মাঝখানে আমরা যারা পালিয়ে বর্ডার ক্রস করতে পারিনি, তারা এ বাড়ি ও বাড়ি আত্মগোপন করে অপারেশন চালাতাম।
_ মনে পড়ে রুবা, কমলাপুরে আসিকদের বাড়িতে ছিল মস্ত বড় একটা নার্সারি। গোলাপ আর গন্ধরাজ ফুলের সঙ্গে সঙ্গে করমচা, কামরাঙ্গা, পেয়ারা_ কত যে গাছ ছিল ওদের বাগানটায়। মাঝে মাঝে আমাদেরও যাওয়া-আসাও ছিল। বিশেষ করে যুদ্ধের মাঝখানে যখন হঠাৎ হঠাৎ এক এক এলাকা শত্রু আর্মি রেইড পড়ত, তখন জীবন বাঁচাতে ছেলেরা কেউ কেউ পালিয়ে আসত। কখন আসত, কখন যেত, কেউ জানতেও পারত না।
_ আম্মা, তোমার সব কথা মনে আছে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রঞ্জুকে।
_ সে সব কথা কি ভোলা যায়? বিশেষ করে এক একটা নিষ্ঠুর ঘটনা। আসিকের ছোটো বোন রিনি তো সেই ভীষণ রাত্রির পরে মামারবাড়ি থেকে আর ফেরেনি। মামির কাছে আদরে মানুষ হয়ে পরে বিয়ে-থা করে ছেলেমেয়ের মা হয়েছিল। অনেক বছর পরে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভাবলে বুকটা ফেটে যায়।
_ছোটো ভাবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বলে রাত হলো। যাই সবাইকে খাবার দিই গিয়ে। রুবাইয়াতের হাতের লেখাগুলো গুছিয়ে রাখেন মা।
সময় বড় নিষ্ঠুর কেমন করে যেন সবাইকে সব ভুলিয়ে দেয়। মাঝরাতে জানালায় দাঁড়িয়ে তারার বোনা আকাশটা দেখে রুবাইয়াত। মনে পড়ে এক একদিন দু’হাত ভরে বাগানের গন্ধরাজের স্তবক নিয়ে আসত আসিক। কি যে অসামান্য সৌন্দর্য সাজানো সেই ফুলগুলো। আজও চোখ বুজলে গালে, কপালে গন্ধরাজের বড় বড় সফেদ পাপড়ির স্পর্শ যেন অলস তন্দ্রার মতো তাকে চুম্বন করে যায়।
_গন্ধরাজগাছের যত্ন আমি নিজে করি। গল্প করে বলত আসিক।
চারদিকে সারাদেশ তখন অগি্নময় হয়ে উঠেছে। ছেলেরা কখন ঘরে ফেরে, কখন বেরিয়ে যায় কেউ জানে না। মাঝ বছরে চোরাগোপ্তা হামলা কঠিন হয়ে উঠল। ঘরে ঘরে মৃত্যুর নিষ্ঠুর আগ্রাসন। রঞ্জুরা দুই ভাই তখন দলের সঙ্গে দেশের বাইরে। সারাদেশ স্বাধীনতার তৃষ্ণায় আত্মদানে উন্মুখ।
কিন্তু দিনগুলো যেন পাথরের মতো ভারী।
রুবাইয়াত চাকরি নিল একটা নার্সারি স্কুলে। কারো কোনো খবর নেই। মাঝখানে শোনা গেল সরকারি অফিসে বিদ্যুৎচালিত কলে-কারখানায় মুক্তিযোদ্ধারা চোরাগোপ্তা হামলা করে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রাতদিন অদেখা এক ভারী অন্ধকারের চাদরে ঢাকা কিন্তু অলৌকিক আনন্দের মতোই এসেছিল ওরা কয়েক জন। তখন কৃষ্ণপক্ষের রাত।
দেয়ালে সাজানো গন্ধরাজের স্তবকিত পাপড়ির গুচ্ছ। যুদ্ধের যাওয়ার আগে তোলা রুবাইয়াতের শৌখিন খোঁপার ছবি। ফুলগুলো থেকে যেন এখনো ভেসে আসে সুবাসিত ভালোবাসা। স্বপ্নের প্রতীক্ষার।
রুবাইয়াত পুরনো খবরের কাগজটা পেল। ভাঁজে ভাঁজে বাদামি হয়ে যাওয়া পুড়ে যাওয়া বিবর্ণতা। আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি পরিবার ও স্বপ্ন।
সেদিন মধ্যরাতে এসেছিল আসিক। আগের দিন ঢাকায় তাদের একটা অপারেশন ছিল।
_এমন ভয়ঙ্কর রাত বাইরের বৃষ্টির ধারাপাত। বিদ্যুৎ চমকালে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
_ওরা ছিল, মাত্র কয়েক মিনিট। বড় ইচ্ছে হয়েছিল আসিকের বুকে একটু মাথা রাখি। কিন্তু ওরা দুই বন্ধু এসেছে তাদের মাকে চোখের দেখা দেখে যেতে। কারো মুখে কথা নেই। আসিকের বৃষ্টিভেজা হাতখানি পলকের জন্য স্পর্শ করেছিল রুবাইয়াত। কি ঠা-া, শীতল সে স্পর্শ। অন্ধকার মিলিয়ে যাওয়া ছায়ামূর্তিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়েছিল, চাইলেই কি ধরে রাখা যায়। বিজয় দিবসের শিশুমেলায় গোটা এলাকা, বড় রাস্তা রঙিন হয়ে উঠেছে। ভিড় আর কলরবে মেতে উঠেছে গোটা দেশ। সবাই হাসি-খুশি, উৎসবে। এলাকার সব মানুষ এই দিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে আয়োজন করলে সবাই যোগ দেয়। ছোটরা স্বাধীনতার ছড়া কবিতা আর মনের কথা বলে যায়। শেষ অবধি এক কিশোরী উঠে আসে মঞ্চে ‘আমি স্বাধীনতার কথা বলছি, তিনজন তরুণ শহীদের কথা। অন্ধকার বৃষ্টি ভেজা রাতে তাদের নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমার নানুর ভাই। তখন আর্মিরা এসে তাদের গুলি করে মেরে ফেলে। পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেয় তাদের নার্সারি। বাগান ভরে ফুটেছিল গন্ধরাজ আর গোলাপ। সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মাটি কালো হয়ে গিয়েছিল। এ কাহিনী আমার বীর শহীদদের, আপনাদের কাছে বলতে এসেছি।’ সারা সভায় নেমে এসেছে পিনপতন স্তব্ধতা। তার মধ্যে দর্শক-শ্রোতাদের নীরব শোকার্ত কান্নার দীর্ঘশ্বাস। স্বাধীনতা ব্যাকুল ভালোবাসাকে বাতাসের বুকে ছড়িয়ে দিয়ে যেন প্রতিধ্বনি তুলেছে। সবার বাড়ি ফিরে যাওয়া একাত্তরের শতবর্ষের মিছিল।
সন্ধ্যার আলো-অাঁধারিতে ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালায় রুবাইয়াত। রঞ্জু এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। তার ছেলেও বাবার কাছে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়ায়। ছেলেবেলা থেকে যে সাহসী যোদ্ধাদের কথা শুনে শুনে বড় হয়েছে, তারাও যেন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। বন্ধুর পিঠে ছুঁয়ে আছে বন্ধুর হাত।
একটা দমকা ঝড়ো বাতাস এসে বাড়িটাকে ঘিরে কান্নার মতো আওয়াজ তোলে। রুবাইয়াতের হাতটা এসে যেন বাড়ি খায় গন্ধরাজের সুন্দর ছবির ওপরে। আছড়ে পড়ে যন্ত্রণার মতো। রুবাইয়াতের বুকের ভেতর থেকে কান্নার অপ্রতিরোধ্য স্রোত বেরিয়ে আসে।
_রুবা, রুবাইয়াত কি হলো? ধড়ফড় করে ঘরে ঢোকেন আসেফা, রঞ্জু।
_ একি? কেমন করে হলো? রঞ্জু বোনের হাত থেকে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো সরাতে চেষ্টা করে। রুবাইয়াত কিছু বলে না। ছবিটার ওপরে কেটে যাওয়া হাতের রক্ত ঝরে ছবিটাকে কেমন ভিজিয়ে দিচ্ছে। দেখে ত্রস্ত হাতে মুছে নিতে চেষ্টা করে রঞ্জু। আসেফা নিষেধ করেন।
_ যাক রঞ্জু, ওযে কত বছর কাঁদে না। আজ যদি সময় ওকে সে সুযোগ দেয় তবে থাক না।’ রুবাইয়াত চমকে মুখ তোলে। দেখে তার চোখের কান্নায় ছবির ফুলগুলো রক্তের ফোঁটায় যেন জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বাইরের দেয়ালে ঝকঝকে চোখ মেলে পাহারা দেয় একটি প্রাচীন ভালোবাসার নাম ‘স্বাধীন।’