রিনি

রিনিরে নিয়া এই গল্পটা মেলা দিন ধইরাই লেখবো লেখবো করতেছিলাম, কিন্তু নানা কাজে আর লেখা হইতেছিল না। লেখা না হওয়ার পেছনে অবশ্য অনেক কারণ। যে সময় গল্পটা ঘটতেছিল রিনির জীবনে তখন প্রায় দিনই ফোন দিয়া ঘটনার আপডেট জানাইতো সে। তো শুনতে শুনতেই আমি একদিন কইলাম, তোমার এই কাহিনি নিয়া কিন্তু একটা ভাল গল্প হয়। রিনি কয়, হ্যাঁ, কাহিনিটা তোমার সাথে খুব যায়। এই ধরনের গল্প তো তোমার আছেও। আমি কইলাম, তুমি যদি নিজে লেখতে চাও তো আমার আপত্তি নাই। গল্পকার হিসেবে নিজের গল্পের ওপর অধিকার তোমারই বেশি। তুমি লিখবা বললে আমি আর আগাবো না। রিনি বলে, না, এই গল্পটা আমার জঁরের সাথে যায় না। লিখলে লিখতে পারো। তো ঘটনা যখন ঘটতেছে তখন তো রিনি প্রায় দিনই ফোন দিয়া ওর পেরেশানির কথা বিস্তারিত জানায় আমারে। আমি মনে মনে তখন গল্পটা সাজাইতেছি। সাজানো মানে গল্পটা এমনভাবে লেখবো যাতে রিনিরে কেউ না চিনতে পারে। তো রিনিরে যেন কেউ না চিনতে পারে এমনভাবে আমি রিনির গল্পটা মনে মনে সাজাইতেছি, প্রায় সাজায়েও আনছিলাম মনে হয়। বইসা খালি লিখে ফেলা বাকী। যখনই ভাবি এইবার বইসা লেখবো দেখা যায় তখনই রিনি ফোন দেয়। কাহিনি নতুন কইরা প্যাঁচ খায়া যায়। আমি চিন্তা করি, কাহিনিটা আরও কিছুদূর আগাক। একটা টুইস্ট আসলে সেই টুইস্টটা দিয়া শুরু করবো। কাহিনি নানা দিকে আগাইতেছিল আমিও গল্পটা নতুন নতুনভাবে সাজাইতেছিলাম। লিখবো লিখবো কইরা মেলা দিন হয়ে গেল। বলতে কি রিনি মেলা দিন আমারে ফোন দেয় না আর আমি রিনির গল্পটা ভুইলা বসে আছি। মাঝে শাহবাগ, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম মেলা ঘটনা ঘইটা গেল। এইসব নিয়া গল্প লেখার ধান্দা আমার নাই। রিনির বিষয়টা নিয়া লেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু রিনি যেহেতু আর ফোন দিল না আমিও বেমালুম ভুইলা গেলাম যে রিনির ঘটনা নিয়া একটা গল্প লেখা যায়। আজকে আবার রিনি ফোন দিছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে। ওর জীবনের সঙ্কট নিয়া কোনো কথাই কইলো না। জাতীয় নানা ইস্যু নিয়া আলাপ হইলো। একটা ফোন নাম্বারও চাইলো, ইহসানুল হাসানের। ইহসানুল হাসানের নাম্বার আমার কাছে নাই। থাকার কথাও না। আমি কইলাম, রিনি তোমার কেমনে মনে হইলো ইহসানুল হাসানের নাম্বার আমার কাছে থাকতে পারে। রিনি বিরক্ত হয়ে ধূর বলে ফোন রাইখা দিল। তখনও রিনির গল্পটার কথা মনে পড়ে নাই। রিনির ফোন রাইখা দেখি চোখে হালকা হালকা ঘুম খেলা করে। বিকাল বেলা ঘুম তো একটা দেওয়াই যায় এই মনে কইরা বালিশে মাথা দিছি। ফোনটা বালিশের নিচেই ছিল। হঠাৎ সেটা বাজতে আরম্ভ করলো। ভাবলাম রিনিই হয়তো ফোন দিছে। সরি টরি বলতে পারে। দেখি, ফোনে মুক্তা। রওশন আরা মুক্তা। গল্পের জন্য ফোন দিছে। সম্পাদকরা এখনও আমারে গল্পের জন্য ফোন দেয়। আমি যে গল্প সময় মতো দিতে পারি না সেইটা জাইনাও আমারে কেন ফোন দেয় বুঝি না। সম্পাদকরা খুব চালু, এক মাস দুই মাস আগে থেকে গল্প চায়। সময় যেহেতু হাতে অনেক তাই আমি কোনো ভাবনাচিন্তার অবকাশ না রাইখাই বলি, দিবোনে। কিন্তু এক মাস দুই মাস কেমনে কোনদিক দিয়া যায় কে জানে। হঠাৎ আবার ফোন দিয়া বলে, কালকেই গল্প লাগবে মাস্ট। আমি তো এক অক্ষরও লেখি নাই। কোত্থেকে গল্প দিবো। কিন্তু এখন তো আর বললে চলবে না যে গল্প কোত্থেকে দিবো। গল্প লিখতে পারবো না সেটা এক মাস আগে বললেই চলতো। কিন্তু তখনতো আমি রাজি হইছি। আমারে নিয়া এই এক প্রোব্লেম। মাথায় গল্প নাই কিন্তু সবাইকে বলি গল্প আছে। সময় মতো মেইল কইরা দিবো নে। তো মুক্তার ফোন পেয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল রিনির গল্পটা তো লেখা হয় নাই। কোথাও দুই-চাইর লাইন লেখা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু রিনির ঘটনা এত প্যাঁচ খাইতেছিল যে আর আগানো হয় নাই। মুক্তারে বললাম, বস গল্প তো প্রায় রেডি। ফিনিশিং বাকী শুধু। গল্প কি আপনের আজকে লাগবে না কাল হলেও চলবে? সবার মতো মুক্তা দেখলাম, আমার কথায় বিশ্বাস করে ফেললো। বলে, কাল কিন্তু লাগবেই লাগবে। শুয়ে শুয়েই ভাবতেছিলাম, মুক্তার জন্য গল্পটা লিখবো কখন? ভাবতে ভাবতে উইঠা পড়লাম ঘুম থিকা। তো, উঠে কম্পিউটার খুলে এই পর্যন্ত লিখে ফেললাম। এই পর্যন্ত লিখে ফেলার পর আবার মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। রিনির গল্পটার শুরুটা মনে পড়তেছে না। রিনিরে ফোন দেওয়া যায়। কিন্তু ফোন দিলেই সে বুঝবে তারে নিয়া গল্পটা এখন আমি লিখতে শুরু করছি। তারে না পড়ায়ে গল্পটা ছাপতে দেওয়া যাবে না। ফলে, আগ বাড়ায়ে রিনির সাথে কথা বলার কোনো মানে হয় না।
গল্পের শুরু অবজারভারে, ডেইলি অবজারভার যখন বের হইতো তখন ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী হিসাবে ওই পত্রিকায় ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দিছিল রিনি। তখন অবজারভারের ডেস্কে কাজ করতো তরুণ সাংবাদিক চিন্ময় বড়ুয়া। বাড়ি চিটাগাং, জাতিতে বৌদ্ধ চিন্ময়ের সৌম্যকান্তি চেহারা দেইখা রিনির ক্র্যাশ হয়ে যায়। চিন্ময় ছিল টল, হ্যান্ডসাম, চুলদাঁড়িতে তাকে লাগতো ইয়াং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। বাঙালি মেয়েদের কাছে তরুণ রবীন্দ্রনাথের আবেদন উত্তম কুমারের চাইতেও বেশি। রিনির কাছে তো থাকবেই, কারণ সে শান্তি নিকেতনে এক বছর পড়াশোনা করছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকর্ষণেই। কন্টিনিউ করা হয় নাই, কারণ অতিমাত্রায় হোমসিক সে। ফিরে এসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ পড়া শুরু করেছিল। অবজারভারে ইয়াং রবীন্দ্রনাথকে দেখে তার পুরানা রবীন্দ্র প্রেম আবার জেগে উঠলো। রিনি কখনো বলে নাই, কিন্তু আমি বুঝি, বৌদ্ধ হিসেবে রিনির একটা বাড়তি টানও তৈরি হইছিল চিন্ময়ের উপর। চিন্ময়ের যে রিনিকে অপছন্দ হয়নি সেটা রিনি বুঝেছিল তার সাথে দৈনিক বাংলার মোড়ে একটা দোকানে চা খেতে খেতে। চিন্ময়ের চোরা চাহনি সে অনুভব করেছিল আর ভিতরে ভিতরে শিহরিত হয়ে উঠছিল। বন্ধু হিসাবে রিনি আমাকে মাঝে মাঝেই চিন্ময়ের কথা বলতো। চিন্ময়ের কথা বললেই সে আনমনা হয়ে যেত। এখানে ওখানে চিন্ময়ের মতো কাউকে দেখলেই রিনি বোঝার চেষ্টা করতো লোকটা চিন্ময়ই কি না। ঢাকায় অবশ্য চিন্ময়ের দেখা পাওয়ার কথা না। কেননা চিন্ময় বহু বছর ধরে চিনে থাকে। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালে কাজ করে। কোনো এক অভিমানে চিন্ময় আর দেশে আসে না। রিনি মাঝে চেষ্টা করছিল তার খোঁজ করার, ব্যাটেবলে লাগেনি। এর মধ্যে দুই তিনটা প্রেমের ট্রাইও করছে রিনি কিন্তু কাউকেই শেষ পর্যন্ত ভাল লাগে নাই। কই যেন গিয়া একটা খটকা লাগে। রিনির খালি মনে হয়, এই ছেলেরে বিয়া করলে তার আর লেখালেখি হবে না। ফলে, সে বারবার পিছায়া আসে। একবার একজনের সাথে মেলাদূর আগাইছিল। ডেটেও গেছলো, কিন্তু ছেলেটা বা লোকটা যখন মুখ বাগিয়ে রিনির দিকে আসলো তখন রিনির এত খারাপ লাগছিল যে সে কষে একটা থাপ্পড় বসায়ে দিছিল লোকটার গালে।
তো হঠাৎ করে ২০১২’র ডিসেম্বরে রিনির সাথে চিন্ময়ের দেখা হয়ে যায়। কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে। রিনি প্রবল উচ্ছাস সহকারে আমারে ফোন দেয় সেই রাতেই। চিন্ময়ের কথা তোমার মনে আছে? হ। সেই যে তোমার প্রথম প্রেম। কই জানি কাজ করতা না একসাথে। সে তোমার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেছিল। রিনি বলে বলো তো মোর্শেদ, আমি বিয়ে করিনি কেন? তুমি তো আমাকে অনেক দিন ধরে চেন। আমার বিয়ে না করার পেছনে ব্যাখ্যাটা কী? হইতে পারে তুমি চিন্ময়ের কারণেই বিয়ে করো নাই। আবার এমনও হইতে পারে যে মেলে নাই তাই বিয়া করতে পারো নাই। আর পছন্দসই বৌদ্ধ ছেলে পাবা কই। তুমি যা খুতখুতে স্বভাবের।
কিন্তু জানো, আলাপের এক ফাঁকে চিন্ময় যখন জানলো আমি বিয়ে করি নাই, তখন না ওর চেহারাটা দেখার মতো হইছিল। মুহূর্তেই যেন সে অনুভব করতে পারলো, আমি যে বিয়ে করি নাই তার পেছনে সে একটা কারণ। সে জন্যই কি না জানি না, আমার সাথে অনেক ক্ষণ গল্প করলো। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মতিঝিল পর্যন্ত আসলাম। ফোন নাম্বার বিনিময় করলো। চিনেই একটা বিয়ে করছে চিন্ময়। একটা বাচ্চা আছে। বৌ-বাচ্চার কথা যখন বলতেছিল তখন ওর মুখের দিকে দেখতেছিলাম। কী একটা বেদনা। আমার কী মনে হইলো জানো, ম্যারিড লাইফে চিন্ময় বোধহয় খুব সুখে নাই।
সেটা কি তোমার মনে হইলো না সে কিছু বললো যাতে তোমার মনে হইলো সে সুখে নাই?
জানি না, কিন্তু চিন্ময় যে সুখে নাই সে বিষয়ে আমি শিওর।
চিন্ময়ের সাথে রিনির দেখা হওয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা। রবির একটা নাম্বার থেকে গভীর রাতে রিনির নাম্বারে একটা মেসেজ এলো। আননোন নাম্বার। লিখছে, রিনির জন্য এখনও তার মন পোড়ে। মেসেজটা পেয়ে রিনির মনে হলো, হয়তো চিন্ময়ই তাকে মেসেজটা পাঠিয়েছে। নাম্বারটায় কল করলো, রিং হয়, কিন্তু কেউ ধরে না। রিনি আবার কল করলো, রিং হয়, কিন্তু কেউ ধরে না। মেসেজটার কোনো উত্তর না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রিনি। সকাল হতেই আমাকে ফোন দিল। আচ্ছা মোর্শেদ, তোমার কি মনে হচ্ছে না, এটা চিন্ময়েরই মেসেজ?
চিন্ময়ের নাম্বার তো তোমার কাছে আছে। সে জানে তার জন্য তোমার অনুভূতি কী? বলতে গেলে তার জন্যই তো তুমি বিয়া করো নাই। সে চাইলে নিজের নাম্বার থেকে তোমাকে মেসেজ পাঠাইলেও তো তুমি রেসপন্স করবা। সে কেন আননোন নাম্বার থেকে তোমাকে মেসেজ করতে যাবে?
সেটা একটা যুক্তি বটে কিন্তু এর মধ্যে চিন্ময় ছাড়া আর কারো সাথে তো আমার ইন্টারেকশন হয় নাই।
তোমার নাম্বার অনেকের কাছেই আছে। তোমার মতো সুন্দরীর জন্য যে কারো মন পুড়তে পারে। পরিচিতদের মধ্যে যে কেউ মেসেজ পাঠাইতে পারে। চিন্ময়ের সাথে দেখা আর ওই লোকের মেসেজ পাঠানোটা কোইন্সডেন্টাল হইতে পারে।
তাহলে বলো তো, কে আমাকে মেসেজটা পাঠাতে পারে?
সেটা একটা গবেষণার বিষয়।
আমার কাটা কাটা জবাব শুনে রিনি একটু দমে যায়। ফোন রেখে দেয়। এরপর দুইদিন আর রিনির আর খবর নাই। দুই দিন পর রিনি ফোন দিলে আমি বুঝি এর মধ্যে আননোন নাম্বারটার সাথে ও অনেক দূর এগিয়েছে। সে ধরেই নিয়েছে ওটা চিন্ময় আর চিন্ময়ের জন্য তার যে প্রেম সেটা সে ঢেলে দিয়েছে। সুযোগ নিয়ে আননোন নাম্বারটা তার সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছে। মেসেজে যতটুকু প্রেম আর যৌনতা সম্ভব সবটাই। রিনি কিছু আভাস দিলে আমি বাকীটা কল্পনা করে নেই। লোকে নাকি বউয়ের সাথেও এত খারাপ কথা লেখে না, লোকটা যেসব কথা তাকে বলছে।
তাহলে তুমি ধরেই নিচ্ছ যে লোকটা চিন্ময়। হতে তো পারে আননোন নাম্বারটা একটা মেয়ের। তোমার রাইভাল কোনো সাহিত্যিক তোমার সাথে মজা নিচ্ছে।
আমার কথা শুনে রিনির মজাটা মুহূর্তেই ফুরিয়ে গেল। বললো, বলো কী? তাহলে কি তন্বি ইসলাম তনিমা?
এই নামটাই রিনির মাথায় আসবে এটা আমি জানতাম। ভেতরে ভেতরে তন্বি ইসলাম তনিমা রিনির এক নাম্বার শত্রু। কিন্তু সামনা-সামনি বন্ধুই তারা। তন্বি যেমন রিনিও তেমন একে অপরের লেখা নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। রিনির গোপন কথা তন্বি যেমন জানে, তন্বির কথাও রিনি জানে। ফলে, এমন হতেই পারে যে, তন্বিই আননোন নাম্বার থেকে রিনির সাথে মজা নিচ্ছে। গুজব আছে তন্বি লেসবিয়ান। ফলে, রিনির সাথে সেক্সুয়াল ফ্লার্ট করতেও সে মজা পাবে সন্দেহ নেই। আমার কথা শুনে রিনি একটু ধন্দে পড়ে গেল। বললো, এটা তো নিরব হায়দারও হতে পারে। নিরব তো সাংবাদিক। নিরবের সাথে চিন্ময়ের বন্ধুত্বের কথা নিরবই আমাকে বলছে। চিন্ময়ের বন্ধু শুনে চিন্ময়কে নিয়ে অনেক কথাই আমি শেয়ার করছি। শোনে চিন্ময় যে দেশে সেটা তন্বির জানার কথা না। কিন্তু নিরব জানে।
কিন্তু নিরবের বউ আর তন্বি যে জিগরি দোস্ত সেটা তুমি কীভাবে ভুলে যাইতেছো?
ঠিক। নিরবের বউয়ের কাছেই হয়তো তন্বি শুনছে চিন্ময় এতদিন পর দেশে ফিরছে এই নিয়া রিনিকে একটু খেলানো যায়। ছিছি মেয়েটা এত নিচে নামতে পারলো?
এমনও হইতে পারে, তন্বি নয়, নিরবই এসব করতেছে। নিরব ম্যারিড লাইফে অসুখী সেটা তো তন্বিই তোমাকে বলছে। চিন্ময়ের মতো নিরবেরও একটা বাচ্চা। চিন্ময়ের ফিরে আসার উপলক্ষে নিরব তোমার কাছে সুযোগ নিচ্ছে।
রিনি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। বলে মোর্শেদ, এখন বলো আমি কী করবো?
আমি বলি, যা হবার হইছে। যথেষ্ট আগাইছো। এখন এক কাজ করো। নাম্বারটা কিছুদিনের জন্য বদলায়ে ফেল।
রিনি ফোন রেখে দিলে আমি ভাবতে বসি, কে এই আননোন নাম্বারধারী ব্যক্তি। নিরব হায়দারের মতো খুতখুতে সংস্কৃতিমনা ব্যস্ত মানুষ কি রাত জেগে রিনির সাথে টেক্সট সেক্স করতে চাইবে? হিসাব মেলে না। বাসায় তার বউ আছে। বউকে এড়িয়ে সারারাত টেক্সট পাঠানো তার পক্ষে কতটা সম্ভব?
আননোন নাম্বারটা তন্বির হতে পারে। তন্বি খুব স্ট্রেইট কাট। সে গল্পকার বটে, কিন্তু এভাবে রোলপ্লে করে রিনিকে খেলানোর মতো ধৈর্য তার আছে?
আমি রিনিকে টেক্সট পাঠাই, আর কে তোমার আর চিন্ময়ের ঘটনা জানে?
রিনি আবার ফোন দেয়।
শোনো মোর্শেদ, চিন্ময়ের সাথে ঘটনাটা কিন্তু কাউকে বলার মতো কিছু না, আবার না বলার মতো কিছু না। তোমাকে বলেছি, তন্বি জানে, নিরব জানে, নিরবের বউ জানে। চিন্ময় যদি কাউকে বলে থাকে তবে সে জানে।
যে লোকটা মেসেজ করছে সে কি বলছে যে সেই চিন্ময়?
সরাসরি না বললেও বোঝাচ্ছে যে সে চিন্ময়।
কী বলে সে বোঝাচ্ছে যে সে চিন্ময়?
পুরনো দিনের কথা। আমি আগে কেমন ছিলাম, এখন কেমন হইছি। সম্প্রতি আমাকে দেখে তার কী মনে হইছে ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, সে যে বৌদ্ধ সেটা সে ভালই বোঝাচ্ছে। যেই হোক লোকটা সে বৌদ্ধ না হলেও ত্রিপিটক তার ভালই পড়া আছে।
একরম একজন নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ এরকম মেসেজ পাঠাইতে পারলো?
রিনি বলে, আচ্ছা মোর্শেদ লোকটা তুমি না তো?
আমিও সন্দেহ তালিকায় আছি? গুড। কিন্তু ত্রিপিটক তো আমি পড়ি নাই। কোনো কোট করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আর তোমাকে যা বলার সরাসরি আমি বলতে পারি। আননোন নাম্বার কিনে রাতভর মেসেজ করার মতো ধৈর্য আমার নাই।
সেটা আমি জানি, কিন্তু কে হতে পারে বলো তো।
তখনই আমি বললাম, রিনি তোমার এই ঘটনা নিয়া কিন্তু ভাল একটা গল্প হইতে পারে। গল্পের নাম- কে সে?
ফাইজলামি করো না তো। তুমি জানো পরশু রাতে সে কী করছে? আমিও যে কেমনে তার এইসব কথায় রেসপন্স করতে গেলাম কেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমার সাথে টেক্সট চালাচালি করতে করতে লোকটা মাস্টারবেট করছে। ওফ, এত নোংরা হয় মানুষ?
এর চেয়েও বেশি নোংরা হয়। গল্পকার হিসাবে সেটা তোমার জানার কথা। কিন্তু তুমি এত রেসপন্স করতে গেলা কেন?
সেটাই ভাবছি।
আমি রিনির গল্পটা সাজাইতেছি আর রিনি ওদিকে রীতিমতো গোয়েন্দা করে যাচ্ছে। তন্বির সাথে দেখা করছে, নিরব হায়দারের সাথে দেখা করে জিজ্ঞেস করছে ডিবিতে ওনার পরিচিত কেউ আছে কি না। চিন্ময়ের নাম্বারে ফোন করে সর্বশক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে। চিন্ময় কিছু রহস্যময় কথা বলেছে কিন্তু সে সব থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। তন্বির সাথে কথা বলার পর নারীবাদী তন্বি আর নিরবের বউ আশা মহা ক্ষেপে গেছে। তাদের মত হলো এটা সেক্সুয়াল অ্যাবিউস এবং এর একটা বিহিত করতে হবে। নিরব বলেছে ডিবি না, র‌্যাবের স্পেশাল উইংয়ের মারফত বিষয়টার সুরাহা করার চেষ্টা করবে সে।
ওদের এই মনোভাবের পর রিনি বলছে ফাইনালি কিছু করার আগে সে আরও ভাবতে চায়। যদি চিন্ময়ই হয় লোকটা তবে সে চায় না অল্প সময়ের জন্য দেশে এসে সে একটা বিপদে পড়ুক। কিন্তু যদি চিন্ময় না হয়ে অন্য কেউ হয়? তার তো শাস্তি পাওয়া দরকার, নাকি?
নিশ্চয়ই। কিন্তু কীভাবে বুঝবা কে সে?
সেইটাই।
রিনি পরপর তিন দিন আর ফোন দেয় না। রাত দিন ওই আননোন নাম্বারের সাথে মেসেজ বিনিময় করে যাচ্ছে। সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, এই তিনদিন চিন্ময় গ্রামে থাকবে। গ্রামে গেলে নিশ্চয়ই মেসেজগুলো আরও নস্টালজিক হয়ে উঠবে। রিনি বুঝতে চায় গ্রামে গিয়ে মেসেজে কোনো চেঞ্জ আসে কি না। এলে বুঝবে নিশ্চিতভাবেই এটা চিন্ময়ই। তিনদিন পর রিনি ফোন দিলে বলি, কিছু বুঝলা?
নাহ। মহা ধড়িবাজ। প্রথম দুইদিন খারাপ কিছু বলে নাই। কাল রাতে আবার। বলে, তোমাকে তো পাবো না কিন্তু অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে তোমাকে বাঁধবো। কী যে আকুতি। তুমি এত প্যাশনেট হইতে পারবা না মোর্শেদ। সত্যি কথা বলতে, তুমি আমি কোনো লেখকই এমন হইতে পারবে না। কারণ একটা সময় তো আমরা পর্যবেক্ষণ করি। যখন প্যাশনটা আর থাকে না। প্যাশন না থাকলে সাথে সাথেই বোঝা যায়। কাল থেকে আমার কী মনে হচ্ছে জানো, লোকটা চিন্ময় না হলেই বা কী? চিনে এতদিন থেকেও কি চিন্ময় নিজের মধ্যে সেই প্যাশন ধরে রাখতে পেরেছে? বউ-বাচ্চা, সংসার করার পরও কি এসব থাকে?
আমি ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু একটা জিনিশ নিশ্চিত লোকটা তোমার প্রেমে পড়েছে।
ঠিক। কিন্তু কে সে?
এমন হতে পারে তোমার কোনো চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড, ইউনিভার্সিটির ছোট ভাই। হতে পারে না? তোমাকে অনেকদিন ধরে চেনে। তুমি হয়তো কোনোভাবেই তার দিকে নজর দাও নি। কিন্তু সে তোমাকে পছন্দ করে যাচ্ছে। চিন্ময়ের কথা সে জানতে পারে নাও জানতে পারে। চিন্ময় দিয়ে অবসেশড বলে তুমি ভাবতে পারছো না সে চিন্ময় নয়। কিন্তু একটু মাথা খাটালে হয়তো বের করতে পারতা।
কে? সায়েম, কবির, সনাতন?
আমি জানি না রিনি। তোমার পক্ষেই সম্ভব বের করা।
দেখতে দেখতে চিন্ময়ের যাবার ডেট এসে গেল।
আশার কাছ থেকে রিনি জেনে নিছে ফ্লাইট ডিটেইলস। সেদিন ছিল সোমবার। দুপুর দুইটায় বিমানবন্দরে চেকইন করার কথা চিন্ময়ের। বিমানে উঠে বসবে ছয়টায়। বিমান ছাড়ার আগ পর্যন্ত লোকটার সাথে মেসেজ বিনিময় করে চললো রিনি। ছয়টার পর যখন রিনি জানে বিমান ছেড়ে দিয়েছে তখন নিজের ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে।
একটা আননোন নাম্বার থেকে আমাকে ফোন দিল রিনি।
বললো, এত টেনশন আর সহ্য করতে পারলাম না, নাম্বারটা চেঞ্জ করে ফেললাম।
ভাল করছো। আগেও করতে পারতা।
হুম।
এখন নাম্বারটা চালু থাকলে কিন্তু বোঝা যাইতো সেটা আসলে চিন্ময়েরই কি না।
থাক আর বুঝে কাজ নাই।
কেন?
কোনো উত্তর দিল না রিনি। বললো, নতুন নাম্বারটা কেউ চাইলে দিও না।
গত কয় মাসে রিনির সাথে আর এইসব নিয়ে কোনো কথা হয় নাই। মুক্তার জন্য এইটুকুই চলবে মনে হয়। আড়াই হাজার ওয়ার্ড হইছে। রিনির সাথে কথা বলে ওর পুরা ঘটনা নিয়া আরেকটা গল্প লিখবো।