সমরেশ

প্রায় কুড়ি বছর পরে সমরেশের সঙ্গে দেখা হল। সে আমাকে চৌরঙ্গীর একটা হোটেলে নিয়ে একটা নিরিবিলি কোণ বেছে বার করল। আমরা বসলাম দু’জনে।
সমরেশ বল্লে : মাঝে-মাঝে খেতাম। অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা নেই। তুমি জান না আমি মদ ধরেছিলাম। খুব বেশি খেতাম না অবিশ্যি কখনও; কিন্তু নেহাৎ কমও খাওয়া পড়ত না। বাইরে গিয়ে মদ খেতাম না। ক্বচিৎ খেতাম হয়তো এক-আধ দিন। আমার মদ খাওয়া চলত আমার নিজের বাড়ীতেই- গোপনে। প্রকাশ্যে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে- কিংবা হোটেল-কাফেতে দল ভারী করে মদ খাওয়া আমার পোষাত না। কেন জান? আমি মানুষটা হচ্ছি সাত্ত্বিক-
শুনে আমার হাসি পেল। ব্যাঙ্ক চলন্ত ট্রেন পোস্ট-অফিস-এর ভ্যান সমীহ করি- সমরেশ চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে বল্লে : কেউ যদি বলে ইন্দ্রনাথবাবুর ছেলের একটু মাল টানবার অভ্যাস আছে-
-ইন্দ্রনাথবাবুর ছেলের?
-হ্যাঁ, পৈতৃক সুনামে মাছি পড়বে সে আমি বরদাস্ত করতে পারি না।
-এবং সাত্ত্বিক মানুষ, তুমি হাসালে, সমরেশ।
সেই বিপ্লবী উদ্রিক্ত খুনে ডাকাতের একি পরিবর্তন! চাও খেত না, আজ চুরুট টানছে, মদ খাওয়া নিয়ে খিস্তি করছে। সাত্ত্বিক হয়েছে বলছে।
-তুমি হাসছ, কিন্তু সত্যিই আমি সাত্ত্বিক রুচির মানুষ; সহজে আমার রক্ত তাতে না। উত্তেজিত পিপাসিত হয়ে উঠি বলে আমি মদ খাই না। আমি খুব ঠাণ্ডা মনেই মদ খাই।
-তাই বুঝি? খেতে কেমন লাগে?
-খারাপ না।
-আজ একটু হবে?
-না। আমি ছড়ে দিয়েঝি। যখন খেতাম, তখনও অন্য কাউকে বখাতাম না।
-আজ বিশ বছর পরে তোমার সঙ্গে দেখা। পেটে একটু না পড়লে চলে?
কথাটা সমরেশের কানেই পৌঁছাল না। যেন চুরুটে এক টান দিয়ে সে বল্লে : কোনোদিন মাতলামো করিনি। অথচ অনেক মদ খেয়েছি। কিন্তু কোনোদিন খাব না আর। আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এ কি, তুমি কাঁটা চামচ সরিয়ে রাখলে যে!
-কী আর খাব
-একটা রোস্ট খাও- ফাউল রোস্ট-
-না, না, আমার দাঁত টনটন করছে।
-তা হলে কফি খাও-
-এরা কফি কেমন করে?
-বেশ ভালোই। দু’তিন কাপ গরম কফি চলুক।
আমি যে মদ খেতাম, এ-কথা কেউই জানে না-আমার স্ত্রী অব্ধি না। অথচ দিশি বিলিতী এমন কোনো মালই নেই যা আমি পাচার করি নি।
সমরেশ কফি ঘাটছিল।
-তোমার স্ত্রীকে ফাঁকি দিলে কি করে? তাঁর তো জানা উচিত।
-জানে নি তো।
সমরেশ বল্লে- মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু যত দিন খেয়েছি আমি ইন্দ্রনাথবাবুর নাতি ও চন্দ্রনাথবাুর ছেলে হয়ে এ-কাজ করছি)এই ভেবেই মনে দুঃখ পেয়েছি; আমার চরিত্রের যে-শুদ্ধতা কোনো মেয়েমানুষই কোনোদিন তা কড়েকে দিতে পারে নি; সেইখানে মদ এসে ক[কাল এই ভেবে মাঝে-মাঝে অস্বস্তি বোধ করেছি। কিন্তু-
টেবিলে কফির পট, দুধ, চিনি এসে হাজির হল।
আমার পেয়ালায় কফি ঢালতে-ঢালতে সমরেশ বল্লে : তুমি বোস- আমি আসছি-
বলে আচমকা সে উঠে গিয়ে কোথায় দরব্জায় পরদার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। মিনিট পঁচিশেক পরে ফিরে এসে : মদ এক অপূর্ব জিনিস।
-তা বটে। কিন্তু খেতে কেন তুমি? এখনও তো খেয়ে এলে। মানুষের জীবন তো মদের চেয়েও অপূর্ব।
সমরেশ মাথা নেড়ে স্বীকার করল; বল্লে : সে-জীবন থেকে পালিয়ে যাবার প্রয়োজনে বাধ রে মদদ ধরি নি আমি। আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি, স্ত্রীকে ভালোবাসি; চাকরী করছি, চাকরীর উন্নতি হচ্ছে; আরো উন্নতির জন্যে প্রাণপাত করবার মত শক্তি আছে রুচি আছে আমার। আমি অসামাজিক নই। মানুসেল দলে ভিড়তে- ভালোবাসতে আমার ভালো লাগে। সমাজকল্যাণ চাই আমি। এ-সব জেনেশুনেও স্থির চোখে মদ খেতে শুরু করলাম-
আমি আবার কফির অর্ডার দিয়েছিলুম। বয় সারসরঞ্জাম সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আমার কফির পেয়ালায় দুধ চিনি মিশিয়ে আমার কাঁধের উপর তার ডান হাতের থাবা বিন্যস্ত করে রাখল সমরেশ, নীরব নিস্তব্ধ হয়ে রইল।
-তুমি কফি খাবে না, সমরেশ?
-না
-কেন? দু’ পেয়ালা কি হবে?
-তুমি আস্তে-আস্তে খাও। তারিয়ে-তারিয়ে খাও। অপূর্ব- অপূর্ব- অপূর্ব বলতে লাগল সমরেশ।
-কাকে তুমি অপূর্ব বলছ
-অপূর্ব? আমি অপূর্ব এই পৃথিবী। অবিস্মরণীয় এই হোটেল- এই বিলিতী হোটেল- এই ক্লাইভ স্ট্রিটের সাহেবদের দম তো সময় মদ্যময়, নি-খি-লে-শ।
সবুর, আমাকে কফি খেতে দেবে না! আহা, করছ কি, সমরেশ- দিলে তো কফি ঢেলে, গেল ছিটকে সব- এখন পেয়ালাটাকেও না ভেঙে ছাড়বে না দেখছি-
আমাকে অচ্ছুত করবে তুমি! সে হাত সরিয়ে সটান হয়ে বসল।
-কারু সঙ্গে আমার মন কষাকষি নেই তো। সবই উজ্জ্বল। উজ্জ্বল-নিরুজ্জ্বল- পবিত্র। দেখেছ কী অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে আকাশে। কী জাজ্বল্যমান এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তুমি কফি খাচ্ছ পাগল নিখিলেশ, নি-খি-লে-শ, অথচ এই দুর্দ্দান্ত ব্রহ্মণ্ডটাকে দেখছ না- টার্নার মনিয়ন, বুলরু লাভিসে, শ’ওয়ালেস, জারডিন স্কিনার, হোরেস মিলার বাই বাই করে ঘুরছে সব। ঐ সিলিঙের দিকে তাকিয়ে দেখো! তাকিয়ে দেখো দেয়ালগিরির দিকে। কী অভাবনীয়- অনির্বচনীয় সব ফ্রেস্কো- দেখছ নিখিলেশ-
-দেখছি বৈ কি-
-কী বিরাট কারুকার্য্য এই একটা বিধাতার। চারদিকে দুর্দ্দান্ত মোজেয়িক জ্বলজ্বল করে উঠছে যেন আমেরিকা এক একটা স্কাইপোর-এ আগুন ধামচ্ছে- নি-খি-লে-শ-
-আচ্ছা!
-কফি খাচ্ছ? আগুন লেগেছে, না?
-কোথায়?
-বাঃ, এই হোটেলে- কলকাতা- প্রশান্ত মহাসাগর-আটলান্টিক- আঃ, কী অন্তহীন অন্তহীন আগুনের মোজেয়িকের ভিতর বসে আছি তুমি আর আমি। আঃ, কী আগুন, কী আরাম। ঐ যে দূর আকাশের তারাটি তড়পাচ্ছে- দেখছ তো-
হোটেলের গহ্বরের এক কোণের ঘেরাটোপের ভিতরে বসে তারা দেখবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, এক টুকরো আকাশও চোখে পড়ছিল না; বল্লাম- ঐ তারাটি? ঐ যে তোমার আঙুল বরাবর গ্যাসের ঢাউস বাতিটি? হ্যাঁ, ওকে আমি খুব সুনজরে দেখি। আমাদের পৃথিবীতে তারা- আমরা কি ছায়াপথের ভিতরে?
-হুই তারাটির নামই অনুরাধা। ও আমার স্ত্রী নয়- বলে আমার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠল সমরেশ।
হোটেলে তখন বেশি কেউ ছিল না। কিন্তু যে দু’চারজন লোক খাচ্ছিল কিংবা পেগ টানছিল, তারা সমরেশের দিকে একবার ফিরে তাকাল কি না তাকাল, মুহূর্ত্তের মধ্যেই নিজেদের কাজে মন দিল তারা।
-বান মাছ দেখেছ
-দেখেছি বৈ কি
-দীঘির শ্যাওলার ভিতর কেমন শটকে বেড়ায় দেখেছ! ওকে বলে বান-শটকান্ শটকানো- হোঃ হোঃ হোঃ- হোঃ হোঃ হোঃ- আমার স্ত্রীর কাছ থেকে আমি শটকে পড়েছি, নিখিলেশ- এক পরস্ত্রীর হুদ্দায়।
-কবে থেকে?
-সেই পরস্ত্রীটি কে জান, নিখিলেশ?
-কে?
সমস্ত হোটেলটাকে বিপর্য্যস্ত করে হাউ-মাউ করে কেঁদে হেসে উঠল সমরেশ।
কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরেই খুব চুপ মেরে গেল।
বল্লে- আমি বিয়ে করিনি। এইবার করব। আমার নিজের স্ত্রীকেই বিয়ে করব আমি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাচ্ছি না তো।
পকেট থেকে একটা ফোটো বের করে সমরেশ। একটি স্ত্রীলোকের ফোটো- ফোটোর নিচে যা লেখা ছিল, তা পড়ে বুঝলাম, মহিলাটি সমরেশের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী এবং অল্প কিছুদিন হল (সন্তান প্রসব করতে গিয়ে) মারা গেছেন।
হালে মদ ধরেছে হয়তো সমরেশ। কিন্তু না ধরলেও পারত। মানুসের যখন তৃতীয় পক্ষ গ্রহণের নসয় আসে জীবনে, তখন সে তো চতুর্থ পক্ষের হাত ধরে সকালে গঙ্গালাভ করবার জন্যে নিতান্তই প্রস্তুত।
-আমাকে বিশ্বাসন কর- আমি মদ ছেড়ে দিয়েছি- বলে সমরেশ। কিন্তু আমি অনেক সময়ই ভেবে অবাক হই যে, আমাদের দেশে এটা-একটা মানুসেল তিন-চারটে স্ত্রীর প্রয়োজন ঘুচল না কেন।
খানিতক্ষণ নিস্তেজ হয়ে বসে থেকে চুরুট জ্বালাল সমরেশ। চুরুটের আগুনে চুমকির জেল্লায় ভরে উঠল ক্রমে-ক্রমে তার চোখ।
এক বোতল হুইস্কির প্রয়োজন হয়ে পড়ল তার। আমাকেও খাওয়াবে।
-চারজর স্ত্রী পর-পর আসে- একসঙ্গে এসে হামলা করে না। সেই জন্যেই ঝুঁকি পোয়াতে পারি- বল্লে সমরেশ।
পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে বিয়েই করেনি- স্ত্রীলোকের প্রতিও আসক্ত নয়- মদ ভেলেও টাকা বেঁচেছে ঢের। তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে খানিকটা সুস্থতা শান্তি ও সমাজের কল্যাণের জন্যে নানা রকমভাবে টাকা খরচ করেছে সে; কিন্তু আমাদের এই আধুকি পৃথিবীর অগম গোলধাঁধার অন্ধকারে কেটা দেশলাইকাঠির আলোও ঠিকরে বেরুল না তাতে। অনেক কঠিন সমীচীন চিন্তার পর মধ ধরেছে তাই সমরেশ- পৃথিবীকে মাঝে-মাঝে অপূর্ব মনে হয় তার, নর-নারীর মুখ প্রদীপ্ত মনে হয়, উৎকৃষ্ট উজ্জ্বল রেণুপরমাণুর আলোড়নে মানবসমাজ ঝিকমিক করতে থাকে, অমৃত হয়ে ওঠে।
এরপর একদিন সমরেশের বাড়ীতে গিয়ে দেখা করলাম তার সঙ্গে। অন্ধকার ঘরে একা বসে ছিল সে। সমস্ত বাড়ীতে একটা চাকর আছে শুধু, আর কেউ নেই।
-তুমি আমাকে সেদিন একটা ফোটো দেখিয়ে ঠকাতে চাচ্ছিলে কেন, সমরেশ?
-সেদিনের কথা ছেড়ে দাও ভাই। যে-সময়টা মদ খাই না, বসে-বসে এই সব করি আর কি! যুদ্ধ করি আর বি! যুদ্ধ, অগণ্য, আন্দোলন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, আরো দাঙ্গা, আরো যুদ্ধ, আরো মন্বন্তর আজকের পৃথিবীতে মানুষ কী করতে পারে আর- বলে দেবে আমাকে? এ ছাড়া কোথায় কে কি করছে আর- দেখিয়ে দেবে আমাকে!
যে বিয়ে করেনি, তার তৃতীয় পক্ষের ছবি অপরকে দেখানো ছাড়া আজকের পৃথিবী কি আর কিছুই করছে না? আধুনিক পৃথিবীর ভিতরের কথা কি এমনই অকিঞ্চিতকর? সমরেশের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে কোনো লাভ হল না। সে যুক্তিতর্ক উপেক্ষা করে অন্যমনস্ক হয়ে রইল।
-এখন আমি হুইস্কি খাব। তুমি খাবে?
-না
-অতিরিক্ত মদ খেলে ট্যাঁক ও লিভার পচার হয়? আমি হিসেবী মানুষ, একা মানুষ, আমার ট্যাঁক কিছু আছে; লিভারও ভালো, এটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি- তিনি কোনোদিনও চাও খাননি। ভূদেব মুখুয্যের খাত ঝিল বাবার- ব্রাহ্মসমাজের ছোঁয়াচেও এসেছিলেন- ওদিকে ভিক্টোরিয়ার আমল চলছে; মানুষের মনে আশা ছিল ঢের- চা দিয়ে কী হবে। চা!
সমরেশ চুরুট জ্বালিয়ে বল্লে- তিনি এসে পড়েছেন। আচ্ছা, তাহলে এখন উঠি।
-তিনি এলেনই শেষ পর্য্যন্ত? হুইস্কির বোতলটার দিকে তাকিয়ে বল্লাম আমি।
-হ্যাঁ। তোমাকে আর টানব না। তুমি যাও। বাইরের বড় বড় সব দিলপাশে আরো কয়েকটা বছর পাক কেয়ে এসো। বৈজ্ঞানিক শুভবুদ্ধি, সমাজ, ইতিহাস- এই সবের টনক নিয়ে দেখো কোনো সুরাহা করতে পার নি আজকের দুর্দ্দিনে। আমি তোমাকে বলেছি, নিখিলেশ, পৃথিবীর মঙ্গল হই। সাদা চোখে পৃথিবীটাকে খারাপ দেখলেও এই বোতলের জিনিষ কিছু টেনে নিলে টের পাই কর্ম্মের পথ ছেড়ে আমি যে আজ সিদ্ধপুরুষ হয়েছি, সে তো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখবার জন্য। দেখছি- দেখাচ্ছি প্রথপ্রদর্শক হয়ে রয়েছি- তোমার বুক বেঁধে এগিয়ে চলো। নি-খি-লে-শ!-
সমরেশের ঘরে অনেক রাত অব্দি জেগে থেকে দেখলাম, লোকটা মদ খাচ্ছে- মদই খেয়ে যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন- বিষয় নিলেমে চড়েছে- প্রিয়নকে হারিয়েছে কিংবা ওম্নি কোনো গভীর অরুন্তুদ আঢ়াত পেলেছে বলে নয় (কিন্তু আঘাত তবুও আরো গভীরতর)- কিন্তু এম্নিই- হো হো করে হেসে উঠবার জন্যে- আমাকে, তার চাকরকে, বেড়ালটাকেও ধরে চুমো খাবার জন্যে, সমস্ত আকাশ বাতাশ পৃথিবী নক্ষত্রলোকের বিশ্বম্ভর সৌন্দর্য্যে উদ্বেল-উৎসারিত হয়ে উঠবার জন্যে।
তারপর কী ভীষণ নিস্তব্ধতা- কী অন্ধকার- কী অনমনীয় অন্তহীন মরণলুপ্তি। দেশে সমাজ জাতি- এবং ক্রমে-ক্রমে সমস্ত গোটা পৃথিবীরই মঙ্গল কি করে হয়, এ নিয়ে দির রাত মাথা-ঘামাতে ও পরিশ্রম করতে দেখেঠি সমরেশকে আমি। পৈতৃক সম্পত্তি ছিল তাদের- বড় জমিদারী ছিল- সমস্ত সে নিঃশোষিত করে ফেল্ল একটা অসম্ভব সজ্ঞাভাবিত স্বপ্নমঙ্গলের উত্তেজনায়। অনেক পড়াশুনা করল, পাশ করল, কত রকম দেশকল্যাণ ও সমাজ উন্নতির প্রতিষ্ঠান রচনা করল সে, ভাঙল, পুনর্গঠন করল, খাটল, জেলে গেলে, বিপ্লব করল, মানুষও খুন করেছিল হয়তো মানবতাকে কনে-দেখা আলো দেখাবার বদলে উদয়সূর্য্য দেখাবার জন্যে; কিন্তু কিছুই শেষ পর্যন্ত দেখাতে পারেনি সে।
কেই বা দেখিয়েছে? অরুসূর্যের দেশকে উদররঞ্জিত অনুসূর্য দেখানো কি সহজ। তবুও মানুষ সাহস স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত চেষ্টা করে যায়- মহামানুষ যারা। সমরেশ কি রকম মানুষ ছিল? (জানি না।) সম্প্রতি অনেক দিন পর্য্যন্ত তার কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। সে চা খেত না সিগারেট খেত না, বিয়ে যে করবে না তো তো সকলেই জানত, মেয়েমানুষের দিকে ফিরেও তাকাল না কোনোদিন সমরেশ। তার মত সুদৃঢ় সুপুরুষের পক্ষে এই শেষোক্ত জিনিষটা কেমন অসঙ্গত ঠেকত আমার চোখে। সমরেশকে হাত করবার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় পরাস্ত হয়ে এক শরীরী নারী নিঃসহায় ভাবে আমার দিতে তাকাতে আমি বিরক্তি বোধ করতাম- কেন, আমার কথা প্রথম বুঝি মনে ছিল না তোমাদের? আমি কি করব? এই সৃষ্টির অন্তর্লীন বিরাট বেকুবির কাছে তোমাদের মত আমাকেও ধর্না দিতে হচ্ছে। সমরেশ আমাদের অতীত; একটি বালিকণার ভিতর সমস্ত সুন্দর সুষম ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে পেয়েছে সে- তারপর অন্য দিকে মুখ ফেরাবার নিদারণ আহ্বান এসে পড়েছে যখন, কেমন উজ্জ্বল নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে আছে সে একটি পল-নিপলকণার ভিতর সমন্ত দেশকাল নিজের বুকের রোমের ভেতর ঘুমিয়ে-পড়া সারসের ঠোঁটের মতা ঠাঁই পেয়েছে অনুভব করে। (সংগৃহীত)

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
জীবনানন্দ দাস- র আরো পোষ্ট দেখুন