বিনা খালাদের বাড়ি

লিচুপাতা থেকে পিছলে পড়ছে সকালবেলার রোদ।

একটুখানি হাওয়া আছে। সেই হাওয়া খোকন মামা মিন্টু মামার মুখের ঘাম মুছতে পারেনি। এই সকালেই কোথায় কোথায় যেন ছোটাছুটি করে এসেছেন দুজনে। ঘাড়ে-গলায় ঘাম, নাকের তলায় ঘাম। ঘামকণায় চিকচিক করছে মুখ।

খোকন মামার হাতে গুলতি, মিন্টু মামা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। লিচুডালে বসেছে শালিক পাখি। গুলতির কালো রাবারে পোড়ামাটির গুলি ধরে শালিক পাখির দিকে তাক করেছেন খোকন মামা, ঠিক তখনই আমরা এগারোজন মানুষ লিচুতলায়। লিচুতলা দিয়েই বাড়িতে ঢুকতে হয়। গেট খোলাই থাকে।

আমাদের দেখে গুলতি ধরা হাত থেমে গেল খোকন মামার। মিন্টু মামা প্রথমে একটা লাফ দিলেন, তারপর ছুটে গেলেন বাড়ির ভিতর। মা, ও মা, আনু আপায় আসছে। আজাদরা সবাই আসছে। তাড়াতাড়ি আসেন।

আমার মায়ের নাম আনোয়ারা। আত্মীয়স্বজন ডাকেন আনু। এই বাড়ি মায়ের একমাত্র মামার বাড়ি। বুজির ছোট ভাইয়ের বাড়ি। তাঁর নাম আবুল হোসেন খান। ডাকনাম আবেদিন। বুজি ডাকেন ‘আবদিন’। কাছে-পিঠের কেউ কেউ ডাকেন আবদিন খাঁ। সামনাসামনি আমরা ডাকি নানা। আড়ালে ডাকি আবদিন নানা।

আবদিন নানার সংসার আমাদের মতোই বড়। তবে আমাদের মতো গরিব না। সচ্ছল সংসার। আমাদের মতো এক কামরার ভাড়া বাসায় তাঁরা থাকেন না। থাকেন নিজের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ির মতো খোলামেলা বড় বাড়ি। গাছপালা আছে; পুকুর, বাগান আছে। পুকুর, বাগান নিজেদের না। বাড়ির লাগোয়া বলে নিজেদের মনে হয়।

তখন পর্যন্ত আট ছেলেমেয়ে নানার। টুনু মিনু অনু খোকন মিন্টু বিনা সেন্টু রিনা। আম্মার কোলে যেমন রিনা, নানির কোলেও তেমন রিনা। দুজনের বয়স দু-এক মাসের এদিক ওদিক। রিস্তায় খালা বোনঝি। নাম এক।

টুনু মিনু অনুর সঙ্গে মিলিয়ে খোকন মামার নাম রাখা হয়েছিল ‘রনু’। আমার আব্বা ছাড়া কেউ তাঁকে সেই নামে ডাকে না।

এখনো সেই নামেই খোকন মামার সঙ্গে কথা বললেন আব্বা। কী খবর রনু, আছ কেমুন?

দাদা আর মিন্টু মামা এক বয়সের। দুজনেই ক্লাস ফোরের ছাত্র। খোকন মামা ওদের চেয়ে বছর দু-আড়াইয়ের বড়। দু-ক্লাস ওপরে পড়েন। ক্লাস সিক্স। গায়ের রং টকটকে ফর্সা, খাড়া নাক, ভাসা ভাসা সুন্দর চোখ, মাথার চুল রেশমি। চেহারা ভালো। লম্বা ধরনের, রোগা পাতলা শরীর।

আব্বার কথা শুনে হাসলেন খোকন মামা। ভালো আছি দুলাভাই। চলেন, বাড়িতে চলেন।

গুলতিকে আমরা বলি ‘গুলাইল’।

আব্বা বললেন, গুলাইল দিয়া পাখি মারন বহুত কঠিন। হাতের সই ঠিক করন লাগে। মারতে পারছো দুয়েকখান পাখি?

না দুলাভাই, পারি নাই।

আব্বার ইংরেজি উচ্চারণ খুব সুন্দর। বললেন, প্র্যাকটিস করো, ভালো মতন প্র্যাকটিস করো। প্র্যাকটিসে সব হয়।

খোকন মামা লাজুক মুখ করে হাসলেন।

মা আম্মা ঢুকে গেছেন বাড়ির ভিতর। নানিকে খবর দিয়ে আবার ছুটে এসেছেন মিন্টু মামা। দাদার হাত ধরেছেন। আজাদ আজাদ বলে অস্থির। আমি আর আব্বা খোকন মামার সঙ্গে।

খোকন মামা আমার হাত ধরলেন। আসো মিলু।

এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো হেজিপেজি না। দেখতে সুন্দর, কথা বলে সুন্দর করে। আমাদের মতো তুই তুই করে না। তুমি করে বলে।

বাড়িতে ভালো রকমের সাড়া পড়ে গেছে।

আজ ছুটির দিন। আবদিন নানা বাড়িতেই আছেন। হাতে বাজারের ব্যাগ, বাজারে যাচ্ছিলেন। পরনে লুঙ্গি আর ঝুলপকেটঅলা সাদা শার্ট। পায়ে রাবারের কালো পাম শু। নানা উঁচু লম্বা স্বাস্থ্যবান মানুষ। গায়ের রং শ্যামলা। চেহারা খুব সুন্দর। মাথায় সামান্য টাক পড়তে শুরু করেছে। চোখে চশমা। চশমার ভিতর তাঁর ভাসা চোখ একটু যেন বেশি ভেসে আছে। নানার এই চোখ পেয়েছেন আমার মামা খালারা সবাই।

নানা দাঁড়িয়ে আছেন উঠানের কোণে। মা আম্মাকে দেখে অমায়িক মুখে হাসলেন। কী রে আনু পুনু, কেমুন আছস তোরা? আইসা ভালো করছস। বহুত দিন বাদে তগো দেখলাম।

মুকুল রিনাকে কোল থেকে নামালেন মা আম্মা। নানার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে করতে বললেন, আপনের দোয়ায় ভালো আছি মামা।

দুই ভাগ্নির মাথায় হাত রাখলেন নানা। থাউক থাউক, ছেলাম করন লাগবো না।

নানার ব্যাগ ধরা হাত পড়েছিল আম্মার মাথায়।

এই বাড়িতে কুয়া নেই। চাপকল আছে, পানি রাখার হাউস আছে। নানি সেদিকটায় ধোয়াপাকলার কাজ করছিলেন। পরনে হালকা আকাশি রঙের সুতি শাড়ি। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এলেন।

আব্বার সঙ্গে আমিও তখন উঠানে।

নানার মতো করে নানিকেও সালাম করলেন মা আম্মা। আব্বা পায়ে হাত দিলেন দুজনারই। দুজনেই বললেন, বাইচা থাকেন, বাইচা থাকেন।

আব্বাকে দুজনেই আপনি করে বলেন। আব্বার ডাকনাম গগন। ভালো নাম গিয়াস উদ্দিন খান। গগন বা গিয়াস উদ্দিন কোনো নামেই তাঁকে তাঁরা ডাকেন না। ডাকেন ‘আজাদের বাপ’ বলে।

নানি আমার মায়ের মতোই সুন্দর। চাঁপা ফুলের পাপড়ির মতো গায়ের রং। তেমন লম্বা না, আবার খাটোও বলা যাবে না। একহারা পাতলা শরীর। আমার মায়ের স্বাস্থ্য ভালো।

নানির মুখ ঘামে চিকচিক করছে। ঠেঁাঁটে মৃদু হাসি।

দোতলা ঘরের সামনের উঠানে তখন বেশ একটা ভিড়। বাংলাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন টুনু মামা অনু মামা। মিনু খালা দোতলায় বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছিলেন।

ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে

আমি বনফুল গো

উঠানের দিকে হইচই শুনে গান থামিয়েছেন। প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলেন। মিনু খালার পরনে হালকা হলুদ রঙের শাড়ি। মুখটা কী সুন্দর! যেন দোতলা থেকে হলুদ একটা পরি নেমে এলো। মা আম্মাকে দেখে কী যে খুশি! একবার মায়ের হাত ধরেন, একবার আম্মার। আপা আপা বলে অস্থির।

টুনু মামা একটু গম্ভীর প্রকৃতির। অনু মামা প্রাণবন্ত। আব্বাকে খুব পছন্দ করেন। দুলাভাই দুলাভাই ডাকছেন আর হাসছেন।

কী সুন্দর দেখতে অনু মামা। একদম রাজপুত্র।

আমি অবাক চোখে অনু মামাকে দেখি। ছেলেদের গায়ের রংও এত ফর্সা হয়? ছেলেদের চোখও এত সুন্দর হয়? মাথার চুল কী সুন্দর অনু মামার! হাসি কী সুন্দর!

অনু মামাকে যত দেখি তত মুগ্ধ হই। যেন আজই অনু মামাকে প্রথম দেখছি। যেন আগে কখনোই দেখিনি তাঁকে।

খোকন মামা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন, মিন্টু মামা ধরে আছেন দাদার হাত। বিনা খালা মণির সঙ্গে। ওরা দুজন এক বয়সী। সেন্টু হচ্ছে বাদল পলির সমান। সে আছে ওদের সঙ্গে। একটু গম্ভীর ধরনের, কম কথা বলা শিশু। কোলের তিনজন, দুই রিনা আর মুকুল এত মানুষের মাঝখানে থেকেও আলাদা হয়ে গেছে। কোল থেকে নামতে পেরে তারা যেন স্বাধীন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এদিক যায়, ওদিক যায়।

আমি পড়ে গেছি মাঝখানে। এই বাড়িতে আমার বয়সী কেউ নেই। হয় বড়, নয় ছোট।

খোকন মামার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি তখন বাড়িটা দেখছি। যেন এই বাড়িও আজই প্রথম দেখছি। যেন এই বাড়ি আগে কখনো দেখিনি। অথচ এই বাড়িতে একবার দুবার এসেছি। ধু ধু মনে পড়ে সেই কথা। চোখের সামনে আবছায়ার মতো দোল খায় সেসব স্মৃতি।

তখন বর্ষাকাল। ভোররাত থেকে তুমুল বৃষ্টি। বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রাম। আমার নানাবাড়ির চারদিকে পানি। উঠান পালানেও পানি উঠবে, এমন অবস্থা। বাগানের ওদিকে লেগে আছে বড় একটা ছইঅলা নৌকা। সেই নৌকায় চড়ে গোয়ালিমান্দ্রা না শ্রীনগর কোথায় যেন এলাম আমরা। বৃষ্টিতে অন্ধকার চারদিক। বৃষ্টির তোড়ে ফুটতে পারছে না ভোরের আলো। আমাদের সঙ্গে পুরুষ মানুষ কে আছে মনে নেই। আব্বা নাকি সেরুদা?

ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চ। ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। নাকি ছেড়েই দিয়েছে! ভটভট শব্দটা যেন পাচ্ছি! নৌকা গিয়ে লেগেছে লঞ্চের গায়ে। আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? লঞ্চের জানালা দিয়ে নৌকা থেকে মাঝি লোকটা আমাকে দুহাতে তুলে ভিতরে চালান করে দিল। ওপাশ থেকে কে যে ধরল, মনে নেই! বাচ্চাদের তোলা হলো এইভাবে। মা আম্মা আর বুজি উঠলেন লঞ্চের পিছন দিক দিয়ে। নাকি জানালা দিয়েই উঠলেন! সঙ্গে কত বোঁচকাবাঁচকি।

আমার চোখে ঘুম লেগে আছে। লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের এক পাশের বেঞ্চে সার ধরে বসেছি আমরা। তখনো মুকুল রিনা হয়নি। মায়ের কোলে ডলি। বাদল লেগে আছে বুজির বুকে। আম্মার কোলে ঘুমিয়ে আছি আমি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। আকাশে নৌকার মতো ভাসছে কালো মেঘ। বিদ্যুতের চমক আর গুড়গুড়ে মেঘডাকে ঘুম ভাঙে। লঞ্চের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি দিনের আলো ফুটছেই না। মেঘের কালো ছায়া আর ঘন কুয়াশার মতো বৃষ্টিতে ভটভট শব্দে চলছে লঞ্চ। হু হু করা হাওয়ায় বৃষ্টির ‘হ্যাচলা’ আসে। খাল আর দুই পাশের আমন আউশ ধানের মাঠ, ঠাস বুনট পাট ধনচের ক্ষেত পানিতে একাকার। কোনটা যে পাড় আর কোনটা যে খাল চেনা যায় না। খালের ধারে গিরস্তবাড়ি, বাজারঘাট। বৃষ্টি ভেজা মানুষ আর গাছপালা। হঠাৎ ভেসে ওঠে পুরনো জমিদার বাড়ির মতো বাড়ি। কী নির্জন! গিরস্তলোক নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে দিনের কাজে। খালি গায়ে লুঙ্গি কাছা মারা। হাতে বৈঠা নয়তো লগি। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে শরীর। একাকী নৌকা নিয়ে কোথায় যায় মানুষটা!

কত খাল পেরিয়ে যায় লঞ্চ! কত নদী! শীতলক্ষ্যা বুড়িগঙ্গা হয়ে সদরঘাট। বিকাল হয়ে গেছে। নাকি সন্ধ্যা! বুঝতে পারছি না কিছুই। একনাগাড়ে একই তালে ঝরছে বৃষ্টি। আকাশে ভাসমান মেঘ আর তার ডাকাডাকি। বিদ্যুতের চমক আর হাওয়া। খাল আর নদীর পানিতে তীব্র স্রোত। চোখে ভাসে শুধু খাল আর নদীর পানিতে স্রোতের খেলা।

কখন এসে সদরঘাটে লাগল লঞ্চ, কিভাবে নামলাম লঞ্চ থেকে, সেসব মনে পড়ে না। সদরঘাট থেকে কিভাবে এলাম গেণ্ডারিয়ায়, তাও মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে বৃষ্টিতে প্যাচ প্যাচ করছে বাড়ির উঠান। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। বৃষ্টিতে হাওয়ায় তোলপাড় করছে লিচুগাছের পাতা।

এমন দিনে এতগুলো মানুষ আমরা বিক্রমপুর থেকে সরাসরি এসেছি ঢাকার গেণ্ডারিয়া, আবদিন নানার বাড়িতে। এই বাড়িতেও লোকজন কম না। বৃষ্টিতে নিঝুম হয়ে থাকা বাড়ি আমরা আসার ফলে হঠাৎই যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে। আমরা পোলাপানরা হইচই করছি। বুজি বিবিখানা পিঠা বানিয়ে এনেছেন ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য। দশ-বারোটা পেটমোটা বিশাল সাইজের ইলিশ, এক ‘ছেইয়া’ করে কেটে জ্বাল দিয়ে নিয়ে এসেছেন। এইভাবে আনলে ইলিশ মাছ নষ্ট হয় না। টিনভর্তি মুড়ি এনেছেন, তাল-খেজুরের মিঠাই এনেছেন। বড় বয়ামের তিন বয়াম আমের মোরব্বা, দুই বয়াম কাশ্মীরি আচার। কাশ্মীর আচারের সঙ্গে আস্ত পাকা মরিচ দিতে হয়। টকটকে লাল লম্বা মরিচ যেন ফিকফিক করে হাসছে বয়ামের ভিতর।

অলস ভঙ্গিতে বসে ডলিকে বুকের দুধ দিচ্ছেন মা। আম্মা গল্প করছেন টুনু মামা মিনু খালা আর অনু মামার সঙ্গে। বুজি বসে কথা বলছেন তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে। খোকন মামা মিন্টু মামা আর দাদা লুডু খেলতে বসেছেন। বৃষ্টির বিরাম নেই। ঝরছে তো ঝরছেই।

পরদিন বা তার পরদিনও থামে না বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতেই চলছে সংসারের কাজ। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়েছেন নানি। মা আর বুজি তাঁকে সাহায্য করছেন। টুনু মামা অনু মামা কোথায় মনে পড়ে না। আম্মা আর মিনু খালা দোতলায় বসে গল্প করছেন। খোকন মামা মিন্টু মামার সঙ্গে দাদাও বৃষ্টিতে কাদায় বাড়ির বাইরে চলে গেছেন। ধু ধু মনে পড়ে এসব।

মণি কোথায়? মণি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

বিকেলের দিকে মেঘলা আকাশ ভেঙে একটুখানি রোদের আভাস ফুটেছে। কমলার খোসার মতো আলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি দোতলা ঘরের চৌকাঠে। লিচুতলার ওদিক থেকে এলো বিনা খালা। উঠানের পিছল মাটিতে সাবধানে পা ফেলছে। ডালিম ফুলের মতো গাঢ় লাল রঙের ফ্রক পরা। লাল ফিতা দিয়ে নানি নাকি মিনু খালাকে তার মাথায় ঝুঁটি বেঁধে দিয়েছেন! বিনা খালার গায়ের রং গোলাপি রঙের গোলাপ পাপড়ির মতো। চেহারা যে কী সুন্দর! চোখ যে কী সুন্দর! বিনা খালার হাসিতে মেঘবৃষ্টি কাটিয়ে, অন্ধকার আবছায়া কাটিয়ে মুহূর্তে যেন উজ্জ্বল হয়ে যায় চারদিক।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আমি কি শুধু বিনা খালাকেই দেখেছি সেবার!

বিনা খালাকে আমার এই গরিব পৃথিবীর মানুষ মনে হয় না। সে যেন এই পৃথিবীতে থাকেই না। সে তো পরি! সে থাকে পরিস্থানে। পরিস্থান থেকে হঠাৎই যেন উড়ে এসেছে পৃথিবীতে। লিচুগাছ ঘেরা দোতলা টিনের ঘরঅলা বাড়িটাতে এসে নেমেছে।

এই বাড়ি নিয়ে এই তো আমার স্মৃতি।

আজ আর বিনা খালা লাল ফ্রক পরে নেই। সাদার ওপর বেগুনি রঙের ফুল আঁকা ফ্রক পরা। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। সে আছে মণিকে নিয়ে। আগে দেখা এই বাড়ি আমি যেন আর খুঁজে পাই না। নতুন করে বিনা খালাদের বাড়ি দেখতে থাকি।

বাড়িতে ঢোকার গেট পুবদিকে।

চার-পাঁচটা লিচুগাছ জড়াজড়ি করে আছে গেটের কাছে। গেট ঢেউটিনের। সারা দিন খোলাই থাকে। গেটের সঙ্গেই উত্তর দিকে মাঝারি সাইজের বাংলাঘর। পুবদিকে দরজা আছে। বাড়িতে ঢোকার জন্য এই দরজাও ব্যবহার করা যায়। বাংলাঘর দিয়ে ঢুকলে ভিতরে দক্ষিণমুখী আরেক দরজা। ওই দরজা দিয়ে বেরোলেই উঠান।

গেটের দক্ষিণে চটি বাঁশের বেড়া। গ্রাম এলাকার বনেদি বাড়িতে এই ধরনের বেড়া থাকে। দক্ষিণে বেড়া গিয়ে শেষ হয়েছে কচুরিভর্তি বিশাল এক জলাভূমিতে। জলাভূমির দক্ষিণ-পুবদিকে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন।

দক্ষিণে বাড়ির সীমানার পর বেড়া পশ্চিমে সামান্য বাঁক নিয়েছে। তারপর আর বেড়া নেই। জলাভূমির কচুরি বাড়ির সীমানায় স্থির হয়েছে। ওদিকটায় বেড়ার দরকার নেই। কয়েকটি বিচিকলার ঝাড়, ডুমুর আর ছিটকি ঝোপ পা বাড়িয়ে আছে জলাভূমির দিকে। একটা ভাঙাচোরা মুরগির খোঁয়াড় পড়ে আছে। এদিক-ওদিক দলা পাকিয়ে আছে মুরগির বিষ্ঠা। চার-পাঁচটা মোরগ-মুরগি নিঃশব্দে চরছে।

বাংলাঘর পুবে-পশ্চিমে। পশ্চিমেও বাংলাঘরের পর ও-রকম বেড়া, বেশ অনেকটা লম্বা। বেড়া ঘেঁষে বেলি মোরগ ফুল দোপাটি আর গন্ধরাজের চারা। অচেনা পাতাবাহার তিরতির করে কাঁপছে। কুঞ্জলতা বেয়ে উঠেছে বেড়ায়। দূর্বা ঘাসের মতো এক ধরনের ঘাসে ফুটে আছে গোলাপি ছোট ছোট ফুল। এগুলোকে বলে দূর্বা ফুল। আমরা বলি দুবলা ফুল।

বাড়ির পশ্চিম পাশে অনেকখানি খোলা জমি। সেই জমির কোথাও কোথাও সবুজ ঘাস, আগাছা। আবার কোথাও কোথাও সাদা মাটি উঁকি দিয়ে আছে। একটা-দুটো মেহেদি ঝোপ, কয়েকটা বেলি আর মোরগ ফুলের চারা, বেঁটেমতো একটা গন্ধরাজ আর মাঝারি সাইজের একটা জামরুলগাছ দক্ষিণের জলাভূমি ঘেঁষে। একটু নিষ্প্রাণ জায়গাটা। গাছগুলোর যত্ন নেই। আগাছার পরিমাণ বাড়ছে। জামরুলগাছটায় পাতাই নেই তেমন। ফুল আসে কি না, ফল ধরে কি না কে জানে। এই ন্যাড়া গাছেই কাক-শালিক বসে, বুলবুলি দোয়েল আর চড়ুই পাখি বসে। যে যার স্বভাবমতো ডাকাডাকি করে। ডালে বসে তাকিয়ে থাকে ভিতরবাড়ির দিকে।

এই জমিটুকু বিনা খালাদের না। তাদের কোনো আত্মীয় কিনে রেখেছে। বাড়িঘর করেনি, দখল নেয়নি। লোকে জানে, এ-ও বিনা খালাদেরই জমি। তাদেরই বাগান।

বাড়ির মাঝখানে ছবির মতন দোতলা ঘর। উত্তরমুখী ঘরের দোতলার বারান্দাটা খুব সুন্দর।

ঘরের দক্ষিণে পিছন দিককার একচিলতে উঠান। উঠানের পর কচুরিভর্তি সেই জলাভূমি। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে টঙঘরের মতো পায়খানাঘর। লঞ্চে ওঠার সিঁড়ির মতো কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ির দুই পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে, তার ওপর আড়াআড়ি বাঁধা হয়েছে শক্ত মোটা বাঁশ। ওই বাঁশ ধরে ধরে সিঁড়ি বাইতে হয়। পায়খানাঘরে ঢুকতে হয়।

সিঁড়ির গোড়ার দিকে একটা আমগাছ। বয়স হয়েছে গাছের। পেট গোড়া বেশ মোটা। কালো বাকল বেয়ে অবিরাম চলাচল করছে লাল কালো পিঁপড়া, ‘ওল্লা’ আর ‘ডাইয়া’। গাছের পাতাগুলো তেমন সতেজ না। মরা মরা, নিষ্প্রাণ।

আমগাছের গোড়ার কাছে বাঁধানো বেদি। একটা চাপকল বসানো। চাপকলের পাশে পানি ধরে রাখার হাউস। তেমন বড় না হাউস, তেমন গভীর না। বহু ব্যবহারে কোনাকানি ভেঙে গেছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না বোধ হয়। ভিতরের দেয়াল আর তলায় স্বচ্ছ পানির ভিতর দিয়েও হালকা সবুজ শ্যাওলা দেখা যায়। গুঁড়ি গুঁড়ি পানিপোকা ছোটাছুটি করে।

হাউসের উত্তরেই রান্নাঘর। মাথার ওপর টিনের একচালা, তিনদিকে বাঁশের বেড়া।

রান্নাঘরের পুবে কয়েক কদম পেরোলে দোতলা ঘরের পশ্চিম দিককার দরজা। বৃষ্টি বাদলার দিনে আঁটাল মাটি পিছল হয় দেখে হাতখানেক দূরে দূরে থান ইট ফেলা। তারপর চার-পাঁচ ধাপের পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে উঠলেই দোতলা ঘরের নিচতলা।

উত্তর দিককার উঠান থেকে দোতলা ঘরে ঢুকতে হলেও এ রকম চার-পাঁচ ধাপের বাঁধানো সিঁড়ি। ঘরটা যে কী সুন্দর! নিচতলায় পাকা মেঝে। লালচে ধরনের রং মেঝের। ঢোকার মুখে কাঠের চৌকাঠ। ঘরে ঢুকলেই উত্তর-পশ্চিম কোণে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। ওপরটা পাটাতন করা। কাঠের রেলিং দেওয়া ঝুলবারান্দা ছবির মতন।

আমরা ঘরে ঢুকেছি উত্তরের দরজা দিয়ে।

নিচতলার তিন ভাগের এক ভাগ বরাবর উত্তর-দক্ষিণে টিনের বেড়া, সিঁড়ির পুবদিকে দরজা। পশ্চিম পাশে বড় একটা চৌকি পাতা। দক্ষিণের জানালা ঘেঁষে একটা মিটসেফ। এই চৌকিতে বসে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। রান্নাঘরের দিককার দরজার দুই পাশে দুটো জানালা।

ওপাশটা অনেক বড়। বড় সাইজের দুখানা খাট পাতা। একটা উত্তরের জানালা ঘেঁষে, আরেকটা দক্ষিণের। তোশকের বিছানা খাটে। সুন্দর চাদর টান টান করে বিছানো। কাঠের হাতলঅলা চেয়ার আছে তিন-চারটা। একটা টেবিল। মাথার ওপর মচমচ করে শব্দ হয়। দোতলায় কেউ হাঁটছে। পুবের জানালা দিয়ে এসেছে রোদ। কী রকম আমুদে ভাব তৈরি হয়েছে বাড়িতে।

সবাই যে যার বয়সীকে নিয়ে ব্যস্ত।

মা আম্মা মিনু খালা টুনু মামা অনু মামা আর আব্বা একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করছেন। নানি ব্যস্ত হয়েছেন রান্নাবান্নায়। রানি নামের মেয়েটিকে আমরা কেউ খেয়াল করিনি। বিনা খালা আর মণির বয়সী হবে। নাকি বছরখানেকের বড়? গোলগাল একটু মোটা মতো। নানির ছোট ভাইয়ের মেয়ে। ভাই মারা গেছেন। রানি খালা এখন বিনা খালাদের সংসারে। এখানে থেকেই পড়াশোনা করছেন রানি খালা, ঘর-সংসারের কাজে নানিকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

এখনো নানির সঙ্গে রান্নাঘরে তিনি।

দোতলা ঘরের নিচতলার পুব পাশে বসে মা আম্মাদের গল্পগুজব চলছে। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। টুনু মামা পেয়েছেন নানার গায়ের রং। তিনি শ্যামলা। রোগা একহারা গড়ন। চোখ খুব সুন্দর। চেহারায় কী রকম একটা ভাবুক ভাব। কথা বলেন ধীর শান্ত ভঙ্গিতে। হইচই চিল্লাচিল্লি একদম নেই। গম্ভীর ধরনের মানুষ। টুনু মামার হাসি খুব সুন্দর। আম্মার বয়সী বলে আম্মার সঙ্গে বন্ধুত্ব। আম্মাকে নাম ধরে ডাকেন। পুনু। মাকে ডাকেন আপা।

টুনু মামার সঙ্গে খোকন মামার চেহারার বেশ মিল। শুধু গায়ের রঙে ব্যবধান। দুই রিনা আর মুকুল মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। রিনার গায়ের রংও নানার মতো। আর সবাই পেয়েছে নানির রং। মিনু খালাও একটু যেন নানার রঙের। কিন্তু অনু মামা মিন্টু মামা বিনা খালা সেন্টু একদম সাহেব-মেমদের মতো।

খোকন মামার হাতে গুলাইল আছেই। এত লোকজন, এত আমোদ ফুর্তির মধ্যেও গুলাইল ছাড়েননি তিনি। নানা বাজারে চলে গেছেন, এতগুলো মানুষ আসার ধাক্কা সামাল দেওয়া হয়ে গেছে। এখন একটু স্থিরভাব বাড়িতে। মিন্টু মামা তো খোকন মামার সাগরেদই, এই বাড়িতে ঢুকে দাদাও তাঁর সাগরেদ হয়ে গেছেন। তিনজনে আবার ছুটে গেছেন বাড়ির বাইরে। লিচুগাছে শালিক পাখির ঝাঁক বসেছে। যদি একটা মারা যায়!

নানা-নানির সামনে সিগ্রেট ধরাতে পারেন না আব্বা। এমন কি পকেটে যে সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ আছে তাও তাঁদের যাতে চোখে না পড়ে সে জন্য ঝুলপকেটে রেখেছেন। রিস্তায় তাঁরা দুজন হচ্ছেন আব্বার মামাশ্বশুর আর মামিশাশুড়ি। তাঁদের সামনে সিগ্রেট ধরানো তো দূরের কথা, পকেটে যে সিগ্রেট আছে, তাঁর যে সিগ্রেট খাওয়ার অভ্যাস আছে সেটাই জানাতে চান না। বেয়াদবি হবে। আড়ালে আব্বাকে তাঁরা বলবেন, বেয়াদব জামাই।

আমি দাঁড়িয়ে আছি দোতলার সিঁড়ির সামনে। শুনি, টুনু মামাকে আব্বা বলছেন, ও টুনু, মামায় তো শ্যামবাজার গেছে, না?

টুনু মামা তাঁর শান্ত ধীর স্বভাব নিয়ে হাসলেন। হ্যাঁ, দুলাভাই।

ক্যা, সূত্রাপুর বাজারে যায় না?

কোনো কোনো দিন যায়। সূত্রাপুর ছোট বাজার। মাছ তরকারি ভালো পাওয়া যায় না। শ্যামবাজারে মাছ তরকারির আড়ত। দামও কম। আপনেরা আসছেন, বাবায় আজ শ্যামবাজারেই গেছে।

তয় আসতে দেরি হইব।

তা হবে। ঘণ্টা দুই আড়াই লাগবে।

আব্বা তাকালেন মায়ের দিকে। আজাদের মা, মামানি আম্মায় তো রান্ধনঘরে! এইদিকে আইবো নি?

মনে হয় না।

তয় একখান সিগ্রেট ধরাই?

ধরান।

খ্যাল রাইখো। আম্মায় এই দিকে আহনের আগেই আমারে কইয়ো।

কমু নে।

ঝুলপকেট থেকে ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ বের করলেন আব্বা। ঠোঁটে সিগ্রেট লাগিয়ে ম্যাচ জ্বালালেন। ডান হাতে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি, সেই হাত আঁজলা করে সিগ্রেট ধরালেন। পুব দিককার খোলা দরজা দিয়ে কাঠি ছুড়ে ফেললেন, নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হাসলেন। অনু মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী অনু মিয়া, রোকনপুরের বাসার কথা মনে আছে নি? খালি আমার পিছে পিছে ঘোরতা আর কইতা, দুইডা পয়সা দেন দুলাভাই।

অনু মামা হাসলেন। সব মনে আছে। আপনে খালি আমারে ঘুরাইতেন। আপনের পিছন পিছন অনেক দূর চইলা যাইতাম আমি।

তয় তোমারে তো আমি পয়সা দিতাম।

ঘুরাইয়া ঘারাইয়া দিতেন।

তুমি হইলা আমার শালা। শালারে সব দুলাভাইরাই ঘুরায়।

আমি একা হয়ে গেছি অনেকক্ষণ। কী করব এখন? এই তো দোতলার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দোতলায় উঠে যাবো? দেখে আসব, কী আছে দোতলায়?

আগেরবার যখন এসেছিলাম, দোতলায় উঠেছিলাম কি না মনে নেই। মিনু খালা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছিলেন, হারমোনিয়ামটা যদি একটু দেখা যায়! এই বাড়িতে কলের গানও আছে। কোথায় রাখা কলের গান? দোতলায়?

বিনা খালাদের বাড়ির হারমোনিয়াম আর কলের গান নাকি আমার নানার। অর্থাৎ মায়ের বাবার। নানা ছিলেন ব্রিটিশ জাহাজের সারেং। টাকা-পয়সা ছিল বিস্তর। আগের স্ত্রী এক মেয়ে রেখে মারা যান। সেই মেয়ে হচ্ছেন সেরুদার মা। পরে বিয়ে করেন আমার বুজিকে। সেই ঘরের বড় মেয়ে আমার মা। খুবই আদরের মেয়ে। মা যাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন এ জন্য কলকাতা থেকে হারমোনিয়াম এনেছিলেন মেয়ের জন্য। মেয়ে যাতে গান শুনতে পারে এ জন্য কলের গান কিনে এনেছিলেন। যখন যে নতুন রেকর্ড বেরোত মেয়ের জন্য নিয়ে আসতেন। টিনের সাদা সাদা বাক্সে থাকে কলের গানের রেকর্ড। পিনের বাক্সগুলো ছোট ছোট। ভারি সুন্দর।

মায়ের হারমোনিয়াম আর কলের গান এই বাড়িতে এলো কী করে?

বুজি বলেছেন, তিনি তাঁর ভাইকে খুবই আদর করেন। ভাইয়ের গান-বাজনার শখ আছে। নানা চাওয়ার পরও গানের দিকে মন দেননি মা। হারমোনিয়াম ছুঁয়েও দেখেননি। কলের গান ইচ্ছা হলে এক দিন বাজাতেন, না হলে মাসের পর মাস তাকিয়েও দেখতেন না। আবদিন নানা তাঁর বোনকে বললেন, আনু তো গান-বাজনা পছন্দই করে না। জিনিস দুইখান নষ্ট হইতাছে। আমি লইয়া যাই।

হারমোনিয়াম, কলের গান আর বাক্স বাক্স রেকর্ড হাসিমুখে ভাইকে দিয়ে দিলেন বুজি। মা-ও ওই নিয়ে কথা বললেন না।

আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, দেখতে ইচ্ছা করে দোতলার কোথায় রাখা সেই হারমোনিয়াম, কোথায় কলের গান!

কেউ দেখতে পায় না, চুপি চুপি দোতলায় উঠে যাই।

দোতলায় কোনো পার্টিশন নেই। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পরই খোলামেলা বড় একখানা জায়গা। কাঠের পাটাতনে ‘মাইট্টা তেল’ দেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। তার কালচে একটা আভাস রয়ে গেছে। উত্তর দিককার বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খোলা। পুব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ সব দিকেই দুটো করে জানালা। সব জানালাই খোলা। প্রচুর আলো ঢুকেছে দোতলায়। পুব দিককার দুই জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে ঢুকেছে রোদ। ওদিকটায় উত্তরের বেড়া ঘেঁষে এক পালঙ্ক, দক্ষিণের বেড়া ঘেঁষে আরেকটা। নিচের খাট দুটোর মতো উঁচু পালঙ্ক দুটোয়ও তোশকের বিছানা, পরিপাটি চাদর। পালঙ্কের মাথার দিক জানালার সঙ্গে। পালঙ্ক ছুঁয়ে তেড়ছা হয়ে রোদ পড়েছে মেঝেতে। একটা সাদা বিড়াল শুয়ে আছে দক্ষিণ দিককার পালঙ্কের জোড়া বালিশ ঘেঁষে।

খানিক আগে কি এই বিড়ালটাই হেঁটেছিল?

তাতেই কি মচমচে শব্দ হয়েছিল?

কিন্তু বিড়ালের হাঁটাচলায় তো শব্দ হয় না!

আমার পায়ের শব্দেও মুখ তুলল না বিড়াল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমি হারমোনিয়াম খুঁজি, কলের গান খুঁজি। আরে, এই তো, চোখের সামনেই তো জিনিস দুটো। কাঠের ভারী ধরনের একটা সিন্দুক রাখা দক্ষিণ দিককার পালঙ্কের পায়ের কাছে। তার ওপর রাখা কলের গান। শুধু একটা বাক্স। চোঙা নেই। বাক্সের রং তেঁতুলের খোলের মতন। পাশে থাক থাক করে রাখা অনেক রেকর্ড। রেকর্ডভর্তি তিনটা বাক্সও আছে। সব রেকর্ড রাখার বাক্স বোধ হয় নেই।

বিড়ালের মতন সাবধানী পায়ে সিন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কলের গানের বাক্সে আলতো করে হাত ছোঁয়াই, রেকর্ডের গায়ে হাত ছোঁয়াই।

আমাদের যদি এ রকম কলের গান থাকত? এ রকম রেকর্ড থাকত? তাহলে দিন-রাত আমি শুধু গান শুনতাম। এক রেকর্ড শেষ হলে চাপতাম আরেক রেকর্ড। গানে গানে ভরে থাকত আমার সারাটি দিন!

দোতলার উত্তর-পশ্চিম কোণে ওই তো রাখা আছে হারমোনিয়াম। বেড়ার সঙ্গে শতরঞ্জি পাতা। তার ওপর রাখা হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামের ওপর ধ্যার ধ্যারে মোটা একটা খাতা। এটা বুঝি গানের খাতা।

কত গান লেখা আছে খাতায়?

কত গান জানেন মিনু খালা?

বিনা খালাও কি গান শেখেন?

আবদিন নানা গান গাইতে পারেন। কেমন গান করেন তিনি? গলা কেমন?

একজোড়া বায়া তবলা আছে হারমোনিয়ামের পাশে। আমি হারমোনিয়ামের সামনে গিয়ে বসি। কলের গানে যেমন করে হাত বুলিয়েছিলাম ঠিক তেমন করে হাত বুলাই হারমোনিয়ামে। কালো-সাদা রিড ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি, চাবিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। অদ্ভুত এক শিহরণ গায়ে। গা কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে।

বিছানা থেকে নেমে সাদা বিড়াল কখন এসে দাঁড়িয়েছে অদূরে। অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে সাত-আট বছরের এক মানবশিশু গভীর মুগ্ধতায় আর বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে আছে।

দুপুরের পর একটু যেন নীরব হয়েছে বাড়ি।

রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। এখন জিরাবার সময়। টুনু মামা অনু মামা বাংলাঘরে। আব্বা আছেন তাঁদের সঙ্গে। নানা দোতলায় উঠে গেছেন। ছুটির দিনে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি একটু ঘুমান। নানির সঙ্গে মা আম্মা মিনু খালা। বাদল পলি ডলির সঙ্গে বড় খাটে লাইন ধরে শুয়েছে সেন্টু রিনা। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে মুকুল। আম্মা রিনা তখনো ঘুমায়নি। বুকে জড়িয়ে তার পিঠ চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছেন আম্মা। বিনা খালা আর মণি পিছন দিককার উঠানে হাঁটছে আর গল্প করছে। কত যে গল্প ওদের! খোকন মামা মিন্টু মামার সঙ্গে দাদা চলে গেছেন বাড়ির বাইরে। খোকন মামার হাতে গুলাইল আছেই। শালিক পাখি একটা না একটা তাঁকে মারতেই হবে।

আমি একা একা এখন কী করি?

মা বলেছিলেন ঘুমাতে। দিনের বেলা ঘুম আমার আসতেই চায় না। শুতে আমার ইচ্ছাই করে না। বাইরের ঝিমধরা রোদ, লিচুপাতায় সর সর করছে হাওয়া। আমার ইচ্ছা করে বাড়ির বাইরে যাই। ভালো করে দেখে আসি চারদিকটা।

কেউ টের পায় না, খোলা গেট দিয়ে আমি লিচুতলায় এসে দাঁড়াই।

পেট ভারী ভারী লাগছে। খাওয়া কি একটু বেশি হয়েছে?

হতে পারে। নানির হাতের রান্না অন্য রকম। শ্যামবাজার থেকে প্রচুর বাজার নিয়ে ফিরেছিলেন নানা। নিজের হাতে দুই ব্যাগ, মিন্তির মাথায় উপচে পড়া টুকরি। বড় বড় তিনটা ইলিশ মাছ। বিশাল একটা মিষ্টি কুমড়া। দুটো কাঁঠাল, আম এনেছেন শখানেক। এখন তো আম-কাঁঠালেরই দিন। ভাগ্নিরা আসছে, আম-কাঁঠাল তো খাওয়াতেই হবে!

নানা বাজার থেকে ফেরার পরই একটা কাঁঠাল ভাঙা হয়েছিল। চাউলা কাঁঠাল। অর্থাৎ শক্ত শক্ত কোষ। কাঁঠাল আমার একদম ভালো লাগে না। গন্ধটাই পছন্দ হয় না। এক কোষ কোনো রকমে খেয়েছিলাম। মিষ্টি আছে!

আমি পছন্দ করি আম। কিন্তু দুপুরবেলা আম দেওয়া হয়নি। আম খাওয়া হবে রাতে। দুধ আনা হয়েছে। আম-দুধ চলবে রাতে।

ভাত বোধ হয় একটু বেশিই খেয়েছি। আমাদের সংসারের একঘেয়ে রান্না খাই রোজ, আজ অন্য রকম। এই কারণে বেশি খাওয়া হয়েছে। ইলিশ মাছের সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা করে কেটে দেওয়া হয়েছিল। ঝোলটা এত মজা!

লিচুতলায় দুপুর ঢলা রোদ। ঝিরঝিরে হাওয়া আর পাতার ছায়া। লিচুতলায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়েছি। বাড়িতে ঢোকার সময়ই পুকুরটা দেখেছিলাম। সেভাবে খেয়াল করা হয়নি। বিশাল পুকুর। দিঘির মতো। বাড়ির পুবদিকে। লিচুতলা থেকে বিশ-পঁচিশ কদম দূরে। কী টলটলে পানি পুকুরের! দুপুর রোদে ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। ওপারে কলাগাছের ঝাড়, দুটো কুঁড়েঘর।

কারা থাকে ওই ঘরে?

ঘরের পিছনে নালা। তার পরই রেললাইন। ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে এদিকে এসেছে রেললাইন। গেণ্ডারিয়া স্টেশন হয়ে, পাগলা-ফতুল্লা ছুঁয়ে চলে গেছে নারায়ণগঞ্জ।

তখন পর্যন্ত রেলগাড়ি দেখা হয়নি।

কখন যাবে রেলগাড়ি?

কখন দেখতে পাব?

পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে দোচালা টিনের তিনটা ঘর। চালার ওপর দুপুর শেষের রোদ পড়েছে। মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। কয়েকটা আমগাছ ছায়া ফেলে রেখেছে টিনের ঘরগুলোর চারপাশে। পিছন দিককার কলাগাছের পাতা নড়ছে। ঘরগুলোর পিছন দিকেই কচুরিভর্তি সেই জলাভূমি।

বিনা খালাদের বাড়ি আর পুকুরের মাঝখান দিয়ে দক্ষিণে পায়ে চলা পথ। সেদিকটায় যাই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

এদিকটায় বিনা খালাদের সীমানা শেষে দুটো বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘর। টিনের একচালা ঘর দুটোর পিছনে বয়সী আমগাছ পশ্চিমের রোদ ঠেকিয়ে রাখে। এক ঘরের সামনে বসে খালি গায়ের কালো মতন একটা লোক নারকেলের হুঁকায় তামাক টানছে।

লোকটা কে?

ওদিকটা আমি ঘুরে ঘুরে দেখি। সামনে পুকুর, পিছনে কচুরিভর্তি জলাভূমি, মাঝখানে সরু মতন জায়গায় ঘরদুয়ার তোলা হয়েছে।

দক্ষিণে গিয়ে পুবে বাঁক নিয়েছে জায়গাটা। কোনায়, জলাভূমি ঘেঁষে অচেনা একটা গাছ। সেই গাছতলায় গিয়ে জলাভূমির দিকে তাকিয়ে থাকি। গেণ্ডারিয়া স্টেশনের ইট রঙের চালা দেখতে পাই। সবই কেমন নিঝুম নির্জন। মানুষজন যেন নেই-ই।

জলাভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে সাদা রঙের সুন্দর দালানবাড়ি। বাড়িটা কি জলাভূমির ওপরেই নাকি? কচুরি ছুঁয়ে আছে তলার দিকে।

এত সুন্দর বাড়িটা কাদের?

এত বড় দালানবাড়ির মালিক, নিশ্চয় তারা খুব বড়লোক!

উদাস ভঙ্গিতে হেঁটে নানাবাড়ির দিকে ফিরি। লিচুতলা ছাড়িয়ে উত্তর দিকে পা বাড়াই। বাংলাঘর ছাড়িয়ে এদিকটায় খানিক এগোলেই বাঁধানো ঘাটলা। ঘাটলার পশ্চিমে পায়ে চলা পথ। তারপর জমিদারদের বাগানবাড়ির মতো একতলা দালানবাড়ি। পুরনো বাড়ির চুন-সুরকি খসে পড়েছে, দেয়ালের চুনকাম বোঝা যায় না। বাড়ির সামনে ঘাসে ছাওয়া লন। যত্নআত্তি নেই-এমন কয়েকটা ফুলের ঝাড়, বিবর্ণ পাতাবাহার।

দালানে ঢোকার মুখে তিন দিক খোলা বারান্দা মতো। ইট রঙের দুখানা বাঁধানো বেঞ্চের মাঝখান দিয়ে ভিতরে ঢোকার পথ।

ঘাটলার বেঞ্চ দুটোও ওই রঙের।

জমিদার বাবু নিশ্চয় পুরো এলাকার মালিক ছিলেন। বাগানবাড়ির সঙ্গে বিশাল পুকুর করে ছিলেন, তিন পাড়ে গাছপালা ছাড়া কিছুই হয়তো ছিল না। কালে কালে বিক্রিবাট্টা হয়ে এই চেহারা পেয়েছে এলাকা। আবদিন নানা এসে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। সরু পাড়ে যাঁরা বাড়ি করেছেন, ঘর তুলেছেন তাঁরাও নিশ্চয় কিনেই নিয়েছেন জমি!

ওই বাড়ির উত্তরে টিনের চৌচালা ঘরের বাড়ি। তেমন গাছপালা নেই এই বাড়িতে। তার পরের বাড়িটার সামনে অনেক নারকেলগাছ নিবিড় হয়ে আছে। আমগাছও আছে কয়েকটা। গাছপালার চাপে বাড়ির ঘরদুয়ার দেখাই যায় না।

এই বাড়ির পর উত্তর-পুবদিকটা ফাঁকা। সেদিক দিয়ে ভেসে আসে ট্রেনের হুইসেল। আমি কেঁপে উঠি, উতলা হই। বাঁধানো ঘাটলায় গিয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকি। গভীর উত্তেজনায় ধুকধুক করে বুক।

ট্রেন আসছে?

আমরা ট্রেন বলি না, বলি রেলগাড়ি।

রেলগাড়ি আসছে, রেলগাড়ি? জীবনে প্রথম রেলগাড়ি দেখব। কী উত্তেজনা! কী বিস্ময়!

তারপর এলো রেলগাড়ি। স্বপ্নের রেলগাড়ি। কালো ইঞ্জিনের ওপর দিককার চোঙা থেকে বেরোচ্ছে সাদা ধোঁয়া। দুবার হুইসেল দিয়েছে রেল। ঝিকঝিক ঝিকঝিক করে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসে। ইঞ্জিনের পরই বগি। কী লম্বা একেকটা বগি! বগির লাল হলুদ রং দুপুর শেষের রোদে চকচক করে।

এক বগি এগোয়, দুই বগি এগোয়। উত্তেজনায় বুক ফেটে যায়, বিস্ময়ে চোখ ফেটে যায়। তাকিয়ে আছি তো তাকিয়েই আছি। রেলের বগি আর শেষ হয় না।

এত লম্বা হয় রেলগাড়ি?

আরে, বাচ্চা ছেলেটার সাহস কত! রেলের দরজায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে! তার খালি গা এই এতটা দূর থেকেও দেখতে পাই। পরনে লুঙ্গি, লুঙ্গির রং সবুজ, দেখতে পাই।

যদি পড়ে যায়?

কী হবে তাহলে?

তারপর মনে হয়, আহা, আমি যদি ওই ছেলেটা হতে পারতাম? আমি যদি রেলের দরজায় এভাবে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারতাম? চলে যেতে পারতাম যেদিকে ইচ্ছা!

কী আনন্দ ছেলেটির!

কত মজা!

ভয়ে আবার বুকও কাঁপে। ওভাবে বসে থাকতে থাকতে যদি আমি পড়ে যাই!

গেণ্ডারিয়া স্টেশনে গিয়ে থামে গাড়ি। পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোনার ওদিক দিয়ে গাড়ির লেজ দেখা যায়। আমি তাকিয়েই থাকি। অপলক চোখে তাকিয়েই থাকি। হুইসেল দিয়ে একসময় ছেড়ে যায় গাড়ি। আমি তাকিয়েই থাকি। আমার যেন ঘোর কাটে না। বিনা খালাদের কত মজা। বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই রেলগাড়ি দেখা যায়।

কিন্তু বিনা খালা তো আমার দিকে তাকায়ই না। আমাকে দেখেই না। সে আছে মণিকে নিয়ে। আহা, বিনা খালা যদি আমার দিকে একবার তাকাত! আমার হাত ধরত, আমার সঙ্গে গল্প করত! সারাক্ষণ থাকত আমার সঙ্গে!

সেই বিকালেই বিনা খালার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল।

বিকালবেলা বাড়িতে আর বাড়ির সামনে যেন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। নানা-নানি আব্বা আর মা মিলে কথা বলছেন নিচতলার পুব পাশে বসে। আব্বা বসে আছেন জড়সড় ভঙ্গিতে। কথা বলছেন কম, শুনছেন বেশি। নানির মুখে পান। মা তাকিয়ে আছেন নানার মুখের দিকে। আব্বার মতো জড়সড় ভাব তাঁর নেই। নানা যা বলছেন তাতেই মাথা দুলিয়ে সায় দিচ্ছেন আব্বা।

আব্বা এই বাড়ির জামাই। জামাইজনদের নাকি শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে এ রকম জড়সড় হয়েই থাকতে হয়। হোক না মামাশ্বশুর, মামিশাশুড়ি।

নানার সঙ্গে খেতে বসেও এই অবস্থা দেখেছি আব্বার। ঠিকমতো যেন খেতেই পারছিলেন না। খাওয়াদাওয়ার পর সিগ্রেট খাওয়ার জন্য লিচুতলার দিকে গিয়েছেন। মা গেলেন পিছন পিছন। শুনলাম, আব্বাকে তিনি বলছেন, মামার সামনে আপনে এমুন ‘মিচাবিলাই’ হইয়া থাকেন ক্যা? মামায় কি বাঘ? আপনেরে খাইয়া হালাইবো?

আব্বা হাসলেন। মিচাবিলাই না, এইটা হইলো ভদ্রতা। ময়মুরব্বির সামনে ভদ্রতা বজায় রাখতে হয়। আমি তো পুনুর জামাইয়ের লাহান না। ভদ্রলোক মানুষ।

এ কথা শুনে মজিদ মামার কথা মনে পড়েছিল আমার! বেশ অনেক দিন দেখি না তাঁকে। আম্মার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না। একমাত্র ছোট্ট মেয়েটি রিনা, রিনার কোনো খোঁজখবরই নেন না। আশ্চর্য মানুষ।

বিকালবেলা কি মজিদ মামাকে নিয়েই কথা বলছেন নানা? মজিদ নামটা যেন শুনলাম দু-একবার!

আম্মা আর মিনু খালা চলে গেছেন পশ্চিম দিককার সেই বাগানমতো জায়গাটায়। জামরুলতলার ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। কী কথায় মিনু খালা খিলখিল করে হাসছেন। বিকালের দিকে তিনি একটু সাজগোজ করেছেন। মাথার কোঁকড়ানো চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। চোখে কাজল। কপালে লাল টিপ। আকাশি রঙের সুন্দর শাড়ি পরেছেন। ফর্সা সুন্দর মুখে পড়েছে বিকালবেলার একটুখানি রোদ।

সামনের উঠানে ডলি দুই রিনা আর মুকুল। কেউ মাটিতে বসে খেলছে, কেউ হাঁটছে, এই এদিকে দৌড়ে যাচ্ছে, এই ওদিকে।

টুনু মামার তিন বন্ধু এসেছেন। বাংলাঘরে বসে হাসি-গল্প চলছে তাঁদের। রানি খালা বড় বড় কাপের চার কাপ চা বানিয়ে দিয়ে এসেছে। সঙ্গে গোল গোল বিস্কুট। কাজ সেরেই সে চলে গেছে লিচুতলায়। সেখানে বিনা খালা আর মণি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রানি খালা। পুকুরঘাটে ভালো রকমের একটা জটলা। খোকন মামা মিন্টু মামার সঙ্গে দাদা আছেন। ওদের সঙ্গে আছে জমিদার বাড়ির মতো বাড়িটার উত্তর পাশের বাড়ির তিন-চারজন। সেন্টু চলে গেছে জমিদার বাড়ির ভিতর। ওই বাড়ির এক মহিলা কোলে নিয়েছে তাকে। অনু মামা তাঁর বয়সী একজন নিয়ে ঘাটলায় আসতেই খোকন মামাদের দল সরে এলো রাস্তার দিকে।

অনু মামা বললেন, কই যাচ খোকা?

খোকন মামা বললেন, ফুটবল খেলতে।

বল কই?

হালিম আনবো।

যা।

বন্ধুর সঙ্গে ঘাটলায় বসে গল্প করতে লাগলেন অনু মামা।

আমি একদম একা। আমার পাশে কেউ নেই। একবার পুকুর ঘাটের দিকে যাই, একবার জমিদার বাড়ির ভিতর। এই বাড়ির মানুষজন খুবই সাদামাটা। তারা বাড়ির মালিক, না ভাড়াটে, বুঝতে পারি না। আমার মামা-খালাদের দিকে কেমন সমীহের চোখে তাকায়।

একসময় দেখি লিচুতলায় বিনা খালা একা। রানি খালা আর মণি বাড়ির ভিতর চলে গেছে। জমিদার বাড়ির সামনে থেকে হেঁটে এলাম লিচুতলার দিকে। বিনা খালা এই প্রথম কথা বললেন আমার সঙ্গে। খেলতে গেলি না?

আমি অবাক। কই খেলতে যামু?

ওই যে ওরা গেল? খোকনদা, মিন্টুদা। আজাদ মামাও তো গেল।

আমারে নেয় নাই। নিবো ক্যা? আমি তো খেলতে পারি না।

হ্যাঁ, তুই তো ছোট।

এবার আমার খেয়াল হলো, বিনা খালা আমাকে তুই করে বলছে। এই বাড়ির কেউ আমাকে তুই করে বলে না। বিনা খালা বলছে কেন?

ব্যাপারটা আমার গায়েই লাগে না। বিনা খালা যে আমার সঙ্গে কথা বলছে তাতেই আমি মুগ্ধ। তুই করেই বলুক না। অসুবিধা কী?

বিনা খালা বলল, মণি আর রানি গেল লুডু খেলতে। আমারেও বলছিল। এই সময় লুডু খেলতে আমার ভালো লাগে না। বললাম, তোরা খেল গিয়া। আমি খেলুম না। আমি এখানে দাঁড়ায়া থাকুম। বিকালবেলা এখানে দাঁড়ায়া থাকতে আমার ভালো লাগে। পুকুরের পানি দেখতে ভালো লাগে, রেললাইনের দিকে তাকায়া থাকতে ভালো লাগে। আয়, আমরা তুলা ভাইদের বাড়ির দিকে যাই।

তুলা ভাই কে?

ওই যে অনদার লগে ঘাটলায় বইসা গল্প করতাছে। ওইটাই তুলা ভাই।

আমি হাসলাম। তার নাম তুলা?

হ্যাঁ। তুই ডাকবি তুলা মামা।

আমি তখনো হাসছি। বিনা খালা আমার মুখের দিকে তাকাল। বুজছি, তুলা নাম শুইনা হাসতাছস। ওই বাড়ির ছেলেমেয়েদের নাম এই রকমই। শোন, নামগুলি আমি কই। তুলা প্যাটেল কিটি এটলি সামুনি…। কিটি আপা খুব সুন্দর।

আপনের মতন?

আমার থিকাও সুন্দর। ল, কিটি আপারে দেখাইয়া আনি।

লন।

বিনা খালা আমার হাত ধরল। বিনা খালার হাত কী মোলায়েম! একটু যেন ভেজা ভেজা। আমার তখন দিকপাশ খেয়াল নেই। বিপুল উৎসাহে বিনা খালার সঙ্গে হাঁটছি। কত কথা যে বলতে ইচ্ছা করছে বিনা খালাকে।

বিনা খালা যাকে আপা ডাকে তাকে কী ডাকব? খালা? কিটি খালা?

বিনা খালার বয়সী গোলগাল মোটামতো একটি মেয়ের সঙ্গে গল্প করছেন কিটি খালা। বাড়ির উঠানে শুকাতে দেওয়া হয়েছে শাড়ি ফ্রক সালোয়ার কামিজ, পাজামা লুঙ্গি শার্ট হাফ প্যান্ট ফুল প্যান্ট। ওসব তুলছেন এক মহিলা।

আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন কিটি খালা। কিরে বিনা, কারে লইয়াইলি?

আনু আপার ছেলে। মিলু।

আনু আপা মানে? ও, বুজছি, বুজছি। তোর ফুপাতো বোন।

হ্যাঁ।

কিটি খালা আমার থুতনি ধরে নেড়ে দিলেন। কী সুন্দর দেখতে কিটি খালা! যেমন আমার মিনু খালা বিনা খালা, তেমন কিটি খালা। এত সুন্দর সুন্দর মানুষ পাশাপাশি বাড়িতে? আর আমাদের জিন্দাবাহারের বাসায়? কী সব মানুষজন সেখানে। হাজেরা, কেরামতের মা, আবুলের ভাবি। পুলিশ কাকি ফিরোজা মমতাজ! নিয়াসা একজনও দেখতে এদের মতো না।

গোলগাল মোটামতো মেয়েটার নাম ফেন্সি। কিটি খালার চাচাতো বোন। সেও দেখতে সুন্দর।

সেই বিকালে কত কথা যে বলল বিনা খালা! বুঝলি মিলু, খোকনদারা খেলতে গেল ফায়ার সার্ভিসের মাঠে। হালিম ভাই হান্নান ভাই, মবিন চাচার ছেলে সাইদ, প্যাটেল ভাই আরো কত ছেলে মিলে ফুটবল খেলব এখন। মবিন চাচার বাড়ির পিছন দিয়া ফায়ার সার্ভিসের মাঠে যাওয়ার চিপা একটা রাস্তা আছে…। ক তো সবথিকা ভালো ফুটবল খেলে কে?

জানি না।

হ্যাঁ, তোর তো জাননের কথা না। প্যাটেল ভাই। প্যাটেল ভাই সবথিকা ভালো ফুটবল খেলে।

কিটি খালাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুকুরের উত্তর-পুব দিককার রাস্তার দিকে যাই আমরা। কোনার নারকেলগাছভর্তি বাড়িটা কাদের? বিনা খালাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আবার ভুলেও যাই। ওদিকটায় এসে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিনা খালা…

বিনা খালা আমার দিকে তাকায়। কী?

আবার রেলগাড়ি যাইবো কুনসুম?

কুনসুম কী রে? বল কখন?

কখন।

এই তো এখনই। দোপরবেলা ফুলবাড়িয়া থিকা একটা ট্রেন নারায়ণগঞ্জ যায়। এখন নারায়ণগঞ্জ থিকা একটা আসব।

ঠিক তখনই স্টেশনের ওদিকে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। আমার বুকজুড়ে উত্তেজনা। বিনা খালার সঙ্গে দৌড়ে যাই পুকুরের পুব পাড়ের কুঁড়েঘর দুটোর ওদিকে। স্টেশনের দিকে তাকাই। ঝমঝম করে ট্রেন এসে ঢুকল স্টেশনে। ওই তো দেখা যাচ্ছে কালো ইঞ্জিন। হালকা ধোঁয়া উঠছে মাথার ওপরকার চোঙা থেকে।

এক দিনে দুটো ট্রেন দেখা হবে?

কী বিস্ময়!

বিনা খালা বলল, এখানে দাঁড়াইলে খুব কাছ থিকা দেখা যাইব ট্রেন। এই যে দেখ নালা। নালার ওই পাড়েই তো রেললাইন। এখান দিয়াই যাইবো ট্রেন।

রেলের পাতে পড়েছে শেষ বিকালের রোদ। চকচক করছে রেললাইন। দুই লাইনের পেট বরাবর চওড়া কাঠ আটকানো, চাকা চাকা নুড়িপাথর ছড়ানো।

নালায় পানি নেই। শুকনা টিন কাঠের টুকরা, পটপাটি, ছেঁড়া কাগজ বোতল আর কত যে ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে! বাজে একটা গন্ধও আসছে ওদিক থেকে। এখানে বসে পায়খানা করে নাকি কুঁড়েঘরের মানুষজন।

গন্ধটা বিনা খালাও পাচ্ছিল। নাক কুঁচকে বলল, পচা গন্ধ! ল, ওইদিকে গিয়া দাঁড়াই।

লন।

আমি যে বিনা খালাকে আপনি আপনি করে বলছি, এই প্রথম বিনা খালা তা খেয়াল করল। মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তুই আমারে আপনে কইরা বলতাছস?

হ।

হ না, হ্যাঁ।

হ্যাঁ।

ক্যান?

মায় শিখাইয়া দিছে। বড়গো আপনে কইরা কইতে হয়।

আমি অত বড় না। মণির সমান।

মণি তো আমার বড়।

জানি। মণিরে তুই আপনে কছ?

না, তুই।

তাইলে আমারে আপনে কছ ক্যান?

মণি হইল বইন, আপনে হইলেন খালা।

তাতে কী?

তয় আপনেরে কী কমু? তুমি?

না, তুই।

আমার একটু লজ্জা লাগল। খালারে মাইনষে তুই কয় কেমনে?

সমান বয়সের হইলে কইতে পারে।

তয় আপনেরে, না না তোমারে, না না তরে…

বিনা খালা হেসে ফেলল। কী বলবি বইলা ফালা।

আমি লাজুক মুখে বললাম, নাম ধইরা তুই কমু?

হ্যাঁ।

আমি চালাকি করে বললাম, না, আমি বিনা খালাও ডাকুম, আবার তুই কইরাও কমু।

কেমনে?

আমি হাসলাম। এই যে এমুন। ওই বিনা খালা, ল লেচুতলায় যাই।

বিনা খালা আমার গালে একটা ঠোকনা দিল। তুই বহুত পাকনা।

আরো কিছু বলতে যাবে, তার আগেই বিকট শব্দে হুইসেল দিল ট্রেন। আমরা দুজনেই কানে হাত দিয়েছি। ঝমঝম শব্দে ট্রেন আসছে আমাদের দিকে। কান থেকে হাত সরিয়ে তাকিয়ে রইলাম ট্রেনের দিকে। এত কাছ থেকে দেখছি ট্রেন! কী বিস্ময়!

বিনা খালা বলল, আয় বগি গুনি। দেখি এই ট্রেনে বগি কয়টা।

ঠিক আছে।

আমরা বগি গুনতে লাগলাম। এক বগি, দুই বগি…

পশ্চিম আকাশ থেকে বিকাল শেষ হওয়া একটুখানি রোদ এসে পড়েছে ট্রেনের ওপর। হলুদ বগির ট্রেন একটু যেন বেশি হলুদ হয়েছে সেই রোদে। আমি ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি এই দৃশ্য আমি দেখছি না। আমি আসলে জেগে নেই। ঘুমিয়ে আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে স্বপ্নের রেলগাড়ি! এক বগি, দুই বগি…

আজ সকালবেলা বাড়ি একটু ফাঁকা হয়েছে।

নানা আব্বা আর টুনু মামা গরম ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে অফিসে চলে গেছেন। ভোরবেলা উঠে রান্না চড়িয়েছিলেন নানি। মা ছিলেন তাঁর সঙ্গে। রানি খালা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা ঘুম থেকে উঠে যে যার মতো হাতমুখ ধুয়েছি, দাঁত মেজেছি। ডলি রিনা মুকুলদের কাজ সারিয়েছেন আম্মা আর মিনু খালা। আমাদেরকে নাশতা করাবার দায়িত্ব তাঁদের ওপর। সাগর কলা আর পাউরুটি নিয়ে এসেছিলেন আব্বা। বিশাল ছখানা পাউরুটি, কয়েক ডজন সাগর কলা। কী সাইজ সেই কলার, পুরো একটা কলা একজনের খাওয়া কঠিন। পেট ফুলে গামলা হয়ে যাবে।

এই কলাই বড়দের একটা করে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে দু-টুকরা পাউরুটি। ছোটদের ভাগে কলার অর্ধেকটা আর এক টুকরা পাউরুটি। আমার তো খিদা বেশি। এসব জিনিসে আগ্রহ অনেক। অর্ধেকটা সাগর কলা আর এক টুকরা পাউরুটিতে পেট ভরতে চায় না। বিনা খালা বসে আছে পাশে। আস্তে করে পাউরুটিতে কামড় দেয় সে, কলায় কামড় দেয়। আমার তাকানোটা খেয়াল করল। কী রে, পেট ভরে নাই?

আমি লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করি। ভরছে।

বিনা খালা যা বোঝার বুঝল। নিজের কলা থেকে একটুখানি ভেঙে আমাকে দিল, রুটি থেকে দিল খানিকটা। নে।

না, না, লাগবো না। তুই খা।

আমি পুরাটা খাইতে পারুম না। নে।

অনেকটা জোর করেই আমার হাতে গুঁজে দিল। পাশে বসা মণি বলল, মিলু এই রকমই। অর সহজে পেট ভরে না।

মণির কথায় লজ্জা আরো বেড়েছে আমার। বিনা খালা আমার পক্ষ নিল। না ভরলে না ভরে, তোর কী! খা মিলু, খা।

আমি সাগর কলায় কামড় দেই, পাউরুটিতে কামড় দেই।

এই বাড়ির সবাই লেখাপড়া করে। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় কাউকে পড়তে বসতে দেখলাম না, আজ সকালেও দেখলাম না। বিনা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওই বিনা খালা, বিয়ানে তরা পড়তে বহচ না?

বিনা খালা আমার কাঁধে হাত দিল। তোর কথা সোন্দর না রে মিলু। বিয়ান না, সকাল। বহছ না, বসছ। বল, ঠিক মতন বল।

আমি বাধুক ভঙ্গিতে বললাম, সকালবেলা তরা পড়তে বসছ না?

দুই বেলাই বসি। সন্ধ্যাবেলা, সকালবেলা।

তয় আইজ বহছ…না, না, বসছ নাই ক্যা?

তরা আসছস, এই জন্য কাইল সন্ধ্যায়ও পড়তে বসে নাই কেউ, আইজ সকালেও বসে নাই। মনে হয় আইজ সন্ধ্যা থিকা বসতে হইব। নাইলে বাবায় রাগ করব।

আমরা দুজন বাংলাঘরের সিঁড়িতে গিয়ে বসেছি। উঠান ভেসে গেছে সকালবেলার রোদে। কাল থেকে বিনা খালাকে আর মণির সঙ্গে দেখি না। মণি আছে রানি খালার সঙ্গে, বিনা খালা আমার সঙ্গে। এক বিকালেই এত বন্ধুত্ব হয়েছে আমাদের, প্রথম প্রথম কথা বলতে আড়ষ্ট লাগছিল, কোন ফাঁকে কেটে গেছে সেই আড়ষ্টতা। কত যে প্রশ্ন বিনা খালাকে করি, কত যে বলি কথা! বিনা খালা সব জানে। সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। তার কথা শুনি আর অবাক হই। আমার চেয়ে দেড় দু-বছরের বড় একজন মানুষ এত কিছু জানে কী করে?

বাড়ির কত খবর যে বিনা খালা আমাকে দেয়। মিনু আপার কিন্তু বিয়া ঠিক হইয়া গেছে। এই বছরই বিয়া হইব। জামাইয়ের নাম বাদল।

আমি অবাক। আরে, আমার ছোট ভাইয়ের নামও তো বাদল।

সেইটা জানি। আপায় ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখাপড়া করছে। কী সোন্দর গান গায়, শুনছস না? সারা দিন গল্পের বই পড়ে। বাবায় চাইছিল আপায় আরো পড়ুক। পড়ে নাই দেইখা বাবায় রাগ। তয় বিয়া হইতাছে ভালো। দুলাভাই জুট করপোরেশনে চাকরি করে। বাড়ি বিক্রমপুরের মৌছামান্দ্রা গ্রাম। চাকরি হইল কুষ্টিয়ায়। বিয়ার পর আপায়ও কুষ্টিয়ায় চইলা যাইবো।

কিয়ে কইরা যাইবো? রেলগাড়ি?

সেইটা কইতে পারি না।

বাংলাঘরে ছিলেন অনু মামা। উঠান পেরিয়ে দোতলা ঘরের দিকে গেলেন। আমাদের দিকে ফিরেও তাকালেন না। একটু যেন উদাস।

বিনা খালা বলল, অনদা ক্লাস নাইনে পড়ে। টুনদার মতন ভালো ছাত্র না। ভাই-বোনগো মইধ্যে টুনদাই সব থিকা ভালো ছাত্র। অনদা খোকনদা মিনদা তিনজনেই পড়ে গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে। আপায় পড়ত মণিজা রহমান গার্লস স্কুলে। আমিও ওই স্কুলেই পড়ি। তুই স্কুলে ভর্তি হছ নাই?

না। আমিও না, মণিও না। আব্বায় কইছে আগামী বচ্ছর ভর্তি কইরা দিব।

ঢাকার স্কুলে?

সেইটা কইতে পারি না।

ঢাকায় হইলে ভালো। তোরা ঢাকায় থাকলে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতে পারবি।

অহন তো আমরা ঢাকায়ই।

অহন না, ক এখন।

এখন।

জানি, তোদের বাসা জিন্দাবাহার।

তোরা আমগ বাসায় যাছ না ক্যা?

আমগ না, আমাদের। ক্যা না, কেন?

আমাদের…কেন…। যাছ না কেন?

বাবায় নিয়া যায় না। সব সময় ব্যস্ত থাকে। দুইটা চাকরি করে যে। একটা হইল সিঅ্যান্ডবিতে। ওইটাই আসল চাকরি। ছুটির দিনে কই জানি আরেকটা চাকরি করে। বিকালের দিকে। একবেলার চাকরি। তোরা আসছস দেইখা সেই চাকরিতে কাইল যায় নাই।

আমার আব্বা একটাই চাকরি করে।

সেইটা জানি। মিনসিপালটিতে।

এই উচ্চারণটা আমি জানি। মিউনিসিপ্যালিটি। আব্বা শিখিয়েছেন। বললাম, মিনসিপালটি না, মিউনিসিপ্যালিটি।

বিনা খালা আমার মতো করে উচ্চারণ করল। মিউনিসিপ্যালিটি।

আমি বড়দের ভঙ্গিতে বললাম, টুনু মামা কই চাকরি করে রে?

আইডাবলিউটিতে। টুনদায় হইল হাইড্রোগ্রাফার।

দুটো শব্দই মনে মনে উচ্চারণ করলাম। আইডাবলিউটি, হাইড্রোগ্রাফার…

ওই বিনা খালা, হাইড্রোগ্রাফার কী রে?

বিনা খালা মিষ্টি করে হাসল। সেইটা জানি না। বিএসসি পাস করার পরই চাকরি হইয়া গেছে টুনদার। চাকরিতে জয়েন করার কয় দিন পরই সিরাজগঞ্জে বদলি হইছিল। ওইখানে ট্রেনিং হইছে।

বিনা খালার মুখে যে শব্দ শুনি, সেটাই আমি মুখস্থ করি। ট্রেনিং শব্দটাও করলাম। কী অর্থ এই শব্দের?

বিনা খালা বলল, টুনদায় পশ্চিম পাকিস্তান চইলা যাইবো।

আমি অবাক। ক্যা?

ক্যা না, কেন?

কেন?

ওইখানে আরেকটা ট্রেনিং হইব।

টুনু মামার চাকরিতে দেখি খালি ট্রেনিং!

হ্যাঁ।

আমরা বলি ‘হ’ বিনা খালা বলে ‘হ্যাঁ’। ভাষা কিছুটা আমাদের মতো, কিছুটা আমাদের মতো না। শুনতে খুব ভালো লাগে।

আমি বিনা খালার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করি। ভাই-বোনরা কে কোথায়, মা আম্মা কে কোথায়, কোনোদিকে আমার খেয়াল থাকে না। আব্বা চলে গেছেন। অফিস শেষ করে এই বাড়িতে আর ফিরবেন না। জিন্দাবাহারের বাসায় চলে যাবেন। ওখানেই থাকবেন। আমরা কদিন থাকবো এই বাড়িতে, কবে ফিরে যাবো কিছু মনে থাকে না আমার। আমি আছি বিনা খালার সঙ্গে। আমার ধ্যান জ্ঞান সব বিনা খালা। খাওয়া ঘুম স্বপ্ন চিন্তা, সব বিনা খালা। চোখ খোলা থাকলে বিনা খালা, চোখ বন্ধ থাকলে বিনা খালা। তার সব কিছু আমার ভালো লাগে, সব কিছু আমি খেয়াল করি। কথা বলার চেষ্টা করি তার মতো, আচরণ করি তার মতো। একজনের বয়স সাত, একজনের নয়। দুটি শিশু কত কী নিয়ে কথা বলে! পাকা পাকা কথা, কাঁচা কাঁচা কথা। কথা তাদের ফুরায়ই না। একজন মগ্ন হয়ে থাকে আরেকজনে।

জিন্দাবাহারের বাসার কথা আমার আর মনে পড়ে না। আমার নিজস্ব ছোট্ট একটা জগৎ তৈরি হয়েছে জিন্দাবাহারে। সেই জগতে কত মানুষ। তাদের কারো কথা মনে পড়ে না। দুপুরবেলার নির্জন ছাদ, রোদের আকাশে স্থির হয়ে আছে ভুবনচিল। আমার মনে পড়ে না। কুয়োতলার স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, সোঁদা গন্ধ, আমার মনে পড়ে না। জামির কাকার বাদাম ভাজার ঘ্রাণ, নিয়াসার খিলখিল হাসি, আমার মনে পড়ে না। ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে আমার প্রিয় ডালিম চারা। কেমন আছে ডালিম চারাটি? আমার মনে পড়ে না।

মন পড়ে থাকে বিনা খালার কাছে।

ভোররাতের দিকে একটা রেলগাড়ি যায়।

ঘুমের ভিতর থেকে শুনতে পাই রেলের হুইসেল। ফুলবাড়িয়ার দিক থেকে একবার-দুবার আসে হুইসেলের শব্দ। কাছাকাছি এসেও কি হুইসেল দেয় একবার!

এ সময় রেলে চড়ে কোথাকার মানুষ কোথায় চলে যায়?

রাতে ঘুমায়নি তারা?

ইচ্ছা করে উঠে দোতলার বারান্দায় যাই। পুব দিককার লিচুগাছ আর পুকুর ছাড়িয়ে ওপারে তাকাই। কুঁড়েঘর দুটোর ফাঁকফোকর দিয়ে দেখি রেলগাড়ি দেখা যায় কি না!

বাইরে কি আলো ফুটেছে?

রেলগাড়ি দেখা যাবে?

চোখ মেলে তাকাই। ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখি আমরা শুয়ে আছি দোতলায়। এক পালঙ্কে মা শুয়েছেন ডলি মুকুলকে নিয়ে। আরেক পালঙ্কে আম্মা মিনু খালা আর আম্মার বুকের কাছে রিনা। আমরা শুয়েছি সিন্দুকের ওদিকটায়। ওখানে ঢালাও বিছানা করা হয়েছে। বাদল পলি সেন্টু, মণি বিনা খালা আর আমি শুয়েছি। হারমোনিয়ামটা যেদিকে রাখা ওখানে আরেকটা বিছানা। সেই বিছানায় খোকন মামা মিন্টু মামার সঙ্গে দাদা। খোলা জানালা দিয়ে আসছে ঝিরঝিরে হাওয়া। বাইরে বুঝি আলো ফুটছে। একটুখানি আলোর আভাসও দেখা যায়। দোতলাটা আধো অন্ধকার।

আমার আর ঘুম আসে না। রেলের হুইসেল ভেসে আসে আরেকবার। এবার যেন ঝিকঝিক শব্দটাও পাই। তার মানে কুঁড়েঘর দুটোর পিছন দিকটায় এসে পড়েছে রেল। গেণ্ডারিয়া স্টেশনে থামবে, নাকি সরাসরি চলে যাবে নারায়ণগঞ্জের দিকে?

শব্দ বাড়ে রেলের, শব্দ কমে। একসময় আর শোনাই যায় না। নারায়ণগঞ্জের দিকে চলে গেছে। এখন বাইরের গাছপালায় জেগে ওঠা পাখিরা ডাকাডাকি করছে। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। দোতলায় শোয়া মানুষগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দই শুধু শব্দ।

আমি উঠে বসি। বিনা খালার দিকে তাকাই। ওই তো মণির পাশে শুয়ে আছে। জানালা দিয়ে ভোরবেলার হালকা আলোটুকু এসে পড়েছে তার মুখে। সেই আলোয় কী পবিত্র দেখায় তার ঘুমন্ত মুখ। আমি তাকিয়ে থাকি। সময় যায়, আমি তাকিয়েই থাকি। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় ভোরের আলো, আমি তাকিয়েই থাকি।

নানা-নানি দুজনেই ওঠেন সকাল সকাল। ফজরের নামাজ পড়ে নানি শুরু করেন সংসারের কাজ। নানা পুকুরঘাটের ওদিকে গিয়ে একটু হেঁটে আসেন। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙে বাড়ির। একে একে জেগে ওঠে সবাই। সকালবেলার কাজগুলো সারার হুড়াহুড়ি লাগে। কেউ দাঁত মাজছে, কেউ মুখ ধুচ্ছে। পায়খানাঘরের ওদিক থেকে ফিরল কেউ। মানুষের সঙ্গে জেগেছে কাক-শালিক, চড়ুই বুলবুলি আর দোয়েল পাখি। যে যার মতো ডাকছে। গাছের ডাল, ঘরের চালা আর উঠান বাগান মুখর হয়েছে তাদের ডাকাডাকিতে। রানি খালা মুরগির খোঁয়াড় খুলে দিয়েছে। দক্ষিণের উঠানে চরছে মোরগ-মুরগি। ইস, এমন ফ্যাত ফ্যাত করে পায়খানা করে মুরগিগুলো!

বাংলাঘরের সঙ্গের রাস্তায় হাঁক দেয় কে একজন। বাকরখানি, এই বাকরখানি! লাগবো বাকরখানি?

খোকন মামাকে পাঠালেন নানি। ডাক লোকটাকে।

খোকন মামা দৌড়ে গেলেন। গেটের সামনে বাকরখানির চাঙারি নামিয়েছে লোকটা। গামছায় ঢাকা চাঙারি। তার তলায় থরে থরে সাজানো বাকরখানি। গামছা সরাতেই কী সুন্দর গন্ধ আসে! মনে হয় সব বাকরখানি একাই খেয়ে ফেলি।

আমরা সবাই ছুটে গেছি বাকরখানিঅলার কাছে। নানি দামদস্তুর করছেন। পুরো চাঙারির বাকরখানি কেনা হবে। এতগুলো একসঙ্গে কিনলে দাম কি কম পড়বে?

একজন মিষ্টিঅলা আসে এ সময়। কাঁধে ভার। ভারের একেকদিকে দুটো করে মাটির গামলা। একেক গামলায় একেক রকম মিষ্টি।

মিষ্টিঅলাকেও দাঁড় করিয়েছেন নানি।

আমার যে তখন কী ভালো লাগছে! আনন্দ উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে বুক। বাকরখানি খাওয়া হবে, মিষ্টি খাওয়া হবে। সকালে এ রকম নাশতা তো কখনো করিনি। যেমন স্বাদের বাকরখানি, তেমন স্বাদের মিষ্টি!

আমার মুখ লালায় ভরে গেছে।

আচ্ছা, কোন মিষ্টিটা রাখা হবে?

রসগোল্লা, না লালমোহন?

আমৃত্তি, না বালুসাই?

লম্বা ধরনের মিষ্টিটাই রাখা হলো। তেমন রসাল মিষ্টি না। শুকনা ধরনের। ওপরে পুরু করে চিনি লাগানো। চিনির তলায় হালকা গোলাপি আভা। এই মিষ্টিকে আমরা বলি বালুসা।

একটা করে বাকরখানি আর একটা করে মিষ্টি, এই হচ্ছে আজ সকালের নাশতা। আমরা যে যার ভঙ্গিতে খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি দোতলার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পলি। মা আম্মা কেউ খেয়াল করেননি, খেয়াল করলেন নানি। কী রে, কান্দছ ক্যা?

পলি কথা বলার আগেই বুঝে গেলেন ঘটনা। বুজছি, মিষ্টি-বাকরখানি পাছ নাই। এর লেইগা কানতে হয়নি ছেমড়ি? চাবি না আমার কাছে?

পলিকে বাকরখানি দিলেন নানি, একটা বালুসা দিলেন।

দুপুর হয়ে আসার সময় বিনা খালা এসে বলল, এখন একটা মালগাড়ি যাবে। দেখবি?

আমার তো উৎসাহের সীমা-পরিসীমা নেই। লাফিয়ে উঠলাম। ল।

ল না, চল।

চল।

আমরা দুজন ছুটতে ছুটতে পুকুরের উত্তর পাড়টায় এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মালগাড়ির দেখা নেই। শব্দও নেই।

মালগাড়ি কো বিনা খালা?

কো না, কই?

কই…

আসবো।

কই, আওয়াজ পাই না তো! সিটি দিব না?

মালগাড়ি সিটি দেয় না। থামেও না। শুধু যায় আর যায়।

তুই বুজলি কেমনে এখন মালগাড়ি যাইবো?

আমি জানি। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে মালগাড়ি যায় নারায়ণগঞ্জ। আমার মনে হইছে আইজ যাইবো। এবার বিনা খালাকে কথা শিখাই আমি। আইজ না, আজ।

বিনা খালা হাসল।

কিন্তু মালগাড়ি কই? আমরা দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। পাশের বাড়ির নারকেলপাতা সর সর করছে হাওয়ায়। পুকুরঘাটে বেশ একটা হইচই। খোকন মামারা নাইতে নেমেছেন। ঘাটলায় বসে গল্প করছেন অনু মামা তুলা মামা আরো কে কে। আমরা দুজন রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। মালগাড়ি আর আসে না।

হতাশ হয়ে বাড়ির দিকে ফিরব, কয়েক পা মাত্র এসেছি, বিনা খালা আমার হাত ধরল। এই মিলু, দাঁড়া।

কী রকম আনমনা হলো বিনা খালা, কান খাড়া করল। মুহূর্ত মাত্র, তার পরই মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল তার। আসতেছে, মালগাড়ি আসতেছে। কই?

আমি শব্দ পাইছি।

কান খাড়া করে আমিও শব্দ পাওয়ার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, রেলের চাকার একটুখানি শব্দ যেন পাই! গাড়ি যেন একটা আসছে!

আস্তে আস্তে সেই শব্দ পরিষ্কার হয়। ফুলবাড়িয়ার ওদিক থেকে মালগাড়ি আসছে। শব্দটা একটু যেন ধীর, একটু যেন অন্য রকম। আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বিনা খালা বলল, মালগাড়ি কিন্তু বিরাট বড়। বগি গুনবি, দেখবি শেষই হইব না।

সত্যি সত্যি মালগাড়ির বগি যেন শেষই হয় না। বগির রং দোতলা ঘরের মেঝের মতো, উঠান থেকে ঘরে ঢোকার সিঁড়ির মতো। রান্নাঘরের ওদিকে ফেলে রাখা থান ইটের মতো। এত আস্তে আস্তে এলো গাড়িটা! যেন দৌড় দিলে এই গাড়ির আগে যাওয়া যাবে, এমন করে চলছে। কোথাও কোনো লোক নেই। বগির দরজা-জানালা সব বন্ধ। দরজায় ঝুলছে সিল করা বড় বড় তালা।

কী আছে ভিতরে?

আমরা মালগাড়ির বগি গুনি। এক বগি, দুই বগি… …

গুনছি তো গুনছিই, শেষ হয় না। কতটা সময় যে কাটে!

মালগাড়ির লেজের কাছে ছোট্ট খোলা একটা অংশ। গাড়িটা যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। লেজের দক্ষিণ দিকটায় তো বগি। পুবে-পশ্চিমে মানুষের বুকসমান রেলিং। উত্তর দিকটা খোলা। ইচ্ছা করলে ওদিক দিয়ে ওঠা যায়। সেই জায়গাটাও ফাঁকা।

আমি সেদিকটায় তাকিয়ে থাকি। নালা পার হয়ে দৌড়ে যাবো নাকি মালগাড়ির লেজের কাছটায়! লাফ দিয়ে চড়ে বসব খোলা জায়গাটায়। কেউ দেখতে পাবে না, আমি একা একা চলে যাব দূরে, বহুদূরে।

আকাশ একটু মেঘলা হয়েছে।

রোদ মুছে দিয়েছে কালো মেঘ। গ্রীষ্মের শেষ দিক, এখন তো এ রকমই হবে। বর্ষাকাল আসছে, আকাশ আজ তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মেঘের গুড়গুড়ে ডাক শোনা যায়।

আমরা সবাই আজ পুকুরঘাটে। পুুকুরে নেমে গোসল করা হবে। মা আম্মা মিনু খালাও আছেন ঘাটে। তাঁরা গোসল করছেন না, ছোটদের গোসল করাচ্ছেন। বেঞ্চে রাখা হয়েছে জামা-প্যান্ট, গামছা। সিঁড়ির নিচ দিককার ধাপে বসে লোটা বদনা ভরে পানি তুলছেন মা। মাথায় শরীরে পানি ঢেলে সাবান দিয়ে ডলে গোসল করাচ্ছেন বাদল পলি ডলি, এমনকি কোলের মুকুলকেও। রিনাকে গোসল করিয়ে বেঞ্চের ওদিকটায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আম্মা। মা একা চারজনকে সামলাতে পারছেন না। তাঁকে সাহায্য করছেন আম্মা। যার গোসল হয়ে যাচ্ছে তাকে ওপরে নিয়ে গামছা দিয়ে শরীর-মাথা মুছিয়ে জামা-প্যান্ট পরিয়ে দিচ্ছেন।

মিনু খালা গোসল করাচ্ছেন সেন্টু আর রিনাকে। কিটি খালাদের বাড়ির পোলাপানও আছে আমাদের সঙ্গে। একদম ছোটদের দেখভাল করছেন কিটি খালা। সামুনি ছেলেটা সেন্টুর বয়সী। বেশ দুরন্ত। বারবার পুকুরে নেমে যেতে চাইছে। কিটি খালা তাকে ধরে রাখছেন।

অনু মামা তুলা মামাও আছেন আজ পুকুরঘাটে। প্যাটেল মামা এলেন একটু পর। খোকন মামা মিন্টু মামা আর দাদা সাঁতার কাটছেন পুকুরে। বেশি দূর যান না ওঁরা। ঘাটলার কাছাকাছিই থাকেন। এই ডুবসাঁতার দিচ্ছেন, এই চিতসাঁতার। খানিক দূর গিয়ে ডুব দিচ্ছেন, পাড়ের দিকে এসে ভুস করে মাথা তুলছেন।

অনু মামা তুলা মামারা চলে গেছেন মাঝপুকুরে। যেন গোসলের উৎসব চলছে আজ।

বিনা খালা রানি খালা আর মণির সঙ্গে আছি আমি। রানি খালা ছাড়া কেউ সাঁতার জানে না। পানির ভিতর ঘাটলার দু-ধাপ নিচে নেমেছি। তাতেই বুকসমান পানি। ওখানেই ডুবাডুবি করছি।

ডুবটা পারি তিনজনেই। এই আমি একটা ডুব দিলাম, এই দিল বিনা খালা। ডুব দিয়ে উঠেই ‘আহ্’ শব্দ করে বিনা খালা। মাথার চুল এসে পড়েছে গালে-মুখে, সেগুলো সরায়। গোসলের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বিনা খালাকে দেখি।

পানির তলায় ঘাটলার সিঁড়ি খুব পিছল। ঠিকমতো দাঁড়ানো মুশকিল। পা পিছলে পিছলে যায়। গভীর পানিতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। যারা সাঁতার না জানে তাদের একা একা গোসল করতে দেওয়া হয় না। আজ সবাই আছে। কারো ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। কেউ না কেউ খেয়াল করবে।

আমি যদি ডুবে যাই?

কেউ যদি আমাকে খেয়াল না করে?

না, করবে। এই তো বিনা খালা আছে পাশে। সে দেখবে।

ছোটদের গোসল করিয়ে মা আম্মা মিনু খালা তাদের নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। আমাদের বলে গেছেন তাড়াতাড়ি উঠতে।

আমরা কী আর উঠি! গোসলে যে কত আরাম!

বিনা খালার চোখ একটু একটু লাল হচ্ছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর চক্ষু লাল হইয়া গেছে বিনা খালা।

বিনা খালা ডুব দিয়ে উঠেছে। গাল-মুখের চুল সরাতে সরাতে বলল, তোরটাও হইছে।

সত্যই?

তয় কি মিথ্যা? মণিরে জিগা, রানিরে জিগা।

আমি ওদের দুজনার দিকে তাকিয়েছি, দেখি ওদের চোখও লাল। লাল চোখ নিয়ে ওপরে উঠেছি, ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। বেঞ্চে রাখা শুকনা জামাকাপড় ভিজবে। ওখানে অনু মামা খোকন মামাদের সঙ্গে তুলা মামা প্যাটেল মামার জামাকাপড় আছে। মাঝপুকুর থেকে অনু মামা বললেন, রানি, সবার জামাকাপড় বাংলাঘরে নিয়া যা।

রানি খালা থাবা মেরে মেরে সবার জামাকাপড় নিয়ে দৌড় দিল। আমরা ছুটলাম তার পিছন পিছন।

সারাটা দুপুর বৃষ্টি হলো। টিনের চালায় ঝমঝম শব্দ। লিচুপাতায় গড়াচ্ছে আকাশের কান্না। বাতাস নেই, গাছগুলো কেমন জবুথবু। রান্নাঘরের চালায় বসে ভিজছে একটা কাক। খানিক বসেই উড়াল দিয়ে গেল জামরুলগাছটার দিকে। বুড়ো আমগাছটার মাথা অন্ধকার হয়ে আছে। জলাভূমির কচুরি ঘন বৃষ্টিতে দেখাই যায় না। মুরগিগুলোর কোনো কোনোটা ঘরের ভিতর এসে ঢুকেছে।

বিড়ালটা কোথায়?

সাদা বিড়ালটা?

বৃষ্টিতে খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। তারপর কেউ গেল ঘুমাতে, কেউ বসল লুডু খেলতে।

আমার ঘুম আসে না। আমি জেগে থাকি। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে উঠানে বৃষ্টি দেখি। ইচ্ছা করে দোতলায় চলে যাই। কলের গান দেখি, হারমোনিয়াম দেখি। তার পরদিন থেকে আর হারমোনিয়াম ধরেননি মিনু খালা। একবারও শুনিনি তাঁর গান। কলের গান তো কেউ বাজায়ই না। নষ্ট নাকি? ওই বিনা খালা, কলের গান তোরা বাজাস না?

ঢেউটিনের চালা থেকে ঝরঝর করে পড়ছে বৃষ্টির পানি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক হাত মেলে সেই পানি ধরার চেষ্টা করছে বিনা খালা। কথা শুনেও আমার দিকে তাকাল না। বলল, টুনদায় অনদায় বাজায়। আপায়ও মাঝে মাঝে বাজায়।

তুই বাজাছ না?

না।

ক্যা…ক্যান?

ছোট পোলাপানের কলের গান ধরতে হয় না।

তুই বাজাইতে পারছ?

পারি।

কে শিখাইছে?

কেউ শিখায় নাই। বাজাইতে দেখি না? দেখতে দেখতে শিখা ফালাইছি।

আমারে শিখাবি?

বিনা খালা আমার দিকে তাকাল। কেমনে শিখামু? দোতলায় গিয়া কলের গান ধরলেই তো কেউ না কেউ দেইখা ফালাইব।

আমরা চুপে চুপে যামু।

রেকর্ড ছাড়লে আওয়াজ হইব না?

হ…হ্যাঁ, তা তো হইবই।

তাইলে?

আমি আনমনা হই। কথা বলি না।

বিনা খালা আবার হাত বাড়িয়েছে বৃষ্টির দিকে। বললাম, তুই গান জানছ, বিনা খালা?

জানি।

কয়টা?

অনেকগুলি।

হারমনি বাজাইতে পারছ?

হারমনি না, হারমোনিয়াম।

হারমোনিয়াম। বাজাইতে পারছ?

অল্প অল্প পারি। আপার মতন পারি না। বাবায় বলছে গানের মাস্টার রাইখা দিব। তার কাছে শিখুম।

মিনু খালার গানের মাস্টার নাই?

ছিল, এখন নাই। আপার তো বিয়া হইয়া যাইব, তার আর গানের মাস্টারের দরকার নাই। আমার জন্য রাখব।

দুপুর শেষ হচ্ছে, বৃষ্টিও থামল। আকাশ পরিষ্কার হয়নি। মেঘ ভাসছে আকাশে, চারদিকে মেঘের ছায়া। বিনা খালা গিয়েছিল বাংলাঘরের দিকে। আমি মাত্র উঠানে নেমেছি, ছুটতে ছুটতে এলো। তাড়াতাড়ি আয় মিলু, তাড়াতাড়ি।

উত্তেজনায় বিনা খালার বড় চোখ আরো বড় হয়ে গেছে, মিষ্টি মুখখানি ফেটে পড়তে চাইছে।

কী হইছে রে?

আয় তাড়াতাড়ি, তারপর বলতেছি।

বিনা খালার সঙ্গে দৌড়ে ঢুকেছি বাংলাঘরে। দেখি অনু মামার পড়ার টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন অনু মামা খোকন মামা মিন্টু মামা আর দাদা। অনু মামার তেমন ভাবান্তর নেই, খোকন মামা ভীষণ উত্তেজিত। মিন্টু মামা আর দাদার মুখ ঝলমল ঝলমল করছে গভীর আনন্দে।

বিনা খালার সঙ্গে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখি একটা শালিকছানা পড়ে আছে টেবিলে। বুকের কাছটা থেঁতলে গেছে, নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। চিঁচিঁ করে ডাকছে।

কী হইছে?

বৃষ্টিতে লিচুগাছের ডালায় বসে ভিজছিল শালিকছানা। বোধ হয় ভালো করে উড়তে শেখেনি। খোকন মামার হাতে সারাক্ষণই গুলাল। বাংলাঘরের বারান্দা থেকে ‘সই’ করেছেন। পোড়ামাটির শক্ত গুলি গিয়ে লেগেছে শালিকছানার বুকে। টুপ করে পড়েছে লিচুতলায়। বৃষ্টিতে ভিজেই খোকন মামা শালিকছানা নিয়ে এসেছেন বাংলাঘরে। তারপর থেকে খোকন মামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে গৌরবের হাসিতে।

কিন্তু আমার মন খারাপ হয়, বিনা খালার মন খারাপ হয়। শালিকছানার দিকে না তাকিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি টুনু মামার টেবিলের দিকে। মোটা মোটা বইপত্রের পাশে টেবিলে দাঁড় করানো সাদা একটা বোর্ড। সূক্ষ্ম পেনসিলে সেই বোর্ডে আঁকা হচ্ছে এক মেয়ের ছবি। পুরো ছবি না, বুকের ওপর থেকে। মেয়েটির কণ্ঠার হাড় পরিষ্কার জেগে আছে ছবিতে।

কে এঁকেছে এই ছবি?

বাংলাঘর থেকে বেরিয়ে বিনা খালা বলল, টুনদায় আঁকছে। টুনদায় খুব ভালো ছবি আঁকে।

বিনা খালার মুখ থেকে বেদনার ছায়া যায়নি। বাংলাঘরের পুব দিককার দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুরঘাটে এসেছি আমরা। বলল, শালিক পাখিটার জন্য আমার খুব মায়া লাগছে।

আমারও লাগছে। পাখি কেউ মারে, বল?

টুনদায় শুনলে রাগ করব। দাদায় পাখি খুব ভালোবাসে। ছোটবেলায় শালিক পালত।

সত্যই?

হ্যাঁ। টুনদার বয়স তখন এগারো-বারো বছর। আমার মাজারো মামা আছে না, ডালু মামা, ডালু মামা আর আমরা এক বাসায় থাকতাম। আজিমপুরের ওই দিকে পলাশী নামে একটা জায়গা আছে, সেই পলাশীতে। ডালু মামা কোয়ার্টারে থাকত…

কোয়ার্টার কী?

সরকারি বাসা। মামায় সরকারি চাকরি করে। বাবার মতন। ওই রকম চাকরি যারা করে, সরকার থেকে তাগো থাকার জন্য বাসা দেয়।

নানারে দেয় নাই?

না, বাবার অফিসে মনে হয় দেয় না। দিলে তো আমরা সেই বাসাতেই থাকতাম। মামার বাসায় থাকতে যামু ক্যান?

আমি বড়দের মতো করে বললাম, তুই কি সেই বাসায় থাকতি? কেমনে থাকতি? তুই কি তখন হইছস?

আমার কথা শুনে বিনা খালা হাসল। ঠিকই কইছস। আমি ক্যান, মিনদাও তখন হয় নাই। আমরা তখন চাইর ভাই-বোন।

নামগুলো আমি বলে দিলাম। টুনু মামা মিনু খালা অনু মামা খোকন মামা।

হ্যাঁ। শোন আসল ঘটনা। টুনদায় একটা শালিকের বাচ্চা জোগাড় করছে। সেইটারে রাখছে ছোট্ট খাঁচায়। খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া বড় করতেছে। পাখিটা একটু একটু উড়তে পারে। খাঁচা থিকা বাইর কইরা দেয় সকালবেলা। সারা দিন ছাড়াই থাকে পাখিটা। টুনদা ডাক দিলে উড়াল দিয়া আইসা দাদার কান্ধে বসে, হাতে বসে।

বাহ্।

দাদায় পাখিটার জন্য পাগল। সে তো পড়ে পোগোজ স্কুলে। আগে আমরা থাকতাম রোকনপুর। সেখান থিকা পোগোজ স্কুল কাছে। ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষ্মীবাজারের ওই দিকে। পলাশী থিকা পোগোজ স্কুল অনেক দূর। দাদায় হাইটা স্কুলে আসে। কোনো কোনো দিন ঘোড়ার গাড়িতে কইরাও আসে।

আমি অবাক। ঘোড়ার গাড়িতে চইড়া স্কুলে আসত?

বিনা খালা তার সেই মিষ্টি হাসিটা হাসল। আরে না, আসল কথা তো তোরে বলি নাই। শোন, ঘোড়ার গাড়ির পিছনে বসার একটা জায়গা আছে, দেখছস?

হ, হ, দেখছি।

বিনা খালা চোখ পাকিয়ে তাকাল। আবার হ বলতাছস? তোরে না শিখাইছি…

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। হ্যাঁ…। কথার তালে ভুইলা গেছিলাম।

শোন, ঘোড়ার গাড়ির পিছনের ওই জায়গাটা থাকে গাড়ির বাইরে। ওইখানে একজন মানুষ বসতে পারে। গাড়ির মালিকের লগে কেউ থাকলে সে বসে আর নাইলে খালি থাকে। কোচোয়ান যাতে দেখতে না পায়, তারে ফাঁকি দিয়া রাস্তার লোকজন, দুষ্টু পোলাপান সেখানে বইসা পড়ে। কোচোয়ান টের পাইলে অসুবিধা আছে। তার হাতে তো চাবুক। চাবুক হইল অনেক লম্বা। সেই চাবুক দিয়া পিছন দিকে বাড়ি দেয়। ঘোড়ার গাড়ির ছাদের ওপর দিয়া চাবুক আইসা গায়ে লাগে। টুনদায় ওই রকম বাড়িও খাইছে।

ক্যান?

স্কুলে যাওয়ার সময় ঘোড়ার গাড়ি দেখলেই, পিছনটা খালি দেখলেই চইড়া বসতো যে!

আমি হাসলাম। বুজছি।

স্কুলে যাওয়ার আগে শালিকের বাচ্চাটারে দাদায় খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া যাইতো। স্কুল থিকা আইসা ডাক দিতো, পাখি আইসা তার কান্ধে বসতো। রাত্রে পাখিটারে রাখতো খাঁচায়। পাকের ঘরের ওই দিকে লাকড়িখড়ি রাখার একটা জায়গা ছিল, সেখানে বেড়ার লগে ঝুলাইয়া রাখতো খাঁচা। এক রাত্রে শোনে পাখিটা চিঁচিঁ করে। দাদায় উইঠা হারিকেন নিয়া বাইর হইছে। দেখে খাঁচায় পাখিটা নাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা দাদায় বুইঝা গেছে। পাকের ঘরের ওই দিকে, লাকড়িখড়ির তলায় ইন্দুরের গর্ত। বিরাট বিরাট ইন্দুর থাকে। সেই ইন্দুর খাঁচার ফাঁক দিয়া কেমনে কেমনে শালিকের বাচ্চাটারে বাইর করছে, গর্তে লইয়া গেছে। বাচ্চাটা তখনো মরে নাই। চিঁচিঁ করতাছে…

আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, তারপর?

অত লাকড়িখড়ি সরাইয়া গর্তের ভিতর থিকা বাচ্চাটা দাদায় কেমনে বাইর করব। সেই বাচ্চা ইন্দুরের পেটেই গেল। দাদার যে কী মন খারাপ হইছিল। শালিকের বাচ্চার জন্য অনেক কান্নাকাটি করছে।

সেই না-দেখা শালিকছানার জন্য বিনা খালার মন খারাপ হলো। বিষণ্ন চোখে কুঁড়েঘরের ওপরকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার দেখাদেখি আমারও মন খারাপ হয়েছে। বিনা খালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

একসময় বিনা খালা বলল, বাবায় প্রথমে চাকরি করতো টাঙ্গাইলে। তখন শুধু টুনদা আর আপায় হইছে। অনদাও হয় নাই। যে বাড়িটায় তারা থাকতো, বাড়িটা গ্রামের বাড়ির মতন। টিনের বড় ঘর, অনেক গাছ। গাছে গাছে পাখি। ডালু মামা একবার গেছে সেই বাড়িতে। আমার নানার বড় বোন থাকতো আমাদের বাড়িতে। সে ছিল বিধবা। বিধবা কারে কয় জানছ?

যার জামাই নাই।

বাহ্, তুই তো দেখি অনেক কিছু জানছ। তয় জামাই বলতে হয় না, বলতে হয় স্বামী। নানার বইনের স্বামী ছিল না। নানায় তারে টাঙ্গাইলে দিছিল মায়ের জন্য। মা একলা একলা থাকবো, তার সঙ্গে থাকার জন্য। টুনদারা তারে ‘আম্মা’ ডাকতো। আম্মাই পালতো টুনদারে। আম্মা তারে গাছ চিনাইতো, পাখি চিনাইতো। সাতটা পাখি একসঙ্গে আইসা মাঝে মাঝে বাড়ির গাছে বসে। দাদারে আম্মা শিখাইয়া দিল, এই পাখির নাম ‘সাতভেলা’। সাতটা পাখি সব সময় একসঙ্গে থাকে, এই জন্য সাতভেলা নাম।

সাতভেলা পাখি তুই দেখছস, বিনা খালা?

না।

আমিও দেখি নাই।

শোন তারপর। কইলাম না, ডালু মামায় গেছে টাঙ্গাইলের বাড়িতে…

হ্যাঁ।

মামার ছিল খোকনদার মতন গুলাইল দিয়া পাখি মারনের অভ্যাস। একদিন একটা সাতভেলা পাখি সে মাইরা ফালাইল। মরা পাখি হাতে নিয়া সে যখন বাড়ির সবাইরে দেখাইতে আনতেছে, অন্য ছয়টা পাখি এমন ডাকাডাকি করতেছিল, উইড়া আইসা মামার মাথায় ঠোকরও দিতে চাইতেছিল। অবস্থা খারাপ দেইখা মরা পাখিটা মামায় জঙ্গলের দিকে ফালাইয়া দিল। দুই দিন পর ভীষণ জ্বর এলো মামার। সেই জ্বর কমেই না, কমেই না। মা আম্মা দুজনেই বুইঝা গেছে, হঠাৎ ক্যান এই রকম জ্বর হইল মামার। কথাটা মামারে আম্মায় বইলাই দিল। সাতভেলা পাখি মারছস, এই জন্য জ্বর হইছে।

আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম, পাখি মারলে জ্বর হয়?

হইতে পারে।

খোকন মামায় যে শালিক পাখিটা মারছে, মামার কি তাইলে জ্বর হইব?

বিনা খালা উদাস গলায় বলল, কী জানি!

কোনো কোনো দিন যে কত আনন্দের ঘটনা ঘটে!

আজকের দিনটি তেমন। সকাল থেকেই আকাশ আজ মেঘলা। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। প্রতিদিন রোদের আকাশ আমার ভালো লাগে না। ঘুম ভাঙার পর প্রতিদিনই যদি দেখি চারদিক ভরে গেছে রোদে, প্রতিদিনকার সকালই এক রকম, আমার ভালো লাগে না। রোদের দিনেও হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙে দেখি রোদ উঠেনি, চারদিক ছায়া ছায়া, আকাশ মেঘলা, আমার ভালো লাগে।

বিনা খালাদের বাড়িতে আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই রোদ উঠেছে সকালবেলা। আকাশ মেঘলা হয়েছিল একদিন দুপুরে, বৃষ্টিও হয়েছিল। সকালের দিকে হয়নি।

আজ হয়েছে। ঘুম ভাঙার পর এ জন্য আমার মন আজ একটু বেশি ভালো। মেঘলা আকাশের তলা দিয়ে জামরুলগাছটার ওদিকে যাই একা একা। বাগানমতো জায়গাটার উত্তর দিককার বেড়া খানিকটা ভাঙা। সেখান দিয়ে বেরিয়ে পায়ে চলা পথ দিয়ে একটু হাঁটি। পশ্চিম দিকে তেমন যাই না। পুব দিকে পুকুর, তার ওপারে কুঁড়েঘর দুটো, আমি পুকুরঘাটে যাই। জমিদার বাড়ির ভিতরটায়ও যেতে ইচ্ছা করে। যাব নাকি একা একা একটু!

বিনা খালা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। সে যে কোথায়? ঘুম ভাঙার পর তাকে আর দেখিইনি। রানি খালা আর মণির সঙ্গে আছে মনে হয়।

বিনা খালার কথা ভাবছি আর তখনই লিচুতলার ওদিক থেকে বিনা খালা ডাকল। মিলু, এই মিলু।

আমি ছুটে গেলাম বিনা খালার কাছে। কী রে?

কই তুই? তোরে খুঁইজাই পাই না।

আমিও তো তোরে পাই নাই।

দোতলায় বইসা পড়তেছিলাম। তোরা আসার পর থিকা লেখাপড়া তো বন্ধ। বাবায় বলছে এর মধ্যেই পড়ালেখা চালাইয়া যাইতে হইবো। তোর অনেক মজা, পড়তে হয় না।

না, না, বাসায় আমি পড়ি।

স্কুল তো নাই।

না থাকুক। আমি কেলাস টুয়ের বই পড়তে পারি। বাংলা ইংরেজি অঙ্ক সব পড়ি।

কেলাস না গাধা, ক্লাস।

ক্লাস…

আমরা দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকি। জলাভূমির ওপর ঝুঁকে থাকা অচেনা গাছটার তলায় এসে দাঁড়াই। এদিককার মানুষজন, পোলাপান কেউ কেউ আমাদের দিকে তাকায়। আব্বার বয়সী একজন মানুষ হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরছেন। ব্যাগে মাছ তরকারি। বোয়াল মাছের লেজা বেরিয়ে আছে ব্যাগ থেকে। বিনা খালাকে দেখে বললেন, কেমুন আছো, বিনা?

বিনা খালা হাসিমুখে বলল, ভালো আছি।

লগে কে? আগে দেখি নাই তো।

আমার ফুফাতো বোনের ছেলে। নাম হইল মিলু।

ভদ্রলোক আর কথা বললেন না। বাজারের ব্যাগ হাতে পুবে-পশ্চিমে লম্বা টিনের ঘরগুলোর দিকে চলে গেলেন।

গাছতলার জলাভূমি অল্প একটু পরিষ্কার করা হয়েছে। তালগাছের শুকনা গুঁড়ি ফেলে ঘাট করা হয়েছে। বাড়ির বউঝিরা বোধ হয় ধোয়াপাকলার কাজ করবে। পানির রং দেখে আমি অবাক। এত কালো কেন পানি?

বিনা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম। ওই বিনা খালা, এখানকার পানি এমুন কালা ক্যা, না না, কালো ক্যান?

পানি কালো না। কচুরির তলায় আছিল, এই জন্য বেশি পরিষ্কার। গাছের ছায়া পড়ছে পানিতে, আকাশ মেঘলা, এই জন্য পানি কালো লাগতেছে।

তালগাছের ঘাটলাটুকুয় বসে পানিতে হাত দিল বিনা খালা। পানি নেড়ে দিল। দেখ, কত পরিষ্কার পানি।

আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই। কাঁচা-পাকা কথা বলি। মেঘলা আকাশের তলায় বিনা খালাদের বাড়ির দিকটা নিঝুম হয়ে আছে। এত মানুষজন বাড়িতে, কারো যেন সাড়াই নেই। লিচুপাতা নত হয়েছে মাটির দিকে। তলায় জমেছে আবছায়া।

এগারোটার দিকে বিনা খালা বলল, গান শুনবি মিলু?

আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। শুনুম। কলের গান বাজাবি?

না। কইছি না তোরে, ছোটদের কলের গান ধরা নিষেধ।

আমি চুপসে গেলাম। তাইলে গান শুনুম কেমনে?

আমি শুনামু।

তুই গান গাইবি?

হ্যাঁ। খালি গলায় না, হারমোনিয়াম বাজাইয়া গান করুম।

কথাটা আমার বিশ্বাস হয় না। চোখ পিটপিট করে বলি, যাহ্। মিছা কথা।

মিথ্যা কথা না, সত্য। শুনবি?

আমি বিনা খালার হাত ধরলাম। চল।

তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না বিনা খালা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করবে আর তার সামনে বসে আমি শুনব! বিশ্বাস হলো, বিনা খালা যখন আমাকে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো, শতরঞ্জির ওপর বসে হারমোনিয়ামে হাত দিল।

বসার ভঙ্গিটা কী সুন্দর! আসনপিঁড়ি করে বসা না। পা দুটো ভাঁজ করে পিছন দিক দিয়ে বসা। গান শুরুর আগে সাদা-কালো রিডে তার এক হাতের আঙুল দৌড়াতে লাগল, আরেক হাত হারমোনিয়ামের কোনায়, সেই হাতে চলছে ‘বেলো’ করার কাজ। আমি বসেছি বিনা খালার মুখোমুখি। মুগ্ধ বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেছি।

বিস্ময় বাড়ল বিনা খালার গান শুনে। কোকিলের মতো মিষ্টি কণ্ঠে বিনা খালা গাইতে লাগল,

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।

তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে

তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ

আমার ঘোর কাটে না, আমি বসেই থাকি। পুরো গানটা গায় বিনা খালা, আমি বসেই থাকি।

এক লাইন দু-লাইন করে কত গান যে বিনা খালা তারপর আমাকে শোনাল! আমার মনে রয়ে গেল শুধু একটা লাইন, ‘না পেয়ে তোমার দেখা একা একা দিন যে আমার কাটে না রে?’

বিনা খালার গান শুনে মণি বাদল পলি কখন উঠে এসেছে দোতলায়, কখন আমার পাশে এসে বসেছে, আমি খেয়ালই করিনি।

বাইরের আকাশ তখনো মেঘলা। রোদের দেখাই নেই।

নিচে নেমে বিনা খালা বলল, ফায়ার সার্ভিসের মাঠে যাবি, মিলু?

আমি লাফ দিয়ে উঠি। যামু।

যাইতে হইবো চুপে চুপে। কাউরে বলতে পারবি না।

আইচ্ছা বলুম না।

তাইলে চল।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির উঠানে। দুজন সারাক্ষণ একসঙ্গে বলে কেউ আমাদের তেমন খেয়াল করে না। উঠানে এখন ছোট্ট রিনাকে কোলে নিয়ে পায়চারি করছেন মিনু খালা। কাছাকাছি দাঁড়িয়েই ফায়ার সার্ভিসের মাঠ দেখতে যাওয়ার কথা বলছে বিনা খালা, আমিও তার সঙ্গে লাফাচ্ছি, এত কাছে থেকেও মিনু খালা তা খেয়াল করলেন না। রিনাকে কোলে নিয়ে পায়চারি করছেন আর গুনগুন করে গান করছেন। কী গান, আমি বুঝতে পারছি না।

মিনু খালার পরনে হালকা বেগুনি শাড়ি। এ রকম মেঘলা দিনেও তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বিনা খালা বলল, আগে তুই বাড়ি থিকা বাইর হবি।

ঠিক আছে।

বাগানের ওই দিকে যা। ভাঙা বেড়ার ওখান দিয়া বাইর হবি। আমি বাইর হমু লেচুতলা দিয়া। তুই রাস্তার ওই দিকে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকবি। আমি আসতেছি।

রাস্তার কোন দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব চোখ ইশারায় বিনা খালা সেদিকটা দেখিয়ে দিল। আমি একবার মিনু খালার দিকে তাকালাম। যেন কোথাও যাচ্ছি না এমন ভঙ্গিতে জামরুলতলার দিকে চলে এলাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাঙা বেড়া দিয়ে চট করে বেরিয়ে এলাম। কেউ দেখতেই পেল না।

রাস্তায় বেরিয়ে বিনা খালা যেদিকে বলেছে সেদিকে হাঁটছি। কয়েক পা হেঁটে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি লিচুতলার দিক থেকে দৌড়ে আসছে বিনা খালা। মুখ ভরে আছে হাসিতে। কাছে এসেই আমার হাত ধরল। তোরে কেউ দেখছে?

না।

আমারেও দেখে নাই।

ফিরত আসনের পর জিগাইবো না, কই গেছিলি?

জিগাইবো না, বল, জিজ্ঞাসা করবো না।

জিজ্ঞাসা করবো না…

বেশি দেরি হইল তো করবোই।

কী বলবি তখন?

ফায়ার সার্ভিসের মাঠে গেছিলাম সেইটা বলা যাইবো না। বলতে হইবো কিটি আপাদের বাড়িতে গেছিলাম।

ঠিক আছে।

দুজনেই জোরে জোরে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ওই বিনা খালা, ফায়ার সার্ভিসের মাঠে বান্দর আছে?

বান্দর না বোকা, বানর?

বানর। আছে?

না। বানরগুলি থাকে সাধনায়। সাধনার মালিকের পালা বানর।

কতগুলি?

এক-দুইশো হইবো।

আল্লারে, এত বান্দর! না না, বানর।

বানরগুলি সারা গেণ্ডারিয়ায় ঘুইরা বেড়ায়। এই বাড়িতে যায়, ওই বাড়িতে যায়। বাড়িতে ঢুইকা পাকের ঘর থিকা খাবারদাবার লইয়া যায়। রাস্তা দিয়া আসা লোকজনের হাত থিকা পাউরুটি কলা লইয়া যায়।

কামড়ায় না?

না, কামড়ায় না, ভয় দেখায়। তাও সব সময় দেখায় না।

কখন দেখায়?

বানরের লগে দুষ্টামি করলে ভয় দেখায়। বেশি দুষ্টামি করলে খামছি দেয়। আবার মানুষরেও ভয় পায়। কখন পায় জানছ?

কখন?

যদি হাতে লাঠি থাকে। হাতে লাঠি থাকলে সামনে আসে না বানরগুলি। এই জন্য দেখবি দোকান বাজার থিকা খাবারদাবার কিন্না আনার সময় পোলাপানরা, বড় মানুষরা হাতে একটা কঞ্চি রাখে। ছোট লাঠিও রাখে।

আগে কবি না।

কইলে কী হইতো?

বাগানের ওখান থিকা একটা কঞ্চি নাইলে একটা চটি লইয়াইতাম।

লাগবো না। এই দিকে বানর আসবো না। এলেও আমাদের সামনে আসবো না। আমাদের লগে তো খাবার নাই!

তার পরও ভয় ভয় করছে আমার। একদিকে বানরের ভয়, আরেক দিকে ফায়ার সার্ভিসের মাঠ দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা।

মবিনের বাড়িটা হলুদ রঙের। একতলা বাড়ি। সামনে লোহার গেট। গেট ছাড়িয়ে কিছুটা খালি জায়গা তারপর চওড়া বারান্দাঅলা বাড়ি। সেই বাড়ির পাশ দিয়ে দক্ষিণে চিপা গলি। আমরা দুজন সেই গলিতে ঢুকে গেলাম। দুজনেরই খালি পা। তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। গলিটা পরিষ্কারই। টুকটাক ময়লা-আবর্জনা যেমন পড়ে থাকে এদিক-ওদিক, তেমন কিছু ময়লা-আবর্জনা আছে।

গলির দক্ষিণ মাথায় পুবে-পশ্চিমে একটা নালা। বেশ চওড়া নালা। তিরতির করে ময়লা পানি পশ্চিম থেকে পুবে যায়। ভাঙাচোরা আর আস্ত ইট ফেলা আছে অনেক। ওসবের ওপর দিয়ে নালা পেরোলেও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভিজে যায়।

আমাদেরও ভিজল।

ওপারে নিবিড় হয়ে আছে গাছপালা। বিশাল বিশাল গাছ। একেকটার মাথা গিয়ে আকাশে ঠেকেছে। কোনো কোনো গাছ চিনতে পারি না, কোনো কোনোটা চেনা। আমগাছ জামগাছ কদমগাছ তেঁতুলগাছ। ওই তো ওটা হচ্ছে শিরীষগাছ। বকুলগাছ আছে, কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ আছে। বেগুনি রঙের জারুল ফুল ফুটে আছে কয়েকটা গাছে। নিমের পাতা তিরতির করছে হাওয়ায়। মাঠ কোথায়, এটা তো বাড়ি!

কথাটা বললাম বিনা খালাকে।

বিনা খালা বকুলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে হাসল। এইটা আছিল দীননাথ সেনের বাড়ি। যার নামে দীননাথ সেন রোড। সে আছিল জমিদার।

তয় তার বাড়ি মাঠ হইল কেমনে?

সেইটা আমি কইতে পারি না। চল।

আমরা দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলাম। গাছপালার ছায়া ঘন হয়ে পড়েছে তলায়। মাথার ওপর আকাশ আগের মতোই মেঘলা। নাকি আগের চেয়ে বেশি! না, রোদ আজ মনে হয় উঠবেই না।

খানিক এগোতেই সামনে বড়সড় একটা মাঠ। ঘন সবুজ ঘাসে ভরে আছে। মাঠের পশ্চিমে বড় বড় অনেক গাছ, বিশাল একটা পুকুর। মেঘলা আকাশের তলায় যেন অন্ধকার হয়ে আছে ওদিকটা। গা ছমছমে নির্জনতা চারদিকে। কোথাও কোনো লোকজন নেই।

আমরা মাঠে এসে দাঁড়াই।

বিনা খালা বলল, এইটা আছিল দীননাথ জমিদারের উঠান। এখন এইটাই ফায়ার সার্ভিসের মাঠ।

ফায়ার সার্ভিস জিনিসটা কী?

বিনা খালা অবাক। জানছ না?

না।

ফায়ার মানি হইল আগুন।

আর সার্ভিস?

সেইটা জানি না। ফায়ার সার্ভিসের কাজ হইল আগুন নিভানো। কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে তারা গিয়া আগুন নিভায়। ওই যে মাঠের ওই দিকে হলুদ দালানটা দেখতাছস, ওইটা হইল ফায়ার সার্ভিসের অফিস।

মাঠ পেরিয়ে আমরা সেদিকটায় যাই।

মাঠের পর সোজা দক্ষিণে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। পথের পুব দিকে পুরানা আমলের দোতলা হলুদ দালান। দালানের সামনে বাসের মতন লাল রঙের পুরানা একটা গাড়ি।

আমি অবাক। এত বড় গাড়ি?

এইটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। গাড়িতে পানি ভরা থাকে। আগুনের খবর পাইলে ফায়ার সার্ভিসের লোক এই গাড়ি নিয়া যায়। গাড়িতে পাইপ লাগানো আছে। পাইপ দিয়া পানি দেয়, আগুন নিভায়। এই গাড়ি যখন চলে তখন ঘণ্টা বাজে।

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কী বিস্ময়!

দালানের দক্ষিণে আরেকটা বড় পুকুর। এদিকে দু-একজন লোক দেখতে পাই। পুকুরে নেমে গোসল করছে একজন। দালানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজন। তাদের হাতে সিগ্রেট। আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।

মাঠের শেষে দক্ষিণে সুরকি বিছানো সুন্দর রাস্তা। রাস্তার পুবে পুকুর পাড়ে বড় বড় কয়েকটা গাছ, আর তলায় শুধুই পাতাবাহারের ঝোপ। হলুদ সবুজ লাল রঙের পাতায় পড়েছে মেঘের ছায়া। বড় গাছগুলোর পাতা আছে স্থির হয়ে।

রাস্তার পশ্চিমে আরেকটা মাঠ। এত পরিচ্ছন্ন সেই মাঠ! চারদিকে পাতাবাহার বেলি মেহেদি হাসনুহেনার ঝাড়, মাঝখানে গাঢ় সবুজ ঘাসের এক টুকরা মাঠ।

বিনা খালা বলল, এইটা আছিল জমিদার বাড়ির সামনের বাগান। সোজা ওই যে রাস্তাটা দেখতাছস, ওই দিকে আছিল বাড়িতে ঢোকার গেট।

আমি বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।

ওই দিকে যাবি?

ল, না না, চল।

আমি ভুল কথা বলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটা যখন শুদ্ধ করি, বিনা খালা হাসে।

এখনো হাসল। কিছু বলল না।

আমরা দুজন দক্ষিণ দিককার শেষ মাথায় এসে দাঁড়ালাম। রাস্তাটা পুবে-পশ্চিমে। বিনা খালা পুব দিকটা দেখিয়ে বলল, ওই দিকে গেণ্ডারিয়া স্টেশন।

তারপর পশ্চিম দিক দেখাল। এই পাশে গেণ্ডারিয়া হাই স্কুল।

রাস্তায় একটা-দুটো রিকশা দেখি, দু-চারজন লোক দেখি। দোকানপাট আছে রাস্তার ধারে, বাড়িঘর আছে। দালান বাড়ি, টিনের বাড়ি। গাছপালা আছে সব বাড়িতেই। বিনা খালাদের বাড়ির দিককার মতোই নির্জন, ছিমছাম।

সময় কতটা কেটেছে আমাদের দুজনার কারো সেই কথা মনে নেই। বাড়ি ফিরতে হবে সেই কথাও যেন মনে পড়তে চায় না। এদিক হাঁটি ওদিক হাঁটি। রাস্তার দিক থেকে ফিরে এসে পুবের পুকুর পাড়ে যাই, গাড়িটার সামনে গিয়ে একটু দাঁড়াই। পশ্চিম দিককার পুকুর পাড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে যাই। ভয়ের জিনিসটা বিনা খালা প্রথমে দেখেনি, আমি দেখেছি। দেখেই বিনা খালার হাত চেপে ধরেছি। বিনা খালা…

কী রে?

ওই যে দেখ, বান্দর, না না, বানর।

কই?

বিনা খালাও বানরটা তারপর দেখতে পেল। পুকুরের ওপারে উঁচু দেয়াল। দেয়ালে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

বিনা খালা হাসল। এত দূরে বানর দেইখাও ভয় পাইলি? ভয়ের কিছু নাই। পুকুর পার হইয়া বানর এই পাড়ে আসব না।

তাও আমার ডর করতাছে।

টুনদার বানরের গল্পটা শুনবি?

আমি অবাক। টুনু মামায় বানরও পালতো?

আরে না। দাদার ছোটবেলার ঘটনা। চল, যাইতে যাইতে কই।

পশ্চিমের পুকুর পাড় থেকে মাঠের দিকে হাঁটতে থাকি আমরা।

বিনা খালা বলল, আম্মারে বানরে ধরছিল?

কোন আম্মারে?

ওই যে মায়ের ফুফু। টাঙ্গাইলের বাড়িতে থাকতো। টুনদারে আর আপারে রাখতো।

বুজছি।

যেই বাড়িতে ডালু মামায় সাতভেলা পাখি মারছিল, সেই বাড়ির পাশের বাড়ির লোকে একটা বানর পালতো। আম্মায় টুনদারে কোলে লইয়া মাঝে মাঝে সেই বাড়িতে যায়। একদিন বানরটা ফুফুর শাড়ি খামছি দিয়া ধরছে। টুনদায় তার কোলে। দাদায় ভয়ে চিৎকার করতেছে। বানর কিছুতেই আম্মার শাড়ি ছাড়ে না। শেষে বাড়ির লোকজন আইসা বানর ছাড়াইলো। দাদায় ভয় পাইছে শুইনা পাড়ার লোকে সেদিনই বানরটারে পিটাইয়া মাইরা ফালায়। মাইরা পায়ে দড়ি বাইন্ধা টানতে টানতে নিয়া আসে দাদারে দেখাইতে…

বানরটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে শুনে আমার মনটা বুঝি খারাপ হয়। ব্যাপারটা খেয়াল করে বিনা খালা। দুঃখী গলায় বলল, তোর মতন অবস্থা আমারও। বানর দেখলে ভয় পাই, কিন্তু ওই যে টাঙ্গাইলের বানরটারে পিটাইয়া মাইরা ফালাইছিল পাড়ার লোকে, সেইটা শুইনা মন খারাপ হইছিল…

আমরা আর কথা বলি না, নালা পেরিয়ে গলিতে উঠি। গলির মুখে এসেছি, ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি, বড় বড় ফোঁটায় মুহূর্তে কুয়াশার মতো করে ফেলল চারদিক। বিনা খালা বলল, দৌড় দে মিলু, দৌড় দে।

আমরা দুজন বাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। যখন ভাঙা বেড়ার ওদিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছি ততক্ষণে ভিজে চুপসে গেছি। যেন পুকুরে ডুব দিয়ে এলাম।

দুপুরের পর বৃষ্টি নেই। তখন খুলে গেল আনন্দের আরেক দরজা। দোতলায় উঠে কলের গান আর একটা রেকর্ডের বাক্স বাংলাঘরে নিয়ে এলেন অনু মামা। আমরা দৌড়ে গিয়ে ভিড় করলাম। কলের গান বাজানো দেখবো, কলের গানে গান শুনবো।

কলের গান টেবিলের ওপর রাখলেন অনু মামা। রেকর্ড বের করে একটা রেকর্ড চাপলেন। পটু হাতে পাম্প করলেন, নতুন পিন লাগিয়ে বাচ্চা বিড়ালের মাথার মতন যন্ত্রটা আলতো হাতে বসিয়ে দিলেন রেকর্ডের ওপর। শুরু হলো গান। কী যে সুন্দর এক পুরুষ কণ্ঠ গাইতে লাগল…

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে

সাতসাগর আর তেরো নদীর পাড়ে

ময়ূরপঙ্খি ভিড়িয়ে দিয়ে সেথায়

দেখে এলেম তারে, সাতসাগরের পাড়ে।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি কলের গানের দিকে। রেকর্ড ঘুরছে, গান হচ্ছে। কালো রেকর্ডের মাঝখানে, লাল রঙের ছাপা কাগজের একপাশে দু-পায়ে খাড়া হয়ে বসা একটা সাদা কুকুরের ছবি। ছবির কুকুরও যেন মুগ্ধ হয়ে গান শোনে।

একটা শেষ হলে আরেকটা রেকর্ড চাপান অনু মামা। পুরুষ কণ্ঠের গান, নারী কণ্ঠের গান। গানে গানে ভরে যায় শেষ দুপুর, আকাশ থেকে নামে বিকালবেলার আলো। এক ধ্যানী কণ্ঠ তখন গাইছে-

আমি বন্ধুবিহীন একা

আঁধার ঘরে বাহিরে বাদল ঝরে

ঝরঝর অবিরল ধারে…

এই গানের অর্থ বুঝি না। তার পরও মনের ভিতরটা কেমন করে। অচেনা অদ্ভুত এক অনুভূতি। শুধু বিনা খালার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করে, বিনা খালার হাত ধরে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। তার সঙ্গে চলে যেতে ইচ্ছা করে ফায়ার সার্ভিসের গাছপালা ঘেরা সবুজ মাঠে। পশ্চিমের পুকুর ধারে গিয়ে নির্জনে বসে থাকতে ইচ্ছা করে।

কলতলার ওদিকে কী করছেন খোকন মামারা?

মিন্টু মামা আর দাদা যথারীতি আছেন তাঁর দুপাশে। পানির হাউসটার পাড়ে দাঁড়িয়েছেন তিনজন। বেশ উত্তেজিত।

বিনা খালা বলল, চল তো, দেখি।

আমরা দুজন সামনে গেছি। দেখি গেরুয়া রঙের বড়সড় একটা টিকটিকি। পায়খানাঘর থেকে টিকটিকিটা ধরে এনেছেন খোকন মামা। হাউসের বিঘত পরিমাণ চওড়া দেয়ালে চিত হয়ে আছে অসহায় টিকটিকি। পেটের দিকটা এত স্বচ্ছ, ভিতরে সাদা ডিম দেখা যাচ্ছে।

খোকন মামার হাতে জংধরা ব্লেড। আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। ভারি উত্তেজিত।

ঘটনা আমরা বুঝতে পারছি না। মিন্টু মামার হাত ধরে নাড়া দিল বিনা খালা। টিকটিকি ধরছেন ক্যান?

মিন্টু মামা আমাদের দিকে তাকালেন না। বললেন, টিকটিকির পেট অপারেশন করুম।

কথাটা আমি বুঝতে পারলাম না। অপারেশন কী?

বিনা খালা বলল, টিকটিকির পেট কাটা হইবো।

ক্যান?

জবাব দিলেন খোকন মামা। পেটে ডিম দেখতাছো না? অপারেশন কইরা ডিম বাইর করুম। মিন্টু আর আজাদ ধরবো টিকটিকির পা। মিন্টু, তুই ধর সামনের পা, আজাদ, তুমি পিছনের পা।

বিনা খালা নাক কুঁচকে বলল, ছি!

তারপর আমার হাত ধরল। আমার ঘিন্না লাগতেছে। চল মিলু, যাই এখান থেকে।

উঠানের দিকে আসতে আসতে বলল, টিকটিকি কেউ হাত দিয়া ধরে? ময়লা জায়গায় থাকে। পোকামাকড় খায়। ছি!

আমরা লিচুতলার দিকে চলে এলাম। দশটা-সাড়ে দশটা বাজে। আকাশ আজ আর মেঘলা না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। একটু একটু হাওয়াও আছে। রোদে হাওয়ায় ঝিলমিল ঝিলমিল করছে পুকুরের পানি। কলের গানে শোনা গান আমি গুনগুন করছি। ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে।’

খানিক পর খোকন মামারা তিনজন এলেন লিচুতলায়। সঙ্গে দেখি সেন্টুও আছে। আমাদের দেখে বললেন, টিকটিকির পেট অপারেশন কইরা দুইটা ডিম বাইর করছি। ডিম দুইটা নরম।

বিনা খালা কথা বলল না। নিঃশব্দে নাক কুঁচকালো।

মিন্টু মামা বললেন, মিলু, যাইবা আমগো লগে?

কই?

আমরা সাধনার ওই দিকে যামু।

খোকন মামা বললেন, সাধনা না, আমরা যামু ধূপখোলা মাঠে। আজাদ, একটা কঞ্চি নাইলে একটা চটি লইয়া আসো। হাতে কিছু না থাকলে বান্দরে ধরতে পারে।

আনতাছি মামা।

দাদা দৌড়ে চলে গেল জামরুলতলার দিকে।

কোথাও যেতে আমার খুব উৎসাহ। বিনা খালার কথা ভুলে রওনা দিলাম ওদের সঙ্গে। সেন্টুকে নিয়ে পাঁচজনের দল। দাদার হাতে দু-আড়াই হাত লম্বা একটা কঞ্চি।

সাধনার ওদিকে এসে ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। কবরস্থানটা ভারি নির্জন। লম্বা লম্বা ঘাস আগাছা আর ঝোপঝাড়ে সবুজ হয়ে আছে। কদমগাছ বকুলগাছ আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কৃষ্ণচূড়া আর কাঁঠালচাপা গাছ আছে। কোনো কবরে চটি বাঁশের বেড়া, কোনোটায় দেয়াল তোলা। বহুকালের পুরনো দেয়াল ভেঙে পড়েছে কোনো কবরের। অচেনা সবুজলতা বেয়ে উঠেছে, আগাছা ঘিরে ধরেছে। এক কবরের ধারে কনকচাঁপা ফুটে আছে।

সাধনার বানরগুলো কি রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে?

ওইটুকু কঞ্চি দেখে কি সত্যি সত্যি ভয় পাবে?

যদি ভয় না পায়? যদি আমাদের দৌড়ানি দেয়? মুখ ভেংচে খামছি দিতে আসে?

না, রাস্তায় বানর নেই। শেডের ওপর বসে আছে। ছুটোছুটি করছে কোনো কোনোটা, মারামারি করছে। মায়ের বুকে ঝুলে দুধ খাচ্ছে বানরশিশু। বড় একটা বানর গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছে, তার পিঠে বসে আছে বাচ্চা বানর। এক বানর খুবই মনোযোগ দিয়ে উকুন মারছে আরেক বানরের। তাদের ক্যাচম্যাচ শব্দে মুখর হয়ে আছে শেডের চালা। জায়গাটা ভরে আছে আয়ুর্বেদী ওষুধের গন্ধে।

খোকন মামা বললেন, এত আস্তে হাঁটলে হইবো না। এইভাবে হাঁটলে ধূপখোলা মাঠ ঘুইরা আসতে অনেক সময় লাগবো। চল, দৌড়াই।

আমরা দৌড়াতে লাগলাম।

সাধনার গলি থেকে বেরোলে উত্তর-দক্ষিণে রাস্তা। দক্ষিণে গেণ্ডারিয়া স্কুলের দিক, উত্তরে সীমান্ত গ্রন্থাগারের মাঠ, মহিলা সমিতি তারপর ধূপখোলা মাঠ।

আমরা উত্তর দিকে দৌড়াতে লাগলাম।

সাধনার ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কেমন একটা গরম ভাব আসছে। সঙ্গে সেই মনোহর গন্ধ। রাস্তার পুব পাশে সাধনার দেয়াল, পশ্চিম পাশে পুরনো আমলের একতলা দালান বাড়ি। বাড়িভর্তি গাছ আর গাছ। আম নারকেল বেল তেঁতুল। জামগাছ কদমগাছ নিমগাছ বকুলগাছ। চাঁপা ফুলের গাছ, কামিনী গন্ধরাজ দেয়াল ছাড়িয়ে উঠেছে।

আমাদের কোনো দিকে তাকাবার সময় নেই। আমরা দৌড়াচ্ছি। সাধনার চকমকি বসানো দেয়ালের পাশে চওড়া গভীর ড্রেন। ড্রেনভরা খয়েরি রঙের পানি, ওষুধ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর শিকড়বাকড়ের যে ছোবড়া বেরোয়, সেই ছোবড়া। ড্রেন যেন ওষুধের ড্রেন। টুংটাং শব্দে ঘণ্টি বাজিয়ে যায় রিকশা। আমরা ড্রেনের পার ধরে দৌড়াচ্ছি। সেন্টু আমার আগে। কেউ কারো দিকে খেয়াল করছি না। দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে সেন্টুর একটা ধাক্কা লাগল। সে উপুড় হয়ে পড়ল ড্রেনে। আমি চিৎকার দিলাম। সেন্টু ড্রেনে পইড়া গেছে।

হায় হায়! সর্বনাশ!

খোকন মামা লাফ দিয়ে নামলেন ড্রেনে। মুহূর্তে তুলে ফেললেন সেন্টুকে। সেন্টুর শরীর মাখামাখি হয়ে আছে ড্রেনের পানি আর ছোবড়াছাবড়িতে। ওসব ছাপিয়ে নাক-মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কপালে রক্ত, গালে রক্ত।

আমরা দিশাহারা হয়ে গেলাম। কারো কোনো হুঁশ নেই। সেন্টুকে কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিলেন খোকন মামা। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন নানি। কী হইছে, অ্যাঁ, কী হইছে?

মা আম্মা মিনু খালা সবাই দিশাহারা। হায় হায়! এমুন হইল কেমনে?

সেন্টু গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। ভয়ে আতঙ্কে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে। আমার সঙ্গেই তো ধাক্কা লেগেছিল সেন্টুর!

বিনা খালা কই, মণি আর রানি খালা?

ওরা গিয়েছিল কিটি খালাদের বাসায়। খবর পেয়ে দৌড়ে এলো।

সেন্টুর ভিজা জামাকাপড় খুলে পরিষ্কার করা হয়েছে। কপাল মাথা, নাক মুখ ধোয়া হয়েছে। সেন্টুর ধবধবে ফর্সা হাতে-পায়েও জখম। কেটে ছিলে গেছে। কপালের এক জায়গায় কাটা, ফুলে লটকন ফলের মতন হয়েছে কপালের আরেকটা দিক। নাক দিয়ে তখনো রক্ত বেরোচ্ছে। কাটা ঠোঁট ফুলে গেছে অনেক। মুখের ভিতরও দেখি রক্ত দেখা যাচ্ছে। দাঁত ভেঙে গেছে নাকি!

অনু মামা বাড়িতেই ছিলেন। নানি চিৎকার করে বললেন, অনু, তাড়াতাড়ি ডাক্তার লইয়া আয়।

অনু মামার পরনে সাদা ময়লা পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি। তার ওপর শার্ট পরতে পরতে দৌড় দিলেন। কতটা সময় কেটেছে কে জানে, লোহারপুলের ওদিক থেকে ডাক্তার নিয়ে এলেন। হিন্দু ডাক্তার। পরনে ধুতি আর ঝুলপকেটঅলা শার্ট। তাঁর ডাক্তারি ব্যাগ অনু মামার হাতে।

গম্ভীর মুখে সেন্টুকে দেখছেন ডাক্তার। সে চোখ বুজে শুয়ে আছে। বাড়ির লোকজন সবাই ভিড় করে আছে খাটের সামনে।

প্রথমে সেন্টুর ব্যথা পাওয়া জায়গাগুলোয় আয়োডিন লাগালেন ডাক্তার। মাঝারি ধরনের একটা শিশি থেকে তুলায় আয়োডিন ভরিয়ে যখন কেটে-ছিলে যাওয়া জায়গাগুলোয় লাগাচ্ছিলেন, উঁ উঁ করে উঠছিল সেন্টু। একটা ইনজেকশনও দেওয়া হলো।

আমি শুকনা, ভয় পাওয়া মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। সাদা কাগজে খসখস করে ডাক্তারবাবু ওষুধের নাম লিখছেন। লেখা শেষ করে অনু মামার হাতে দিয়ে বললেন, দুইটা ট্যাবলেট আর একটা মলম দিলাম। ট্যাবলেট তিন বেলা খাওয়াইতে হইবো আর মলম লাগাইতে হইবো। জ্বর আসবো। তবে ভয়ের কিছু নাই। তিন দিনের মইধ্যে ভালো হইয়া যাইবো।

ডাক্তারবাবু ভিজিট নিলেন দু-টাকা। অনু মামা তাঁর সঙ্গে চলে গেলেন ওষুধ আনতে।

ততক্ষণে জ্বর এসে গেছে সেন্টুর। উঁ উঁ করে কাঁদছে আর বলছে, মিলু আমারে ধাক্কা দিছে। ধাক্কা দিয়া ড্রেনে ফালাইয়া দিছে। উঁ উঁ…

মা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকালো। আমার বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলে কোনো রকমে বললাম, আমি ধাক্কা দেই নাই। একলগে দৌড়াইতে ছিলাম…

খোকন মামা মিন্টু মামার অপরাধী মুখ। দাদা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বিনা খালা আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর তাকালো সেন্টুর মুখের দিকে।

আমি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাই। মায়ের কোলে মুকুল। মুকুলের দিকে তাঁর খেয়াল নেই। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তুই এত শয়তান হইছস? ধাক্কা দিছস ওরে? বাসায় যাইয়া লই, পিটাইয়া তর হাড্ডি ভাইঙ্গা ফালামু।

আমি আবার বলার চেষ্টা করি। আমি ধাক্কা দেই নাই…

কেউ আমার কথা পাত্তা দেয় না, বিশ্বাস করে না।

নানি বললেন, পোলাপানরে দোষ দিয়া লাভ নাই। সব দোষ খোকার। ও তো বড়, ও ক্যান অগো লইয়া সাধনায় গেছিল…

মা বললেন, ও কি আর বুজছে, এমুন হইবো!

আবার আমার দিকে তাকালেন মা। তোর আব্বারে আমি খবর দিতাছি। সে আসলেই তারে বলুম, কী করছস তুই!

আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলার চেষ্টা করলাম, খোকন মামারে জিজ্ঞাসা করেন মা, মিন্টু মামা আর দাদারে জিজ্ঞাসা করেন। আমি ইচ্ছা কইরা ধাক্কা দেই নাই…

খোকন মামা মিন্টু মামা বা আমার বড় ভাই, দাদা, কেউ আমার পক্ষ নেয় না। আমার চোখ ভরে আসে কান্নায়। একা একা লিচুতলায় চলে আসি। গাল বেয়ে নামে চোখের পানি। লিচুতলায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি। নাক টানি আর চোখ মুছি।

এ সময় পিছন থেকে এসে বিনা খালা আমার কাঁধে হাত দেয়। মুখ ফিরিয়েছি, দেখি বিনা খালা অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমার কান্না বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো গলায় বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলি না বিনা খালা, তোর কাছে আমি মিথ্যা কথা বলি না। ইচ্ছা কইরা সেন্টুরে আমি ধাক্কা দেই নাই। দৌড়াইতে দৌড়াইতে ধাক্কা লাইগা গেছে…

গভীর মায়াবী হাতে বিনা খালা আমার চোখ মুছিয়ে দিতে লাগল। ধীর শান্ত নরম আর মমতামাখা কণ্ঠে বলল, আমি তোর কথা বিশ্বাস করি। আমি জানি, তুই ইচ্ছা কইরা ধাক্কা দেস নাই। কান্দিস না, কান্দিস না…

সেই স্পর্শে কান্না থামে না আমার, আরো বাড়ে। দু-হাতে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বিনা খালা। পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, কান্দিস না, কান্দিস না…

আমি কাঁদতেই থাকি।

আজ আমরা ফিরে যাচ্ছি।

সতেরোটা দিন কাটল বিনা খালাদের বাড়িতে। কী মধুর দিন, কী আনন্দের দিন! গানে ভরা দিন, রোদ-বৃষ্টির দিন। পুকুর জলের দিন, লিচুপাতার দিন। রেলগাড়ি আর ফায়ার সার্ভিসের মাঠে ফেলে আসা দিন। নারকেলপাতায় হাওয়া খেলার দিন, কিটি খালাদের বাড়ির তারে শুকাতে দেওয়া জামাকাপড়ের দিন। কুঁড়েঘরের চালায় শেষ বিকালের দিন, জলাভূমির বেগুনি কচুরি ফুল আর অচেনা গাছের দিন। কলের গান আর হারমোনিয়ামের দিন। টুনু মামার আঁকা অসমাপ্ত ছবি আর জামরুলের বিবর্ণ ডালে বসা শালিক পাখির দিন। মেঘভাঙা রোদে আলোকিত হয়ে থাকা বিনা খালার মিষ্টি মায়াবী মুখের দিন। কত কী পিছনে ফেলে যাচ্ছি।

সকালের রোদে ঝকঝক করছে চারদিক। আমাদের সঙ্গে লিচুতলায় এসেছে বাড়ির সবাই। নানা আর টুনু মামা অফিসে চলে গেছেন। অনু মামা আছেন বাড়িতে। নানি আর মিনু খালা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছেন আমাদের। এত দিন একসঙ্গে থাকা দাদার জন্য মন খারাপ খোকন মামা মিন্টু মামার। মণির হাত ধরে আছে রানি খালা। তিন-চার দিনেই সেরে উঠেছে সেন্টু। জ্বর ছেড়ে গেছে, কপাল ফোলা নেই, কেটে-ছিলে যাওয়া জায়গা শুকাতে শুরু করেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে মিনু খালার পাশে। শুধু বিনা খালা দূরে দূরে। আমার দিকে একবার দুবার তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরাচ্ছে। তার ছলছলে চোখ আমি দেখতে পাই।

বিনা খালার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখও ছলছল করে।

এদিকটায় রিকশা আসতে চায় না। সাধনার ওদিকে গিয়ে রিকশা নিতে হবে। আমাদের হাতে পোঁটলাপাঁটলি, কাপড়ের ব্যাগ। আস্তে ধীরে হাঁটতে শুরু করি। বাড়ির লোকজন ভাঙা বেড়ার ওদিকটা পর্যন্ত আসে, খানিক দাঁড়িয়ে আমাদের চলে যাওয়া দেখে ফিরে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে শুধু বিনা খালা। কচুরি ফুলের মতো সাদা আর বেগুনির মিশেল দেওয়া ফ্রক পরা, কোঁকড়া চুল পিঠের ওপর, গালে এসে পড়েছে একগোছা চুল। সকালবেলার রোদে কী যে সুন্দর লাগছে তার মুখ!

আমি মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিনা খালাকে দেখি। চোখ বেয়ে কখন নেমেছে কান্না, টের পাইনি। বিনা খালাকে দেখি থেকে থেকে চোখ মোছে। আমার জন্য কাঁদে বিনা খালা, আমি কাঁদি তার জন্য। আবার কবে দেখা হবে বিনা খালার সঙ্গে, আবার কবে সে আমার হাত ধরবে! আবার কবে গান গেয়ে শোনাবে, ‘না পেয়ে তোমার দেখা একা একা দিন যে আমার কাটে না রে।’