মানুষ ও খাঁচার পাখি

untitled-5_131393

চোখ ফোটার পর দেখেছি ভাঙাচোরা একটা দালানবাড়ি। এই ধরনের বাড়িকে বলে পরিত্যক্ত বাড়ি। কেউ বাস করে
না। কতকালের পুরনো কে জানে! ছাদ দেয়াল ধসে গেছে, ইটগুলো আছে হাঁ করে। বট অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে
দেয়ালে কার্নিসে। কোনো কোনোটা বড়ও হয়েছে। জোরে হাওয়া দিলে ডালে পাতায় শন শন করে শব্দ হয়। বিশাল
বাড়িটির চারদিকে একসময় দেয়াল ছিল। এখন নেই। ঝোপ-জঙ্গল আর সবুজ ঘাসের মাঠ চারদিকে। শহরের
একেবারে শেষ প্রান্তের বাড়ি। বাড়ির পেছন দিকে গ্রাম এলাকা, গরিব মানুষের বাস। সেইসব মানুষ এই বাড়ির সামনে
দিয়ে শহরে যায়। মানুষের হাঁটাচলায় বাড়ির গা-ঘেঁষে পায়েচলা একটা পথ হয়েছে।
কার্নিসের গর্তে ছিল আমাদের বাসা। খড়কুটোর আরামদায়ক বাসা অনেক যত্নে বানিয়েছিল মা-বাবা। আমরা চার
ভাইবোন সেই বাসায় বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করতাম। তারা গেছে খাবারের খোঁজে। খাবার নিয়ে এলেই আমরা
ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করব, চিঁ চিঁ ডাকে পাগল করব মা-বাবাকে। অন্য সময় থাকি নিজেদের নিয়ে। এ ওর সঙ্গে খুনসুটি
করছি, ঠোকরাঠুকরি করছি।
এই করতে গিয়ে একদিন বাসা থেকে পড়ে গেলাম। তেমন করে পালক গজায়নি, উড়তে শেখা তো দূরের কথা! ভাগ্য
ভাল শক্ত কোথাও পড়িনি। পড়েছি ওই পায়েচলা পথের ধারে, আগাছার ঝোপে। ব্যথা পাইনি, কিন্তু ভাইবোন থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম, মা বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এই দুঃখে চিঁ চিঁ করে কাঁদছি, এদিক-ওদিক যাওয়ার চেষ্টা
করছি, একটি মেয়ে এসে দু’হাতের তালু এক করে আমাকে তুলল। অতি মমতায় বুকের কাছে ধরে একটা বাড়িতে নিয়ে
এল। বাড়িটা শহরে ঢোকার মুখে। নিচতলার ফ্ল্যাটে থাকে মতিন সাহেবের পরিবার। মতিন সাহেবের একটি মাত্র
মেয়ে। নাম মীম। যে মেয়েটি আমাকে তুলে আনল তার নাম রোজিনা। সে এই ফ্ল্যাটে কাজ করে। সকালবেলা কাজে
এসে সন্ধ্যাবেলা ফিরে যায়। মীমের মা একটু মোটা। মোটা মানুষ অলস হয়। তিনিও অলস। সংসারের কাজ তেমন
করেন না। সব করে রোজিনা।
আমাকে নিয়ে রোজিনা যখন ফ্ল্যাটে ঢুকছে, মতিন সাহেব মর্নিংওয়াক সেরে ফিরলেন। রোজিনার হাতে আমাকে দেখে
খুশি হলেন। ‘আরে, শালিকছানা দেখছি! কোথায় পেলি?’
ঘটনা বলল রোজিনা। শুনে তিনি বললেন, ‘নিয়ে এসে ভাল করেছিস। ওখানে পড়ে থাকলে ইঁদুর-বেড়ালে খেত, কাকে
খেত। এটা ভাতশালিকের ছানা। ভাতশালিক পোষ মানে।’
মতিন সাহেবকে ‘খালু’ ডাকে রোজিনা। সে বলল, ‘কিন্তু শালিকছানা কোথায় রাখব, খালু? একটা খাঁচা দরকার।’
‘অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসব।’
ততক্ষণে মীম আমাকে দেখে ফেলেছে। পাখিরছানা দেখলে মানুষ খুশি হয়। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা। মীম ক্লাস
সেভেনে পড়ে। তেরো বছরের মেয়ে। আমাকে দেখে খুব খুশি। ডাকাডাকি করে মাকে আনল। তিনি গম্ভীর ধরনের মানুষ। আমাকে দেখে খুশি হলেন না বেজার, বোঝা গেল না। এক পলক দেখে নিজের রুমে ঢুকে গেলেন। মীম একটা পুরনো খবরের কাগজ এনে ভাঁজ করে রাখল বারান্দার কোণে। তার ওপর আমাকে বসিয়ে দিল রোজিনা।
বিকেল পর্যন্ত জড়সড় হয়ে সেখানটায় বসে রইলাম। রোজিনা আর মীম কিছুক্ষণ পর পর এসে দেখে যাচ্ছিল।
পাউরুটির টুকরো, সামান্য একটু ভাত ছোট্ট একটা বাটিতে করে রেখে দিয়েছিল সামনে। আমি তখনও ঠুকরে খেতে
শিখিনি। খিদে পেয়েছে খুব। একদিকে ভাইবোন আর মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে খিদের কষ্ট, দুই কষ্টে
চিঁ চিঁ করে কাঁদছিলাম। মীম বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে একহাতে নরম করে ধরল আমাকে। অন্য হাতে ঠোঁট ফাঁক করে একটু একটু করে ভাত ঢুকিয়ে দিল মুখে। প্রথম দুয়েকবার সমস্যা হলো, তারপর ঠিকই গিলে ফেললাম। কয়েকবার খেতেই
পেট ভরে গেল। আর গিলছি না দেখে মীম বুঝে গেল, এখন আর ভাত খাব না, এখন খাব পানি। একই কায়দায় সে
আমাকে কয়েক ফোঁটা পানি খাওয়াল।
শেষ বিকেলে মাঝারি সাইজের একটা খাঁচা নিয়ে এলেন মতিন সাহেব। চিকন তার দিয়ে তৈরি সুন্দর খাঁচা। খাঁচায় সামান্য খড়নাড়া ঢোকাল মীম। তারপর ঢোকাল আমাকে। খড়নাড়া পেয়ে আমার প্রথমে মনে হলো, বুঝি নিজেদের বাসায় ফিরেছি। এই তো এখনই পাব ভাইবোনকে, মা-বাবাকে। ভুল ভাঙতে দেরি হলো না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে চিঁ
চিঁ করে কাঁদতে লাগলাম।
শুরু হলো আমার খাঁচার জীবন।
মীমদের বাড়িতে ছিলাম সাত মাস। প্রথম কয়েকটা দিন কষ্টে কাটল। মা-বাবা, ভাইবোনের কথা খুব মনে হতো। খুব কাঁদতাম তাদের জন্য। খাঁচার জীবনটা তখনও খারাপ লাগেনি। কারণ আমাদের বাসাও তো ছিল খাঁচার মতোই।
পার্থক্য এটুকুই, ওখানে মা-বাবা, ভাইবোন ছিল, এখানে আমি একা। একা থাকার কষ্টটাই বড়। দিনটা কাটত ভালই,
খারাপ লাগত রাতে। অন্ধকার বারান্দায় খাঁচার এক কোণে বসে মনে হতো এ কোন পৃথিবীতে চলে এসেছি! তার পরও
চুপচাপ বসে ঝিমাতাম। দিনের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনটা ভাল হয়ে যেত। মীমদের বাড়ির বারান্দা ছাড়িয়ে
এক টুকরো খোলা উঠোন। ভোর হতে না হতেই রোদের সঙ্গে সেই উঠোনে আসত কাক-চড়ূই আর শালিকপাখি।
শালিকগুলো ভাতশালিক। উঠোনে এসে খাবার খুঁজত। শালিকগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি আমার মা-বাবাকে খুঁজতাম,
চিঁ চিঁ করে ডাকতাম। কাক-চড়ূই আমার দিকে ফিরেও তাকাত না, শালিকগুলো তাকাত। নিজেদের ভাষায় কথা বলত। ‘আহা, কোন মা-বাবার বুক খালি করে খাঁচায় এসে ঢুকেছে।’ আমি আকুল হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
এই করে করে দিন কাটছিল। ততদিনে শরীর বদলেছে। পালকে পালকে ভরে গেছি। ডানা শক্ত হয়েছে। ডাকতে শিখেছি, ঠুকরে খেতে শিখেছি। রোজিনাকে খুব ভাল চিনতে পারি, মীমকে চিনতে পারি। মতিন সাহেব আর তাঁর
স্ত্রীকেও চিনি। কিন্তু তাঁদের জন্য আমার কোনো টান নেই। রোজিনা আর মীম খেতে দেয়, এজন্য তাদের প্রতি টান।
আমি যেমন বদলেছি খাঁচার ভেতরটাও তেমন বদলেছে তখন। খড়নাড়া সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোট্ট এলুমিনিয়ামের বাটিতে থাকে খাবার, মাটির খোঁড়ায় থাকে পানি। একদিন পানি খেতে গিয়ে খোঁড়ায় নেমে গেলাম। নেমে দেখি, আহ,
কী আরাম! কেউ শেখায়নি, তবু ডানা ঝাঁপটে, শরীর ডুবিয়ে গোসল করলাম। আরে, এ তো এক নতুন আনন্দ! গোসল
করার পর শরীর খুবই সতেজ লাগে!
আমাকে গোসল করতে দেখে মীম আর রোজিনা খুব খুশি। আমি তখন তাদের হাত থেকেও খাই। খাঁচার ফাঁকে রুটির
টুকরো, একটুখানি কলা, বিস্কুট, ওরা ধরে, আমি ঠুকরে খেয়ে নিই। ওদের হাতে খাবার দেখলেই ছটফট করি, খাবারের জন্য ছুটোছুটি করি, খাবার পেলে খুব মজা লাগে।
একরাতে ভয় পেলাম, খুব ভয় পেলাম। সেদিন প্রায় সারারাত বিদ্যুৎ ছিল না। গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক।
রাত কত হয়েছে কে জানে! কোথাও কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ দেখি মার্বেলের মতো নীল দুটো আলো এগিয়ে আসছে।
প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কী! তারপরই দেখি আলো দুটো খাঁচার একেবারে কাছে এসে পড়েছে। খাঁচাটা রাখা আছে ভাঙা একটা চেয়ারের ওপর। আলো দুটো লাফিয়ে উঠল চেয়ারে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, এ এক ভয়ঙ্কর হুলো। রাতের অন্ধকারে আমাকে ছিঁড়ে খেতে এসেছে। ডানা ঝাঁপটে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলাম। না, হুলো তো নড়ে না! খাঁচার দরজা খোলার চেষ্টা করছে! কী হবে এখন! যদি দরজা খুলে ফেলে? যদি আমাকে ধরে ফেলে?
অন্ধকার খাঁচায় ছুটোছুটি করতে লাগলাম, ডানা ঝাঁপটাতে লাগলাম। সঙ্গে ত্রাহী ডাক। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বেরিয়ে এল মীম। তার হাতে মোবাইল। মোবাইলের আলোয় খাঁচার কাছে এল। তাকে দেখেই এক লাফে উধাও হয়ে গেল হুলো।
তখনও ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। আমার অবস্থা বুঝল মীম। খাঁচাটা সে পেছন দিককার বারান্দায় নিয়ে এল। এই বারান্দা নেট দেওয়া। বেড়াল ঢুকতে পারবে না।
তারপর থেকে রাতেরবেলা আমাকে রাখা হয় পেছন দিককার বারান্দায়, দিনেরবেলা সামনের বারান্দায়। দিনেরবেলা খাঁচায় বসে আমি তাকিয়ে থাকি উঠোনের দিকে। কাক-চড়ুই দেখি না, দেখি শুধু শালিকপাখি। কত শালিক আসে
বাড়িতে! এদের মধ্যে কি আছে আমার মা-বাবা, ভাইবোন? থাকলেও তাদেরকে আমি চিনতে পারি না, তারা চিনতে
পারে না আমাকে। এখন আর আমাকে নিয়ে কথাও বলে না তারা। আমাকে নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। খাঁচার পাখির কথা কেন ভাববে মুক্ত পাখিরা!
তখন থেকেই দুঃখটা আমার শুরু হয়েছে। খাঁচায় বসে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি উঠোনের শালিকগুলো তাদের ইচ্ছে মতো উড়ে আসছে, উড়ে যাচ্ছে। তাদের আছে খোলা আকাশ, গাছপালা, খোলা মাঠ আর মানুষের ঘরবাড়ি।
যখন যেদিকে ইচ্ছে উড়াল দিতে পারছে। তাদের পৃথিবী বিশাল, আমার পৃথিবী ছোট্ট এক খাঁচা। আহা, যদি ওদের মতো মুক্ত জীবন হতো আমার!
আশ্চর্য কা , কয়েকদিনের মধ্যেই মুক্ত জীবন আমি পেয়ে গেলাম।
মতিন সাহেবের চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে। এই ফ্ল্যাট ছেড়ে শহরের অন্য এলাকায় ভাল ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছেন তিনি।
বাড়ি বদলের কাজ চলছে। আসবাবপত্র নেওয়া শুরু হয়েছে। রোজিনার মন খুব খারাপ। এতদিনের কাজ ছুটে গেল।
তবু আসবাবপত্র গুছগাছ করে দিচ্ছিল। বাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। আমার দিকে মন নেই কারও। বেলা হয়েছে তবু খাবার দেয়নি। আমি ডাকাডাকি করছিলাম। কাজের ফাঁকে ব্যাপারটা খেয়াল করল রোজিনা। একমুঠো চাল এনে খুবই আনমনা ভঙ্গিতে খাঁচার দরজা খুলে বাটিতে রাখল, রেখে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেল। কিছু না বুঝেই আমি দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। গেটের বাইরে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, লোকজন আসবাবপত্র তুলছে। মীম মোবাইলে কথা বলছে। কেউ আমাকে খেয়ালই করল না।
বাইরে বেরিয়েই উড়াল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। দেখি শুধু লাফ দিয়ে কিছুটা এগোতে পারি, উড়াল দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ডানা আড়ষ্ট, শরীর আড়ষ্ট। তারপরও মুক্ত জীবন পেয়েছি, আমার আনন্দ দেখে কে! লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তার দিকে চলে এলাম। একবার একটা গাছের ডালে চড়লাম, বাড়ির দেয়ালে চড়লাম, বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ। মুক্ত স্বাধীন পাখির মতো জীবন পেয়ে গেছি, শুধু উড়তে পারছি না, এই যা। তার পরও ওড়ার অনেক চেষ্টা করলাম, কাজ হলো না। দুপুর হয়ে গেছে। খিদে পেয়েছে খুব। কী করব এখন! খাবার পাব কোথায়!
রাস্তার দিককার দেয়ালে বসে এসব ভাবছি, দেখি ওপাশে একটা চায়ের দোকান। কয়েকজন লোক বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছে, পাউরুটি খাচ্ছে। দেয়াল থেকে নেমে সেদিকটায় গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, কেউ আমাকে খেয়ালই করছে না।
যে বেঞ্চে বসে লোকগুলো চা খাচ্ছিল সেই বেঞ্চের তলায় এসে ঢুকলাম। এক লোকের কালো দুটো পা আমার সামনে।
তার পায়ের কাছে দেখি বিস্কুটের টুকরোটাকরা পড়ে আছে। ঠোকর দিতে গিয়ে লোকটার পায়ে ঠোকর দিয়ে ফেললাম।
লোকটা চমকে বেঞ্চের তলায় তাকাল, আমাকে দেখে ফেলল। দেখে কী বুঝল কে জানে, একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, আমি লাফ দিয়ে তার হাতে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝে গেল, আমি পোষাপাখি।
লোকটার নাম জাহাঙ্গীর। রোজিনার কায়দায় সেও আমাকে নিয়ে এল একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে। মতিন সাহেবের ফ্ল্যাটের চেয়ে এই ফ্ল্যাট অনেক দামি, অনেক ভাল। শহরের খুবই নামকরা এলাকায়। এলাকাটা বড় লোকদের। ফ্ল্যাট হচ্ছে
হক সাহেব নামের এক ভদ্রলোকের। তিনি বড় চাকরি করেন। অফিসের কাছেই ফ্ল্যাট। কিন্তু এই ফ্ল্যাট তাঁর নিজের না, অফিসের। তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাট অন্য এলাকায়। যানজটের কারণে সেখান থেকে আসা-যাওয়ার অসুবিধা বলে অফিস থেকে এই ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। শনি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চলে যান নিজের ফ্ল্যাটে। সেখানে তাঁর স্ত্রী, ছোট মেয়ে আর চার বছরের ছেলেটি আছে। বড় মেয়ে থাকে আমেরিকায়।
শুক্রবার ছুটির দিন। বৃহস্পতিবার রাত, শুক্রবার পুরো দিন পুরো রাত স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কাটিয়ে শনিবার সকালে তিনি অফিসে চলে আসেন। জাহাঙ্গীর লোকটা হচ্ছে তাঁর কেয়ারটেকার। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কাজই করে। হক সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি, জাহাঙ্গীরের চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। তার বউ-বাচ্ছা গ্রামে থাকে।
আমাকে বুকের কাছে ধরে রেখেই ফ্ল্যাটের লক খুলল জাহাঙ্গীর। স্টোররুমে গিয়ে ভাঙাচোরা ছোট্ট একটা খাঁচা বের করল। কেন খাঁচাটা এ রকম এক ফ্ল্যাটের স্টোররুমে পড়ে আছে, কে জানে! জাহাঙ্গীর বোধহয় কোনো কারণে এনে রেখেছিল। আমার জায়গা হল সেই খাঁচায়।
খাঁচায় ঢুকে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি তো এখন আগের সেই শালিকছানাটি নেই। বড় হয়েছি, পুরোপুরি শালিকপাখি। এইটুকু খাঁচায় জায়গা হয় কেমন করে! এ হয়তো একটা চড়ূইপাখির জন্য ঠিক আছে! এই খাঁচায় আমি তো ঠিকমতো নড়াচড়াই করতে পারছি না!
একদিকে খাঁচা নিয়ে অস্বস্তি, অন্যদিকে খিদেও পেয়েছে। জাহাঙ্গীর ঠিক তখনই একটা ছোট্ট বাটিতে আমাকে একটু
ভাত দিল। আমি ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলাম। জাহাঙ্গীর তীক্ষষ্ট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে।
সেদিন বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যাবেলা ফ্ল্যাটে এলেন হক সাহেব। টুকটাক জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে নিজের ফ্ল্যাটে রওনা দেবেন। জাহাঙ্গীর খাঁচাটা রেখেছিল বারান্দায়। কী কাজে এদিকে এসেছেন হক সাহেব, আমাকে দেখে ফেললেন।
দেখে একটু চমকালেন। গম্ভীর গলায় জাহাঙ্গীরকে ডাকলেন।
‘জাহাঙ্গীর’।
জাহাঙ্গীর ছুটে এল। ‘জি স্যার।’
‘পাখি পেলে কোথায়?’
ঘটনা বলল জাহাঙ্গীর। শুনে তিনি খুশি। ‘তার মানে এটা পোষাশালিক?’
জাহাঙ্গীর কেলিয়ে হাসল। ‘জি স্যার।’
‘কিন্তু এইটুকু খাঁচায় এই পাখি থাকবে কী করে?’
এবারও হাসল জাহাঙ্গীর। ‘তাই তো স্যার।’
আগে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝলাম কথায় কথায় হাসার অভ্যাস জাহাঙ্গীরের। এই ধরনের মানুষরা ভাল হয়।
দেড় দিনের মধ্যে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
পরদিন ভোরবেলা, আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার স্বভাব মতো ডাকতে লাগলাম। ঘুম চোখে উঠে এল জাহাঙ্গীর। আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। ‘কী রে, কী হইছে? চিল্লাচিলি্ল লাগাইছস ক্যান?’
আমি ডাক বন্ধ করে তার দিকে তাকাই।
‘বুজছি, খিদা লাগছে। খাড়া, খাওন দিতাছি।’
নিজের জন্য রুটি বানাবে জাহাঙ্গীর, একদলা আটা এনে আমাকে দিল। আমি ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলাম। কিন্তু এই
খাঁচায় আমি নড়তে-চড়তে পারি না, ভারি অসুবিধা। এ রকম অসুবিধা নিয়ে বাঁচা যায়! এই খাঁচায় তো পানির খোঁড়াও
রাখা যাবে না! গোসল করব কীভাবে!
এসব সমস্যা পরদিন মিটে গেল।
সকাল এগারোটার দিকে প্রথমে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন হক সাহেব, তাঁর পেছন পেছন ঢুকল ড্রাইভার ফরিদ। ফরিদের হাতে
বড় একটা খাঁচা। নতুন ঝকঝকে খাঁচাটি সাদা রং করা। ভেতরে পাখি বসার সুন্দর ব্যবস্থা। প্লাস্টিকের দুটো বাটি রাখা
আছে দরজার দু’পাশে, কোনার দিকে। ওগুলোর একটায় থাকবে খাবার, অন্যটায় পানি। মাটির বড়সড় একটা খোঁড়া
আছে। ওতে থাকবে গোসলের পানি। খাঁচার তলায় আকাশি রঙের প্লাস্টিকের ট্রে। খাবারের টুকরোটাকরা, আমার
বিষ্ঠা ইত্যাদি পড়বে ওই ট্রেতে। খুলে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। খুলে ধুয়ে ফেললেই সব পরিষ্কার।
দারুণ ব্যাপার।
হক সাহেব বললেন, ‘জাহাঙ্গীর, এই খাঁচায় থাকবে পাখি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো দিও। পাখির যেন অযত্ন না হয়।’
জাহাঙ্গীরের সেই কেলানো হাসি। ‘না স্যার, হবে না।’
খেয়াল করলাম, আমার সঙ্গে এক ভাষায় কথা বলে জাহাঙ্গীর, হক সাহেবের সঙ্গে বলে আরেক ভাষায়। অর্থাৎ,
মালিকের সঙ্গে শুদ্ধভাষা, পাখির সঙ্গে অশুদ্ধ।
সেদিনই নতুন খাঁচায় ঢুকে গেলাম। খেয়ে, গোসল সেরে গাছের ডালার মতো স্টিকটায় বসে রইলাম। ভারি আরামদায়ক একটা জীবন হল। জাহাঙ্গীর খুবই যত্ন নেয়। সকালবেলা একদলা নরম আটা রেখে দেয় বাটিতে, আমি পেটপুরে খাই। কখনও কখনও আটারদলা হাতে রেখে এক চিমটি করে খাঁচার ফাঁকে ধরে, আমি ঠোকর দিয়ে খেয়ে নিই। এগারোটার দিকে ভাত দেয়। ভাত খেয়ে খোঁড়ায় নেমে গোসল করি। সব সেরে স্টিকে বসে গাছপালার দিকে
তাকিয়ে থাকি, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
এই এলাকায় অনেক গাছপালা। গাছপালা বেশি থাকলে পাখিও বেশি আসে। মীমদের বাড়িতে শুধু কাক-চড়ূই আর শালিক দেখেছি, এখানে দেখেছি অনেক রকম পাখি। জালালি কবুতর দেখলাম একদিন, চার পাঁচটা বুলবুলি এসে বেশ আমোদ করল বারান্দার রেলিংয়ে। এক দুপুরে শুনি ঘুঘু ডাকছে। পাখির ওড়াউড়ি দেখলে, তাদের মুক্ত স্বাধীন জীবন দেখলেই খাঁচার জীবনটার কথা মনে হয় আমার। চারদিকে কত মুক্তপাখি, কত স্বাধীন তাদের জীবন। আমার জীবন পরাধীন, বন্দিজীবন। স্বাধীন জীবনেও কষ্ট যন্ত্রণা আছে, পরিশ্রম আছে। খাবারের জন্য দিনভর ছুটোছুটি, মাটিতে শত্রু আছে বেড়াল, আকাশে আছে চিল দাঁড়কাক। ঝড়-বৃষ্টি আছে, শীত-কুয়াশা আছে। প্রকৃতির হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার যুদ্ধ করতে হয়, শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবার যুদ্ধ করতে হয়। তারপরও স্বাধীন জীবনের তুলনা হয় না। আমার মতো খাঁচার পাখিই কেবল বুঝতে পারে মুক্ত-স্বাধীন জীবন কত মূল্যবান। খাঁচার জীবন যত আরামেরই হোক, এ জীবন অর্থহীন। জেলে থাকার মতো, পরাধীন থাকার মতো।
জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বেশিদিন থাকা হল না। হক সাহেবের ছেলেটির নাম প্রাপ্য। এক শুক্রবার দুপুরের পর সে তার বোনের সঙ্গে এই ফ্ল্যাটে এল। প্রাপ্যকে সারাক্ষণ আগলে রাখে রুবিনা নামের একটি মেয়ে। সেও আছে সঙ্গে। আর হক সাহেব তো আছেনই। প্রাপ্যর মা দেশে নেই। তিনি আমেরিকায় গেছেন বড় মেয়ের কাছে। ফিরবেন মাসখানেক পর। মা কাছে নেই বলে ছেলের দিকে বেশি নজর হক সাহেবের। আগের তুলনায় ছেলেকে অনেক সময় দিচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়ের নাম লেখা। লেখা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। সেও সময় দিচ্ছে ভাইকে। ছুটির দিন বলে এই ফ্ল্যাটে এসেছে বেড়াতে।
আমাকে দেখে প্রাপ্যর আনন্দ আর ধরে না। ঘুরে ফিরে খাঁচার কাছে আসে আর আমাকে ডাকে। ‘হ্যালো পাখি।’
এত মিষ্টি করে হাসে প্রাপ্য, খুব ভাল লাগল ছেলেটিকে। সারাটা বিকেল আমার সঙ্গে কাটাল সে। ফিরে যাওয়ার সময়
বাবাকে বলল, ‘পাখি নিয়ে যাব।’
হক সাহেব বিব্রত। ‘এই পাখি নেওয়া যাবে না, বাবা।’
‘কেন?’
‘পাখিটা আমাদের না।’
‘কার পাখি?’
‘জাহাঙ্গীরের।’
প্রাপ্য খুব বুদ্ধিমান। জাহাঙ্গীরকে বলল, ‘তোমার পাখিটা আমাকে দেবে?’
একদিকে মালিকের ছেলে, আরেকদিকে অত মিষ্টি করে বলা, প্রাপ্যর কথা ফেলতে পারল না জাহাঙ্গীর। হাসিমুখে বলল, ‘হ্যাঁ দেব।’
‘পাখিটা আমি নিয়ে যাই?’
আদর করে প্রাপ্যকে সে আপনি করে বলল, ‘হ্যাঁ নিয়ে যান।’
হক সাহেব এবং লেখা দু’জনেই প্রাপ্যকে বোঝাল, ‘অন্যের পাখি নিতে হয় না। তোমাকে আমরা আরও ভাল পাখি
কিনে দেব।’ প্রাপ্য কিছু বুঝলই না। পাখি না নিয়ে সে যাবে না।
কী আর করা! খাঁচাটা গাড়িতে তুলে দিল জাহাঙ্গীর। ততদিনে তার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক হয়েছে। জাহাঙ্গীরের
মন তো খারাপই, আমার মনটাও খারাপ হল। জাহাঙ্গীরের জীবনও তো পরাধীন জীবন। মালিকের মুখ চেয়ে সব
করতে হয়। আমার জীবন লোহার খাঁচার, জাহাঙ্গীরের জীবন অন্যরকম এক খাঁচার। পৃথিবী ভর্তি শুধু খাঁচা। এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায় ঢোকার নামই হয়তো জীবন।
হক সাহেবের এই ফ্ল্যাট চারতলায়। বেশ বড়, বেশ দামি ফ্ল্যাট। এত সুন্দর করে সাজানো, তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পাঁচজন কাজের লোক আছে। একেকজনের একেক কাজ। রুবিনা আর মিতু আছে প্রাপ্যর সঙ্গে। জুলেখার মা করে
রান্নাবান্নার কাজ। রাজুর মা আছে ধোয়ামোছার কাজে। একটু কম কাজ মাবিয়ার। সে বাথরুম পরিষ্কার করে,
বারান্দায় রাখা গাছের টবে পানি দেয়।
আমার দায়িত্ব পড়ল মাবিয়ার ওপর। জাহাঙ্গীর তাকে মোবাইলে বলে দিয়েছে কখন কীভাবে খাবার দিতে হবে, ট্রে
পরিষ্কার করতে হবে। পানির খোঁড়ায় কতটা পানি দিতে হবে, গোসলের পর পানি বদলে ফেলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাবিয়া সেভাবেই সব করছে।
এই ফ্ল্যাটেও আমার থাকার জায়গা হল বারান্দায়। বারান্দার ওপাশে গাছপালা ঘেরা পুরনো একটা দোতলা বাড়ি।
বাড়ির ভেতর, বারান্দা সব আমাদের বারান্দা থেকে দেখা যায়। লোকজন তেমন নেই বাড়িটায়। একটা অল্পবয়সী বউকে দেখি মাঝে মাঝে বারান্দায় আসে, উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বউটি গর্ভবতী। তার হাঁটাচলা ধীর, মুখে এক ধরনের বিষণ্নতা। এখন শরৎকাল। শরতের নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে সে কী ভাবে, কে জানে!
প্রথম দিনই প্রাপ্যকে আমার খুব ভাল লেগেছিল। এই বাড়িতে এসে আরও ভাল লাগল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে আমার কাছে ছুটে আসে। হাসিমুখে মিষ্টি করে বলে, ‘হ্যালো পাখি।’ স্কুলে যাওয়ার সময় একবার ‘হ্যালো’ করে যায়, ফিরে এসে করে। প্রাপ্যর জন্য কী রকম একটা টান তৈরি হয়েছে আমার। সে ‘হ্যালো’ করলে আমিও আমার ভাষায় করি।
মাঝে মাঝে প্রাপ্য বলে ‘হ্যালো পাখি, কেমন আছ?’
আমি মন খারাপ গলায় বলি, ‘ভাল না। খাঁচার জীবন কোনো জীবন? ভাল থাকি কী করে?’
খাওয়া গোসল ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। এইটুকু সেরে স্টিকে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আর নিজের কথা ভাবি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, হু হু করে বয় হাওয়া, ফুলের গন্ধ আসে। বৃষ্টি হাওয়া আর ফুলের গন্ধে কেন যে মনটা খারাপ হয়!
কয়েকদিন পর হক সাহেবের স্ত্রী ফিরলেন। সি্নগ্ধ সুন্দর মহিলা। আমার কথা আমেরিকায় বসেই শুনেছিলেন। প্রাপ্য
ফোনে বলেছে। বারান্দায় এসে আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘সংসারে নতুন অতিথি।’
স্ত্রীর ফেরা উপলক্ষে তিনদিনের ছুটি নিয়েছেন হক সাহেব। দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে আরও তিনদিন, মোট পাঁচদিন
বাড়িতে থাকবেন। হক সাহেবের প্রিয় জায়গা দক্ষিণের এই বারান্দা। শেষ বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেন। দুটো হালকা ধরনের চেয়ারের মাঝখানে টিটেবিল। সেখানে গ্রিনটির মগ। দু’জনে চা খান আর গল্প করেন। অদূরে খাঁচায়
বসে আমি তাঁদের কথা শুনি।
এক বিকেলে পাশের বাড়ির বউটি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। চোখ আকাশের দিকে। চায়ে চুমুক দিয়ে হক সাহেব তার
দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাকালেন আমার দিকে। স্ত্রীকে বললেন, ‘পাখিদের সঙ্গে মানুষের অনেক মিল,
জানো!’
ভদ্রমহিলা অবাক। ‘কী রকম?’
‘ওই বউটিকে দেখে আর খাঁচার পাখিটা দেখে ক’দিন ধরেই কথাটা মনে হয়। আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে।
গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে একটা তালগাছ ছিল। সেই গাছে বছরভর ঝুলতো বাবুইপাখির বাসা। মেয়েরা গর্ভধারণ করলে তাদের শরীর ধীরে ধীরে বাবুইপাখির বাসার মতো হয়ে ওঠে। বাসা থেকে একদিন যেমন করে বেরিয়ে আসে
বাবুইছানা, মানুষের জন্মও যেন তেমন।’
স্ত্রী উচ্ছ্বসিত হলেন। ‘বাবুইপাখির বাসা আমিও দেখেছি। ঠিকই বলেছ। গর্ভবতী মেয়েদের শরীর বাবুইপাখির বাসার মতো।’
‘আরেকটা কথাও মনে হয়। মানুষও এক ধরনের খাঁচার পাখি। মায়ের গর্ভ একখাঁচা, জন্মের পর ঘর একখাঁচা, বাড়ি
খাঁচা, সমাজ খাঁচা, দেশ কিংবা পৃথিবী খাঁচা। মানুষ এই খাঁচায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যেমন আমাদের ওই পাখিটা। মৃত্যু ছাড়া মানুষের আসলে স্বাধীনতা নেই, খাঁচা থেকে মুক্তির পথ নেই।’
স্ত্রী হাসলেন। ‘বিরাট দার্শনিক তত্ত্ব দিচ্ছ। ঘটনা কী?’
হক সাহেব উদাস ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিলেন। ‘কোনো ঘটনা নেই। এই বয়সে মৃত্যুচিন্তা আসে। নিজের অজান্তে আমি
হয়তো জীবনমৃত্যু নিয়ে ভাবছি বলে এসব মনে হল।’
তারপর ছেলেমেয়ে সংসার ইত্যাদির কথায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন তাঁরা। আমার তখন বারবার মনে হচ্ছে, ঠিকই বলেছেন হক সাহেব। মানুষের সঙ্গে আসলেই পাখিদের খুব মিল। আমার মায়ের গর্ভও ছিল এক খাঁচা। যে ডিমের ভেতর ছিলাম, ডিমটা খাঁচা, যে বাসায় জন্মালাম, বাসাটা খাঁচা। নিয়তি আমাকে ছোট্ট এক খাঁচায় পুরে দিয়েছে কিন্তু মুক্তপাখিদের জীবনও আসলে খাঁচারই জীবন। নিজের চারপাশের বৃত্তই খাঁচা। মুক্তপাখিদের খাঁচা বিশাল, আমারটা ছোট, ব্যবধান এটুকুই। না না আর একটা ব্যবধানও আছে, তাদের মতো সংসার বাচ্ছাকাচ্ছা হল না আমার। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তাদের মতো না। না হোক, সবার কি সবকিছু হয়! এই খাঁচার জীবনে আমি আমার মতো এক আনন্দ
তৈরি করে নিলেই পারি। চারদিকে আনন্দের কত উপকরণ! দিনের আলো, রাতের অন্ধকার কিংবা জ্যোৎস্না, ভেসে
যাওয়া মেঘ, ঝরঝর বৃষ্টি, গাছের পাতায় হাওয়ার খেলা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি আর মানুষ, পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা গান ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ পেয়ে যাই, বেঁচে থাকার আনন্দ আমি পেয়ে যাই। সকালবেলা প্রাপ্য এসে বলে, ‘হ্যালো পাখি, কেমন আছ?’
আমি উচ্ছল গলায় বলি, ‘ভাল আছি। খুব ভাল।’