হুমায়ূন বিহীন আমরা

humayun ahmedশুরু হয়েছে শ্রাবণ মাস। অনেকেই বলে বৃষ্টিভেজা শ্রাবণ। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শ্রাবণকে খুব পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন বৃষ্টিকেও। তার কথাসাহিত্য ও নাটকে এর প্রতিফলন আমরা দেখি। অথচ গত বছর শ্রাবণ আসতে না আসতেই এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ বিহীন এক বছর কেটে গেল। সময় কত দ্রুত চলে যায়। হুমায়ূন আহমেদ মানেই প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা, অনুরাগ, মায়া-মমতা, ভক্তি শ্রদ্ধা, সমীহ, সম্ভ্রম আর বিহ্বলতা, বুকভাঙ্গা হাহাকার, রোদন মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুরের ঝকঝকে আলোর বিচ্ছুরণ। অনেকটা কোনো এক ঝড়ের ভুল ঝরিয়ে দিল ফুল/প্রথম প্রেম বিতরণ মাধুরী ফেলেছিল। এ মুকুল হায়রে।
হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তি কথাটাকে ছাপিয়ে অনেক অনেক দূর অবধি ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমন অক্লান্ত অদম্য পরিশ্রমী উদ্যোগী পুরুষ খুব কমই দেখা যায়। হুমায়ূন হারা শুধু আত্মীয়স্বজনরাই নয় সাধারণ মানুষ যেভাবে উতলা হয়ে পড়েছে তা স্মরণকালের মধ্যে এমনটা দেখা যায়নি। শুধু বাঁধা ছন্দের বাইরে গদ্য লিখে যে আসর জমানো যায় তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হুমায়ূন ঝড়। সুশ্রী-কুশ্রী, ভালো-মন্দ তার রচিত আঙিনায় এসে ঠেলাঠেলি করে আকাশে উঠে পড়ল গদ্য বাণীর মহাদেশ/কখনো ছড়ালো অগি্ননিঃশ্বাস/কখনো ঝরালে জলপ্রপাত। কোথাও তার সমতল, কোথাও অসমতল, কোথাও দুর্গম অরণ্য যেন। হুমায়ূন ঝড়ে রবীন্দ্র সহায় না মেনে এক কদমও যে চলা যায় না সে তো হুমায়ূন নিজেই বাৎলে গেছেন তার বিপুল বিশাল রচনা সম্ভারে। এমন কি দৈনন্দিন জীবন যাত্রাতেও যত্রতত্র খুঁজে পাওয়া যায় হুমায়ূনের চিন্তা প্রবাহে রবীন্দ্রনাথকে।
‘যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে। বাতাসে তারে উড়িয়ে নিয়ে যায়। মাটি মিশায় মাটিতে/গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা/ভালোবাসা দিয়ে গেল …’
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছে নয়নে নয়নে … এমনি কত শত পঙ্ক্তিতে হুমায়ূন বিদ্যুতায়িত হয়েছিলেন যে তা আর বলার নয়।
নিত্যদিনে জীবনযাপনেই কেবল নয়, তার রচনাতেও যে রবীন্দ্রনাথ ধ্রুব হয়ে আছেন সে কথা বলা বাহুল্য জেনেও বলতে হয় যেমন যারা হুমায়ূনের গল্প নিয়ে বলছেন বা লিখছেন তারা কি জানেন, এক্ষেত্রেও রবীন্দ্র শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। যেমন তিনি বলছেন ‘গল্প ফুরোয় না, গল্প বানিয়ের দিন ফুরোয়।’ এর পরেই আছে_ শুধু শিশু বয়সের নয়, সকল বয়সেই মানুষ হলো গল্পপোষ্য জীব।
পশুপাখির জীবন হলো আহার নিদ্রা, সন্তান পালন, মানুষের জীবন হলো গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা, সুখ-দুঃখ, রাগবিরাগ, ভালোবাসার কত ঘাত প্রতিঘাত। ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্তন। এখানেই শেষ নয় আরো আছে ‘নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরস্পর দেখা হতেই প্রশ্ন- কী হলো হে, কী খবর, তার পরে।’ এই তার পরের সঙ্গে ‘তার পরে’ বোনা হয়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষের গল্প গাঁথা হচ্ছে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনী। তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস। আবার সেই সঙ্গে আরো বলছেন, ‘বুদ্ধির মাত্রাটা একটু কমাতে যদি না পার তাহলে গল্প বলা ছেড়ে দাও।’ না এখানেই শেষ নয়। নিত্যদিনের লীলা খেলার বিষয়েও দুটি উদ্ধৃতি না দিলে কেমন হয়। একজন আসে যুক্তি হইতে বন্ধনে, আর একজন যায় বন্ধন হইতে যুক্তিতে… তিনি যে গাহিতেছেন। আর আমরা যে শুনিতেছি। তিনি বাঁধিতে বাঁধিতে শোনান, আমরা খুলিতে খুলিতে শুনি।
তারপরে প্রশ্নের উত্তর নেই সব চুপ। এইতো সৃষ্টির লীলা এ তো কৃপণের পুঁজি নয়। এ যে আনন্দের অমিতব্যয়। মুকুল ধরেও যেমন ঝরেও তেমনি।
হুমায়ূন কোনো এপিটাপ লিখে গেছেন কি না আমার জানা নেই। তবে সে এপিটাপে যে বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, রজনী শংকল ঘন ঘন দেয়া গরজন/রিমঝিম শব্দে বরিয়ে। থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তখন কথা থেকে গেলেও বলা থামে না। বাংলাদেশের এখন তদনুরূপ অবস্থা।
শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে/পথে তারি সকল বারি দিলে ঢেলে।/কেয়া কাঁদে, ‘যায় যায় যায়।’/কদম ঝরে ‘হায় হায় হায়।’
দখিন-হাওয়া কয় ওর তো আর সময় ছিল না বাকি আর। তাই তো ও চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। হুমায়ূন বিহীন আমরা এবং আমাদের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহুমায়ূন আহমেদ- র আরো পোষ্ট দেখুন