বেদনাকে বলেছি কেঁদো না

এখন পর্যন্ত যাপিত এই জীবনে বেদনাই আমার প্রথম এবং প্রধান বন্ধু। আশৈশব এই বেদনাই আমাকে ক্রমান্বয়ে যোগ্য করে তুলেছে। এই বেদনা একদিকে আমাকে যেমন দ্রোহ ও প্রতিবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে, কৈশোরেই নদীর উল্টোজলে সাঁতার দিতে শিখিয়েছে, অন্যদিকে আবার ধৈর্য, স্থৈর্য ও সহনশীলতার পাঠ, এমনকি প্রেমিক হয়ে ওঠার প্রধান উপাদান হিসেবেও কাজ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বেদনাই আমাকে কবি করে তুলেছে, আজকের হেলাল হাফিজ বানিয়েছে। উলি্লখিত বক্তব্যের সমর্থনে আমার একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি, কবিতাটির শিরোনাম ‘আমার সকল আয়োজন’।
আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?
কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,
দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের
একমাত্র মৌলিক কাহিনী।

আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত_ হাতের আঙুল_আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।

আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগি্নতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি-ম্যাচের মতো বুকে।
[কবিতা একাত্তর]

প্রিয় বন্ধু হিসেবে এর পরই উল্লেখ করতে হবে আমার জন্মদাতা জনক ও আমার প্রিয়তম শিক্ষক প্রয়াত খোরশেদ আলী তালুকদারের কথা, যাকে নেত্রকোনার সবাই এক বাক্যে পাগড়িওয়ালা স্যার বলে ডাকতেন ও চিনতেন। আমার শৈশব ও কৈশোরের পুরোটা সময়েই জড়িয়ে আছে নেত্রকোনার দত্ত হাই স্কুল। আব্বা ছিলেন সে স্কুলের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সম্মানীত একজন শিক্ষক। আম্মার মৃত্যুর পর আমরা দু’ভাই দুলাল ও হেলালকে নিয়েই ওই বিপত্নীক মানুষটি কাটিয়েছেন চার বছরের ভিন্ন স্বাদ ও মাত্রার এক অন্য রকম ব্যতিক্রমী সংসার জীবন। আব্বার দু’হাতের দু’আঙুল ধরে আমরা দু’ভাই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। প্রায়শই আব্বা আমাকে ক্লাস রুমের টেবিলের ওপর বসিয়ে রেখে ক্লাস নিতেন। মাঝে মধ্যে টেবিলের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে। উল্লেখ না করলেই নয় যে, স্কুলের সব শিক্ষক ও সিনিয়র ক্লাসের ছাত্ররা আমাকে অকল্পনীয় আদর-যত্ন করতেন এবং সব সময় আমার প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। বস্তুত দত্ত হাই স্কুল ছিল তখন আমার মায়ের মতো। গর্ভধারিণী মায়ের চিরবিদায়ের কারণে তখন থেকেই আমার জীবন আসলে ভেতরে ভেতরে এলোমেলো হয়ে গেছে।
আম্মা মারা যাওয়ার পর চার বছর আব্বা বিয়ে করেননি। এ সময় আব্বা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে সংসার করেছেন_ কখনও আমরা হোটেলে খেয়েছি, কখনও আব্বা নিজে রান্না করে খাইয়েছেন।
আব্বা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন তখন আমার বয়স হবে ছয় কি সাত বছর। আমার মনে আছে, আব্বার বিয়েতে আমার সে কি আনন্দ_ কারণ এই প্রথম আমি বরযাত্রী হলাম। আর বিয়েতে আমি বরের কোলে বসে আছি। কিন্তু নতুন মা আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে আব্বা এবং আমার সবকিছুই কেমন যেন বদলে যেতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি অস্থির হয়ে পড়লাম; ঘরে আর আমার ভলো লাগে না। আব্বার ওপর ক্রমশই আমার রাগ আর ক্ষোভ বাড়তে লাগল। যদিও আমার মনে এখন আর সে রাগের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আসলে দ্বিতীয় বিয়েটাই তার এবং আমাদের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল। তবুও এসব ক্ষেত্রে নতুন মা এবং তার নিজের সন্তানের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই যেমনটা হয়_ আমার বালক বয়সে সেভাবেই মনটা ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। আমার দিন কাটতে লাগল হেলাফেলায়, এখানে ওখানে। পড়াশোনায়ও মন নেই। দেখতে দেখতে মনের ভেতরের এই ব্যথা আর ক্রন্দন নিয়েই আমি একসময় কৈশোর থেকে যৌবনে পেঁৗছে গেলাম। কিন্তু সেখানে পেঁৗছেও আমি মায়ের অভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আব্বার ওপর রাগ করে সে সময় আমি একটি কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম। যে কবিতা কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। কবিতাটির দুটি লাইন ছিল এমন_
‘একটি মানুষ জরায়ুর রক্তিম সৈকতে পুনর্বার সাজালো জীবন,
একটি বালক কেঁদে কেঁদে ভেসে এলো যৌবনের সোঁনালী আগুনে।’
কবিতার বাকি পঙ্ক্তিমালা এখন আর মনে নেই।
কীভাবে যেন কবিতাটি আব্বার হাতে পড়েছিল। কবিতাটি পড়ে তিনি আমার এসব বেদনারেখা, ক্ষোভ-দুঃখ বুঝতে পেরেছিলেন। যেহেতু তিনি কবি ছিলেন, আমাকে চিঠিতে তার একটি কবিতার দুটি লাইন লিখে পাঠালেন। আব্বা লিখেছিলেন_
‘রেটিনার লোনা জলে তোমার সাঁতার
পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার।’
যদিও তার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল; তবু আমি কোনো উত্তর দিইনি আর।
আব্বার সঙ্গে আমার যে অদ্ভুত বন্ধুত্বটা ছিল_ আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের পর ক্রমেই তা বিয়োগের দিকে যাত্রা শুরু করে।
আমি যে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলাম তা নয়। সব সময়ই কোনোমতে টেনেটুনে পাস করতাম। বিশেষ করে অঙ্কে ছিলাম খুব কাঁচা। তবে স্কুলে খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, ক্রমাগত গল্প বলা_ এমন অনেক কিছুতেই আমার অবস্থান ছিল সবার ওপরে। প্রতি বছর পুরস্কার হিসেবে প্রচুর বই পেতাম। সেই বই জমতে জমতে একসময় অনেক বই হয়ে গেল। আমার জমানো এই বইগুলো নেত্রকোনা পাবলিক লাইব্রেরিতে দিয়ে আব্বাকে লাইব্রেরির আজীবন সদস্য বানিয়েছিলাম। সেদিন যে আমার কি আনন্দ হয়েছিল তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়; আমার জমানো বই দিয়ে আব্বাকে আজীবন সদস্য করতে পেরেছি_ সে এক আশ্চর্য গর্বের বিষয় ছিল।
আব্বা খুব ধর্মপ্রাণ হলেও মনমানসিকতায় ছিলেন খুব আধুনিক। পাগড়ি পরতেন। নামাজ পড়তেন পাঁচ ওয়াক্ত। তার শিয়রে সব সময় সাতটা কোরআন শরিফ থাকত। সাত রকমের টাইপোগ্রাফিতে সাতটা কোরআন শরিফ আব্বা খুব যত্ন করে আগলে রাখতেন। যখন যেটা ইচ্ছা হতো সেটা বের করে পড়তেন। আব্বার চরিত্রের এমন অনেক অদ্ভুত দিক ছিল। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনা বলি_ আব্বা একদিন সন্ধ্যায় আমাকে বললেন, ‘আমি স্কুলের কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি।’ আসলে তিনি যাবেন সিনেমা দেখতে। নেত্রকোনায় একটাই সিনেমা হল ছিল তখন। সেই সিনেমা হলের মালিকের ছোট ভাই বাচ্চু আব্বার ছাত্র ছিল। তাকে তিনি আগে থেকেই বলে রাখতেন। সে আবার আমার চার বছরের বড় ভাই দুলালের সহপাঠী। বাচ্চু আব্বার জন্য, কেউ দেখতে না পায়_ এমন একটা জায়গায় সিটের ব্যবস্থা করে রাখত। তখনকার দিনে একজন শিক্ষক আবার আব্বার মতো ধার্মিক এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন লোক সিনেমা দেখতে যাবে, এটা ছিল অকল্পনীয়। তবু সুচিত্রা-উত্তমের কিংবা কোনো ভালো হিন্দি ছবি এলে আব্বা দেখতে যেতেন। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই, তখন হালকা শীত_ পরের দিন ইংরেজি পরীক্ষা, কিন্তু হলে চলছে সুচিত্রা সেন আর উত্তম কুমারের বিখ্যাত ছবি ‘শিল্পী’। আমার তো এই ছবি দেখতেই হবে; কিন্তু পরীক্ষা। কী করি ভেবে পাচ্ছি না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক বন্ধুকে বললাম_ পরীক্ষার গুলি্ল মার, আজকে এই ছবি না দেখে উপায় নাই। আমরা কাউকে কিছু না বলে ছবি দেখতে চলে গেলাম। নাইট শো শুরু হলো রাত ৯টায়। ছবিতে নায়ক দুঃখে-কষ্টে যক্ষ্মায় মারা যায়। আর আমার সে কি কান্না! আমার বন্ধু আমার কান্না থামাতে পারে না। হল থেকে বেরিয়ে আমরা যখন বাসার দিকে রওনা দিলাম, কিছুদূর যাওয়ার পর সামনে চাদর মুড়ি দেওয়া একটা লোককে দেখে আমার সন্দেহ হলো_ কিরে আব্বার মতো মনে হচ্ছে! আমরা একটু ভালো করে খেয়াল করে নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ আব্বাই তো। এখন কী করি? পরীক্ষা ফেলে আমি ছবি দেখতে এসেছি; ধরা পড়লে তো আর রেহাই নেই। আমরা দু’জন বুদ্ধি করে অন্য রাস্তা ধরে আগে আগে গিয়ে পড়তে বসে পড়লাম। ভাবটা এমন, যেন সন্ধ্যা থেকেই আমি পড়ছি।
এমনই একটা পরিবেশে থেকেও আমি ঘরহীন ঘরে থাকি শৈশব থেকেই। আর নেত্রকোনার উদার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হতে হতে বন্ধু বলি, বান্ধবী বলি_ অনেক ছিল। আমি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বাড়িতে যেতাম। ততদিনে ভেতরে আস্তে আস্তে প্রেমের অনুভূতিটাও জেগে উঠতে শুরু করেছে। জয়াদের বাড়িতে যেতাম। জয়ার সঙ্গে মিষ্টি একটা প্রেম ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। বোন, বান্ধবী এবং প্রেমিকার এক মিশ্র অনুভূতিতে তার সঙ্গে কথা হতো, খুনসুটি হতো। ৪১ বছর পর কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হলো। মুক্তিযুদ্ধের আগেই ওরা ভারতে চলে গিয়েছিল; আর আসেনি। সেদিন জয়া বলছিল, ‘কয়েকদিন হলো আমরা এসেছি। চলে যাব। নেত্রকোনায় খুঁজে দেখি তোমার কবিতার বইটা পাই কি-না। তোমার সঙ্গে দেখা হলো না_ তোমার বইটা নিয়ে যাই।’ এরপর আর কিছুই জানি না। জয়া বইটা পেয়েছিল কি-না তাও না।
কৈশোরেই হেলেনের প্রেমে পড়লাম। হেলেন ছিল আমার কাছাকাছি বয়সের। সে যে খুব রূপসী ছিল তা নয়। রূপসী ছিলেন ওর মা। আমার তো মা-ই নেই। আমি ছিলাম মাতৃস্নেহের কাঙাল। একজন সুন্দরী নারী দেখলেই, প্রথমেই মনে হতো_ আহারে উনি যদি আমার মা হতেন! মুন্সীগঞ্জে, আমার ফুপাতো বোন রেনু আপাকে দেখেও প্রথমে আমার যেমনটা মনে হতো। আবার মাঝে মধ্যে প্রেমিকাও মনে হতো। আসলে একেই হয়তো বলে ‘প্লেটোনিক লাভ’। এখানে একটা মজার তথ্য উল্লেখ করার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। তা হলো, বয়োসন্ধিকালে আমার অনেক মেয়ে বন্ধু থাকা সত্ত্বেও আমি আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি লিখেছিলাম একজন ছেলে বন্ধুকে। এর প্রকৃত কারণ বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়ার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বোধ হয় ফ্রয়েড।
দেখতে ফুটফুটে হওয়ার কারণে নেত্রকোনায় সবাই আমাকে পছন্দ করত। পাগড়ি অলা স্যারের ছেলে, আবার মা নেই_ সবাই আদর করত। আমি যে কোনো সময় যে কোনো বাসায় চলে যেতে পারতাম। সবিতা দি’র বাসায় যেতাম। আমাকে সবিতা দি আদর করে এটা-ওটা খাওয়াত।
এভাবে কাটছিল অথবা কাটিয়ে দিচ্ছিলাম শৈশব-কৈশোর। কিন্তু যতই বড় হতে লাগলাম, মাতৃহীনতার বেদনা চন্দ্রগ্রহণের মতো গ্রাস করতে লাগল আমাকে। কিছুতেই আমি আর স্থির হতে পারলাম না উপরন্তু সঙ্গে যোগ হলো বিমাতার বৈরী আচরণ। এবং ধীরে ধীরে যখন আব্বার সঙ্গে আমার দূরত্ব স্পষ্ট হতে লাগল_ আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। আমি দিশাহীন হয়ে গেলাম। তখনই আরও বেশি এলোমেলো হয়ে গেল আমার জীবন। আমি বুঝতে পারলাম না কীভাবে সামাল দেব এই নিঃসঙ্গতা আর অস্থিরতা। আমার একটি কবিতায় আছে_
‘জননীর জৈবসারে বর্ধিত বৃক্ষের নিচে
কাঁদতাম যখন দাঁড়িয়ে
সজল শৈশবে, বড়ো সাধ হতো
আমিও কবর হয়ে যাই,
বহুদিন হলো আমি সে রকম কবর দেখি না
কবরে স্পর্ধিত সেই একই বৃক্ষ আমাকে দেখে না।’
ততদিনে আমার ভেতরে ঢুকে গেছে কবিতা। আমি সে সময়টাতে হুট করেই হারিয়ে যেতাম। হয়তো দু’তিন দিন বাড়িতেই আসতাম না। আব্বা নানা জায়গায় খুঁজতেন। শুরু হলো আমার উচ্ছৃঙ্খল জীবন। তবু কোনোভাবে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করে ঢাকায় চলে এলাম। ফেলে এলাম অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী। তাদের অনেকের সঙ্গেই জীবনে আর দেখা হয়নি। এখানে বিশেষ করে শংকরীর কথা না বললেই নয়। অসাধারণ বিদুষী ও রূপসী এই তরুণী নেত্রকোনা কলেজে আইএসসি পড়ার সময় আমার সহপাঠী ছিল। আমাদের মধ্যে চোখে চোখেই কথা বেশি, বাক্য বিনিময় হয়েছে খুব কম। তবে আমরা যে পরস্পরকে বেশ পছন্দ করি তা অত্যন্ত সংগোপনে আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে উভয়েই খুব উপভোগ করতাম। সবচেয়ে মজা হতো বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। সব সময় পাশাপাশি দুই টেবিলে দাঁড়িয়ে আমরা ফুল, তেলাপোকা, টিকটিকি বা ব্যাঙের অ্যানাটমি ক্লাস করতাম। একদিন বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে খুব বড় একটি রক্তজবার ফুল হাতে নিয়ে শংকরীর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম_ আচ্ছা, ফুলটির পুংকেশর কোনটি আমাকে একটু চিনিয়ে দাও না। সে ডাগর দু’চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চিনি বটে, কিন্তু এমন ভিতু মানুষকে ফুলের পুংকেশর চেনানোর কী দায় পড়েছে আমার। লোকমুখে শুনেছি, আমার সেই শংকরী ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এক মুসলমান ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে কুমিল্লায় সংসার পেতেছিল। কি জানি, এখন সে কেমন আছে! কোথায় আছে?
তখন আমাকে দেখলে কেউ বলবে না যে আমি অনার্সে ভর্তি হয়েছি; আমি তখনও প্রায় একটা বাচ্চা ছেলে।
১৯৬৭ সালে আইএসসি পাস করার পর শুরু হলো অনাদর ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা এক মানুষের উদ্বাস্তু উন্মূল প্রথম যৌবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম ঠিকই কিন্তু এক মাস না যেতেই আব্বার সঙ্গে অভিমান করে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিলাম। আমার ফুফা অর্থাৎ আমার সেই রেণু আপার আব্বা তখন মুন্সীগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে চাকরি করতেন। আসলে তার সুপারিশ ও তদবিরের ফলেই আমি চাকরিটা পেয়েছিলাম। এক বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার এসে বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্সে ভর্তি হলাম। অল্পদিনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ১৯৬৯ সালের কিংবদন্তির গণ-অভ্যুত্থান। আমি তখন তৎকালীন ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র। ক্যাম্পাসে কবি হিসেবেও মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছি। ঠিক এই সময়েই ঘটে আমার জীবনের সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা। কিছুটা জ্ঞান আবার অনেকটা ঘোরের মধ্যেই রচিত হলো ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা। রাতারাতি আমি এক বিখ্যাত মানুষে পরিণত হই। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমি একজন তারকা কবি হিসেবে সমাদৃত হতে থাকি। এর পেছনে অবশ্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন কবির। তাদের উদ্যোগেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ হয়, ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
এর পরের কাহিনী সম্ভবত কারও তেমন অজানা নয়। ততদিনে বেশ ভালোভাবেই পরিচয় হয়ে গেছে কবি আবুল হাসান, কবি হুমায়ুন কবির, বহুমাত্রিক লেখক আহমদ ছফাসহ আরও অনেকের সঙ্গে। কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল, কেন না আমাদের উভয়েরই বাড়ি নেত্রকোনায়। কবি রফিক আজাদের বাড়ি টাঙ্গাইলে হলেও তিনি নেত্রকোনা কলেজে লেখাপড়া করেছেন বলে তার সঙ্গেও আমার আগেই পরিচয় ছিল। খালেক দাদ চৌধুরী সম্পাদিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় খোরশেদ আলী তালুকদার, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ এবং আরও অনেকেই একসঙ্গে কবিতা লিখতেন।
শুরু হলো আমার কবি হয়ে ওঠার আরেক জীবন বৃত্তান্ত। চরম অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা আর বেপরোয়া সেই জীবনে প্রধান সঙ্গী হিসেবে পেলাম আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় মানুষ, অগ্রজপ্রতিম বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণকে। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন গুণদার প্রিয় বন্ধু কবি আবুল হাসান, যিনি অল্পদিনের মধ্যেই আমারও প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হলেন। যেহেতু তখন আমি ইকবাল হলে থাকতাম, ফলে তাদেরও রাত্রিযাপনের নিরাপদ একটা আশ্রয়স্থল হলো আমার রুম। হলে তখন আমি কবি হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র সবার কাছেই তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছি এবং সব ব্যাপারেই এক ধরনের বাড়তি সুবিধা পেতে শুরু করেছি। সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব_ তারাও আমাকে অত্যন্ত আদর করতেন। যদিও আমি কোনো সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। কেবল একজন কবি হিসেবেই এসব সুবিধা ভোগ করেছি। জেনে অবাক হবেন, আমি পুরো আট বছর তৎকালীন ইকবাল হল এবং পরে স্বাধীনতা-উত্তর জহুরুল হক হলে রাজকীয় জীবন যাপন করেছি। নারী ভাগ্যও আমার বেশ ভালোই ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই আমার অনেক বিদুষী ও রূপসী বন্ধু জুটে গেল। তখন টিএসসি ছিল খুবই সুন্দর এবং ছিমছাম, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা চমৎকার পরিবেশ ছিল। টিএসসিতে কখনোই আমাকে নিজের পয়সায় খেতে হয়নি [তখন আমার অবশ্য নিজের টাকা-পয়সাও ছিল না], অধিকাংশ সময় বান্ধবীরাই খাইয়েছে। এই করতে করতে ক্রমেই ঘনিয়ে এলো ১৯৭১ সাল, ২৫ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ এবং অতঃপর স্বপ্নের স্বাধীনতা। অবশেষে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে শুরু হলো আমার আরেক জীবন। সে জীবনের কাহিনীও কম চমকপ্রদ নয়, কিন্তু সময়স্বল্পতা ও স্থানাভাবের কারণে আজ তবে এটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।
বক্ষ্যমাণ আত্মজৈবনিক এই নিবন্ধের শুরুতে যেমন আমার একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছিলাম, তেমনি শেষও করছি আমার ‘সুন্দরের গান’ কবিতাটি দিয়ে।

হলো না, হলো না।
শৈশব হলো না, কৈশোর হলো না
না দিয়ে যৌবন শুরু, কার যেন
বিনা দোষে শুরুটা হলো না।

হলো না, হলো না।
দিবস হলো না, রজনীও না
সংসার হলো না, সন্ন্যাস হলো না, কার যেন
এসব হলো না, ওসব আরও না।

হলো না, হলো না।
সন্দুর হলো না, অসুন্দরও না
জীবন হলো না, জীবনেরও না, কার যেন
কিছুই হলো না, কিচ্ছু হলো না।

হলো না। না হোক,
আমি কী এমন লোক!
আমার হলো না তাতে কি হয়েছে?
তোমাদের হোক।
[কবিতা একাত্তর] হ

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
হেলাল হাফিজ- র আরো পোষ্ট দেখুন