একুশের ফুলগুলো

ফাল্গুনের প্রথম দিন থেকেই কোকিলটা পাগল হয়ে ওঠে। এ দিকে কোকিলের মন কেমন করো ডাক, অন্য দিকে গাছগাছালির আড়ালে পাতায় পাতায় মহাহুল্লোড় তুলে দোয়েল শিস দিচ্ছে। ভোরবেলার বাতাসেও যেন উতলা হয়ে ওঠার ক্ষ্যাপামি। সব মিলিয়ে কারো গোপন ভালোবাসার ভাষা শোনা যায়। পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে থেমে দাঁড়ালেন আফরোজা। কে যেন মস্তবড় বকুলগাছটার পেছনে লুকিয়ে পড়েছে। মৃদু হাসলেন আফরোজা। এটাই ওদের স্বভাব। লুকোচুরি খেলবে। তারপর হয়তো হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়াবে। মুঠি ভরা সুগন্ধি ফুল। আচমকা থেমে দাঁড়ালেন আফরোজা। কানের কাছে তীব্র একটা কাতর কান্নার শব্দ শুনে সারা শরীর কেঁপে উঠল তার। কানের কাছে নয়, ঠিক তার বুকের মধ্যেই। দ্রুত এগিয়ে গেলেন বাগানের গেটের কাছে। ফিসফিস করে বললেন কে রে? কে রে তুই? বল না একটু!
– আমি মিঠু, নানু! শহীদ মিনারে যাবো তো, ফুল কুড়াতে এসেছি। মিঠে গলায় উত্তর আসে। গেটের নিচে তাকিয়ে আফরোজা বলেন- ওখানে কী করছিস, ভেতরে ঢোক না!
– আসব নানু? ছোট ছোট পায়ে কেডস সু পরা তড়বড়ে মেয়েটা, হাসিমুখে বলল- কী সুন্দর গন্ধ, তাই না নানু? দারোয়ান ভাই যে ঢুকতে দেয় না, তাই এত ভোরে এসেছি।
– আচ্ছা, সে হোক, তুই ভেতরে আয়। আফরোজা কেঁচিগেটের ছোট পাল্লাটা খুলে ধরেন। ভুলেই যান যে, এ সময় তার মর্নিং টি নিয়ে স্বামীর সাথে চা খাওয়ার কথা। কিন্তু ছোট্ট মিঠুর সাথে ফুল কুড়ানোয় মেতে উঠে সবই যেন ভুলে যান আফরোজা। এক সময় মিঠুর ছোট্ট সাজিটা ফুলে ভরে গেলে ওটা মিঠুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন- এবার যা। এত ফুল একলা পড়ে থাকে, কেউ যদি ওদের আদর করে না নেয়, তাহলে তো ওদের কোনো দামই থাকবে না।
– যাই নানু…। পিঠের ওপর কোঁকড়া চুলের বিনুনি দুলিয়ে চলে যায় মিঠু। মাত্র সাত বছর বয়সের হাসিখুশি মেয়েটা।
একটা খেয়ালি বাতাসের ঝাপটা এসে আফরোজাকে ছুঁয়ে যায়। চমকে উঠে অবাক হয়ে চার পাশে তাকিয়ে দেখেন। বাতাসটা যেন ফুঁপিয়ে ওঠে তাকে ঘিরে। কতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি? আর কেনই বা দাঁড়িয়ে আছেন? একটু আগে লোহার গেটটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেছে। সে দিকে তাকিয়ে থাকেন আফরোজা। পেছন থেকে বুয়া ডাকে- খালাম্মা, খালু ডাকে। চা ঠাণ্ডা হইতাছে।
– অ্যা?! ও হ্যাঁ, আসছি যাও। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ধরে উঠে যান আফরোজা।
অনেক দিনের শখের বাড়িটা আফরোজা আর শাহেদের। শ্বশুর যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ফল-ফুলের সমারোহে ভরে থাকত। মৌমাছির চাক ধরে মধু তৈরি হতো। বাড়িটা তাদের ভালোবাসায় ভরা ছিল। বন্ধুবান্ধব আসতেন। ছোটদের জন্মদিন। কান ফোঁড়ানো আর ভালো লাগার অনুষ্ঠানে দারুণ জমে উঠত উৎসব। এই বাড়ির পুরনো দেয়াল আর ঘরগুলো নিয়ে তারা ভালোই ছিলেন। আশির দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে খুব সাড়ম্বরে ডেভেলপমেন্টের বড় রকমের ধাক্কা এসে লাগল। বড় ছেলে পড়তে গেল আমেরিকায়, আর আসতে চাইল না। মেয়ের বিয়ে দিলেন। সেও গেল কানাডা, কয়েক বছর পর পর আসে। বাবা-মায়ের সাথে সময়টুকু কাটিয়ে ফিরে যায়, আফরোজাও কলেজ নিয়ে ব্যস্ত। স্বামী বিজ্ঞানের মানুষ। তবে দু’জন মিলে একটা বাগান করেছিলেন। রাগী, ুব্ধ শহরের মাঝখানে তাদের গাছগাছালি-ঘেরা বাড়ি। গনগনে খটখটে চৈত্র-বৈশাখ মাসেও তাদের বাড়িটায় ঢুকলে সবাই বলত- আঃ কী আরাম! প্রতি বছর একুশের দিনগুলোতে আশপাশের ছেলেমেয়েরা ফুল নিতে আসত। শহীদ মিনারে যাবে তাই, তবুও ফুল ছেঁড়াটা সইতে পারতেন না, ভীষণ খারাপ লাগত আফরোজার। মাঝে মাঝে বলতেন, আমার বাগানে হামলা করো কেন? নিজেরা ফুল ফোটালে কী ক্ষতি হয় শুনি? তারপর নিজেই কেটে কেটে ফুল দিয়ে দিতেন। আসলে সেই নব্বইয়ের দশকে হাতেগোনা কিছু ফুলের দোকান ছিল এই ঢাকায়। ফুলের মওসুমে নিজে গাছের যতœ করতেন আফরোজা। নিজেকে কখনো নিঃসঙ্গ মনে হয়নি তার।
কিন্তু সময় বদলে গেল কিছু দিনের মধ্যে। গেট বরাবর লাগানো একটা বকুলগাছ। অল্প কিছু ফুল ফোটতে শুরু করেছে। গেটের কাছে বাতাবি ফুলের সুগন্ধ বাড়ি ঘিরে। কিন্তু নাগরিক প্রয়োজনে আবাসনকে দিতে হলো। গাছগুলো এক এক করে এবার কাটতে শুরু করবে। মন খারাপ করে কী হবে বলো? তার কষ্ট না ভোগ করে মগবাজারের তোমার বাবার বাড়ি চলে যাই, চলো- বলেছিলেন অধ্যাপক। ভাগ্যিস শেফালি ফুলের গাছটা পড়েছে বাবা আর মায়ের দেয়াল ঘেরা কবরের গা ঘেঁষে। কিন্তু কঠিন, ধুলোমলিন, নিঃসঙ্গ। এমনই একদিন ফেব্রুয়ারির একুশে আসার আগেই চোখে পড়ল ঘটনাটা। সন্ধ্যাবেলায় পাশের বাড়ির নাতনীকে নিয়ে পাড়া সম্পর্কের ননদকে হাসপাতালে যেতে দেখলেন আফরোজা। শুনলেন মিঠুর কিডনিতে অসুখ ধরা পড়েছে। আপ্রাণ চেষ্টার মাঝখানে মাত্র কয়েক দিনের মাথায় শোকের সমুদ্রে ভাসিয়ে চলে গেল মিঠু। অথচ সেদিনও কচিগলায় বলেছিল,
– আমার খুব অসুখ নানু। কবে ফুল কুড়াব?
– তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও মিঠু, ফুল কুড়াতে হবে না- বলেছিলেন আফরোজা।
তাদের প্রিয় বাড়িটির সামনে দিয়ে যেতে যেতে চোখের পানি নামল আফরোজার। বিশালকায় মিক্সার মেশিন, ভারী ভারী দানবের মতো যন্ত্র এসে সাধের বনবাগানকে ঘিরে তৈরি করল ধ্বংসের মহোৎসব। যে বাগান শ্যামলিমায় স্নিগ্ধ ছায়ায় ভরা ছিল, সেখানে উঠল মস্ত মস্ত প্রাসাদতুল্য ঘর বারান্দা, যার কোঠরে জায়গাজুড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ লিফট। অজানা-অচেনা মানুষেরা বিশাল কমপ্লেক্সের সুযোগ সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট। পাখির কলরব না-ই থাকল, এসি মেশিন, মেকানিক্যাল ব্যবস্থায় চলাচল, সবই প্রয়োজন মেটায়। না, এখানে কোনো দিক থেকে বসন্তের বাতাস বা ঝড়ের দুরন্ত আঘাত এসে চমকে দেয় না। ঢুকে পড়ে না। দুষ্টু দামাল ছেলের দল পিচঢালা রাজপথের কুড়ানিরা আলাদা আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। একটা ফুল নেয়ার জন্য তাদের অনুনয়-বিনয়কে মায়া করে কিছু ফুল কিনে নেন বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির যাত্রীরা।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কী এক অসহায় আকাক্সায় ফুলের পাড়ায় গিয়ে ঘোরেন আফরোজা। অনেকক্ষণ ফুলকুড়ানি কচি শিশুদের দৌড়ঝাঁপ দেখেন, তারপর ফিরে যান নিজের নতুন আবাসনের চার দেয়ালের মধ্যে। এখান থেকে সারাক্ষণ নাগরিক কর্মব্যস্ততার শব্দই কানে আসে। এমনকি কোকিলের ডাকও এখন খুব দুর্লভ। কী এক অজানা তৃষ্ণায় ছটফট করেন আফরোজা। স্বামীকে বলেন,
– চলো না একটু শাহবাগ থেকে ঘুরে আসি।
– এত ভোরে? কী ব্যাপার বলো তো? স্বামীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আফরোজা মৃদু হাসেন। বলেন- চলো না।
শহীদ মিনারের কাছে এখন একুশের দিনটির জন্য ঝাড়া-মোছা চলছে। ফুলের দোকানগুলো অসংখ্য ফুল বোঝাই। গাঁদা থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী হাজার হাজার ফুলে ছেয়ে গেছে এলাকা। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে ফুলের নেশায়। কী অদ্ভুত এক ব্যাকুলতায় দোকান থেকে দোকানে ঘোরেন আফরোজা। দামি, উৎফুল্ল ক্রেতারা গাড়ি রেখে গোছায় গোছায় ফুল কিনছেন। স্বামী বললেন- চলো এখানে সব বিদেশী ফুল বোঝাই। দারুণ সুন্দর, খুব দামি। পছন্দ করো। আফরোজা শুকনো ফুলের পাপড়ি মাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন, একটা ছোট দোকানে। জিজ্ঞেস করলেন- শেফালি ফুল আছে? অথবা বকুল? পাশে দাঁড়িয়ে এক দোকানি বললেন- অহন শেফালি ফুল পাইবেন কই? সিজন যাইতাছে গিয়া। এইহানে সব বিদেশী ফুল। কয়েক দিন পর্যন্ত থাকে টাটকা তাজা। দিমু? এইডা হইল সাত শ’ ট্যাকা।
– না, আমি ঘরে রাখার জন্য শেফালি ফুল চাই। বলে সামনে গেলেন আফরোজা।
– কী ব্যাপার বলো তো? একটু অবাক হয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলেন অধ্যাপক।
– স্যার, এই বছর দুই কোটি ট্যাকার দেশী-বিদেশী ফুল কেনাবেচা হইতাছে। সহজে নষ্ট হয় না। একদম তাজা ফুল। কমপক্ষে সাত দিন থাকে। ম্যাডামে চাইতাছে শেফালি ফুল!
– দুই কোটি টাকার পুষ্পবাণিজ্য? এ তো চমৎকার ব্যাপার। শুকনো গলায় বলেন অধ্যাপক, চলো রমনায় গিয়ে একটু ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরে যাই। আফরোজার মনের মধ্যে স্বপ্নের মতো শিশুকণ্ঠের অনুরণন চলছে। ফুল নেব নানু? ভেতরে আসব নানু? সামনের ছায়াঘেরা বড় বড় গাছতলায় বসতে গিয়ে চমকে উঠলেন দু’জনেই।
পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা একগুচ্ছ মেয়ে দৌড়ে এলো। হাতের মধ্যে ধরে রয়েছে শেফালি ফুলের হাস্যোজ্জ্বল জাফরানি ডাঁটা। কী অপূর্ব সাদা রঙ থেকে স্বপ্নিল সুরভি এসে আচ্ছন্ন করে তুলছে বাতাসকে। আরেকজনও ছুটে এলো ঝরা বকুল ভরা হাতের মুঠি নিয়ে। কোনো আড়াল থেকে কোকিলটা বুক ভরে ডেকে উঠল, যেন এমন একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল।
– খালাম্মা, নেন না খালাম্মা। বহুত খুঁইজা তয় পাইছি। অহন না নিলে মইরা যাইব। মিনতির সুরে কথা বলে ফুলবালিকা।
– না, না, নেব। নেব না কেন? আনন্দিত ব্যাকুলতা নিয়ে ফুলগুলো হাতে নিলেন আফরোজা। অধ্যাপক সাহেব পকেট থেকে নিজের রুমাল বের করে শেফালি আর বকুলগুলো যতেœর সাথে বেঁধে নিলেন। বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে হাসিমুখে ফুলবালিকাদের পয়সা দিলেন। শিশুদের মুখগুলো আলো হয়ে ওঠে। ঠিক যেন মিঠু। দু’জনেই স্তব্ধ। সামান্য ক’টি ফুল তাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল নিজেদের ফেলে আসা বকুলতলায়। শিউলিগাছটাও যেন হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। হারিয়ে যাওয়া জীবন ভালোবেসে ডাক পাঠিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে মিঠু, দৌড়ে আয়! ফুলবালিকারা দৌড়ে আয়, তোদের আদরের শেফালি ফুল খুঁজে পেয়েছি। চল এবার একুশের কাছে যাই। একটি হারানো শিশুর চঞ্চল পায়ের শব্দকে বুক ভরে নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করেন আফরোজা।