বিকেলের বেহাগ

bikeler behag-2সাত
এনায়েতুল্লা খান নিষেধ করেছিলেন, তবু তার বড় ছেলে মইনুল ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে এলো। ঢাকা এয়ারপোর্টে দাউদের সঙ্গে তিনিও গেলেন তাকে নিয়ে আসতে। অ্যারাইভাল লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসে মইনুল বেশ অবাক হলো তাকে দেখে। তিনি হেসে বললেন, কীরে অমন করে তাকাচ্ছিস কেন? ভূত দেখছিস?মইনুল আমতা আমতা করে বলল, না। মানে। আপনে আবার কষ্ট করতে গেলেন কেন? দাউদই যথেষ্ট ছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে বোধহয়।
এনায়েতুল্লা বললেন, না। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। প্লেন একটু লেট ছিল। আমরা এক একজন ২০০ টাকা দিয়ে ভেতরে গিয়ে বসতে পেরেছি।বসে বসে অপেক্ষা করা পরিশ্রমের না, লোকজন দেখে দেখে একঘেয়েও মনে হয়নি। রোজ রোজ তো আসি না, একদিন না হয় ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতাহলো। দাউদের সঙ্গে কথা বলে সময়টা ভালোই কাটিয়েছি। বাড়িতে কথা বলার সঙ্গে এখানে কথা বলার অনেক তফাত।
একটু ভেবে তিনি সামনের যাত্রীদের দেখে বললেন, এয়ারপোর্ট সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। মনে হয় পৃথিবীর সব ঠিকানা এই জায়গায়। এখান থেকে যেখানে খুশি যাওয়া যায়। বুঝলি, যখন ডিপারচারের অ্যানাউন্স করে এক একটা শহরের নাম বলে তখন দারুণ রোমাঞ্চ বোধ করি। নামগুলো ম্যাজিক সৃষ্টি করে। ঢাকা এয়ারপোর্টে অবশ্য তেমন করে অনেক
শহরের নাম অ্যানাউন্স করে না, ফ্লাইটের সংখ্যা তো কম। ডেসটিনেশনও কম। কিন্তু যা করে তাই বা কম কী? ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, লন্ডন, রোম,প্যারিস, ইস্তাম্বুল। মনে হয় যেন নিজেই যাচ্ছি উড়ে। বলে তিনি সুর করে গাইবার চেষ্টা করেন,আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী।
তারপর মইনুলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, সত্যিই তাই।কিন্তু হলে হবে কী, উপায় নেই ঘুরে বেড়াবার।
আক্ষেপের স্বরে বলেন, এই একটা ব্যাপার যার সঙ্গে বয়সের সম্পর্ক রয়েছে।
মইনুল আর দাউদ লাগেজের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গার দিকে অগ্রসর হলো।
এনায়েতুল্লা হেঁটে এলেন তাদের পেছনে পেছনে।গাড়ির বুটে মইনুলের স্যুটকেসটা ঢোকাল ড্রাইভার সালাম। সে এনায়েতুল্লার দেয়া স্যুটটা পরে এসেছে,টাই ছাড়া। জুলাই মাস, গরম পড়ছে। ঘামছে বরকত, তার কোটের কোনা ভিজে উঠেছে।
মইনুল অবাক চোখে সালামকে দেখল। সে তাকে লাজুক ভঙ্গিতে একটা সালাম দিল। মইনুল দাউদের দিকে তাকাল। দাউদ বুঝতে পেরে বলল, স্যুটটা আব্বা ওকে দিয়েছেন। সবাইকে একটা করে উপহার দিয়েছেন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে।
মাইনুল গাড়ির দরজা খুলে বলল, কেন? উপহার দেয়া কেন?
দাউদ বলল, আব্বা বললেন এসব এখন তার পরা হচ্ছে না। আগের মতো পরার কোনো অকেশন নেই। জানাশোনা লোকে এসব পরলে তার ভালো লাগবে।
মইনুল গাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, তাই বলে এদের দিতে হবে? এত দামি দামি কাপড়-চোপড়! ড্রাইভার সালাম তখনো গাড়িতে তার সিটে বসেনি, বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।
দাউদ অন্যদিকে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসতে বসতে বলল, আব্বা বললেন জানাশোনা লোকে পরলে তার ভালো লাগবে। আমরা দুই ভাই তো পরতে পারব না কেননা দুজনই আব্বার চেয়ে লম্বা।আমি অবশ্য বিক্রির কথা বলেছিলাম। আব্বা শোনেননি। উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন বিক্রির কথা শুনে।
হুঁ- বলে মইনুল সিটে ভালো করে বসে স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসতে থাকা বরকতকে দেখল। তার মনে হলো সে এখনো অস্ট্রেলিয়ায় আছে; সেখানে সবাই একরকম কাপড় পরে। বাইরে বাইরে সবাই সমান,কোনো শ্রেনীভেদ নেই। সে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জুলাই মাসে ওকে স্যুট পরতে দিয়েছেন কেন?
এনায়েতুল্লা বললেন, আমি বলিনি। সালাম নিজেই পরেছে। ভেবেছে এটা পরে তোকে রিসিভ করলে খুব সম্মান দেখানো হবে। আর গরমের কথা বলছিস? হ্যাঁ, গরম খুব বেশি। ক্লাইমেট চেঞ্জ। ফোরকাস্ট হচ্ছে আগামী পঞ্চাশ বছরে গরম দ্বিগুণ হবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং।
শুনে মইনুল ড্রাইভার সালামের দিকে তাকাল। ভাবল পঞ্চাশ বছর ধরে এই স্যুট পরতে পারবে না সে। কেউই পরবে না। স্যুট পরার রেওয়াজ উঠেই যাবে মনে হচ্ছে, এমনকি শীতকালেও। শীতকালের মেয়াদ কমে এসেছে আর আগের মতো শীতও পড়ছে না। সে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল,আপনাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে। ফ্রেশ অ্যান্ড হেলদি। মনে হচ্ছে ডিসিপ্লিন মেনে চলছেন।সময়মতো খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন। ওষুধ খাচ্ছেন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।মোটেও না। আমরা মর্জিমাফিক চলছি। যখন যা ভালো লাগে তাই করছি। দাউদ বলেনি তোমাকে?
কী দাউদ? বলে তিনি ছোট ছেলের দিকে তাকালেন।
দাউদ কিছু বলার আগেই মইনুল বলল, বলেন কী আব্বা! এই বয়সে যা ইচ্ছা তা-ই করা যায় না। অসুস্থ না হলেও নিয়ম মেনে চলতে হয়। বয়স বয়স কর কেন তোমরা? মনের কথা ভাব না কেউ। মনে মনে আমি সবসময়ই স্ট্রং। অন্তত তাই মনে করি। অনেক দিন বাঁচা হলো, এখন শেষ জীবনেই তো খুশিমতো চলার সময়। সব ইচ্ছা পূরণ করার শেষ সুযোগ এখনই। কিপ্টের মতো টাকা খরচ করা যেমন খারাপ, হিসাব করে বাঁচা-ও একইভাবে নিন্দার। পরিতাপের বিষয়ও বটে। আমি পরিতাপ নিয়ে চলে যেতে চাই না। বুঝলে হে-বলে তিনি হাসিমুখে বড় ছেলের দিকে তাকালেন।
মইনুল গম্ভীর হয়ে বলল, ডাক্তার অনুমতি দিয়েছেন এমনভাবে চলার? মানে, তার আপত্তি নেই কোনো?ডাক্তার? ওইসব ব্যবসায়ী, ওদের কথা বলছ? ওরা বয়স্ক রোগী পেলে মহাখুশি হয়। ছাড়তে চায় না।একগাদা টেস্ট করতে দেয়। তারপর অনেক ওষুধ প্রেসক্রাইব করে। নিয়মিত তাদের চেম্বারে গিয়ে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করার পর চেক-আপ করতে বলে। সব ব্যবসায়ী। আমি এদের এখন পাত্তা দিই না। দাউদকে বলেছি আমার যা হওয়ার হবে। বেঁচে থাকার জন্য হন্নে হয়ে ঘুরতে চাইনে এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে আরেক ডাক্তারের চেম্বারে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে।
মইনুল অবাক হয়ে বলে, আপনি চিকিৎসায় বিশ্বাস করেন না? বাট হোয়াই? ইট ইজ সায়েন্টিফিক।সবাই চিকিৎসা করায় অসুস্থ হলে। এটাই নিয়ম। বলে সে অবাক হয়ে তার আব্বাকে দেখে। তাদের গাড়ি তখন এয়ারপোর্ট রোডে নেভির হেড অফিস পার হচ্ছে। একটা গানবোট গেটের সামনে সাজানো। কংক্রিটের ভিতে জমে আছে। হাই অ্যান্ড ড্রাই।
এনায়েতুল্লা খান বললেন, বিশ্বাস করব না কেন?যাদের বাঁচার দরকার, যারা এখনো বয়সে কম,অ্যাকটিভ, সমাজকে দেয়ার ক্ষমতা আছে, তাদের জন্য চিকিৎসা ইজ অলরাইট। চিকিৎসায় বিশ্বাস করি না, চিকিৎসার দরকার নেইÑ এ কথা আমি বলি না।
মইনুল বলে, আপনার বাঁচার দরকার নেই?
এনায়েতুল্লা বলেন, জোর করে বাঁচার দরকার নেই।একগাদা ওষুধ খেয়ে, পছন্দমতো খাবার না খেয়ে,দেশের ভেতরেই ঘোরাঘুরি না করে বিছানায় শুয়ে থেকে বাঁচার কোনো মানে হয় না। যতক্ষণ সুস্থ আছি, বেঁচে থাকব। অসুস্থ হলে বাঁচার দরকার নেই। সমাজকে, দেশকে যা দেয়ার তা আমার দেয়া হয়ে গেছে। এখন অবসরের জীবনে সহিষ্ণু প্রতীক্ষা থাকাটাই ভদ্র এবং রুচিশীল।
মইনুল বলে, জীবন-মৃত্যু নিয়ে আপনার এই দৃষ্টিভঙ্গি হলো কবে থেকে? কেমন করে? ভেরি আনইউজুয়াল।
এনায়েতুল্লা বললেন, আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর। সিসিইউ থেকে আইসিইউ। সেখান থেকে ক্যাবিন। সাদা পোশাক পরা ডাক্তার আর নার্সদের ছোটাছুটি, এসব দেখে আমি চিকিৎসার প্রতি উদাসীন হয়ে গেছি। একজন বয়োবৃদ্ধকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব করার কোনো মানে হয় না। টাকা-পয়সা খরচের কথা আমি বলছি না। টাকার অভাব আমার নেই। এ রকম চিকিৎসা ঘন ঘন করলেও আমি দেউলিয়া হব না। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন চিকিৎসার জন্য এমন দৌড়ঝাঁপ করব? মজা হলো কী জান? হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সরা জানে যে আমার মতো বৃদ্ধ না বেঁচে থাকলেও পৃথিবীর কিছু আসে যায় না। কিন্তু তবুও তারা বাঁচাতে চায়।সাধ্যমতো চেষ্টা করে। এ জন্য করে যে আমি বেঁচে থাকলে আরো চিকিৎসা করাব। তাহলে
হাসপাতালের আয় বাড়বে, তাদের আয় অব্যাহত থাকবে। হ্যাঁ, টাকার জন্যই ওরা আমাদের মতো রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। জানে আমরা ইউজলেস, তার পরও বাঁচাতে চায় নিজেদের স্বার্থে। প্রাইভেট হেলথ সেক্টর একটা বাজার আর আমরা এক একটা কমোডিটি। যত বেশি বয়স, অসুখের সংখ্যাও সেই অনুযায়ী বেশি। আর বেশি হওয়া মানেই বেশি চিকিৎসা, বেশি চিকিৎসা মানে বেশি আয়। বাজারের এই হিসাব খুব সোজা। আমি হাই ভ্যালু কমোডিটি হতে চাইনে। আমি প্রতিবাদ করি। আমার মতো সবারই করা উচিত।
মইনুল দাউদের দিকে তাকাল। বোঝা গেল আব্বার কথা শুনে তার প্রায় আক্কেলগুড়–ম। দাউদ মৃদু হাসল তাকে তাকাতে দেখে। বোঝাল এসব কথা সে আগেও শুনেছে। তার কাছে নতুন কিছুই না।
মইনুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি যাই ভাবেন না কেন, আমাদের কাছে আপনার জীবনের মূল্য আছে। আপনার বেঁচে থাকা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেন? গুরুত্বপূর্ণ কেন? আমার কাছে তোমরা কী চাও? কী দিতে পারি এখন আমি তোমাদের?মইনুল বলে, সেড়বহ, ভালোবাসা। তারপর একটু ভেবে বলে, দোয়া।
এনায়েতুল্লা হাসেন। তারপর বলেন, ওসব অনেক দেয়া হয়েছে। একই জিনিস বার বার দিলে তার মূল্য থাকে না। ইনফ্লেশনের মতো হয়ে যায়।ওইসব ছিচকাঁদুনে কথা বাংলা সিনেমায় মানায়।এখনকার বাংলা সিনেমা নয়, আগের সময়ের। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে তৈরি সিনেমায়।এখনকার সিনেমায় এসব কথা থাকে না।
দাউদ বলল, আব্বা আপনে অনেকক্ষণ কথা বলছেন। এখন একটু থামুন। আপনার রেস্ট নেয়া দরকার।
এনায়েতুল্লা মহাখালীর ফ্লাইওভারের দিকে তাকালেন। একটা বিজ্ঞাপনে নতুন বাড়ির ছবি দেখা যাচ্ছে। তিনি মইনুলের দিকে ফিরে বললেন, শুনলে তো? আমার রেস্ট নেয়ার কথা। তোমার ভাই বলছে। আমি যে ফাইনাল রেস্ট নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি তা সে, তার স্ত্রী কেউই বুঝতে চায় না। তুমিও চাইবে না। খুবই স্বাভাবিক।
মইনুল বলল, এখন এ কথা থাক আব্বা। পরে আলাপ হবে। তারপর দুই দিকে তাকিয়ে বলল,একি ভয়ঙ্কর অবস্থা! এত গাড়ি, বাস, ট্রাক। এত মানুষ। সবকিছু গিজগিজ করছে।
এনায়েতুল্লা নির্বিকার হয়ে বললেন, আরো বাড়বে।সবকিছু। তুমি তো বিদেশে আছ, এসব থেকে দূরে। দাউদদের কথা ভেবে মাঝেমধ্যে দুশ্চিন্তা হয়।
তারপর ড্রাইভার সালামকে বললেন, গান-টান হোক। বরকত একটা সিডি লাগাও। একটু পর ক্যাসেটে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হলো : মনে খুশির তরঙ্গ উঠেছে, ভয়-ভাবনার বাঁধন টুটেছে। এনায়েতুল্লা খুব মনোযোগ দিয়ে গানটা শুনতে থাকলেন। বোঝা গেল তার বেশ পছন্দের গান।
মইনুল ঢাকায় আসার দুই দিন পর এনায়েতুল্লা নাস্তার টেবিলে বসে বললেন, চল বেরিয়ে পড়ি।কোথায়? মইনুল আর দাউদ একসঙ্গে তাকাল তার দিকে।চল সুন্দরবনে যাই। এনায়েতুল্লা খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন, যেন পাশের বাড়ি যাবেন।
সুন্দরবনে? দুই ভাই একসঙ্গে সপ্রশ্নে তাকাল। হ্যাঁ। সুন্দরবনে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ করার ক্যাম্পেইন চলছে। দাউদ আর তার স্ত্রীকে বলেছি এসএমএস পাঠাতে। আমার হয়ে তুলিও পাঠিয়েছে। তুমিও পাঠাও। এখন চল দেখে আসি সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আমাদেরই দেশে,অথচ দেখা হলো না। খুব লজ্জার ব্যাপার না? বেটার লেট দ্যান নেভার। চল তিনজনই বেরিয়ে পড়ি।সুন্দরবন না দেখে মরলে শান্তি পাব না।
দাউদ বলল, কিন্তু আব্বা সুন্দরবন অনেক দূর।সেখানে যাওয়া বেশ কষ্টের। লঞ্চেই থাকতে হবে।খেতে হবে, ঘুমোতে হবে। অসুখ হলে ডাক্তার পাওয়া যাবে না।
এনায়েতুল্লা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত লোকে যাচ্ছে।তাদের কষ্ট হচ্ছে না। আমাদেরই হবে? আমাদের শরীর কি ননীর তৈরি? যেন একসময় সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছি। কষ্ট মনে হয়নি। অসুস্থ হয়ে পড়িনি কখনো। কিন্তু আব্বা আপনার বয়স…। দাউদ কথা শেষ করতে পারে না।
এনায়েতুল্লা প্রায় গর্জে উঠে বলেন, আবার বয়সের কথা বলছ? কখনো বলবে না। ওটা আমার কাছে বড়ই অপমানজনক মনে হয়। আমার যে বয়স হয়েছে তা কি আমি জানি না? তোমাদের বলতে হবে? টাকা দেয়ার পর ডাক্তারের মুখে শুনতে হবে যে আমার কী হয়েছে? রাবিশ। তারপর জয়নাবের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে তো কী হয়েছে? এটা নতুন কিছু। আমিই কি প্রথম যার বয়স হয়েছে এবং যার মাঝেমধ্যে অসুখ হয়?আমাকে এসব কথা বলে উত্তেজিত করো না তোমরা। কথা বলা শেষ করে তিনি মাথা নিচু করেন। তাকে বেশ উত্তেজিত দেখায়।
তুলি পাশে বসে ছিল। সে দাউদের দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বু তুমি দাদুকে উত্তেজিত করছ কেন?আমি এতক্ষণ তোমাদের কথা শুনছিলাম। আমার মনে হচ্ছে দাদুকে তোমরা আন্ডারএস্টিমেট করছ।মিসআন্ডারস্ট্যান্ড করছ। তাকে তার মতো চলতে দাও। যা করলে খুশি হবে তাই করুক দাদু।
তারপর সে খুশি হয়ে বলল, দাদু এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি এনার্জেটিক। ফেং সুইয়ের পর দাদু বদলে গেছে। মানসিকভাবে অনেক বেশি শক্ত এখন।
ফেং সুই? মইনুল দাউদের দিকে তাকাল।
দাউদ মুখ ভার করে বসে ছিল। সে বলল, পরে বলব তোমাকে। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ও দেখাবে।
এনায়েতুল্লার জেদই টিকল। মইনুল আর দাউদকে নিয়ে তিনি রওনা হলেন সুন্দরবনের পথে। জয়নাব গেল না তুলির জন্য। সামনে তুলির পরীক্ষা। সে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিল। বলেছিল সাত দিন স্কুলে না গেলে কী হবে? তার মা ধমক দিয়ে তার কথা বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে সাত দিন অনেক সময়। পড়াশোনার খুব ক্ষতি হবে। শুনে এনায়েতুল্লা বলেছেন, দাউদ তুমি প্রমিজ কর আমার সামনে। তুলির পরীক্ষা হয়ে গেলে তাকে নিয়ে তুমি আর জয়নাব সুন্দরবন ক্রুজে যাবে।
দাউদ বলল, ঠিক আছে। চেয়ারে বসে হাততালি দিয়ে তুলি বলল, মনে থাকে যেন। ভুলে যেও না।কিংবা চালাকি করো না।তার কথা শুনে জয়নাব অসন্তুষ্ট চোখে তাকাল।
এনায়েতুল্লা তখন তুলির দিকে তাকিয়ে হাসছেন।সাত দিন পর এনায়েতুল্লা মইনুল আর দাউদকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। বাড়িতে গাড়ি বারান্দায় গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করে বললেন, তুলি আস। দেখ আমরা তিনজনই ফিরে এসেছি। একজনকেও রয়াল বেঙ্গল টাইগার খায়নি। কুমিরও টেনে নেয়নি।
তার কথা শুনে তুলি দৌড়ে এলো বারান্দায়। পেছনে জয়নাব এসে দাঁড়াল। শ্বশুরের কথা শুনে সে মুখে আঁচলচাপা দিল। আমেনার মাও এসেছিল, সে হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল রান্না ঘরে।এনায়েতুল্লার ছেলেমানুষি দেখে সবার হাসি পেয়েছে।
খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে এনায়েতুল্লা জয়নাবকে বললেন, তুলিকে নিয়ে অবশ্যই সুন্দরবন যাবে। দেখার কত কী আছে সেখানে। কী গভীর জঙ্গল, কত রকমের পাখি, কত ধরনের মাছ। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আমরা বাঘ কিংবা কুমির দেখিনি, কপাল ভালো হলে তোমরা দেখতে পারবে। ভয়ের কিছু নেই। লঞ্চে ওরা আক্রমণ করে না, তা ছাড়া সঙ্গে ফরেস্টের গার্ড থাকে। বেশ নিরাপদ। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বললেন,আমরা অবশ্য অনেক হরিণ দেখেছি। আমরা ডাঙায়ও নেমেছি। তখন জোয়ার নেমে গেছে। সুন্দরী গাছের শিকড়গুলো বর্শার ফলকের মতো মাটি ফুঁড়ে উপর দিকে উঠে আছে। বেশ সাবধানে হাঁটতে হয়। বেশ রোমাঞ্চকর কাদার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া। আমরা বাঘ দেখতে না পেলেও তার পায়ের ছাপ দেখেছি।
শুনে তুলি লাফ দেয়ার মতো করে বলে, ওরে বাবা। তাহলে তো বাঘ কাছেই ছিল।
এনায়েতুল্লা বললেন, হয়তো ছিল। কিন্তু আমরা এতজন দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়ই। কাছে আসেনি। তারও তো প্রাণের ভয় আছে।
জয়নাব বলল, আপনাদের যেতে কষ্ট হয়নি? খাওয়া-দাওয়া, ঘুমোনোর ভালো ব্যবস্থা ছিল?
এনায়েতুল্লা বললেন, চমৎকার ব্যবস্থা। প্যাকেজ ট্যুর যারা আয়োজন করে তারা বড়ই এফিশিয়েন্ট।ডাবল বেড, সিঙ্গল বেডরুম। আমি সিঙ্গল বেডরুমেই ছিলাম। বেশ কমফর্টেবল। প্রত্যেক
রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড টয়লেট অ্যান্ড বাথ। হ্যাঁ,অ্যাটাচড বাথ। জাস্ট লাইক হোম। একটুও অসুবিধা হয়নি। নাস্তা, লাঞ্চ, হাইটি, ডিনার সবই সময়মতো দিয়েছে। রান্না চমৎকার ছিল। আর নদীতে এমনিতেই ক্ষুধা জেগে ওঠে। আমরা পেট পুরে খেয়েছি। রাতে লঞ্চের ছাদে গানের আয়োজন হতো। কয়েকজন বিদেশি ট্যুরিস্ট ছিল। তাদের একজন গিটার দিয়ে গান গেয়ে শোনাত। লালন সঙ্গীত! বোঝ, ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
মইনুল বলল, যাওয়ার আগে আমি কিছু বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। ট্যুর অপারেটর যে এত সুন্দর আয়োজন করতে পারবে ভাবতে পারিনি।
এনায়েতুল্লা বললেন, করতে পারবে কেন, করছে। নিয়মিত ভাবেই করছে। অল প্রাইভেট অপারেটর। সেদিন গ্রাম থেকে আসার সময় রাস্তার পাশে এক রেস্তোরাঁয় চা-নাস্তা খেতে নেমে সব দেখে দাউদকে বলেছিলাম গ্র্যাসরুটে সব কাজ ভালোভাবেই হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ওপরের দিক নিয়ে। তারাই উন্নতির রাশ টেনে ধরেছে। কথা বলার পর তাকে বেশ অস্থির দেখায়।
তুলি বলল, আম্মু আমাকে কিন্তু পরীক্ষা হয়ে গেলেই সুন্দরবন নিয়ে যেতে হবে। তারপর তার দাদুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, তুমি যাবে দাদু আমাদের সঙ্গে?
হ্যাঁ। কেন যাব না? সুন্দরবনে বার বার যাওয়া যায়।দেখে দেখে শেষ হয় না। নিশ্চয়ই যাব তোমাদের সঙ্গে।
দুই ভাই একে অন্যের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করে।
এনায়েতুল্লা তা দেখেন না। তিনি বলেন, দাউদ আগামী শুক্রবার তোমার বড় ভাইকে নিয়ে চল আমরা গ্রামের বাড়ি যাই। সেখানে পুকুরপাড়ে যে ঘর তৈরি হচ্ছে তা দেখিয়ে আনি।
পুকুরপাড়ে ঘর? মইনুল অবাক হয়ে তাকায় একবার বাবার দিকে আরেকবার ছোট ভাইয়ের দিকে। হ্যাঁ। গ্রামের বাড়িতে যে পুকুর রয়েছে তার পাশে একটা ঘর তৈরি করছি। সিমেন্ট ফ্লোর। টিনের ছাদ। আমরা মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাব সেখানে। রিল্যাক্স করব। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা নেই।সবকিছু ফ্রেশ পাওয়া যায়। মইনুল তুমি চল, দেখে খুব পছন্দ হবে। ঢাকার মতো পলিউটেড নয়। তা ছাড়া গ্রামের বাড়ি হলো আমাদের আসল ঠিকানা। আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার। আমি যে কদিন আছি যাব সেখানে ঠিক করেছি। তোমরাও যাবে, আমি না থাকলেও। ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবে।
তুলি খুশি হয়ে বলল, আমি যাব দাদু, গ্রামের বাড়িতে যাব।
জয়নাব বলল, তোমার পরীক্ষা শেষ হোক আগে।
এনায়েতুল্লা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, একদিন গেলে ওর পড়ার কিছু ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হলেও সে তা পুষিয়ে নিতে পারবে। সুন্দরবন থেকে ফিরে আসার দুই দিন পর মইনুলকে
নিয়ে এনায়েতুল্লা গ্রামের বাড়ি বেলায়েতপুর গেলেন। দাউদ যেতে পারল না, তার অফিসে জরুরি কাজ পড়ে গেল। যাওয়ার পথে এনায়েতুল্লা যত না কথা বললেন তার চেয়ে বেশি বলল ড্রাইভার সালাম। তার বাড়ি বেলায়েতপুর গ্রামের পাশে,এনায়েতুল্লা গ্রামের বাড়ি যাওয়া-আসা করায় সে খুব খুশি। তার সঙ্গে গিয়ে সে চট করে নিজের গ্রামের বাড়িতে বউ-ছেলে-মেয়েকে দেখে আসতে পারে।
সে এনায়েতুল্লা আর দাউদকে নিয়ে গিয়েছে তার গ্রামের বাড়িতে একবার। খুব যত্ন করে খাইয়েছে তার বউ। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের দুজনকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল যে তারা খুব সম্মানিত বোধ করেছে তাদের দুজনকে পেয়ে। এনায়েতুল্লা খুশি হয়ে ফিরে আসার সময় তার বউকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। বলেছেন ঘরের পুরনো টিনের ছাদ বদলে নেয়ার জন্য দিলেন।তাদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচও তিনি দেবেন বলে জানিয়ে এসেছেন। শুনে সালামের মা আনন্দে প্রায় কেঁদে দিয়েছিলেন। তার বউ আর ছেলে-মেয়ে এসে একটু পর পর পা ছুঁয়ে সালাম করেছে এনায়েতুল্লা আর দাউদের।সালাম গাড়ি চালাতে চালাতে তার গ্রামের কথা বলে, গ্রামের নেতাদের অপকর্মের সমালোচনা করে। আফসোস করে বলে, স্যারের মতো কেউ যদি তার গ্রামে থাকতেন আর মাঝেমধ্যে যাওয়া-আসা করতেন তাহলে মতলববাজদের অপকর্ম বন্ধ হয়ে যেত। সে আরো বলে, স্যার যদি ইলেকশনে দাঁড়ান তাহলে তার গ্রামের সব মানুষ তাকে সমর্থন করবে। শুনে এনায়েতুল্লা হাসেন। মইনুল বরকতকে বলে তার আব্বার বয়স হয়েছে। তিনি রাজনীতির ব্যস্ততায় জড়াতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, গ্রামের কোন্দলেও তার পক্ষে জড়ানো ঠিক হবে না। শুনে সালাম বলেছে জড়ানোর প্রয়োজন হবে না। তিনি মাঝেমধ্যে গিয়ে গ্রামের সমস্যা সম্পর্কে শুনলেই মতলববাজরা সতর্ক হয়ে যাবে। গ্রামের মানুষও তাদের স্যারের কথা বলে হুশিয়ার করে দিতে পারবে। গ্রামে একজন নিরপেক্ষ, স্বার্থহীন, শিক্ষিত মুরুব্বি দরকার। স্যার হতে পারেন সেই মুরুব্বি।হতে পারেন কেন, হয়েই গেছেন ইতিমধ্যে। তিনি যে নিজ গ্রামে একটা ঘর তৈরি করছেন এতেই আশপাশের গ্রামে সাড়া পড়ে গেছে। সবাই সাহস পেয়েছে, ভরসা পেয়েছে মনে। এখন তিনি যখনই যান গ্রামের লোক ছুটে আসে তার কাছে। স্থানীয় এমপিকে তারা দেখে না, তিনি শুধু ভোটের সময় আসেন।
মইনুল সালামের কথা শুনে তার আব্বার দিকে তাকায়, তিনি স্মিত হাসি মুখে নিয়ে বসে থাকেন।বোঝা যায় বরকতের কথা শুনে তিনি বেশ আনন্দিত, তৃপ্ত। দেখে মইনুল বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে যে নিষেধ করলেও তার আব্বা গ্রামের বাড়িতে ঘন ঘনই আসবেন।
গ্রাম থেকে ফিরে এসে মইনুল দাউদকে বিষয়টা জানায়। দাউদ বলে তাদের আব্বাকে দেখে সেও দেখেছে গ্রামের মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে। তারা ধীরে ধীরে তাদের আব্বাকে
অলিখিত নেতা বানিয়ে ফেলেছে। তিনি গেলে তারা খোলাখুলি তাদের সমস্যার কথা বলে,অভিযোগগুলো তুলে ধরে। তিনি ধৈর্য ধরে শোনেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন, সেই আশ্বাস
দেন। ঢাকায় ফিরে টেলিফোনে একে-ওকে গ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানান। আর টাকা দিয়ে সাহায্য করা তো আছেই।
মইনুল চিন্তিত হয়ে দাউদকে বলে, সে যেন আব্বাকে নিষেধ না করলেও তার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করে। আব্বার পক্ষে গ্রাম নিয়ে বেশি জড়ানো ঠিক হবে না। শুধু যে তার
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই না, অযথা অনেক টাকাও খরচ হবে। গ্রামের মানুষ লোভী হয়ে পড়বে। দাউদ বড় ভাইকে জানায় আব্বা যা ভালো মনে করেন তাই করে যাবেন, কারো কথা শুনবেন না। বেশ জেদ জেগে উঠেছে তার মধ্যে, সব ব্যাপারেই। বরং নিষেধ করলে ফল উল্টো হতে পারে।
শুনে মইনুল বলে, তাহলে তো খুব চিন্তার বিষয়। দুশ্চিন্তারই বলা যায়। এমন একটা অসুখ থেকে উঠে তিনি এভাবে চলাফেরা করবেন, ব্যবহার করবেন তা শুধু অস্বাভাবিক নয়, তার জন্য ক্ষতিকরও তা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
দাউদ বলে, বোঝানো হয়েছে। তিনি শুনে খেপে যান। এখন তাই কিছু বলি না। তারপর বলে, ভরসা একমাত্র তুলি।
তুলি?
হ্যাঁ। আব্বা তার কথা খুব শোনেন। তার দেয়া বই পড়েন। সে আব্বার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। সেই অ্যাকাউন্টের সাহায্যে আব্বার পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বার করছে। তুলি আব্বার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেছে।
ইন্টারেস্টিং। তা এর মধ্যে আব্বার আচার-আচরণের পরিবর্তনের কী সম্ভাবনা দেখতে পেলে তুমি?
দাউদ বলল, তিনি যদি পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ শুরু করেন তাহলে তা একটা নেশা হয়ে যাবে। তখন তিনি ফেসবুক নিয়েই থাকবেন। এখনকার মতো গ্রামে ঘন ঘন যাওয়ার কথা ভাববেন না। সেই সময়ও পাবেন না।
ফেসবুক নিয়েই মেতে থাকবেন, বাচ্চা ছেলেরা যেমন নতুন খেলনা পেয়ে মেতে থাকে। তা ছাড়া তুলির দেয়া বইপত্র তো আছেই।
মইনুল বলল, বেশ। তাহলে ওইভাবেই চলুক।
তারপর সে কিছুক্ষণ ভাবল। দাউদের দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে বলল, বাড়িটা ভেঙে হাইরাইজ করার ব্যাপারে আব্বার মত বদলেছে? তাকে রাজি করাতে পেরেছ?
না। তুমি তো সে কথা জান। টেলিফোনে বলেছি।আব্বার সঙ্গে তোমারও কথা হয়েছে এ নিয়ে।
হ্যাঁ। একদিন ফোনে বেশ রাগারাগিই হয়ে গেল আব্বার সঙ্গে বাড়িটা নিয়ে। আমি আর এখন ওই বিষয়ে কোনো কথা বলি না। ভাবলাম তুমি বল-টল কি না।
আমিও বলি না। আমার সঙ্গেও কয়েকবার কথাকাটাকাটি হয়েছে আব্বার। দাউদ জানায়।
তাহলে অপেক্ষা করতে হবে আরকি। তিনি যতদিন আছেন এভাবেই চলবে। বাড়ি এমনই থাকবে।
তারপর সে বিরক্ত হয়ে বলে, আব্বা কী যে আনন্দ পান পুরনো এই বাড়িতে থেকে। হাইরাইজ হয়ে গেলে দশটা ফ্ল্যাট পাব আমরা মইনুল বলে।
সেই সঙ্গে নগদ দশ কোটি টাকা। দাউদ বলে।
বলিস কী? এত?
হ্যাঁ। দিন দিন জমির দাম বাড়ছে। নতুন বিল্ডিং কোড হওয়ার পর ছয় তলার জায়গায় দশ তলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। ফ্ল্যাট যেমন বেশি পাওয়া যাচ্ছে তেমনি ক্যাশ টাকাও।
মইনুল বলল, দেরি করায় তাহলে আমাদের লাভই হলো।। দ্যাটস দ্য ব্রাইট সাইট। থাক, আব্বার ওপর চাপ দিয়ে কাজ নেই। আর কদিনই বা আছেন। বলেই সে বিব্রতবোধ করে। দাউদের দিকে নার্ভাস চোখে তাকায়।
দাউদ খুব স্বাভাবিক স্বরে বলে, হ্যাঁ তাই। কদিনই বা আছেন। এখন তার পাগলামি সহ্য করতে হবে।তাল দিয়ে চলতে হবে। তার সঙ্গে গ্রামে যেতে হবে। গ্রামের মানুষ ঢাকার বাড়িতে এলে তাদের খাওয়াতে হবে, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
তারপর সে হেসে বলে, তুমি বেশ আছ। ডাউন আন্ডারে থাক। সব ঝক্কি-ঝামেলা আমাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। টেলিফোনে কুশল জিজ্ঞাসা করেই তোমার দায়িত্ব শেষ।
মইনুল বলল, কেন? এই যে মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতে হচ্ছে? এতে ঝামেলা নেই? সময় নষ্ট হচ্ছে না? খরচের কথা না-ই বললাম।
দাউদ বলল, কত আর আস। বড়জোর বছরে একবার। কোনো বছর তাও না।
শুনে মইনুল তার ছোট ভাইয়ের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, আব্বাকে দিয়ে এখনই একটা উইল লিখিয়ে নিতে পারলে মন্দ হতো না।
উইল? কীসের উইল? দাউদ তাকায় বড় ভাইয়ের দিকে।
এই বাড়ি, জমির উত্তরাধিকার নিয়ে। আমাদের দুই ভাইকে সমান ভাগে দেয়ার হেবানামা করে দেবেন।সেই মর্মে উইল। এটা না করলে পরে ঝামেলা হতে পারে।
দাউদ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, কীসের ঝামেলা? তাকে একটু অসন্তুষ্ট দেখায়।
মইনুল বলে, আব্বা যেভাবে গ্রামে যাওয়া-আসা করছেন তার ফলে হয়তো গ্রামের বাড়ির জন্য,বাড়ির লোকের জন্য কিছু দিয়ে যেতে পারেন।তাতে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে। সেই
ঝামেলার কথা বলছিলাম।
হুঁ- বলে দাউদ ভাবতে থাকে। একটু আগে বড় ভাইকে যে ব্যাপারে সন্দেহ করে সে অসন্তুষ্ট হয়েছিল তা চলে যায়। তাকে এখন অন্যরকম দেখায়। সেও চিন্তায় পড়েছে মইনুলের মতো।