বিকেলের বেহাগ

bikeler behag-2পাঁচ
সকালে নাস্তার পর ঘরে এসে তার লেখার টেবিলের সামনে বসলেন এনায়েতুল্লা। দেরাজ খুলে পুরনো চিঠিগুলো বার করলেন। কিছু পিকচার পোস্টকার্ডও বেরিয়ে এলো চিঠির সঙ্গে। তিনি বান্ডিলগুলো খুলে চিঠিগুলো দেখলেন এক এক করে। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু। তখন তিনি আমেরিকায় পড়া শেষ করে লন্ডনে পৌঁছেছেন এবং সেখানে আবার পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছেন। লন্ডনের ঠিকানায় লেখা তার আমেরিকান বন্ধু আর বান্ধবীদের বেশকিছু চিঠি। চিঠিগুলোয় পুরনো কাগজের গন্ধ, পাতলা আর হলুদ হয়ে এসেছে বয়সের ভারে। সেসব স্পর্শ করতেই অদ্ভুত অনুভূতি এলো তার মনে। এরপর আরো চিঠি খুলে দেখলেন তিনি; ষাটের দশক, সত্তরের দশক, আশির দশক, নব্বুইয়ের দশক, সহশ্রাব্দের পরের দশক; দীর্ঘ সময়কে আলিঙ্গন করে রয়েছে চিঠিগুলো। পরের দিকে চিঠির পরিবর্তে এসেছে ই-মেইল। একই ব্যক্তির লেখা চিঠির সংখ্যা বেশ কম,প্রায় নেই বললেই চলে। তিনি কৌতূহল নিয়ে কয়েকটা চিঠি বছরের ক্রমানুসারে পড়লেন :
সিয়াটল, ওয়াশিংটন
এপ্রিল, ১৯৬২
এনায়েত
তোমাকে আমার ফ্যামিলি খুব মিস করে। বিশেষ করে ছোট বোন মার্সিয়া। তাকে তুমি খুব হাসাতে যখন তুমি আমাদের বাড়ি আসতে। আমার মা প্রায়ই বলেন, তুমি তাকে কিচেনে গিয়ে সাহায্য করতে যা আমরা, তার ছেলেমেয়েরা কখনো করিনি। আমার বাবা এখনো তার সেইলবোটের অফিস থেকে এসে বাডওয়াইজারের বিয়ার বটল নিয়ে ফুটবল খেলা দেখেন। তিনি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেন।আমি পরীক্ষা পাশ করে চাকরি করব না। ফিশিং বোট কিনেছি। আলাস্কার উপকূলে গিয়ে মাছ ধরব। চিঠি লিখ, যোগাযোগ রেখ। তোমার কথা বেশ মনে পড়ে।
ইতি-ড্যান বার।

নিউইয়র্ক
সেপ্টেম্বর, ১৯৬২
এনায়েত
তুমি কেমন আছো? দেশে না ফিরে লন্ডনেই থেকে গেলে? সার্সির আইল্যান্ডে থাকার মতো হবে না তো? ইংল্যান্ডও একটা দ্বীপ! দেখা যাচ্ছে তুমি বড় অ্যাডভেঞ্চারাস। গতানুগতিকের মধ্যে পড় না। সেই জন্যই তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমরা তোমার কথা বলি যখন একত্রিত হয় উইকএন্ডে।
ইতি- বেটি গার্মেন।

ফিলাডেলফিয়া
নভেম্বর, ১৯৬৩
এনায়েত
এখানে খুব শীত এখনই। হোয়াইট ক্রিসমাস হবে নিঃসন্দেহে। লন্ডনেও নিশ্চয়ই এখন শীত। চেস্টনাট স্ট্রিটে আমাদের পত্রিকার অফিসের দেয়ালে তোমার ছবিসুদ্ধ আর্টিকল এখনো টাঙানো। ওয়াটার কুলারের কাছে যাওয়ার সময় সবার চোখে পড়ে। তোমার মুখের হাসি খুব নটি। আমরা তোমার জোকস্ মিস করি।
ইতি-বারবারা।

ভ্যাঙ্কুবার, কানাডা
জানুয়ারি, ১৯৬৪
জাহাজ দিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময় আমরা যেসব ছবি তুলেছিলাম সেগুলি তোমাকে পাঠিয়েছি। পেলে কিনা জানাবে। রুথ হঠাৎ বিয়ে করেছে, স্বামীকে নিয়ে টরন্টোতে থাকে। আমি বাবার ফার্মে চাকরি করছি। লন্ডনে গেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
ইতি-জেনেট।

লন্ডন
ডিসেম্বর, ১৯৬৪
এনায়েত
তুমি যাওয়ার পর আমরা হঙ্কিটঙ্ক ট্যাভার্নে নিয়মিত যাই না। বুল অ্যান্ড বুশে গেলেই তোমার আর উইকএন্ডগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। এখনো সেখানে ভিড় হয় আগের মতো। তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কতদিন পড়াবে? এখানে পিএইচডি করতে কবে আসছো। এলে আবার আগের মতো আমরা হাইকিংয়ে বেরিয়ে পড়ব ছুটিতে। তোমার ঘুরে বেড়াবার নেশা আমাকেও পেয়ে বসেছে। তবে একা একা ঘুরতে ভালো লাগে না। ভালো সঙ্গী পাচ্ছি না।
ইতি-চার্লস।

প্যারিস
জানুয়ারি, ১৯৬৭
এনায়েত
প্যারিসে আমার থাকার মেয়াদ শেষ। নতুন পত্রিকায় চাকরি নিয়ে নিউইয়র্কে যাচ্ছি। পৌঁছে আমার নতুন ঠিকানা দেব। আমাদের যোগাযোগ রাখা উচিত। প্যারিসের ক্যাফে ডি অ্যাগোর যেখানে হেমিংওয়ে বসে লিখতেন আর তার বহু বছর পর আমরা গিয়ে বসেছিলাম সেখানে মাঝে মাঝে যাই। হেমিংওয়ের নাম দেয়ালে লেখা, কিন্তু আমাদের নাম লেখা নেই। আমাদের দু’জনের কেউ তার মতো বিখ্যাত হলে ক্যাফের মালিককে আমাদের নামও লিখতে বলব।
ইতি-জেমস।

হেলসিংকি
জুলাই, ১৯৬৮
এনায়েত
অনেক দিন তোমার চিঠি পাই না। নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। আমাদের এখানে এখন সামার, অনেক রাত পর্যন্ত উজ্জ্বল রোদ থাকে। অনেকে বাইরে সময় কাটায়। পার্কে, ট্যাভার্নে, রেস্তরাঁয় খুব ভিড়।তোমাকে নিয়ে যে হলে সাইবেলিউসের সিম্ফনি শুনতে গিয়েছিলাম সেটা ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। তুমি ফিনিশ স্থাপত্যের খুব প্রশংসা করেছিলে, বিশেষ করে এরো সারিনেনের।হেলসিঙ্কির পুরুষরা এখনো আগের মতো রাতের বেলা মাতাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আর গান গায়। তাদের সঙ্গে তোমার গান গাওয়ার দৃশ্য আমি এখনো ভুলতে পারি না। তুমি খুব মজার।
ইতি-রাইনা।

লন্ডন
জানুয়ারি, ১৯৭০
এনায়েত
তুমি সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার পর আর চিঠিপত্র লেখো না। খুব ব্যস্ত থাকতে হয় নাকি?লন্ডনে আসবে না কাজ উপলক্ষে? এলে আগে থাকতে জানাবে। আমি এয়ারপোর্টে গিয়ে তোমাকে রিসিভ করব। ওয়েস্ট এন্ডে গিয়ে মিউজিকাল দেখা যাবে।
ইতি-জয়েস।

নিউ হ্যাভেন, কানেকটিকাট
এপ্রিল, ১৯৭১
এনায়েত
তোমাদের জন্য খুব চিন্তিত। ভালো আছো তো? যদি পারো উত্তর দিও। অসুবিধা আছে, সে কথা জানি।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন, কানেকটিকাট
জানুয়ারি, ১৯৭২
এনায়েত
অভিনন্দন। স্বাধীন দেশের নাগরিক এখন তোমরা। অনেক কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে যে দেশের অভ্যুদয় তার জন্য কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে, যারা দেশে আছে আর যারা প্রবাসী। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা এখানে ফান্ড তুলেছি।প্রচার কাজ করেছি। এখন পুনর্বাসনের জন্য ফান্ড তুলছি। শিগগির দেশে আসব বলে আশা করছি।তখন দেখা হবে।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন
সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫
এনায়েত
দেশে যে পৈশাচিক এবং নৃশংস হত্যাকান্ড হয়ে গেল সেই খবরে আমরা স্তম্ভিত। পাঞ্জাবি সেনারা যা করেনি বাঙালিরা তাই করতে পারল কি করে? আমাদের কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না।
আমরা যে এত নিষ্ঠুর তা জানা ছিল না।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন
অক্টোবর, ১৯৭৮
এনায়েত
তোমার চিঠি পাই না। খুব ব্যস্ত থাকো?সময় পেলে চিঠি দিও। পুরনো বন্ধুর চিঠি পেলে ভালো লাগে। আমি এবং আমার স্বামী ভালো আছি। আশা করি তোমরা ভালো আছো।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন
জানুয়ারি, ১৯৮০
এনায়েত
আমরা খুব সম্ভবত এই সামারে বাংলাদেশে যাবো। তখন দেখা হবে। পুরনো বন্ধুদের খবর দিও। একটা রি-ইউনিয়ন হলে মন্দ হয় না। খরচ আমিই দেব। তুমি অর্গানাইজ করো।
ইতি-কুমু।

হিরোশিমা
জুন, ১৯৮৩
এনায়েত
তোমাকে নিয়ে হিরোশিমার ধ্বংসাবশেষ দেখাতে গিয়ে এলেঁ রেনেঁর ‘হিরোশিমা, মাই লাভ’সিনেমা দেখাটা কাকতালীয় ছিল। কিন্তু তার জন্য বইটা দেখার অভিজ্ঞতা বেশ নাড়া দিয়েছিল
মর্মমূলে। আমি হিরোশিমাতেই এখন একটা কলেজে পড়াচ্ছি। বুড়ো মাকে দেখতে হচ্ছে। তার বয়স পচানব্বই। জাপানে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে তাদের দেখাশোনা করার সমস্যা।
ইতি-হিরোশি।

কিওতো
৭২ আগস্ট ২০১৩
এপ্রিল, ১৯৮৯
এনায়েত
চেরি ব্লসম শুরু হয়েছে। সবাই চেরি গাছের নিচে বসে থাকে যতক্ষণ পারে। তোমাকে নিয়ে পার্ক থেকে পার্কে ঘোরার কথা মনে পড়ছে। আবার আসবে কি?
ইতি-কাইদা।

উরুসা, তানজানিয়া
মে, ১৯৯৪
এনায়েত
এদেশের নাগরিক হয়েও আমার সেরেঙ্গেতি প্লেন দেখা হয়নি। কিলিমাঞ্জিরো পাহাড়ের চূড়াতেও উঠিনি। কনফারেন্স শেষে তোমার উৎসাহে একসঙ্গে দুটোই দেখা হলো।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। সেরেঙ্গেতি প্লেনে যাবার সময় আমাদের জিপ খারাপ হবার পর তিন ঘণ্টা বিশাল প্রান্তরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আর যখন সিংহের এক পাল এসে ঘুরছিল জিপের চারদিকে
যখন তোমাকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে খুব ভরসা পেয়েছিলাম। একটু লজ্জাও পেয়েছিলাম এই ভেবে যে সাফারি পার্কের দেশের লোক হয়ে আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম। পরে কিলিমাঞ্জিরো পাহাড়ে আরোহণের সময় তুমি হেমিংওয়ের লেখা গল্পের কথা বলে আমাকে উৎসাহিত করেছিলে। আমরা পাহাড়ের চূড়ায় (ক্রাটারে) ওঠার পর কোনো বরফ জমাট লিয়োপার্ড দেখতে পাইনি কিন্তু অত উঁচুতে ওঠার উত্তেজনায় তার জন্য হতাশও হইনি। তুমি বেশ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ। আমাদের দেশে আবার এলে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। ভালো কথা, উরুসায় আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের যে ট্রাইব্যুনাল রুয়ান্দার গণহত্যার বিচার করছে সেখানে বাংলাদেশের একজন বিচারক আছে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে এবং তাকে তোমার কথা বলেছি।
ইতি-নায়ারে।

হিরোশিমা
জুলাই, ১৯৯৪
এনায়েত
তোমার সঙ্গে মাউন্ট ফুজির শীর্ষে আরোহণ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। হুকুসাইয়ের আঁকা উড কাঠের ছবিতে মাউন্ট ফুজি দেখেছি কিন্তু তার চূড়ায় উঠব একদিন, একথা ভাবিনি। মাউন্ট ফুজি আমাদের কাছে খুব পবিত্র স্থান, সেই জন্য সেখানে যাওয়া ছিল তীর্থযাত্রার মতো। দেখলাম তুমি পাহাড়ে উঠতে একটুও ক্লান্ত হওনি। মনে হয়েছে পর্বত আরোহণে তুমি বেশ অভ্যস্ত। তোমার দেশে কি অনেক পাহাড় আছে?
ইতি-কাইদা।

নিউ হ্যাভেন
অক্টোবর, ১৯৯৪
এনায়েত
তোমার চিঠি পাচ্ছি না। মনে হয় খুব ব্যস্ত অথবা আমাকে মনে পড়ছে না। এখানে এখন ফল মানে অটাম। মেপল গাছের পাতা সবুজ থেকে হলুদ হচ্ছে, তারপর সোনালি রঙ নিয়ে কিছুদিন থাকবে। বাদামি হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়বে নিচে। অনেকের মতো তোমারও এই রঙ বদল ভালো লাগত দেখে। আমার এখন ভালো লাগার পাশাপাশি বেদনাও জাগে। মনে হয় যেন জীবনের বছরগুলো শেষ হয়ে ঝরে যাচ্ছে।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন
জানুয়ারি, ১৯৯৮
এনায়েত
এই বছর দারুণ শীত পড়েছে। বাড়ির সামনে বরফ জমে জমে দেয়াল তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকদিন সকালে সাবল দিয়ে সরিয়ে পথ বার করি। পরদিন রাতে আবার জমে। নিউ ইংল্যান্ডের
সব জায়গায় এরকম। অনেক বছর হলো এখানেই আছি, দারুণ শীত সত্ত্বেও। মায়া জন্মে গেছে। নতুন শহরে গিয়ে বাস করতে ইচ্ছা করে না। তুমি অনেক বছর আমেরিকায় আসো না। অবসর নেয়ার পর সপরিবারে বেড়াতে এসো। তোমাদের নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াবো, কোস্ট টু কোস্ট।
ইতি-কুমু।

নিউ হ্যাভেন
জুলাই, ২০০১
এনায়েত
এখন থেকে ই-মেইলে লিখব। খুব সোজা। তুমি শিখে নিও। আমার নেশা হয়ে গেছে। রোজ সকালে আমি কম্পিউটার খুলে দেখি কে কে ই-মেইল পাঠাল। অনেকেই ই-মেইল ব্যবহার করে। এতে চিঠি লেখার পরিশ্রম নেই। তুমিও এই অভ্যাস করে নাও। খুব সহজেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে।
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

জুন, ২০০২
এনায়েত
তোমার ই-মেইল পাই না। শুধু আমিই পাঠিয়ে যাচ্ছি। তুমি কি এখনো শেখনি? শিখে নাও। খুব সোজা। বাচ্চা ছেলেরাও পারে। অন্যকে দিয়ে ই-মেইল পাঠানোর মধ্যে মজা নেই।
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

ডিসেম্বর, ২০০৪
এনায়েত
ক্রিসমাসের ছুটিতে আমার ভাই-বোনরা বেড়াতে এসেছে। তারা আমেরিকা আর কানাডার বিভিনড়ব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। বছরে আমাদের একবার ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন হয়। এবছর সামারে বাংলাদেশে গিয়ে ঢাকায় তোমাদের বাড়িতে লাঞ্চের স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। তোমার স্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ।
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

জুলাই, ২০০৬
এনায়েত
তোমার সঙ্গে সেদিন ফোনে কথা বলে ভালো লাগল। তোমাকে ফোন করতে হবে না। আমিই করব। এখান থেকে ফোনে কথা বলা অনেক সস্তা। কিছু মনে করছ না তো?
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

মার্চ, ২০০৬
এনায়েত
তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে খুব দুঃখ পেলাম। তোমাকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। পারলে কিছুদিনের জন্য এসে আমাদের এখানে বেড়িয়ে যাও। আমাদের বন্ধু কবীরকে দিয়ে মায়া এঞ্জেলুর একটা কবিতার বই পাঠাচ্ছি। বেশ মিষ্টি স্বভাবের কবি। পড়ে মনে শান্তি পাবে।
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

এপ্রিল, ২০০৭
এনায়েত
মাঝে মাঝে ভাবি, হোয়াট ইফ? মানে যদি তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হতো তাহলে কি হতো আমার জীবন? অথবা রকিবের সঙ্গে? কিংবা কবীরের সঙ্গে? জালালও হতে পারত আমার
জীবনসঙ্গী। রাশেদও হতে পারত। কিন্তু তোমরা কেউই আমার স্বামী হলে না। হলে কি হতো সেই প্রশ্ন মাঝে মাঝে করি নিজেকে। উত্তরটা পাইনে।তোমারও কি একথা মনে হয় কখনো? ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

জুন, ২০০৯
এনায়েত
আমার সব পুরনো বন্ধুর ঠিকানা পেয়ে গিয়েছি। ফেসবুকে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। তাদের ছবিও আছে। প্রায়ই আমাদের মধ্যে মেসেজ এক্সচেঞ্জ হয়। তুমিও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে
ফেলো। হাতে চিঠি লেখা অনেক আগেই শেষ। ই-মেইলও পুরনো হয়ে গেছে এখন। কেউ ব্যবহার করছে না। কোম্পানি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া। থ্যাঙ্কস টু জুকারবার্গ।
ইতি-কুমু।
কুমু@আমেরিকা অনলাইন

সেপ্টেম্বর, ২০১০
এনায়েত
আমি অ্যাপলের আইপ্যাড কিনেছি। আই ফোন তো আছেই। স্মার্ট ফোন যা দিয়ে ই-মেইল পাঠানো যায়। এখন আইপ্যাড নিয়ে গাড়িতে যাবার সময়, রেস্তরাঁয় বসে কিংবা সমুদ্র তীরে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আত্মীয়রা তো আছেই। মনে হচ্ছে আইপ্যাড কম্পিউটারকে গুদামঘরে পাঠিয়ে দেবে। থ্যাঙ্কস টু স্টিভ জভস।
ইতি-কুমু।
এনায়েতুল্লা খান পুরনো চিঠিগুলো খুলে খুলে পড়ছেন; ই-মেইলগুলো খোলার প্রয়োজন পড়ে না, ভাঁজহীন পাতাতেই প্রিন্ট আউট। তিনি পড়ায় মগ্ন এই সময় তুলি ঘরে ঢুকল।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কি পড়ছ দাদু? খুব পুরনো চিঠিপত্র মনে হচ্ছে।
তিনি বললেন, পুরনো চিঠির সঙ্গে রিসেন্টলি লেখা চিঠি আর ই-মেইলও আছে। আমার বন্ধুদের চিঠি।কেউ কেউ শুধুই পরিচিত। বেশিরভাগই বিদেশি। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে অবসর নেয়ার আগে পর্যন্ত যখন যেখানে গিয়েছি যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তারা চিঠি লিখেছে, পরের দিকে যখন ইন্টারনেট এসে যায় তখন কেউ কেউ ই-মেইল পাঠিয়েছে। সেই সব চিঠি আর ই-মেইলের কিছু জমানো ছিল টেবিলের ড্রয়ারে। খুলে বান্ডিল গুলোর ভেতর থেকে বার করে পড়ছি। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা, অথচ কত বছর পার হয়ে গেছে। এখন দু’হাজার এগারো সালের মাঝামাঝি আর এই যে দেখ এখানে প্রথম যে চিঠি তার তারিখ ১৯৬২ সালের এপ্রিল।
তুলি কাছে এসে বলল, ওয়াও। এত পুরনো সব চিঠি জমিয়ে রেখেছো। কোনোদিন বলোনি তো। তারপর চিঠিগুলো দেখে বলল, এ যে দেখছি অনেক।
এনায়েতুল্লা বললেন, পুরনো চিঠি অনেকের কাছেই জমা থাকে। এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। তবে শিল্পী-সাহিত্যিকদের লেখা চিঠিপত্র ছাপাতে দেখেছি। আমি সেই শ্রেণিতে পড়ি না, তাই
পত্রিকায় ছাপানোর কথা ভাবিনি। কিন্তু ফেলেও দিইনি, ভেবেছি পরে আবার পড়ব। এক ধরনের নস্টালজিয়া আর কি। তারপর চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেন, অনেক কোথা, আরো ছিল। হারিয়ে ফেলেছি। আমি খুব গোছানো মানুষ না। সবকিছু জমিয়ে রাখা হয় না।
তুলি কয়েকটা চিঠি হাতে নিয়ে একটু দেখে বলল,বিভিন্ন দেশ থেকে লেখা চিঠি। সব তোমার বন্ধু ছিল।
এনায়েতুল্লা বললেন, বিভিনড়ব ধরনের বন্ধু। কেউ সহপাঠী-সহপাঠিনী। আবার অন্যেরা শুধুই পরিচিত কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
তুলি বলল, আগে লোকে চিঠি লিখতে ভালোবাসতো মনে হয়। আমাকে কেউ চিঠি লেখে না। আমার বন্ধুদেরও না। আমরা সবাই এসএমএস ব্যবহার করি।
এনায়েতুল্লা বললেন, হ্যাঁ আগে চিঠিই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। তখন ই-মেইল ছিল না। মোবাইল ফোন ছিল না। চিঠি লিখেই যোগাযোগ রাখা হতো। চিঠি লেখা ছিল একটা আর্ট,
কারো কারো কাছে। এখন ই-মেইলে পুরো বাক্যটাও লেখে না কেউ। এসএমএস, যার কথা বললি, সেখানেও কোনো পার্সোনাল টাচই নেই।
তুলি বলল, এখন নতুন টেকনোলজির যুগ। অভ্যস্ত হয়ে গেছে সবাই। অবশ্য তোমাদের মতো সিনিয়র সিটিজেনরা এসব তেমন ব্যবহার করেন না।
তারপর সে চিঠিগুলো হাতে নিয়ে বলল, তোমার এসব বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনো? চিঠি আদান-প্রদান হয়? মনে হয় নেই। তোমার নামে কোনো চিঠি আসতে দেখি না বাড়িতে।
তিনি বললেন, না। যোগাযোগ বিচ্ছিনড়ব হয়ে গেছে। আমারই দোষ। চিঠি লেখার অভ্যাস নেই আমার।কারো সঙ্গে কিছুদিন চিঠি লেখার পর আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ি। একসময় চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে যায়।তখন তারাও আর লিখতে উৎসাহ পায় না। এই জন্যই বাড়িতে আমার নামে এখন কোনো চিঠি আসে না।
তুলি চিঠিগুলো একটা একটা করে হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে বলল, কি করবে এ চিঠিগুলো? বিলি করে দেবে তোমার পুরনো কাপড়-চোপড়ের মতো? তার চোখে কৌতুক আর দুষ্টুমি।
তিনি হেসে বললেন, চিঠি তো কাপড়-চোপড় না,যে অন্যের কাজে লাগবে। কাকে বিলি করব, কে নেবে? তারপর চিঠিগুলো স্পর্শ করে বললেন, এসব প্রাইভেট। আমাকে লেখা। অন্যকে দেব কেন?
তাহলে? কি করবে? ছিঁড়ে ফেলবে নাকি জমিয়ে রাখবে? বলে তুলি চিঠিগুলো একটু একটু করে পড়ে।
তিনি বললেন, ছিঁড়ে ফেলতে পারি। পুড়িয়েও ফেলা যায়। কিন্তু মায়া লাগছে। কত সব পুরনো বন্ধুর লেখা। খুব যত্ন করে লিখেছে তারা। তাছাড়া এক একটা চিঠি ডায়েরির মতো। সময়কে ধরে রেখেছে। চিঠিগুলো দেখেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। একটা বিশেষ ধরনের অনুভূতি এসে যাচ্ছে। ভাবছি চিঠিগুলো নিয়ে কি করব।যাদের চিঠি তাদের কাছে ফেরত পাঠানো যায় না?তারা ঠিক করবে কি হবে চিঠির পরিণাম?চিঠিগুলোর মালিক তো তারাই যারা লিখেছে।
নিজে ছিঁড়ে ফেলতে না পারলে তাদের কাছেই ফেরত পাঠিয়ে দাও।
তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, কারো ঠিকানা জানা নেই। এতদিন পর পুরনো ঠিকানায় পাঠালে এসব চিঠি কেউ পাবে বলে মনে হয় না। দেখা যাচ্ছে আমার কাছেই রাখতে হবে, ড্রয়ারের ভেতর, এখন যেমন আছে। তারপর তিনি চিন্তিত হয়ে বলেন, কিন্তু পরে কি হবে? আমি না থাকলে এ চিঠিগুলো কোথায় যাবে?
তুলি হঠাৎ উৎসাহের সঙ্গে বলল, ইউরেকা। ইউরেকা। পেয়েছি।
কি? কি পেয়েছিস?
একটা উপায় খুঁজে পেয়েছি। মোক্ষম উপায়।ফেসবুকে তোমার নামে একটা প্রোফাইল অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। সেখান থেকে সার্চ করে বার করব তোমার পুরনো বন্ধুদের। তাদের তুমি চিঠিগুলোর কথা বলবে। তাছাড়া তুমি আবার নতুন করে যোগাযোগ করতে পারবে।
তিনি অবাক হয়ে তুলির দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, সেটা সম্ভব? তারা কি ফেসবুকের নেটওয়ার্কে আছে?
খুব সম্ভব আছে। দেখা যাচ্ছে তোমার বন্ধুরা প্রায় সবাই বিদেশি অথবা প্রবাসী বাংলাদেশি। এরা বয়স্ক হলেও টেক স্যাভি নিশ্চয়ই। মানে গিজমো।
টেক স্যাভি? গিজমো? তিনি বুঝতে না পেরে তুলির দিকে তাকান। সে মুচকি হাসছে।
তুলি বলল, মানে নতুন প্রযুক্তির ভক্ত। নেশারু বলা যায়। সবাই না হলেও তোমার অধিকাংশ বন্ধুই নিশ্চয়ই সোসাল নেটওয়ার্কে আছে। চেষ্টা করে দেখা যাক।
তিনি বললেন, বেশ। দেখ তুই। এভাবে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া গেলে খুবই ভালো হবে। অবশ্য তাদের ক’জন বেঁচে আছে কে জানে।
তুলি বলল, বিদেশে প্রায় সবাই দীর্ঘজীবী হয়। তারপর বলল, তোমার মোবাইল নেই। আমারটার নাম্বার দেয়া যাবে।
মোবাইল ফোন লাগবে? কম্পিউটারে হবে না? ইন্টারনেটে?ইন্টারনেট লাগবে। সেটা ছাড়া কানেকশনই করা যাবে না। ওটাই তো সুপার হাইওয়ে। তবে ফেসবুকে সাইন-আপ করার জন্য নাম আর ই-মেইল দিতে হবে।
কাকে দিবি? এখন পর্যন্ত পুরনো বন্ধুদের কারো ঠিকানা জানা নেই।
তুলি বলল, ফেসবুক ডটকম ঠিকানায়। ওয়েবসাইটে। এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা হয় ফেসবুক।
মোবাইল নাম্বার দিলে তারা একটা কোড নাম্বার দেবে। সেই কোড নাম্বার ব্যবহার করে আমরা তোমার বন্ধুদের নাম সার্চ শুরু করব।
কেমন করে সার্চ করবি? আমার বন্ধুরা বিভিন্ন দেশে,সেসব দেশের বিভিনড়ব শহরে থাকে তারা। তাছাড়া একই নামে অনেক লোক থাকতে পারে। সার্চ করবি কীভাবে বুঝিয়ে বল দেখি?
তুলি বলল, আমরা সার্চে গিয়ে একটা নাম ব্যবহার করব। যেমন ধর তোমার বন্ধু ড্যান বার।
হয়তো অনেক ড্যান বার আছে ফেসবুকের তালিকায়।
থাকুক, তাতে অসুবিধে নেই। আমরা তোমার বন্ধু ড্যান বারের পার্সোনাল ডাটা যেমন ঠিকানা, কোথায় পড়াশোনা করেছে, স্ত্রীর নাম, ছেলেমেয়ের নাম,কোন পেশায় নিয়োজিত, কি কি তার শখ এসব ব্যবহার করে শনাক্ত করতে পারব অনেকের মধ্যে কোন জন তোমার বন্ধু ড্যান বার। তাছাড়া ফেসবুকে প্রত্যেকের ছবি দেয়া আছে। সেই ছবি দেখে তুমি চিনতে পারবে ছবির ড্যান বারই তোমার বন্ধু কিনা। চেহারায় পরিবর্তন দেখা যাবে কিন্তু তুমি ঠিকই চিনতে পারবে। বুঝবেন ড্যান বারই তোমার পুরনো বন্ধু।
শুনে বেশ অবাক হলেন এনায়েতুল্লা খান। তার চোখ প্রায় কপালে উঠে গেল। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, এ যে দেখছি দারুণ ব্যাপার। যোগাযোগ প্রযুক্তির এত উনড়বতি হয়েছে জানতাম না।
তারপর উৎসাহের সঙ্গে বললেন, শুরু কর। সার্চ শুরু হয়ে যাক। তুই যা বললি তাতে মনে হচ্ছে এক একজনকে ফেসবুকে খুঁজে বার করতে সময় নেবে। একই নামে হয়তো হাজার হাজার না হলেও শতে শতে লোক রয়েছে।
তুলি বলল, তুমি আমাকে তোমার কাছে জমানো সব চিঠিগুলো দাও। আমি তোমার বন্ধুদের নাম, ঠিকানা লিখে নেব। এর বেশি তথ্য তো এখন পাওয়া যাবে না। তবে এখান থেকে সার্চ শুরু করব আমরা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমার বন্ধুদের অনেককেই পেয়ে যাব।
তিনি আগের মতোই উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। সবার খোঁজ-খবর নেয়া যাবে। কে কি করছে জানা যাবে। কার ক’টা ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সেই খবরও আদান-প্রদান করা যাবে। আমি খুব এক্সাইটেড ফিল করছি।পুরনো বন্ধুদের সারপ্রাইজ দেব। তারা এতদিন পর আমার কাছ থেকে খবর পেয়ে খুব অবাক হবে।
পরদিন বিকালে তুলি স্কুল থেকে এসে তার দাদুর ঘরে ঢুকে দেখল তিনি আরো চিঠি বার করে পড়ছেন। সে বলল, অন্য বন্ধুদের চিঠি?
তিনি বললেন, না। ওদেরই যাদের চিঠি তোকে দিয়েছি।
তুলি বলল, চিঠিগুলো আমি পড়েছি। তোমার বন্ধুদের মধ্যে কুমুর নাম অনেকবার এসেছে। নিউ হ্যাভেনের ঠিকানা। আমেরিকায়। অন্যের তুলনায় তার চিঠিই বেশি। মনে হচ্ছে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
নিউ হ্যাভেনেই ছিল সে আর তার স্বামী বহু বছর।এখনো আছে কিনা জানি না। হ্যাঁ, সে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তুলি বলল, কুমু মেয়ের নাম। তোমার বান্ধবী ছিলেন তিনি?তিনি তুলির দিকে তাকালেন। না, ঠাট্টা করছে না
সে। নিছক কৌতূহল তার চোখে-মুখে। তিনি বললেন, হ্যাঁ বান্ধবী ছিল। ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলতে পারো।
তুলি বলল, একটা চিঠিতে তিনি বেশ কয়েকজন বন্ধুর নাম উল্লেখ করেছেন। তোমার নাম তো আছেই। তিনি লিখেছেন এসব বন্ধুদের সঙ্গে তার বিয়ে হলে ভবিষ্যতে কি হতো সেটা মাঝে মাঝে তিনি কল্পনা করেন। বেশ অদ্ভুত চিন্তা। মজারও।তোমার বান্ধবীর রসিকতা বোধ আছে।
পড়েছিস তুই চিঠিটা? হ্যাঁ, কুমু তাই লিখেছে। প্রস্ন রেখেছে, হোয়াট ইফ? মানে আমাদের কারো সঙ্গে বিয়ে হলে কি হতো তার জীবনে।
তুলি বলল, তোমাদের যখন যৌবন সেই বয়সে আমাদের দেশে একজন মেয়ের অনেক পুরুষ বন্ধু থাকতে পারত?
তিনি তুলির দিকে তাকালেন। না, এবারো বিদ্রুপ কিংবা ঠাট্টা নেই তার স্বরে। শুধুই কৌতূহল আর জানার আগ্রহ।
তিনি বললেন, না, আমাদের সময় মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের খুব মেলামেশার চল ছিল না। সমাজ রক্ষণশীল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ও তাই।তাছাড়া ক’জন মেয়েই বা পড়ত তখন।
তাহলে? কুমুর এত বয়ফ্রেন্ড হলো কি করে?তিনি হেসে বললেন, সে ব্যতিক্রমী ছিল। অনেকেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে। সে আপত্তি করেনি। ভয় পায়নি, লোক-লজ্জাও না। বললাম না ব্যতিক্রমী ছিল।
এর জন্য তার বদনাম হয়নি? তুলি তাকাল সোজাসুজি তার দিকে।
তিনি আবার তুলিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে। এর পেছনেও কৌতূহল। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
তিনি বললেন, হয়েছিল। কুমুর বদনাম হয়েছিল এর জন্য। আমাদের পরিচিত গন্ডির সমাজ এর জন্য তাকে ক্ষমা করেনি। তার বেশ বদনাম হয়েছিল।
সেই জন্যই তোমরা কেউ তাকে বিয়ে করনি?
তুলির জেরা করার ভঙ্গিতে প্রশড়ব শুনে তিনি এবার হকচকিয়ে গেলেন। দারুণ অবাক হলেন। বাঘা ডিটেকটিভের মতো সে সত্য বার করে আনতে
চাইছে। বের করে ফেলেছেও।
তিনি ইতস্তত করে বললেন, হ্যাঁ। তাই। লোকনিন্দার ভয়ে, লজ্জায় আমরা কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইনি। পিছিয়ে গিয়েছি।
শুনে তুলি হাসলো। তারপর বলল, ইউ ওয়ার অল কাওয়ার্ডস।
তিনি বললেন, তা বলতে পারিস। হ্যাঁ, কাওয়ার্ডস ছাড়া আর কি বলা যায় আমাদের? আমরা উজান স্রোতে যেতে চাইনি। নিরাপদ স্থানে থেকেছি।
তুলি বলল, সি ইজ এ নাইস ওম্যান। চিঠি পড়ে তাই মনে হয়। এভাবে লেট ডাইন করার পরও তোমাদের কারো ওপর রাগ নেই তার। ক্ষোভ নেই। তোমাকে চিঠি লিখেছেন, অন্য বন্ধুদেরও নিশ্চয়ই লিখেছেন। কল্পনা করেছেন মাঝে মাঝে কেমন হতো যদি তোমাদের কারো সঙ্গে তার বিয়ে হতো। বেশ মজার ভদ্র মহিলা। রসিকতা বোধ আছে। তার চিঠির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বন্ধুত্বকে তিনি ভুলতে পারেননি।

তিনি বললেন, কুমুর চিঠি লেখার ন্যাক আছে। বলতে পারিস ওটা তার হবি। চিঠি লিখে সে খুব আনন্দ পেত। নিশ্চয়ই সব পুরনো বন্ধুকে সে চিঠি লিখেছে আমেরিকায় যাওয়ার পরও। বান্ধবীদের তো বটেই।
তুলি বলল, ফেসবুকে এ ভদ্রমহিলার খোঁজ পাওয়া গেলে তোমার অনেক পুরনো বন্ধুর কথাও জানা যাবে। তিনি নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তারা তোমার মতো আলসেমি করে চিঠি লেখা বন্ধ করে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেননি। কুমু নামের বান্ধবীর খোঁজ পেলেই তুমি পুরনো বন্ধুদেরও পেয়ে যাবে। হ্যাঁ, তখন তাদের সারপ্রাইজ দিতে পারবে।
তিনি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, দারুণ হবে। আমি ভাবতেই পারছি না যে এটা সম্ভব।
তুলি নতুন চিঠির বান্ডিল হাতে নিয়ে বলল,এগুলোও পড়ে দেখি। নতুন কোনো তথ্য থাকতে পারে। আজ রাত থেকেই সার্চ শুরু করব। গভীর রাতে, পড়াশোনা শেষ করে। আব্বা-আম্মা তখন ঘুমোবে, টের পাবে না। তারা জানতেই পারবে না আমরা দু’জন কি অ্যাডভেঞ্চার শুরু করেছি।
তিনি একটু ভেবে বললেন, এটা এত জরুরি কিছু না। তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই। ধীরে সুস্থে করলেই হবে। তুমি পড়াশোনার ক্ষতি করো না।
তুলি বলল, ধীরে সুস্থেই তো হবে। একদিনে তো সব নাম সার্চ করা যাবে না। অনেক নামও না। একটা একটা করে নাম সার্চ করতে হবে। একটা নামের বিপরীতে অনেক এন্ট্রি এসে যাবে। সেই লিস্ট থেকে বেছে বেছে আমাদের টার্গেট নাম বার করতে সময় নেবে। তবে এ সার্চ করাটাও হবে খুব উত্তেজনার ব্যাপার।
তিনি বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে। আমি এখনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।
তুলি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, না, না তুমি উত্তেজিত হতে যাবেন না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।সার্চ করতে গিয়ে আমিই উত্তেজিত হবো।
তিনি বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন, রাখো তোমার ডাক্তার! কে শোনে তাদের নিষেধ? নিষেধ করাটা তাদের ব্যবসার অংশ। ওইভাবেই টাকা কামায় তারা দু’হাতে। আমি আর ডাক্তারের কাছে যাব না, অজ্ঞান হয়ে গেলেও তোমার আব্বা-আম্মাকে বলবে তারা যেন আমাকে ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে না নিয়ে যায়। তাদের ব্যবসায় আমি একটা পণ্য হতে চাই না। বলতে বলতে তিনি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
তারপর বলেন, অল্প বয়সী কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য ডাক্তার-হাসপাতাল করতে হবে। সেটাই নিয়ম হওয়া উচিত। তাদের জীবনে অনেক কিছু করা বাকি। আমার মতো বয়সের মানুষের জীবনে যা করার সবই হয়ে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষায় থাকা। আমাদের এক কবি লিখেছিলেন ‘সহিষ্ণু প্রতীক্ষা’। হ্যাঁ, সহিষ্ণু প্রতীক্ষাই করব আমি, আমার বয়সের সবারই তাই করা উচিত। প্রতীক্ষার দিনগুলোতে যদি ডাক্তার-হাসপাতাল করে কাটাতে হয় তাহলে তা কোনো কাজের কথা হবে না। অযথা যেটুকু সময় আছে তাও নষ্ট করা।
তুলি শুনে হেসে বলে, দাদু অন্যরকম মানুষ। তবে তুমি যদি আবার অজ্ঞান হয়ে যাও আব্বা-আম্মা কি করবে তা তো জানোই। আমি নিষেধ করলে তারা শুনবে না।
এনায়েতুল্লা খান অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, আমি অনেকবার বলেছি। আবার বলব।
তাকে খুব গম্ভীর দেখাল।