সপ্তমজন

অনুবাদ : অভিজিৎ মুখার্জি

‘একটা বিশাল ঢেউ আমাকে আরেকটু হলে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল,’ গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে সপ্তমজন বলল। ‘সেপ্টেম্বরের এক বিকেলের ঘটনা। আমার বয়স তখন দশ।’

সে রাতে নিজের নিজের কাহিনি বলার সর্বশেষ জন ছিল এই লোকটি। ঘড়ির কাঁটা তখন ১০টা ছাড়িয়েছে। ঘেঁষাঘেঁষি করে গোল হয়ে বসা অল্পই কয়েকজনের দলটা তখন বাইরের অন্ধকারকে ভেদ করে পশ্চিমমুখো বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। গাছেদের ঝাঁকিয়ে দিয়ে, জানালায় খটাখট শব্দ তুলে সে বাতাস শেষ পর্যন্ত একটা শিস দিয়ে বয়ে গেল বাড়িটাকে পেছনে ফেলে।

‘আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বিশাল ঢেউ একটা,’ সে বলে। ‘আশ্চর্য একটা ঢেউ। সর্ব অর্থেই দৈত্যের মতন।’

একটু থামে সে।

‘একটুর জন্য আমি ফসকে গেলেও, আর যা কিছু ছিল আমার কাছে দামি, আমার বদলে সেই সবকিছুই গিলে নিল ঢেউটা, নিয়ে গেল অন্য কোনো জগতে। বহু বছর লেগে গেল তারপর আবার কখনো সে জিনিস ফিরে পেতে আর সেই অভিজ্ঞতার আঘাত সামলে উঠতে- মহামূল্যবান সেই বছরগুলো আর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’র

এই সপ্তমজনকে দেখে মনে হয় পঞ্চাশের কোঠার মাঝামাঝি বয়স। দোহারা চেহারা, লম্বা, গোঁফ আছে, ডান চোখের পাশেই একটা ক্ষতচিহ্ন, খুব দীর্ঘ নয় কিন্তু গভীর, হয়তো ছোট ফলার ছুরির আঘাতে ঘটেছিল ক্ষতটা। ছোট করে ছাঁটা চুলে জায়গায় জায়গায় শক্ত, খোঁচা খোঁচা সাদা ছোপ। যা বলতে চায় তার জন্য সঠিক শব্দ খুঁজে না পেলে লোকের মুখের ভাব যেমন হয়, এর মুখটা অনেকটা সেই রকম। এর ক্ষেত্রে অবশ্য এই অভিব্যক্তিটা যেন অনেক আগের থেকেই ছিল, যেন এটা নিয়েই জন্মেছে। ছাই রঙের টুইড কোটের নিচে সাদামাটা নীল রঙের একটা জামা, হাতটা মাঝেমাঝেই কলারের কাছে চলে যাচ্ছে। ওখানে যারা জড়ো হয়েছিল তাদের কেউ-ই লোকটার নাম বা বৃত্তি সম্বন্ধে কিছুই জানে না।

গলাটা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়ার পর যেন নৈঃশব্দ্যে হারিয়ে গেল ওর যা কিছু কথা। অন্যরা অপেক্ষা করে রইল, এর পরেও যাতে কথাটা চালিয়ে যেতে পারে।

‘আমার ক্ষেত্রে একটা ঢেউ,’ সে বলে। ‘আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় আপনাদের একেকজনের ক্ষেত্রে সেটা কী কী হতে পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে ঘটনাক্রমে একটা বিশালাকার ঢেউয়েরই রূপ নিয়েছিল। একদিন হঠাৎই আমার সামনে এসে হাজির হলো এটি, কোনো রকম সতর্কবার্তা ছাড়াই, একটা ঢেউয়ের রূপ নিয়ে। কী যে সর্বনাশা ঢেউ!’

‘স`-জেলার এক সমুদ্রতীরবর্তী শহরে আমি বড় হয়েছিল। এতই ছোট শহর যে নাম বললে চিনতে পারবেন কি না সন্দেহ। বাবা ছিলেন স্থানীয় ডাক্তার, ফলত ছোটবেলাটা আরামেই কাটছিল। স্মৃতি তৈরি হওয়ার পর থেকেই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল যে ছেলেটি, তাকে আমি ‘ক’ বলেই অভিহিত করব। ওর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির কাছেই, স্কুলে এক ক্লাস নিচে পড়ত। পিঠাপিঠি ভাইয়ের মতো আমরা একসঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতাম, একসঙ্গে বাড়ি ফিরে খেলতাম। ওই দীর্ঘ বন্ধুত্বের একদিনও ঝগড়া, মারামারি কিছু হয়নি। মায়ের পেটের ভাই আমার একজন ছিল, আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়, কিন্তু বয়সের ফারাকের জন্যই হোক, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাবের জন্যই হোক, খুব একটা নৈকট্য তার সঙ্গে কখনো তৈরি হয়নি। ভ্রাতৃস্নেহ আমি পুরোটাই অর্পণ করেছিলাম বন্ধু ‘ক’ -কে।

`ক` ছেলেটা ছিল দুবলা, শীর্ণ চেহারার, একটু ফ্যাকাসে রং আর মুখটা এতই লাবণ্যময় যে মনে হতে পারত মেয়ে বুঝি। ওর অবশ্য কথা বলায় কী একটা ত্রুটি ছিল, যারা চেনে না তাদের কাছে অনেক সময় মনে হতো ছেলেটা বুঝি হাবাগোবা গোছের, অত দুবলা ছিল বলেই আমি কি স্কুলে, কি বাড়িতে ওকে আগলে রাখতাম। আমি ছিলাম বেশ খানিকটা বড়সড় আর খেলাধুলায় পটু, আমার ওপর ভরসা করত অন্য বাচ্চারা। তবে যে কারণে আমি ‘ক’-র সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করতাম সেটা হলো ওর মিষ্টি আর নির্মল স্বভাব। মোটেই হাবাগোবা ছিল না, কিন্তু কথা বলার ওই ত্রুটির কারণে ওর পরীক্ষার ফল খুব ভালো হতো না। অধিকাংশ বিষয়ই কোনোক্রমে উতরে যেত। কিন্তু আর্ট ক্লাসে ও ছিল দুর্দান্ত। একটা পেনসিল কিংবা রং ধরিয়ে দিয়ে দেখুন ওর হাতে, এমন প্রাণবন্ত ছবি আঁকত যে টিচাররা পর্যন্ত আশ্চর্য হয়ে যেতেন। একটার পর একটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেত, আমি নিশ্চিত, বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত চর্চা চালিয়ে গেলে ও নির্ঘাত বিখ্যাত শিল্পী হতো। সমুদ্রের তীরে গিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসত ও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের তীরে বসে এঁকে যেত। প্রায়ই আমি গিয়ে ওর পাশে বসে দেখতাম, কীভাবে দ্রুত হাতে নিখুঁতভাবে তুলি চালাত, আশ্চর্য হয়ে দেখতাম কীভাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, যেটা একটু আগেও ছিল সাদা একটা কাগজ মাত্র, তার ওপর অমন জীবন্ত সব অবয়ব, রং ফুটিয়ে তুলত। এখন বুঝতে পারি ওটা ছিল নেহাতই নির্ভেজাল প্রতিভার ব্যাপার।

এক বছর সেপ্টেম্বর মাসে ভয়ংকর এক টাইফুন এসে আছড়ে পড়ল আমাদের এলাকায়। রেডিওতে জানালো যে ১০ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভয়ানক। স্কুলগুলোতে ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো, ঝড়ের প্রস্তুতিতে সমস্ত দোকানের ঝাঁপ নামানো রইল। ভোরে উঠে আমার বাবা আর দাদা ঘুরে ঘুরে বাড়ির সব ঠেলে সরানো যায় এমন দরজাগুলোকে বন্ধ করে পেরেক মেরে দিল আর মা সারা দিন রান্নাঘরে কাটাল বিপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য খাবার তৈরি করে রাখতে। আমরা যাবতীয় বোতলে, ক্যানে জল ভরে রাখলাম আর দরকারি জিনিসপত্র সব রুকস্যাকে ভরে নিলাম, যদি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় আমাদের, তার প্রস্তুতিতে। বড়দের কাছে টাইফুন জিনিসটা একটা বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক ব্যাপার, প্রতিবছর যার মোকাবিলা করতে হতো ওদের, কিন্তু বাচ্চাদের যেহেতু এইসব বাস্তব সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না, ওদের কাছে এটা একটা বিরাট সার্কাসের মতো, দারুণ উত্তেজনার উৎস।

দুপুরের একটু পরেই আকাশের রং হঠাৎ করেই পাল্টে যেতে শুরু করল। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক ভুতুড়েভাবে। বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম, তারপর একসময় গর্জন করে বাতাস বইতে শুরু করল, বৃষ্টি একটা অদ্ভুত শুকনো শব্দ করে বাড়ির ওপর এসে আছড়ে পড়তে লাগল, যেন মুঠো মুঠো বালু। আমরা তখন সর্বশেষ দরজাটা আটকে দিয়ে সেই অন্ধকার বাড়ির একটা ঘরে সবাই জড়ো হয়ে রেডিও শুনতে লাগলাম। এই ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি ততটা হচ্ছে না, রেডিওতে বলল, তবে ঝোড়ো বাতাসে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে খুব, বাড়ির চালা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, জাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছে। ভাঙাচোরা জিনিস উড়ে এস বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে অথবা আহত করেছে লোককে। বারবারই লোকদের বারণ করা হচ্ছিল বাড়ি থেকে বের হতে। থেকে থেকে বাড়িটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল যেন বিশাল একটা হাত ওটাকে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে। কখনো বা খুব ভারী কোনো জিনিস এসে দরজায় আছড়ে পড়ার আওয়াজ। বাবা অনুমান করল যে প্রতিবেশীদের কারও বাড়ির টালি হয়তো উড়ে যাচ্ছে। দুপুরে ভাত আর মায়ের রাঁধা ওমলেট খেয়ে রেডিও শুনতে শুনতে অপেক্ষা করে রইলাম কখন টাইফুন বয়ে চলে যাবে অন্য কোনো দিকে।

কিন্তু টাইফুন সে রকম কোনো লক্ষণই দেখাল না। রেডিওতে বলল টাইফুন নাকি সমুদ্রতটে ‘স’ জেলায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার প্রাবল্য খুইয়ে এখন ধীরগতিতে উত্তর-পূর্ব দিকে রওনা দিয়েছে। অথচ মাটির ওপর যা কিছু দাঁড়িয়ে আছে সেই সবই উপড়ে তুলে নিয়ে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় টাইফুনের ভয়াল গর্জন অব্যাহতই রইল।

এভাবেই সেই ঝড়ের তীব্রতা বজায় রইল আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক, আর তারপরেই সবকিছু কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎই এমন সুনসান, অনেক দূরের কোনো পাখির কান্নাও তখন শোনা যাচ্ছে। বাবা একটা দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাল। বাতাস আর বইছে না, বৃষ্টিও বন্ধ হয়েছে। আকাশের ধার ঘেঁষে এ-মাথা থেকে ও-মাথা ধূসর ঘন মেঘ, এখানে ওখানে নীল রং উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টির জলে ভারাক্রান্ত গাছগুলো থেকে উঠোনে তখনো জল ঝরছে।

এখন আমরা রয়েছি পাক খাওয়া ঝড়ের কেন্দ্রে, যাকে বলে ঝড়ের চোখ, বাবা বলল। এখন খানিকক্ষণ, হয়তো ১৫ কি ২০ মিনিট, এ রকম শান্ত থাকবে, যেন একটা বিরতি। এরপর আবার আগের মতোই বাতাস ফের বইতে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাইরে যেতে পারি কি না। বাবা বলল, দূরে না গেলে, এদিক-ওদিক একটু হাঁটতে পারি। ‘কিন্তু ঝড়ের আভাস পাওয়ামাত্র, আমি চাই, তুমি ঠিক এখানে ফিরে আসবে।’

বেরিয়ে এসে আমি এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। বিশ্বাসই করা যাচ্ছিল না যে ও রকম দুরন্ত একটা ঝড় কয়েক মিনিট আগেও ওখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকালাম : মনে হলো ঝড়ের বিশাল চোখ ওপর থেকে ঠান্ডা চাউনিতে নিচে আমাদের দিকে তাকিয়ে। অবশ্যই ও রকম কোনো চোখ ছিল না : আমরা তখন নেহাতই বায়ুপ্রবাহের ঘূর্ণাবর্তের ঠিক কেন্দ্রে কয়েক মিনিটের জন্য শান্ত হওয়া একটা অবস্থানে।

বড়রা পরখ করে দেখছিল বাড়িটার কতটা ক্ষতি হয়েছে, আমি চলে গেলাম বিচের দিকে। রাস্তার এখানে ওখানে গাছের ভাঙা ডাল ছড়ানো, কোনো কোনোটা পাইনের এমন মোটা ডাল, যা বড়রাও একা তুলতে পারবে না। সর্বত্র চুরমার হয়ে যাওয়া ছাদের টালি, উইন্ডস্ক্রিনে ফাটলধরা গাড়ি, এমনকি আবর্জনা ফেলার একটা বড় ড্রাম রাস্তার মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একটা বিশাল হাত যেন আকাশ থেকে নেমে এসে সামনে যা পড়েছে সব শুইয়ে দিয়ে গেছে।

আমাকে রাস্তায় হাঁটতে দেখে ‘ক’ও বেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছো?’

বললাম, ‘এই-ই, বিচটা একটু দেখে আসি।’

কোনো কথা না বলে, ও আমার সঙ্গে এল। ওর একটা ছোট্ট সাদা কুকুর ছিল, আমাদের পেছন পেছন সেটাও আসছিল।

‘বাতাস বইতে থাকলেই কিন্তু আমরা সোজা বাড়ি ফিরে যাব,’ আমি জানালাম, ‘ক’ কথা না বলে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালো।

সমুদ্রতীর আমাদের বাড়ি থেকে ২০০ গজের হাঁটা পথ। ধার বরাবর কংক্রিটের বাঁধ- আমি তখন যতটা লম্বা প্রায় সেই উচ্চতায় একটা বিরাট উঁচু বাঁধ। জলের ধারে পৌঁছাতে আমাদের ছোটখাটো একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে হতো। প্রায় প্রতিদিনই এখানেই খেলতে আসতাম আমরা, তাই এর সবটাই আমাদের খুবই ভালোমতো জানা, কিন্তু টাইফুনের চোখের মধ্যে যতক্ষণ, ততক্ষণ সবকিছুই একেবারে অন্য রকম : আকাশের রং, সমুদ্রের রং, ঢেউয়ের শব্দ, জোয়ার-ভাটার গন্ধ, বিচের আগাগোড়া পুরোটাই। কিছুক্ষণ আমরা বাঁধের ওপর বসে তাকিয়ে রইলাম, নিজেদের মধ্যে কোনো কথা না বলে। একটা দুর্ধর্ষ টাইফুনের মধ্যে তখনো আমরা, অথচ ঢেউগুলো আশ্চর্য রকম শব্দহীন। বিচের যতটা পর্যন্ত জল এসে পৌঁছায় সাধারণত, তার থেকে যেন অনেকটা দূরেই থেমে যাচ্ছে, ভাটায়ও জলের প্রান্তটা দূরেই। যত দূর চোখ যায় তত দূর পর্যন্ত কেবল সাদা বালু। বিচের ওপর সার দিয়ে পড়ে থাকা জঞ্জালটুকু না ধরলে ওই বিশাল ফাঁকা পরিসরটাকে কেমন যেন আসবাবহীন খালি ঘরের মতো দেখাচ্ছিল।

বাঁধের ওধারে নেমে গিয়ে আমরা সেই প্রশস্ত বিচ বরাবর হাঁটতে লাগলাম, যা কিছু এখানে ওখানে জমেছে সেগুলো খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে। প্লাস্টিকের খেলনা, স্যান্ডেল, কাঠের টুকরো, যা হয়তো কখনো কোনো আসবাবপত্রের অংশ ছিল, কাপড়ের ফালি, অদ্ভুত দেখতে সব বোতল, ভাঙা প্যাকিং বাক্স আর তার ওপর বিদেশি ভাষায় কিসব লেখা, এ ছাড়াও অন্যান্য, আরেকটু অপরিচিত এটা-ওটা : যেন একটা বিশাল মিষ্টির দোকান। বহুদূর থেকে ঝড় এগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে নির্ঘাৎ। একটু অন্য রকম কিছু আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই, আমরা সেগুলোকে তুলে নিয়ে নানা কোণ থেকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম, আমাদের হয়ে গেলে ‘ক’-র কুকুরটা এসে ভালো করে শুঁকে দেখছিল সেগুলোকে।

এভাবে পাঁচ মিনিটও হয়েছে কি না সন্দেহ, আমি টের পেলাম যে ঢেউ এগিয়ে এসেছে একেবারে আমার কাছ পর্যন্ত। কোনো আওয়াজ না করে, সতর্কবার্তা না পাঠিয়ে, সমুদ্র তার দীর্ঘ, মসৃণ জিব বাড়িয়ে দিয়েছে বিচের ওপর যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই পর্যন্ত। আগে কখনো এ রকম কিছু আমার দেখা নেই। বাচ্চা হলেও, বেড়ে উঠেছি সমুদ্রতীরে, আমার ভালোই জানা ছিল কী ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে সমুদ্র, কী ভীষণ হিংস্রতায় কোনো রকম জানান না দিয়ে এসে হানা দিতে পারে। সেই কারণেই আমি সাবধানে জল থেকে অনেকটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তা সত্ত্বেও ঢেউ গড়িয়ে এল আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে। আর তারপর, ততটাই নিঃশব্দে, জল আবার পিছিয়ে গেল, থেমে রইল দূরে।

যে ঢেউ আমার দিকে অমন ধেয়ে এসেছিল, তা আবার নিরীহ ঢেউ হয়ে গেছে- বালুর বিচকে শান্তভাবে ধুয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কী যেন একটা অশুভ কিছুর আভাস- সরীসৃপের ত্বক স্পর্শ করার মতো- একটা হিমশীতল অনুভূতি বইয়ে দিল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে। আমার আশঙ্কার কোনোই ভিত্তি ছিল না- কিন্তু ছিল একশ ভাগ বাস্তব। আমার মন বলছিল ওরা তখনো জীবিত। ঢেউগুলোতে তখনো প্রাণ ছিল। ওরা জানত যে আমি তখনো ওখানে এবং আমাকে গ্রাস করার ফন্দি আঁটছিল। মনে হলো একটা বিশাল মানুষখেকো জানোয়ার ঘাসজমিতে কোথাও গুড়ি মেরে রয়েছে, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ধারালো দাঁতে আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার মুহূর্তটির চিন্তায় বিভোর। আমাকে পালাতেই হবে।

‘আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।’ আমি চেঁচিয়ে ‘ক’কে বললাম। বিচের আরো হয়তো ১০ গজ মতো ভেতরে চলে গিয়েছিল ও, আমার দিকে পেছন ফিরে উবু হয়ে বসা, কী যেন দেখছে। নিশ্চিতভাবেই বেশ জোরেই চেঁচিয়ে বলেছিলাম, কিন্তু আমার গলার আওয়াজ ওর কাছে পৌঁছায়নি বলেই মনে হলো। কিছু একটা দেখতে পেয়ে হয়তো এমন মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে আমার চিৎকারে কোনো কাজই হয়নি। ও রকমই ছিল ‘ক’। কিছু একটা নিয়ে এমন ডুবে থাকত যে অন্য সব ভুলে যেত। এমনও হতে পারে যে যতটা বলে মনে হয়েছিল ততটা জোরে হয়তো চেঁচাইনি। এটুকু মনে পড়ছে, নিজের গলার আওয়াজে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, যেন অন্য কারও কণ্ঠস্বর।

তারপর কানে এল একটা গভীর গুড়গুড় শব্দ। মেদিনী কাঁপিয়ে দিল যেন। আসলে, গুড়গুড় করে শব্দটা শোনার ঠিক আগে অন্য একটা শব্দ কানে এসেছিল, একটা বিচিত্র কলকল করে আওয়াজ, যেন অনেকটা জল মাটির ভেতরে কোনো গর্ত থেকে তোড়ে বেরিয়ে আসছে। শব্দটা কিছুক্ষণ হয়ে, তারপর থেমে যায়, এর পরে আমি ওই আশ্চর্য গুড়গুড় করে শব্দটা শুনতে পাই। কিন্তু তাতেও ‘ক’ চোখ তুলে চেয়ে দেখেনি। তখনো উবু হয়ে বসে, গভীর মনোনিবেশ করে নিজের পায়ের কাছে কী একটা দেখছে। ওই গুড়গুড় শব্দটা ও হয়তো শোনেনি। জানি না কী করে ও রকম মাটি কাঁপানো একটা আওয়াজ ওকে ফাঁকি দিয়ে গেল। হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু হতেও তো পারে যে ওটা ছিল এমনই একটা শব্দ, যা কেবল আমি শুনতে পেয়েছিলাম- বিশেষ ধরনের কোনো শব্দ। এমনকি ‘ক’ -র কুকুরটাও যেন খেয়াল করেনি, অথচ আপনারা জানেন শব্দের ব্যাপারে কুকুররা কত সজাগ!

আমি বুঝতেই পারলাম যে আমার উচিত ‘ক’-র কাছে ছুটে গিয়ে, ওকে হাতে ধরে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসা। একমাত্র ওটাই করতে হতো। বুঝতেই পারছিলাম যে ঢেউ আসছে আর ও সেটা খেয়াল করেনি। কী করা উচিত যেমন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম, তেমনি স্পষ্ট টের পেলাম যে আমি উল্টোদিকে দৌড়াচ্ছি- ফুল স্পিডে বাঁধের দিকে একা। এ রকম যে করলাম, আমি নিশ্চিত, করলাম ভয়ে, ভয় আমাকে এমন কাবু করে ফেলেছিল যে আমার গলার আওয়াজ হারিয়ে ফেলেছিলাম, পা দুটো নিজ থেকেই দৌড়চ্ছিল। হোঁচট খেতে খেতে নরম বালুর ওপর দিয়ে বাঁধের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম, পৌঁছে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমি ‘ক’ কে চিৎকার করে ডাকলাম।

‘তাড়াতাড়ি ‘ক’! চলে এসো ওখান থেকে! ঢেউ আসছে!’ এবার কিন্তু গলার আওয়াজ ঠিকই ছিল। টের পেলাম গুড়গুড় শব্দটা থেমেছে, আর তারপর, অবশেষে ‘ক’ আমার চিৎকার শুনে চোখ তুলে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা ঢেউ, বিশাল একটা সাপের মতো ওই উঁচুতে ফণা তুলে ছোবল দিতে উদ্যত অবস্থায় তীরের দিকে ধেয়ে আসছিল। আমি জীবনে কখনো ও রকম কিছু আগে দেখিনি। নির্ঘাৎ অন্তত তিনতলা সমান উঁচু ছিল ঢেউটা। নিঃশব্দে (অন্তত আমার স্মৃতিতে যে ছবি রয়ে গেছে, তাতে কোনো শব্দ ছিল না) ‘ক’-র পেছনে এসে আরো উঁচু হয়ে আকাশকে ঢেকে দিল। ‘ক’ কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে ছিল, হতভম্ব হয়ে। তারপর, কী যেন টের পেয়ে, ঢেউয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দৌড়াতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু তখন আর তার সময় নেই। পরমুহূর্তেই ঢেউ ওকে গিলে নিল। সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল ওকে, দ্রুততম গতিতে ধেয়ে আসা রেলগাড়ির মতো।

ঢেউটা শেষে এসে আছড়ে পড়ল বিচের ওপর, ভেঙে গিয়ে লাফিয়ে উঠল অগুনতি ছোট ছোট ঢেউ, উড়ে এসে সেগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঁধের ওপরে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওগুলোর থেকে বাঁচতে আমি মাথা নিচু করে চলে গেলাম বাঁধের আড়ালে। জলের ছিটেয় জামাকাপড় ভিজে গেল, কিন্তু তার বেশি কিছু হলো না। হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে বাঁধের ওপর উঠে ভালো করে বিচের সবটা নজর করে দেখলাম। ততক্ষণে ঢেউ ফিরে যাচ্ছে, একটা ভয়ানক আওয়াজ করে এবার সেটা ধেয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল ওটা যেন একটা বিশাল কার্পেটের অংশ আর খোলার জন্য কার্পেটটাতে টান মেরেছে কেউ একটা, পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে। বিচের কোথাও ‘ক’ অথবা তার কুকুরের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু খাঁ খাঁ করছে বালু। পিছিয়ে যাওয়া ঢেউ এতটাই জল টেনে নিয়ে গেছে বিচ থেকে যে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের পুরো তলদেশটাই বেরিয়ে পড়েছে। একা দাঁড়িয়ে রইলাম বাঁধের ওপরে, স্থাণুবৎ।

আবারও একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে ফেলল সবকিছুকে- একটা মরিয়া স্তব্ধতা, যেন শব্দ জিনিসটাকেই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছে। ঢেউ ‘ক’-কে গিলে নিয়ে বহুদূরে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এখন কী করব। বিচের ভেতরে কিছুটা এগিয়ে যাব? একটু এগোলে কোথাও হয়তো ‘ক’ আছে, বালুতে চাপা পড়েছে…কিন্তু বাঁধ ছেড়ে এগোব না, ঠিক করলাম। অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম যে বড় ঢেউ প্রায়ই দুটো কি তিনটে পরপর একসঙ্গে আসে। ঠিক বলতে পারব না কতটা সময় কেটে গেছিল- হয়তো ১০ কি ২০ সেকেন্ডের একটা গা ছমছম করা শূন্যতা- আর তারপরই, যা ভেবেছিলাম, এল পরের ঢেউটা। আবার দৈত্যের গর্জনে কেঁপে উঠল বিচ এবং আবারও শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ার পর আরেকটা বিশালকায় ঢেউ মাথা তুলল ছোবল মারার মতো করে। আমার সামনেই উঁচু হয়ে উঠে, একটা পর্বতচূড়ার মতো করে আকাশকে আড়াল করে দিল। তবে, এবার কিন্তু আমি আর দৌড়ালাম না। মোহাবিষ্টের মতো সেই সাগর-প্রাচীরের ওপর যেন শেকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আর দৌড়ে কী হবে, আমার মনে হলো, ‘ক’-কে তো নিয়েই গেছে। কিংবা হয়তো ভয়ে কাবু হয়ে নিথর হয়ে গিয়েছিলাম। নিশ্চিত করে বলা যাবে না, ঠিক কী কারণে আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।

এই দ্বিতীয় ঢেউটা প্রথমটার মতোই বড়- আরও একটু বড় হলেও হতে পারে। আমার মাথার চেয়ে অনেক, অনেকটা উঁচু থেকে ওটা পড়তে লাগল, পড়নটাও তাই বদলে যাচ্ছিল, একটা ইটের দেয়াল ধীরে ধীরে ধসে পড়ছে যেন। এত বিশাল বড় যে একটা সত্যিকারের ঢেউ বলেই মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন অন্য কিছু, অনেক দূরের অন্য কোনো জগৎ থেকে আসা কিছু, কোনো কারণে একটা ঢেউয়ের আকার নিয়েছে। অন্ধকার আমাকে গ্রাস করবে, সেই মুহূর্তটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। এমনকি, চোখ বন্ধও করিনি আমি। নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ অবিশ্বাস্য স্পষ্টতায় কানে আসছিল, পরিষ্কার মনে আছে।

কিন্তু, ঠিক আমার একেবারে সামনে এসে হাজির হয়ে ঢেউটা থেমে গেল। হঠাৎ করেই যেন ওটার সমস্ত দম ফুরিয়ে গেল, আর এগোনোর ক্ষমতা হারিয়ে শূন্যে ঝুলে রইল, নিথর অবস্থায়ই ভেঙে পড়তে লাগল। আর ওটার নিষ্ঠুর স্বচ্ছ জিবের মধ্যে, একেবারে চূড়ায়, আমি দেখতে পেলাম ‘ক’কে।

আপনাদের কারো কারো পক্ষে হয়তো এটা বিশ্বাস করা কঠিন হবে, আর তা হলে, আমি মোটেই তাদের দোষ দেব না। এমনকি আজও, আমি নিজেই এটা নিতে পারিনি। এর কোনো ব্যাখ্যা, আপনাদের কাছে যতটুকু আছে আমার কাছেও ততটুকুই। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত করে জানি যে কোনো বিভ্রম ঘটেনি, কোনোরকম কল্পনা-উৎসারিত দৃশ্য ওটা ছিল না। সেই মুহূর্তে যা ঘটেছিল যতটা সততার সঙ্গে সেটা বিবৃত করা যায় ততটাই চেষ্টা করছি- ঠিক ঠিক যা ঘটেছিল। ঢেউয়ের একেবারে অগ্রভাগে, যেন কোনো স্বচ্ছ ক্যাপসুলের মধ্যে, ‘ক’-র শরীরটা ভাসছিল, একদিকে কাৎ হয়ে। কিন্তু সেটুকুই শুধু নয়। ‘ক’ সোজা আমার দিকে চেয়ে ছিল- চেয়ে হাসছিল। ঠিক আমার সামনে, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলতে পারি- এ রকম দূরত্বে আমার বন্ধু ‘ক’, কয়েক মুহূর্ত আগেই ঢেউ যাকে গ্রাস করে নিয়েছে। এবং আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মামুলি স্মিত হাসি নয়- দাঁত বের করে চওড়া হাসি, আক্ষরিক অর্থেই আকর্ণবিস্তৃত। ওর শীতল, জমে যাওয়া দৃষ্টি আমার চোখের ওপরে নিবদ্ধ। যে ‘ক’-কে আমি চিনতাম, এখন আর সেই ‘ক’ নয়। আর ওর ডান হাত আমার দিকে বাড়ানো, যেন আমার হাত ধরে টেনে সেই অন্য জগতে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে, যেখানে ও এখন চলে গেছে। আর একটু এগোতে পারলেই ওর হাত আমার হাতের নাগাল পেয়ে যেত। কিন্তু নাগাল না পেয়ে, ‘ক’ আরেকবার আমার দিকে চেয়ে হাসল, এর চেয়ে বিস্তৃত হাসিমুখ আর হয় না।

ওই সময় মনে হয় আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপরে যা ঘটল বলে জানি সেটা হলো আমি বাবার ক্লিনিকের বেডে শুয়ে। যেই জ্ঞান ফিরল, নার্স বাবাকে ডাকতে গেল, বাবা দৌড়ে এসে হাজির হলো। আমার নাড়ি দেখে, চোখের মণি ভালো করে দেখে নিয়ে বাবা আমার কপালে হাত রাখল। হাত নাড়াতে চেষ্টা করেছিলাম, তুলতেই পারলাম না হাতটা। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছিল আর চেতনা কেমন যেন আচ্ছন্ন। বেশ কিছুকাল আমি সেই প্রবল জ্বরের সঙ্গে যুঝেছিলাম বলেই মনে হলো। ‘তিন দিন ধরে তুমি ঘুমিয়ে আছ’, বাবা আমাকে জানাল। একজন প্রতিবেশীর চোখে পড়েছিল পুরো ব্যাপারটা, তিনিই আমাকে তুলে বাড়ি অবধি বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ‘ক’-কে আর খুঁজে পায়নি ওরা। আমি বাবাকে কিছু একটা বলতে চাইছিলাম। বলতেই হতো কিছু একটা। কিন্তু আমার অসাড় ফুলে যাওয়া জিহ্বায় কোনো শব্দই উচ্চারণ করা গেল না। মনে হচ্ছিল কোনো একটা জীব যেন আমার মুখের ভেতরে বাসা বেঁধেছে। বাবা আমাকে আমার নিজের নাম বলতে বলল, কিন্তু সেটা স্মরণ করে ওঠার আগেই, আমি আবার সংজ্ঞা হারালাম, ডুবে গেলাম অন্ধকারে।

সব মিলিয়ে পুরো একটি সপ্তাহ আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম, খাবার বলতে তরল পথ্য। এর মধ্যে বহুবার বমি করেছিলাম, থেকে থেকে প্রলাপও বকেছি, আমার অবস্থা এতটাই শঙ্কাজনক হয়ে পড়েছিল যে বাবা পরে বলেছিল, ওর আশঙ্কা হচ্ছিল হয়তো মানসিক আঘাত আর প্রবল জ্বর থেকে আমার কোনো রকম স্থায়ী স্নায়ুবিক অসুস্থতাও দেখা দিতে পারে। যেভাবেই হোক, আমি কিন্তু সেরে উঠতে লাগলাম, অন্ততপক্ষে শারীরিকভাবে। কিন্তু আগের জীবনে আমাকে আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না।

‘ক’-র দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কুকুরটাকেও না। সাধারণত, ওই অঞ্চলে কেউ ডুবে গেলে শরীরটা কয়েকদিন পরে ভেসে উঠত পূবের দিকে একটা ছোট্ট খাঁড়ির তীরে। ‘ক’-র শরীর আর ভেসে আসেনি। বড় বড় ঢেউয়ে শরীরটা সম্ভবত সমুদ্রের অনেক ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল, অত দূর থেকে আর তীরে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। হয়তো সাগরের একেবারে তলদেশে ডুবে গেছে, মাছেরা খেয়ে নিয়েছে। বহুদিন ধরে খোঁজাখুঁজি হয়েছিল, স্থানীয় জেলেদের বদান্যতায়, কিন্তু অবশেষে হাল ছেড়ে দেওয়া হয়। শরীরটাই যখন পাওয়া যায়নি, অন্ত্যেষ্টিও আর হয়নি। মানসিক ভারসাম্য আদ্ধেক হারিয়ে ফেলা ‘ক’-র বাবা-মা রোজ বিচের এ-মাথা থেকে ও-মাথা হাঁটাহাঁটি করতেন, অথবা বাড়িতে দরজা বন্ধ করে সূত্র (বৌদ্ধধর্মে নানা জ্ঞানের কথা বিভিন্ন সূত্রে বিধৃত থাকে) আওড়াতেন।

অত বড় আঘাত পেয়েও ‘ক’-র বাবা-মা কিন্তু টাইফুনের মধ্যে সমুদ্রতীরে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে কোনো রকম তিরস্কার করেননি। ওরা জানতেন কীভাবে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো করে আমি ‘ক’-কে আগলে রাখতাম, ভালোবাসতাম। আমার নিজের বাবা-মাও কখনো আমার উপস্থিতিতে ঘটনাটার কথা উল্লেখ করত না। কিন্তু সত্য তো আমার অজানা নয়। আমি তো জানতাম যে চেষ্টা করলে আমি ‘ক’- কে বাঁচাতেই পারতাম। আমি হয়তো দৌড়ে গিয়ে ওকে টেনে আনতে পারতাম ঢেউ এসে পৌঁছানোর আগেই। কী হতো বলা যায় না, তবে আমার স্মৃতিতে ঘটনাগুলোর সময়কালের যে ধারণা রয়ে গিয়েছিল, তাতে মনেই হচ্ছিল যে পারা যেত। অথচ, আগেও যা বলেছি, ভয়ের চোটে ওকে ফেলে রেখে আমি শুধু নিজেকে বাঁচালাম। এই যে ‘ক’-র বাবা-মা আমাকে দুষলেন না, কিংবা সকলেই সাবধানে যা ঘটেছিল তা নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো কথাবার্তায় গেল না, এতে করে আমার মর্মবেদনা আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমার আবেগ যে আঘাত পেয়েছিল, তা সামলে উঠতে বহুদিন লেগে গেল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্কুলে যাইনি। কিচ্ছু খেতাম না, প্রতিদিনই সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতাম।

‘ক’ আমার সঙ্গ ছাড়েনি, সেই ঢেউয়ের চূড়ায় শুয়ে আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে, হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ক্ষতচিহ্নের মতো সেই ছবি কিছুতেই আমার মন থেকে যাচ্ছিল না। কোনোক্রমে ঘুমোতে পারলেও, স্বপ্নের মধ্যে এসে হাজির হতো- তবে, এবার আর ঢেউয়ের মাথায় ক্যাপসুলের ভেতরে নয়, ক্যাপসুল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে ‘ক’ আমার কবজি ধরে টানতে থাকত ওটার ভেতরে গিয়ে ঢোকার জন্য।

এ ছাড়া ছিল আরেকটা স্বপ্ন। আমি সমুদ্রে সাঁতার কাটছি। গ্রীষ্মের একটি চমৎকার বিকেল, তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমি অলস ব্রেস্টস্ট্রোক কেটে সাঁতরাচ্ছি। সূর্যের তাপ আমার পিঠের ওপর এসে পড়ছে আর জলটা খুব আরামদায়ক। হঠাৎ করেই কে যেন আমার ডান পা-টা চেপে ধরল। গোড়ালিতে একটা বরফ-শীতল হাতের স্পর্শ টের পাচ্ছি, চেপে ধরেছে। বজ্র-আঁটুনিতে চেপে ধরেছে, এত জোরে যে ছাড়ানো যায় না। জলের নিচে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে আমাকে। সেখানে আমি দেখতে পাচ্ছি ‘ক’-র মুখ, সেই আকর্ণ-বিস্তৃত চওড়া হাসি। চোখ আমার চোখে দৃঢ়-নিবদ্ধ। আমি চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। জল ঢুকে যাচ্ছে আমার গলা দিয়ে, আমার ফুসফুস ভরে যেতে শুরু করেছে সেই জলে।

অন্ধকারে জেগে উঠে আমি আর্তনাদ করে উঠি, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কুলকুল করে ঘামছি।

বছর না ঘুরতেই আমি বাবা-মাকে গিয়ে মিনতি করলাম আমাকে যেন এ শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতে দেওয়া হয়। চোখের সামনেই বিচটা, যেখান থেকে ‘ক’-কে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, দুঃস্বপ্নের হাত থেকে এমতাবস্থায় কিছুতেই মুক্তি হবে না আমার। এখান থেকে বেরোতে না পারলে আমি উন্মাদ হয়ে যাব। বাবা-মা বুঝতে পারলেন এবং আমার অন্যত্র গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। জানুয়ারিতে আমি নাগানো জেলার এক পাহাড়ি গ্রাম কোমোরোতে গিয়ে বাবার আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। ওখানেই প্রাইমারি স্কুলের পড়া চুকিয়ে, হাইস্কুলের পাঠও সাঙ্গ করলাম। এমনকি ছুটিতেও কখনো বাড়ি যাইনি। বাবা-মা মাঝেমাঝেই আসতেন আমাকে দেখতে।

এখনো আমি নাগানোতেই থাকি। নাগানো শহরেরই এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ওই এলাকারই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরির এক কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। এখনো ওখানেই কাজ করি। আর পাঁচজনের মতোই আমার জীবন। দেখতেই পাচ্ছেন, আলাদা করে খেয়াল করার মতো কিছু নেই আমার মধ্যে। খুব মিশুক লোক আমাকে বলা যাবে না, তবে কয়েকজন বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে পাহাড়ে চড়তে যাই। যেদিন থেকে আমার সেই পুরোনো শহর ছেড়েছি, ওই নিয়ম করে দুঃস্বপ্ন দেখাও বন্ধ হয়েছে। তবে ওটা এখনো আমার জীবনের একটা অংশ। কখনো কখনো এসে হাজির হয়, বাড়ির দরজায় শমনের মতো। ভুলে যাওয়ার উপক্রম হলেই আবির্ভাব হবে। আর প্রত্যেকবারই এক্কেবারে সেই একই স্বপ্ন, খুঁটিনাটি সুদ্ধ। আর্তনাদ করে জেগে উঠি, বিছানার চাদর ঘামে ভিজে সপসপে।

হয়তো এই কারণেই, আমার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। মাঝরাতে আর্তনাদ করে উঠে পাশে যে শুয়ে আছে তার ঘুম ভাঙাতে আমি চাইনি। এ যাবৎ অনেক নারীর সঙ্গেই আমার ভাব-ভালোবাসা হয়েছে, কিন্তু কারও সঙ্গেই আমি একটা রাতও কাটাইনি। আতঙ্কটা হাড়ে-মজ্জায় সেঁধিয়ে গেছে। এটা আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

চল্লিশটি বছর আমার নিজের বাড়ি যে শহরে তার ত্রিসীমানায় যাইনি। না ওখানকার, না অন্য কোথাও, সমুদ্রতীরমুখো আর কখনো হইনি। ভয় হতো, গেলে যদি স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়। সাঁতার কাটতে আমি চিরকাল ভালোবাসি, কিন্তু ওই শহর ত্যাগ করার পর এমনকি আর কোনো পুলেও যাইনি। গভীর নদী অথবা লেকের ধারেও যেতাম না। নৌকোয় চড়া এড়িয়ে চলেছি, প্লেনে চাপতে হবে বলে বিদেশেও যাইনি। এত সব সাবধানতা অবলম্বন করেও আমি ডুবে যাচ্ছি, এই আতঙ্কজনক দৃশ্যকে মন থেকে সরাতে পারিনি। ‘ক’-র সেই ঠান্ডা হাতের মতোই, এই আশঙ্কাও আমার মনের ওপর থেকে তার মুঠি এতটুকু শিথিল করেনি।

শেষ অবধি, গত বছর বসন্তে আমি সেই বিচে আরেকবার গেলাম, যেখানে ঢেউ এসে ‘ক’-কে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

তার আগের বছর বাবা ক্যান্সারে মারা যান আর দাদা আমাদের সাবেক বাড়িটা বিক্রি করে দেন। যে ছাউনিটাতে সব জিনিস গুদামজাত করা হতো, সেখানে এটা-ওটা দেখতে দেখতে ও হঠাৎ আমার ছোটবেলার সব জিনিসে ঠাসা একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স খুঁজে পেয়ে যায়, আর ওটা নাগানোতে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বাক্সের ভেতর বেশির ভাগই হাবিজাবি জিনিস, কিন্তু ‘ক’-র আঁকা ছবি একগোছা ছিল, ‘ক’ ওগুলো আমায় দিয়েছিল। আমার কাছে ‘ক’-র স্মৃতিচিহ্ন ভেবে হয়তো বাবা-মা সরিয়ে রেখেছিল ওগুলো, কিন্তু আর কিছু না করুক আমার পুরোনো ভয় আবার বেশ উসকে দিল ছবিগুলো। আমার মনে হলো যেন ‘ক’-র আত্মা আবার ওগুলো থেকে পুনর্জীবন পেয়ে ফিরে আসবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ফের কাগজের মোড়কের মধ্যে ওগুলো ভরে রাখলাম, পরে কখনো ফেলে দেওয়া যাবে ভেবে। কিন্তু সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুদিন দোনোমোনো করার পর আবার একদিন বান্ডিলটা খুলে একরকম জোর করেই বেশ সময় নিয়ে নজর করে দেখলাম ‘ক’-র জলরংয়ে আঁকা ছবিগুলো।

বেশির ভাগই নিসর্গচিত্র, হয় সমুদ্রতটের পরিচিত দৃশ্য, কিংবা বালুর বিচ, পাইন বন, শহরের নানা মহল্লা- অঙ্কনের পরিচ্ছন্নতা ও রঙের ব্যবহার একেবারে স্বতন্ত্র, ঠিক যেমন দেখেছি ‘ক’-র হাত থেকে বেরোতে। এত বছর পরেও ছবিগুলো কী যে জীবন্ত, এবং যেন আমার স্মৃতিতে যতটা আছে তার চেয়েও অধিকতর দক্ষতায় আঁকা। দেখলাম, ছবিগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে আমি উষ্ণতায় ভরা স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছি। বালক বয়সি ‘ক’-র গভীর অনুভূতি পুরোটাই টের পাওয়া যায় ছবিগুলোতে – যেভাবে চোখ মেলেই ও পৃথিবীকে পেয়েছিল। যা কিছু একসঙ্গে করেছিলাম, যেখানে যেখানে একসঙ্গে গিয়েছিলাম, সব যেন আরো তীব্রভাবে ফিরে আসতে লাগল। আমি হৃদয়ঙ্গম করলাম, এই দেখাটা আমার চোখেও ছিল সেই সময়টায়, পাশে হেঁটে যাওয়া ছেলেটির মতোই প্রাণবন্ত, অনাবিল দৃষ্টিতে আমিও তখন পৃথিবীটাকে দেখতাম।

সেদিন থেকে রোজই কাজ থেকে ফিরে ‘ক’ -র ছবিগুলোর থেকে কোনো একটাকে নিয়ে আমি ডেস্কে গিয়ে বসার অভ্যাস তৈরি করে ফেললাম। একটা মাত্র ছবি নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারতাম। প্রতিটা ছবির সঙ্গেই শৈশবের আরো একটা কোমল নিসর্গচিত্র, যা আমি এত দিন স্মৃতি থেকে আড়াল করে রেখেছিলাম, ফিরে আসতে লাগল। টের পাচ্ছিলাম, যখনই ‘ক’-র কোনো একটা ছবি দেখতাম, কিছু একটা আমার মাংসে-মজ্জায় ঢুকে স্থান করে নিচ্ছিল। এভাবেই হয়তো সপ্তাহ খানেক যেতেই এক সন্ধ্যায় এই কথাটার উদয় হলো আমার ভাবনায় : এই এতগুলো বছর আমি সম্ভবত মারাত্মক একটা ভুল করছিলাম। সেই ঢেউয়ের চূড়ায় শায়িত অবস্থায়, ‘ক’ মোটেও ঘৃণা বা অসন্তোষের চোখে আমার দিকে তাকায়নি, মোটেই চেষ্টা করছিল না ওর সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাওয়ার। আর সেই ভয়ানক হাসি আমার দিকে চেয়ে; সেটা দৃষ্টিকোণ আর আলোছায়ার একটা দুর্ঘটনাই নির্ঘাৎ, ‘ক’ মোটেই ওটা সজ্ঞানে করেনি। ততক্ষণে খুব সম্ভবত ওর আর জ্ঞানই ছিল না, অথবা চিরবিচ্ছেদের আগে হয়তো একটা স্মিত হাসি হেসেছিল। যে তীব্র ঘৃণা ওর অভিব্যক্তিতে আমি দেখেছিলাম বলে ভেবেছি, তা হয়তো সেই মুহূর্তে যে দুঃসহ ভয় আমাকে কাবু করে ফেলেছিল, তারই একটা প্রতিফলন।

সেই সন্ধ্যায় অভিনিবেশ সহকারে যতই আমি ‘ক’-র জলরংয়ে আঁকা ছবিগুলো দেখছিলাম ততই গভীরভাবে আমার বিশ্বাসে এই চিন্তাগুলো প্রোথিত হয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার পরেও এক বালকের শান্ত নিষ্পাপ মনের পরিচয় ছাড়া আর কিছু ওতে পাইনি আমি।

বহুক্ষণ বসেই রইলাম নিজের ডেস্কে। আর কিছুই করার মতো ছিল না। সূর্য ডুবে গেল আর একটা ফ্যাকাসে অন্ধকার ঘরটাকে গ্রাস করে নিতে লাগল। তারপর নামল রাত্রির গভীর নৈঃশব্দ্য, অন্তহীন যেন। শেষে একসময় পাল্লা যেন একদিকে ঝুঁকল, অন্ধকার পথ করে দিল উষাকে। নতুন দিনের সূর্য আকাশে ছোপ ধরালো গোলাপি রঙের, পাখিরা জেগে উঠল তাদের গান শুরু করতে। তখন বুঝলাম এবার ফিরতে হবে।

ব্যাগে কয়েকটা জিনিস ভরে নিয়ে, অফিসে ফোন করে ‘যাচ্ছি না’ জানিয়ে দিয়ে, আমি চড়ে বসলাম আমার পুরোনো শহরে যাওয়ার ট্রেনে। যে শান্ত, ছোট, সমুদ্রতীরবর্তী শহর আমার স্মৃতিতে ছিল, তাকে আর পাওয়া গেল না। ষাটের দশকের দ্রুত উন্নয়নের ঠেলায় কাছেই গড়ে উঠেছে এক শিল্পনগরী। তাতে নিসর্গ দৃশ্য গেছে ভালোরকম পাল্টে। স্টেশনের ধারের ছোট্ট গিফট শপটা এখন একটা মল, শহরের একমাত্র সিনেমা হলটি এখন পরিণত হয়েছে সুপার মার্কেটে। আমাদের সাবেক বাড়িটা আর নেই। কয়েক মাস আগে ওটা ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু ধ্বংসাবশেষ জমিতে পড়ে আছে। উঠোনের গাছ সব কেটে ফেলা হয়েছে, কালচে জমিতে এখানে ওখানে আগাছা। ‘ক’ দের বাড়িটাও উধাও, সেখানে কংক্রিটের পার্কিং লট…গাড়ি রাখার জায়গা, ছোট গাড়িতে, ভ্যানে ভর্তি। আমি যে খুব মুষড়ে পড়লাম, তা নয়। বহুদিন আগে থেকেই ওটা আর আমার শহর নেই।

হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের তীরে গেলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম বাঁধের ওপরে। অন্য ধারে সমুদ্র বহুদূর অবধি বিস্তৃত, নির্বাধ, বিশাল, দিগন্ত এক ছেদহীন সরলরেখা। তটরেখাটা যেন হুবহু আগের মতোই আছে। লম্বা বিচ, ঢেউ এসে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, জলের ধারে ধারে মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে। বেলা গড়িয়ে চারটে বেজে গেছে ততক্ষণে, শেষ বিকেলের নরম রোদ যেন নিচে সবকিছুর সঙ্গে লেপ্টে আছে, অস্তগামী সূর্য পশ্চিমমুখো তার দীর্ঘ, প্রায় ধ্যানমগ্ন যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। সেই শান্ত নিসর্গকে নীরবে তারিফ জানিয়েই যেন, ব্যাগটা বালুর ওপরে নামিয়ে রেখে আমি তার পাশেই বসলাম। তখনকার দৃশ্য দেখে কল্পনা করাই মুশকিল যে কখনো ভয়ানক একটা টাইফুন এখানে হানা দিয়েছিল, একটা দৈত্যাকার ঢেউ সারা জগতে আমার প্রিয়তম বন্ধুকে গিলে নিয়েছিল। সেই ভয়ানক ঘটনা স্মরণ করবে এমন কেউ আর এখন নেই নির্ঘাৎ। মনে হচ্ছিল যেন পুরোটাই ছিল একটা বিভ্রম, যা অত বিশদে, যেন চোখের সামনে ঘটেছে, আমি স্বপ্নের মতো করে দেখেছিলাম।

টের পেলাম আমার ভেতরের গভীর অন্ধকারটা মিলিয়ে গেছে। যেমন হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি আকস্মাৎ। বালুতে উঠে দাঁড়িয়ে, জুতো-টুতো কিছু না খুলে, প্যান্টটা না গুটিয়ে আমি সামনে গিয়ে ফেনার মধ্যে দাঁড়ালাম, যাতে ঢেউ এসে আমার গোড়ালি ভিজিয়ে দিতে পারে। যেন সবকিছু মিটিয়ে নিতেই আমার বাল্য বয়সে যেসব ঢেউয়েরা বিচকে ধুয়ে দিয়ে যেত, আবারও এসে যত্ন করে আমার পা ধুয়ে দিতে লাগল, আমার জুতো, মোজা, সব জলে ভিজে গাঢ়তর বর্ণ ধারণ করতে শুরু করল। ধীরে একটা ঢেউ, তারপর বেশ কিছুটা বিরতি, তারপর আরেকটা, এইভাবে আসছিল, যাচ্ছিল। আশপাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল তারা একটু কেমনভাবে তাকাচ্ছিল আমার দিকে, আমি ভ্রুক্ষেপ করলাম না। আমি এখন আবার ফিরে পাচ্ছি সব, অবশেষে।

আকাশের দিকে তাকালাম। ধূসরবর্ণ কয়েকটা তুলোর মতো মেঘ ঝুলে আছে, কোনো নড়াচড়া নেই। মনে হলো আমারই জন্য যেন ওরা তখন ওখানে, যদিও কেন এমন মনে হলো বলতে পারব না। মনে পড়ে গেল, এভাবেই একবার আকাশে তাকিয়ে টাইফুনের চোখ খুঁজেছিলাম। আমার ভেতরে ধাবমান সময়ের অক্ষ যেন এমন সময় বড় করে একবার শ্বাস ফেলল। একটা জীর্ণ সৌধের মতো ধসে পড়ল দীর্ঘ চল্লিশটা বছর, পুরোনো আর নতুন সময় একই শরীরে জড়িয়ে গেল একটা ঘূর্ণিপাকে। সব শব্দ কোথায় অন্তর্হিত, আমার চারপাশের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে আমি ঢেউগুলোতে পড়ে গেলাম। হৃৎপিণ্ডটা গলার পেছনে কোথাও ধকধক করে আওয়াজ করছে, হাতে-পায়ে কোনো সাড় নেই। ওইভাবে পড়ে ছিলাম বেশ কিছুটা সময়, জলে মুখ ডোবানো, উঠতে পারছি না। কিন্তু ভয় পাইনি। একটুও ভয় করছিল না। আর যেন কোথাও ভয় করার মতো কিছু নেই। সেসবের দিন কেটে গেছে।

সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তারপর আর দেখিনি। মাঝরাতে আর্তনাদ করে জেগে ওঠাও আর নেই। চেষ্টা করছি জীবনটা নতুন করে শুরু করতে। জানি, তার পক্ষে হয়তো একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে। হয়তো আর খুব বেশি দিন বাঁচব না। যত দেরিতেই হোক, শেষ অবধি যে একটা মুক্তি এসেছে, এতেই আমি কৃতার্থ, যেভাবেই হোক সামলে যে উঠতে পেরেছি। হ্যাঁ, কৃতার্থই : বিনা উদ্ধারে জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারত, তখনো ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠছি।

সপ্তমজন এবার থামল আর তারপর অন্য সকলের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কারো মুখে কোনো কথা নেই, কেউ নড়ছে চড়ছে না, এমনকি যেন শ্বাসও নিচ্ছে না। সবাই গল্পের বাকিটুকুর অপেক্ষায় আছে। বাইরে, বাতাস থেমে গেছে, সব স্তব্ধ। সপ্তমজন এবার হাতটাকে আবার কলারের কাছে আনল, যেন কথা খুঁজছে।

‘বলা হয় যে ভয় একমাত্র ভয়কেই, তবে আমার বিশ্বাস একটু ভিন্ন,’ একবার বলে। তারপর, একমুহূর্ত পরেই যোগ করে, ‘ভয় তো আছেই। নানা সময়ে, নানা রূপে আমাদের কাছে আসে, আমাদের কাবু করে ফেলে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের কথা যেটা, সেটা হলো, এই সময় আমরা ভয়ের থেকে পালাই, চোখ বুজে ফেলি। এতে করে আমাদের ভেতরের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি নিয়ে সমর্পণ করে বসি অন্যকিছুর কাছে। আমার ক্ষেত্রে এই অন্যকিছুর ভূমিকা নিয়েছিল সেই ঢেউ।

লেখক পরিচিত:
অভিজিৎমুখার্জি
পশ্চিমবঙ্গ।
প্রকৌশলী। অধ্যাপক। অনুবাদক।