চিতাবাঘ চোখের মেয়েটি ও আমি

অন্ধকারে তোমার জ্বলজ্বলে চোখে চিতাবাঘটা দেখে সে ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠল। চিতাবাঘ মানে লামচিতা বা ক্লাউডেড লেপার্ড। সঙ্গী মানবীর চোখে অন্ধকারে এ রকম বাঘ দেখলে কেউ কি স্থির থাকতে পারে। সে তোমার চোখে লামচিতার জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল।
তুমি বললে, কি হলো? চিৎকার করছ কেন? আমি কি বাঘ? সে প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠল, তোমার চোখ দুটি জ্বলছে। বুনো লামচিতার মতো। কোথায় পেলে?
কী যা-তা বলছ? আমি বাঘ হতে যাব কেন? ভালো করে দেখ। নেশা করনি তো! তুমি বললে তাকে।
এ রকম কখনও দেখিনি তো! অথচ চারদিকে নির্ভার আঁধার, লোকজন না থাকলেও এখানে ভয়ের কিছু কখনও দেখিনি। এই পাশের বনেও আজ পর্যন্ত কোনোদিন বাঘ দেখা যায়নি। অথচ তোমার চোখে… বলতে বলতে সে পকেট হাতড়ে টর্চ বের করতে গিয়ে পিস্তলটা বের করে নিল। অন্ধকারেও সে তা বুঝতে পেরে টর্চটা বের করল। টিপ দিয়ে তোমার চোখে ধরল। ওর হাত তখনও কাঁপছে, কুয়াশার মতো।
হঠাৎ জোরালো আলো বেরিয়ে আসাতে তুমি চোখ বন্ধ করে নিলে। সে তখনও থরথর করে কাঁপছে বৃষ্টির মতো। কি বলবে না বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তুমি তখন জোরালো আলোতে চোখ খুলে দিলে। ঘন পাপড়ির মাঝে চোখে বাঘটি নেই। শান্ত নির্ভার কালো চোখের মণি ঘুরপাক খাচ্ছে। পলকে পলকে তুলকালাম। মটকা মেরে না থেকে তুমি কথাবার্তা বদলে ফেললে। অফিসের কথাবার্তা। সবুজ হাওয়া হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়া ইত্যাদি। অফিসটাও এমন যে, দেয়ালের গায়ে বড় বড় গাছ, লতা, পাহাড়ের বাস্তব চিত্র নিখুঁতভাবে মার্বেল পাথরে ফুটিয়ে তোলা। কোথায় যেন জঙ্গলের শব্দ উঠে চারদিকে ছড়িয়ে ভেঙে পড়ছে জ্যান্ত ঢেউয়ের মতো। তুমি এ রকম একটি অদ্ভুত অফিসে চাকরির সন্ধানে এসেছ। আর সে লোকটি স্বয়ং চাকরি দেওয়ার মালিক। সে তোমার চোখে লামচিতা দেখে ভয় পেয়েও চাকরি দেওয়া প্রায় স্থির করে ফেলে। বুনো ভয়ের উন্মাদ শিহরণে। সেটা হয়তো ভয়ের চেয়েও রোমাঞ্চকর মনে করে।
এভাবে গল্পটা তৈরি করলে ঘটনার পর ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমিও জানি না। আর তা না করলে গল্প কোথায় ভেসে যায় তাই-বা কে বলবে! পরিকল্পিতও তো হতে পারে ঘটনার জাল বোনা আর পঞ্চগড়ের বদলে রাঙামাটিকে পটভূমি করলে। কিন্তু তার মধ্যে এসে পড়ল তোমার প্রতি সে লোকটির ভয়ের মধ্যেও আছে বিজন লিপ্সা। অথবা তমসাচ্ছন্ন ভালোবাসা। এক জোড়া চোখে এমন ভয়াবহ দৃশ্য কেইবা দেখতে পায়! পেলেও লোকটির মতো কেইবা ঘুরে দাঁড়ায় পালিয়ে না গিয়ে!
তাহলে পাঠিকা ও পাঠকমিত্র দাঁড়ান, শুনুন। ঘরের ভেতর যত দৃশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করা হোক না কেন লোকটি কখনও এ রকম ভাবতে পারেনি। সে যখন তোমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার আগে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, চলে না গেলে আলোর মধ্যে তোমার চোখ কখনও জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠত না, তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ১০০ ভাগ ঠিক।
আচ্ছা, সে লোকটি যদি ভয় না পেত, চিৎকার না করত, চোখ দুটির লামচিতা বাঘকে ভয় না পেত, তোমাকে জাপটে ধরত, অন্ধকারে ওখানেই কাপড়-চোপড় খুলে একটা সাংঘাতিক ভালোবাসা জাতীয় কিছু করে বসত। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তুমিও যদি কিছু একটা করে বসতে দীর্ঘ সময় নিয়ে, যাকে হ্যাঁ বা না ভালোবাসা দুই-ই বলা যায়… আমাদের গল্প তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! বস্তুত সে রকম ঘটনা কি জীবনে ঘটে না? গল্পে তা সাহস করে লেখা যায় না বিস্তারিতভাবে, তার দরকারও পড়ে না, আমরা ইঙ্গিতেই বুঝে নিতে পারি। বাস্তবে অফিসের সেই কৃত্রিম আরণ্যক পরিবেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় অথবা বিভ্রাট না থাকলেও অনেক কিছু ঘটে যায় নির্জন পরিবেশে। পরিবেশবাদীরা ক্ষমা করবেন, আপনাদের কাজ বন-জঙ্গল-রাস্তা-ঘাট-নদী-সমুদ্র নিয়ে, এদিকে চোখ দেবেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিকরা… মিখাইল শোলকভ, জাঁ পল সার্ত্র, ইউসুনারি কাওয়াবাতা বা মার্কেজ।
ওই আলোর চোখ, ওই লামচিতা, অন্ধকারে ছাড়া যা জ্বলে না, জোরালো আলো পড়লে যা নিমিষে উধাও হয়ে যায়, যাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে গল্প আর গল্প থাকে না, ভালোবাসা হয়ে যায় বাষ্প, বুদবুদ, পুরনো কাসুন্দি… এক জোড়া চোখ, তার সঙ্গে অন্ধকারে কথা বলা, তোমার সঙ্গে সে যা করতে পারত, জেনেও যা সে জানে না এবং করেনি যা সে করতে পারলেও তখন করেনি, তোমার না চাওয়া সে বোঝেনি, চাওয়া থেকেও বহু দূরে সে দাঁড়িয়ে, বোঝেনি, বোঝেনি সে তোমার মনের ভাষা নারীর সহজ ও যুগপৎ অনন্ত রহস্য, আবার বুঝতে পারলেও তা অত্যন্ত সহজ-সরল ও মনোদৈহিক। অফিসের মাঝে যেমন বন বা বনানী সৃষ্টি করা যায়, তেমনি ভালোবাসা করাও হয়। অরণ্যও ভালোবাসা করার জন্য কাঁদে। যে কারণেই হোক তোমরা ভালোবাসা করলে। না যেন কখন হ্যাঁ হয়ে গেল।
তোমার চোখে সে চিতাবাঘ দেখল। তুমি তো দেখনি। সে ভয় পেয়েও করল। তুমি বাধ্য হয়ে করলে ঢেউয়ের পরিণামবশত। তোমার কালো মেঘচিতার স্বভাবশত তুমি গর্জন করলে, কুঁকড়ে বা সুখবশত বা বেদনা-সুখবশত গড়াগড়ি করলে। তুমি তো তোমার চোখ দেখতে পাও না, সে দেখে যুগপৎ ভীত ও রুদ্র হয়েছে। তখন আলো ছিল না, তুমি জান না তখন তোমার কালো নাকি সবুজ চোখ ছিল। হয়তো দেখেছ বা কল্পনা করেছ, হয়তো শুরুটা ওর কথা অনুযায়ী ভেবেছ। তবে শুরু যদি আদৌ থেকে থাকে, শুরু না থাকলে শেষও থাকে না। আর শুরু যদি হয়ে থাকে তার সমাপ্তি বা বেদনাকর সমাপ্তিও থাকে… ভালো কি মন্দ তা পরের কথা। বাধা-বিপত্তির বিবেচনা যখন থাকে না, হঠাৎ যদি আলো এসে যায় অথবা আলো থেকে অন্ধকার চলে আসে, আবার চোখে চিতাবাঘ জ্বলজ্বল করতে থাকে… আর চিতাটা তো আসে শুধু চোখ থেকে, শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে নয়, নিজের চোখটা তো তুমি দেখতে পাও না, পায় সে অর্থাৎ লোকটি। লোকটাও তা বুঝে নিয়েছে এরই মধ্যে, ভাই সে হাত দিয়ে তোমার চোখ দুটি বুজে দিয়ে চিতাকে পরাস্ত করার শিল্প আয়ত্ত করে নিয়েছে। ওই চিতাকে সে যেমন ভয় পায়, তেমনি বশ করে নেওয়ার বিদ্যাও বুঝে নিয়েছে। অন্ধকারে সে তা কৌশলে প্রয়োগ করতে থাকে। সে এখন তোমার নতুন অফিসের প্রধান কর্তা হয়েও তোমাকে মনে মনে ভয় পায়, চিতাবাঘের ভয়। অফিসের শৃঙ্খলার চেয়ে চিতাবাঘ অনেক বেশি বিপজ্জনক আবার উত্তেজনায় আনন্দকরও। আবার লোকটির চাপের মধ্যে চিতাবাঘের কল্পগর্জন প্রচণ্ড সুখকর। সুখকর আরও বেশি তোমার শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে চিতাটা বেরিয়ে আসতে পারে না। বক্ষ, নাভি, ওষ্ঠ, নিতম্ব বা ঊরুসন্ধি কোথাও থেকে নয়। তাতে সে প্রমত্ত হয়ে তোমার পাশে এমনকি নিদ্রা পর্যন্ত কামনা করতে পারে মনে করে। তবু ভয় তার থেকেই যায়। যে যা বলুক বাঘিনীর ভয় হিংস্রতায় ভরা, বাঘও তাকে ভয় পায় একটা সময় ছাড়া।
কিন্তু তুমি পারলে না। চলে গেলে চোখের ডাক্তারের কাছে চিরতরে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করেও কিছু পায় না। চিকিৎসাশাস্ত্রের সব সম্ভাবনা ও আবিষ্কার আঁতিপাঁতি করেও কিছু খুঁজে পায় না। শুধু চোখ নয়, শরীরের অন্য কোথাও খোঁজে তন্ন তন্ন করে। তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাক। জীবন যেমন হয় আরকি। নারীরও যেমন।
গল্পটি এখানে দু-একটা কথা বলে শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু জীবন বোধকরি তা নয় বা পছন্দ করে না। দু-একটা প্রশ্ন উঠে আসে। একটির মাঝে দ্বিতীয় গল্প থেকে যায়। উঁকি মারে। আর্জি জানায়।
ধূসর-কালো লামচিতার ডোরাকাটা দাগ উজ্জ্বল হয়ে দেখা যায়। লম্বা লেজ ও চাবুকের মতো শরীরে থাকে দুর্দান্ত দুটি বিধ্বংসী চোখ। কিন্তু বেচারি লামচিতা লুপ্ত হতে হতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পার্বত্য আগরতলা ও পার্শ্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম, আসাম ও বার্মা অঞ্চলে। চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরীরাও সুখে নেই একই সূত্রে, রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও নানা দেশে ছুটে যাচ্ছে। ঢাকায় ওদের গতিবিধি স্বাভাবিক নয়। মরুক গো ছাই, তোমার সমস্যাই এখন বড়। তোমার সমস্যার সুরাহা করতে না পেরে চক্ষু ডাক্তার আনন্দ-ফুর্তি থেকে দূরে থাকে। তুমি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেই পার। তোমার মা-বাবা সাধারণ গরিব শিক্ষিত গৃহস্থ। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত নিসর্গের মতো, তুমি তার ওপর ছিলে বাড়ির রোজগেরে বড় সন্তান। আনন্দ-ফুর্তি একসময় যাতনা দেয়, দূরে থাকতে বলে। আনন্দ কতদিন আর ভালো লাগে যাতনায়? আনন্দময়-যাতনা হলেও কথা ছিল। তোমার কালো অতল চোখে ছিল পদ্মাদীঘির টলমল জল, ছিল শৈশব-কৈশোরের অপাপবিদ্ধ সময়। আর সেখানে হানা দিল চাকরিদাতা। চিঠির ভাষা মুসাবিদার নামে তোমার ভাবনাতেও আসত না তোমার ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়বে বা তুমি ওর ওপর খেলাচ্ছলে তেমন কিছু একটা করে বসবে। পার্বত্য অঞ্চলেও এমন সব অপকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে উন্নয়নের নামে, সাহায্য সংস্থার খোলসে। তার চেয়ে চক্ষু ডাক্তার অনেক সংবেদনশীল। তবে পূর্ব চাকরিদাতাও কম সংবেদনশীল ছিল না। তার ব্যবহারে কোনো ঘাটতি থাকলে তাকে সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে শোধরানোর। সেটা না দিয়ে তোমার দিকে সবাই ঝুঁকে পড়েছে। অথচ তুমি তেমন কিছু কেউ-কেটা নও। তোমার সম্পদ বলতে চোখের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা চিতাটা। তাও বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর প্রতি আসলে সবার সহানুভূতি একটু বেশি। যারা কিছুই বোঝে না তারাও সহানুভূতিশীল। এটিই আধুনিক পৃৃথিবীর ধর্ম হয়ে যাচ্ছে। অথচ অসহায় তুমি। তুমি অন্ধকারকে ভয় পাও। কারণ অন্ধকারেই শুধু তোমার চোখের চিতা দেখা যায়। আলোতে দেখা যাওয়ার কথা নয়। বাঘ, সিংহ, হরিণ, মোষ সবার চোখ অন্ধকারে জ্বলে। মানুষের জ্বলে না, বানরেরাও না। আর তুমি ঘুমুলে চিতাটা জ্বলে না। কাজেই সমস্যাটা তোমার ব্যক্তিগত নয় বলা যায় না। আবার চিতাটা তোমার চোখ থেকে বেরিয়ে খাবার খুঁজতে যায় না, কাউকে আক্রমণও করে না। এমনকি তার নিজস্ব কোনো ভালোবাসা করার বাসনাও দেখা যায় না। তাহলে? তোমার মাধ্যমে করে?
তাহলে এটা তোমার ব্যক্তিগত জটিল মনোদৈহিক সমস্যা। আমরা তার সমাধান বের করতে পারব যথেষ্ট সময় ব্যয় করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে তবেই।
ঠিক এই সময়ে আমি গিয়ে পেঁৗছলাম খাগড়াছড়িতে। আর কাকতালীয়ভাবে জেনে গেলাম তোমার সব কথা।
এ রকম ঘটনা ভূ-বাংলায়ও দু-একটি ঘটে। তোমার প্রসঙ্গে আমার জীবনেও ঘটে গেল। বাস্তবেও যেন ঘটে, গল্পেও ঘটে যায়। খাগড়াছড়ির রিন ছং ঝরনা দেখে আসার সময় বিপত্তিটা ঘটল। কী করে যে পথ হারালাম, কখন যে রাত নেমে এলো আমিও বিস্মিত হয়ে গেলাম। আশপাশে জনবসতি নেই। রাতে আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই। শুক্লপক্ষও নয় যে চাঁদ উঠবে। জুমের ফসলও উঠে গেছে বলে মোনঘরে কোনো বাসিন্দা নেই। ফসল নেই বলে বানর-হরিণও আসার সম্ভাবনা নেই। অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছুই চারদিকে নেই। অন্ধকারে পাহাড় যেমন পড়ে থাকে সে রকম পড়ে রইল। মোনঘরটির বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের আঁধার ছাড়া ঢোকার কিছু নেই। ভেতরে খড়কুটো জড়ো করে শুয়ে পড়ব কি-না ভাবছি। আসার সময় লোকজন থেকে জেনে এসেছিলাম। পাহাড়ের একেবারে নিচে ঝরনা। সেখান থেকে উঠে আসা, পথ চেনা, ফিরে যাওয়া, অন্ধকারে পথ চেনা… এসব তো দু-দশ মিনিটের ব্যাপার নয়। চাঁদও উঠল না কৃষ্ণপক্ষ বলে। ঘুমিয়ে পড়ব বলেই ঠিক করলাম। শীত ও ঠাণ্ডা নামল, যেন ঝপ শব্দ করে। অদূরে পাশের পাহাড়ে আলো জ্বলছে। তাহলে ওটা পাড়া বা গ্রাম। এটা পরিত্যক্ত জুমক্ষেত। শীত আক্রমণ শুরু করল। গায়ে শীতের যে কাপড় আছে তা যথেষ্ট। কিন্তু ঘুমানোর উপযোগী হলো লেপ-তোশক বা কাঁথা-কম্বল। তোশকের দরকার নেই। শুকনো খড় আছে। খড়ও গায়ে দেওয়া যায়, সে রকম উপযুক্ত সোমত্ত বয়সী হলে।
পরিত্যক্ত জুমের একলা মোনঘর সন্ত্রাস না থাকলে কী যে নিরবচ্ছিন্ন সুখকর তা আমি জেনে এসেছি। আমার স্কুলের বন্ধু বাসন্তী, ছবি, রফি, দীপিতাসহ সবারই জীবন দিয়ে। তোমার চোখের লামচিতা চোখ থেকে গর্ভাশয়ে যাবে বলে চোখের ডাক্তার সতর্ক করে দিয়েছে। তার আগে তাকে শেষ করতে না পারলে সবল হৃৎপিণ্ডে হানা দিতে পারে জানিয়েছে। একে একে সবাই তোমাকে খাদ্যভুক্ত করেছে। অনেক ঘাটের পানি তুমি খেয়েছ বাধ্য হয়ে অতৃপ্তিভরে। শুধু বাঁচার জন্য বা স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার জন্য। স্বপ্ন শুধু দেখা নয়, ছোঁয়ার জন্য। সবাই একে একে চলে গেছে উল্কা ও ধূমকেতুর মতো। তোমার চিতাবাঘটাকে কেউ ভালোবাসল না অসাময়িকভাবেও। ভয়ের কথা বলেছে কিন্তু ভয় তাড়ানোর কোনো সহানুভূতি ও সাহায্য করেনি।
তুমি এলে। পরিত্যক্ত মোনঘরে। খড়-বিছালির শয্যায়, শীতের পাহাড়ি হিমগ্নতায়, খড়ের নিবিড় শব্দশিল্পে, উত্তাল বাংলাদেশের ঢোলের শব্দও পরোয়া না করে, যাকে লোকে বলে ভালোবাসা তা শেখালে, যাকে ঘৃণা বলে তাও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিলে, বিরহ ও বিচ্ছেদ কাকে বলে সুসঙ্গমে তা বর্ণনা করে দেখালে, চিরমিলন বলে কিছু নেই তাও তোমার কাছে প্রথম শুনলাম অধরে-শরীরে, আবার দেখা হওয়ার আশা-নিরাশার রহস্য তুমি ভেঙে চুরে ছত্রখান করে শেখালে। কারণ এরই মধ্যে তুমি এক ‘মৈত্রী-করুণা-মুদিতা-উপেক্ষা’র কাছে দীক্ষা নিয়ে আমার সঙ্গমে এসেছ আর কালো লামচিতার চোখ তুমি আমার কাছে সঞ্চিত করে রেখেছ, যে ব্যাপারটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একেবারেই আলাদা, অধরা ও অপাপবিদ্ধ।
এখন আমরা দু’জনেই কি ওই লামচিতার দুই চোখের অধিকারী নই!