"অশ্রুপার্বণ"….কাজী নাসির মামুন'র দীর্ঘ কবিতা…

 

//অশ্রুপার্বণ//

 

আয়ুর আকাশে চিরদিন
একটি দীঘল কালো মেঘ
………….অনন্ত উপেক্ষা নিয়ে
জীবনকে পরিহাস করে; তবু ভালো লাগে শালিখ পাখির
আলাপচারিতা, ভালো লাগে
……………..বিহঙ্গ মর্মর ।
কখনো তাদের
বিদীর্ণ সংলাপ, ক্রোত্ ক্রোত্ ভালোবাসা দেখে
আমি যে শিখতে পাই আমার অন্তিম পলায়ন বিদ্যা !
মৃত্যু প্রহেলিকার ডুমুর গাছ কীভাবে চিনতে হয়
………………………………ফুলের অস্তিত্ব ছাড়া
সেইটুকু মন্ত্রমনোযোগ;
কেবলি দেখতে পাই
………………………….অন্ধের দু’চোখ ভরা দৃশ্য !

 

 

১.

সে আসলে তুষার বালক;
গলে যেতে এসেছিল কাগজের সরল নৌকায়
………………..ভাসতে ভাসতে জং ধরা পৃথিবীতে একবার ।
তার স্মৃতি, সুপ্ত কুশলতা
কর্তিত যৌবনে দেহমুক্ত প্রাণ, বিঘ্নিত সংগ্রাম
আর তাকে ঘিরে সমবেত বেদনার অভিন্ন প্রলাপ
যেন সব ঔরসের পাদবিন্দু; স্লেটের পেন্সিলে এঁকে
………………. নিজেই মুছতে হলো বাবাকে; মায়ের
বনজ হৃদয়ে শুধু একটি হলুদ পাতা গাছ থেকে পড়ে গেল ।
গাছের গুঁড়ির মতো অনড় মন্থর পরিভাষা
আমিতো জানিনা কিছু ! বাবাকে দেখেছি
সহসা পারেন; মা-ও খুব প্রেমপ্রত্নভরা নিপুণ পাথর ।
…………সূর্যাস্ত মহিমাটুকু আঁচলে বাঁধতে গিয়ে
দূর আকাশের ধ্রুবতারা
নিজের সন্তান বলে ভাবতে পারেন
……….সারারাত তাকিয়ে তাকিয়ে;
আশ্বস্ত নীলিমা ছুঁয়ে এতটা নীরব, তবু
আমাকে ডাকেন, এই দেখ,
রেহেলের কোরান পাতায়
কালো অক্ষরের মতো সত্য এই রাত ।
কখনো সবুজ পত্রাঞ্জলিমাখা বাদা বনে
…….. নির্মোক সরিয়ে চুমো খাস
পূর্ণ রূপসীরে;
গগন পুস্তকে তার নাম লিখা ।
কম্পিতা পৃথিবী দেখে ভয় পাস ?
ডাগর দুনিয়া বড়ো নিরন্ন কৌতুক !
মোহিত রক্তের সিঁড়ি বেয়ে
কোন গান নেমে আসে শরীরে সবার ?
যৌবন ! যৌবন ! আহা, কত লাল ঋতু রোমন্থনে
পুণ্য পাপ  রোদ্র  জলকনা দিয়ে
সোনালী মোড়কে বাঁধা এই নাম !
খুলে দেখ, নীল ফিতা গেঁড়ো দিয়ে
…………………কেউ কেউ বেঁধেছে কোকিল ।
অশান্ত রণ-পা
শিকল পড়ে না কারো; যদি কোনোদিন
রক্তে জাগে অপারগ রূপের নিখিল
বলে, আয়, রাক্ষস দুর্জয় !
ব্যাকুল হৃদয়ে তুই একটি নিহিত ফুল
…………….হাতে নিস, শুধু বুঝে নিস অনাদর ।
তোর ভাই আটাশ বছর
কত রূপ স্বপ্ন গ্রন্থনার কাকাতুয়া
শোণিত নৃত্যের প্রলোভনে
ভুলিয়ে ভালিয়ে এতকাল
নিজে কেন পলাতক আজ ?
এই চোখ পানির জাহাজ ।
বৃষ্টি মুদ্রণের চারুকলা সারাদিন ভেসে থাকে
জাহাজে আমার; কত মৃত্যু, পরম্পরা, কীট, কৌরবের
………………………..দংশন, ললিত প্রেম নারীদের;
……………………………ফুল পাখি চন্দনের
ধারাপাতে কামনা মৌতাত, শত্রু ক্ষমাহীন, দুরূহ জীবন
…………………আর রমণী রঙিনসব পুরুষকে
দেখে দেখে মনে হয়, অচ্ছুত বেদনা
সানন্দে পোষণ করে একমাত্র মানুষ । সে তার
হাতে লাঠি, মুখে আগুনের হল্কা নিয়ে গজরায় ।
অকাট্য রক্তের মায়ারূপ–ভাই পুত্র সমাদরে
মানুষ কেন যে ধরে রাখে !
নির্মেদ প্রস্তুতি ছাড়া জীবন তাহলে
কী আর ? কেবলি দেখি, তোর ভাই
………..লাঠির প্রহার থেকে সরে গেছে;
…………আগুনের হল্কা থেকে নেমে গেছে ।
তার মুখ, লঙ্ঘিত হাত পা
মাটির পয়ারে বাঁধা চামড়ার হলুদ বরণ
আর তার অশ্রুত স্বপ্নকে ছুঁয়ে যায়
অরণ্য-রূপক এক সম্ভাব্য হরিণ ।
যেন সে-ই প্রজ্ঞা লাবনির এক বনপথে
…………’মা’ ‘মা’ বলে আমাকে ডাকছে ।

 

মায়ের কথার মধ্যে রক্তের গ্রন্থন
অনেক শিখর উঁচু হিমালয় যেন ।
আমার আত্মায় সেই ভার, সেই অস্ফুট পর্বত
একটি সম্পাতি পাখি এসে নিয়ে যাবে ?
তারার মাস্তুলে বসে বয়ান-পল্লবে শুধু
একটি গাছের কথা, একটি দোয়েল আর মরমী ফড়িং
তুলে এনে আমিও নির্ভার
সুদূর কবিতা হবো,
……………..মা শুনবে ?

 

২.
বজ্র বিদ্যুতের হাল ধরে কোন মেঘ তারা ?
………….. কোন সত্য ঝিলিমিলি ? চিতল মাছের মতো সাদা ?
বঁড়শিতে গেঁথে নিয়ে, বিদ্ধ করে শত শত কোঁচ
আমি কেন দেখি না তড়াস
বাবা ও মায়ের ? দেখি যাপনের কত তীর, বর্শা, কত
কাঁটার স্থাপনা খুব সযত্নে শোষণ করে করে একদিন
আমূল বিরুদ্ধ হয়ে দু’হাতে ফেরান ।
চুমুক চুম্বন আর চোষ্য থেকে দূরে যেতে যেতে
……………আরেক অতল স্পর্শবোধ যজ্ঞ অভিলাষ টের পেয়ে
…………………নড়ে উঠি প্ররোচিত আবেগে আমার; তবু জঠর অনেক
পরাক্রান্ত প্রেমস্বত্বভোগী
তৃষিত ইচ্ছায় জ্বলে ওঠে ।
কে তাকে ফেরায় ?
কি যে টান ! অনন্ত প্রশ্রয় এই লাল কারাভোগ !
যদি ঘুম যাই শষ্পদল ফেলে এসে, ফেলে আসি
মুখর গোলাপ, কোনো পদ্মিনী নারীকে
আমার হঠাৎ ঝড়ো বাউরি আগুনে
…………….. দস্যু কবলিত, আমি চাইবো না ফিরে যাই, রক্ষা করি
যৌন মোহপিণ্ড ওই মাতৃজাত; হয়তো পারবো
স্বেচ্ছায় পুড়িয়ে দিতে পতন-রঙিন কোনো সম্পর্ক শিখর–
মায়ের আস্থায়
বাবার প্রবল উজ্জীবনে
নিহিত নির্মম এক বিদগ্ধ সন্তান ।
মনে হবে, পৃথিবীর ক’পাটি দাঁতের মতো
…………………. উড়ে গেল সাদা বক; ভূতল সমাধি তার গান গেয়ে যাক…
তবু পারবো না
আকাশের নীলিম জামায়
জলের আস্তিন ছুঁয়ে এসে
…………….সমান সূর্যের ভূমিকায়
প্রদাহ ছড়িয়ে দিতে জীবনের; অঝোর বৃষ্টির মতো ঝরে যাবো
………………………………..অন্তর্লোকে বিপ্রতীপ;
জলো হতে হতে যাবে মানবতা ফল্গু সুখ হর্ষ কাম জন্মান্ধ প্রেমের ।
বাবা যে শোষকভুক্ত; গাছের কোটরে বসে জেনেছেন কাঠ হওয়া ।
স্পন্দনের বিপরীতে আরেক নিষ্প্রাণ অধিকার
আসবাব ছড়িয়ে দেওয়ার নাম পিতৃত্ব ? দাহক

………………………তবু সুর সঙ্গ অন্ত্যমিলে লেলিহান
জীবনের ভব নাম শাঁখের করাত, মা-ও জানে ।
চেরাইয়ের কাঠের গুঁড়োয়
এই তবে অসভ্য সংসার–
স’মিলে স’মিলে তার করাল হা-এর মতো জেগে থাকে ত্রাস ।
মা কি সোনাবিল ?
উদার মাঠের বুকে একমুঠো সজল দম্ভের রাণী ?
জগৎ মন্দ্রিত সব সাদা স্বচ্ছ অমৃত মধুকে
নিজের ভিতরে নিয়ে বুকের বাষ্পকে বলে,
…………………উড়ে যা, স্থবির মোহমাংস ।
আয়, তবে ডামবো হাতি, শুঁড়ে গুঁজে নিয়ে
কাকের পালক
……………………………..কিছুটা উদ্দেশ্য হোক মৌন পরপার ।
তার মনে ঘুঘুর উজাড় বাড়ি জমা করে রাখা ।
অস্থিতির পাতিকাক ঘুমকুমারের
অনিচ্ছা মৃত্যুর অলসতা দিয়ে তৈরি করে
…………………. তাকেই দিয়েছে সেই জাদু, আর বাবাকে কুহক ।
শিশুর প্রশ্নের মতো চকিত, সরল
নির্ঝরে বিমর্ষ করা কে সেই ঘুমকুমার ? নিরত বাদুড় ?
……………….. যেন হৃৎপিন্ড ঝোলে বাবা ও মায়ের ?
বলে, আয় । জুয়া খেলি, ভাই ।
হেরেছি সকল পুচ্ছ, মেঘ

…………….সোনার ময়ূর ।
সব তুই একা
তুলে নে এবার ।

 

সে আসলে তুষার বালক
গলে যেতে এসেছিল কাগজের সরল নৌকায়
……………………..ভাসতে ভাসতে জং ধরা পৃথিবীতে একবার ।

 

৩.

কোন সহোদর আমি ?
বলি, ভাই বড় ধন; বলি,
শোণিত চক্রের মৌমাছি আমরা; এই একতা সুফল
করুণ গুঞ্জনে ভরে দিয়ে
সে যে একা গেল !
কালের নিবন্ধে সে কি মূর্ছিত অক্ষর ? সারারাত তার
……………….নিথর কপাল ছুঁয়ে এত যে বেদনাপাঠ, ক্রন্দন জ্যামিতি
সবার, সেটা কি সূক্ষ্ণ নিজের ললাট ?
তবে কেন ছড়াই সন্তাপ ?
বাবা যে পারেন, মা যে পারেন দুনিয়া আলোড়িত
সবটুকু রক্তিম বুদ্বুদ
…………..পরোক্ষ সঙ্কেতে হাওয়া করে দিতে ?
মা কি তবে বেদনারহিত কেউ ? ভুলে আছে যাতনার রক্তকোকনদ ?
বাবা কি শত্রুঘ্ন ঋষি ? হৃদয়ে স্পন্দিত এক অমূল্য বিষাদ, তবু
…………………………ডুমুর ফুলের মতো অদৃশ্য ব্যঞ্জনে ভাষাহীন ?

 

 

শোন ভাই, পরিজন
মোরগ মুরগী
ফলত মহিষ আর মোহের দম্পতি
কপোত কপোতি এই পৃথিবীর ; হয়তো অনেক কথা প্রশ্নসমবেত,
আর তার সমাধান আখের খেতের পাশে ফেলে আসি ; তার
……………………….. চিকন লুম্বাটে গুচ্ছ পাতার আঁচড়
স্মরণে আনতে গিয়ে ভাবি,
মা আমার চিনির তরল ।
বাবা খুব দানাদার, জলে মিশে আছে ।
সেই রস পান করে নারী ও রঙ্গন ফুলে জীবন জড়িয়ে খুব জানলাম,
………………………যৌবন প্রেমকে বোঝে উৎসবের  মতো ।
যেন সে বিনম্র দাস, নখর সন্ত্রাসী
পাগল, ইজারাদার সহজ সমর্পণের; কথা ও গল্পের
কিনারায় শিখা ও স্রোতের
ইশারা ঘনিয়ে বলে, আমিই প্রথম বিন্দু শেষ হতে চাই
…………………………দিব্যগন্ধ চম্পক পরিয়ে
……………………………. তোমার খোপায় ।
বহুদিন আমি কৃকলাস–সপ্তপর্ণীতলে উপবন ছেয়ে আছি একা একা;
মধ্যস্বত্বভোগী অমরাতে
দেখবো গমন চিহ্ন পুলোমার; তুমি সেই আমার পুলোমা
ধরো আমি ভৃগু ঋষি, নিরন্ন ভিক্ষুক ।
………………………..প্রেম চাই আজ ।

 

ভাইয়ের মৃত্যুর দিনে
আমি সেই অনন্ত প্রেমের অগ্নি আর ঘোলা জলে
গলিত পুচ্ছের মতো জেগে উঠি বিরোধী আভায় ।
তার প্রেমিকার শোক অঝোর সশ্রম কান্না দেখে মনে হয়
ধ্বংস ও লীলার মাঝে প্রেম এক অচ্ছুত সুন্দর !
যেনো ডুমো মাছি মৃত পাঁজরের দিকে শূন্য মহিমা ছড়ায়;
স্খলিত হৃদয়ে তবু অদম্য সঞ্চয়–
………………….কালি ও গৌরব রক্ত সূচনার ।
দেবালয় পুর্ণ করে যদি সত্য মানি অভিনয়,
তবে ঘাত, স্বপ্ন
রহস্য মোচন আর সোনার কুঠার
ভিন্ন কিছু নয়, এক বিন্দু হেয় নশ্বরতা ।
যদি প্রেম হতো বাঁশি,
বানিয়ে দিতাম লিচুপাতা দিয়ে; দিতাম রঙিন শঙ্খ অযুত নিযুত ।
যদি লামা বৌদ্ধ সুন্দরীকে
মঠের দুয়ারে বেঁধে বলতাম নির্বাণ প্রান্তরে দেখো
…………….এই যে দিয়েছি মরা ভাই, ডেকে তোলো ।
কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, নাচো ।
……………..ফলাও তোমার রক্ত পায়ে পায়ে ।
প্রেমের নির্মিতি–হে নশ্বর হেয় ক্ষণকাল, বলো, গোধূলি সঞ্চার,
কী হতো নীল নভোসঙ্গীত ?

 

অবগাহনের যেই পাড়ে এই প্রশ্ন
দুয়ার খুলতে চায়, সেখানে মৃত্যুও  স্থিত লজ্জাবতী,
অনঙ্গ আলোর দিকে চুপচাপ; বাসনা মন্দির ফুটো করে
সত্যের সকল অপলাপ এইখানে মুছে দিয়ে যায়
…………..রোমকূপ ঘিরে থাকা লিলুয়া বাতাস ।
হাঙর মানুষ
মোরগ মুরগী আর গরু মহিষের
………..সোনার কাঠামো ঠিক এইখানে দারুণ অবলীলায়
ভেঙেচুরে এক হয়ে যায় ।
কে বলে সমাপ্তি গান এমন ফুৎকারে ? শেষ কোকিলের পাখা দিয়ে
……………………………..আমিও গড়েছি তাই মৃত্যুর সঞ্চয় ?

 

 

৪.

মমি করা ফেরাউন তার দেহ থেকে একটু একটু ইতিহাস
………………আমাকে দিয়েছে খুব সযত্ন ভঙ্গিতে ।
ঝালরের মতো সেই ঘুম
বিমূঢ় সাজিয়ে রেখে আমি-যে গড়েছি এক পাতালপুরীর সিংহাসন
তাকেই বলছি পিরামিড—
……………..এখানে ঘাসের শয্যা আগুন মঞ্জুরি দিয়ে কে-যে
পুড়েছে, অক্ষম ঘূর্ণিবায়ু কিছু তার
বলে না এখন । বলে রক্ত,
……………………..হাড়ের কাহিনী,
সাদ্দাদ কারূন রুক্ষ রাবণের সংশয় বিভূতি ।
কিছুই নেই না আমি; শুধু মোহপাশ থেকে
একটি লাবন্য এনে বুঝতে চেয়েছি নিজে, কোথায় আমার মর্মপীড়া;
কোথায় নিষুপ্তিমুখ, যেখানে নির্মম বাড়ি বানিয়ে রেখেছে এক অরূপ মাকড়
আমার আত্মাকে ঘিরে; তার জাল, জটিল আরম্ভ আর অন্তিম খুনের রঙে
…………..কিছু পাপ, ব্যহত ঘূর্ণন প্রলোভনসহ
……………………………আমাকে ডাকছে ।
আমি কি যে পেন্ডুলাম দুলে উঠি ইচ্ছার সংগ্রামে ।
হয়তো অনেক মাহামৃত্যু থেকে এভাবে জাগতে শেখে মরাল ভৌতিক ।
‘ভাই’ ‘ভাই’ বলে উড়ে আসে ।
মায়ের পিঞ্জর বলে, থাক;
বাবার প্রিয়তা বলে, রয়ে যা । থাকে না,
……………….সে স্মৃতির পুঞ্জ ?
………….গ্রহের বিভ্রমে তাকে দেখা যায় ?
তার এই চলে যাওয়া থেকে
একটি সান্তনা
সোনার বল্মীকে রেখে আনত শরীর
অঝোর বাণীর মতো আমাকে বলেছে,
…………………..আমিও অনেক পুষ্পবৃষ্টি পাবো ।
পাবো কপোতাক্ষ শস্যসমতল;
অনেক পর্বত পাখি গৃধিনী শকুন কলাপাতা–
নিরন্তর অনেক আকাশ খেরোখাতা খুললেই পাবো আমার বাবার ।
সূর্যের জীবন্ত গ্রাফ ঘিলুমধ্যমায়
সাজিয়ে নিলেই হলো । সূর্যকি মূর্ছনা ?
ফসলে ছড়িয়ে দেয় তন্দ্রার কামড় ?
তবু কেউ বর্ণাঢ্য প্রাণের
নিশানা মুঠোয় নিয়ে ছুঁড়ে দেয়; বুঝে ফেলে নিষ্পন্ন জন্মের
……………………….ধূলিঘেরা রহস্য নির্মাণ এই জীবনের ।
কদম ফুলের সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক জানে কারো কারো ভেজা চোখ ।
তবে কি নিহিত কিছু জলাঞ্জলি সিক্ত আলো বেদনা অনন্যোপায়
…………………………………..হৃদয়ের গান গেয়ে ফেরে ?
তখন মৃত্যুকে জীবনের চেয়ে মর্মভেদী নির্বিষ সভ্যতা মনে হয় ?
শূন্য মরুভূমির উটের কূঁজ দেখে মনে হয়
নতুন কবর উঁচু হয়ে আছে ? যেন পিরামিড ?
সেখানে আমার ভাই ? প্রয়াত প্রেমিক ?
কামিনী ফুলের মতো তুমি কেন সৌরভ হলে না সূক্ষ্ণ মহাকাল ?
গন্ধের মোড়কে তাকে বাঁধিয়ে নিতাম ।
রেশম পোকার মতো সে-যে
গুটিয়ে রয়েছে
লালার প্রাসাদে খুব একা ।
সে কি উট ? নিজেই বিমূঢ় ?
হয়তো তৃষ্ণায় তার অনেক বহনক্ষম নিরীহ শক্তির প্ররোচনা
অসতর্ক দৌড়ের ব্যাপক কলরোল
জল তাকে দেয় নাই, দিয়েছে প্রথম চোরাবালি;
তবু সে দৌড়ায়; তবু আয়ুর মায়ায় তার বিদীর্ণ তৃষ্ণার
জল খুঁজে ফেরে আর দেখে
……………জলের বদলে এক তিমির রৌদ্রের ঝিকিমিকি
বিনীত সত্তায় জেঁকে বসেছে তখন ।
হয়তো বাঁচার সত্যে তখন সুডৌল তরমুজে
তুমুল নিঃশ্বাস খোঁজে অতর্কিত প্রাণের পেখম;
মরুর উদ্যানভরা হয়তো খেঁজুর গাছ, যার চোখা চোখা গোড়ালির ‘পরে
কামড় বসিয়ে উট রক্ত খায়; নিজের বিবরে তা-ই জল মনে করে ।
আপন রক্তই তার তৃষ্ণার নিয়তি ।
আমার নিয়তি কি অর্ধেক পোয়াপিঠে ?
বাকিটা অর্ধেক যেন ঘুমবীজ–মাটির কন্দরে গেঁথে এসে
ভাবছি কোথাও বাউলের মর্ম থেকে স্বপ্ন তুলে নেবো;
…………………..নেবো গান পাখালি মৃদঙ্গ আর নদী;
বটের ছায়ার মতো নিঝুম বিবেক
দেবে না বাউল ?
বলবো, তুমই
আমার হারানো ভাই–আধখানা পোয়াপিঠে ।

 

 

সেই পিঠে গাছ
আজকে আমাকে পায়; আমাকে পাথর করে অবনত প্রফুল্ল মহিষ ।
ব্যাঙ্গোমা ব্যাঙ্গোমী আর সমূহ নন্দিত রূপরেখা মহাজগতের ।
নির্মেদ সত্যকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
পরাভূত সকল সুন্দর একজোট হয়ে গেছে বেদনায় ?
তবে যে দেখছি
একটি কুকুর
সহজে ঘুমায়, সহজেই জেগে উঠে ।
বিষাদ পালন করে কোন হাঁস ?
…………….জলস্মৃতি ফেলে দেয় সাঁতারের পর ।
শুধু এক গর্ভবতী সন্ধ্যা
মায়ের আহ্লাদ থেকে চুরি করে অর্ধেক নিঃশ্বাস
কালো হয় । ফুলে ফেঁপে ওঠে ।
আকাশে ফোঁটায় বাচ্চা অনেক তারার ?
সেই পাঠপ্রতিক্রিয়া, ছবির আদলে আর কত বিষ বুকে নিয়ে
আমার বাবার খেরোখাতা যেন রেকর্ড প্লেয়ার ।
বাজে রকমারি গান, গৃহীত জীবন, বাজে ঘণ্টাঃ
…………………………………ঢং ঢং ঢং
নীরন্ধ্র মস্তকে তুলে নিয়ে
ওই সব চিন্তার নির্ঝর আমি রোজ খুলে খুলে পড়িঃ

 

ওরে, পিনোকিও
কাঠের পুতুল–মূর্ত অনাথ আমার,
………………….নীলিম পরীকে বলে
ঝিঁঝিঁ পোকা ঝিমনির সোনার বিবেক
এখানে ফেলে দিয়ে যাস ।
জারজ প্রাণেরা চায় পিতৃস্বত্ব আজ ।

 

জীবন একটা চারভূজ পরিসীমা ।
মাঝে তার উলম্ব রেখায় কত রোগ গ্লানি শস্যহানি
পরাহত রক্তের বিদ্যুৎ
নীরস বিক্রমে পার হয়ে এসে একদিন ভাঙ্গে
  ………………. ইন্দ্রিয়প্রমাদ
  ………………..ভাঙ্গে শুল্কসভা
ফেরে না প্রাণজ কেউ
সীমিত চতুর্ভূজের…এখানে নিঃশেষ
এখানে অতিক্রমণ শেষ হয়ে যায় ।

 

যদি হও সত্যের অর্জুন
উদোম নূহের জীবন ।
  …………শুধু এক বুড়ি অন্য পরিনামে
 কিছু দেখেনি জল বন্যা হতাহত…
সে কি তার আগে
মুসার সর্পের হোতা আলোর ওঝাকে ভয় পেয়েছিল ?
 ……………..দেখেছিল অঙ্গের নগ্নতা,
……………..পুরুষ্ট আগুন, ক্লীব, রুহ্
সুদীর্ঘ ইচ্ছায় ?

 

‘ হে নিদ্রার বাপ, জেগে ওঠো ‘

 

৫.

শীত সমাকীর্ণ
কয়েকটি জলের ফোঁটায়
অমোঘ লিখতে গিয়ে জীবন…জীবন
ভেবে দেখি, আমার মা প্রতিকল্প হবে না কারোর ।
বাবাও হবে না কারো বিকল্প স্বরূপ ।
তবু রোজ মায়ের প্রকোপ থেকে সরে যাই; বাবার নির্জলা
উপস্থিতি মান্য করে দূরে আসি; দেখি, মৃত ভাই
বিমূঢ় পঞ্জিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহাকালে ।
অনুষ্ঠান বিগলিত এই নাম মুছে যেতে থাকে ।
মুছে যায় সরব জনতাবন, সুহৃদ আত্মীয়া যারা, প্রিয় মুখ নারী আর একটি পাহাড় ।
পাহাড় নদীকে জন্ম দেয়; নদী শুয়ে থাকে পাহাড়ের পাশে ।
তবুও যোজন দূরে দু’জনেই দু’জনার ।
মাটি ও জলের এই ফুলে উঠা–এইটুকু স্তিমিত সঞ্চয় যেন
…………………………..জীবনের গভীরে গোপন সঙ্গ–
………………………………….বিদিত মৃত্যুর চাষ করা ।
পাহাড় গড়িয়ে হয় সমতল, নদীও শুকায়;
তবু এই ভাতৃসঙ্ঘ, শয্যা; অনাগত জন্ম হন্তারক
ঘনায় ছোবল; তবু চন্দ্রাতপ; সজল বিচ্ছেদভরা পৃথিবীতে
সহসা লেলিয়ে দেই প্রেম, শুধু মনোহর অমৃত অঞ্জলি শ্রদ্ধাপরশ;
………………………………..মাটির কলসে সেই জল
কোনো কাক পাথর ডুবিয়ে খায়; তৃষ্ণা !
আহা ! তৃষ্ণা বিরচিত ক্ষয়িষ্ণু গ্রন্থের মতো হে জীবন–
নিষ্পন্ন বিন্দুকে জেনে গেছি আমি ?
জেনে গেছি এই সর্প সমাদর–বিষ আর মণি
…………………………তুমুল নিজের ?

 

৬.

রঙ ঋতু মনুষ্য বিবেক সূর্য প্রেম ও নারীর
গণমূর্ছনায় স্বপ্নে অরক্ষিত এখনো জীবন পরিপূর্ণ শিরোনামে
প্রফুল্ল আলোক হতে পারে না বলেই
একটি শামুক দেখি আপ্রাণ গুটিয়ে থাকে নিজের ভেতর ।
সেকি নয় পরান্মুখ ? তবু হাঁটে । সুধীর চলতে পারে
…………..একা একা; তার গণ্ডি, খোলস-পরিধি নিয়ে
আর তার ব্যপক স্বরাজ মৃত্যু পরবর্তী অমোঘ আস্থায়
পা কাটে অলক্ষ্যে মানুষের । সেই রক্তিম চিহ্নকে
দেখে দেখে মানুষ জানে না
হাঁস আর মোরগ-মুরগীগুলো সারাদিন খেয়ে দেয়ে
……………..চিন্তাহীন বেঁচে থাকে অলস মদির ।
কখনো যদিও হই ভীষ্মের মৃত্যুর মতো ইচ্ছাধীন–
শুধু গৌণ জন্মকে মুখ্যত ক্রীড়ারত রেখে শৃঙ্গারের দক্ষ জাদুকর,
তবে কি মিলবে ওই পাখিজগতের
কীর্তিহীন মেধারঙ ? ওই হৃদি-বাস্তবতা, তার
…………………. যোগ্য মানবিকায়ন আমার জীবন ?

 

স্মিত প্রশ্ন হে আমার মেধার সংশ্রব,
ও জন্ম জন্মান্তরের বিরোধ যাতনা আর মেঘলা দু’চোখ–
দেখো, সুখী পালোয়ান ওই পাখিদের
হঠাৎ আক্ষেপ ছাড়া মরে যাওয়ার প্রভূত বীর পদাবলী ।
…………………অন্তর্লোকে মৃত্যু সমাসীন, তবু
ঘোড়ার কেশরে দেখো দুর্জয় কল্লোল ।
আর পিঠ একটি দ্বীপের মতো, কালো;
………সেখানে অসংখ্য ব্যাঙ লাফাচ্ছে, ঝাঁপিয়ে
পড়ছে জলের মধ্যে; মনে হয় সপ্রাণ বসন্ত গুটি
………….এ রকম লম্ফ দেয় আমাদের কর্দম জীবনে বহুবার ।
এতটা দৃশ্যের নিরূপণ, তার স্পন্দন, সরল সুরারোপ
নিজেকে বইতে দিয়ে আমি কি পারি না হতে একটি মহিষ ?
বিষাদ রহিত হাঁস ? অথবা মোরগ
যার গুপ্ত নিয়তি রয়েছে সকালের প্রাতঃরাশ
হবার, অথচ পুর্ব রাত্রেও সে ছিল অন্তরিত
………………. খোঁয়াড়ের রাজা–বহুপত্নী মাত করে
মন্দ্রিত সপ্তকে যৌবনের ?

 

 

( নোটঃ এখানে লাইনগুলোর এলাইনমেন্ট ঠিক রাখতে ডট ডট ব্যবহার করা হয়েছে  )

 

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( votes, average: ৫.০০ out of ৫)
Loading...
কাজী নাসির মামুন- র আরো পোষ্ট দেখুন