বস বললেন, ‘আপনার উচিত ছিল ক্লায়েন্টকে ফোন করা। জিজ্ঞেস করা যে তিনি ফ্ল্যাটটা কেনার ব্যাপারে সেকেন্ড থট দেবেন কি না।’
আমি বললাম, ‘জি বস।’
‘কী জি জি করছেন? জি মানে কী?’
‘আমার উচিত ছিল ক্লায়েন্টকে আরেকবার ফোন করে জিজ্ঞেস করা।’
‘তাহলে করেননি কেন?’
‘গতবার করেছিলাম, বস। তখন ক্লায়েন্ট দাম কমিয়ে দিল। ভাবল, আমাদের আগ্রহ বেশি। আমরা কম দামে ছেড়ে দেব। তখন আপনি বললেন, ক্লায়েন্টকে সেকেন্ড টাইম ফোন দেবেন না। আর ক্লায়েন্ট যে ফ্ল্যাটটা পছন্দ করবে, সেটাকে সোল্ড আউট দেখাবেন। তখন সে তাড়াতাড়ি কিনে ফেলবে।’
‘গতবারের কেস আর এবারের কেস এক হলো? আগেরটা ছিল রেইনি সিজন। এখন শরত্কাল। কী বুঝলেন?’
‘বস, আপনার কাছ থেকে আমি রোজ নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারি। আপনার মতো বস পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।’
‘এখন যান, নতুন ক্লায়েন্টদের এসএমএস করেন। অফার জানান।’
‘জি বস।’
বস ফেসবুকে আছেন। চ্যাট করছেন। খুব জরুরি কাজ। তাঁকে এখন যন্ত্রণা করা উচিত না।
আমার টেবিলের সামনের ডিসপ্লে বোর্ডে আমি একটা বাণী ঝুলিয়ে রেখেছি।
রুল নম্বর ওয়ান: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
রুল নম্বর টু: ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
একজন ক্লায়েন্ট এসেছেন। দরকারি ক্লায়েন্ট। বিদ্যুৎ বিভাগের মিটার রিডার। এর মধ্যে তিনটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছেন। আরেকটা কিনবেন। এসে বললেন, ‘আরশাদ সাহেব কই?’
আরশাদ সাহেব আমার বস। তিনি ফেসবুক করছেন।
আমি ক্লায়েন্টকে বললাম, ‘স্যার, আমাকে বলেন, আমি দেখছি আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি।’
‘আরশাদ সাহেবকে ডেকে দেন।’
আমি গেলাম বসের রুমে। বস ইউটিউবে হিন্দি নাচ দেখছেন। ‘চিতিয়া কালাইয়া বে’… খুব জরুরি কাজ, জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজের নাচ দেখা। তাঁকে ডিস্টার্ব করা উচিত না।
আমি ফিরে এলাম। বললাম, ‘বস খুব বিজি। আপনি কাইন্ডলি বসুন। কফি খান। আধা ঘণ্টা পরে আমি তাঁকে ডেকে দেব।’
এরই মধ্যে বসের ফোন, ‘মাসুম, একটু আসবা?’
গেলাম বসের কাছে। বস বললেন, ‘মাসুম, শোনো, একটা সমস্যা হয়ে গেছে, আমি একটা সেফটিপিন মুখে নিয়ে চাবাচ্ছিলাম, ওটা পেটে চলে গেছে। এই সমস্যার কোনো সমাধান জানো?’
‘আপনি সেফটিপিন কোথায় পেলেন?’
‘তোমার পিয়া আপু একটা কার্ড দিয়েছিল। তার সঙ্গে একটা সোনালি রঙের সেফটিপিন ছিল। ওটা দাঁতে নিয়ে চাবাচ্ছিলাম।’
‘ও হো!’ আমি বললাম, ‘মাছের কাঁটা গলায় বিঁধলে বিড়ালের পা ধরে মাফ চাইতে হয়। কিন্তু সেফটিপিন খাওয়ার চিকিত্সা তো জানি না।’
‘কী করা যায় বলো তো?’
আমি বললাম, ‘বাইরে মিটার রিডার স্যার বসে আছেন। ওনাকে কি বিদায় করে দেব?’
তিনি বললেন, ‘অবশ্যই। আমার জীবন-মরণ প্রশ্ন। আমি মারা গেলে তিনটা ফ্ল্যাট বেশি সেল করে আমি কী করব?’
আমি ক্লায়েন্টকে বিদায় করে দিলাম। ইন্টারনেটে সেফটিপিন খাওয়ার পরিণতি মৃত্যু কি না, সার্চ দিয়ে দেখলাম। ব্যাপক জ্ঞানচর্চা হলো।
বসের রুমে গেলাম কৌতূহলবশত। সেফটিপিনটা কি তাঁর পেটে ঢুকে নাড়িভুঁড়ি ফুটো করে দিতে পারবে? ওটা কি খোলা ছিল?
আশার ছলনে ভুলি উঁকি দিলাম।
তিনি সুস্থই আছেন। তবে তাঁকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।
‘বস, সেফটিপিনটা কি পেটে খোলা ছিল?’
‘হুঁ। দাঁত খোঁচাচ্ছিলাম।’
গ্রেট নিউজ। সেফটিপিন খোলা ছিল। মুখটায় কাতর ভঙ্গি করার চেষ্টা করলাম, ‘খোঁচা দিচ্ছে?’
‘না।’
‘বস, ইন্টারনেটে সার্চ দিয়েছি। পিন খাওয়ার ব্যাপারে নানা কিছু জানতে পারলাম। জানার কোনো শেষ নাই, বস। আপনি পিন না খেলে জানতেই পারতাম না যে আমি জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি।’
‘ইন্টারনেট ঘেঁটে কী জানলা তাই বলো।’
‘এক ফ্যাশন ডিজাইনার মহিলা সেফটিপিন খেয়ে ফেলেছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এক্স-রে করা হলো, দেখা গেল, তিনি পিন খাননি, তিনি পিন ইনহেল করেছেন, এটা তাঁর ফুসফুসে গিয়ে বসে আছে। প্রথম অপারেশন ফেইল করল। দ্বিতীয়বার পাঁজর কেটে তারপর ফুসফুস পর্যন্ত ছুরি চালাতে হয়েছে।’
বস বললেন, ‘না না, আমি ইনহেল করিনি, আমি গিলে ফেলেছি।’
‘সর্বনাশ।’
‘কেন?’
‘ওটা আপনার পেটের নাড়ি ফুটো করতে পারে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। এই রকম দুটো ঘটনা দেখাচ্ছে ইন্টারনেটে। একটা বাচ্চার জ্বর আর জ্বর। ভালো হয় না। পরে দেখা গেল পেটে পিন ঢুকে ইনফেকশন হয়ে গেছে। আরেকটা কেসে এটা গলায় আটকে ছিল। মুখের ভেতরে মেশিন ঢুকিয়ে ওটাকে বের করা গেছে।’
তিনি ঘামতে লাগলেন।
আমি বললাম, ‘বস, চিন্তা করবেন না। চলেন, হাসপাতালে যাই।’
‘হাসপাতালে যাব?’
‘জি, চলেন।’
‘শোনো, পিয়াকে কিন্তু খবর দিয়ো না। পিয়া জানতে পারলে খুব ভয় পাবে। ও খুব ভিতু মেয়ে।’
পিয়া বসের গার্লফ্রেন্ড। আমি রুম থেকে বের হয়েই তাঁকে ফোন দিলাম, ‘পিয়া আপু, তাড়াতাড়ি আসেন। বস আপনার সেফটিপিন খেয়ে ফেলেছেন। আমার কথা বলবেন না। তিনি চান না আপনি জানুন। তবে, কেস খুব জটিল। পেটে গেঁথে গেছে। এই সমস্যায় এর আগে পৃথিবীতে তিন শ তেত্রিশ জন মারা গেছে বলে ইন্টারনেটে দেখলাম।’
পিয়া আপু এলেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হাইট, একহারা গড়ন, ঘাড়ে কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাবরি দোলানো চুল। নীল রঙের কামিজ। এত সুন্দর দেখতে এই আপুটা, কিন্তু তাঁর মেজাজ কেন এত তিরিক্ষি!
তিনি এসেই ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘তোমার পেটে সেফটিপিন, তুমি আমাকে বলো নাই কেন?’
‘কে বলল?’
‘আমি তোমার পেটের খবর জানি।’
বস বললেন, ‘এইটা কোনো দেবার মতো খবর হলো?’
পিয়া আপু বললেন, ‘মাসুম, মোটরবাইক রেডি করো, আমরা ক্লিনিকে যাব।’
আমার বাইকের পেছনে পিয়া আপু, তার পেছনে বস। আমরা ক্লিনিকে গেলাম। পিয়া আপুর পারফিউমের গন্ধটা বড়ই মিষ্টি। মনে হয় ফরাসি সৌরভ।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ।
‘কী সমস্যা?’ ডাক্তার বললেন।
আমি বললাম, ‘উনি আমার বস। পিন খেয়ে ফেলেছেন।’
ডাক্তার খিক করে হেসে ফেললেন, ‘কী পিন?’
‘কী পিন মানে?’ আমি বললাম।
‘আলপিন, বোর্ডপিন, সেফটিপিন…’
‘সেফটিপিন!’ বস বললেন।
‘খোলা ছিল।’ আমি বললাম।
এক্স-রে করতে পাঠানো হলো।
এর মধ্যে পিয়ন আলাউদ্দিন ফোন করেছে আমার মোবাইল ফোনে, ‘স্যার, বস মনে হয় সেফটিপিনটা খায় নাই। ওনার টেবিলে একটা চাবানো সেফটিপিন পড়ে আছে।’
‘সোনালি রঙের?’
‘জি স্যার।’
আমি বললাম, ‘চুপ হারামজাদা। খাইছে কি খায় নাই, এক্স-রেতে ধরা পড়বে।’
এক্স-রেতে কিছু পাওয়া গেল না।
পিয়া আপু বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব এখন উপায়?’
ডাক্তার বললেন, ‘এমআরআই করতে হবে।’
আমি মিটমিট করে হাসছি। এমআরআই জিনিসটা বেশ মজার। এর আগে একজন বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমআরআই করে এসে টিভিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন, ‘আমার শত্রুরও যেন এমআরআই করতে না হয়।’
আমার এক কাজিনের এমআরআই হয়েছিল, আমি দেখেছি।
বসের এমআরআই হচ্ছে। তাঁকে হেলমেটের মতো একটা জিনিস পরানো হলো। এরপর তাঁকে কফিনের মতো একটা জিনিসে ঢোকানো হলো। তারপর সেটা ঢুকে গেল একটা বিশাল লোহার তাঁবুর ভেতরে।
তাঁর হাতে একটা কলবেল। কোনো অসুবিধা হলে তিনি বেল টিপবেন।
মেশিন চালুর আগেই তিনি বেল টিপলেন। টিংটং।
‘কী হয়েছে?’ এমআরআইয়ের ডাক্তার ছুটে গেলেন ভেতরে।
‘ভয় লাগে।’
পিয়া আপু বললেন, ‘সেফটিপিন খাওয়ার সময় খেয়াল ছিল না?’
প্রবল শব্দ হলো। তাঁকে ওই লোহার গুহায় আটকে রাখা হলো পুরো আধা ঘণ্টা। তারপর তাঁকে বের করে আনা হলো। এমআরআই, এক্স-রে মিলে বিল এল ১২ হাজার টাকা মাত্র।
ডাক্তার রিপোর্ট দেখে বললেন, ‘না, কিছু নাই।’
‘এখন তাহলে আমরা কী করব?’ পিয়া আপু বললেন ডাক্তারকে।
ডাক্তার বললেন, ‘একটা কাজ করা যায়। পেটটা আমরা ওয়াশ করে দিই। বেশিক্ষণ তো হয়নি। নিশ্চয়ই স্টোমাকেই রয়ে গেছে। ওয়াশ করলেই বের হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা তাই করেন।’
বসের পাকস্থলী ওয়াশ করা হচ্ছে। ভয়াবহ দৃশ্য। আমি এটা দেখতে পারব না। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আহা, কী কষ্টই না পাচ্ছে লোকটা!
ওয়াশ করেও কাজ হলো না। সেফটিপিন বের হলো না পেট থেকে।
পিয়া আপু বললেন, ‘এখন? সেফটিপিন বের হলো না কেন?’
ডাক্তার বললেন, ‘মনে হয় এবডোমেনে চলে গেছে!’
‘এখন কি কিছুই করার নাই?’ পিয়া আপুর কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘আপনার কিছু করার নাই। পেশেন্টের আছে।’ ডাক্তার বললেন।
‘কী?’ পিয়া আপু চোখের হালকা সানগ্লাসটা খুলে জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনাকে বলব না। রোগীকে বলব।’ ডাক্তার হাসছেন।
‘আমাকেই বলেন।’ পিয়া আপু গম্ভীর।
‘উনি কি কমোড ব্যবহার করেন, নাকি ইন্ডিয়ান প্যান? ওনাকে বাচ্চাদের পটি ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করে ওনাকে খেয়াল রাখতে হবে এটা বের হলো কি না…’
পিয়া আপু খেপে গেলেন, ‘এই রকম একটা পচা কথা আমাকে বলতে পারলেন?’
ডাক্তার মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আমি তো বলতে চাই নাই…’
তিন দিন পরে আমি পিয়া আপুকে ফোন করলাম। সেফটিপিন পাওয়া গেছে।
পিয়া আপু বললেন, ‘আমি এই প্রসঙ্গ শুনতে চাই না।’
আমি বললাম, ‘শোনেন। ভালো গল্প। পচা গল্প না। সেফটিপিনটা বসের টেবিলে একটা কাগজের সঙ্গে গাঁথা আছে। আজকে আলাউদ্দিন খুঁজে পেয়েছে।’
পিয়া আপু বললেন, ‘তোমার বসের সঙ্গে আজ থেকেই আমার সমস্ত রিলেশন শেষ।’
পিয়া আপুর ফেসবুকে দেখলাম, সম্পর্ক দেখাচ্ছে ‘সিঙ্গেল’।
পিয়ন আলাউদ্দিন বলল, ‘স্যার, আপনে বসরে ক্যান কইলেন না তিনি সেফটিপিন খান নাই।’
আমি বললাম, ‘আলাউদ্দিন, আমার টেবিলের ডিসপ্লে বোর্ডে দেখ কী টাঙিয়ে রেখেছি। পড়।
রুল নম্বর ওয়ান: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
রুল নম্বর টু: ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
বস বলেছেন, তিনি সেফটিপিন খেয়েছেন, তুই-আমি কে রে ভুল ধরার? তিনি যখন বলেছেন যে তিনি পিন খেয়েছেন, তিনি অবশ্যই পিন খেয়েছেন। দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।’