বীজ

পশ্চিম থেকে কালো মেঘ উঠে ছেয়ে দিয়েছে আকাশ।
ভরদুপুরে কুলুঙ্গিতে লম্ফু জ্বলছে।
সে জানে চুল আজ শুকোবে না
তাও মাথা ঘসেছে গুঁড়ো সাবান দিয়ে
ভেজা চুলে সুগন্ধি তেল মাখিয়েছে।
মাটির দাওয়ায় বসে আছে মুন্ডুরি
রাঙ্গা মোড়াম এর পথ চেয়ে।
চিনিলাল- এর ভাবনায় গায়ের গন্ধ তীব্র হয়।
দিগন্তে চুমু খাওয়া মাঠ পেরিয়ে
শাল পিয়ালের বন পাশ কাটিয়ে
বাস রাস্তা ধরে তিন ক্রোশ দূরে
গঞ্জের রেল ইষ্টিশন।
সেখানেই মন পরে রয়েছে তার।
চিনিলাল যে সেই পথেই ফিরবে
দূর পাহাড়িয়া শহর থেকে।

গত বদনায় একসাথে থাকা শুরু করেছিল তারা।
ভালই কাটছিল দিন গুলো,
মুন্ডুরি সারাদিন বনে বাদারে ঘুরে পাতা কুড়িয়ে আনত,
সেই পাতা দিয়ে তৈরি করত থালা।
চিনিলাল এর কাজ ছিল খাদানে পাথর ভাঙা।
গোটা দিন শরীর দুরমুশ খাটিয়ে সাঁঝেরবেলা বাড়ি ফিরত।
সরষের তেল কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে ভেজা ভাত খেয়ে
তালাই বিছিয়ে শুয়ে পরত খোলা আকাশের নীচে।
অনেকক্ষণ গল্প করত
সারা দিনের গল্প।
মুন্ডুরি ক’আঁঠি পাতা বেঁধেছে
খাদানে পাথর চাপা পরে কোন মজুরের পা থেঁতলেছে
এইসব রোজের গল্প।
তারপর রাত বাড়লে ঘন হত তারা
গরম নিশ্বাস, পিছল শরীর মিশে যেত
মেখে নিত পরস্পরের গায়ের ঘাম।
সেদিন চিনিলাল কে লেপটে মুন্ডুরি বলেছিল…
‘সাঙ্গা টো কোরে ফেল
মুর ভিতর তুর বীজ আলছে’।
পরের দিন চিনিলাল কাজে যায়নি।
খুলে বসেছিল টিনের বাক্স,
তার এতো দিনের জমানো পুঁজি।
গাঁয়ের লোকেদের শুয়োরের মাংস
মুখিয়াকে গোটা ছাগল
টাকায় কুলোয়নি।

শহরের ঠিকাদার যেদিন দূর পাহাড়ে ব্রিজ তৈরির কাজে ডাকল
চিনিলাল এক কথায় রাজি।
মুন্ডুরি সেদিন ঠিকাদার এর কাছে শুনেছিল
সেই দূর রাজ্যের কথা।
সেখানে উঁচু উঁচু পাহাড়
খরস্রোতা পাথুরে নদী
পাহাড় চুড়ায় শিবের মন্দির
আরও অনেক কথা।
মুন্ডুরি ও যেতে চেয়েছিল।
তারপর থেমে যায় পেটের বাচ্চাটার কথা ভেবে।
যাওয়ার আগে চিনিলাল বলেছিল____
‘সোহর থিক্কা কামায়ে ফিরি, তাবাদে সাঙ্গা কোরি লিব’।

মুন্ডুরি নিজের টাকায় একটা শুয়োর কিনে রেখেছে
কাঁঠাল পাতা আর বুনো ফুল দিয়ে বানিয়েছে গয়না
মুন্সি কে বলে দু হাঁড়ি মহুয়াও আনিয়েছে
কাঠের আঁচে ভুটি চচ্চড়ি টগবগ করে ফুটছে
আজ চিনিলাল ফিরবে।
চিনিলাল ফিরলেই সাঙ্গা।

মুন্ডুরির কুঁড়ের সামনের রাস্তা
আজ চটজলদি আঁধার জড়িয়ে নিল।
মারাং মুরুং খেপেছে আজ
বিদ্যুৎ এর ঝলকানিতে চোখ রাঙ্গাচ্ছে
গম্ভীর গর্জনে তার ব্রহ্মাণ্ড থরথর
আকাশ ভেঙ্গে আজ বৃষ্টি নেমেছে।
মুন্ডুরি এখনও দাওয়ায় বসে।
অন্ধকার রাস্তায় একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়।
হঠাৎ যেন বুকের ভেতর মাদল বেজে উঠলো
দূর থেকে ভেসে আসছে আঁড় বাঁশির সুর
আর তর সইছে না, চিনিলাল কি এসে গেল?
ভারী পেট নিয়েই তাড়াহুড়ো করে উঠতে নেয়, পারে না।
ততক্ষনে অন্ধকার কেটে বেরিয়ে পরেছে সেই ছায়ামূর্তি।
ঠিকাদার!!!
না, চিনিলাল ফেরেনি।
মেঘ ফেটে ভেসে গেছে সে
কোন আজানায়
হাজার হাজার মানুষের সাথে।

মুন্ডুরি একইভাবে বসে আছে।
থেমে গেছে মাদল
থেমে গেছে বাঁশি
থেমে গেছে ঝড়
থেমে গেছে সময়
সব হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল
এখন বুক উথলে কান্না বেরতে চায়।

কান্না বেরচ্ছেনা কেন?
পেটের বীজ টা কি নড়ে উঠল?