সুষমার জন্য

সন্ধ্যে নামতে না নামতেই নিয়ন আলোয় ভরে ওঠে এই গলি।
হঠাৎ যেন প্রান পেয়ে চঞ্চল হয়
ক্ষুধার্ত, ভুভুক্ষ মানুষের আনাগোনায়;
একের পর এক খদ্দের সামলাতে হয় কলি কে।
অক্লান্ত, অবিরাম।
আজ সকাল থেকেই তার তলপেটে ব্যাথা।
তবুও ছুটি নেই।
মাথায় যে তার অনেক দায়িত্ব।

দেশের বাড়িতে তার অন্য একটা নাম ছিল, মনীষা।
উঁচু উঁচু পাহাড়ের গায়ে তার দেশ।
সেখানে বর্ষা বনের গায়ে গায়ে অর্কিড আর রডোডেন্ড্রন;
ইতি উতি পাথুরে শরীরে নেচে বেড়ায় উচ্ছল ঝরনা।
তার ওপরেই রবার গাছের শিকর জুড়ে জুড়ে
তৈরি হয় প্রাকৃতিক সেতু।
ওদের গ্রামে সাকুল্যে তিনটে ঘর।
বাড়িতে এ বাবা মা, দুই বোন, এক ভাই আর বৃদ্ধা ঠাকুমা।
এক সাথে ভালই কেটে যায় দিন গুলো।
সকাল হতেই গোটা গ্রাম বেরিয়ে পড়ে জঙ্গলের আদারে বাদারে।
কেউ বা ফল পারে তো কেউ শিকার করে।
মনীষার ছিল একটু অন্যরকম কাজ।
পাথর কুড়োনো।
পাথুরে ঝরনার তলায় লুকিয়ে থাকা দামি দামি সব রত্ন।
সারাদিন আঙ্গুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে
সেই সব রত্ন বের করে আনত পাথরের বুক থেকে।
কয়েকদিনের চেষ্টায় মুঠো খানেক জড়ো হলে
বেরিয়ে পড়ত বেচতে
সেই দুই পাহাড় পেরিয়ে শিলং শহরে।

যাওয়া আসার পথেই দেখতে পেতো
পাহাড়ের গায়ে সাজানো সাহেবদের ইংরেজি স্কুল।
তার সামনেই লম্বা সবুজ লনে খেলা করে বাচ্চারা
আকাশ নীল ডোরাকাটা জামা তাদের সবার গায়ে।
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখত মনীষা।
কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকতো ভেতরে;
কি আছে ওখানে? পড়াশোনা মানে কি?
বাচ্চাগুলো সারাদিন কি করে?
ওরাও কি তার মতই পাথর কোড়ায়?
মনে বড় সাধ জাগত
সেই সব বাচ্চাদের সাথে এক সারিতে মিশে যাওয়ার।
যদিও সে বেশ ভাল করেই জানত
এই সাধ তার পূরণ হবেনা কখনোই।
তাই আবার বেরিয়ে পরা পাথর বেচতে।

পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা পাকা রাস্তা ধরে এসে পৌঁছাত পুলিশ বাজার।
হরিন্দর চাচা পাঞ্জাবি, হাতের কাজের জিনিস পত্রের দোকান তার।
সেখানেই সব রত্ন বেচে দিত মনীষা।
তারপর দোকানের টুলে বসেই তাকিয়ে থাকতো রাস্তায়।
বহু মানুষ বেড়াতে আসে এই পাহাড়ি শহরে।
কোথাও নতুন বিয়ে হওয়া জুটি,
কোথাও বাচ্চাদের হাত ধরে বাবা মা।
মনীষার নজর টানত কলেজে পড়া মেয়েদের দল।
স্বপ্নালু চোখ মেলে তাদের দেখত মনীষা।
কেমন সুন্দর সব পোশাক পরে, কলকলিয়ে পেরিয়ে যায় তারা।
ভীষণ মন চাইতো নিজেকে তাদের রঙে রাঙিয়ে নিতে।
সে সব কিছুই হয়নি।

একদিন হঠাৎ নতুন স্বপ্নের ঝাঁপি নিয়ে হাজির হোল সুখওয়ান্ত
সেইদিন মনীষার অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো নতুন আশার আলো দেখতে পেল।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠল মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নেরা।
কিন্তু হায়!
অবুঝ মন বোঝেনি সেদিন, সব স্বপ্নের ভেলা লাগেনা পাড়ে।
বাকি গল্পটা বাকিদের মতই।

ইতিমধ্যে সুখওয়ান্তের দেওয়া উপহার প্রায় তিন বছরের হোল।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দুলে বেড়ায় সারা বাড়ি, গোটা পাড়া।
এখন প্রায় গোটা এলাকা তাকে চিনে ফেলেছে।
যদিও এপাড়ার সবাই তাকে অলি বলে ডাকে।
মনীষা কিন্তু মনে মনে তার অন্য একটা নাম রেখেছে, সুষমা।
বেশ একটু দেরি করেই কথা ফুটেছে অলির।
যেদিন প্রথম নরম ঠোঁট হাল্কা কাঁপিয়ে ‘মাম’ বলে ডাক দিল,
আনন্দের কান্নায় ভরে গিয়েছিল মনীষার বুক।
ছোট্ট সেই প্রানের ভেতরেই লুকিয়ে আছে তার স্বপ্ন,
সেই চোখেই পূরণ হতে চায় তার অপূর্ণ আশা আকাঙ্খা।

আজ সকাল থেকেই মনীষার তল পেটে ভীষণ ব্যাথা।
যোনি দ্বার বেয়ে গড়িয়ে চলেছে ময়লা রক্তরস।
তাও ছুটি নেই তার।
মাথায় যে তার অনেক দায়িত্ব।
একের পর এক হিংস্র দানব এসে প্রবেশ করছে তার অভ্যন্তরে।
চোদ্দো, পনেরো, ষোলো……
বমি করে যাচ্ছে পৌরুষ।
দাঁতে দাঁত চেপে পরে থাকে মনীষা
ময়লা চিটচিটে বিছানায়।
এখন তার চোখে সুষমার ছবি।
পাহাড়ি স্কুলের লম্বা লন দিয়ে ছুটে আসছে সুষমা।
পরনে আকাশ নীল ডোরা কাটা জামা, সবুজ স্কারট
পিঠে ব্যাগ, কাঁধে ঝোলানো জলের বোতল।
বাহাত্তর, তেয়াত্তর, চুয়াত্তর, পঁচাত্তর……
ক্লান্ত পৌরুষ বমি করে লোকটা।
আবার পরের খদ্দের।
কাম তৃষ্ণায় ছটফটে কোনও এক দানব।
মনীষার ছুটি নেই।
ক্লান্তি মাখা ঠোঁটে তবু জয়ের হাসি।
লম্বা লন পেরিয়ে ছুটে আসছে সুষমা।
পরনে আকাশ নীল ডোরাকাটা জামা……