জীবন স্মৃতির আড়ালে


বহু বাঁক পেরিয়ে এমন এক সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে আমার জীবন, যখন কোনো আবেগ নেই। আছে শুধু অতীত স্মৃতি-বিস্মৃতি। এ সময়ে অনেক পরিচিত মানুষের মুখ মনে পড়ে। যদিওবা ঝাপসা সব কিছু; তবুও নিজের অজান্তেই অতীত রোমন্থন করে সময় কাটাই। দৃষ্টির মতো স্মৃতিও দ্বিধা-বিহ্বলতায় পরিপূর্ণ। তবুও তাদের কথাই মনে আসে বারবার, যারা আমার এই পথ চলার সঙ্গী হিসেবে নিজেদের অনেক কিছু উজাড় করে দিয়েছেন। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় তাদের কথা স্মরণ করে আমি মাথা নত করি। শৈশব স্মৃতি লিখতে গিয়ে তাদের নামই বলব আমি।
১১ জুলাই, ১৯৩৬। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল মোল্লাবাড়িতে আমার জন্ম। আব্বার নাম মীর আবদুর রব এবং মায়ের নাম রওশন আরা মীর। আমার বাবা-মা সম্পর্কে পরস্পর চাচাতো ভাই-বোন। আমার নানা আবদুর রাজ্জাক মীর ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। কাপড় ও জুতোর ব্যবসায়ে তিনি অঢেল অর্থ-কড়ির মালিক ছিলেন।
আমার দাদা মীর আবদুল ওয়াহাব। তিনি কবি ছিলেন। জারিগান লিখতেন। আরবি-ফারসি ভাষায় ভালো দখল ছিল। সংস্কৃতও জানতেন। আমার নানার তুলনায় দাদা নিতান্তই গরিব ছিলেন। অসংখ্য বইপত্রে স্তূপ হয়ে থাকত তার ঘর। পশু-পাখি পোষার শখ ছিল তার। আমার দাদির নাম হাসিনা বানু। অত্যন্ত রূপসী ও ব্যক্তিত্বশালী মহিলা ছিলেন তিনি। আমার শৈশব তার উষ্ণ স্নেহে অতিবাহিত হয়েছিল। আমার অতি শৈশব স্মৃতি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো, আমার দাদির পবিত্র মুখাবয়ব। দাদির মৃত্যু আমার কচি মনের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। সেই দিনটির কথা আমার অস্পষ্টভাবে এখনও মনে পড়ে।
দাদির মৃত্যুর পরপরই আমার শিশুকাল যেন কৈশোরের রঙ ঝলমলে প্রজাপতি হয়ে পৃথিবীর ওপর তার পাখা ঝাপটাতে লাগলো। আমার দেখভাল ও মায়ের কাজে সহযোগিতা করার জন্য দাদি থাকার সময়েই আলেকজান বলে একটি মেয়ে রাখা হয়েছিল। আমরা সবাই তাকে ‘আককি’ বলে ডাকতাম। শ্যামলা, ছিপছিপে একহারা গড়ন ছিল তার। দাদি মারা যাওয়ার পর আমার আর আককির মাঝে বেশ ভালো সখ্য তৈরি হলো। আমাকে নিয়ে আককি বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত। এই সুযোগে আমাদের গ্রামটি ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেতাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমের শেষ সীমানা থেকে শুরু হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন। সেখান থেকে শুরু হয়েছে আমার জন্য এক অচেনা জগৎ। রেলগাড়ির দ্রুত আসা-যাওয়া। বুক কাঁপানো হুইসেল। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। পোড়া কয়লার গন্ধ। স্টেশনের দক্ষিণে ভিড় করে দাঁড়ানো ঘোড়ার গাড়ি। এসব ছিল আমার সেই বয়সের জন্য এক বিশাল অবাক করা বিষয়। আককির সঙ্গে আমি সরকারি ডাকবাংলো, গাঁয়ের খ্রিস্টান মিশনারি গির্জা, বাড়ির পূর্বদিকে জর্জ ফিফ্থ হাইস্কুল_ এখন যার নাম নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুল, স্কুলের সামনে বিরাট পুকুরসহ আরও নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। সেই পুকুরটি এখন খেলার মাঠ। কিন্তু সেই সময়ের পুকুরটি সুন্দর সরোবর হয়ে আমার মনে আজো ঢেউ তোলে।
আমি যখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছি, চিনতে শুরু করছি সব কিছু একে একে; ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আকস্মিক অঘটন আমার সবে কৈশোরে পা দেওয়া বিস্ময়ের জগৎকে ঢেকে দিল বেদনায়। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে শুনি আককি পালিয়ে গেছে। সবাই ভেবেছিল, সে তার স্বামীর বাড়িতে গেছে। পরে জানা গেল, সেখানে সে যায়নি। এবং পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। কোন সর্বনাশা দুঃখ তার মনে বাসা বেঁধেছিল কে জানে! যা তাকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল অকালে। বাড়ির সবার স্মৃতি থেকে আককি মুছে গেলেও আমার স্মৃতিতে আককি বর্শার মতো গেঁথে আছে। আমি ভুলিনি আমার এই প্রিয় বোনটিকে।
এবার আমার মায়ের কথা বলি। আমার মা ছিলেন আমার কাছে প্রায় অচেনা এক গর্ভধারিণী ও স্তন্যদায়িনী। নিজের চর্চায় ও বিলাসে তিনি ছিলেন যত্নশীলা। সন্তানের চেয়ে স্বামীর প্রতিই তিনি ছিলেন বেশি মনোযোগী। আব্বার প্রতি তার প্রেম ছিল দু’কূল ছাপানো। সদা সজ্জিতা, সুরুচিপূর্ণা এই মহিলা আমার মা, এটা ভাবতে ও তাকে ‘আম্মা’ বলে ডাকতে আমার অহঙ্কারের সীমা ছিল না। আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভয় করতাম ও ভালোবাসতাম। তিনি ছিলেন আমার ধরার বাইরে অন্য এক জগতের বাসিন্দা। আমি ধুলো-কাদায় খেলতে খেলতে শরীরে ময়লা নিয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতাম না। মনে হতো সুন্দর করে সেজে থাকা তার শরীরটা নোংরা হয়ে যাবে। তার শাড়িটা মলিন করে ফেলব আমি। তাকে দূর থেকে দেখে শান্তি পেতাম আমি। আমার জন্য মায়ের মনের গভীর গোপন অঞ্চলে এক স্নেহ কাজ করতো যা সব সময় আড়ালে থাকত। কিন্তু প্রয়োজন হলেই সেই স্নেহের অঞ্চলে আকাশভর্তি ভালোবাসার বৃষ্টি ঝরত।
তিতাস নদী আমার শৈশবকে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এই নদীর সঙ্গে আমার সখ্য, স্মৃতি অনেক। তিতাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের কথাই বলব এখন। শৈশবে যে সময় একা একা বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, সে সময়ে একবার নৌকা করে নাইয়র যাওয়ার সুযোগ এসেছিল আমার। সিলেটের ভাটি এলাকায় আমার দাদির বাপের বাড়ির কাছে একটি বিরাট মেলা বত। হঠাৎ করেই ঠিক হলো আমাদের কাপড়ের দোকানটি সেখানে যাবে। দাদির বাবার বাড়ির লোকজন মাকে তাদের সঙ্গে নাইয়র নিতে চাইলেন। আমার মা তাতে রাজি হয়ে গেলেন। এই কথা শুনে আমার তো আনন্দের আর কোনো সীমা নেই। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর রওনা দেওয়ার প্রতীক্ষিত দিনটি এলো অবশেষে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার সামনে খালে সারি সারি পাল বাঁধা নৌকা দাঁড়িয়ে থাকত সব সময়। সেখান থেকেই রওনা দেব আমরা। আমাদের জন্য ঠিক করা নৌকাটি বড় বজরার মতো দেখতে। আমরা নৌকায় উঠলাম। মাঝিরা বদর বদর বলে পাল খুলে দিল। শহরের খাল পেরিয়ে অবশেষে নৌকা তিতাসে এসে পড়ল। আমার চোখের সামনে খুলে গেল নিঃসীম নৈসর্গিক এক তরঙ্গায়িত অধ্যায়। এতদিনকার পরিচিত নিসর্গ দৃশ্যের পরিসীমাটি খুলে গিয়ে ধরা দিল অন্য কোনো জগৎ। এই আমার জীবনের প্রথম নদী, এত কাছ থেকে দেখা। এর আগে নৌকাবাইচের সময় নদীর কাছে গিয়েছি; কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা একবারেই অন্যরকম। এ যেন জীবন্ত নদী। দুপুরে খেয়ে নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিলাম। এর মধ্যে আমাদের নৌকা একটি বিলের মাঝে এসে পড়ল। ঘুম থেকে জেগে দেখি, এক আদিগন্ত বিস্তৃত পুষ্পের জগতে এসে পড়েছি। শাপলা আর জলজ ফুলে চারপাশ সাদায়, হলুদে রাঙা কোনো অন্যভুবন। এদিক-ওদিকে পাখিদের ওড়াউড়ি। আমি চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে জমিয়ে রাখছিলাম মনের গহিন অন্দরে চিরদিনের মতো।
১৯৫০-এর গোড়ার দিক থেকে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বইপাগল কিশোর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার শহরের একপ্রান্তে একটা বইয়ের দোকান ছিল। ওই বইয়ের দোকান থেকেই আমার বই পড়া শুরু হয়েছিল। সেখানে কাচের আলমারিতে প্রদর্শনের জন্য নানা বই সাজানো ছিল। এই দোকানে যে ভালো বই পাওয়া যায়_ এ কথা আমি শহরের বইপড়ূয়া নর-নারীদের কাছে গিয়ে বলতাম। ফলে দোকানের বিক্রি ভালো হতো। দোকানের মালিকরা আমাকে বই ঘেঁটে দেখতে দিতেন। আমি প্রায়ই ওই দোকানে গেলে তারা আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। আমার সাধ্যে কুলালে আমি আমার পছন্দের বইটি কিনে নিতাম। কিন্তু প্রায়ই আমার সাধ্যে কুলাত না। আমি বইগুলো ঘেঁটে দেখতাম। এই মুহূর্তে একটি বইয়ের কথা আমার মনে পড়ছে। বইটির নাম ছিল সম্ভবত ‘সুন্দরবনের কাহিনী’। বইটির লেখক ছিলেন বোধহয় হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন। এ বইটি পড়ে আমি উপকৃত হয়েছিলাম অনেক।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বোধহয় আমার প্রতি এ শহরের প্রায় সব মানুষের সহানুভূতি ছিল।
আমার বন্ধু-বান্ধব ছিল হাতেগোনা কয়েকজন। বই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। এমনও হয়েছে মাঠে খেলা হচ্ছে আর আমি মাঠের পাশে বই নিয়ে বসে আছি। বই পাঠের সূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অনেক সম্ভ্রান্ত মহিলার সঙ্গে আমার বইয়ের আদান-প্রদান চলত। যারা বই পড়তেন তারা আমাকে খুঁজে বেড়াতেন। আমি তাদের পাঠের তৃষ্ণা মেটাতাম। আমি এখানের বই ওখানে পেঁৗছে দিতাম। এতে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করত। যেন আমি কোনো অচেনা একটি পাখি। সবাই আমাকে পেলে খুশিতে আটখানা হয়ে যেত। একবার মনে আছে বগলের নিচে একটি বই নিয়ে হাঁটছিলাম। কখন যে দুটি মলাটের মাঝে থাকা বইয়ের সব পৃষ্ঠা খসে পড়ে গিয়েছিল তা খেয়াল করতে পারিনি। যখন চৈতন্য হলো_ দেখি, শুধু মলাটটা আছে। বইয়ের নাম ছিল ‘জীবন্ত মমির হাত’। কখন যে মলাট রেখে বইটি পথে ঝরে গেছে তা টের পাইনি। পরে কোথায় খুঁজব? আমার বগলের নিচ থেকে ঝরে গেছে জীবন্ত মমির হাত। আর পাওয়ার উপায় নেই। মনে পড়ছে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সমস্ত পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে একটি যোগসূত্র ছিলাম আমি। আমার মতো আরও একজন বইপাগল মানুষ এই শহরে ছিল। একটি মেয়ে। আমি তার নাম উল্লেখ করতে চাই না; কিন্তু সে ছিল নতুন বইয়ের জন্য দিওয়ানা এবং আমিই ছিলাম তার প্রকৃত বন্ধু। পরে অবশ্য বিয়ে-শাদি হয়ে যাওয়াতে তার জীবন দুর্বিপাকে পড়েছিল।
ঈদের কথা কিছু বলছি এই মুহূর্তে। যদিও বহু ঈদের স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করছে। কোথায় হারিয়ে গেছে অতীতের সেই ঈদের স্মৃতি। সেই সব দিন। ঈদের দিন। এখনকার মতো নয় আমাদের সেই সব দিন। আলাদা, সম্পূর্ণই আলাদা।
আজ এই ক্ষণে স্মৃতিতে ভাসে কত আপনজনের মুখ। সামাজিক নানা কারণে তারা হয়তো আর আমার সানি্নধ্যে আসতে পারে না আর আমিও পারি না যেতে। এই অবস্থায় একদিন হয়তো আমাকেই চলে যেতে হবে। তবে আমার মনে কোনো আক্ষেপ নিয়ে যেতে চাই না। কত দিন, কত বছর অতীত হয়ে গেছে; আমি ভুলিনি কিছুই। এই তো জীবন। আমার জীবনের কথা।
আমাদের গরিব সংসারে আমার ভাইবোনরা অতীতে যেমন আমাকে ঘিরে থাকত, আজো তাদের ছোঁয়া আমার শরীরে-মনে তেমনি লেগে আছে। হাসি ও প্রীতির মধ্যে আগের মতোই এখনও মনটা তাজা আছে। কিন্তু নেই আমার ভাইবোনরা, বেঁচে আছে তবে কাছে নেই। কতই ভালো হতো যদি মৃত্যুর আগে একবার তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো। অতীতের স্মৃতির কথা বলতাম। হাসতাম। কৌতুক করতাম। হয়তো সেই অবস্থা আর ফিরবে না। অথচ আমাকে ফিরে যেতে হবে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন