নিঃসঙ্গ দুপুর

ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায় রাশিদুনের।
জানালার কাঠের পাল্লার ফুটোফাটা দিয়ে দিনের হালকা আলো ঢুকছে। রাশিদুনের মনে হয় বেশ লাগছে দেখতে। কতকাল আগের এই পুরনো বাড়ির কাঠের পাল্লাকে আজ ছবির মতো লাগবে কেন? কতদিনই তো দেখেছে রোদ উঠলে এমন দিনের আলো ঘরে ঢোকে। তখন তো এমন লাগেনি। আজ কি তাহলে কোনো খুশির খবর আছে? আনন্দে রাশিদুনের দু’চোখ বুজে আসে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ আসছে। তার মেয়েদের কণ্ঠস্বরের মতো। যেন কথা বলছে শিউলি বা বকুল। নাকি হাস্নাহেনা? চম্পাও হতে পারে। নাহ্, পদ্মর কণ্ঠস্বর কানে বেশি লাগছে।
রাশিদুন বিছানায় উঠে বসে।
হলো কি আজ? মন এতো ভালো লাগছে কেন? জীবন তো বোঝা টেনেটেনেই শেষ হলো। আর কদিনই বা আয়ু? ভালোলাগার জায়গাটা একটু অন্যরকম হয়ে যায় মুহূর্তে। ইদানীং বয়সের হিসাব অন্য অনেককিছু পাশ কাটিয়ে সামনে এসে যায়। বিছানা থেকে নেমে জানালা খুলে দিলে বাইরের দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। নরম রোদ গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। পাখিগুলো গাছের শাখায়, নয়তো কুমড়োর মাচার ওপর কিংবা খোলা জায়গায় উড়াউড়ি করছে। সবাই মিলেই ঠিক করেছে আজ রাশিদুনকে সুন্দর দৃশ্য উপহার দেবে। যেন কোনোদিন রাশিদুনের বুক পুড়ে যায়নি- যেন রাশিদুনের কোনো দুঃখ নেই। ও পুড়ে-যাওয়া বুকের ক্ষত নিয়ে জীবনের অর্ধেকের বেশি বছরগুলো কাটায়নি। ওর জানালার সামনে দিয়ে উড়ে যায় কোনো চড়ুই কিংবা শালিক। দূরের ডালে বসে আছে কাক। কিংবা দোয়েল। ও জানালার দিকে কপাল ঠেকিয়ে রাখে। মৃদু বাতাস ওর কাঁচাপাকা চুল ছুঁয়ে যায়। এলোমেলো করে দেয় যত্ন করে বেঁধে রাখা চুল। কুঁচি চুল কপালের ওপর এসে পড়ে। চোখের উপরও। ও ডান হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো একটা দুইটা করে সরায়। মনে পড়ে হাশেম মিয়ার বাড়িতে যেতে হবে। ওর মেয়ের বাচ্চা হবে। আনু বুয়া মারা যাওয়ার পরে এখনতো গ্রামের দাই রাশিদুন একাই। হাশেম ভাই রাতে এসে বলেছে, আপনি সকালেই আসবেন বুয়া। লাইলির যা চলছে সকালের দিকেই বাচ্চাটা হতে পারে। আমার ঘরের প্রথম নাতি-নাতনি।
রাশিদুন বলেছিল, এই খুশিতে খাসি কিনে রাখেন। বাচ্চার কান্না শুনলেই জবাই দিবেন।
যদি নাতনি হয়?
নাতনির জন্যও খাসি জবাই হবে। বলেন কি হাশেম ভাই আপনি কি নাতি-নাতনি ভাগ করেন নাকি?
আপনি যখন বলছেন তখন দুইটা খাসি কিনব।
সাতদিনের মাথায় আকিকা দিব। দুই খাসির মাথা আপনাকে দিয়ে যাব। সঙ্গে লাল শাড়ি।
মাত্র গত সন্ধ্যায় এমন কথায় প্রাণখুলে হেসেছিল- রাশিদুন। ভাবে, এইজন্য আজ সকালে ওর এমন ভালোলাগছে। ওর তো বেলা উঠার আগেই হাসেম মিয়ার বাড়িতে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পাখিদের বলে, মেয়েগুলো কেন তোদের মতো হয়না নিজের বাচ্চা নিজেই ফুটাবে। আহা তাহলে তো রাশিদুনের দাইয়ের কাজ করতে হতো না। নারে পাখিরা, দাইয়ের কাজ করতে আমার ভালোলাগে। নাড়ি কাটলেই তো লোকে বলতে পারে নাড়ি-ছেঁড়া ধন পাওয়া কি সোজা কথা?
রাশিদুন দরজা খুলে বের হয়। গোসল করে। চুল আঁচড়ায়। ভেজা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে রাখে। টিনের বাক্স থেকে একটা নতুন শাড়ি বের করে। স্নো মাখে। তারপর মাথায় শাড়ির আঁচল উঠিয়ে দিয়ে আয়না দেখে। মনে মনে ভাবে, তাকে বেশ লাগছে দেখতে। বয়স হলেও চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। নিজেকেই প্রশ্ন করে, এমন জবাব মানে কী? পরক্ষণে লজ্জা পায়।
দরজায় দাঁড়িয়ে মোমিনা বলে, বড় বুয়া হাশেম মিয়ার বাড়ি থেকে আপনাকে ডাকতে এসেছে।
যাই। রাশিদুন আয়নায় নিজের চেহারা আবার দেখে ঘর থেকে বের হয়। হাসেম মিয়ার জামাই এসেছে ডাকতে।
খালা তাড়াতাড়ি চলেন। শাশুড়ি-আম্মা বলেছে অনেক ব্যথা উঠেছে।
দু’জনে মেঠোপথে নেমে আসে। ওদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তাই হেঁটে অল্প সময়ে পৌঁছে যায়। সাবান দিয়ে হাত-পা ধুয়ে যখন আঁতুড়ঘরে যায় রাশিদুন তখন ব্যথায় কঁকাচ্ছে লাইলি। পাশে বসে থাকা ওর মা বলে, ও মাইয়া দ্যাখ তোর দাই-খালা আইসা পড়েছে।
রাশিদুন ওর কাছে গিয়ে বসে হাত ধরে।
আমার দিকে তাকা রে মা-
মুহূর্ত মাত্র। মেয়ে হয়েছে। নাড়ি কেটে শুকনো কাপড় দিয়ে বাচ্চাকে পরিষ্কার করতে করতে রাশেদুন বলে, আমারও প্রথম সন্তান মেয়ে ছিল। নাম রেখেছিলাম শিউলি।
আপনি আমার নাতনির নাম রাখেন রাশিদুন বুয়া।
রাশিদুন এক মুহূর্ত ভেবে বলে, এখন ফাল্গুন মাস। ওর নাম রাখেন ফাল্গুন।
কি সোন্দর নাম। তার নানা আকিকা দিয়া ভালো নাম রাখব। আমি এই নামে ডাকুম।
এই বাড়ির প্রথম নাতনি। ওর কি আর একটা নামে হবে। দেখবেন ওর দশটা নাম হবে।
হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লাইলির মায়ের মুখ। তখন লাইলি নিজেও চোখ খোলে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবং বালিশের ওপর মাথা সোজা করে। রাশিদুনের হাত ধরে বলে, খালা আপনে আমার মাইটারে দোয়া করবেন। ও য্যান একটা কিছু হইতে পারে। শুধু য্যান ভাত রান্না না লাগে ওর।
রাশিদুন লাইলির মাথায় হাত রাখে। পদ্মর মুখ ভেসে ওঠে ওর সামনে। পদ্ম হওয়ার পরই তো ওর তালাক হয়ে যায়। কেন মেয়ের জন্ম হলো! অপরাধ ওর একার। রাশিদুনের আনমনা হয়ে যাওয়া লাইলি খেয়াল করে। মৃদুস্বরে ডাকে, খালা।
রাশিদুন মৃদু হেসে বলে, তোর মেয়ে একটা কিছু হবে রে। দেখিস ও পারবে। একটু পরে ওকে তোর বুকে দেব। তুই ওর কানে কানে তোর স্বপ্নের কথা বলবি।
ঠিক। ঠিক কইছেন। লাইলি বালিশের ওপর মাথা কাত করে। ওর ক্লান্তি কাটছে। ধকলের ভার কমেছে, খানিকটুকু সতেজ হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। রাশিদুনের মনে হয় যে মেয়েটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নিজের সঙ্গে একা একা যুদ্ধ করেই তো ও জন্ম দিল মেয়েটির। এখন ওর স্বপ্ন দেখার সময়। স্বপ্ন দু’জনকেই দেখতে হবে। রাশিদুন ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে, মেয়ের জন্য সামনে যুদ্ধ আছে। হেরে যেতে দেখি না যেন।
আমি হারব না খালা। আমি আপনার মেয়েদের কথা জানি।
দোয়া করি মা তোকে।
সেদিন অনেকক্ষণ ওই বাড়িতে থাকে রাশিদুন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে বিকেলে বাড়ি ফিরলে দেখতে পায় পদ্ম এসেছে। দূর থেকে মাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। নিজের মাথা অনেকক্ষণ মায়ের বুকে চিপে রাখে। খিলখিল হাসিতে নিজেকে মাতিয়ে তুলে বলে, তোমার বুকের ভেতর রেলগাড়ির শব্দ হচ্ছে। রেলগাড়ি ঝমঝম পা পিছলে আলুর দম। তোমাকে আজকে আমি এক হাজার একটা চুমু দেব।
ছাড়, ছাড় তোর হয়েছে কি রে?
হবে আবার কি, আমাকে জন্ম দিয়ে তোমার জীবন বরবাদ হয়ে গেলো। তার মানে তুমি একটি বানর জন্ম দিয়েছিলে না কি মা?
হ্যাঁ, তা দিয়েছিলাম। বানরটা কি এখন গাছে না মাটিতে?
বানরটা এখন আকাশে।
আমি ছুঁতে পারি ওকে?
পার। শুধু তুমিই পার। তোমার মতো আর একজন মানুষ আমার জীবনে নাই।
বানরটা আমার জন্য কোনো খবর এনেছে?
মাগো, তুমিতো জান আমি দৌড়ে সেরা মেয়ে। সবসময় স্কুলে ফার্স্ট হতাম। এবার জেলায় গিয়েও ফার্স্ট হয়েছি। আমি সাফ গেমসে নেপাল যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
নেপাল! ওহ্ আল্লাহ রে, তুই আমার সোনার চাঁদ মেয়ে। তুই আমার পদ্মফুল। আয়, ঘরে আয়। কি খাবি?
মামী আমাকে খইমুড়ি খাইয়েছে। তালের রসের গুড় দিয়ে খেয়েছি। মজা লেগেছে।
রাতে আমার সঙ্গে থাকবি?
এক শর্তে থাকতে পারি।
বল কী?
কাল আমার সঙ্গে যাবে। বাজানের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, দেখো যে মেয়েটির জন্মের পর আমাকে তালাক দিয়েছিলে সে আজ তোমার গর্ব।
রাশিদুন হাসতে হাসতে বলে, আয় ঘরে আয়।
তুমি কি আমার শর্ত মানো নাকি মানো না?
এখন তুমি বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নাও মা।
প্রতিশোধ? এত বছর পরে আর প্রতিশোধ কী?
বাবা কি করেছিল তা কি তুমি ভুলে গেছ?
আজকে আমি একটি পদ্মফুল দিয়ে এসেছি আমাদের লাইলির কোলে।
সেজন্য তো লাইলি আপুর স্বামী বলেনি যে, মেয়ের জন্ম হয়েছে কেন- তোমাকে আমি তালাক দিলাম। যার জন্য তোমার তালাক হয়েছিল আমি তোমার সেই মেয়ে মা। এখন তুমি প্রতিশোধ নাও।
আমার পাঁচ মেয়ে- শিউলি, বকুল, হাস্নাহেনা, চম্পা আর পদ্ম। আমার পাঁচ মেয়ে প্রতিশোধ দিয়েছে। ওরা দেখিয়েছে ওরা কি পারে। ওরা তো ওদের মতো করে বড় হয়েছে। আমি আমার মতো করে জীবন চালিয়েছি। কারো ঘাড়ে বসে ভাত খাইনি যে; জীবনে।
মাগো তুমি কিছু বলছো না যে?
প্রতিশোধ নেয়ারতো কিছু বাকি নেই রে আমার পদ্মফুল।
পদ্ম ফোঁস করে উঠে বলে, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে না?
না, জয়নুল মিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা আমার নাই। ও নরকের কীট।
তাহলে আমি গেলাম। পদ্ম কারো দিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করে। এক ছুটে বাড়ির আঙ্গিনা পার হয়ে পথে ওঠে। মেঠো পথে ওর পা ফেলতে সমস্যা হয় না। খানিকপরে পাকা সড়ক পাবে। বড় বটগাছের কাছাকাছি আসতেই পদ্ম জয়নুল মিয়ার মুখোমুখি হয়। পদ্ম হাঁকাতে হাঁকাতে বলে, বাজান আপনি এখানে কেন?
তোকে খুঁজতে এসেছি মা। শিউলি বলছিল তুই নাকি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরিসনি।
আমি মাকে আমার নেপাল যাওয়ার খবর দিতে এসেছিলাম।
তোর এই খবরে গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আমার খুব গর্ব হয়েছে রে মা।
এটাই আপনার ওপর আমার প্রতিশোধ।
প্রতিশোধ? জয়নুল মিয়া কুঁচকে যায়।
পদ্ম ফুঁসে উঠে বলে, মনে নাই? আমার জন্মের পর আপনি মাকে তিন তালাক দিয়েছিলেন।
প্রতিশোধতো তোর মা নিয়েছে।
আমি নেপাল থেকে ফিরে এসে মাকে এই বাড়িতে আনব। আমি গেলাম।
পদ্ম ছুটতে শুরু করে। জয়নুল মিয়া হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাঁটতে শুরু করে। মাথা ঝুলে তার বুকের কাছাকাছি। মনে হয় বাড়ি ফেরার দরকার নেই। আজ রাতটা এই বটগাছের নিচে শুয়ে কাটিয়ে দেবে। পরক্ষণে মনে হয়- লাভ কী! বাড়িতেই ফিরতে হবে। বাড়ি মানে সেই জায়গা যেখানে রাশিদুনের সঙ্গে জীবন শুরু হয়েছিল। আবার শেষ হয়েছিল। তারপরে বেঁচে থাকার এতগুলো বছর তো নিজের সঙ্গে বোঝাবুঝি করে কেটে গেল। আর কয় দিনের আয়ু! জয়নুল মিয়া দিনের হিসেব করতে করতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল আলো ছড়িয়েছে।
২.
সোমবার। ৩০ চৈত্র। ১৪০০।
বাড়ির মাটির দেয়ালের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে তারিখটা লেখে জয়নুল মিয়া। ষোল বছর ধরে লিখছে। কোনো বছরে ভুল হয়নি। কিংবা অসুস্থতার কারণে লিখতে পারেনি, তাও ঘটেনি। ঢাকা শহরে কাজ খুঁজতে গিয়ে সময় মতো ফিরতে পারেনি, তাও নয়। এই তারিখটি লেখার জন্য ওর জীবনে কোনো অঘটন ঘটেনি।
এখন যদি তার জন্য এতকিছু করতে পারি, তবে সেদিন মনে অন্য কথা ছিল কেন? কেন মুখ থেকে বেরিয়ে বাতাসে আগুন ঝরালো কথাগুলো? তাহলে কি ও মুখে এক, মনে আর এক ধরনের মানুষ? জয়নুল পথের ধারের বড় শিরীষ গাছের নিচে শুয়ে কপাল চাপড়ায়। জয়নুল মিয়ার শূন্য দৃষ্টি তার নিঃসঙ্গতা ঘনীভূত করে। নিঃসঙ্গতা মানসিক যেমন, তেমন শারীরিকও। তারপরও জয়নুল মিয়া কোনো নারীর কাছে যায়নি। বলেনি, ভালোবাসা চাই এবং শরীরও। ও নিজেই নিজেকে এভাবে ভুলের শাস্তি দিয়েছে।
পঞ্চম কন্যার জন্মের খবর শুনে রাগের মাথায় তিন তালাক উচ্চারণ করেছিল জয়নুল। এখন থেকে ষোল বছর আগে। দু’হাতে নিজের চুল চেপে ধরে বলে, তখন আমার মাথায় কিসের ঘূর্ণিপাক দিয়েছিল? পচন নাকি জলরাশি? চিন্তার সময় জয়নুল মিয়ার মাথায় এমন শব্দরাজি ভর করে। কোথায় থেকে উড়ে আসে তা জানে না। সেদিন কেন আমি এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম! বেদনায় কুঁকড়ে গিয়ে বিছানা থেকে নামে জয়নুল মিয়া। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। ফর্সা হয়নি চারদিক। ও ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় পা বাড়ালে দেখতে পায় ওর পাঁচ কন্যা গোল হয়ে বারান্দায় বসে আছে। একজনে মাটিতে হাতের তালু বিছিয়ে রেখেছে অন্যরা তেঁতুলের বিচি রাখছে চারপাশে। ওরা গোল হয়ে বসে খেলা করছে। বাবাকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে দেখে পাঁচজনই একসঙ্গে তাকায় তার দিকে। জয়নুল মিয়া জানে, ওরা আজ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাবাকে পাহারা দেবে।
আপনি ঘুমাতে পেরেছেন বাজান?
জয়নুল মিয়া কথা বলে না। উঠোনের কামারাঙা গাছটার দিকে তাকায়। মেয়েরা কেন তাকে এমন ঘিরে রাখে? কেন ওরা বাবার প্রতি রেগে ওঠে না। কেন বলে না, মাকে বাদ দিয়ে যে সংসারে আমাদেরকে রেখেছেন সে কাজটি ঠিক করেননি বাজান। জয়নুল মিয়া ওদের কথার জবাব না দিয়ে বারান্দা থেকে উঠানে নামে। শরীরটা কেমন জানি লাগছে। মাথায় ঝিমঝিম ভাব। চোখে ঝাঁঝালো জ্বালা। জীবন নিয়ে কি করবে জয়নুল মিয়া? বেঁচে থাকাই বা-। না, এতকিছু ভাবার দরকার নেই। বেঁচেতো আছেই। নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যে দিন ফুরিয়ে যায় তার আর ভালোমন্দ কি? জয়নুল মিয়া জানে পাঁচ কন্যা তার জীবনকে আড়াল করে রাখে। গত রাতে ভাত খেতে দিয়ে ওরা বলেছিল, বাজান ঘুমিয়ে পড়েন। রাত হয়েছে।
এখন তো আমার ঘুম আসবে না মায়েরা। আমাকে কেন তোমরা ঘুমুতে বল?
ঘুম আসবে বাজান। ঘুমকে তো তালাক দেয়া যায় না। তালাক!
মেয়েরা কথা বলে না। শুধু আগুন ঝরার দুচোখে। কথার বদলে কাজটি আরও ভয়াবহ। এমন ভয়াবহ কাজের আড়ালে জয়নুল মিয়া দিনের বোঝা টানে। বুঝতে পারে এসব বোঝায় ঘাড়ে ওজন বাড়ে না, ওজন বাড়ে বুকের ভেতর। বুকের কদর যেখানে বলে সেখানে। তারপরে বন্ধু বয়াতীর মতো গুনগুনিয়ে বলে, বন্ধু তোমার পথের দিশা কই? জয়নুল মিয়া জানে তার বন্ধু মুন্সী বয়াতী এ কথা শুনলে হা হা করে বাসবে। তাকে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চম্পা এসে হাত ধরে বলে, বাজান আসেন।
কোথায়?
বারান্দায় চলেন, আমাদের সঙ্গে বসবেন।
বসে কি করব?
আজ আপনার খুব দুঃখের দিন বাজান।
হ্যাঁ, দুঃখ। যাই বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
আজকে আপনাকে আমরা কোথাও যেতে দেব না।
পেছন থেকে শিউলি বলে। বকুল বলে, আপনার দুঃখ আপনার একার না। দুঃখ আমাদেরও। চলেন বাজান আপনার কাছ থেকে দুঃখের কথা শুনি।
চলো। পাঁচ কন্যা তাকে ঘিরে ধরে। বাজানের মাথার চুল ঠিক করে দেয়। ফতুয়া ঝেড়ে দেয়। তারপর হাত ধরে বারান্দার মাদুরের ওপর বসায়। ওদের মনে হয় বাজান এমন একটা বাইরের মানুষের মতো, যেন কোনো এক শহর থেকে ফেরার পথে গ্রামের এই বাড়িতে বসেছে দম ফেলার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে তার বুকে হাঁফ ধরেছে। মাথার বোঝাটা খুব ভারী। বারান্দায় উঠে বসলে চম্পা বলে, বুকের ভেতর কথা থাকলে তাকে তালাক দেয়া যায় না বাজান।
জয়নুল মিয়া খোলা চোখে তাকিয়ে বলে, তালাক।
আপনি এখন আমাদেরকে তালাকের গল্প বলবেন। বলবেন না? বলেন বলবেন? পদ্ম বাবার মুখের ওপর আঙুল নাড়ায়। ও জয়নুল মিয়ার তৃতীয় কন্যা। আঁতুড়ঘরে জয়নুল মিয়া যখন ওকে দেখতে গিয়েছিল তখন ওর মা বলেছিল, আমি ওর নাম রেখেছি পদ্ম। ও আমার পদ্মফুল।
মেয়েকে দেখে জয়নুল মিয়ার তেমন কোনো আবেগ কাজ করেনি। আনন্দ বা দুঃখ কিছুই না। রাগ হয়েছিল স্ত্রীর ওপর, কিন্তু তাকে মুখে কিছু বলেনি। পরপর তিনটি কন্যার জন্ম দিয়ে আবার নাম রেখেছে পদ্ম। বলেছে, আমার পদ্মফুল।
আব্বা আপনাকে পানি দেব?
না। আমার পানির পিপাসা পায়নি।
ডাক্তার আপনাকে বেশি করে পানি খেতে বলেছে। আমাদেরকেও বলেছে আমরা যেন আপনাকে বেশি পানি খেতে দিই। তাহলে আপনার কলজে শুকিয়ে যাবে না।
তা ঠিক মা। আমার কলজেয় এক সমুদ্র পানি দরকার।
পানির স্রোতে আপনিই বাঁধ দিয়েছেন।
দিয়েছিলাম। তোমাদেরকে তো বলেছি মায়েরা।
প্রতি বছর আপনি দেয়ালে একটি তারিখ লিখেন।
জয়নুল মিয়া তার স্বরে চেঁচিয়ে বলে, লিখিতো। তোমরা কি আমাকে জেরা করছ মেয়েরা?
না, বাজান, আমরা আপনাকে জেরা করি না। এটা আমাদের গল্প। রূপকথা। আপনি বলেন, আমরা শুনব।
বুকটা কেমন ধরে যায় জয়নুল মিয়ার। চারদিকে ঢাকায়। উঠোনের বেড়ার গায়ে দৃষ্টি আটকে থাকে। ওটা আর বাইরে ছড়ানো যায় না- খুব ইচ্ছে হয় যদি দৃষ্টি যেতে যেতে যেতে যেতে রাশিদুনের বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পৌঁছে যেত। সেটা হবে না। চারদিকেই বেড়া আছে। ও শুধু দেখতে পায় আলো ফুটেছে। আসলে এখন তো ও তাকালেই দেখতে পায় না। এই আলো ফোটা দেখাটাও মাঝে মাঝে ওর কাছে সত্য নয় মনে হয়। সত্য হবে কি করে, নিজেকেই প্রশ্ন করে ও। যে ভুলের বোঝা মাথায় নিয়ে পথ চলে তার সামনে কি সত্য বলে কিছু থাকে? ভুলটাই থাকে শুধু। আর থাকে ভুলের অনুশোচনা।
বাজান, গল্পটা বলেন? আমার জন্মের গল্প।
তারপর হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে পদ্ম। ওর বাবা জানে তার এই মেয়েটি পাঁচ কন্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুরন্ত। ও ভয় বোঝে না। ও শাসন মানে না। স্কুলে ফার্স্ট হয়। এমন মেয়ের বাবা হওয়া কি সহজ কথা! জয়নুল মিয়া চোখ টিপটিপ করে মেয়ের দিকে তাকায়। জয়নুল মিয়ার শরীরে শীতল প্রবাহ বয়ে যায়। ও দেখতে পায় ওর পাঁচ মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জয়নুল মিয়া গলা খাকারি দিয়ে শুরু করে, সেদিন ছিল চৈত্র মাসের শেষ দিন। খরখরে রোদ ছিল চারদিকে। তোমাদের আম্মার প্রসব ব্যথা উঠেছিল সকালে। আমার মা ছিল তোমাদের মায়ের কাছে। আমি দাই ডেকে এনেছিলাম।
দাই ডাকতে যেতে আপনার খুব কষ্ট হয়েছিল না, বাজান?
কষ্ট, কষ্ট কেন হবে? আমার শরীর ভালোই ছিল।
খরখরে রোদ ছিল যে? আপনার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। চোত মাসের রোদ খুব খারাপ বাজান।
জয়নুল মিয়া বুঝতে পারে বিষয়টা। কোনো কিছু না বলে ঢোক গেলে। পা চুলকায়।
আপনার মনে অনেক ভয় ছিল না বাজান? পদ্ম কথা শেষ না করে খুক করে হাসে। হাসি বাড়ে। হাসতে হাসতে বকুলের গায়ে গড়িয়ে পড়ে।
থাম বকুল ওকে ধমক দেয়। পাশ থেকে হাস্নুহেনা ওকে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে বলে, তোর জন্মাইতো আমাদের যত যন্ত্রণা। আবার হি হি করে হাসিস, লজ্জা করে না। কনুইয়ের ধাক্কা উপেক্ষা করে পদ্ম বলে, বাজান আপনার ভয় ছিল এমন যে আবার যদি একটা মেয়ে হয়? তাই না বাজান।
জয়নুল মিয়া কথা না বলে ঠোঁট চাটে। ওদের কথার পাশ কাটিয়ে বলে, দাই আঁতুড়ঘরে ঢুকলে আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকি। যদি আমাকে আবার দরকার হয় সে জন্য অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতে বেলা বাড়ে। আমার চায় মেয়ের ক্ষিদে পায়। ওরা উঠোনে ঘুরে ঘুরে কান্নাকাটি করে। খরখরে রোদে আমার মাথা চনচন করে। অপেক্ষা করতে করতে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
আপনার কিসের এত অপেক্ষা ছিল বাজান?
একটি ছেলের। চার মেয়ের পরে আমি একটি ছেলের জন্মের অপেক্ষায় ছিলাম।
আপনার আশা পূরণ হয়নি। তখন আমার জন্ম হয়েছিল। আর মেয়ে, হয়েছে শুনে আপনি খুব রেগে গিয়েছিলেন।
জয়নুল মিয়া চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে তার কথা বলার তেমন কিছু নাই। মেয়েরা এমন কথা সব সময়ই বলে এবং বছরের এই দিনে কথাগুলো তার কাছে নতুন করে পৌঁছায়। জয়নুল মিয়া এভাবে এমন কথা ভাবলে তার ভুলের বোঝা লাঘব হয়। ওদের এসব কথা বলাই উচিত। ও কাছে বসে থাকা ছোট মেয়েটির মাথায় হাত রাখে।
পদ্ম খুক করে হাসে। ওর হাসির একরকম ঢং আছে। ঢংটা সাবই বোঝে, কিন্তু নকল করতে পারে না। দূর থেকেইে হাসি শুনলে ওর পরিচিতজনরা বুঝতে পারে যে এটা পদ্মর হাসি। ও বলে, আম্মা আমাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় আমার নাম রেখেছিল পদ্ম। দাদী আমাকে খুব কষ্ট করে পেলেছিল। হায় দাদী, কিছু বুঝে ওঠার আগেই মরে গেল।
এই কথা শোনার পরে পাঁচবোন একসঙ্গে শাড়ির আঁচলে বা ওড়নায় চোখ মুছল। জয়নুল মিয়ার চোখে জল নাই। এক এক করে সব মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। কারও মুখে-মাথায় দৃষ্টি বেশিক্ষণ আটকে থাকে। তারপর প্রত্যেকের মাথায় হাত রাখে জয়নুল মিয়া। জয়নুল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাস উড়তে পারে না। দীর্ঘশ্বাস আটকে যায় মেয়েদের বুকে। সেটা প্রবল ঘূর্ণি হয়। জয়নুল মিয়া বুঝতে পারে, দীর্ঘশ্বাসও ঘূর্ণির জন্ম দেয়। এখন এই বাড়ির ওপর বয়ে কাছে দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি। জয়নুল ভাবল, ঘূর্ণি তাকে ছাড়ল না।
এবার চোখ মুছে শিউলি বলে, আমাদের আম্মার কাছে আমরা সব মেয়েরা ফুলের মতো ছিলাম। সে জন্য ফুলের নাম দিয়ে আমাদের নাম রেখেছেন আম্মা।
হ্যাঁ, তোমাদের নাম তোমাদের মায়ের রাখা। জয়নুল মিয়া আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শিউলির নাম আমি জোহরা রেখেছিলাম। তোমার আম্মা রাখতে দেয়নি। আর মেয়েদের নাম রাখা নিয়ে আমারতো শখ ছিল না। আমি ছেলের জন্য একটি নাম ঠিক করেছিলাম। তোমার আম্মা এটা জানতো বলে আমার ওপর রেগেছিল। আমার মাও আমার সঙ্গে রাগ করতো। আমি কি গল্পটা শেষ করব?
কেউ কোনো কথা বলে না। প্রত্যেকে নিজেদের হাঁটুর ওপর মাথা নামিয়ে রাখে। জয়নুল মিয়া দু’হাত নিজের বুকের ওপর জড়ো করে। চোখ বন্ধ করে এবং সোজা হয়ে বসে থাকে। যেন কোনো এক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। বিচারের রায় শোনার অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু তখন বাড়িতে ঘূর্ণি- ঘটনার ঘূর্ণি বয়ে যায় বাড়ির উপর দিয়ে। গল্পটা ঘূর্ণিই যেন বলে। পাক খেতে খেতে বাড়ির উপর দিয়ে সরিষার ক্ষেত পার হয়ে চলে যায় বিন্দুবাসী গ্রামে, যেখানে রাশিদুন চাল ঝাড়তে ঝাড়তে হাত থামায়। কুলোটা নামিয়ে রাখে নিচে। ওর চারপাশে উড়ে বেড়ায় তুষ- চুলের ওপর বিন্দু বিন্দু জমে-মুখের ওপরও তুষের আস্তর পড়ে। ঘাড় চুলকালে হাত বাড়ায় রাশিদুন। বুঝতে পারে শরীরের যেখানে যেখানে কাপড় নেই, সেখানে তুষের আস্তর জমেছে। উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঝাড়া দিলে কাপড় থেকে দ্বিতীয়দফায় তুষ উড়বে বাতাসে। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাশিদুন।
উঠোনে দাঁড়িয়ে খরখরে রোদ মাথায় নিয়ে পায়চারি করছিল জয়নুল মিয়া। আঁতুড়ঘরের দরজা ফাঁক করে মা চেঁচিয়ে বলে, তোর মাইয়া হইছে রে বাপ। পঞ্চম কন্যার জন্মের খবর শুনে রাগের মাথায় তিন তালাক উচ্চারণ করে জয়নুল মিয়া। ওর ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর সবটুকু না শুনেই দরজা বন্ধ করে দেয় ওর মা। মেয়ের নাড়ি কাটা তখনো হয়নি। রাশিদুন দেখতে পায় দাইয়ের হাত থেসে গেছে। নতুন ব্লেডের কাগজ ছেঁড়া হয়নি পর্যন্ত। সে কান খাড়া করে প্রথমে দরজার দিকে তাকায়, তারপরে রাশিদুনের দিকে। রাশিদুন দাইয়ের মুখের দিকে না তাকিয়ে ঘাড়টা বালিশে কাত করে। মনে হয় প্রসব বেদনার সবটুকু প্রসবের পরে ঘাড়ে এসে জমা হয়েছে। গোলাকার পিণ্ডের মতো লাগছে। রাশিদুন আবার অন্য পাশে ঘাড় ঘোরায়। ও বুঝতে পারে উঠোনে দাঁড়িয়ে তালাক উচ্চারণ করার পর জয়নুল মিয়া বারান্দায় উঠে এসেছে। মুখে মুখে লাগানো দরজার ফাঁক দিয়ে সব কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। জয়নুল মিয়া চিৎকার করে তালাক দিয়ে গো গো শব্দে আরও কীসব বলছে তা রাশিদুন শুনতে চায় না। তার শাশুড়ি ছেলেকে বকাবকি করছে ঘরের ভেতর থেকে, যে মানুষ ছেলে বা মেয়ে হওয়া নিয়ে রাগ করে সে আল্লাহর ইচ্ছা মানে না। তার ইচ্ছার উপর আবার কথা কি? মানুষ এত সাহস করে কেন। ও এর ফল বুঝবে। ওকে কত বুঝিয়েছি ও মোটেও বুঝদার ছেলে না। ও বলবে, মাবুদ তুমি যা আমার ঘর আলো করে পাঠিয়েছ, তাতে আমি খুসি। আমার ছেলে হলে হবে কি, ও একটা শয়তান ছেলে। তিনি দাইয়ের হাত থেকে ব্লেড নিয়ে নাতনির নাড়ি কাটেন।
প্রসবের কষ্ট শেষ হলেও নতুন যন্ত্রণা শুরু হয় রাশিদুনের। পরক্ষণে বুঝতে পারে যন্ত্রণা নয়, ক্রোধ ওকে দগ্ধ করে। ক্রোধে চৌচির হয়ে যায় ওর চেনাজানা সবটুকু জগৎ- যেমন বাবার বাড়ির বিন্দুবাসী গ্রাম এবং কুড়ি বছর ধরে বাস করা এই হলতা গ্রাম। এখন এই গ্রামটি আর ওর শ্বশুরবাড়ির গ্রাম থাকবে না এবং বসবাসের জায়গাও থাকবে না। ও কি করবে? চল্লিশ দিনের মাথায় সিদ্ধান্ত নেবে। মেয়েকে ওর দাদির হাতে তুলে দিয়ে, বাকি চার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে রেখে, পরনের ফুটো শাড়ি ব্লাউজ নিয়ে ছেড়ে যাবে হলতা গ্রাম। আর কোনোদিন এখানে আসবে না। একদিনের জন্যও না। মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে এই সিদ্ধান্ত নেয় রাশিদুন। ভাবে জয়নুলের মুখ আর দেখবে না। যদি সামনে পড়ে তাও না। মাথার ঘোমটা বড় করে টেনে দিলে দেখার পাট চুকে যাবে। এভাবে চল্লিশ দিন কাটিয়ে মেয়েদের মায়া চুকিয়ে তিন তালাকের দায় মাথায় নিয়ে বাবার বাড়ি বিন্দুবাসী গ্রামে চলে যায় রাশিদুন।
এই ষোল বছরে একদিনও আসেনি এ বাড়িতে। শাশুড়ি মারা যাবার খবর শুনেও না। মেয়েদের অসুখের খবর শুনেও না। তার একটাই উত্তর, ছাড়তে যখন হয়েছে, ছেড়ে এসেছি। দ্বিতীয়বার ঢোকার জন্য ওই বাড়ি ছাড়িনি। ওর এমন সিদ্ধান্তে কেউ বলে সাবাস, কেউ বলে নিষ্ঠুর। রাশিদুন কোনো কিছু গায়ে মাখে না। বাবার বাড়িতে নিজের ভাতের জন্য ভূতের মতো খাটে। বাবা মারা যাওয়ার পরে ভায়ের সংসারেও দিনরাত খাটে। ভায়ের বউ কলিমন মাঝে মাঝে হাত থেকে কাজ কেড়ে নিতে চাইলে বলে, ভাত জোগাতে খাটনি লাগে। লজ্জা করতে নাই। নিজের অন্ন নিজে জোগাই না কেন কলিমন? তুমি আমার মায়ের পেটের বোন হলেও আমি এমন খাটনিই করতাম। রাগ করিস না সোনা বোন।
কলিমন রাগ করবে কি, ও জানে ওর স্বামীর বড় বোনটি এমনই। মাথা নিচু করে না। যতক্ষণ সাধ্য ততক্ষণই নিজে করে যায়। শ্বশুরবাড়িতেও এমন করেই কাজ করে ভাত খেয়েছে। শাশুড়ি তার উপর খুবই খুশি। মেয়ের মতো আদর করেন। কুলোর উপর স্তব্ধ হয়ে যাওয়া হাত নড়ে ওঠে রাশিদুনের। সে আবার চাল ঝাড়তে শুরু করে। মনে মনে নিজেকে বলে, ৩০ চৈত্র। আজ সেইদিন। আজ মেয়েরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। ও চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠে বানাবে আজ। এই একদিনই পিঠে বানায় ও। রাশিদুন মনে করে সে এখন সুখ-দুঃখের বাইরে।
গল্পটা এভাবে এক জায়গায় থামে। কিন্তু জয়নুল মিয়া সুখ-দুঃখের বাইরে যেতে পারে না। এখনই একই ঘূর্ণির মধ্যে আছে। রাগের মাথায় কি করেছে ভেবে নিজের চুল এলোমেলো করে কেটেছিল কাঁচি দিয়ে। লোকেরা যখন জিজ্ঞেস করেছিল, এভাবে চুল কেটেছ কেন? জয়নুল ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেছিল, পারলে টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম। কিন্তু পারিনাইতো। জয়নুল মিয়ার এলোমেলো জীবনের সবটুকু এখন থিতিয়ে এসেছে। এখন আর ও রাশিদুনকে ফিরে পাবার ভরসা করে না। যখন ফেরাবার চেষ্টা করেছিল, তখন ওর সাফ জবাব ছিল, যে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি, সেখানে আর ফিরবো না। আবার একটা তিন তালাকের সুযোগ দেব না ওকে। গল্পটা এভাবে থেমেই গেছে।
অনেকক্ষণ পরে শিউলি বলে, আজকে আমরা আম্মার কাছে যাব।
যাবে আমিও জানি। তোমাদের সঙ্গে আমিও যাব।
আপনি দূরের বটগাছটার নিজে শুয়ে থাকবেন বাজান। আপনার সঙ্গে আমরা চিড়া-গুড়ের পুঁটলি দেব। শবরী কলাও দেব একটা। পানির বোতল দেব। আর কিছু লাগবে?
না। তোমরা আমার অনেক যত্ন করো। মায়েরা আমার- জয়নুল মিয়া দু’হাতে চোখ মোছে। তারপর ভেজা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের মায়ের জন্য কি কিনেছ?
আপনি তো জানেন সারা বছর আমরা মায়ের জন্য টাকা জমাই। দুটা শাড়ি কিনি। সঙ্গে ব্লাউজ পেটিকোট, গামছা। নারকেলের তেল, চিরুনি।
পদ্ম হি হি করে হেসে বলে, এবার আমি মায়ের জন্য জরির ফিতা কিনেছি। আমার স্কুল থেকে আসার সময় মনিরের দোকান থেকে ফিতা কিনেছি।
তোমার মা কি জরির ফিতা দিয়ে চুল বাঁধবে?
চুল বাঁধার জন্যতো কিনিনি বাজান। কিনেছি- পদ্ম এক মুহূর্ত হাসে। তারপর অন্যদিকে মুখ ফেরায়।
বকুল ধমক দিয়ে বলে, বল কেন কিনেছিস? তুই কি আম্মার সঙ্গে ইয়ার্কি করবি?
হ্যাঁ, ইয়ার্কি বললে ইয়ার্কিই হয়। আম্মার যদি মরতে ইচ্ছে হয় তাহলে জরির ফিতায় ফাঁস লাগিয়ে মরবে সে জন্য কিনেছি।
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পদ্ম বলে, যে মেয়ের জন্মের জন্য মায়ের তালাক হয় সেই মেয়ের মনে মরণ ছাড়া আর কোনো চিন্তা থাকে না।
দুই লাফে উঠোনে নেমে চারদিকে পাক খায় পদ্ম। সবাই জানে কষ্টের দ্বিমুখী স্রোত এই পদ্মের ভেতরই সবচেয়ে বেশি। ওর কান্না থামানোর জন্য কেউ এগোয় না। সবাই জানে ও নিজে নিজেই শান্ত হবে।
চম্পা জিজ্ঞেস করে, বাজান কখন রওনা দেব?
তোমরা সবাই পান্তা পানি খাও। তারপর তৈরি হও। তোমরা যখন বলবে আমি তখনই রওনা দেব। এই যাত্রা তো তোমাদের মায়েরা। আমার না।
ভালো করে বেলা ওঠে। রোদ ছড়ায়। ছোট ছোট পুঁটলি নিয়ে রওনা করে ছয়জন মানুষ। সবার আগে জয়নুল মিয়া। হাতে চিড়ে-গুড়ের পুঁটলি। প্রত্যেকের হাতে তাদের মায়ের জন্য কিছু না কিছু আছে। একটি কই মাছ ভাজা। দুটো বড় টেংরার দোপেয়াজাও আছে ওদের সঙ্গে। মা আর কি খেতে ভালোবাসে তা ওদের মনে নেই। বাজানকে জিজ্ঞেস করলে জানান কিছুই বলে না এই ব্যাপারে সে বোবা হয়ে যায়।
সবাই মিলে যাচ্ছে বিন্দুবাসী গ্রামে।
৩.
আজ রাত রাশিদুনের।
মাঝেমধ্যে এমন ভাবনা ও নিজের মধ্যে লালন করে। ছক-বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে এমন ভাবনাকে ও প্রশ্রয় দেয়। প্রশ্রয়টুকু ওর আনন্দ। রাশিদুল মনে করে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য উপায় একটি রশি। রশির উপর দিয়ে এপার-ওপার করতে শিখলে দিন কাটানো নিরানন্দ হয় না।
ও নিজের শোবার ঘরের দরজার পাল্লা খুলে দেয়। বারান্দায় এসে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে। উঠোনে ম্লান জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। ম্লান জ্যোৎস্নার রাতকে ওর ঘনিষ্ঠ উষ্ণতার রাত মনে হয়। এমন এক রাতে ওর বিয়ে হয়েছিল।
সেদিন হাটবার ছিল।
অনেক রাত পর্যন্ত হাটুরেরা কথা বলতে বলতে বাড়িতে ফিরেছে। কখনো ওদের হাসি শুনেছে, কখনো দু’চার লাইন গান। জয়নুলকে ফিসফিস করে বলেছিল, চলো দু’জনে হাত ধরে রাস্তায় হেঁটে আসি। জয়নুল নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, পাগল, আমাদের জন্য ঘরই ভালো। তার চেয়ে বেশি ভালো এই চৌকি।
বিয়ের রাতে রাস্তায় হাঁটলে বাসর ঘড়ায় ঘড়ায় পূর্ণ হবে।
না হবে না।
জয়নুলের প্রবল নিশ্বাস উড়িয়ে দিয়েছিল ওর আকাক্সক্ষা। ও নিজেকে দমাতে চায়নি। আকাক্সক্ষা বুকের ভেতর চেপে রেখেছিল। সেই আকাক্সক্ষার ডানা গজিয়েছে। এই নিঃসঙ্গ দিনে ঘুরেঘুরে এসে বলে, চলো ঘরে-ফেরা হাটুরেদের সঙ্গে হেঁটে আসি। মরা জ্যোৎøা গায়ে মাখি। সবাইকে বলি, আজ আমরা যাত্রা শুরু করেছি। দু’জনে ঘর বেঁধেছি। আমাদের সংসার বড় হবে। ছেলেপুলে আসবে।
রাশিদুন কান পেতে থাকে।
তেমন কথাবার্তা ভেসে আসে না। হাসি কিংবা গানের লাইনও শোনা যায় না। ও মন খারাপ করে না। ভাবে নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য নীরবতাই আনন্দ।
গাছের পাতা নড়ে। বাতাসের মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। কোনো ঘর থেকে কাশির শব্দ আসে। কোথাও থেকে মৃদু কথা। এই বাড়িতে অনেকগুলো ঘর আছে। রাশিদুনের পাঁচ চাচা। পাঁচ চাচার ছেলেরা ঘর বাড়িয়েছে। বাড়ির জায়গা-জমিন ধরে যত ঘর করা যায় ততগুলো ঘরই উঠেছে। সব মিলিয়ে পনোরোটা ঘর। রাশিদুন তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। ভাইয়ের ছোট দুই মেয়ের ঘরে ঘুমায়। ওদের বাড়িটা রাস্তার দিকে বলে হাটুরেদের কথা শোনা যায়। রাত নীরব হলে জোরে জোরেই শোনা যায়। রাশিদুনের কথা শুনতে ভালো লাগে।
আজ মাছ কিনতে পারলাম না।
হ, মাছের দাম চড়া ছিল।
আনাজই গরিবের মাছ।
আনাজ দেখলে বউয়ের মুখ কালো হয়ে যায়।
আমাগো আর কালো ধলা।
মুহূর্তে নীরব হয়ে যায়। আবার একজনের কথা ভেসে আসে।
বাদাম বেচে ভালোই আয় করেছি। সে জন্য কতগুলো মাগুর মাছ কিনতে পেরেছি। হাট থেকে মাছ নিয়ে গেলে আমার মা রাঁধবে তারপরে ভাত খাবে বাচ্চারা।
আহা রে সোনার বাচ্চারা। নুন-পান্তা খেতে খেতে পেটে শিকড় গজায়। দু’চারটে মাছ কিনলে ওদের পেটের শেকড়ে শাপলা ফোটে।
হা-হা হাসিতে মাঠ-প্রান্তর ভরিয়ে দেয় হাটুরে। রাশিদুন কান খাড়া করে হাসি শোনে। ভাবে ওর দুই মেয়ে শিউলি আর বকুল হাট-ফেরত বাবার জন্য বসে থাকত। মাছ আনলে, সেই মাছ রান্না করত ওর শাশুড়ি। দুই মেয়ের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিত ওদের দাদী। পেটপুরে ভাত খেয়ে ঘুমুতে যেত দুই মেয়ে। একসময় ঘুমুতে যেত ওর শাশুড়ি। রাত জেগে বসে থাকত দু’জনে। কত গল্প হতো। বিয়ের সময়ের গল্প। শিউলি আর বকুলের জন্মের সময়ের গল্প। দুই মেয়ের জন্ম পর্যন্ত লোকটি হাসিখুশি ছিল। বলতো, মাগো আমার মেয়েদেরকে তোমার মতো করে গড়বে। তুমি যেমন আদর করতে আমাকে ওরাও তেমন করে আদর করবে আমাকে। তুমি যেমন লাল চিরুনি দিয়ে আমার চুল আঁচড়ে দিতে ওরা তেমন আমার চুল আঁচড়ে দিবে। আমি যেমন তোমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতাম, ওরাও আমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবে।
রাশিদুন থামিয়ে দিয়ে বলতো, হয়েছে হয়েছে থাম। তোমার যেমন শত শত বায়না ছিল মায়ের কাছে, তেমনি তোমার নতুন মায়েদের কাছেও বায়না করো। পারবে করতে?
ধুত তা কেমন করে পারব। আমার শরম করবে না। বাবা কি মেয়েদের কাছে বায়না করতে পারে?
কেন পারবে না, খুব পারবে। বায়না করলেই হয়।
না, না, তা হবে না।
সব তাহলে তোমার ইচ্ছাই। তুমি মেয়েদেরকে মা বানাতে চাও না?
চাইলে কি আর হয়? মা তো মা-ই।
জয়নুল মিয়া মুচকি হেসে পানের খিলি মুখে পুরতো। তারপর রাশিদুনের হাত ধরে বলতো- চলো ঘুমুতে যাই। …।
ছেলের জন্ম কি আমার হাতে? তোমার কপালে না থাকলে আমি কি করব।
অতশত বুঝি না শিউলির মা। আমার সাফ কথা।
সাফ কথা!
রাশিদুনের হাত থেকে পান-সুপারির থালা পড়ে যায়। সেই দিন থেকে ওর বুকের ভেতরে ভয় ঢোকে। বুঝতে পারে সাত বছর ধরে যে লোকটি ওকে নানা স্বপ্নের কথা বলেছে সে লোকটি এই লোক নয়। দু’জনে ভিন্ন মানুষ। রাশিদুন মাথা নিচু করে পান-সুপারি কাঁসার থালায় ওঠানোর সময় টের পায় ওর চোখ ভিজে যায়। সামনে মহাবিপদ। এই বিপদ থেকে ও পার পাবে কীভাবে? রাশিদুনের শরীর ঝিমিয়ে আসে। ও পান-সুপারির সব টুকরো তুলতে পারে না। একসময় জয়নুল মিয়া ওর হাত ধরে বলে, ঘরে চলো। রাত অনেক হয়েছে।
রাশিদুন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুমি যাও। আমি পরে যাবো।
ক্যান?
আমার ইচ্ছা। এখন আমার ঘুম আসবে না।
তোমার ঘুম না আসলে আমার কী? ঘরে চলো।
আমি যাব না।
বললেই হলো, যাব না? ওঠো।
জয়নুল হ্যাঁচকা টান দিলে রাশিদুনের পায়ে লেগে থালা বারান্দার পাশে গড়িয়ে যায়। ও হাঁটুতে ঠেকা দিয়ে বসে থাকে। জয়নুল ওকে টেনে তোলার জন্য জোর খাটায়।
ওঠো।
…।
খবরদার গালি দিবা না। ভালো হবে না। একদম ভালো হবে না।
কি করবি, কি করবি তুই হারামজাদী? তোর করার সাধ্য কি?
তোকে জবাই করার সাধ্য আছে। মাথা ফাটিয়ে দুই টুকরোও করতে পারব।
কি এতবড় কথা! তোর এত সাহস!
হ্যাঁ, এতবড় কথাই। সাহসও আছে। কুড়াল দিয়ে দুই কোপ দিলেই হবে। মাথা দুই টুকরা হয়ে যাবে। শ্যাষ।
তুই একটা ডাইনি। বিধবা হওয়ার সাধ হয়েছে।
বেশি বাড়াবাড়ি করবা না।
ঘরে চল, ঘরে চল বলছি।
খবরদার ধরবা না আমারে। আজ রাতে আমি ঘরে যাব না। তুমি যাও।
কোথায় ঘুমাবে?
এই বারান্দায়। মাদুরের উপর।
বেশি বাড় বেড়েছে।
রাশিদুন দ্রুত হাতে পান-সুপারির কাঁসার থালাটা গুছিয়ে পাশে রাখে। বারান্দার দড়িতে ঝুলে থাকা শাড়িটা টেনে নামিয়ে গোল করে বালিশের মতো বানিয়ে মাদুরের ওপর রাখে। প্রবল ঝগড়ায় বুকের শ্বাস ঘনঘন পড়ছে। দম ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। বড় করে শ্বাস ফেলে ও। জয়নুল এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে শাড়ির পোটলাটা লাত্থি দিয়ে উঠোনে ফেলে দেয়। রাশিদুন কিছু বলে ওঠার আগেই ঘরে ঢুকে যায়। রাশিদুনের বুক ভেঙে যায়। কিন্তু কাঁদতে পারে না। গুনগুন শব্দও বেরিয়ে আসে না। দু’টো মেয়ের জন্মের পর একটি ছেলের ইচ্ছায় এই প্রথম একটি ঝগড়া হলো। এরপর কি হবে? কতদূর গড়াবে ঘটনা? এরপর যদি আবার একটি মেয়ে হয় তাহলে কি শিউলির বাবা আবার…? আর ও রান্নাঘরের…।
রাশিদুনের দম ফুরিয়ে আসতে চায়। ও কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না। কেমন করে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে ও? রাশিদুন শাড়ি নিয়ে বানানো বালিশটা কুড়িয়ে এনে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না। শেষরাতে ঝিমুনি আসে। তাও অল্প সময়ের জন্য।
ওর শাশুড়ি ঘর থেকে বেরিয়েছে। ওর মাথায় হাত রেখে বলে, বৌমা কি হয়েছে? ওঠো। যাও, ঘরে যাও। ঘরে গিয়ে ঘুমাও। ছেলেটা যে কি, কেবল মাথা গরম করে। ওঠো বৌমা। পাঁচটা ছেলেমেয়ে মরার পরে ও আমার একটা পোলা। জোর করে কিছু বলতে পারি না। যাও বৌমা ঘরে যাও।
রাশিদুন শাশুড়ির সামনে কিছু বলে না। মাদুরটা হাতে নিয়ে ঘরে আসে। মেঝেতে বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। জয়নুলের ঘুম ভাঙে না। কিন্তু ঘুম আসে না রাশিদুনের। বুকের কাছে হাঁটু জড়ো করে শুয়ে থাকে। রাশিদুনের মনে হয় এভাবে হাঁটু জড়ো করে শুয়ে থাকার জন্যই আজকের রাত। যা কিছু ঘটেছিল তার সবটুকু মনে করার জন্যই আজকের রাত। রাশিদুন নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ভাবে, সেদিনও এমন ম্লান জ্যোৎস্নার রাত ছিল। সেদিনও হাটের দিন ছিল। জয়নুল মিয়া নিজেই হাট থেকে ফিরেছিল। তার আশপাশে অন্য হাটুরেরা কথা বলতে বলতে ঘরে ফিরছিল। তারা ঘরে ফিরে ভাত খেয়েছিল। রাত বাড়লে ঘুমুতে গিয়েছিল। ম্লান জ্যোৎস্নার রাতে…? রাশিদুন প্রবল বিষণ্ণয়তায় ডুবে যায়। নাকি রাশিদুন যা করেছিল তেমন ঘটনা ঘটেছিল। অনেক নারীর ঘরে? ধুত, বাজে ভাবনা। রাশিদুন শুনতে পায় লক্ষ্মী প্যাঁচার ডাক। এমন রাতে লক্ষ্মী প্যাঁচার ডাক শুনতে ভালো লাগে রাশিদুনের। ওই ডাক গানের মতো বাজে তার কানে। আজ রাতেও রাশিদুন কান পেতে প্যাঁচার ডাক শোনে। যেন চায়ের দোকানের স্টোরের সামনে বসে চায়ের কাপে চিনি দিয়ে নাড়তে নাড়তে গান গাইছে তোরাব। যেন কাপ-পিরিচ ধোয়ার সময় গান গাইছে তোরাব। আর বেশি জোরে গাইলে ধমক শুনত দোকানের মালিকের। সেই সময় ছিল ভর দুপুর। স্কুল থেকে ফেরার সময়। রাশিদুন কান পেতে থাকত। কখন গানের কলি ভেসে আসবে। কখন ছেলেটি চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াবে। হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলবে, ভর দুপুর সবচেয়ে প্রিয় সময়। আকাশ মেঘলা থাকলে ছায়া বিছিয়ে থাকত দোকানের সামনে। সেটা ম্লান দুপুর হয়ে যেত। ওর ভালো লাগতো রোদ ঝকঝকে দিন। বলত, আকাশে মেঘ থাকলে মন খারাপ হয়। রশি তোমার কেমন দিন ভালো লাগে? তোমার যেই রকম দিন ভালো লাগে আমারও সেই রকম দিন ভালো লাগে। সত্যি? তোরাবের চোখে ঝিলিক উঠত। বলত, একদিন তোমারে নিজের হাতে চা বানায়ে খাওয়াব। খাবে তো রশি?
ও ঘাড় কাত করে সায় দিত।
তোরাব খুশি হয়ে বলত, কবে যে পারব কে জানে? চায়ের দোকানে কেবল লোক আর লোক।
রাশিদুন মৃদু হেসে বলত, যাই।
স্কুল বন্ধ থাকলে মালিকের হাতে মার খেত তোরাব। ওর কাজে ভুল হতো। কাজে মন বসতো না। ছোকরা কেউ চায়ের জন্য এলে খারাপ ব্যবহার করত। মালিক ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করত, কি হয়েছে তোর?
ও বোকার মতো তাকিয়ে থাকত।
কি হয়েছে তা কি বলা যায়? বুকের ভিতর গুড়গুড় ধ্বনি। অনবরত বলে যায়, আজ আমার রশির স্কুল বন্ধ। আজ রশি এই পথে স্কুলে যাবে না। ওর সঙ্গে টুকটাক কথা হবে না। ছোট ছোট কথা। লম্বা কিছু না। কিন্তু রাশিদুনের কাছে সেই টুকরো কথা ছিল আকাশ সমান। ভর দুপুরের মতো ভালোলাগার।
তারপর একদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রাশিদুনের। বিয়ের কথা হচ্ছে। কুঁকিয়ে কাঁদে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। অবশ্য কথা শোনার লোকও নেই। কাকে বলবে? সাহসই বা কোথায়? মাস দুয়েক পরে বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। বাড়ির লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে একদিন ঘোর দুপুরবেলা সেই চায়ের দোকানে গিয়েছিল রাশিদুন। অন্য একটি ছেলে দোকানে কাজ করছিল। দোকান ফাঁকা। কাপ-পিরিচ ধুতে ধুতে রাশিদুনকে দেখে বলেছিল, তুমি কে গো? চা খাবা?
না, না চা খাব না।
পয়সা নাই?
না। ফুটো পয়সাও নাই।
তাহলে পানি খাবে?
না। আমি বেশি পানি খাই না।
বিস্কুট খাবে? পয়সা লাগবে না।
আমাকে বিস্কুট দিলে মালিক তোমাকে চোর বলবে।
বলবে না। আমার কাছে পয়সা আছে। হিসাব মিলায়ে দেব।
আমি এই বেঞ্চে একটু বসি?
বস, বস। মেলা দূর থেকে আসছ বুঝি? কোনদিকে যাবে?
ঐদিকে। রাশিদুন হাত উঠিয়ে দেখায়।
ছেলেটি কিছু বুঝল কিনা তাও খেয়াল করে না। ওর চোখ আটকে যায় বেড়ার গায়ের একটি লেখার ওপর। কয়লা ঘঁষে ঘঁষে কালো করে লেখা আছে, রশি। রাশিদুনের বুক মুচড়ে ওঠে। ও ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, এটা কারো নাম বুঝি?
ছেলেটি বিগলিত হেসে বলে, একটা মেয়ের নাম। কার নাম জানি না। যাওয়ার দিন মালিক দোকানে ছিল না, তোরাব লিখেছে। বোধহয় মেয়েটার প্রেমে পড়েছিল। নামটা লেখার সময় ওকে আমি কাঁদতে দেখেছি।
আচ্ছা আমি যাই।
রাশিদুন উঠে দাঁড়ায়।
এত তাড়াতাড়ি যাবে কেন?
একটু দম নিতে চেয়েছিলাম। দম নেয়া হয়েছে।
রাশিদুন হাঁটতে শুরু করলে ছেলেটি পেছন থেকে ডেকে বলে, একটু দাঁড়াও।
রাশিদুন ঘুরে দাঁড়ালে ছেলেটি কাছে এসে বলে, তুমি কি রশি?
না, না, আমি কেন রশি হব। আমি রশি না, রশি না।
ও ছুটতে শুরু করে। হা-হা করে হাসতে শুরু করে ছেলেটি। হাসতে হাসতে বলে, বুঝতে পারছি, তুমিই রশি, তুমিই রশি।
পেছন থেকে ছেলেটির প্রাণখোলা হাসি সেদিন রাশিদুনকে প্রবলভাবে তাড়া করেছিলেন। বাড়ি ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুকুরে। ভেবেছিল নিজের চোখের পানি লুকানোর এর চেয়ে বড় জায়গা আর নেই। সেদিন কতক্ষণ পুকুরে ছিল জানে না রাশিদুন। মায়ের বকাবকিতে পুকুর থেকে ওঠার পরই জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপরে নানা জনের নানা প্রশ্ন- কারও প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি ও। এর মাস কয়েক পরেই জয়নুলের সঙ্গে বিয়ে হয় রাশিদুনের।
তোরাবের সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হয়নি ওর। কতদিন লুকিয়ে চোখ মুছেছে। আস্তে আস্তে সেই মন-খারাপ থাকা কেটে গেছে। কিন্তু আজ এই ম্লান জ্যোৎস্নার রাতে চায়ের দোকানের সেই ছেলেটির হা-হা শব্দের হাসি রাশিদুনের বাড়ির উঠোনে ঘূর্ণি ওঠায়- বুঝতে পারছি তুমিই রশি, তুমিই রশি!
রাশিদুন দু’হাতে মুখ ঢাকে। ওতো ঠিকই বলেছিল। কতকাল পরে দু’কান ভরে সেই হাশির শব্দ আজ রাতে চারদিক তোলপাড় করে দিচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তোরাব। কৈশোরে দেখা সেই ছেলেটি ম্লান জ্যোৎস্নার অপরূপ চেহারা। তোরাবের সঙ্গে বিয়ে হলে তোরাবও কি ছেলের জন্য ওর সঙ্গে এমন ব্যবহার করত? এমন সংসার ছাড়া করে দিয়ে বলত, তুমি আমার রশি না। কোনোদিনও ছিলে না। এখন তুমি আমার বংশ রক্ষা কর, না পারলে বিদায় হও। তালাক- রাশিদুনের ইচ্ছে হয় গান গাইতে। কৈশোরে ও গুনগুন করে গান গাইত। কখনো গলা ছেড়ে না। এখনো সেইসব গান বিশেষ বিশেষ সময় গুনগুনিয়ে গায়। আজও মনে হয় এই রাতে গান গাইবে। ছড়াতে থাকে সুর- পরান সখা রে আর কতকাল রহিবে পরানের গভীরে- গান ছড়াতে থাকে। একটি লাইন থেকে অন্য লাইনে যায়। বিঘ্ন ঘটে না কথা এবং সুরের। গান থামলে রাশিদুন বুঝে যায় আজ রাত ওর একার। এখানে শিউলির বাবার ভালোবাসার দিন নেই। আছে শুধুই তোরাব। তার স্মৃতির দেয়াল ভেঙে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। বলছে, আমি খুব খুশি যে তুমি মনে করছো আমাকে। তুমি কেমন আছ রশি?
তোমার কথা মনে করে আমার আনন্দ হচ্ছে। আমি ভালোই আছি। যখন আমার বুকে কষ্টের পাহাড় জমে আমি তখন তোমাকে মনে করি। আমার স্কুলে যাওয়ার পথের ধারের দিনের কথা মনে করি। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো, কখনো ভুলি না।
রশি তোমাকে আমার খুব ভালোলাগতো। মনে হতো দিন-রাত তোমার সঙ্গে গল্প করি। একদিন দেখলাম তুমি আর স্কুলে যাও না। মন খারাপ করে বসে থাকি। কাজে ভুল হলে মালিক মারে। তোমাকে একদিন দেখতে পাব এই আশায় সবকিছু সহ্য করি। কিন্তু তুমি আর আস না।
আমার উপর কড়া নিষেধ ছিল। মায়ের শাসন। আব্বার চোখ রাঙানিতে বাড়ি থেকে কোথাও যেতে পারতাম না।
যেদিন শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিন কাউকে কিছু না বলে দোকান ছেড়ে চলে যাই। পথের ছেলে আবার পথে নামি। চলে যাই ঢাকায়। রশি তুমি কেমন আছ?
আকস্মিকভাবে রাশিদুন স্তব্ধ হয়ে যায়। ভাবে, কৈশোরে যে ইচ্ছা অপূর্ণ ছিল এখন কি সেটা পূর্ণ হবে? একটি বিয়ে, একটি নতুন ঘর। শুধুই আনন্দের জন্য বেঁচে থাকো।
রশি তুমি কিছু বলছ না যে? তুমি কেমন আছ?
আমি স্বপ্ন দেখছি।
স্বপ্ন? এই বয়সে আর স্বপ্ন কি?
তোমার সঙ্গে নতুন ঘরের স্বপ্ন।
হা-হা হাসিতে তোলপাড় করে দেয় তোরাব। দু’কান ভরে সেই শব্দ শুনবে বলে কান পাতে রাশিদুন। চারদিকে প্রবল নিস্তব্ধতা। শূন্যতা ঘুরপাক খায়। পাখির ডাক নেই। বাতাসের শব্দও না।
মধ্য গগনে চাঁদ।
রাশিদুন হাঁটুর ওপর মাথা রাখে। ভাবে, কেন এমন একটি স্বপ্ন ওকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করল? এখন আমি তোরাবের সঙ্গে ঘরের মধ্যেই আছি- যে ঘরের ছাদ-বেড়া নেই। এই ঘর স্মৃতির ঘর- তোরাবের সঙ্গে স্মৃতি আর ম্লান জ্যোৎস্না রাতে স্মৃতির খুনসুটি। রাশিদুনের বুক ভেঙে যায়। দীর্ঘশ্বাস ছড়ায় চারদিকে। জীবনের না পাওয়া আকাক্সক্ষা ওকে মরমে মারছে- ওর মধ্যে কেন এই ভাবনা? এখনতো মেয়েদের বিয়ের সময়। যাদের জন্মের পরে একটি করে ফুলের নাম দিয়ে নাম রেখেছে- যেন মেয়েরা ওর চারপাশে ফুলের সৌরভ ছড়ায়।
বকুল বিদেশে যাচ্ছে। টাকা উপার্জন করবে। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলেছে, মাগো, আমার আয়ের টাকা দিয়ে বাড়িতে দালান উঠাব। আপনাকে নিয়ে যাব। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
রাশিদুন বিস্মিত হয়ে বলেছিল, আমি? আমি কেন ওই বাড়িতে যাব?
আমি বাড়ি বানালে সেটা আপনার মেয়ের বাড়ি হবে। আমরা চাই বুড়োকালে আপনি দু’দণ্ড শান্তিতে থাকবেন।
তোমাদের বাজান?
বাজানও থাকবে। আপনি আর বাজান দু’জনে বারান্দায় বসে পান-সুপারি খাবেন, আর গল্প করবেন।
রাশিদুন দ্রুত উঠে বলে, তা হবে না। তোমার বাজান আমার কছে এখন পরপুরুষ।
বকুল বিড়বিড় করে বলেছিল, পরপুরুষ!
রাশিদুনও একই ভঙ্গিতে বলেছিল, তালাক হয়েছে না!
তালাক! বকুল নিজের দ্বিধা কাটাতে পারে না।
রাশিদুনও রাগ এবং বিষণ্ণতার ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। বুঝতে পারে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। যে মেয়ের জন্মের পর একটি প্রবল ঝগড়া হয়েছিল ওদের সেই মেয়ের সামনে এখন বিশাল- পরক্ষণে মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে বলে, একটা কথা মাগো-
বল, কি? থামলি কেন?
লজ্জা লাগছে বলতে।
বল, বল, আমি কিছু মনে করব না।
বকুল ইতস্তত করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, পরপুরুষের সঙ্গে তো কথা বলা যায়। সবাই তো সবার সঙ্গে কথা বলে। আপনি তো কথা বলবেন। বাজানের সঙ্গে একঘরে ঘুমাবেন না মাগো।
কথাটি বলে এক ঝলক মায়ের দিকে তাকিয়ে বকুল একলাফে উঠান পার হয়ে মামীর চুলার পাশে গিয়ে বসেছিল। আমার ভেতরটা তোলপাড় করছিল। ভাবছিলাম, মেয়েটা মায়ের সামনে সত্য কথা বলেছে। ও ঠিকই বলেছে। আমার দ্বিধা কেটে যায়।
রাশিদুন ভেবে দেখল, আজ এই রাতে বকুলের বলা সত্যি কথা ওকে স্বস্তি দেয় না। যে জীবন তার দেখা হয়েছে সেখানেও আর ফিরে যেতে চায় না। সামনে যেটুকু পথ যেতে হবে সেই পথও তোরাবের হাত ধরে পার হতে চায়। তোরাবের স্মৃতি বড় স্পষ্ট এবং মধুর। তোরাবের পুরোটুকু দেখা হয়নি, তারপরও না দেখা মানুষই এখন ওর স্বপ্নে।
ম্লান জ্যোৎস্না রাতে পুরো চরাচর নিস্তব্ধ হয়ে গেলে জোনাকির আলোও জ্বলে না, কিন্তু রাশিদুন বুঝে যায় আর একটি জীবনের আকাক্সক্ষায় ওর শরীর মন তোলপাড় করছে। ও আর পেছন ফিরে দেখবে না।
ঝিঁঝির শব্দ শোনার জন্য ও কান পাতে। মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনার জন্যও কান পাতে। শুনতে পায় বকুল বলছে, আম্মা আমি যাচ্ছি। আবার আপনার সঙ্গে কবে দেখা হবে জানি না। বিদেশের কাজে কেমন থাকব জানি না। আপনি ভালো থাকবেন আম্মা। আপনি আমাদের আদরের মা।
রাশিদুন ছটফটিয়ে ওঠে। বাস্তবে ফিরে আসার সময় হয়েছে। অতীতের টানাটানি জীবনের সুরাহা নয়।
আগামীকাল বকুল দুবাইয়ের পথে রওনা করবে। রাশিদুনের বুক কেমন করে।
উঠোনে নেমে দাঁড়ায়। ম্লান জ্যোৎস্নায় ছেয়ে খাকা প্রাঙ্গণ পূর্ণিমার আলোয় ভরে উঠতে থাকে। নিজেকেই বলে, রশিরে হারিয়ে যাওয়া দিন কোনোদিন ফিরবে না। নিজের মনের আঙ্গিনায় ম্লান জ্যোস্নাকে পূর্ণিমার সামনে আনতে হবে।
৪.
সকালবেলা ঘুম ভাঙে না শিউলির।
কত রাত পর্যন্ত কেঁদেছে জানে না। বাড়িতে কোনো ঘড়ি নেই। যদি থাকত, তাহলেও কুপি জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখার আগ্রহ ওর থাকত না। এক ঘোরের ভেতরে কেমন করে যেন রাতের সময় চলে গেছে। ওর ঘুম আসে আজানের সময়। আজানের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে, এমন এক চৈতন্য রহিত অবস্থায় ও ঘুমের ভেতর তলিয়ে যায়। এই মুহূর্তে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহের ভেতরে এক নিঃসাড় অবস্থায় আছে।
বকুল বিছানার ওপর বসে প্রথমেই শিউলির দিকে তাকায়। ওকে ঘুমাতে দেখে ভুরু কুঁচকে রাখে। ওর নিজের ঘুম ভেঙেছে বেশ প্রসন্ন চিত্তে। ভাবে, রাত খুব ভালোই কেটেছে। সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙেনি। মশার কামড় টের পায়নি। আসলে ওর জীবনের সুখের পাল্লা ভারি হয়েছে। সোহেল ওকে ভালোবাসার কথা বলেছে। দুজনে একসঙ্গে দুবাইয়ে কাজ করতে যাবে এমন স্বপ্ন দেখিয়েছে। শিউলির দিকে তাকিয়ে বুক ভার লাগে। ভাবে বিশেষ বয়সে প্রেমে না পড়লে দিন এবং রাত কুঁকড়ে যায়। সব কাজটাই সময়মতো হওয়া চাই। শিউলির ঘুম যদি আজ রাতে না ভাঙে তাহলে ভালোবাসাহীন জীবনের মৃত্যু ওদের সবাইকে কাঁদাবে। শিউলির ঘুম নিশ্চয়ই ভাঙবে। বকুল নিঃশব্দে বিছানা ছাড়ে। হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যায়। চুলো থেকে ছাই তুলে চুলো পরিষ্কার করে। রাতের বাসনকোসন নিয়ে ধুতে বসে রান্নাঘরের পেছনে। সব বোনেরা মিলে একটি জায়গা পরিষ্কার করে দিয়েছে থালা বাসন ধোয়ার জন্য। দুটো বালতি ভরা পানি রাখা হয়। বালতির পানি ভরে রাখার দায়িত্ব চম্পার। কখনো কাজটি করতে ভুলে না সে। বকুল একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল, তুই এমন বাপের মেয়ে হলি কি করে রে চম্পা? বালতি ভরাতে কখনো ভুলে যাস না?
ভুলব কেন? তোমরা আমাকে কাজটি করতে বলেছ, আমি করে যাই। ইয়ার্কিমারা কথা কিন্তু আমার সহ্য হয় না বকুল বুবু।
ইয়ার্কি করিনি। তোমার কাজের প্রশংসা করেছি।
হয়েছে রাখ। চম্পা মুখ ঝামটা দিয়েছিল।
থালা-বাসন সামনে নিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বকুল ভাবে, সোহেল কি কখনও ওকে এমন করে মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলবে? হয়তো বলবে। এক সময় ভালোবাসার কথা বলার দিন ফুরিয়ে যাবে। এক সময় ঝগড়া হবে, মারপিটও হতে পারে- নাকি মেরেও ফেলতে পারে। বকুল এটো বাসন-কোসনের ওপর হাত রেখে শিউরে ওঠে। ওর বাবারওতো এমন ভালোবাসার দিন ছিল, তারপর কেমন করে কি হয়ে গেল। বাবা-মায়ের মধুর জীবনের সঞ্চয় শেষ। এখন দুজনের হাত শূন্য কড়িতে ভরা। বকুল প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বাসন-কোসন ধোয়ার কাজ শুরু করে। চোখে পানিও আসে। ভাবে নতুন চলা শুরু হল। উঠোন থেকে অন্যদের কথা ভেসে আসছে। পদ্ম স্কুলে যাবে। ওর তাড়াহুড়ো আছে। চম্পার হাসির শব্দ শোনা যায়। হাস্নাহেনাও কি যেন বলছে। সব মিলিয়ে ভোরের পাখির কলরবের মতো সকালটা মনে হলেও নিজের ভারটা কমে না বকুলের। বুঝতে পারে এই নতুন যাত্রার সবটা সুখের নয়। ভালোবাসার কথা একদিন শেষ হবে।
ও বাসন-কোসন নিয়ে ফিরে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, এত হাসাহাসি কেন? ঘুম ভাঙতেই মুখে হাসি আসে?
আসবে না কেন? হাসিরতো মা-বাপ নাই। বকা খাওয়ার ভয়ও নাই।
হাসছিলি কেন তাই বল!
শিউলি বুবু মরার মতো ঘুমাচ্ছে।
কথা বলা শেষ করেই আবার হি হি হাসির রোল ওঠে।
চম্পা বলে, মানুষ যে মরার মতো ঘুমায় এই প্রথম দেখলাম।
বকুল ধমক দিয়ে বলে, তাতে হয়েছে কি? তোরা কি বুবু মরে গেলে খুশি হবি?
ছি, ছি, আমরা তাই বলেছি নাকি। বকুল বুবু তুমি না এমন করে কথা বলো।
বকুল ওদের দিকে না তাকিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। ওদের হাসি কখনও থামেনি। ওরা হাসতেই থাকে। বাসন-কোসন রাখার জন্য পিঁড়ির ওপর বসলে ওর মাথা হাঁটুর ওপর নেমে আসে। ও নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারে না। কাঁদতে শুরু করে। সোহেলের ভালোবাসায় নানা পোকা এবং পোকার বিষাদ কামড় যেন ওকে জ্বালিয়ে মারে। যে প্রসন্ন মন নিয়ে ঘুম ভেঙেছিল সেই মনের অবস্থা কত তাড়াতাড়ি বদলে গেল। হায় নিষ্ঠুর দুনিয়া। ওর কান্নার শব্দ শুনে তিন বোন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। সমস্বরে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে বুবু? আমরা কি কিছু করেছি?
বকুল কাঁদতেই থাকে। ওদের দিকে মুখ ফেরায় না। হাস্নাহেনা বলে, থাক, আমরা আর কথা বলব না। বকুল বুবুর বোধ হয় মায়ের কথা মনে হয়েছে সে জন্য কাঁদছে।
তিনজনে ফিরে আসে ঘরের বারান্দায়। পদ্ম বলে, তুমি আমাকে পান্তা ভাত দাও হাস্নু বুবু। আমি স্কুলে যাই।
মনে আছে, কাল রাতে রান্না হয়নি। আমরা দুধভাত খেয়েছি।
বলবে তো পান্তা আছে, কিন্তু কোনো তরকারি নাই।
হ্যাঁ সেটাই বলতে চেয়েছিলাম। তার আগে তুই আমাকে ঝাড়ি দিয়ে দিলি।
এটা কোনো রাগের ঝাড়ি না। সত্য কথার ঝাড়ি।
ওরে আমার সত্যবতী। কোন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধবি?
আয় বেঁধে দিই।
লাল-সবুজ ফিতা দিয়ে চুলের বেণী ঝুলিয়ে দাও।
যা নিয়ে আয়।
পদ্ম ঘরে ঢুকে দেখে বিছানার ওপর বসে আছে শিউলি। চেহারায় বিরক্তি আর কান্না যেন জমে আছে। চুল উসকো-খুসকো। খোঁপা করেনি। পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। শাড়িও গায়ের ওপর ঠিক নাই। পদ্ম কাছে গিয়ে বলে, কি হয়েছে?
তুই রেডি হোসনি কেন?
তখন চুলের বেণী করব। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান্তা খাব। তারপর একদৌড়ে সবার আগে স্কুলে পৌঁছে যাব। আমার আগে কেউ পৌঁছাতে পারব না বুবু। তুমি যাবে না স্কুলে?
যাব। শুধু কাপড় বদলাব। তারপর ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে রওনা করব।
পদ্ম হাসতে হাসতে বলে, তুমি তো আমার মতো দৌড়াতে পারবে না। তুমি না হেডমিসট্রেস।
ও তাক থেকে চুলের ফিতা নিয়ে বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকায়। দেখতে পায় শিউলি কাঁথা-বালিশ গুছিয়ে রাখছে। হঠাৎ ওর মনে হয় আজকে বকুল বুবুর যেন কি হয়েছে। তার মনেও দুঃখ। পদ্ম কাছে এসে দাঁড়ালে হাøাহেনা ওর চুলে হাত দেয়। সিঁথি করে। সমান করে আঁচড়ে বেণী করে। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জয়নুল মিয়া। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড়িমুড়ি ভেঙে বলে, তোরা কি করিস রে?
স্কুলে যাওয়ার তোড়জোড় করি বাজান।
শিউলি চলে গেছে।
না, যাবে। বিছানা গোছাচ্ছে।
বিছানাটা তোরা গোছাতে পারিস না।
কেন হেডমিসস্ট্রেস হলে বিছানা গোছানোর কাজ করতে হয় না বাজান?
এই বুঝলি তোরা!
জয়নুল মিয়া বিরক্ত হয়ে উঠোনে নেমে যায়। রান্নাঘরে বকুল মরিচ পোড়াচ্ছে। মরিচের ঝাঁঝালো গন্ধ গড়াচ্ছে চারদিকে। জয়নুলের মনে হয় বাতাসে মাটিতে সবখানে পোড়া মরিচের গন্ধ আর ওর মাথায় ঘূর্ণি উঠিয়েছে। ও নিঃশব্দে বাইরে চলে আসে। ভাবে, আমি সারা দিন ধানক্ষেতে কাজ করব। দুপুরে খেতেও আসব না বাড়িতে। আজ ওর কাজের দিন। সোনালি ধান কাটার দিন। কিন্তু সকাল তেমন ফোটেনি। ও একজন উদভ্রান্ত মানুষের মতো দিকভুলে মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে যাচ্ছে পাকা ধান। বলছে, জয়নুল মিয়া কোথায় যাও?
মামার বাড়ি কতদূরে?
পদ্মপুকুরপাড়ে। পুকুরে সোনালি মাছ আছে। সোনার সুতোয় বানানো জালে সেই মাছ ধরব।
ভেসে আসে বয়াতীর কণ্ঠ- পরাণ গেল পাখি আমার রে- ও পাখি- কতদূরে যাবি-
জয়নুল ফিরে দাঁড়ায়। ওর মনে হয় বয়াতীর গান শুনে ওর ভেতরের ঘোর কেটে যাচ্ছে। আসলে রাতে রাশিদুনকে স্বপ্ন দেখার পরে ওর ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ও রাশিদুনকে বলেছিল, আমার কথা কি তোমার একটুও মনে পড়ে না শিউলির মা। কেমন করে আমাকে ভুলে গেলে। রাশিদুন মাছ কাটার বঁটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, তুমি একটা হারামী। তুমি কেমন করে তালাকের কথা বললে। আমি তোমাকে কোনোদিন মাফ করব না।
জয়নুল ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে আসতে আসতে বলে, তবে আমাকে কে মাফ করবে শিউলির মা। তোমার দোহাই লাগে শিউলির মা- কি দোহাই লাগে? জয়নুল চারদিকে তাকায়। দেখতে পায়- গান গাইতে গাইতে অনেক দূরে চলে গেছে বয়াতী। এই ভোরবেলায় ও কোথায় যাচ্ছে। কি দরকার আর একজনের পথচলা খুঁজে দেখা। যে যার মতো চলুক। চলতে চলতে শেষ করুক জীবনের শেষ দিন। এই এখন যেমন জয়নুল মিয়াকে একা একা দিন শেষ করতে হচ্ছে।
পাশ দিয়ে সাঁই করে ছুটে যায় চম্পা ও পদ্ম। ওরা দুজনে স্কুলে যাচ্ছে। বাবার দিকে তাকায় না। ভাবটা এমন যে একজন মানুষ পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকলে কিইবা এসে যায়। ওদের ছুটতে হবে। তাই ওরা ছুটছে। এক সময় জয়নুল মিয়ার চোখের আড়ালে চলে যায় ওরা। বিষণ্ণ হয়ে জয়নুল বাড়িতে ঢোকে। ছুটে আসে হাস্নাহেনা, বাজান আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
ক্ষেতে গিয়েছিলাম। পাকা ধানের শীষ নাড়িয়ে ধানের অবস্থা দেখে এসেছি। কাটার সময় হয়েছে তো।
আপনি কার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন?
এই উঠোনোর দিকে তাকিয়ে। আর কয়দিন পরে এই উঠোনের কোনায় ধানের স্তূপ বোঝাই হবে।
ধান সেদ্ধ হবে। মাড়াই হবে। তারপরে ধান ভানার কলে যাবে। তখন বকুল বুবুর দুবাই যাওয়ার সময় হবে। বুবু আর লাঠি হাতে ধান পাহারা দেবে। আমি তখন কি করব বাজান? একা একা আমার খুব কান্না পাবে।
মাগো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো?
এই উঠোনের সঙ্গে।
ধানকাটার সময় হলে তোমার দাদী এই উঠোনোর সঙ্গে কথা বলত। ধান কাটার সময় হলে তোমার মাও এই উঠৈানোর সঙ্গে কতা বলত।
এখন আমরা কথা বলি। দাদী যখন কথা বলেছেন তখন দাদীর সংসার ছিল। আমার মায়েরও সংসার ছিল। আমাদের পাঁচ বোনের সংসার নেই। আমাদের উঠোনের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
আমাদের নসিবে বৈশাখী ঝড়।
আমি যাই।
জয়নুল মিয়া আবার বাড়ির বাইরে যায়। ভাবে দেখা হলে ওসমানকে বলবে, এ বছরে ওর ক্ষেতের ধান ও নিজে আর কাটবে না। লোক দিয়ে কাটিয়ে দেবে ওসমান। সেখান থেকে ধান চাল কলের চাতালে যাবে। এই উঠোন আর ধান দিয়ে ভরে উঠবে না।
জয়নুল মিয়া পা টেনে টেনে হাঁটে। কবে যেন পায়ে ব্যথা পেয়েছিল এখন আর মনে পড়ছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পা প্রথমে ঝাঁকিয়ে নেয়, পরে ব্যথা পাওয়া জায়গাটা টিপে ব্যথার পরিমাণ আন্দাজ করে নেয়। বুঝতে পারে কাবু করে ফেলার মতো ব্যথা নয়। অপরদিক থেকে হনহনিয়ে হেঁটে আসা তাজুল মিয়া ওর কাছে দাঁড়িয়ে বলে, হয়েছে আপনার?
কিছু না। আপনি আপনার পথে যান।
কথা বললেই আপনি এমন তিড়িংবিড়িং করেন কেন?
ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না?
না পারি না। আপনার সঙ্গে পারি না। আপনি ঘরে বউ রেখে আমার শিউলির দিকে চোখ দেন। আপনার লজ্জা করে না?
লজ্জা আবার কিসের? বিয়ে করতে চেয়েছি। রক্ষিতা রাখতে চাইনি। ভাত-কাপড় দিতে পারব।
আর একবার এই কথা বললে জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
বাপের মুরোদ তো পাইপয়সা নাই। মেয়েগুলোকে দিয়ে ঘরের খুঁটি বানিয়েছেন। মেয়েদের ঘাড়ে বসে ভাত-খাওয়া।
তবে রে শুয়োরের বাচ্চা
ছোট একটি ইটের টুকরো কুড়িয়ে ছুড়ে মারার জন্য তৈরি হতেই তাজুল মিয়া ছাতা খুলে নিজেকে আড়াল করে এবং দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায়।
স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বের হয় শিউলি। খানিকটুকু এগোতেই বাবাকে পথের ধারে বসে থাকতে দেখে দৌড়ে কাছে যায়। হাত ধরে টেনে তোলে।
কি হয়েছে বাজান?
শুয়োরের বাচ্চা তাজুল বলে আমি মেয়েদেরকে ঘরের খুঁটি বানিয়েছি।
ও শয়তানটাকে পেলে আমি ওকে বঁটি দিয়ে জবাই দেব। আপনি দুঃখ পাবেন না বাজান। বাড়ি যান।
বকুল আপনার পান্তা বেড়েছে।
জয়নুল মিয়া এদিক-ওদিক তাকায়। ভাবে, কোন বাড়িতে যাবে? যেখানে মেয়েরা ঘরের খুঁটি।
বাজান, চলেন আপনাকে বাড়িতে রেখে আসি।
তুমি স্কুলে যাও মা। তুমি স্কুলের হেডমাস্টারনি। তোমার দেরি হওয়া ঠিক হবে না। মাগো তুমি যাও। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
জয়নুল মিয়া বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় বাড়ির উঠোনে ঘরে পোড়া মরিচের গন্ধ ভরেই আছে। কোথাও থেকে গন্ধ সরেনি। জয়নুল মিয়ার মনে হয় বুকভরে শ্বাস টানতে পারছে না। বুক জ্বলে যাচ্ছে।
রান্নাঘর থেকে থালাভর্তি ভাত নিয়ে বকুল কাছে এসে বলে, বাজান বারান্দায় আসেন। মাদুর বিছিয়ে রেখেছি।
মাগো ভাত খেতে তো মন চায় না।
শরীর ভালো নাই।
জয়নুল নিজের হাত কপালে দিয়ে বলে, জ্বর আছে তো মনে হয় না। আমার মনে হয় দুনিয়ায় যত অসুখ আছে তার সব এখন আমার শরীরে ঢুকছে। বলছে, জয়নুল মিয়া তোমাকে ভালো থাকতে দিব না।
বাজান আপনি যে কিসব কথা বলেন। এমন করে ভাবলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন। আপনি আমাদের বটগাছ। আপনার ছায়া না হলে আমরা তো বাঁচব না। আসেন ভাত খান।
পোড়া মরিচের গন্ধে বুক জ্বলে যায়।
মরিচ তো সেই কখন পুড়িয়োছি। এখন গন্ধ নাই। এই যে আমি শ্বাস টানছি। কই গন্ধ তো পাই না।
আমি তো গন্ধ পাই। শ্বাস টানতে পারি না।
উঠোনের অপর দিক থেকে ছুটে আসে হাস্নাহেনা। বাবার হাত ধরে বলে, আপনাকে আজকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। শুধু আপনি আর আমি যাব। বকুল বুবু যাবে না।
কোথায় যাবি রে?
হাস্নাহেনা বাবার দুহাত ধরে বলে, বাবাকে নিয়ে সেই বটগাছের নিচে বসিয়ে দেব।
কোন বটগাছ?
যে বটগাছের কাছে আমার মা থাকে। ওখানে বাজানকে বসিয়ে রেখে আমি মাকে দেখতে যাব। তারপর বাজানকে নিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসব। বেশি সময় লাগাব না বকুল বুবু।
তুই কি বলিস? যত্তসব বাজে কথা।
না, মোটেই বাজে কথা না। পোড়া মরিচের গন্ধ তো বাজানের বুকের মধ্যে। ওই বটগাছের নিচে কতক্ষণ বসলে বাজানের শরীর থেকে পোড়া মরিচের গন্ধ বেরিয়ে যাবে।
জয়নুল মিয়া হাঁ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, মেয়েটা বোধ হয় ঠিকই বলেছে। রাতে স্বপ্ন দেখার পর থেকেই তো এমন লাগছে। বাবাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বকুল বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। অবাক হয়ে ডাকে বাজান।
হাস্নাহেনার সঙ্গে আমি যাব মাগো।
যাবেন? বকুলের বিস্ময় কাটে না।
জয়নুল মিয়া ঘাড় নেড়ে মৃদুস্বরে বলে, যাব।
বকুল এবার চেঁচিয়ে বলে, যাবেন?
জয়নুল মিয়া মুখে কিছু বলে না। শুধু ঘাড় কাত করে।
আপনি না বলেছিলেন, আজকে ধান কাটবেন।
কাটব। ওই বটগাছের নিচ থেকে ফিরে এসে কাটব।
তাহলে ভাত খান বাজান।
বকুল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ওর বুকের ভেতর হালকা হয়ে যায়। ভাবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা টিকে থাকে। মাঝে যত ঘটনাই ঘটুক না কেন। সারা সকাল নিজের ভেতরে যে যন্ত্রণা ছিল সেটা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায়। বকুলের ভেতরে প্রসন্ন ভোর স্থির হয়ে গেলে ও দ্রুত বাবার দিকে তাকায়। ওর বাবা খুব শান্ত চিত্তে পান্তা ভাত খাচ্ছে। তাকে একজন ধ্যানী মানুষই মনে হচ্ছে। ওর দুঃখ হয় এমন প্রশান্ত মনে ভাত খাওয়ার সময় ওর বাবাকে যদি এক টুকরো ইলিশ মাছ দেয়া যেত। নেই। একটা ডিমও ঘরে নেই। ও বাবার জন্য গ্লাস ভরে পানি নিয়ে আসে। দেখতে পায় হাস্নাহেনা বেণী করে চুলের মাথায় লাল আর হলুদ ফিতা দিয়ে চমৎকার ফুল ফুটিয়েছে। বকুল খুশি হয়ে ভাবে, আজকের দিন ওর একলার। নিশ্চয় সুযোগ বুঝে সোহেল আসবে। এসে বলবে, তুমি আমার সামনে হাত পাত বকুল। ও দু’হাত পেতে দাঁড়ালে সোহেল একমুঠু বকুল ফুল দিয়ে বলবে, এগুলো শুধু গাছের বকুল না। আমাদের ভালোবাসার ফুল। শুকিয়ে গেলেও ফেলে দিও না। কৌটায় ভরে রেখে দিও। বিয়ের পরে আমরা এই ফুল দিয়ে নতুন করে মালা গাঁথব।
মাগো পনি দাও।
বাজানের ডাকে ও নিজের ভেতর ফিরে আসে। বাবার সামনে গ্লাস এগিয়ে দেয়। ওকে দেখে জয়নুল মিয়া কিছু একটা আন্দাজ করে বলে, তোমাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে মা।
আপনি যে আম্মার কাছে যাবেন, সেজন্য খুশি লাগছে।
ও তাইতো, তাইতো।
জয়নুল মিয়া গ্লাসের পানি দিয়ে বাসনে হাত ধুয়ে নেয়। ঘাড়ের ওপর রাখা গামছা দিয়ে মুখ মোছে। ভাবে, মেয়েগুলো না থাকলে বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের হতো। সুন্দর একটি জামা পরে হাস্নাহেনা আসে। হাতে বাবার জন্য একটা ফতুয়া। বলে, গায়েরটা খুলে এইটা পরেন। বকুল বুবু আপনার জামাটা ধুয়ে দিবে। ময়লা হয়ছে। জয়নুল আবার ভাবে, মেয়েগুলো না থাকলে এই যত্ন কে করত!
বাড়িটা শূন্য হয়ে গেলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কবুল ভাবে, এই বাড়িটি আজ ওর আর সোহেলের। কি মজা! কি মজা! প্রেম ছাড়া মানুষ বাঁচবে কেন? মানুষের বাঁচার জন্য যা দরকার তার সব আমার চাই- বকুল দু’হাত উপরে তুলে ঘুরপাক খায়। আমার বাজান আমার জন্য বড় শিক্ষা। কত মনে করে মাকে- আহা বাজান আমার। শুধু একটা ভুল করে এখন কেঁদেকেটে, স্বপ্ন দেখে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। ধানকাটা বন্ধ করে মায়ের বাড়ির কাছে বাতাস টানতে গেছে। সেই বাতাস টেনে বুকের ভেতরের, পোড়া মরিচের গন্ধ বের করে দেবে। বাজান আপনেরে একশ বছর আয়ু দেক আল্লাহ। আপনার মেয়েরা আপনার চারপাশে থাকবে। কেউ আপনাকে ছেড়ে যাবে না।
উঠোনে ঢোকোর আগে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় সোহেল আসছে। বেশ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বকুল কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। সোহেল হলে ওকে ডাকতে হবে। এই বাড়িতে ও এসেছে। কিন্তু খালি বাড়িতে না। বেশিরভাগ সময় বাড়িতে সবাই থাকতে এসেছে। তখন তো ভালোবাসার কথা হয়নি। সে সময় আর এ সময় এক নয়। ও বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সোহেলকে জানাতে হবে যে বাড়িতে কেউ নেই। আনন্দে ওর শরীর হিম হয়ে যায়। ও বাঁশের বেড়ার গায়ে নিজেকে ছেড়ে দেয়।
সোহেল কাছে এসে বলে, তোমাকে আমি দূর থেকে দেখেছি বকুল ফুল।
আমিও তোমাকে দেখেছি। চলো ভেতরে যাই।
ভেতরে? বাড়িতে কেউ নাই?
উঁহু। বকুলের ঠোঁটে রহস্যের হাসি।
সোহেল একরকম চেঁচিয়ে বলে, নেই?
কবুল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোহেলের হাত ধরে টেনে উঠোনে এসে দাঁড়ায়।
আজ অনেক গল্প হবে?
সোহেল চোখ বুঁজে বলে, হবে।
হবে বলতে চোখ বুজলে কেন?
দেখতে চাই।
কি দেখতে চাও? অবাক করলে।
দেখতে চাই সাগরের তল।
সাগর? এই গ্রামে সাগর কোথায়?
আছে। দেখা যায় না।
ও, তাই। সাগরের নাম কী?
ভালোবাসা। প্রেম।
ভালোবাসা? প্রেম?
হ্যাঁ, তাইতো। বুঝতে পারছ না?
পারছি। ভালোবাসার সাগর।
সোহেল ওর দুহাত জড়িয়ে ধরে বলে, এখন আমরা কি করব?
গল্প।
শুধু গল্প?
তো আবার কি।
তাইতো, তো আবার কি।
উঠোনের জামগাছের নিচে বসে অজস স্বপ্নের কথা বলে যায় দু’জনে। দু’জনেই ভাবে ভালোবাসার প্রথম দিকের দিনগুলো এমনই হওয়া উঁচিত। কলকলিয়ে কথা বলে, হেসে, শুধু হাতে হাত লাগানো স্পর্শের সাগর বানিয়ে, দিনের গড়িয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে, পার করে দেয়া- আবার সূর্য-ওঠা- আবার দিনের শুরু।
বকুল প্রশ্ন করে, আমাদের সুখের দিনগুলো কি এমন থাকবে?
দাঁত কিড়মিড় করে সোহেল। খুব নিঃশব্দে, যেন বকুল কিছু বুঝতে না পারে। নিজে নিজে বলে, সুখের দিন না ছাতু, শুধু এভাবে বসে থাকলেই কি মন ভালোবাসায় ভরে যায়? হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেইতো বোঝা যেত ভালোবাসা কত সুখের! এমন সুযোগ পাওয়া কি বারবার ঘটবে? জয়নুল মিয়া কতবার শরীর থেকে পোড়া মরিচের গন্ধ তাড়াতে বটগাছের নিচে বসে থাকবে? ওর রাগ হয়।
বকুল আবার বলে, কিছু বললে না যে?
আমি তোমার মতো এতো বোকা না?
বোকা? তুমি কোথায় আমার বোকামি দেখলে?
সুখের দিনটিন এসব নিয়ে আমার ভাবনা নাই।
যত্তসব পেঁয়াজী ভাবনা।
তুমি এমন করে বললে?
তোমার বাবাকে দেখে বোঝ না যে সুখের দিন কেমন করে শেষ হয়।
বকুল দু’হাতে চোখ মোছে। সোহেলের হাত ছেড়ে দেয়। ধম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, প্রেম না হতেই শরীর খোঁজ এ তোমার কেমন ভালোবাসা? দরকার নাই ভালোবাসার।
রাগ করো না বকুল ফুল। আমি তো তেমন কিছু বলিনি। বোঝাতে চেয়েছি যে প্রেমের পথে কাঁটা আছে।
থাকুক কাঁটা থাকুক। আজ তুমি যাও। শিউলি বুবুর আসার সময় হয়েছে। পদ্মও আসবে।
তুমি কি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?
জানি না। এখন যাও। মনে রেখ সময় বুঝে সবকিছু চাইতে হয়। নইলে গোবরের ঘুঁটেও মেলে না।
যাই। আবার আসব।
বকুল কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। উঠোনজুড়ে ঘূর্ণি। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভালোলাগার সবটুকু। শুরুই যদি এমন হয়, তাহলে বাকি থাকবে কি! সুখের কোনো স্থায়ী সময় নেই নাকি? প্রবল ভাবনায় বকুলের চারদিকে তোলপাড় করে? তাহলে মনে করতে হবে বাজান যে বটগাছ তলায় বসে আছে এটাও সুখের একটা দিক। ও বিমূঢ় হয়ে থাকে। ভাবনা নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারে না। ও ভেবেছিল একরকম, হয়েছে আর একরকম। ও বুঝতে পারছে ওর মধ্যে দুঃখের চেয়ে রাগ বেশি। ক্রোধে ওর চারপাশে আবার ঘূর্ণি ওঠে। ও বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকতে না পারলে পায়চারি করে। উঠোনে কয়েকবার ঘুরে রান্নাঘরের দরজায় বসে। বসে থাকাও হয় না। গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালে দেখতে পায় বেশ খানিকটা দূরে রাস্তার ধারে বসে আছে সোহেল। ওকে গেটের সামনে দেখে একছুটে বকুলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে মাফ করে দাও বকুল ফুল। আর এভাবে কথা বলব না। আমি ভুল করেছি।
বকুলের ভেতরে আবার তোলপাড় ওঠে। ও সোহেলের মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বাড়িতে ঢোকে। সোহেল পিছে পিছে এসে বলে, তুমি মাফ না করলে আমি উঠোনে বসে থাকব। যাব না। সবাই এসে দেখুক যে আমি বকুলকে ভালোবেসে এখানে বসে আছি।
না, বসবে না। তুমি যাও।
তাহলে বলো, মাফ করেছো?
ঠিক আছে, মাফ করলাম।
হা-হা করে হেসে সোহেল বলে, তোমার আঙুল দাও আমাকে। আমি ধরে বলি, তবে।
বকুলের তর্জনী ছুঁয়ে ও বেরিয়ে যায়। বকুল আবার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, ছেলেটি বোধহয় খানিকটুকু পাগল। পাগলের সঙ্গে কি ঘর হয়? নসিব! বকুল কপাল চাপড়ায়। আবারও প্রবলভাবে ওর চারদিকে তোলপাড় ওঠে। ও এক ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করলে দেখতে পায় শিউলি বাড়ি ফিরেছে।
শিউলি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তোর কি হয়েছে বকুল?
বকুলকে প্রশ্নটি করার পরই বাবলার কথা মনে পড়ে শিউলির। ভেতরটা খচ করে ওঠে। ও আবার বকুলকে প্রশ্ন করে, কী হচ্ছে?
কি আবার হবে। মন ভালো নেই।
দেখে মনে হয় না যে মন ভালো নেই।
এমন সন্দেহ করার অভ্যাস তো তোমার ছিল না বুবু।
শিউলি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠোনের চারদিকে তাকায়। উঠোনের মাটিতে অন্য একটি পায়ের ছাপ মনে হয়। কিন্তু ঠিক স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে বকুলকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। উচিত হবে না। পাশাপাশি নিজের মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন স্থির হয়ে যায়- এ বাড়ির বাতানে আজ সম্পর্কের বাতাস বইছে। একটা কিছু ঘটেছে। শিউলি ভাবতে থাকে যে বকুলের সঙ্গে কারও প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে এবং ছেলেটি এই বাড়িতে এসেছিল। যে কারণে বাবলা ওর মনের মধ্যে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্পষ্ট নয়, স্পষ্ট ছায়া। ওর হাতের বই-খাতা, ছাতা, ভ্যানিটি ব্যাগ ধুপ করে পড়ে যায়।
কী হলো বুবু?
মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ এসেছিল।
যত্তসব, বাজে সন্দেহ। বাবার কাছে নালিশ দেব। বলব, বাজান আপনার বড় মেয়ের বিয়ে দেন। ওর মাথার গোলমাল হচ্ছে।
পড়ে যাওয়া জিনিসগুলো তুলতে তুলতে কথা বলছে দেখে শিউলির আর বকুলের মুখ দেখা হয় না। বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস আসে। বকুল সবকিছু হাতে নিয়ে বলে, চলো, ঘরে চলো। শিউলির মনে হয় বকুল নয় বাবলাই দাঁড়িয়ে আছে। ও ঘরের দিকে পা বাড়াতে পারে না। হাত মুখ ধোয়ার জন্য ঘরের পেছনে যায়। বালতির পানিতে হাত ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে ওর ভীষণ কান্না পায়। ও দু’হাতে পানি নিয়ে নিজের চোখ ধুয়ে ফেলে। পেছন থেকে বকুল বলে, এখন আর কেঁদে লাভ হবে না। যা ভুল করেছ তো করেছই। চলো, ঘরে চলো।
তুই যা।
তোমাকে না নিয়ে যাব না।
এই বাড়িতে আজ একটা কিছু ঘটেছে।
তোমার মাথা ঘটেছে। বুবু তুমি খুব সন্দেহবাতিক হয়েছ। তোমার মনের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে তাই বলো। বাবলা ভায়ের কথা মনে হচ্ছে?
কী বললি?
শিউলি ক্রুদ্ধ চোখে ঘুরে দাঁড়ায়। বকুল হকচকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। দু’পা পিছিয়ে বলে, ঘরে চলো। যা বলেছি আর বলবো না।
তুই যা বকুল। আমি এখন ঘরে যাব না।
তবে কী করবে? বসে বসে পানি ঘাটবে?
হ্যাঁ, তাই করবো।
তাহলে তাই করো। আমি গেলাম। তোমার খিদে পায়নি?
শিউলি ওর প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ও পানিভরা বালতির দিকে তাকায়। দু’আঁজলা পানি উঠিয়ে মুখে দেয়। ভাবে, বেশ লাগছে। ও বারবার দু’হাতে মুখে পানি দেয়। কতকাল যেন এভাবে মুখ-ধোয়া হয়নি। আশ্চর্য, কোনো কোনো সময় বুঝি এমনই। অন্যরকম হয়ে যেতে বলে না, কিন্তু করে দেয়। নিজেকে না বোঝার বাইরে নিয়ে যায়। বড় জটিল এই বেঁচে থাকা। কতদিন টানতে পারবে এই জীবন! বুড়ি ফুখুরি হয়ে একদিন ঘরের ভেতরে মরে পড়ে থাকবে। দেখার কেউ থাকবে না। এমন যদি হয় তিন দিন বা পাঁচ দিন কেউ খোঁজ করলো না? কী হবে তখন? পিপঁড়েয় ভরে যাবে মৃত শরীর? শিউরে ওঠে শিউলি। ভাবে, এখনই এসব ভাবার দরকার নেই। ওর নিজের কেউ না থাকলে কি হবে আশপাশের লোকজন থাকবে না? দূর সম্পর্কের কাউকে এনে কাছে রাখা যাবে না? মামার বাড়ি, চাচার বাড়ির কেউ? কিংবা বোনদের ছেলেমেয়েরা? শিউলি বালতির পানিতে নিজের চেহারা দেখার চেষ্টা করে। হয় না। ওর হাতের ছোঁয়ায় বালতির পানি স্থির নয়। দোলায়মান পানিতে ছায়ার রেখা স্পষ্ট হয় না। শিউলি শাড়ির আঁচলে মুখ মোছে। একই সঙ্গে টের পায় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। পায়ের শব্দ নিঃশব্দ হলে সেটা পানির আলোড়নে মিশে যায়। দুইয়ে মিলে এক হয়ে প্রবল কষ্ট দেয় শিউলিকে। ও দু’হাতে মুখ ঢাকে।
পেছন থেকে তিন বোন ওর গলা জড়িয়ে ধরে পাশে বসে পড়ে। ওর মনে হয় চারদিক থেকে কেউ বলছে, তুমি ভয় পেওনা। আমরা তোমার সঙ্গে আছি। তোমার কেউ নেই কে বলেছে, আমরা তো আছি। অন্য কোথাও থাকলেও ফিরে ফিরে তোমার কাছে আসবো। আমাদের জীবনে শ্বশুরবাড়ি মধুরহাঁড়ি কি হবে যে, আমরা বাজানের বাড়ি আসতে পারবো না? মায়ের মতো বড় বোনকে দেখতে?
পাশ থেকে পদ্ম বলে, আমরা ঠিক করেছি আমরাও তোমার মতো সারারাত বসে থাকবো।
কেন? তোদের দুঃখ কী?
তোমার দুঃখ কি শিউলি বুবু?
আমার কোনো দুঃখ নাই।
তাহলে এখানে বসে আছ কেন?
ইচ্ছা হয়েছে, মজা পাচ্ছি তাই।
ও এটা তোমার ফুর্তি? তাই বলো। তাহলে তোমার সঙ্গে বসে থাকা আমাদেরও ফুর্তি।
শিউলি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে, আমাকে তোরা বিরক্ত করবি না বলে দিলাম।
তুমি বললেই হলো নাকি, একশোবার করব।
একদিন দেখবি এই বাড়িতে আমি একলা মরে পড়ে আছি। শকুন ঠুকরে খাবে, পরে শিয়াল কুকুরে লাশ টেনে নিয়ে গর্তে ফেলে খাবে। কঙ্কালটা-
চুপ কর। পদ্মর হাত এক বড় মানুষের থাবার মতো শিউলির মুখ চাপা দেয়। কঠোর স্বরে বলে, আর একটা কথা বলবিতো-
শিউলি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এক ঝটকার পদ্মর হাত ছাড়িয়ে বলে, এই বাড়িতে আজ বাইরের ছেলের গন্ধ পেয়েছি। তোরা সবাই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিস।
বকুল দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে বলে, আমরা তো যাবই। যাবো না কেন? আমরা কি সবাই তোমার মতো আইবুড়ো হব? বলো তুমি কি চাও?
আমি চাইলেই কি তোরা শোনার জন্য বসে থাকবি?
আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ। মুহূর্ত সময় সর্বত্র। শিউলির কণ্ঠ আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে- কি সবাই চুপ কেন?
বকুল বলে, আমরা আইবুড়ো হবো না।
চম্পার গলা ধরে যায়। কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে, আমি সংসার না করে থাকতে পারব না।
পদ্মর স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।, আমিও ঘর চাই। পুরুষ মানুষ চাই। তোমাকেও চাই। যেখানে থাকি তোমার কথা মনে করব।
পদ্ম ঠিকই বলেছে। আমরা সবাই তোমাকে মধ্যমণি করে রাখব।
বকুল সরাসরি শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে, আমি চাই তুমিও বিয়ে করবে। তোমার একা থাকা চলবে না।
শিউলি দু’হাতে মুখ ঢাকে। ওদের দিকে তাকাতে পারে না। ওর ভয় করে। ও ভয়ে কুঁকড়ে যায়। তারপর সোজা হয়ে বসে বালতিটা উল্টে ফেলে দিয়ে বলে, আমি সারাজীবন একাই থাকব। মাস্টারি করে জীবন শেষ করব।
তুমি আমাদেরকে চাও না?
চাইব না কেন? চাই। তোরা শ্বশুরবাড়িতে থাকবি আর আমার এখানে আসা যাওয়া করবি।
এইতো বেশ ভালোমানুষীর মতো কথা বললে। চলো আজ খিচুড়ি আর ডিম ভাজি হবে।
শিউলি চোখ বড় করে বলে, বাজান আর হাস্নার কি হলো? আসে না কেন?
আসবে, আসবে ভাবার কিছু নাই।
মা বোধহয় বাড়িতে নাই। সে জন্য হাস্না বসে আছে।
মা আবার কোথায় যাবে?
কেন মায়ের ধাত্রীর কাজ আছে না। গাঁয়ের কোনো বাড়িতে হয়তো কারো প্রসব বেদনা উঠেছে। মা গেছে ফ্রি ধাত্রীগিরি করতে।
হি-হি করে হাসে বকুল। ওর হাসিতে গা জ্বলে ওঠে শিউলির। ধমকের সুরে বলে, এটা কোনো হাসির কথা না। যত্তসব ফাজলামি।
শিউলির ধমকের কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করে বকুল আর একদিকে তাকিয়ে বলে, আমি চাই আমার প্রথম সন্তান মায়ের হাতে হবে। সব তার চাঁদমুখো নাতির দিকে তাকিয়ে বলবে, আলাই বালাই চলে যা। নাতির চোখে চাঁদের-
কথা শেষ না করে বকুল একছুটে বাড়ির উঠোনে চলে যায়। ওর পেছনে পেছনে চম্পা আর পদ্মও দৌড় দেয়। দাঁড়িয়ে থাকে শিউলি। ভাবে, বকুলের কাছে আজ পুরুষ এসেছিল। কে? আকাশ-পাতাল হাতড়িয়ে নাম খোঁজে ও। কারো চেহারা সামনে আসে না। বকুল সংসারের স্বপ্ন দেখছে, এমনকি সন্তানেরও। কাউকে না পেলে কি এমন স্বপ্ন দেখা যায়? আজ বকুলের কাছে কেউ এসেছিল, এমন একটি স্থির বিশ্বাস ওর মধ্যে জন্মায়।
শেষ বিকেলে ফিরে আসে জয়নুল মিয়া আর হাস্নাহেনা। দুজনের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ শুধু নয়, তারা যেন এক বিধ্বস্ত মানুষ। শরীরের কতটা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে এসেছে কোথায়, তার কিছুই জানে না। বাকিটা থেকেও একটু একটু করে ঝরেছে রক্ত। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ফেলে হেঁটে এসেছে এতটা পথ। জয়নুল হাতে পুঁটলিটা রাখারও সুযোগ পায় না সেটা হাত থেকে পড়ে যায়। নিজে বারান্দায় বিছানা মাদুরের ওপর বসে পড়ে। তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে বুকের ওপর হাত জড়ো করে রাখে। চোখ বোজা। বড় বড় নিশ্বাসে বুকের পাঁজর ওঠানামা করে। চার মেয়ে ঘিরে ধরেছে তাকে।
হাস্নাহেনা কারও সঙ্গে কথা না বলে কলতলায় গিয়েছে। চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। ভাবছে, গোটা শরীর পানিতে ভেজালেও জ্বালা জুড়াবে না। বুকের ভেতর দাউদাউ আগুন। একটু পরে ও অর্ধেক ভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। খানিকটা দূরে নিজের পিঁড়িটার ওপর। ওদের পাঁচ বোনের পাঁচটা পিঁড়ি আছে। বাজানেরও একটা আছে। দাদীর আর মায়েরও ছিল। সেগুলো এখন মাচার ওপর ওঠানো আছে। চার বোন এখন পর্যন্ত বাবাকে প্রশ্ন করেনি। তাকে শান্ত হতে দিয়েছে। দম নিতে দিয়েছে। দেখতে পায় বাজানের বড় বড় শ্বাস কমে এসেছে।
শিউলি জিজ্ঞেস করে, বাজান পানি খাবেন?
জয়নুল মিয়া চোখ না খুলেই বলে, দাও মা।
পদ্ম দৌড়ে রান্নাঘরে যায়। জগে করে পানি আনে। ভাবে, বাজানের অনেক পিপাসা পেয়েছে। এক গ্লাস পানিতে হবে না। এবং পদ্মর আশঙ্কা সত্য করে জয়নুল মিয়া তিন-চার গ্লাস পানি খেয়ে বারান্দায় থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে কলতলায় যায়। আজ তার জীবনে সেই দিনটিই ফিরে এসেছে। এখন থেকে পনেরো বছর আগে সে তার সংসারে একটি বজাক কাবু করে ফেলেছে। বারবারই মনে হচ্ছে, দিন ফুরানোর আগের অবস্থা জয়নুল মিয়া এক বালতি পানি সামনে নিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকে। নিজের চেহারা দেখার চেষ্টা করে। দেখা হয় না। পানিতে গাছের ছায়া পড়ে কালো হয়ে গেছে। পরক্ষণে ভাবে, কোনোদিন আর নিজের চেহারা আয়নায়ও দেখবে না। যে মানুষের কর্মের দায় মাথার ওপর বোঝা হয়ে থাকে সে মানুষের চেহারা নিজের দেখা উচিত নয়। এমন একটি সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে শরীর মুচড়ে ওঠে। জয়নুল মিয়ার মনে হয় বুকে ব্যথা হচ্ছে। দু’হাতে বুক চেপে ধরলে মাথা বালতির ওপর ঝুঁকে যায়।
জয়নুল মিয়া জ্ঞান হারায়।
বারান্দায় চার বোন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। হাস্নাহেনা কাপড় বদলাবে বলে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। দরজা খোলেন। ওরই বা এত সময় লাগছে কেন? মামার বাড়িতে আজকে কি হলো? চার বোন পরস্পরের দিকে তাকায়। ভুরু কুঁচকায়, চোখ বড় করে, উথালপাথাল ভাবনায় ডুবে যায়- কিন্তু সমাধান ওদের কাছে নেই। ওরা অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার সময় ক্রমাগত দীর্ঘ হয়। এক সময় পদ্ম উঠে গিয়ে ঘরের দরজায় শব্দ করে।
হাস্নু বুবু দরজা খোল। আমরা তো মরে যাচ্ছি।
হাস্নাহেনা দরজা খুলে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, মরণ কি এত সোজা। মরণের জন্যও সওয়াব লাগে। ভাগ্য, ভাগ্য-
তুমি বারান্দায় আসো। আমরা মায়ের কথা শুনব। মায়ের কী হয়েছে?
মায়ের কিছু হয়নি। মা তো শুধু আমাদের মা না। মা তো একজন ধাত্রী-মা।
জানিতো। তার কি হয়েছে? তার জন্য তোমার মেজাজ খারাপ করছ কেন?
মায়ের হাতে একটি মেয়েশিশুর জন্ম হয়েছে।
তাতে হয়েছে কী? মাতো কত প্রসব করায়। এটাতো মার কাছে ডালভাত।
থাম, ছেড়ি থাম। শুয়োর একটা, হারামী।
চার বোন অবাক হয়ে হাস্নাহেনার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে যেটার সঙ্গে ওদের পাঁচ বোনের সম্পর্ক আছে। নইলে হাস্নাহেনা এমন করত না। ওদের বাজানও চুপসে আছে। কথা না বলে উঠোনে নেমে গেছে। হয়তো গোসল করছে। চারজন চুপ করে বসে থাকে। কিছুই ভালো লাগে না। কেমন করে যে জীবনটা কেমন হয়ে গেলো ওদের। কতকিছু পাওয়ার কথা ছিল, তার একভাগও পাওয়া হলো না। হাøাহেনা তখনও ফোঁস ফোঁস করছে আর চোখ মুছছে।
শিউলি ভাবে, মা এখন কী করছে? ধাত্রীর কীটবক্সটি পরিষ্কার করে রাখছে কি? নাকি গালে হাত দিয়ে বসে আছে? ভাবছে, কালো রঙের কাকগুলো যদি সব সাদা হয়ে যেত, তাহলে কেমন হতো? বাহ, মা কি এখনও শিশু নাকি? আচ্ছা, তার জন্মের সময় নানা কি মন খারপ করেছিল? নাকি বলেছিল মেয়ে আমার সোনার খনি?
শিউলি এটুকু ভেবে অন্যদের মুখের দিকে তাকায়। বলতে পারে, সব বোনের ভাবনায় এখন ওদের মা। ওদের মা ওর বুকের ভেতর ঢুকেছে কালো কাকের বদলে সাদা কাক হয়ে।
বকুল ভাবে, মা এখন কী করছে? বাড়ির আশপাশে বা কাছে-ধারে কোথাও কি আর একটি প্রসব করাতে গিয়েছে? ব্যথা উঠেছে সেই নারীর। মা জানে না ছেলে হবে না মেয়ে হবে। যে নারীর ব্যথা উঠেছে সে কুঁকাচ্ছে। ব্যথায় কেঁদে ফেলছে। আর মা অধীর আগ্রহে বসে আছে। অপেক্ষা করছে বচ্চাটির নাড়ি কাটবে বলে। মায়ের মন খারাপ হয়। ভাবে, পাঁচটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে সংসারের আলো তার জীবন থেকে মুছে গেছে। মা হয়তো ভাবছে, আরেক জীবনে কোনো বড় পাপ করেছিল। সেইজন্য এই শাস্তি। এখন ওদের মা ওর বুকের ভেতর ঢুকেছে কালো ভোমরা হয়ে। চাঁপা ভাবে, মা এখন কী করছে? নিশ্চয়ই কোথাও একটি বাচ্চা হয়েছে আর মা ওর শরীর মুছে দিচ্ছে কালো ন্যাকড়া দিয়ে। পুরনো কোনো শাড়ির ন্যাকড়া। কালো বলে সেই ন্যাকড়ায় রক্ত দেখা যায় না। মায়ের হাতে একটি ছেলের জন্ম হয়েছে। ছেলের নাড়ি কাটতে মায়ের কেমন লাগে? চাঁপার ভেতরটা ধড়ফড় করে ওঠে। মাতো ধাত্রী-মা। তার কাছে আবার ছেলে আর মেয়ে কি! ওদের কাছে যেমন সব পাখি সমান, পাখিদের ছেলেমেয়ে নাই। তেমনই ওর মায়ের কাছে সব বাচ্চা সমান। এখন ওদের মা ওর বুকের ভেতর ঢুকেছে একটা লক্ষ্মী প্যাঁচা হয়ে।
পদ্ম ভাবে, মা এখন কী করছে? কোথাও না গিয়ে নিশ্চয় বাড়িতে আছে। সুফির বাচ্চা হবে। সুফি ওদের মাসতো বোন। সেই বাচ্চার জন্য মা নিশ্চয় কাঁথা সেলাই করছে। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-কালো-বেগুনি-খয়রি রঙ্গের সুতো। কাঁথার ওপর সুতোর ফুল ফুটে উঠছে। গাছ-লতাপাতা থাকছে। পাখি থাকছে। বাচ্চার মুখও থাকছে। দোলনা থাকছে। ঝুনঝুনি থাকছে। হা-হা মায়ের ভালোবাসা আমার বুকের ভেতর নদী হয়েছে। সেই নদীর সোনালি মাছ আমার মা-মায়ের বুকে এখন নদীর স্রোত বইছে। সেই নদীর ডিঙিতে তার পাঁচ মেয়ে আছে।
তখন হাস্নাহেনা চোখ মুছে বোনদের মুখের দিকে তাকায়। ফিক করে হেসে বলে, তোমরা মায়ের কথা ভাবছ না?
ভাবছি তো। তুই ভাবিস না?
ভাবি তো। তোমাদের মতো আমিও ভাবি।
আমরা আমাদের বুকের ভেতর মায়ের ছবি বানিয়েছি। তুইও কি বানিয়েছিস?
হ্যাঁ, বানিয়েছি।
চার বোন এসঙ্গে কলকলিয়ে উঠে বলে, তাহলে বল তুই কি বানিয়েছিস?
আমি ভাবলাম, মা এখন কী করছে? নিশ্চয় একটা বড় মাঠে মা ফুল গাছের বীজ বুনছে। মাঠটা একদম পৃথিবীর সমান বড়। পৃথবীর পাঁচটা কোনা। এক কোনায় বুনেছে শিউলি ফুলের বীজ। আর এক কোনায় বকুল। এক কোনায় হাস্নাহেনা। এক কোনায় চাঁপা। আর এক কোনায় দীঘি বানিয়ে সেখানে দিয়েছেন পদ্মর চারা। দিন গড়াল। মায়ের লাগানো চারা বড় হলো। ফুলে ফুলে ভরে গেলো গাছগুলো। একসাজি ফুল মায়ের বুকের ভেতর রয়ে গেল। ফুলের গন্ধে মা পাগল হয়ে আছে। যত শ্বাস টানে তত ফুলের গন্ধে বুক ভরে যায়। আমার মা রানীর মতো বসে থাকে আর মিটিমিটি হাসে।
ঠিকই বলেছিস।
আমাদের মা রানী।
ধাত্রী-রানী। হুররে-
আমাদের রানী-মা আজকে রাগ করেছে কেন?
হাস্নাহেনা থেমে থেমে বলে, ছয় মাস আগে মায়ের হাতে একটি মেয়ের জন্ম হয়েছিল। মা ওর নাম রেখেছিল বুলি। মা বলল, খুব ফুটফুটে একটি মেয়ে ছিল।
হাস্নাহেনা থামলে পদ্ম উদগ্রীব কণ্ঠে বলে, ওর কি হয়েছে? মরে গেছে?
মরে যায়নি। এইটুকু মেয়ে নিয়ে নিজে নিজে মরতে পারে না
তাহলে মায়ের রাগ হয়েছে কেন?
ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
কেন ও মেয়ে বলে?
হাস্নাহেনা চিৎকার করে বলে হ্যাঁ তাই। ও মেয়ে বলে, মেয়ে বলে-। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ও। দু’হাতে মুখ ঢাকে। এক সময় মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে, আমি মায়ের সঙ্গে মেয়েটিকে দেখতে গিয়েছিলাম।
বেঁচে আছে?
আছে। মা ওকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। আমি যখন মায়ের কাছে যাই তখনই বাড়িতে খবরটা আসে। মা আমার হাত ধরে বলল, চল। দেখলাম মায়ের চোখে রাগ। রাগে চোখের জেল্লা চকচক করে।
গিয়ে কি দেখলি?
দেখলাম বাড়িতে লোকজনের ভিড়। মা চিল্লায়ে কাঁদে, মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। মেয়েটাকে ওর নানি কোলে নিয়ে ওঠানে দৌড়ায়। আর বুলি বুলবুলি পাখি হয়ে ওড়ে।
হি হি করে হাসে হাস্নাহেনা। সবাই বুঝতে পারে যে এটা কোনো হাসি না। এটা পেত্নীর হাসি। অন্ধকার রাতের ঘোর কৃষ্ণ হাসি। আকস্মিকভাবে শিউলি বোনকে কষে ধমক দিয়ে বলে, বুলির কি হয়েছিল?
ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
কে? কে এই পাষণ্ড?
হাস্নাহেনা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ওর মুখে এসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল।
আবার সবাই মিলে চেঁচিয়ে বলে,
কে? কে এই পাষণ্ড?
হাস্নাহেনা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ওর বাপ-ওর বাপ-
ওর বাপ!
স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। এক একটি মুখ যেন এক একটি পাথর খণ্ড। হাজার বছরের পুরনো কালো কুচকুচে পাথর। ওই পাথর খণ্ডের ওপর শ্যাওলা জমেছে। এই শ্যাওলায় ঢেকে গেছে চোখ-নাক-ভুরু-কপাল। হাস্নাহেনার মনে হয় বোনেরা পাথর হয়ে গেলেও ওর কিছু করার আছে। ও গল্প বলে, বুলির বাপ হরকত আর মা হাসমতআরা। দুজনের প্রেমের বিয়া- দুজনে দিনমজুরি খাটে। দিন আনে দিন খায়। হাসমতআরা ধান বেনে খুদকুঁড়ো জোগায়, হরকত হাটে কুলিগিরি করে। দুজনে কামাই করলে হবে কি বাড়িতে মাতবর হরকত। যখন তখন গায়ে হাত ওঠে। যখন তখন গোস্ত-মুরগি রান্না না করার জন্য চুলের ঝুঁটি ধরে। হাসমতআরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, এ কেমন প্রেম। গর্ভ হয় তার। হরকত শাসায়। বলে, পোলা চাই। মাইয়া হইলে বুঝবি। আমাদের ধাত্রী-মায়ের হাতে মাইয়া হয়। বাপ মাইয়া পয়দা করার শোধ নিছে। মেয়েটা এখন বাঁচলে হয়।
বকুল দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, তাহলে এ ঘটনায় বাবা-মায়ের দেখাদেখি হয়।
দেখাদেখি তো হবেই রাস্তাটা তো একটা। ওই পথেই মায়ের যাওয়া। আমার হাত শক্ত করে ধরে মা হনহন করে হেঁটে যায়। বাজানের দিকে ঘুরেও দেখে না। বাজান তো সেই বটগাছের নিচে বসে ছিল। আমি একটু দাঁড়াতে চাইলে মা আমার হাত ধরে জোরে টান দেয়। আমি আর কিছু বলি না। ঘটনার জায়গা থেকে ফেরার সময় মা নিজেই বাজানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
হাস্নাহেনা থামলে পাথরের খণ্ডরা নড়াচড়া করে ওঠে। মুখে কথা নেই। পরস্পরের দিকে তাকায়ও না। কেউ কারও মুখ দেখবে না এমন একটা ভঙ্গি সবার মাঝে স্থির হয়ে গেলে গল্প বলা আবার শুরু হয়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সেলিনা হোসেন- র আরো পোষ্ট দেখুন