কেরানিও দৌড়ে ছিল

image_1256_313403
১৪
কেরানির জীবন এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, আর আমাদেরও গল্পকথনের দরকার হতো না। বুড়িগঙ্গার পাড়ে, কাদার ভেতরে, ডাব-নারকেলের খোসা, খালি বোতল আর চানাচুর-বিস্কুটের ছেঁড়া প্যাকেট একদিন পচে গলে মিশে যায়। আমাদের কেরানিকেও যখন এখানে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়, সেও পতিত হয়ে পড়ে থাকতে পারত দিনের পর দিন। তারপর একদিন সে মাটিতে মিশে যেত, গলে যেত, বিলীন হয়ে যেত। এই সদরঘাট, এই বুড়িগঙ্গা এ লঞ্চের মিছিল, সবই থাকত, কেবল সে থাকত না। কেউ তার কথা মনে করত না। কে কার কথা পৃথিবীতে মনে রাখে? যারা বলে_ মনে রাখব, তারা মিথ্যা বলে!
না, বিধাতাও মনে রাখেন না। আমাদের সৃষ্টিকর্তাও মনে রাখেন না। এত অযুত তাঁর সৃষ্টি, ক’টা তিনি মনে রাখবেন? আমরা কি ঘোর অসহায়কালে বলে উঠি না_ আল্লাহ তুমি কি আমারে ভুইলা গ্যাছো?
হাঁ, অবিকল এই বাক্যটিই উচ্চারণ করে ওঠে কেরানি, কিন্তু তার হস্তিবাড়ির জন্মকালের ভাষায়_ আল্লাহ, তোমার কাছে বিস্সরণ হয়া গেইছোঁ কি মুই? কেরানির বোধকরি জন্মের ওপরই ঘৃণা ধরে যায়। যাবার কথাই। আমরা সাফাই দিয়ে বলতে পারি পাগলির গর্ভধারণ কেরানির কারণে নয়। তবু তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মালিকের লাথি তার জোটে। আর মালিকের লাথি মানে চাকরিও তার খতম হয়ে যায়। নীল সাগর-৩ লঞ্চ কেরানিকে ছেড়েই বরিশালের দিকে যাত্রা করে।
ভালো, একা আসে। মন্দ, দলে দলে। সুখের পর সুখ, হয় না। দুঃখের পর দুঃখ, এ তো নিত্যই। কেরানি তার চরিত্রের সুনাম হারায়, লঞ্চের চাকরি হারায়, মন্দের আর কী তবে বাকি থাকে তার? আছে, বাকি আছে। কোনোদিন যা হয় নাই, তাই আজ হয়।
গভীর রাতে বাসায় ফেরে কেরানি। বুলবুল মিয়ার ঘোড়া, তার শ্বশুরের ঘোড়া, এতদিনের চেনা ঘোড়া, সেই ঘোড়ার পায়ের চটাঙ একটা লাথিও কেরানি সে রাতে খায়। চুপিচুপি সে ঢুকছিল, ঘোড়ার আস্তাবলের পাশ দিয়েই গলি বেয়ে তাকে ঢুকতে হয়, তার সাড়া পেয়ে ঘোড়াটি একটু গলা ঘরঘর শব্দ করে ওঠে। তখন সে তার পিঠে হাত রেখে তাকে চুপ করাতে যায়। আর তক্ষুনি ঘোড়া তাকে লাগায় লাথি। তৎক্ষণাৎ বাবাগো বলে চিতপাত হয়ে পড়ে কেরানি। তার চিৎকারে বাড়ি জেগে ওঠে।
কী হইছে? ক্যাঠা রে ক্যাঠা?
কেরানিকে দেখে হতভম্ব রুহিতন, হতভম্ব তার আম্মা-আব্বাজান। মাটিতে পড়ে আছে। কোমরের কাছে হাত মুঠো করে ঠেসে ধরে কাতরাচ্ছে। ঘোড়াটি ঊর্ধ্বমুখে ডাক ছাড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে ঘোড়া মেরেছে লাথি। কিন্তু এর চেয়েও তাদের কাছে বড় বিস্ময়ের, কেরানি এখানে কেন? তার তো এখন বরিশালের পথে লঞ্চে থাকবার কথা। আর তার জামা-কাপড়েরই বা এ হাল কেন? সর্বাঙ্গে তার কাদা এলো কোথা থেকে?
রুহিতন আছাড়ি বিছাড়ি চেঁচিয়ে ওঠে। বুলবুল মিয়া ধমক দিয়ে ওঠে মেয়েকে, চিল্লাইছ না! ঘরে লয়া যা। আগে ছুছথো হউক, হের বাদে জানোন যাইবো গটনা কী।
ঘটনা এরপর সংক্ষেপে এই, বুলবুল মিয়ার আশ্রয়ও সে হারায়। সে রাতে নানা রকম গল্প রচনা করে কেরানি একটা বুঝ দিতে চেয়েছিল রুহিতনকে, বুলবুল মিয়াকে। কিন্তু তারা তল পায় নাই কথার, ঠাহর পায় নাই সত্যতার। রাতটা বড় এলোমেলো কাটে। কেরানির জ্বর আসে। রুহিতন তার কপালে জলপট্টি দেয় ঠিকই, বারবার জিগ্যেস করতেও থাকে, আমারে তুমি সত্য কইরা কও গটনা কী! কেরানি মাথা নাড়ে অবিরাম আর বলে, চুপ থাকো! চুপ থাকো!
পরদিন ভোরে হঠাৎ দেখা দেয় আফলাতুন মিয়া। তাকে দেখে বুলবুল মিয়া অবাক।
এই অসময়ে আইলা! ঘরের ভিত্রে আহো!
বুলবুল মিয়াকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে আফলাতুন বলে, ভাবীজানরেও ডাক দ্যান। সদরঘাট থিকা আসতে আছি। কতা আছে।
দোর লাগিয়ে কথা হয় তাদের। আধঘণ্টা পরে বুলবুল মিয়া যখন বেরিয়ে আসে তার চেহারা তখন খুনির চেহারা।
কই! হারামজাদায় কই! বলতে বলতে কেরানির ঘরের দরোজায় লাথি মেরে কবাট সরায় বুলবুল মিয়া। তারপর এক ঝড় বয়ে যায় ঘরের ভেতরে। বুলবুল মিয়া প্রথমেই তার মেয়েকে কেরানির পাশ থেকে একটানে সরিয়ে উঠানে ছুঁড়ে দেয়। তারপর অবিরাম চড়-ঘুষি-লাথি চালাতে থাকে কেরানির ওপর। এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বংশাল মসজিদের ইমাম সাহেবকে এ বাড়িতে দেখা যায়। তার সম্মুখে কেরানিকে আনা হয়।
দে, তালাক দে আমার মাইয়ারে।
ইমাম সাহেবের হাজিরায় তিন তালাক হয়ে যায় রুহিতনের সঙ্গে কেরানির বিবাহ। এর পরে আর কথা কী! কেরানিকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
কেরানি এখন কোথায় যায়? মানুষের কি যাবার জায়গার টান পড়েছে কোনো কালে? নিরাশ্রয়েরও আশ্রয় আছে আকাশতলে। না, এটা কাব্যকথা না। কেরানি এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। তার পুরনো কাজের জায়গা টঙ্গীতে যায়। সেখানে হোটেলের মালিক বদল হয়েছে, পুরনো কর্মচারীও কেউ নাই। বাজারে এখনও কয়েকজন চেনা মানুষ আছে, তারা তাকে সমাদর করে বসায়, ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। আবার সে পথে নামে।
হঠাৎ এক দুশ্চিন্তা তার হয়। বাড়ির কথা মনে পড়ে। মা প্রায় উন্মাদ। বাবা শূলব্যথায় অস্থির। সংসারে অভাব। এ মাসে কেরানি টাকা পাঠাতে পারে নাই। তবে তাদের চলছে কী করে? ভাবতে ভাবতে কেরানির মাথা গরম হয়ে ওঠে। একবার সে মনে করে, আমার এত দায় কিসের? আবার ভাবে, বাপের বড় ছেলে আমি, আমি না দেখলে দেখবে কে?
আমরা খুব বিমোহিত হয়ে যাব কেরানির এহেন চিন্তায় যে, বড় ছেলে না দেখলে সংসার চলবে কী করে। এবং এটাও আমরা অচিরে দেখব এমন একটি ভালো চিন্তাও মানুষকে কোন্ গহ্বরে নিতে পারে।
দিনের পর দিন কাটে কেরানির। প্রথমত তার মনের মধ্যে মদিনার কথা, রুহিতনের কথা ঝাঁপাঝাঁপি করে। তারপর নদী যেমন মরে যায়, খাল যেমন শুকিয়ে যায়, এই দুই নারীও তার মন থেকে মুছে যায়। হয়তো আর কিছু নয়, অনাহারের চাপেই সে অতীত ভুলে যায়। অনাহার! অনাহার! দিনের পর দিন অনাহারে কাটে আমাদের কেরানির।
অধিক অনাহারেরও এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে_ মানুষকে মাতাল করে। মানুষ মদে মাতাল হয়, মাদকে মাতাল হয়, ক্ষুধার ঘোর কিন্তু তার চেয়ে কম মাদকের নয়! মাথা ঘুরতে থাকে। পা টলতে থাকে। চোখ ঝাপসা দেখতে থাকে। কথা খেই হারাতে থাকে। মাতাল মাটিতে পড়ে যায়। অনাহারী মানুষও ধপ করে পড়ে যায়।
ধপ করে বসে যায় কেরানি। কোথায়? কোথায় সে বসে পড়ে? তার খবর নাই, আমাদের আছে। সদরঘাটে! এখানে সে আবার ফিরে এসেছে। মাতালের মতো টলতে টলতে সে সদরঘাট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন আর চলতে পারে নাই, বসে পড়েছে। না, তবে পথে নয়, নিজামতের হোটেলে।
এই হোটেল তার কত পরিচিত। এই নিজামতকেই তো সে মদিনার কথা একদিন খুলে বলেছিল। লঞ্চের চাকরির প্রথম দিকে উপরি টাকা-পয়সা সে যা পেত এই নিজামতের কাছেই তো জমা রাখত। অনাহারে অনাহারে তার চিন্তাশক্তি গুলিয়ে গেলেও নিজামতের কথা তার অন্তরাত্মা ভোলে নাই। সেই টানেই সে এখানে আবার চলে এসেছে।
কিন্তু নিজামত তখন হোটেলে নাই। তার শ্বশুর যাবে হজ করতে, তাকে হাজি ক্যাম্পে তুলে দিতে গেছে সে। হোটেলের পুরনো বেয়ারা মতির চোখে পড়ে কেরানি। মতি তাকে দেখে থমকে যায়। যে মানুষটাকে লাথি মেরে সদরঘাট থেকে বিদায় করা হয়েছে, তাও রাস্তার এক পাগলিকে গর্ভবতী করার কারণে, সে আবার ফিরে এলে তার প্রতি কী রকম আচরণ করা উচিত মতি ঠাহর করে উঠতে পারে না। অতএব সে কাছে ভেড়ে না।
আমরা কেরানিকে দেখি। ওই সে মাথা নামিয়ে বসে আছে। টেবিলের ওপর তার মাথা। হাত দুটি ঝুলে পড়েছে দু’দিকে। মাথাটা নামাবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ আঁধার। সে ঘুমিয়ে পড়েছে অথবা জ্ঞান হারিয়েছে। একটা নীল মাছি ঘুরে ঘুরে তার কানের কাছে ভিনভিন করছে। পাশের দোকান থেকে দু’একজন উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে টেবিলের ওপর মাথা নামিয়ে পড়ে থাকা মানুষটিকে। তারা একটি নতুন নাটকের অপেক্ষা করছে। নতুন এবং সরস। পাগলিকে নিয়ে! এই লোকটিকে নিয়ে!
নাটক একটি সত্যিই ঘটে বা অতঃপর ঘটবে, কিন্তু তার সঙ্গে পাগলির কোনো সম্পর্ক নাই।
কেরানি যে মাথা নামিয়ে অঘোরে পড়ে ছিল, তার মাথায় কারও হাত এসে স্থির হয়। যারা এতক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, তারা সরে যায় চোখের পলকে। মতি যে দূর থেকে এক ধ্যানে চোখ রাখছিল কেরানির ওপরে, সেও এখন চমকে উঠে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কেরানি তার আচ্ছন্নবোধের ভেতরে নাড়া অনুভব করে। কেউ তার মাথা ধরে নাড়ছে। ক্রমে সে নাড়া জোরালো হয়ে পড়ে। তখন সে নড়ে চড়ে। না, মাথা সে তোলে না, তার কাঁধ পিঠ সে নাড়ায়। একবার এক হাত দিয়ে মাথার ওপরে অচেনা হাতটিকে ফেলে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু যথেষ্ট বল সে পায় না। তখন সে আবার ফিরে যায় তার আচ্ছন্ন ঘোরের ভেতরে।
আর তখনই, তার মাথার ওপরে রাখা সেই হাতটি, তার চুল ধরে তাকে টেনে তোলে। কেরানি তাকিয়ে দ্যাখে, আমরাও দেখি, খাম্বা সামাদ, হাতটি খাম্বা সামাদের। সেই খাম্বা সামাদ, যার দাপটে বুড়িগঙ্গা শুকিয়ে যেতে সাহস পায় না, ভরাপানিতেই থাকে। সেই খাম্বা সামাদ, যার নামের আগে খাম্বার কারণ, কারও ওপরে রোষ হলে তার একটাই হুকুম, অরে খাম্বার লগে বান্দ!
অনাহারে চেতনা কি একেবারে লোপ পায়? না, বোধহয়। অনেকে বলে, অনাহারে মানুষের বোধ আর খর হয়। আমাদের কেরানিও খাম্বা সামাদকে পলকেই চিনে ওঠে। সদরঘাটে এসেছে কী করে জানা নাই কেরানির, কিন্তু খাম্বা সামাদকে দেখা মাত্র সে হুঁশ ফিরে পায়। এটা সদরঘাট! আর এটি নিজামতের হোটেল। সে এখানে। আর তার চুলের মুঠি এখন খাম্বা সামাদের হাতে।
ভয় পায় সে। কিন্তু অবাক হয় খাম্বা সামাদের মুখে হাসির ফালি লক্ষ করে। হাসছে কেন? হাসতে হাসতেই তো খাম্বা সামাদ নাভির নিচে চাকু ঢুকিয়ে দেয় বলে শোনা যায়।
খাম্বা সামাদ কেরানির চুল ছেড়ে দিয়ে উলটো দিকে বসে পড়ে।
মনে হয়, ভুখা আছেন।
কেরানি দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা ওপর-নিচ করে।
অই! এদিকে!
মতি যেন উড়ে আসে। এসেই হাত কচলাতে থাকে।
আত্ কচলাছ ক্যা? কী আছে লয়া আয়। ভাইছাবেরে নাছতা করা!
মুহূর্তে মতি উড়ে যায় বাবুর্চির কাছে।
ভোজবাজির মতো অচিরে টেবিলে পড়তে থাকে গামছার ঘষা, খুলতে থাকে পানির বোতলের মুখ, আসতে থাকে তেহারি, পায়া, মুরগির লটপটি, পরোটা, ভাজি, বুটের ডাল, শসা-লেবুর টুকরা, কাঁচা মরিচ টেবিলে।
খান। খায়া লন আগে।
কেরানি তিলমাত্র দেরি না করে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। এই তেহারি এক খাবলা তো ওই পরোটা ছিঁড়ে মুরগির ঝোলে ডুবিয়ে। কাঁচা মরিচ আধখানা এক কামড়ে।
মতির দিকে তাকিয়ে খাম্বা সামাদ বলে, খিদা কতডি দ্যাখছছ্? মালঅই ভাসায়া চা দিবি!
আপনেরেও দিমু? দেই?
নাহ। খাম্বা সামাদ হাতের ঝাড়ায় মতিকে সমুখ থেকে বিদায় করে। তারপর কেরানিকে সে বলে, আমার সঙ্গে চলেন।
এতক্ষণে ভাষা ফোটে কেরানির মুখে, কোথায়?
আমার লগে। চিন্তা করেন ক্যা? আমি সব শুনছি। পাগলির প্যাট ক্যাঠা বান্ধাইছে সে খবরও আমার কাছে আছে।
কেরানি যেন অন্ধকারে দপ করে আলো জ্বলে উঠতে দ্যাখে। তার আশা হয়। আশা এমনই যে কখনোই মরে যায় না মানুষের। মনের কোনায় ঘাপটি মেরে থাকে।
কেরানি বলে, ভাই, আমি না!
তা আমি জানি। আমি আপনেরে অনেকদিন বিচরাইছি। পাই নাই! মনে করলাম মানুষটা বুঝি নাই হয়া গেছে। দুঃখ হইলো। একটা অবোধ মানুষ বিচার না পায়া হারায়া গ্যালো। নাকি নদীর পানিতে ডুব দিল। তারপরে ভুস কইরা হটাৎ দেখি আপনে। এইহানেই। এই সদরঘাটেই। যেইখান থিকা লাত্থি দিয়া আপনেরে বিদায় করা হইছিল, এই সগরঘাটেই দেহি আপনে।
কেরানি চারদিকে তাকিয়ে দ্যাখে। তার যেন বিশ্বাস হয় না এই সদরঘাটেই আবার সে ফিরে এসেছে। একটু ভয়ও করে তার। খাম্বা সামাদ তার সমুখে, খাম্বা সামাদই তাকে খাওয়াচ্ছে, তার সঙ্গে আপনজনের মতো কথা বলছে, এমনকি পাগলিকে গর্ভবতী করার ব্যাপারে কেরানি যে ছিল না তাও জানিয়েছে, তবু ভয় করে কেরানির।
হাঁ, মানুষেরই এমন হয়_ ভরা পেটেই ভয় আসে, অনাহারীর ভয় নাই।
উঠেন।
কোথায়?
আরে, চলেনই না।
খাম্বা সামাদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে কেরানি। খাম্বা সামাদ তাকে নিয়ে নিউ ঢাকা বোর্ডিংয়ে আসে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। এক বেয়ারা দৌড়ে আসে চাবি নিয়ে। বেয়ারা একটা কামরা খুলে দেয়। কেরানিকে তখন পিঠে আদরের ঠেলা দিয়ে খাম্বা সামাদ ঘরে ঢোকায়।
এইডা আমার রিজাব করা ঘর। এইখানে থাকবেন। এলা গোসল কইরা লন।
রূপকথাই যেন। চোখের ওপরে ভোজবাজি। কী সুন্দর ঘর। ডবল খাট। ধবধবে চাদর বিছানা। লাগোয়া গোসলখানাও ঝকঝকে। ঘরের ভেতরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়ে কেরানির। চমকে ওঠে সে। এ কী চেহারা হয়েছে! সারা মুখ দাড়ি উঠে জঙ্গল।
খাম্বা সামাদ বলে, আমি স্যালুন থিকা ছ্যাড়া পাঠায়া দিতাছি, শ্যাভ কইরা দিবো। তারবাদে একটু ঘুমায়া লন।
চোখ ভেঙে ঘুম আসে কেরানির। কতদিন সে বিছানা পায় নাই, বিছানায় ঘুমায় নাই, ভরাপেটে ঘুম আসে যেন নদীর ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে।
অঘোর ঘুমের ভেতরে কেরানি ডাক শোনে, মাস্টোর! মাস্টোর! মিহি গলা! মেয়েলি গলা! ঘুমের ভেতরে আবছা যেন মনে হয় রুহিতনের গলা। না, রুহিতন তো তাকে মাস্টোর বলে ডাকে না, ডাকে জজমিয়া বলে। তবে এ কার গলা!
কেরানি চোখ মেলে দ্যাখে বাচ্চা একটা ছেলে।
তুমি কে?
এইখানে কাম করি। আমার মায়ে মসলা পিষে। আমি ময়না।
কেরানির একটু ধন্দ লাগে। ছেলের কেন মেয়ের নাম? বলে, তোমার আর নাম নাই?
আছে! থাকবো না ক্যান? মায়ে আমার নাম রাখছে শাবানা বেগম।
কেরানি উঠে বসে। মেয়ে তবে! শার্ট হাফ প্যান্ট পরে আছে ছেলেদের মতো, তাই বোঝা যাচ্ছিল না। এইটুকু মেয়ে, পেটের দায়ে হোটেলে কাজ করছে! তার মায়া করে। খারাপ লাগে। বলে, তুমি যাও। তোমাকে আমার লাগবে না।
আমারে যে আপনেরে ডাক দিতে কইলো। নিচে বইসা আছে। আমারে কইলেন যা ডাক দিয়া লয়া আয়। গলা হুনলেই আমার যা ডর লাগে!
কার?
আর কার? উই যে আপনেরে তখন দিয়া গেলেন এইখানে, হেই মানুষটা।
তার মানে খাম্বা সামাদ, এখন সে তারই অপেক্ষায় বসে আছে নিচে। ময়না বলে, আপনে যান, আমি বিছনা ঠিকঠাক কইরা ঝাইরা মুইছা তালা দিয়া দিমুনে।
নিচে আসতেই কেরানি দেখতে পায় খাম্বা সামাদকে।
ঘুম হইছে?
কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে গলা এবং সেই সঙ্গে শরীরটাও। কেরানি বলে, হ্যাঁ, ভাই। ঘুমিয়েছি।
খাম্বা সামাদ মুগ্ধ কণ্ঠে বলে, আপনের এই একটা আমার খুব ভালা লাগে, ভাই। আপনের ভাষাটা। ছাইড়েন না। এই ভাষা আর আপনের চেহারা! দুনিয়ায় আপনেরে ঠ্যাকায় কে? দুনিয়া আপনের পায়ে বান্দির মতো পইড়া থাকবো। এলা চলেন।
বাইরে এসে কেরানি দ্যাখে ঝকঝকে শাদা রঙের একটা গাড়ি হোটেলের সমুখে দাঁড়িয়ে। পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো কেরানি, খাম্বা সামাদ তার হাত ধরে বলে, যান কই? গাড়িতে ওঠেন!
গাড়িতে ওঠে কেরানি।
আইজ আপনেরে নিয়া অনেক চিন্তাভাবনা করছি। পরে কথা হইবো। এখন আপনের ড্রেস।
ড্রেস!
আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। ওই যে কয় না_ পোশাকেই পরিচয়। চলেন, আপনের ড্রেস আগে ঠিক করি।
বিশাল ঝকঝকে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কেরানিকে নিয়ে তোলে খাম্বা সামাদ। বিশাল আয়নায় ছবি পড়ে কেরানির। তার পরনে খাকি হাফশার্ট আর নীল প্যান্ট এতই ময়লা যে লজ্জায় ভেঙে পড়ে সে।
খাম্বা সামাদ একা নয়, তার সঙ্গে আরও দুজন এসেছে। তারা বলে, ভাই, আপনে বসেন। যা যা লাগে আমরা ওনারে ফিট করতাছি।
একেবারে তেলেসমাতি কাণ্ড। আধ ঘণ্টা পরে কেরানি যখন স্টোর থেকে বেরিয়ে আসে তখন কে বলবে একটু আগে এই লোকটাই ঢুকেছিল_ এই লোকটাই, যার পরনে এখন ডেনিম ট্রাউজার, ডার্ক ব্লু সাফারি শার্ট, পায়ে হাশপাপি মোকাসিন! [চলবে]