কেরানিও দৌড়ে ছিল


কেরানির জীবনে এরপর যা ঘটে তা যেমন অবিশ্বাস্য তেমনই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সে যে সুচারুভাবে এই আচমকা ঢেউ পার হয়ে যায়, সেটাও আমরা এক্ষুনি দেখতে পাবো। আমাদের খেদ হতে পারে_ অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে না কেন!
কথা হচ্ছে, আমাদের সবার জীবনেই কিছু না কিছু বিস্ময়কর ঘটেই। অপরের চোখেও তা পড়ে। অপরে তা বর্ণনা করে চোখ বিস্টম্ফারিত করে। ঈর্ষায় কাতরকণ্ঠ হয় তারা। শুধু যার জীবনে ঘটে তার নিজের চোখে পড়ে না।
চোখে আমাদের অনেক কিছুই না পড়বার কারণ আমরা জীবন প্রবাহকে অনুভব করি না। সদ্য বিস্ময় আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে হা-হুতাশেই মগ্ন থাকি। লটারিতে টাকা পাওয়া কি মোটর সাইকেল জেতাকেই জীবন-জিৎ বলে মনে করি। গরীব ছেলের জন্যে সিনেমায় বড়লোকের মেয়েকে প্রেমে পাগল হতে দেখে আমরা বলি_ ধুর, বাস্তবে এমন হয় না। কিন্তু ঘরের মানুষ যে আমাদের সকল দোষ সত্ত্বেও বুক দিয়ে ভালোবাসছে, সেটা আমাদের নজরেই পড়ে না।
আমরা নিবেদন করবো কেরানির জীবনে অতঃপর যা ঘটে তাকে স্বাভাবিক একটি ঘটনাক্রম হিসেবে পাঠককে ধরে নিতে। এবং তার সঙ্গে অগ্রসর হতে। আমরা বুলবুল মিয়ার বাড়িতে টিনের ঘরে চৌকির ওপর শোয়া হা-ক্লান্ত কেরানির কাছে যাই। তার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর একটা সালতামামি নিই। লঞ্চে সে কেরানি। বেতন ভালোই। উপরিও আছে। মালিকপক্ষের হাতে লাথিঝাঁটা জুটলেও উন্নতির আশা তার আছে। শোনা যাচ্ছে নীল সাগর লঞ্চ কোম্পানির মালিক আরো দুটি নতুন লঞ্চ ভাসাবেন, অখন ছোট কেরানি থেকে সে বড় কেরানির পোস্টিং পাবে।
দেশের বাড়ি ছেড়ে একদিন সে কত ঘাট ঘুরে ঢাকা এসেছিলো। এর আগে তার শেষ চাকরিটা টঙ্গিতে। টঙ্গি বাজারে এক ভাতের হোটেলে সে ম্যানেজার ছিলো। একদিন এক ঘটনায় সেখান থেকে তার চাকরি যায়। ঘটনা আর কিছুই নয়, হোটেলে যে মাতারি মশলা পিষতো, হোটেলের টিনের দোতলায় মেঝের পরে সে পাটি পেতে ঘুমাতো, তার বিছানায় হোটেলের মালিক সোলেমান মিয়াকে সে এক রাতে আবিষ্কার করে।
হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হবার পর পেছনের কলে গোসল করবার জন্যে সে দোতলায় ওঠে কাপড় গামছা আনতে। দোতলাতেই তার থাকা। দোতলায় উঠে লাইট জ্বালাবে কি জ্বালাবার আগেই সে একটা সাড়া পায়। খসখস শব্দ। ইঁদুর কি? বিড়ালই বা! হোটেলের মাছ তরকারি কাঁটাকুটোর লোভে তাগড়া দুটো বেড়াল সারাক্ষণ ঘোরাফেরা করে। হেই ধুর ভাগ বলে ওঠে সে। কিন্তু না বেড়াল পালায় না, ইঁদুরের চলাচল থেমে যায়। শব্দটা হতেই থাকে। তখন মনে হয়, বেড়াল ইঁদুর নয়, মানুষ! ঠাহর করে সে মানুষের সাড়া পায়। সাড়া মানে উসুখুসু। সাড়া মানে ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ। সুইচে হাত দেবার আগেই ঘরঘর গলায় কে একটা মানুষ বলে, লাইট না জ্বালিস! আরে, এ তো সোলেমান মিয়ার গলা। ততক্ষণে হাতের কাজ হাত করেছে। লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছে। পঁচিশ পাওয়ারের টিমটিমে হলুদ আলোয় দোতলার নিচু ছাদের ছোট্ট ঘরটা মুহূর্তে ভুতুড়ে ছবি হয়ে দেখা দেয়। ভুতুড়েই বটে! মেঝের ওপরে কেরানিরই মলিন বিছানা কাঁথার ওপরে শোয়া হোটেলের মালিক আর মশলা পেষার মাতারি যে!
মালিক সোলেমান মিয়া বিব্রত হয় না মোটে। বরং সে ধীরেসুস্থে মাতারির ওপর থেকে উঠে লুঙ্গির কষি বাঁধতে বাঁধতে বলে, তুইও ইয়াকে নিবার পারিস। অসুবিধা নাই! কিন্তু সে প্রবৃত্তি তার হয় না। মাতারিও তেমনি। সেও উঠে বসে কোমর থেকে শাড়ি হাঁটুর নিচে নামাতে নামাতে বলে, ইয়ার চেহারা খাপসুরৎ হইলে কী হয়! ব্যাটা নপুংসক! কথাটা বড় অপমানসূচক বলে কেরানির কানে বাজে, যদিও ততদিন পর্যন্ত সে নারীর স্বাদ জানে নাই, পুংসকতারও পরীক্ষা তার এতকাল হয় নাই। পরদিনই সে চাকরি ছেড়ে দেয়। খানিকটা ঘেন্নায়, অনেকটা লজ্জায়, আর কিছুটা ভয়ে। ভয়, কেননা সে জানে, নারীর কারণে রাজাও সর্বস্বান্ত হয়। আর, সে তো এক ভাতের হোটেলের ম্যানেজার!
কেরানি যে দেশের বাড়িতে টাকা পাঠায়, তার টাকার ওপরেই বাবা-মায়ের এখন যে ভরসা, সেটা সে ভোলে নাই। বাবার শূলব্যাধি। মা বধির, উন্মাদ ও শয্যাগত। ছোট বোনটির বেচাল আচরণ। বড়বুবু একা তার ইশকুলের চাকরির টাকায় কত আর সামলাবে! টঙ্গির হোটেলের চাকরি ছেড়ে, বকেয়া বেতনের এক পয়সাও না পেয়ে, ঢাকার উদ্দেশে বাসে যাত্রা করে সে। চাকরি একটা চাইই তার। বাস তাকে সদরঘাটে নামিয়ে দেয়।
আর, এই সদরঘাটেই সেইদিনই সে চাকরির সন্ধান পায়। তার সুশ্রী চেহারার বদৌলতেই সে চোখে পড়ে যায় একজনের। সদরঘাটে সিনেমার একটা শুটিং হচ্ছিলো। সিনেমার পরিচালক দৃশ্য নিচ্ছে এমন যেন নায়িকার পয়সা নাই, লঞ্চের ভাড়া দিতে পারে নাই, সেই নিয়ে লঞ্চের বড় কেরানি তাকে দাবড়ানি দিচ্ছে, তখন লঞ্চেরই এক ছোট কেরানি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে নায়িকার ভাড়া মিটিয়ে দেয়_ ব্যাস এই পর্যন্ত। এখন হয়েছে কী, যে খুচরো অভিনেতার ছোট্ট এই পার্ট করার কথা ছিলো সে আসে নাই। এদিকে শুটিংয়ের বেলা বয়ে যায়।
শুটিংয়ের চারদিকে মানুষের ভীড়। আমাদের কেরানি কখনো সিনেমার শুটিং দেখে নাই। ভীড়ের মধ্যে সেও ঢুকে পড়ে কাণ্ড দেখছিলো। হঠাৎ তার কাছে সিনেমার পরিচালক এসে বলে, এই যে ভাই, আপনি একটু এদিকে আসেন তো!
আমি!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি। আমার সঙ্গে আসেন।
ভয়-ভয় করে তার। এ কী রে বাবা! আমাকে কেন? পালাবার আগেই তার আস্তিন ধরে পরিচালক তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়, টেনে নিয়ে তোলে একেবারে শুটিংয়ের গাড়ির ভেতরে।
আপনি কখনো সিনেমায় পার্ট করেছেন?
গলা শুকিয়ে যায় কেরানির।
পরিচালক অভয় দিয়ে বলে, কোনো অসুবিধা নাই। আপনাকে সিনেমায় একটা পার্ট দেবো। আপনার চেহারা ভালো। এই রকমই একজনকে আমরা খুঁজছিলাম।
পার্টটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে হতভম্ব আমাদের কেরানিকে নিয়ে পরিচালক দাঁড় করিয়ে দেয় ক্যামেরার সামনে। একবার রিহার্সেলও হয়ে যায়। একবার দু’বার তিনবার। ওকে! স্টার্ট ক্যামেরা! রোল!! পরিচালক চিৎকার করে ওঠে। আর সেই আওয়াজেই হাত পা সেঁদিয়ে যায় কেরানির। পাশেই নায়িকা। গা দিয়ে ভুরভুর করছে সেন্টের গন্ধ। মুখে মেম সায়েবদের মতো শাদা রঙের পালিশ! পরীর মতো রূপ! পার্ট-টার্ট সব গুলিয়ে যায় কেরানির। বোবা হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। দরদর করে ঘাম পড়তে থাকে কপাল বেয়ে।
হাসির একটা হুল্লোড় ওঠে উৎসুক জনতার ভীড়ের মধ্যে। পরিচালক ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
এই চুপ! চুপ সকলে! কোয়াইট! কোয়াইট!!
জনতা কি আর চুপ হয়! ভীড়ের ভেতর থেকে উৎসাহবাণী ছোটে।
আরে ভাই, ডরাইলেন নাকি? সাওস করেন!
সাহস করা দূরে থাক, কেরানি প্রায় মূর্ছিত হয়ে টাল খেয়ে পড়ে। আবার তাকে খাড়া করে পরিচালক। ভরসা দেয়।
আরে কিচ্ছু না। আপনি পারবেন। প্রথম প্রথম ওরকম একটু হয়। ঘাবড়ানোর কিছু নাই। রেডি! ওকে! স্টার্ট ক্যামেরা!
না! হবে না! তাকে দিয়ে হবে না! তার মুখ শুকিয়ে যায়। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নায়িকা তাকে আশ্বাস দেয়।
আপনি পারবেন! কিচ্ছু না! আসুন তো!
এই বলে নায়িকা তাকে সাহস দেবার জন্যে যেই না তার হাতে হাত রেখেছে, সে আর তার ভেতরে নাই। নারীর হাতের স্পর্শ যেন সাপের ছোবল। তৎক্ষণাৎ সে দেয় দৌড়। হো হো করে হেসে ওঠে ভীড়ের মানুষেরা। দৌড় তো দৌড়। দিশেবিশে না পেয়ে একেবারে লঞ্চের ভেতরে ঢুকে যায় কেরানি।
সেই লঞ্চের ভেতরে ঢোকাটাই তার জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। লঞ্চের সুখানি তাকে থির হয়ে বসতে বলে। বইয়েন তো আপনে! সেই বসা। আর সেই সুখানির প্রশ্নের উত্তরেই সে বলে, আমি চাকরির তালাশে এসে এই বিপদে পড়লাম!
শুটিং এরপর হয়। যুবকের পার্ট করবার খুচরো অভিনেতাটি ততক্ষণে এসে গেছে। নির্বিঘ্নে শুটিং চলে। জনতাও আমাদের কেরানির কথা ভুলে যায়। তারা মশগুল হয়ে থাকে নায়িকা নিয়ে। সুখানি বলে, সিনেমার ফাট না পারেন আসল ফাট আপনাকে দিয়া চলিৎ ফারে! লঞ্চে কেরানির চাকরি খালি আছে। করিবেন? আগে যে শালা ছিলো, তাঁই ভাগি গেইছে!
এটা অবিশ্বাস্যই যে এভাবে এক বেকার হোটেলের চাকরি ছাড়ার পরদিনই নতুন একটা চাকরি পেয়ে যাবে না চাইতেই। কিন্তু এ ঘটনাও ঘটনা নয়, আমাদের কেরানির জীবনে এবার ঘটনা যা ঘটবে তা খানিক পরেই বলা যাবে।
আপাতত এই সংবাদ_ এভাবেই সাগর নীল লঞ্চের এই চাকরিতে তার ঢোকা। ডাঙা ছেড়ে পানির বুকে আসা। জীবন যদি ভাসমান তার, শ্যাওলার মতো ভেসে চলা, ভাসতে ভাসতেই হস্তিবাড়ি থেকে তার এতদূর আসা। লঞ্চের চাকরিটা কেরানির খুব পছন্দ হয়ে যায়। ডাঙার ওপরে তার আর বিশ্বাস নাই। পানির বহমান ধারা, নদীর বহে যাওয়া, তাকে এই বিশ্বাস দেয়_ জীবনও এমন বহে যাবে, একদিন তার জীবনের ধারা সাগরে পেঁৗছুবে। এই বিশ্বাস জেগে ওঠার কারণও আছে। বরিশালে আগুনমুখা নদীর বিস্তার যেদিন সে প্রথম প্রত্যক্ষ করে, সে মুগ্ধ হয়ে যায়, নিজের ওপরে বিশ্বাস তার ফিরে আসে।
মুগ্ধতা কী শুধু আগুনমুখার বিস্তার দেখে? ওই নদীতে, নদীর যে এ কুল ও কুল দেখা না যায় সেই গহনে একখানা ডিঙা তার নজরে এসেছিলো একদিন। ছোট্ট এক ডিঙায় কিশোর এক নদী পাড়ি দিচ্ছিলো। নদীর অসীম বিস্তারে কালো একটি বিন্দুর মতো ডিঙা। আর সেই ডিঙায় একটি মানুষ। মানুষও নয়, বাচ্চা একটা ছেলে। স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। বুকের মধ্যে বলও পায়। ইশকুলে পড়া একটি কবিতার কথা তার মনে পড়ে_ বেরিয়ে যখন পড়েছি ভাই থামলে তো আর চলবে না / হিমালয়ের বরফ যেন ভাঙবে তবু গলবে না!
কেরানির বড় ভালো লেগে যায় লঞ্চের এই চাকরি। রাতের নদী কেটে লঞ্চ চলেছে বরিশালের পথে। নদীর পানিতে পূর্ণিমা চাঁদের ঝিলিমিলি। গম্ভীর গুঞ্জনের মতো এঞ্জিনের শব্দ। নদীর বাঁকে বাঁকে লাল বিকন বাতি। আঁধারের বুক চিরে লঞ্চের সার্চলাইটের আলো, একবার ডানে একবার বামে, তারপর দপ করে নিভে যাওয়া। আলোটা নিভে যেতেই বুকের ভেতরে ভয় লাফিয়ে ওঠা। কিন্তু না, আঁধারেও ঠিক সঠিক পথেই লঞ্চ এগিয়ে চলেছে। কেরানির মনে নির্ভাবনা জাগে। তার জীবনটাও লঞ্চের মতোই অন্ধকারেও ঠিক এগিয়ে যাবে। কেরানির মনে এমন সম্ভাবনা জাগে না যে লঞ্চের চাকরি ছেড়ে সে অন্য কোনো কাজ একদিন নেবে।
কাজটিও তো মন্দ নয়। ছোট কেরানি থেকে একদিন সে বড় কেরানি হবে। তারপর চাই কি ম্যানেজারও হতে পারে সে। মেঘলা রাতে নদীর ওপরে আকাশে হঠাৎ যেমন বিজলি চমকে ওঠে, কেরানির মনে কখনো এমন একটা অদ্ভুত চিন্তা ঝলক দিয়ে ওঠে যে সে একদিন সারেং হবে। একদিন ডাঙার দালানের মতো আস্তমস্ত একটা লঞ্চ সে নদীর বুকে চালাবে। কিন্তু কল্পনা তো কল্পনাই। মুহূর্তে ওঠে, মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। আমরা এতক্ষণ যা বলি নাই এবার তা বলি। চিন্তা বা দুশ্চিন্তার ধাত আমাদের এই কেরানির যদিও নাই, কল্পনায় ভেসে যাওয়া তার অনেক মানুষের চেয়ে অনেক অধিকই আছে। আর, এই ভেসে যাওয়াটা আছে বলেই তার জীবনের পরবর্তী ধাপে যত অসম্ভব বা অপ্রত্যাশাই থাক না কেন, সহজেই সে গা ভাসিয়ে দিতে পারে। এই সূত্রটি মনে রাখলেই আমরা কেরানির জীবনে অতঃপর যা ঘটবে তাতে হতচকিত না হয়ে স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলেই গ্রহণ করতে পারবো।
সালতামামির এ পর্যায়ে আমরা এবার দেখে নিই, বাবার জবানিতে বড়বুবুর দেশের চিঠিতে তার বিয়ের আয়োজনের সংবাদ সে পেয়েছিলো হঠাৎ করেই, কিন্তু বাড়িতে সে যায় বাবার অসুখের মিথ্যা অজুহাতে। বিয়ের কথা সে বলে নাই_ না লঞ্চের মালিকের কাছে, না যেখানে সে থাকে সেই বুলবুল মিয়ার বাড়িতে। আর, দেশের বাড়ি হস্তিবাড়ি গিয়ে সে যে বিয়ে করে আসে, সেই বিয়েটাও স্বাভাবিক পরিণতি পায় নাই। মদিনার সঙ্গে তার সংসর্গ হয় নাই। এমনকি বিয়ে যে তার আদৌ হয়েছে, এ সত্যও তার মনে এখনো পুরোপুরি বসে নাই।
বুলবুল মিয়ার ছাপড়া ঘরে বাতি নিভিয়ে সে পড়ে ছিলো বিছানায়। নাকে এসে লাগছিলো মুরগী রান্নার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। তার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে যায়। ঘ্রাণই আমাদের স্মৃতিকে সবচেয়ে দ্রুত ফিরিয়ে আনে। রান্নার ঘ্রাণে সে উন্মনা হয়ে যায়। মদিনার চেহারাটি আবছা ভেসে ওঠে তার মনে। আবছাই বটে। ভালো করে মেয়েটিকে তার দেখা হয় নাই। অন্ধকারেই তো! হস্তিবাড়িতে তার ঘরে টেমির টিমটিমে আলোয় মদিনা! না, সে তাকে শরীরে পায় নাই। চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু মেয়েটি তার কাছে ধরা দেয় নাই। মনির মৃধা মদিনার ইজ্জতনাশ করতে চেয়েছিলো, সেই আতঙ্কটাই কি মেয়েটির মনে পুরুষের স্পর্শমাত্র সাপের ছোবল হয়ে ওঠে? কিংবা বিশ্বাস কি, মনির হয়তো সত্যসত্যই মদিনার ইজ্জতনাশ করেছিলো, নান্না সকল কথা সম্পূর্ণ তার কাছে প্রকাশ করে নাই!
এই সম্ভাবনাটি ক্রমেই এখন কেরানির মনে ফণা ধরে ওঠে। ফণা তো ফণা, তাকে দংশাতে থাকে। হ্যাঁ, মদিনার সর্বনাশই করেছিলো মনির। সে কেরানি একটা কামড় খাওয়া পেয়ারা, সতীত্ব হারানো এক যুবতী, তাকেই বিয়ে করেছিলো কি? মাথার ভেতরে দপদপ করে ওঠে। বুকের ভেতরে ঝড় বয়। সময় বহে যায়। বাইরে আওয়াজ পাওয়া যায়। আফলাতুন মিয়ার কথা শোনা যায়।
কই? জজমিয়া কই?
বুলবুল মিয়ার আওয়াজ পাওয়া যায়, আরে আহো আহো! জজ মিয়া জানি্ন কইরা আইছে তো, ঘরে হুইয়া আছে। তুমি বড় দেরী কইরা আইলা!
আর কইও না। এক ভ্যাজালে পড়ছিলাম। জজমিয়ার ঘর তো আন্ধার দেহি।
বলতে বলতে আফলাতুন মিয়া ঘরে ঢুকে পড়ে। ধড়মড় করে উঠে বসে কেরানি। এই লোকটির কারণেই একদিন এ বাড়ি সে জায়গীর পেয়েছিলো। দেখাসাক্ষাত কমই হতো। সপ্তাহে মাত্র একদিনই তো সে এ বাড়ি ঘুমায়। বাকি অন্যদিন তো দিনের বেলা ছাড়া সে বাড়ি আসে না বা থাকে না। চেহারাটা ভুলেই গিয়েছিলো।
আফলাতুন সুইচ টিপে ঘরের বাতি জ্বালায়। কেরানিকে এক নজর দেখে নিয়ে তারই বিছানায় জমিয়ে বসে পড়ে। তারপর কাঁধে একটা হাত রেখে জিগ্যেস করে, আবক্ষার খবর কি?
প্রশ্নটা ঠিক ঠাহর করতে পারে না কেরানি। মুহূর্তের জন্যে তার বিস্মরণ হয়ে যায় যে বাবার অসুখের কথা বলেই সে বাড়ি গিয়েছিলো।
আফলাতুন আবারও বলে, আবক্ষার অসুখের সম্বাদ পায়া যে গ্যালেন, আমরা তো চিন্তায় আছি।
এখন ভালো।
আলহামদুলিল্লা। যাউক বিপদ কাটছে। আপনেও মাশাআল্লা ফিরা আসছেন। ফিরা আসছেন মগর এক বিপদে আমারে ফালাইছেন!
কেরানি উদ্বিগ্ন মুখে আফলাতুনের দিকে তাকায়।
আফলাতুন বলে, জিগাইবেন তো বিপদ কুনহানে? কমুআনে। আইজই কমু। আপনেই ক্যাবল পারবেন এই বিপদ থিকা আমারে খালাশ করতে। তার আগে খানা। রাইতও অনেক। আমিও বেশি টাইম বইতে পারুম না। ভুকও লাগছে। আপনে ভি ভুকে কাহিল হয়া আছেন দেহি। মুখখান বড় আন্ধার দেহি!
কেরানি হাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয় না। ঘরের ভেতরে রহিতনের মা আসে। বলে, খানা এইহানেই দিতাছি। আফলাতুনকে বলে, কি কন, ভাইছাব? এইহানেই ভালা। কথাবার্তি কইতে পারবেন। আগে খায়া লন।
আফলাতুন বলে, মোরগ জবা করছেন মনে লয়, ভাবী। আপনের হাতের মোরগের ছালোন! কতদিন খাই নাই।
বিরানি ভি খাইবেন। আইজের মইধ্যেই তারিখ কলাম ঠিক করবেন।
তারিখ! কিসের তারিখ! কেরানি আফলাতুন মিয়ার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়।
রুহিতনের মা খাবার আনতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আফলাতুন মিয়া। তারপর বেশ প্রশস্ত একটি হাসি রচনা করে বলে, আমাগো ভাবিসাবের সবতাতেই তরাতড়ি! আরে, ব্রিয়ানি তো হইবোই, খামুওই! তার পহেলা যে কারণে ব্রিয়ানি হেইটা ঠিক করতে হইবো না? জজমিয়ার জবান পাইতে লাগবো না?
জবান! কিসের জবান! মনের মধ্যে দিশেবিশে পায় না কেরানি।
প্রশ্নটা অনুমান করে আফলাতুন মিয়া। অতঃপর বলে, বিয়া! আরে, বিয়াশাদীর লিয়া ফাল পাড়লে তো হইবো না! যার লগে বিয়া তার জবান লইতে হইবো না? আমাগো মাইয়ার কথা তো পাইয়াই গেছি। মাইয়া কি আর মুখ ফুইট্টা কয়! আর, কইবোই বা কী! মাইয়ার পছন্দের বড় হইলো গা তার বাপমায়ের পছন্দ। বুলবুলভাই আর ভাবী আপনেরে খুব পছন্দ করে। আরে! দম ধইরা চায়া আছেন যে! রুহিতনের লগে আপনের বিয়ার কথা কই। আর আপনেও তো আমাগো মাইয়ারে দেখছেন জানছেন। এমুন মাইয়া হাজারে নাই। এলা একখান তারিখ ঠিক করা, ব্যস এইতো। আর কথা কিয়ের! ছামনের শুক্কুরবার বাদজুম্মা, কী কন?
কেরানির চোখের সমুখে জগত ঘুরে ওঠে। সে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে।
আফলাতুন মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে, তাইলে আপনের কথা পায়া গেলাম। আপনে রাজী।
ঘরের ভেতরে রুহিতনের মা খানা নিয়ে আসে, পেছনে বুলবুল মিয়ার হাতে চিলুমচি আর পানির জগ। তাদের দেখেই আফলাতুন মিয়া কলরব করে ওঠে, শোকর আলহামদুলিল্লা, ভাবী, রাজী! খাওনের লাইগা কথা ফালায়া রাখি নাই, আগেই শ্যাষ কইরা ফালছি। জজমিয়া রাজী! ছামনের শুক্কুরবারেই!
বুলবুল মিয়া কেরানির সমুখে চিলুমচি পেতে পানি ঢালবার জন্যে জগ এগিয়ে ধরে বলে, লন, জজমিয়া হাত ধুয়া লন। বিছমিল্লা বইলা শুরু করেন।
আফলাতুন মিয়া বলে, তুমরা তো খামাকা উথাল পাথাল হয়া পড়ছিলা। রাজী হয় কি না হয়! আর আমি কইছিলাম কি কইছিলাম না জজমিয়াও তুমার রুহিতনরে খুবই নেকনজরে দ্যাখে! এলা হইলো তো!
কেরানির পাতে বুলবুলমিয়া মুরগীর রান তুলে দেয়। এত বড় রান কেরানী এর আগে পাতে কখনো পায় নাই। এমনকি মাত্রই সাতদিন আগে গত শুক্রবারেই তো মদিনার সঙ্গে তার বিয়ের খানাতেও না!

[চলবে]