কেরানিও দৌড়ে ছিল

কেরানীও দৌড়ে ছিল

কেরানীও দৌড়ে ছিল
বুড়িগঙ্গা! নামেই প্রমাণ একদিন গঙ্গা ছিল এই খাতে। সেই গঙ্গা, শরীর পবিত্র হয় যে-জলে গাহনে, যে জলে চিতাভস্ম বিসর্জিত হয়। নারী যুবতী থেকে ক্রমে বুড়ি হয় তার একই শরীরে। নদীর বয়স হলে নদী দেহ ছেড়ে তার যৌবন নিয়ে সে অন্য খাতে যায়। এখন এ বুড়িগঙ্গাও আর সেই শুদ্ধজলের গঙ্গা নয়। এখানে গাহনে আর শুদ্ধ হওয়া নেই।
কেরানি যে এ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুদ্ধ হতে? আচমকা আসন্ন বিয়ের খবরে উৎফুল্ল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াই কি তার? মনে তার রাঙা আলো। নদীজল সে কি রাঙাই দ্যাখে, যদিও আকাশে এখন ভোরের লালিমা আর নেই। ডুব দিয়ে সে জলের সবজে-নীল অতলে মাঝগাঙে যাওয়ার জন্যে মাছের মতো ঠেলে যায়।
মাঝগাঙ! এ পাড়ে তো নদীর বুকে থইথই করছে আবর্জনা। পানিশূন্য প্লাস্টিকের বোতল। চানাচুরের খালি প্যাকেট। ডাবের খোসা। রবারের বাতিল টায়ার। রাশি রাশি। আর ভেসে আছে বেগুনি রঙের পাতলা কাচের মতো ডিজেল তেলের আস্তর। মানুষের মলও বুঝি দেখা যায় ভেসে যেতে। নদীর এই বেহালে সে ঝাঁপাল তবে?
তার রোজকার গাহন এটি। তবে নদীতে ঝাঁপিয়ে নয়, বালতি করে পানি তুলে তুলে। বালতির লম্বা রশি। নদীর অতলে বালতি ডুবিয়ে, একেবারে শীতল পাঁকের বুক থেকে পানি তুলে লঞ্চের পেছন পাটাতনে দাঁড়িয়ে তবে তার গোসল।
ভোরে লঞ্চ এসে ঘাটে নোঙর করবার পর, যাত্রীরা সব নেমে যাবার পর, কেউ কিছু মনোভুলে ফেলে গেছে কি-না সে সব খবরদারি করবার পর, ছোটখাটো মূল্যবান কিছু যেমন টাকা-পয়সা কী গলার চেন, কী একটা মোবাইল সে সব বড় কেরানির অলক্ষ্যে সরিয়ে ফেলবার পর, সারেং সুখানির নাশতার জন্য পাড়ের হোটেল থেকে গরম পরোটা, ডিমের মামলেট, মগে চা এনে দেবার পর, খাকি প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গিটা পরে নেবার পর, তবে সে লঞ্চের নিচতলার পেছন পাটাতনে বালতি নিয়ে যাবার অবকাশ পায়। নদীর গভীর থেকে পানি তুলে মাথায় ঢালে।
আজ তার অন্যরকম দেখা যায়। আজ সে সরাসরি নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে এর আগে বুবুর হাতে লেখা বাবার জবানির চিঠিটা সে লঞ্চের বই-টই, রশিদ-ফশিদ রাখার তার বরাদ্দ নিজস্ব খোপে ঢুকিয়ে রাখে। আর বিয়ের সওদা ফর্দটা আট ভাঁজ করে গুটিয়ে তাবিজের মতো করে লুকিয়ে রাখে তার দু’পকেটওয়ালা শার্টের ডান পকেটের চোরাপকেটে। পকেটমারের হাত থেকে টাকা বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওই পকেট। না, পকেট তার মারা যায়নি কখনও। টাকা তার চোরের হাতে যায়নি। কিন্তু এ ফর্দ তার অন্যের হাতে যাবে। কথাটা খানিক পরেই জানা যাবে।
লঞ্চের মেজো কেরানির চোখে পড়ে আমাদের কেরানিটির নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া। আরে, মাথা খারাপ হলো নাকি! ময়লা নোংরা পানিতে দিল ঝাঁপ! বড় কেরানি তখন পাড়ে নামছিল হোটেলে নাশতা করবে বলে। তাকে ডাক দিয়ে বিষয়টার বয়ান দিল মেজো কেরানি।
কই? হালায় কই? কি কছ্ পানিতে ঝাঁপ দিছে!
কিন্তু পেটে খিদে, বড় কেরানির আজ উপরি আয়টাও মন্দ হয়নি। পুরো এগারোজনের ভাড়া পকেটস্থ করা গেছে। উপরি টাকাগুলো পাড়ের হোটেলে ম্যানেজার রহিম বক্শের কাছে নিত্য জমা রাখে। কাছে রাখা ঠিক না। মালিকের লোক পকেট তালাশ করতে পারে আচমকা! খিদের দাপটে পাড়ে নামার তাগিদও ছিল তার। অতএব সে আর দাঁড়ায় না। কিছুক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকেই দ্রুত সে নেমে যায়।
নদীতে তখনও আবর্জনার ভিড়ের মধ্যে ডুব দেবার পানি চক্করটি ঘুরছে। তেলের আস্তরণ নিজে নিজেই আবার মেরামত হতে এগিয়ে আসছে ডুব দেবার ফাট বরাবর। ডাবের একরাশ খোসা তখনও নাচানাচি করছে কেরানির ঝাঁপিয়ে পড়ার তোড়ে।
ল, যাই, নাশতা করি, তরেও আইজ নাশতা করামু! তেহারি! তখন মেজো কেরানিও বড়-র সঙ্গে পাটাতন থেকে লাফিয়ে আরেকটা লঞ্চের পাটাতনে পড়ে। সেই লঞ্চের কিনার ধরে ধরে পাড়ে তারা পৌঁছে যায়। নদীর দিকে এখন শুধু একজনই উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে।
এ মূর্তিকে আগে আমরা দেখিনি, তবে ঘাটের সবাই দেখেছে। বছরখানেক ধরেই দেখছে। তার পরিচয় কী, কোথা থেকে এসেছে, কেন সে এখানে সারাদিন সারারাত কেউ জানে না। জানবার দরকারও কেউ বড় একটা বোধ করে না। মাঝেমাঝেই খিলখিল হাসিতে সে যখন ফেটে পড়ে তখন লঞ্চের চোঙে বসা কাকটাও পাখা ঝাপটে উড়ে যায়। হাসিটি তার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ধাক্কা খেতে থাকে সার সার লঞ্চের সব লোহার শরীরে। তখন চমকে ওঠে লোকেরা। আরে যা যা! দূর! দূর হ!
কিন্তু যুবক তো যুবকই, অঙ্গে তাদের জোয়ারের কাল। ভাটার টান আরও পরে। ওই হাসিটি শুনে যদি তার দিকে চোখ পড়ে, তৎক্ষণাৎ মনে তাদের উত্তাল ঢেউ উঠে আছাড় মারে। কিন্তু তাদের সময় নেই, কাজের মানুষ তারা, সদরঘাটে কাজের মানুষ ছাড়া মানুষ নেই। যুবকরা তাকে ফিরে ফিরে দেখতে দেখতে যে-যার মতো চলে যায়।
ওদিকে লঞ্চের ব্রিজ ঘরে শক্তপোক্ত মস্ত চেয়ারে বসা প্রৌঢ় সারেংরা কম্পাসের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঢলানো কাচের নীলচে স্বচ্ছতা ভেদ করে দৈবাৎ যদি তাকায়, যদি তাকে চোখে পড়ে হঠাৎ এক পুরনো তাপে তারা তপ্ত হয়ে যায়। গঙ্গার আদি ধারা তো আর বুড়িগঙ্গায় নেই! বিগতযৌবন স্মরণে পাগলিকে দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই তাদের নির্গত হওয়ার থাকে না।
এ এক আশ্চর্যই বলতে হয়। পাগলি হলেও শরীর তার মোটে মরে নাই। কিটকিটে ময়লা পাজামার ভেতর থেকে পুরুষ্টু তার ঊরু দুটি চোখে না পড়ে পারে না। তার গায়ের ছেঁড়া কামিজের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা স্তন দুটি হাঁ জাম্বুরার মতো যে একবার খুলে খাবার হঠাৎ টান বোধ করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদু ফল বিষয়ে সে তো কিছুই জানে না!
পাগলি নদীর দিকে চোখ পেতে রাখে। অচিরে সে চেঁচিয়ে ওঠে, উঠছে রে! উঠছে! আর সেইসঙ্গে খিলখিল হাসিটি। হাততালিও।
মাঝনদীতে ভুস করে জেগে উঠেছে কেরানি। নদীর অতল বেয়ে সে এখন পরিষ্কার পানিতে। আর পানিও এখানে সাপের মতো বুক টেনে নিঃশব্দে বহমান চলমান। সাপের মতোই ঠাণ্ডা। ডুব থেকে উঠে আসার ফলে কেরানির পিঠ বেয়ে পানির যে-ধারা নামে, মনে হয় ছোট ছোট সাপই বুঝি কিলবিল করে নামছে।
কেরানির প্রাণ ভয়ে থমথম করে ওঠে।
বাবার জবানিতে বুবুর লেখা চিঠিতে তার বিয়ের আদেশ। আদেশ ছাড়া আর কী? তার মতামত নেওয়া হয় নাই। পাত্রীও সে দ্যাখে নাই। পাত্রীর বংশ-পরিচয় দূরে থাকে, নামটি পর্যন্ত চিঠিতে নাই। সরাসরি এক বাক্য তোমার বিবাহ স্থির! আদেশ ছাড়া আর কী! আগামী শুক্রবার বাদজুম্মা শুভকাজের দিন ধার্য হইয়াছে! আদেশই তো!
কিন্তু আদেশ মানেই ভয়। ভয় তো প্রথমে তার হয় নাই। প্রথমেই বরং তার মন রাঙা হয়ে উঠেছিল। বৌ! ঝাঁপবন্ধ ঘরের ভেতরে বাতি নেভানো অন্ধকারে একটা শরীর! সুগন্ধি! ভুরভুর। ম’ ম’! গায়ে সুবাস। চুলে সুবাস। চৌকির পাড়ে মেঝের ওপর ছাড়া শাড়িতেও! তারপর, শরীরের পাটে সোনালি দরজা। একেবারে রাণীমহলে! ভেতরটা একেবারে আড়মোড়া ভেঙে উঠেছিল।
মাঝনদীতে খাড়া সে। কোমর পর্যন্ত পানিতে। পা ঠেলে ঠেলে নিজেকে ভাসিয়ে রাখে কেরানি। ভেতরের ভয়টা ঠেলে পুরনো একটা মিষ্টি ভয় তার হঠাৎ মনে পড়ে। সেই কোন কিশোরকালে! কী যেন নাম ছিল তার? মনে নাই? হ্যাঁ আছে। যুগ ঠেলে নামটা জিভের ডগায় আসে। রুপাই! কিন্তু মুখখানা? আবছা মনে পড়ে। কালো চিকচিকে। পুতুলের মতো মাটি টেপা নাক। চোখ দুটো মাছের মতো নীলচে। গালে-মুখে মাটির গন্ধ বৃষ্টি ভেজা মাটির। মনে পড়ে কী গন্ধটাই মনে পড়ে। নদীর বুকে কোমর ঠেলে ভাসতে ভাসতে কেরানির মনে পড়ে।
আধকোশা নদীর পাড়ে বাদাড়ের মধ্যে সে আর রুপাই।
খেলা করবু? মজার খেলা আছে একখান!
কোন খেলা?
তুই আর মুই!
পুতুল কোনঠায়?
পুতুল তো তুই!
তারপরই তো! না, না, মোকে ন্যাংটা না করো।
আরে, এঠায় আছে কাঁই? এইদন করিলে খেলা হবার নয়!
না, সে খেলা হয় নাই তার। খেলার পুতুল হাতে। খেলার কৌশল তখনও জানা নাই। শুধু ছোঁয়াছুঁয়ি ঘষাঘষি ঠেলাঠেলি। আহ, যায় না কেনে?
মোর ব্যথা করে! সেই যে তাকে মরণের এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে নদীর পাড় ভেঙে হস্তিবাড়ির দিকে ছুটে গিয়েছিল রুপাই, আর ফিরে আসে নাই।
ফিরে আসে! চিঠিখানা পড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রুপাই তার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বৌ! তবে বৌ! সেই রুপাই কি তবে? তার সঙ্গেই বিয়েটা? না, রুপাই কী করে হবে? গাঁয়ের দেশে কবে তার বিয়ে হয়ে গেছে। আরে, সে তো তার বিয়ের দিন জলেশ্বরী থেকে হস্তিবাড়ি হঠাৎ ফিরে এসেছিল। ইশকুলে ছুটি ছিল। এসে শোনে রুপাইয়ের বিয়ে। বাড়ির সমুখ দিয়েও একবার ঘুরে আসে। ঝাউ কেটে গেট! গেটের মাথায় লাল-নীল-সবুজ কাগজ কাটা মালা। অপটু অক্ষরে লেখা ‘শুভবিবাহ’। সন্ধ্যাকালে কবুল হওয়ার কথা। তার আগেই সে ফিরে গিয়েছিল জলেশ্বরীতে তার লজিং বাড়িতে।
কেরানি এখন মাঝনদী থেকে তার নিজ লঞ্চের দিকে ধীর সাঁতার কাটে। যেন একটা ঘোরের ভেতরে সে এখনও। কোন দিকে যাত্রা তার, নির্ণয় নেই। কেরায়ার এক নাও আসছিল ওপার থেকে এপারে। হাঁক ওঠে, জঞ্জাল ঠেইলা লঞ্চে যান! গোসলটাই বরবাদ! নায়ে আসেন। নায়ে! আলগোচ্ছে ওঠেন। গু ভাসে!
এতদূরেও মল! ত্যাগেও তার বিলয় নাই? রুপাই আজও তার বিলয়ে যায় নাই কেরানির মনে? কিন্তু সাপ! মাঝগাঙে নদীর সেই শীতলতা! পায়ের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে সরসর। পিঠ বেয়ে কিলবিল। রুপাইয়ের সঙ্গে সেই অসাধু কাজটার চেষ্টা কি নতুন করে ভীত করে তোলে তাকে?
সে ভীত হয় পাগলিকে দেখে। কেরায়ার নাও থেকে নেমে নিজের লঞ্চে যাবে কেরানি, চোখ তুলে দ্যাখে পাগলি দু’হাত বাড়িয়ে আছে।
আয়! আয়!
আরে, দূর!
ডরাইছ না! দুধ আছে!
চিৎকার করে ওঠে কেরানি। _এই শালিকে পুলিশ ধরে না!
সঙ্গে সঙ্গে রণমূর্তি ধরে পাগলি পাল্টা চেঁচিয়ে ওঠে, মাঙের পুত, পুলিশ ডাকছ্? পুলিশ আমার এইখানে!
পাগলি পা ফাঁক করে যথাস্থান দেখিয়ে দেখিয়ে কোমর দোলায়। তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে লঞ্চে ওঠে কেরানি। দ্রুত গা মুছে প্যান্ট-শার্ট ক্ষিপ্র হাতে পরে নিয়ে লজিংয়ের উদ্দেশে পথ ধরে। একেবারে পাগলা ঘোড়ার মতোই পায়ে তার দাপ বাসে। চোখও ঘোলা। নদীর পানিতে ডুব, তার ওপর পাগলির ওই কাণ্ড! চোখ তো ঘোলা হবেই। লাগে ধাক্কা বড় কেরানির গায়ে।
আবে, তড়বড় কইরা কই যাছ? বিকাল চাইরটার মইদ্যেই কলাম আয়া পইড়ো।
এ কথার উত্তর দেয় না কেরানি। তখন বড় কেরানি মোক্ষম অস্ত্রটা ছাড়ে, আবে, ঘোড়ার লাহান যে দৌড়াছ, তর রুহিতন ঘরেই আছে। পলায় নাই!
রুহিতন! রুহিতন! যার ঘরে সে থাকে বংশালের গলিতে, বাহারি ঘোড়ারগাড়ি নিয়ে যে খুশনবীশ শহর দেখনেওয়ালাদের চকবাজার, আহসান মঞ্জিল, হাইকোর্ট, রমনা পার্ক ঘুরিয়ে আনে, সেই ঘরের মালিক বুলবুল মিয়া, আর তারই মেয়ে রুহিতন। মাসের টাকায় কেরানি খাওয়া-থাকা দুইই পায়। ঘরে সে খায় এক বেলা, কেবল দুপুরে। ঘরে তার খাবারটা এনে দেয় রুহিতনই। কাম-কাজ নাই। বিয়েও হয় নাই। শক্ত-সমর্থ খর একটা মেয়ে। ঘোড়ার দলাইমলাই সাবান- গোসল পর্যন্ত রুহিতনের লালচুড়ি পরা হাতে।
কী গু-খুরি কাজটাই না কেরানি একদিন করেছিল!
ভোরের লঞ্চ সদরঘাটে এসে পেঁৗছলে ওপর-নিচ তালাশ করার কালে একদিন পেয়েছিল প্লাস্টিকের এক ফেলে যাওয়া ব্যাগ। তার মধ্যে ছিল লাল শাড়ি একটা, সোনালি চুমকি, গলার একটা সোনা-রাংতা হার আর লালচুড়ি এক গোছা। এনে দিয়েছিল রুহিতনকে।
পাইলাম! মনে মনে জিভ কেটে তৎক্ষণাৎ_ পাইলাম মানে বাজারে পেলাম।
জলেশ্বরীর হাই ইশকুলে বাংলা মাস্টার নলিনী বাবুর কাছে বেত খেয়ে ভাষা শেখা বাংলা বলবে তো শুদ্ধ উচ্চারণ করে বলবে, নইলে ভাষাকে অপমান করা আর মাকে অপমান করা একই কথা! সেই থেকে চেষ্টা। ভাষায় তবু মিশেল হয়ে যায়।
সেইদিন রাতের কালে শুনলাম বাবার কাছে জিদ ধরছ! লাল শাড়ি লাল চুড়ি! বাবা বলে, না! আর তুমিও বলছ হ্যাঁ। লাল চুড়ি! লাল শাড়ি! এত শখ তোমার! সদরঘাটে দোকানের মেলা! আরে, দোকানের পর দোকান! তারপর পাছে অন্যরকম না ভাবে রুহিতন মনে কর ভাই তোমাকে দিল!
ভাই! কয় কী ব্যাডায়! তুমি আমার কুনকালের ভাই! শাজাদার লাহান সুরৎ লিয়া তুমি ভাই হইবা আমার কুন দুঃখে!
না, কথাটা মুখে উচ্চারণ করে বলে নাই রুহিতন। মনে মনে! আর সেই থেকেই তো!
রুহিতনের কথা অজানা নাই লঞ্চের কারো। দোষটা তো তারই। সে-ই না কতদিন বুলবুল মিয়া, তার ঘোড়া, তার ঘোড়ারগাড়ির সাজ, তার গাড়িতে উঠে যুবক-যুবতী প্যাসেঞ্জারের আনতাবড়ি কাজ, আর রুহিতনের গল্প করেছে লঞ্চ নিয়ে ঢাকা থেকে বরিশাল, বরিশাল থেকে ঢাকা যাত্রাকালে। ছলচ্ছল নদী। আকাশভরা তারা। নদীর বাঁকে বাঁকে বিকন-বাতির লাল ইশারা। তখন যদি মনের মধ্যে রুহিতনের লাল চুড়ি রিনঠিন করে ওঠে, সে দোষ কার?
রুহিতন দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। যেন তারই অপেক্ষায়।
আইজ বড় ছবেরে ছবেরে আইলা মাস্টোর!
রুহিতন তাকে মাস্টার বলে ডাকে। বুলবুল মিয়ার কাছে নিজেকে সে লঞ্চের কেরানি বলেই পরিচয় দিত, কিন্তু এখানে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিতে নিয়ে এসেছিল সদরঘাটের যে রিকশাওয়ালা, বুলবুল মিয়ার চাচাতো ভাই, সেই আফলাতুন মিয়া আগ বাড়িয়ে বলেছিল, নীল সাগর লঞ্চের মাস্টার লিয়া আইছি। বাড়ির পোলার মতো রাখবা, অ্যাকবেলা খাইবো, আর সময়তে তোমার মিউনিসিপালির লুটিশ-ফুটিশেরও জবাবও হের কাছে ল্যাখাইয়া লইতে পারবা। মানুষটা ছিক্ষিত, কপালের ফেরে লঞ্চে নোকরি লইছে। নাইলে তো হের কুট-কাছারিতে জজ হওনের কথা!
আরে বলে কী! ছি ছি! লজ্জায় মাথা হেঁট করে রেখেছিল নীল সাগর কোম্পানির তিন নম্বর জাহাজের কেরানি। চোখ তুলে দ্যাখে, আফলাতুনের ওই বেদিশা কথায় খাতির তার তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেছে।
বুলবুল মিয়া যেন এতদিন পরে হাতে চাঁদ পেয়েছে! কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দেয়! আহেন, আহেন। ব্যছ আর কথা খরচো কিয়ের? কষ্ট থোড়া ছা হইব! অর মায়ের হাতের পাকও ছুবিধার না! এক ছময় আমার দাদাজান নবাব ছলিমুল্লাহর খাছ ছহিছ আছিলেন। পরে তো পাকিস্তান হইলো। তারপর বাংলাদ্যাশ। পাকিস্তান মাঠ ভি অহন নাম খোয়াইছে। বাংলা মাঠ না কী জানি কয় অহন! উইদিকে আর যাই না। ঘোড়ার গাড়ি ভি উইঠা গেছে। অহন কেউ বেড়াইলে-ছেড়াইলে! অবস্থাগতিকে পইড়া গেছি। টিমটিম কইরা বাত্তি! তয় নবাব বাড়ির তমিজ-তালাশ তো অহনতরি ভুলি নাই! গরিব বাড়িত খাতিরেই থাকবেন। কি কছ, রুহিতন?
রুহিতন দরোজার কেওয়ার ধরেই দাঁড়িয়েছিল।
এতক্ষণ দেখেও চোখ তার দিকে ফেরায় নাই। এবার তাকায়। একবার। একবারই তো! ওতেই সেদিন সেই প্রথম দিনেই কেরানির বুকের ভেতরটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল।
[চলবে]