৩০ লাখের আর্তনাদ

রাতের আঁধার ছিন্ন করে ভোরে যখন আলো ফুটতে থাকবে, আকাশ হয়ে উঠবে ধূসর নীলাভ, মাঠের বুকে প্রকাশিত হতে থাকবে সবুজ, তারপর যে লাল সূর্যটি দিগন্ত ঠেলে উঠবে, আজ বিজয় দিবসের ভোরে তার দিকে তাকিয়ে আমাদেরই সব গরিমায় তাকে আমরা বিশেষ করে দেখে উঠব স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালির রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওই—আমার দেশমায়ের সবুজ আঁচলে টকটকে লাল উদিত সূর্যটি।
দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব একমাত্র এই বাঙালিরই। আমরা যে হাজার বছর অপেক্ষা করেছিলাম মুক্তির ও স্বাধীনতার, কত ব্যর্থ যুদ্ধ ও বিপ্লবের পর, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রণোদনায় তাঁরই রণমন্ত্র জয় বাংলা কণ্ঠে ও চেতনায় ধারণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের রং আমরা দেখে উঠি পতাকায়। নমিত হৃদয়ে তাঁদের আমরা অভিবাদন করি প্রত্যয়ের মুষ্টি তুলে বিজয় দিবসে।
কিন্তু আজ এই ২০১৫-এর বিজয় দিবসে ওই যে সূর্যটি উঠেছে, একাত্তরে আমাদের দেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে যে তারা হত্যা করেছিল, তাদের প্রতিটি রক্তফোঁটা মেখেই আজ এই সূর্যটি বিশেষভাবে উঠেছে, আর তার সঙ্গে ভোরের ভৈরবী নয়, বাতাসে এখন আমি শুনতে পাচ্ছি হাহাকার—আমার ১০ লাখ মা, বোন ও মেয়েদের, যারা ধর্ষিত হয়েছে, যাদের কোল খালি হয়েছে, যারা নিষ্ঠুর বৈধব্যের কাফনতুল্য সাদায় আবৃত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর চোখ প্লাবিত হয়েছিল তাদেরই অশ্রুতে, যখন তিনি একাত্তরের বিজয়ের পরে স্বদেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজও আমাদের মনে পড়ে, আমরা ভুলিনি।
আমরা যে ভুলিনি, বঙ্গবন্ধু-কন্যা ও উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা যে ভোলেননি, তারই উজ্জ্বল সাক্ষ্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন। একাত্তরের সেই কালে পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল কুলাঙ্গার যারা খুনি হয়ে উঠেছিল, তাদের আমরা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের আদালতে তুলে বিধিমতো শাস্তির বিধান করতে শুরু করেছি—ইতিমধ্যেই চারজনের ফাঁসি কার্যকর—আরও অনেকেই রয়েছে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়, অচিরে তারাও পাবে দণ্ড, এতে একাত্তরের গণহত্যায় নিহত বিদেহী আত্মা শান্তি পাচ্ছে ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। অনেক দেরিতে হলেও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং দণ্ড কার্যকর করে ইতিহাসের দায় আমরা শোধ করছি।
২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর আজ। আজই আমরা ভোরের প্রথম সূর্যটিকে বিশেষভাবে ৩০ লাখ মানুষের রক্তরাঙা দেখে উঠছি কেন? কারণ, ওই ৩০ লাখের প্রতিটি রক্তফোঁটা আজ চিৎকার করছে। চিৎকার করছে, কেননা পাকিস্তানমাত্রই কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছে—না, বাংলাদেশে তারা গণহত্যা চালায়নি, একাত্তরে বাংলার মাটিতে তাদের হাতে কোনো হত্যা হয়নি এবং যারা যুদ্ধাপরাধী প্রমাণিত হয়ে আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ দণ্ড পেয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছে, তারা যুদ্ধাপরাধী নয়, ঘোর অন্যায় করে তাদের প্রাণ হরণ করা হয়েছে! পাকিস্তান সরকার সে দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এই কথা জানিয়েছে এবং বলেছে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওরা যুদ্ধাপরাধী নয়, ওরা নাকি বিরোধীদলীয় নেতা।
কী মিথ্যাচার! সত্যের কী জঘন্য অপলাপ! আমরা হতবাক হয়ে যাই দেখে যে কতখানি নির্লজ্জ ও উদ্ধত হলে রাষ্ট্রীয় আচার লঙ্ঘন করে একটি স্বাধীন দেশের বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি পাকিস্তান সরকার এমন উচ্চারণ করতে পারে!
কিন্তু তারা বললেই সত্য অসত্য হয়ে যাবে না। তাদের মুখের মিথ্যাও সত্য বলে গৃহীত হবে না। সত্য যে সত্যই! তাই বাইরে তারা যা-ই বলুক, নিজের নিভৃতে বুকে হাত দিয়ে পাকিস্তানিরা বলতে পারবে না, তাদের হাতে বাংলার রক্ত নেই।
একাত্তরে পাকিস্তানিরা বাংলার বুকে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম এক গণহত্যা, তার প্রমাণ খুঁজতে আর কোথাও যেতে হবে না, তার প্রমাণ রয়েছে তাদেরই দেশে, তাদেরই হাতে।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করার পর—ভুলে যাব না যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানি ও জাপানের আত্মসমর্পণের ২৬ বছর পর এই প্রথম কোনো দেশের বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল সেদিন—পরাজিত ওই পাকিস্তান সেদিন গঠন করেছিল হামুদুর রহমান কমিশন এবং সেই কমিশনে পাকিস্তানেরই ঊর্ধ্বতন-অধস্তন বহু অফিসার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন বাংলাদেশে তাঁদের পরিচালিত গণহত্যার দানবীয় কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। শুধু তা-ই নয়, একাত্তরে বাংলাদেশে কার্যরত তাদেরই মুখপাত্র সিদ্দিক সালেকের স্মৃতিকথাতেও রয়েছে এর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। আরও রয়েছে বাংলাদেশে তখনকার মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাডের পাঠানো একের পর এক বিবরণে, ওই গণহত্যার ঘটনা।
আজ যখন এই ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পাকিস্তান, তখন গণহত্যায় নিহত সেই ৩০ লাখ মানুষের আত্মা চিৎকার করে ওঠে, আমরা বধির হয়ে যাই অশান্ত তাদের চিৎকারে; আমাদের মর্মের ভেতরে ঘোর রব তুলে ওই তারা বলছে—এর উপযুক্ত জবাব দেওয়ার সময় এখন হয়েছে।
আমি অনেক ভেবেছি, আমি অনেক অশ্রু নিয়ে তাকিয়ে দেখছি ২০১৫-এর এই বিজয় দিবসে উদিত রক্তলাল সূর্যটিকে, ৩০ লাখ আত্মার শপথ আমি উপযুক্ত জবাব খুঁজে পেয়েছি। আর সেটি বলার জন্যই আমার এ ছোট্ট লেখাটি।
এই মুহূর্তেই আমাদের কর্তব্য:
আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা।
এবং সে ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের খুনি পাকিস্তানি জেনারেল ও অফিসারদের অনুপস্থিত ধরেও বিচার করা।
এবং অপরাধ প্রমাণিত করে দণ্ডদান করা।
ইতিহাসে এমন বিচার ও দণ্ডদানের নজির আছে অপরাধীদের সশরীরে উপস্থিত করা না গেলেও।
আজ এই বিজয় দিবসে আমি আমাদের সরকারের কাছে জোর থেকে আরও জোর আবেদন জানাচ্ছি, একাত্তরের খুনি পাকিস্তানিদের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল অবিলম্বে গঠন করা হোক। বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমার একাধিক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে উত্তর পেয়েছি—এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা খুবই সম্ভব এবং পাকিস্তানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের এটাই হবে সর্বোৎকৃষ্ট জবাব।
সময় বয়ে চলে, সময় বয়ে যায়। সময় বয়ে গেলেই অপরাধের ঘটনা ধুয়ে যায় না—অপরাধ অপরাধই থেকে যায়, এমনকি হাজার বছর পার হয়ে গেলেও। আমার মনে পড়ে, প্রয়াত বিচারপতি কে এম সোবহান একবার ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির এক সভায় বলেছিলেন, জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করার ঘটনা দুই হাজার বছর আগে হলেও কেউ যদি অভিযোগ আনে, নিহত ও ঘাতক হাজার বছর আগে ধুলায় মিশে গেলেও আজ এত দিন পরেও তার বিচার অবশ্য অবশ্যই করা যাবে এবং দণ্ডও দেওয়া যাবে।
আর একাত্তর তো সেদিনের ঘটনা। ইতিহাসের চোখে একটা পলকমাত্র। অচিরেই ২০২১-এ আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে পৌঁছাচ্ছি। যদি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আমরা সেদিনের খুনি পাকিস্তানিদের ইন অ্যাবসেনশিয়া ট্রায়াল অর্থাৎ অনুপস্থিত সত্ত্বেও বিচার করতে পারি, অপরাধ প্রমাণ করে তাদের প্রাপ্য শাস্তি-দণ্ড দিতে পারি, সে দণ্ড দৃশ্যত কার্যকর করা না গেলেও সেটাই হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহার।