লেখা শেখা

পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন শিউরে উঠি, লেখার কৌশল কত কম জেনে-আরো ভালো, যদি বলি কিছুই না জেনে-একদা কলম হাতে নিয়েছিলাম। লেখা যেহেতু কোনো একটি ভাষায় লেখা এবং যেহেতু সেই ভাষা আমরা শিশুকাল থেকেই, জন্ম-বোবা না হলে অনবরত ব্যবহার করে থাকি, তাই আমাদের অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে একবারও মনে হয় না যে শিল্পের প্রয়োজনে ভাষা নামক এই উপাদানটিকে সম্পূর্ণ নতুন করে, দৈনন্দিন ব্যবহার-পদ্ধতি ও ব্যবহার-যুক্তি থেকে একেবারে আলাদা করে দেখে নিয়ে কলম ধরতে হয়; যেন আমরা এ থেকে শুরু করি যে কথা যখন বলতে পারি, চিঠি যখন লিখতে পারি, তখন কাগজ-কলম নিয়ে বসলে একটি গল্প বা কবিতাও লিখে ফেলতে পারব। কবিতার ব্যাপারে হয়তো একটুখানি সচেতন চেষ্টার দরকার হয়, কারণ কবিতায় আছে ছন্দ আর সেই ছন্দ ঠিক প্রতিদিনের উচ্চারণে প্রযুক্ত নয়। যে মানুষ কবিতার দিকে প্রথম হাত বাড়ায় সেও ছন্দ জেনে নয়, বরং অতীতে পড়া, সম্ভবত বিদ্যালয়ে পড়া, কোনো কবিতার ছন্দকে আঁধারে হাত বাড়িয়ে তার শরীর অনুমান করে নিয়ে সেই শরীরেই শব্দ সাজায়; হয়তো এ কারণেই দেখা যায়, প্রায় যেকোনো কবির প্রথম দিকের কবিতাগুলো তাঁর ঠিক আগের সময়ের বা সমকালের সবচেয়ে ব্যবহৃত ছন্দেই লেখা। কিন্তু লেখা যদি হতো ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়া অথবা গান গাইবার মতো কোনো উদ্যম, তাহলে এতটা নিশ্চিন্তে, এতটা কম সচেতন হয়ে আমরা কলম ধরতে পারতাম না; অন্তত ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া বা গান গাইবার জন্য রং-তুলি, হাতুড়ি-ছেনি বা হারমোনিয়াম নিয়ে যতটুকু পাঠ ও রেওয়াজ এবং আরো বড় করে যতটুকু সাধ্য সাধনা করা দরকার, তা করে নিয়েই কাগজে কলম ছোঁয়াতাম। যুক্তিবিজ্ঞানে যাকে বলে ‘ভ্রান্ত সাদৃশ্যমূলক অনুমান’-জীবনে আমরা সেটারই শিকার হই বড় নির্মমভাবে; আর এ জন্যই আমরা এ কথায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখি, এর ভেতরে আদৌ কোনো ফাঁক দেখি না যে জলে নেমেই সাঁতার শিখতে হয়। সাদৃশ্যমূলক এই অনুমানটিকেই ব্যবহার করে আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করি যে লিখতে শুরু না করে লেখা সম্পর্কে জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয় কিংবা শুধু ভাবের ঘোরে লিখতে লিখতেই লেখক হওয়া যায়! এই অনুমানটিকে সম্প্রসারিত করে আমি যদি মহাশূন্যে যাত্রার উদাহরণ তুলে ধরি? তাহলেও কি ‘জলে না নেমে সাঁতার শেখা যায় না’-এই বচনটির সত্যতা আপনি দেখতে পাবেন? পাবেন না; কারণ, জল আর মহাশূন্য ঠিক এক জিনিস নয়। মহাশূন্য সম্পর্কে সম্ভবপর ও জ্ঞাত সব তথ্য না নিয়ে, মহাশূন্যের বায়ুহীন অবস্থায় জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সঙ্গে না নিয়ে, মহাশূন্যের কম্পনাতীত উত্তাপ ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো পোশাক না পরে এবং এসব আয়োজন সম্পর্কে ষোলো আনা নিশ্চিত না হয়ে আপনি কিছুতেই নভোলোকে যাত্রা করতে পারেন না, পারবেন না। কাজেই এ ক্ষেত্রে বলা যাবে না যে মহাশূন্যে না গিয়ে কেউ মহাশূন্য ভ্রমণ রপ্ত করতে পারে না। এখন লেখার ব্যাপারটিকে যদি মহাশূন্যে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে লেখার আগে লেখার কৌশল আমাদের পুরোপুরি জেনে নিতে হবে। কিন্তু আরেক দিক থেকে এটাও একটি ভ্রান্ত সাদৃশ্যমূলক অনুমান। কারণ এ দুটো উদ্যমের মৌলিক লক্ষ্যই ভিন্ন; তার চেয়েও বড় কথা, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাত নিয়ম মানতে হয়। এবং অজ্ঞাত নিয়মটাও বৈজ্ঞানিককে আবিষ্কার করে নিতে হয়; কোনো নিয়ম নিজে থেকে নির্মাণ করে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো উপায় তাঁর নেই; অন্যদিকে একজন লেখককে জ্ঞাত নিয়ম জেনে নিতে হয় বটে; কিন্তু তিনি নিজেও কিছু নতুন নিয়ম নির্মাণ করতে পারেন। আর যেহেতু তিনি নিজেই কিছু নতুন নিয়ম নির্মাণ করতে সক্ষম-তাঁর কাজের প্রকৃতিই তাই। অতএব, একজন লেখককে সেই সব অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বা তাঁকে যেতে দিতে হয়, যেখানে তিনি কখনো ভুলপথে চলছেন, কখনো আঁধারে হাঁটছেন, কখনো বা মেঘহীন পূর্ণিমায়। এই যদি না হয়, তাহলে শামসুর রাহমানের বদলে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কোনো পণ্ডিত আমাদের সমকা