বহরমপুর ভ্রমণ

হেমন্তের পাতলা কুয়াশা জড়ানো ভোরে আমি আর আমার জীবনসঙ্গী আনোয়ারা সৈয়দ হক ঢাকা থেকে রওনা হয়েছি সীমান্তের ওপারে বহরমপুরের দিকে। ওখানে অনেক দিনের এক নাট্য সংস্থা ঋত্বিক আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বছর পনেরো থেকে ওঁরা দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা করে আসছেন। ২০১৫-এর ওই উৎসবে ওঁরা আমাকে ডেকেছেন উপস্থিত থাকবার জন্যে। ওঁদের মনে আছে আমার আশি বছর হতে যাচ্ছে এবারেই, ওদের ইচ্ছে, আমাকে ওঁরা সংবর্ধিত করবেন। আমি মোটে সে লোভে নয়, বরং ওঁদের সঙ্গে, কলকাতার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের একটি শহরে সেখানকার কৃতি নাট্যজনদের সঙ্গে সহমর্মী দু-একটি দিন কাটাতে পারব, সেই টানেই মঞ্জুকে নিয়ে এবার এই যাত্রায় বেরিয়েছি। মঞ্জু আমার স্ত্রীর ডাকনাম। বস্তুত তিনি আমার জীবনটাকেই মঞ্জুমণ্ডিত করে রেখেছেন বিবাহের আজ এই পঞ্চাশটি বছর।

ঋত্বিকের ডাকে বহরমপুরে এর প্রায় বছর ন’য়েক আগে একবার গিয়েছিলাম, বড় সুন্দর দুটি দিন কেটেছিল সেবার। ওঁদের নাট্যমেলার উদ্বোধন করেছিলাম সেবার, আর মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলাম প্রথমবারের মতো, পলাশী আর সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিময় আবহে উত্তোলিত হয়েছিলাম। মনে পড়ে, সেই আবহ এতটাই আমার ভেতরে কাজ করেছিল যে আমি নারীগণ নামে একটি কাব্যনাটক লিখে উঠেছিলাম, যার বিষয় ছিল, যে-রাতে সিরাজ নিহত হন, সেই রাতে তাঁর জেনানামহলের নারীদের পরিস্থিতি। ওই নাটকে আমি যুদ্ধকালে—বস্তুত যেকোনো যুদ্ধকালেই ও বিশেষ করে পরাজিত পক্ষের নারীদের পরিস্থিতি ও এক চূড়ান্ত বিচলিত সময়ে তাদের অবস্থান-চিত্র আঁকবার চেষ্টা করি।

কিন্তু এখন সে কথা থাক, এখন আমরা বহরমপুরের পথে। বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে সড়কপথে বহরমপুর যাব, তার আগে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া বাংলাদেশের যশোরের প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাতে হবে। মঞ্জু যশোরের কন্যা, শহরেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি। অতএব আমরা ঠিক করি, বিমানে যশোর যাব, সেখান থেকে সড়কপথে বেনাপোল, তারপর সীমান্তের ওপারে আমাদের নেবার জন্যে ঋত্বিকের পাঠানো গাড়িতে আমরা উঠব। ঋত্বিকের দুই প্রাণপুরুষ মোহিতবন্ধু অধিকারী আর বিপ্লব দে আগেই ফোনে জানিয়েছেন যে গাড়ি তো থাকবেই, এগিয়ে নেবার জন্যে কর্মীও তাঁরা পাঠাবেন।

ডিসেম্বরের ৭ তারিখ, বিমানে যশোর পৌঁছেছি, মঞ্জুর ছোট ভাই টুকু চৌধুরীর বাড়িতে দুপুরের রাজকীয় ভোজ শেষে বেড়াতে বেরিয়েছি, ঘুরে ঘুরে দেখেছি মঞ্জুর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিজিরেত, আর সেই একখণ্ড জমি, যেটি মঞ্জু নিজে কিনেছেন ছোট্ট একটা বাংলোবাড়ি তুলবেন বলে। স্বপ্নের সেই বাড়িটির নাম আমি দিয়ে রেখেছি— মঞ্জুনীড়।

পরদিন ভোরে টুকুর গাড়িতে যশোর রোড ধরে বেনাপোলের পথে আমরা বেরিয়ে পড়ি। তার আগে যশোর শহরের চৌরাস্তায় আমরা এক দোকানে বসে প্রভাতী জলযোগ সেরে নিই এলাকার বিখ্যাত পুরি-ডাল আর মিষ্টান্ন সহযোগে। মঞ্জুকে আমি হাসতে হাসতে বলি,তোমার মনে কি আছে বিয়ের পর প্রথম যখন তোমাদের বাড়ি আমি আমাকে ভোরের জলযোগ তোমরা করিয়েছিলে দোকানের কেনা পুরি ডাল দিয়ে? আমি খুব অবাক হয়েছিলাম—কী! কেনা খাবার দিয়ে জামাই আপ্যায়ন? পরে শুনেছি, যশোরে এটাই তোমাদের রীতি, দোকানের খাবারে ভোর ও বিকেলের জলযোগ করানো!

এই যে বেনাপোলের দিকে এখন চলেছি, পথের দুপাশে সারি সারি প্রাচীন গাছ আমাদের মনে করিয়ে দিল নড়াইলের সেই রাজার কথা, যিনি তাঁর মায়ের গঙ্গাস্নানে কলকাতা পর্যন্ত পালকিতে যাবার এই সড়কটির দুপাশে এত বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, মা যেন ছায়া পান তাঁর চলতি পথে। আমরাও এখন পথের সেই মাতৃছায়া অনুভব করে উঠলাম চলতে চলতে।

আর, এটাও আমাদের দুজনেরই মনে পড়ে গেল, একাত্তরে যখন বর্বর পাকিস্তানিরা গণহত্যা শুরু করে দেয়, তখন বাংলার ভীত মানুষেরা এই পথ দিয়েই তো ত্রস্ত দীর্ঘ মিছিলে ভারতে গিয়েছিল আশ্রয় নিতে। উদ্বাস্তুদের সেই মিছিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে তিনি কালির বদলে তাঁর গলিত অশ্রু দিয়ে লিখে উঠেছিলেন ‘যশোর রোড’ নামে অসামান্য এক কবিতা। সেই কবিতার বাংলা অনুবাদটি ভারতীয় গায়ক মৌসুমী ভৌমিক যে বেদনা ও চেতনা লয়ে, তাঁর মর্মস্পর্শী গায়নে গেয়ে ওঠেন, তা এত বছর পরেও আজ এই যাত্রাপথে মঞ্জু ও আমি যেন আবার কানে শুনে উঠলাম, আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।

আমাদের মনে প্রার্থনা জেগে ওঠে, আর যেন পৃথিবীর কোনো জাতি কোনো দেশকে পাকিস্তানি সৈন্যদের অমন বর্বরতা ও বিকটতার শিকার হতে না হয়। কৃতজ্ঞতায় আমরা আপ্লুত হয়ে যাই ভারতের প্রতি—এক কোটি মানুষকে তারা আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সহায়তা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী গঠন করে পরাজয় ঘটিয়েছে বর্বর ওই বাহিনীর।

সড়কপথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আমরা পৌঁছে যাই বেলা এগারোটা নাগাদ। সীমান্ত-লাগোয়া সেই বিশাল বৃক্ষটি দূর থেকেই আমার চোখে পড়ে, যার নিচে মঞ্চ বাঁধা হয় প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে, আর সেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে হয় অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানে সেদিন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও মন্ত্রী ও সুধীজনেরা আসেন, ওপার থেকে কত মানুষই আসেন, ওই একটি দিনে উঠে যায় সীমান্তের রাষ্ট্রীয় বাধা, বাঙালির মিলনমেলা বসে যায় প্রতিবছরই সেদিনটায় এই বৃক্ষতলে, তারপরে এপারের এই বাঙালিরা যায় ওপারে, ভারতখণ্ডে, সেখানেও হয় অনুষ্ঠান, আমি নিজেই তো একবার এমন এক একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে এসেছিলাম আমন্ত্রিত হয়ে। আমিও সেদিন এপার-ওপার ভুলে এমনই ভ্রাতৃবন্ধন অনুভব করে উঠেছিলাম সকল বাঙালির ভেতরে, যে-বাঙালি ভাষা আর সংস্কৃতির একসূত্রে গাঁথা। আমাদের পথ ভিন্ন, ইতিহাস ভিন্ন, কিন্তু সকলেই যে আমরা একই মাটির সন্তান, সেই বোধ আমাকে ও মঞ্জুকে এতটাই আপ্লুত করে রাখে যে আমরা সীমান্ত পেরোবার আনুষ্ঠানিকতার সমুখে কিছুক্ষণের জন্যে বেপথু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

কিন্তু বেপথু হয়ে থাকবার উপায় আছে? আমাদের দেখে কলরব করে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন অফিসার, কাস্টম কর্মকর্তা রাঙামাটির মহিলা, তাঁরাই নিমেষ না গত হতে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমাদের এগিয়ে দেন নো-ম্যানস ল্যান্ডের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। আমাদের ব্যাগ দুটো আন্তর্জাতিক কুলির হাতে দিয়েই চোখ তুলে দেখি সীমান্তের লৌহ ফটকের ওপারে কারা যেন হাত নাড়ছে। ওদের একজন চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আমরা ঋত্বিক থেকে এসেছি। বলতে বলতে ফটক ঠেলেই যেন আমাদের ওরা ছুঁতে চায়, কিন্তু বাধা! আমরা এগিয়ে যাই। ফটকের মুখে দাঁড়ানো ভারতীয় প্রহরা পেরিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছাবার আগেই ঋত্বিকের ছেলেটি—সুমন তার নাম—কাছে আসে, আর এখানেও আমরা নিমেষ না গত হতেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ভারতীয় জমিতে, সড়কে পা রাখি।

বাংলাদেশে নাহয় আমার কিছুটা পরিচিতির কারণে সীমান্ত ওরা নিমেষে পার করে দেন, কিন্তু ভারতে? এখানেও যে মোটে সময় লাগল না, মোটে ঝুটঝামেলা হলো না, এইটে আমাকে মুগ্ধ করল। আগেও বহু বছর আমি এই পথে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পার হয়েছি, কিন্তু এর আগে কোনোবারই আমি এতটা সহজ ও এত সময় সংক্ষেপে পার হতে পারিনি। প্রশংসা করতে হয় উভয় প্রান্তেরই সরকারি ব্যবস্থাপনাকে, সীমান্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ভারতীয় এবং বাংলাদেশি সকল কর্মকর্তা ও কর্মীকে। হ্যাঁ, দুই দেশের ভেতরে যাতায়াত তো এ রকমই সহজ ও ঝামেলামুক্ত হওয়া উচিত। আমরা নিকটতম প্রতিবেশী এবং মানবিক ও রাষ্ট্রিক উভয় দিক থেকে একে অপরের বন্ধুত্বের বন্ধনেই তো আবদ্ধ।

রওনা হওয়া গেল বহরমপুরের দিকে। প্রশস্ত সুমো গাড়ি। মঞ্জু বসলেন ড্রাইভারের পাশে আর আমি সুমনের ও ঋত্বিকের আরেকজনার সঙ্গে পেছনের সিটে। চাকদহ রানাঘাট পেরিয়ে থামলাম আমরা কৃষ্ণনগরে কিছু খেয়ে নেবার জন্যে। ভাত-মাছ শেষে সুমন আমাদের সমুখে ধরে দিল সরভাজা। বলল, কৃষ্ণনগরের সরভাজা খেলেন না তো খেলেন কী! খেলাম। মঞ্জু বললেন, আমি কিন্তু কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের কথা ভুলছি নে! ফেরার পথে কিনবই কিনব!

প্রায় পড়তি বিকেল, গাড়ি এসে দাঁড়াল বহরমপুরে, ভাগিরথী তীরে সরকারি সেচ-নিবাসে। বাহির প্রাঙ্গণেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে এক ভিড় মানুষ। ভিড়ের ভেতরে মোহিত আর বিপ্লবকে লক্ষ করলাম। ফুলের স্তবক হাতে তাঁরা এগিয়ে এলেন। আর প্রণাম! এক ভিড় প্রণাম! ঋত্বিকের ছেলেমেয়ে নতুন-পুরোনো নাট্যজনদের! এঁদের ভক্তি আর ভালোবাসার প্লাবনে সাগরভাসা হয়ে উঠি আমরা দুজনে। আমার চোখে জল এসে যায়। সজল আমি মনে করে উঠি, এই ভিড়ের ভেতরে একজনাই শুধু আজ নেই। তিনি গৌতম রায়চৌধুরী—ঋত্বিকের নাট্যকার ও নির্দেশক, এখন প্রয়াত।

নিবাসের দোতলায় আমরা বসি, কফি পান করি সকলে মিলে, আমাদের বিশ্রামের অবকাশ দিয়ে মোহিত বিপ্লব আর-আর সকলে চলে যান ওঁদের নাটকের মহড়ায়। আজ ডিসেম্বরের ৮ তারিখ, ১০ তারিখে ওঁদের নাট্যমেলার উদ্বোধন, আর প্রথম দিনেই অভিনীত হবে ঋত্বিকের নতুন নাটক, তারই ব্যস্ততা, তারই মহড়া, উৎসবের অন্য আয়োজন তো সেই সঙ্গে আছেই।

(ভ্রমণ কাহিনিটি অসমাপ্ত)