শেষ যোদ্ধা

কাল: বর্তমান

কুশীলব: লোক ১, লোক ২, প্রৌঢ়, স্বামী, স্ত্রী, কন্যা, কন্যার প্রেমিক যুবক ও কোরাস
(মঞ্চ: তিন স্তরে তিনটি স্থান—পার্ক, বসবার ঘর, রেস্তোরাঁ)

দৃশ্য: ১

পার্কের অংশ ভোরের মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত।
আবহধ্বনি: মোটা বাঁশিতে ভৈরবী রাগ, দূর থেকে আগত।
দুটি লোক এসে মঞ্চে দাঁড়ায়।

লোক ১: সন্ধ্যায় যে সূর্য ডুবে যায়
ভোরে সে আবার ওঠে।
আজও সে উঠেছে।
কিন্তু আমাদের যা কিছু
বিদায় নেয়
সূর্যের মতো কি
সব ফিরে আসে?
ধরা যাক, ফেরে।
তাই যদি! আবার প্রথম
থেকে? মুক্তিযুদ্ধ?
হঠাৎ এ কথা কেন? তবে
আবার বিজয়? পরাজয়?
মানুষের মানচিত্র দেখি
দেখা যাক মানুষকে তবে।

আবহ ধ্বনির ওই ভৈরবী সুর হঠাৎ শ্বসিয়ে ওঠে পূর্ণনাদে। তারপরই একেবারে থেমে যায়।
লোক ২: কাচ ভেঙে পড়ুক জানলার।
দরজার পাল্লা খসে যাক।
দরজা তো বন্ধ করা যায়,
সত্য রোধ করে রাখা যায়।
বহুদিন বন্ধ হয়ে আছে।
কাচ মানে সবই দেখা যাচ্ছে,
কিন্তু এক আবরণে ঢাকা।
সে-ও তো অনেক দিন থেকে!
খসে যাক! ভেঙে যাক! ভাঙো!
শুরু হোক নাটকের পালা।
ইতিহাসও আসলে নাটক।
কুশীলব আমাদেরই মতো
জন জাতি সাধারণ লোক।
কিন্তু পুরোভাগে একজন
স্বপ্নের সোনালি জামা গায়ে

যিনি এসে সমুখে দাঁড়ান

আমাদের মুক্তি যাঁর হাতে।

লোক ১: এ নাটক! হতে পারে আমাদেরই! ধরা যাক,

এখন বিকট কাল

আমাদের দেশে,

দেশপ্রেমিক ফাঁসিতে,

আর, শত্রু রাষ্ট্রক্ষমতায়,

মুক্তির উজ্জ্বল দিন অস্ত গেছে

জাতির আকাশে,

উদয়ের আশা নেই,

বসন্তের বাগান নিহত,

মানুষ তো ভীত হয়

সহজেই সামান্য মানুষ।

লোক ২: ওদিকে এমন কেউ নেই

আশা দেবে,

ডাক ভেঙে একবার

বলবে যে জাগো!

চলো যাই আবার মুক্তির

যুদ্ধে, এসো!

ইতিহাস রক্ত যদি চায়,

রক্ত দেব!

রক্তে গোলাপ ফোটাব,

মাঠে এসে নামো,

রক্তরাজপথ করো মানবিক কৃষির জমিন।

লোক ১: দিগন্ত পর্যন্ত শুধু হতাশ্বাস

শোঁসায় ফোঁসায়।

দলে দলে দেশত্যাগ

আরও একবার,

আমাদের অনেকেই

পরবাসে উদ্বাস্তু এখন।

নিস্তাপ সুদীর্ঘ দিন,

যান্ত্রিক জীবন।

উদ্বাস্তু সকল আজ অভ্যস্ত

প্রবাসে।

দিন আসে, দিন যায়।

রাতে চাঁদ বিষাদ-জ্যোৎস্নায়।

সূর্য ওঠে পান্ডুর মলিন।

লোক ১: ধরা যাক, আমাদের সীমান্তের ওপারে উত্তরে

প্রান্তবর্তী কোনো এক

অখ্যাত শহরে,

ওই আলো আকাশে ফুটছে। ভোরের

প্রথম আলো।

একজন ওই এসে দাঁড়ালেন—

দেখা যাক তবে!

লোক দুটি আড়ালে চলে যায়।

দৃশ্য: ২

এক বৃদ্ধ পার্কে আসে। ধূসর স্যুট পরিহিত। হাতে বেড়ানোর ছড়ি। বৃদ্ধ স্থাণু দাঁড়িয়ে থাকে। এখনো মঞ্চের আলো আগের মতোই অতি মৃদু।

কিছুক্ষণ পরে ধীরে বৃত্তাকার আলো সমপাতিত হয় বৃদ্ধের ওপরে।

বৃদ্ধ হলেও ব্যক্তিটির মেরুদণ্ড এখনো সতেজ ও টানটান। ভঙ্গিতে যৌবনের দৃপ্তি।

বৃদ্ধ জ্যাকেটের পকেট থেকে একটি ঠোঙা বের করে বীজদানা মুঠোয় ঢালে। আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখিদের স্মিত চোখে কিছুক্ষণ দ্যাখে। তারপর তাদের ডাকে

বৃদ্ধ: আয় আয় আয়।

আবহধ্বনি: পাখিদের কিচিরমিচির।

বৃদ্ধ দানা ছড়িয়ে দেয় মাটিতে। পাখিরা নেমে এসে দানা খাচ্ছে দেখে ভারি খুশি হয়।

আবহধ্বনি: শ্রবণ বধির করে দিয়ে অকস্মাৎ গোলাগুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, যেনবা যুদ্ধের ময়দানে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শব্দ থেমে যায়। ঘোর নীরবতা নেমে আসে।

আবহধ্বনি: তুমুল কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘ফা-য়া–র’।

সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ হাতের লাঠিকে বন্দুক হেন তুলে ধরে তাক করে, যেন গুলি ছুড়তে থাকে।

আবহধ্বনি: উচ্চারিত হয় ‘চা-আ–র্জ’।

বৃদ্ধ তার হাতের লাঠি বন্দুকের মতো বাগিয়ে ধরে এগোতে থাকে। তুমুল গোলাগুলির শব্দের ভেতরে হঠাৎ সে থামে। নামিয়ে নেয় লাঠি। যেন কী সে করছিল, নিজেই জানে না। গোলাগুলির শব্দ থেমে যায় অকস্মাৎ। হতভম্ব বৃদ্ধ সচকিত হয়ে ভাবে, কেউ কি তার এই পাগলামো দেখে ফেলল? সে চারদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিপাত করে। তারপর আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভঙ্গিতে লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে মঞ্চ ছেড়ে চলে যায়।

শূন্য মঞ্চ পড়ে থাকে কিছুক্ষণ।

আবহধ্বনি: ফিরে আসে বাঁশিতে ভোরের করুণ ভৈরবী।

দৃশ্য: ৩

আলো পরিস্ফুট হওয়ার আগেই মঞ্চে এক প্রৌঢ় আসে। উৎসুক চোখে সে দূরে বাইরে কিছু দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই তার স্ত্রী আসে চায়ের পেয়ালা হাতে।

স্ত্রী: কী দেখছ? কই, কথা বলছ না!

চা জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল।

প্রৌঢ়: দাঁড়াও! দেখছি। ওই লোকটিকে।

স্ত্রী: এত দেখবার কী আছে! বুড়ো একটা।

লাঠি হাতে ঠুকঠুক—ভোরে বেরিয়েছে!

এ রকম কত ভোরে কত লোক

হাঁটাহাঁটি করে।

প্রৌঢ়: আমি তাকে আগেও দেখেছি—রেস্তোরাঁয়

মাঝে মাঝে আসেন, সামান্য কিছু

আহার করেন।

একটা স্যুপের সঙ্গে একখানা কড়া টোস্ট—ব্যস।

প্রতিবার একই অর্ডার। তাই স্পষ্ট

মনে আছে।

ওয়েটার ছোকরাদের হাতে তাঁকে পড়তে

দিই না।

বরাবর আমিই তাঁকে সার্ভ করি ক্যাশ

থেকে নেমে—

শুধু যে উদার হাতে বকশিশ দেন,

তার জন্য নয়।

কী যেন রয়েছে তাঁর—আভিজাত্য,

নিঃসঙ্গতা, আর?

বুক চাপা কথা কিছু? যেমন বালির নিচে

নদীর নিশ্বাস?

পড়ে যাওয়া পাখির ডানার নিচে

দুরন্ত আকাশ!

ঠিক ঠাহর হয় না। আমাদেরই মতো

এক শরণার্থী কি না

বহুদিন থেকে এই দেশে, হয়তো বা

আরেক শহরে এসে

বহুদিন, তারপর এইখানে—সীমান্তের এ শহরে

কিছুদিন হলো এসেছেন। মাঝে মাঝে

মনে হয়

হয়তো দেখেছি তাকে, যেন তাঁর

যৌবন বয়সে।

কবে? বা কোথায়? ধন্দ লাগে।

যেন জ্যোৎস্নার ভেতরে কাউকে

হঠাৎ দেখে—চেনা।

অদ্ভুত তাই না?

স্ত্রী: অদ্ভুত বলে কীই অদ্ভুত!

আমিও দেখেছি ওই বুড়োটাকে।

একদিন আলাপও হয়েছে।

প্রৌঢ়: পরিচয় পেলে কিছু? নামধাম?

বলেনি কিছুই?

স্ত্রী: না, ঠিক আলাপ নয়। অদ্ভুত শোনো না!

পার্কের মালির কাছে যাচ্ছিলাম ভোরে—

সেদিন গোলাপ বেশ পার্কে ফুটেছিল—

দু-একটা যদি দেয়—দিল

ফিরছি গোলাপ হাতে, পথে দেখা—

ঠিক ওই লাঠি হাতে,

ঠিক ওই বন্দুকের মতো লাঠি তাক করে ধরা,

তারপর হঠাৎ নামিয়ে নিয়ে চারদিক দেখা—

যেন ধরা পড়ে গেছে, যেন

কেউ কি দেখল, যেন

বাচ্চা ছেলে চুরি করে বাবার

কলম নিয়ে লিখছিল,

পায়ের শব্দেই তার পিলে চমকে গেছে।

দূর থেকে দেখছিলাম। কাছে আসতেই

বুড়োটা আমাকে দেখে হে হে করে হেসে

হঠাৎ বলল কী জানো?—অদ্ভুত ভুতুড়ে স্বর!

কী লাল গোলাপগুলো—রক্ত

কিন্তু এ রকমই লাল।

প্রৌঢ়: রক্ত? লাল?

স্ত্রী: আমি তো অবাক। হঠাৎ রক্তের কথা?

ছনমন করে উঠি। আরে, আচ্ছা তো পাগল!

বুড়োটা আমার দিকে ভালো করে

দেখে তারপর—

ম্যাডাম কি এখানে থাকেন?

হঠাৎ তখন আমি ভাবলাম, কেন?

এতগুলো বছর এখানে আছি—এই দেশে—

এখনো কি মনে হয় শরণার্থী

দেখলে আমাকে!

এখানে আমরা সেই কবে চলে আসি

দেশ ছেড়ে, মার খেয়ে, সীমান্ত পেরিয়ে—

যখন দেশের সেই গৌরবের দিন গেছে

মুক্তির যুদ্ধের,

স্বাধীনতা অর্জনের, তারপরে

একে একে সব শেষ,

মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ধরে ফাঁসিকাঠে,

তুমিও তো যুদ্ধ করেছিলে—গণতন্ত্র?

সাম্যবাদ?

মনে পড়ে? আমাদের একে একে

সব শেষ হলো।

জঙ্গিবাদ মৌলবাদ দেশের দখল নিল,

পালিয়ে এলাম

সীমান্তের এপারে এই দেশের শহরে।

প্রৌঢ়: ভেবেছি দুদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে,

গণতন্ত্র ফিরে এলে দেশে ফিরে যাব।

কিন্তু দেশ জাগল না, মানুষ নিথর।

যেন ব্রহ্মপুত্র ছিল, আজ মরাখাত!

খরস্রোত মরে গিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত

এক বালির পাহাড়।

পনেরো বছর পার হয়ে গেল, তবু

দেশে আর ফেরাই হলো না।

স্ত্রী: দেশ আমি ভুলেই গিয়েছি।

এখানেই কখন শেকড় গেঁথে গেছে!

তুমিও কেমন দ্যাখো, সেদিনের

যোদ্ধা তুমি আজ

রেস্তোরাঁর ম্যানেজার! কেটে গেল
একটা জীবন!

কেমন বুড়িয়ে গেলে! ঠান্ডা! নিরুত্তাপ!

দ্যাখো, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রৌঢ়: দাও দিকি। সত্যিই বলেছ ঠান্ডা
কিছু ভালো নয়।
এ দেশে এসেছি আজ পনেরো বছর,
পাহাড়ের কোলে দেশ—এখানে ঠান্ডাটা—
কিছুতেই—এখন পর্যন্ত কিছু ধাতস্থ হলো না।

স্ত্রী: আমারও আমারও।
কবে যে এখান থেকে দেশে ফিরে যাব।
কোনো দিন ফিরতে পারব?

প্রৌঢ়: সে আশা কোরো না। মৃত্যু হলে এখানেই!

স্ত্রী: এ কথা তোমার মুখে? তুমি তো কখনো
বলোনি মৃত্যুর কথা! চিরকাল তুমি

বলেছ—অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো ধরো—

একদিন ফের যুদ্ধ হবে
আমাদের দেশ থেকে নিশ্চিত

উৎখাত হব দেখো

মৌলবাদী স্বৈরশাসনের।
একদিন গণতন্ত্র ফিরে আসবেই
একদিন তরুণেরা আবার উঠবে জেগে, তারা
আবার সোনার দেশ যুদ্ধ করে
ফিরিয়ে আনবে।
প্রৌঢ়: কিন্তু—ওই ওখানে কিন্তুটা।

স্ত্রী: খুলে বলো। মনে হচ্ছে এতদিনে তুমি
অন্য রকম ভাবছ।

প্রৌঢ়: ভাবনা কি চিরকাল এক জায়গায় থাকে?
ভাবনা বদলে যায়, দিন হয়ে যায় রাত,
রাত ফিরে ভোর হয়, এ তো জানা কথা।
নদীও পাল্টে নেয় তার গতিধারা।

স্ত্রী: যদি ভূমিকম্প হয়। তখন হঠাৎ
নদী তার গতিমুখ মাছের লেজের মতো
দেয় যে আছাড়—বদল তো তাতেই হয়।
কী এমন?—যে তোমার এত দিন পরে
ভাবনায় বদল আসছে?

(কাব্যনাটকটি অসমাপ্ত)