না পাঠানো চিঠি

মা,
তুমি কেমন আছ? আমার পোষা বেড়াল খুঁচূ সে কেমন আছে? সে রাত্রি কার পাশে শোয়? দুপুরে যেন আলী সাহেবদের বাগানে না যায়। মা, ঝিঙ্গে মাচায় ফুল এসেছে? তুলি কে আমার ডুরে শাড়ি টা পড়তে বোলো। আচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়। তুলি কে কত মেরেছি! আর কোনদিন মারবো না। আমি ভালো আছি, আমার জন্য চিন্তা কোরো না।

মা আমাদের, …মা তোমাদের ঘরের চালে নতুন খর দিয়েছো? এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব। তরফদার বাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে? কালু ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু? একবার মেঘের ডাক শুনে কৈ মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়। আমি আম গাছ তলায় দুটো কৈ মাছ ধরেছিলাম। তোমার মনে আছে, মা? মনে আছে আলী সাহেবের বাগানের সেই নারকোল? চুরি করে আনিনি! মাটিতে পরে ছিলো। কেউ দেখেনি। নারকোল বরার সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

আলী সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করতো। বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চেলা কাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল আমাকে। আমার কি দোষ? কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি? আমার পিঠে এখনো সে দাগ আছে। আলী সাহেবদের বাগানে আর কোনদিন যাইনি। আমি আর কোনো বাগানেই যাই না, মা। সেই দাগটায় হাত ভুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি। বাবা যেনো আমার জন্য একটুও না ভাবে।

তুলি কি এখনো ভুতের ভয় পায়, মা? তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলাবউ দেখেছিলাম। সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হলো। দাদা সেই কলা গাছটা কেটে ফেললো। আমি কিন্তু ভয় পাই নি। তুলি কে কত খেপিয়েছি…… আমার আবার মাঝ রাত্রি সেই কলা বউ দেখতে ইচ্ছে করে।

হ্যাঁ ভালো কথা, দাদা কোনো কাজ পেয়েছে? নকুলবাবু যে বলেছিল, বহরমপুরে নিয়ে যাবে। দাদা কে বোলো আমি ওর উপরে রাগ করিনি। রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট। আমার শরীরে আর রাগ নেই। আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না মা। আমি রোজ দোকানের খাবার খাই। হোটেল থেকে দু-বেলা আমার খাবার এনে দেয়। মাংস মুখে দেই আর তুলির কথা আর কালু ভুলুর কথা মনে পড়ে।

আমাদের, তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না। আমি আলু পটলের তরকারী খাই, পটল ভাজাও খাই। হোটেলে কিন্তু কখনো শাক রান্না হয় না। পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক। কি ভালো, কি ভালো বিনা পয়সায়। কোনদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জোটবে না। জোড় হওয়া দিলে তাল গাছের পাতা শর শর করে ঠিক বৃষ্টির মত শব্দ হয়। এই ভ্রাদ্দর মাসে তাল পাঁকে। ডিব ডিব করে তাল পড়ে। বাড়ীর তাল গাছ দুটো আছে তো? কালু তালের বরা বড় ভালবাসে। একদিন বানিয়ে দিও। তেলের খুব দাম জানি! তবু একদিন দিও।

আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ-হাজার টাকা পেয়েছিলে। তা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছে তো? সেই গরুটা ভালো দুধ দেয়? আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও অনেক ভালো। গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়। গরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়! বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা! দু’বেলা ভাত দাওরে, শাড়ি দাওরে , বিয়ের যোগার কর রে, হাবলু, মিজান, শ্রীধর দের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে। আমি কি বুঝি না? সব বুঝি, সব বুঝি।

কেনো আমায় বিক্রি করে দিলে? তাও তো বুঝি। সে জন্যই তো আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই। আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পড়ে আছি। তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিও ঠিক ঠাক। কালু ভুলু কে ইস্কুলে পাঠিও? তুলি কে ব্রজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইও। তুমি একটা শাড়ি কিনো। বাবার জন্য একটা ধুতি। দাদার একটা ঘড়ির সখ! তা কি ও টাকায় কুলোবে?

আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। সোনার দুল গড়িয়েছি। একদিন কি হলো জানো মা? আকাশ খুব মেঘ জমে ছিল। দিনের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনের মধ্যে হঠাত কেমন কেমন করে উঠলো! দুপুর বেলায় চুপি চুপি বেড়িয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। ইস্টিশনে মেনে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিক্সা! খুব ইচ্ছে হলো একবার আমাদের, …তোমাদের পুকুরটা দেখে আসি। রথতলার মোড়ে আসতেই করা যেনো চেঁচিয়ে উঠলো-

…কে যায়? কে যায়? দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা। আমাকে বললো, হারামজাদী, কেন ফিরে এসেছিস? আমি ভয় পেলে বললাম, ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি …একবার শুধু দেখতে এসেছি। হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্য মাগী। কী করে জানলো বলো তো, তা কি আমার গায়ে লেখা আছে ? আর এক ছেলে, চিনি না, বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম! হাবুল রিকশাওয়ালা কে চোখ রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা। আমি বললাম, দাদা, দাদা আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি। আর তুলির জন্য… দাদা টেনে একটা চড় কষলো আমার গালে। আমাকে বিক্রির টাকা হকের টাকা আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা। দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর। আমাকে ও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।

আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি। দাদা তো ঠিকই করেছে, আমি তো আর দাদার বোন নই, তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই। আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে। না, না আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো, গরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক, পুকুরে মাছ হোক, ক্ষেতে ধান হোক, ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক। আর কোনদিন ঐ গ্রাম অপবিত্র করতে যাবো না।

আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি, দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি, আলমারি ভর্তি কাচের গেলাস। বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি। এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে। তাহলেই বুঝছো, কেমন আরামে আছি আমি?

আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা। তোমার আরও ছেলেমেয়ে আেছ, আমি আর মা পাবো কোথায়? সেই জন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা। তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে, তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল। যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা… তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো, তুলিওকে যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়। যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিও, ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ। আর যদি কোনোরকমই ওর বিয়ে দিতে না পার? ওকে বলো, গলায় দড়ি দিয়ে মরতে, মরলে ও বেঁচে যাবে …মা। মরলে ও বেঁচে যাবে।

      না পাঠানো চিঠি