বরকতের সঙ্গে লাঞ্চ করার কথা ছিলো

বরকতের সঙ্গে আমার দুপুরে লাঞ্চ করার কথা ছিলো।
খুব ভোরে বেরিয়ে যাবার সময় হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেছিলো,
শাদাভাতের সাথে আলুভর্তা আর গরম ডালের সুস্বাদু ঘ্রাণ
ফাল্গুনের মগ্ন বাতাস ছড়িয়ে দেবে ঢাকা শহরে। আমি মিছিল শেষ
করে চলে যাবো নবাবপুর রোডের শাহী রেস্তোরাঁয়। আকাশে
ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের আনাগোনা আর কলাভবনের চারপাশে পুলিশের
বেষ্টনী দেখে আমি বলেছিলাম, পকেটে বর্ণমালার বই নিয়ে ঘুরছি,
বিপদ হবে না তো? বরকত আমার সামনেই কলম দিয়ে একটা বর্ণ
এঁকে দিয়েছিলো বিশাল আকাশজুড়ে, রাস্তার কালো পিচের ওপর,
এসএম হলের সামনের দু’পাশের রাস্তার বিশাল বিশাল বৃক্ষের
পাতায় পাতায় তার কলম থেকে ঝরে পড়ছিলো উদ্বাস্তু অক্ষর, যেন
মায়াহীন-ছায়াহীন ভাষার বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মতো বন্দি বাংলা ভাষার
আর্তনাদ আছড়ে পড়ছিলো কারাগারের দেয়ালে। আমি বলেছিলাম,
দুপুরে দেখা হবে। টিউশনি সেরে ভাঙা রাস্তায় রিকশার আওয়াজ
শুনতে শুনতে আমি পেঁৗছে গিয়েছিলাম শাহী রেস্তোরাঁর দরোজায়।
কিন্তু মালিক বন্ধ শার্টার উঁচু করলো, যেন হাঙরের মুখ খুলে গেলো
অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, তারপর বিবর্ণ ফ্যাকাশে চোখে আমার দিকে
তাকিয়ে বললো, দোকান বন্ধ, শোনেন নি কিছু? আমার বুক পকেটে
তখন বাংলা বর্ণমালার লাফালাফি আর তীব্র চিৎকার আমাকে উপুড়
করে ফেলে দিলো রাস্তায়। ফাল্গুনের হলুদ বাতাস আমার কানের
কাছে ফিসফিস করে বলে গেলো, বরকত নেই। রক্তের স্রোত ভিজিয়ে
দিলো আমার পা, আমার হাত, আমার জামায় ছড়িয়ে পড়লো বাংলা
বর্ণমালার নানান অক্ষর। তারপর হঠাৎ করেই ওরা মুক্ত পাখির মতো
উড়তে থাকলো আকাশে। ঢাকা মেডিকেলের কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে
আমি ছুটতে থাকলাম সামনের দিকে, গরুর পালের মতো একদল
পুলিশ আমাকে তাড়া করলো প্রিজন ভ্যানে তোলার জন্য, রাইফেলের
গুলির ভেতরেও আমি দিব্যি পেঁৗছে গেলাম ইমার্জেন্সির বারান্দায়।
আলুভর্তা আর গরম ডালের সুস্বাদু ঘ্রাণ বাতাস থেকে মুছে গেলো
বারুদের গন্ধে। আমি তৃষ্ণার্ত বরকতের মুখের কাছে খুলে দিলাম
পদ্মা-মেঘনার থই থই জলরাশির বাঁধভাঙা মুখ।