লজ্জা

EidOutputআমার খুব রাগ হয় বাবার ওপর। বাবার পরনে এক অদ্ভুত পোশাক। যেন জোব্বা একটা, নীল রঙের। আগের চেয়ে স্বাস্থ্য অনেক ভালো হয়েছে। মাথায়ও কখনো এমন ঘন চুল ছিল না। মুখেও বেশ ভারিক্কি চালের হাসি। এই সব কিছু মিলিয়ে বাবাকে আমি চিনতে পারি না। তাই দেখে বাবার হাসি যেন বেড়ে যায়—কী রে, তুই চিনতে পারছিস না আমাকে? আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকি। আহা, বলবি তো। চিনতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? বাবাকে চিনতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা না। তাহলে অমন মুখ করে আছিস কেন? তোমার একি চেহারা বাবা! এ রকম রংচঙে পোশাক তুমি কখনো পরতে না। অবশ্য তোমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। বিশ্রাম, বুঝেছিস বাবু, খুব বিশ্রামে আছি। আর ভালো ভালো খাবার…। আগে ভালো ভালো খাবার জুটত না তোমার? না না, তা কী করে বলি! তোর মা কি কম করত…। এখন খুব আনন্দে আছ, না বাবা? তা বলতে পারিস। বাবা হেসে মাথা দোলায়। শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। খুব বেশি দিন হয়নি। বছর দেড়েক হলো বাবা আমাদের সঙ্গে নেই। বাবার তখনকার চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন পড়তাম ক্লাস সেভেনের শেষদিকে। সুতরাং তখনকার সব কিছু আমার মনে থাকারই কথা। আমার অবাক লাগে এই ভেবে, এই মাত্র দেড় বছরে বাবা এতটা বদলে গেছে! বাবা কি জানে না, এখনো তার কথা আমার কতটা মনে হয়! আমি মুখ নিচু করে থাকি। তাই দেখে বাবা বোধ হয় কিছু আন্দাজ করতে পারে। বলে, আমি আনন্দে আছি শুনে তোর কি মন খারাপ হয়ে গেল, বাবু? আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বলি, না, মন খারাপ হবে কেন! বোঝাই যাচ্ছে, আমার ওপর খেপেছিস তুই। কী আশ্চর্য বাবা! তোমার ওপর আমি কেন খেপতে যাব? তুমি ভালো আছ শুনে আমার তো ভালো লাগারই কথা, তাই না? বাবা একটু হাসে—কিন্তু বাবু, তুই কি এটা বুঝতে পারছিস না, তোকে ছাড়া আমার পক্ষে আসলেও ভালো থাকা সম্ভব না। তাহলে তুমি অমন রঙিন পোশাক পরেছ কেন বাবা? তোমার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেছে…। এটা কি খারাপ? এই যে আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে… না না, আমি তা বলছি না। এটা তো বরং ভালো খবরই…। আসলে বাবু, তুই তো আমাকে সেই অনেক দিন ধরে দেখেছিস বিছানায় পড়ে থাকা রোগে ভোগা অসুস্থ মানুষ হিসেবে। এখন তো সেভাবে দেখছিস না, তাই তোর মনে হচ্ছে আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আসলে তা নয় রে। আর এই যে জোব্বা পরেছি একটা—জোব্বা পরতে খুব আরাম রে। নীল রঙের কথা বলছিস?…আমার তো মন ভালো থাকে না রে। আমি নীল রং পরে মন ভালো রাখতে চাই।…আমার ওপর এখন আর রাগ নেই তো তোর? আমি একটু লাজুক হাসি হাসি—না বাবা, তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। তোদের ছেড়ে থাকতে আমার এতটুকু ভালো লাগে না। বাবা, তুমি কি মনে করো আমাদের ভালো লাগে? বুঝি, সব বুঝি আমি।…তুই এমনিতে ভালো আছিস তো? আছি বাবা, এই তো, আছি এক রকম। তোর মা, তোর মা ভালো আছে? ভালোই তো দেখি বাবা। তবে মা এত গম্ভীর থাকে মাঝেমধ্যে, বোঝা যায় না। বাবা একটু হাসার চেষ্টা করে—সেটাই স্বাভাবিক।…তোর মাকে এত জ্বালিয়েছি আমি। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বোকার মতো একটু হাসি। বাবা একটু ইতস্তত করে—একটা কথা বাবু…না, থাক।…ঠিক আছে, এটা আর এমন কী ব্যাপার, বলেই ফেলি।…তোর হাফিজ চাচা, এখনো তোদের খোঁজখবর নেয় তো? আমি বুঝতে পারি, বাবা আসলে বলতে চাচ্ছে হাফিজ চাচা এখনো নিয়মিত আমাদের বাসায় আসেন কি না। কী বলব, আমি বুঝতে পারি না। বাবা কেন এই প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তা-ও তো আমার জানা। আমিও বাবার মতো একটু ইতস্তত করে বলি, আসে বাবা, হাফিজ চাচা মাঝেমধ্যে আসে। বাবা বিড়বিড় করে বলে, হাফিজ খুব ভালো, হাফিজ খুব ভালো। ও না থাকলে এখন তোদের খুব অসুবিধা হতো। এই যেমন ধর, এই ফ্ল্যাটেই বোধ হয় তোদের আর থাকা হতো না, ছেড়ে দিতে হতো। আর শুধু এখানকার কথাই বলি কেন! তুই দ্যাখ, সেই কবে থেকে, আমার অসুখের সময় থেকে কত কী-ই না করেছে হাফিজ…। তুই ছোট ছিলি, তোর সব মনে থাকারও কথা নয়।==== আমার মনে আছে বাবা। বাবা একটু হাসে—তাহলে তো ভালোই হলো। জীবনে বাবু, উপকারীর উপকার মনে রাখতে হয়। তুই যেন কখনো হাফিজের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না। না বাবা, করব না। আমি হেসে ফেলি। এ কথা বাবা কেন বলে তা-ও আমার জানা। আমি একবার হাফিজ চাচার দিকে অ্যাশট্রে ছুড়ে মেরেছিলাম। সে প্রায় বছর দুয়েক আগের কথা। বাবার মনে আছে দেখে আমার একটু অবাকও লাগে। অবশ্য কিছু কিছু লোক আছে, যারা কিছুই ভোলে না। বাবাও কখনো কিছু ভুলত না। মা কোন দিন কেমন শাড়ি পরেছিল, বহু দিন পরও বাবা সেটি বলে দিতে পারত। আর এই শাড়ি নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়েছিল বাবার সঙ্গে। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন থেকে বাবা বিছানায়। তবে তখন মাঝেমধ্যে উঠে ঘরে পায়চারি করত, মাঝেমধ্যে বাইরে যেত। চাকরিটা তখনো ছিল। তবে বছরখানেকের মধ্যে বাবার বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গেল। বাবা তখন বিছানা ছেড়ে প্রায় উঠতেই পারত না। চাকরিও আর নেই। বাবা সারা দিন বাসায় থাকত, বিছানায়। মাঝেমধ্যে উঠে চেয়ারে বসত, মিনিট কয়েকের জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াত, এই এটুকু। আর তখন দিনে দুই প্যাকেট সিগারেট খেত বাবা। মা এ নিয়ে খুব রাগারাগি করত—ওই চোঙা ফুঁকে কী যে আরাম পাও। …সারা জীবন চোঙা ফুঁকেই তো গেলে। বাবা কিছু না বলে হাসার চেষ্টা করত। কথা বলছ না কেন? আর কয় দিনই বা আছি বলো! চোঙা যখন ফুঁকছি, ফুঁকেই যাই। আর কয় দিনই বা আছি—এ কথা তো বলছ অনেক দিন হলো, যাচ্ছ না তো। যাব, বাবুর মা, যাব। আর বেশি দিন নেই, আমি বুঝতে পারি। যদি সত্যিই বোঝো, তবে সিগারেটের পেছনে পয়সা নষ্ট না করে বাবুর জন্য রেখে যাও। বাবুর জন্য তুমি থাকলে বাবুর মা। আমি তো কারো জন্যই কিছু করতে পারলাম না। নিজের ভালো পাগলও বোঝে। তুমি বোঝো না। তুমি পাগলও নও। আমি একটা ছাগল, বাবুর মা। এসব আজেবাজে কথা বোলো না। তোমার অনেক আজেবাজে কথা আমি শুনেছি। আর শুনব না। এসব কথা বলতে বলতে সেদিন বাবা-মার ছোটখাটো একটা ঝগড়া বেধে যায়। বাবা দুর্বল শরীরে খুব একটা চেঁচাতে পারে না, কিন্তু মা খুব চেঁচায়। বাবা তার ওপর এ জীবনে কত অত্যাচার করেছে, তার ফিরিস্তি দেয়। পাশের ঘরে বসে এসব শুনতে শুনতে মায়ের ওপর আমার খুব রাগ হয়। ইচ্ছা হয়, পাশের ঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলি—মা, তুমি বাবাকে অত অত কথা শুনিয়ো না। মাকে অবশ্য আমার কিছুই বলা হয় না। কারণ আমি যতই যা ভাবি না কেন, আমি নিজেও জানি মাকে আমার কখনো কিছু বলা হবে না। মা বাবার সঙ্গে যতই কঠিন কঠিন কথা বলুক না কেন, আমাকে ভালোবাসে খুব। আমার কিসে ভালো হবে, কী খেতে আমার ভালো লাগে, কোন জিনিসটা আমার কখন দরকার—এসব দিকে তার কড়া নজর। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয়, মা বাবাকেও খুব ভালোবাসে। মা কখনো বাবার ওপর রাগ করে না, রাগ করে বাবার অসুখের ওপর। আর বাবার অসুখটা যে ভালো হবে না, এ জন্যও তার রাগ। এ সবই আসলে বাবার প্রতি তার ভালোবাসা থেকে। সেদিন বাবা-মার যখন ঝগড়া চলছে তখন হাফিজ চাচা আসে। হাফিজ চাচা বাবার কলিগ। অবশ্য এভাবে বলা ভালো, বাবাই হাফিজ চাচার কলিগ ছিল। এখন চাকরি নেই বাবার, চাকরির সুবাদে পাওয়া এই ফ্ল্যাট তাই ছেড়ে দিতে হতে পারে। এ অবস্থায় হাফিজ চাচা প্রায় আসে, যেন আমাদের সান্ত্বনা দিতে—না, ভয়ের কিছু নেই, সব ঠিক আছে। অবশ্য ফ্ল্যাট একটা মা-ও পেতে পারে! বাবা রেলওয়ে স্টাফ ছিল, মা রেলওয়ে স্কুলেরই টিচার, ভূগোলের। তবে মা এত বড় ফ্ল্যাট কখনো পাবে না, বাবার সঙ্গে তুলনায় মার চাকরিটা বেশ ছোট। তা ছাড়া এ ফ্ল্যাট ছাড়া, অন্য ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পাওয়া, সেটার দখল পাওয়া—এসব খুব ঝামেলার। অনেক সময় নাকি বছরের পর বছর ঝুলে থাকতে হয়। এসব অবশ্য আমি তখন বুঝতাম না, বড়দের মুখে শুনতাম শুধু। সে যাক, হাফিজ চাচা যখন ঘরে ঢোকে তখন মা-বাবা দুজনই চুপ। তবে এত বেশি চুপ, হাফিজ চাচা ঠিকই বুঝে নেয় কিছু একটা হয়েছে। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বলে—আপনারা কি আবার ঝগড়া করেছেন কালাম ভাই? বাবা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। ভাবি। হাফিজ চাচা বলে। কী নিয়ে লেগেছে আজ আপনাদের? লাগল আর কোথায়! একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে…কেউ যদি শখ করে মৃত্যুকে ডেকে আনে তাহলে আমার আর বলার কী আছে। সে কথা শুনে বাবা তখনই আরেকটা সিগারেট ধরায়। এটা কি আপনার উচিত হচ্ছে কালাম ভাই? ভাবি তো ভুল কিছু বলেনি। তুমি কথা বোলো না, তুমি চুপ করে থাকো। ঠিক আছে, আমি চুপ করে থাকছি। …বাবু বাবু। হাফিজ চাচা গলা তুলে আমাকে ডাকে। আমি খুব অনিচ্ছা নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াই। এদিকে আসো, আমার কাছে। হাফিজ চাচা ডাকে। তার হাতে দুটি প্যাকেট। একটা খুলতে খুলতে বলে—এই নাও, এটা তোমার শার্ট। পরে দ্যাখো তো ঠিক হয়েছে না কি! না হলে বদলে আনতে হবে।…আর ভাবি, এটা আপনার শাড়ি।…দ্যাখেন পছন্দ হয় কি না। আমি ব্যাচেলর মানুষ, শাড়িটাড়ির ব্যাপার বুঝি না। হাফিজ চাচা আরেকটা প্যাকেট এগিয়ে দ্যায় মার দিকে। মা তখনই প্যাকেটটা খুলে ফেলে—বাহ, সুন্দর তো! আমিও খুলব না খুলব না করে প্যাকেট থেকে শার্টটা বের করে আনি। বাবা একটু হাসে—এসব আবার এনেছ যে? ঈদ এসে গেল না! হাফিজ চাচাও হাসে। সে হাসি অবশ্য বোকার মতো। আচ্ছা, ঈদ এসে গেল!…তা, ঈদ শুধু ওদের দুজনের জন্য এলো, আমার জন্য এলো না! আমার জন্য কিছু আনোনি যে? ভুলে গেছ, না ইচ্ছা করেই আনোনি? হাফিজ চাচা থতমত খেয়ে এমন ভাবে হাসে, যেন বাবা খুব একটা মজার কথা বলেছে। কথা বলছ না কেন! আমি তো ইয়ার্কি মারছি না, সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি। ঠিক আছে কালাম ভাই। হাফিজ চাচা হেসে হেসে বলে। কাল আপনার জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি নিয়ে আসব। অপেক্ষায় তো আছ কাফনের কাপড় কেনার। বাবা মৃদু গলায় বলে।…তোমার ভাবির জন্য শাড়ি কিনেছ কেন? বললাম না ঈদ এসে গেছে।…আর না আসুক ঈদ, ভাবির জন্য একটা শাড়িও কি আমি কিনতে পারি না? আর কটা দিন অপেক্ষা করলেই পারতে। আমি তো বেশি দিন নেই, তারপর না হয়…। হাফিজ চাচা গম্ভীর গলায় বলে—কালাম ভাই, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। বাবা কী যেন বলে, হাফিজ চাচা উত্তর দ্যায়, মা হাফিজ চাচার পক্ষ নেয়। এই সব মিলে আবার এক ঝগড়া বেধে যায়। আমি সব কথা বুঝি না, তবে মার হাফিজ চাচার হয়ে কথা বলতে দেখে আমার খুব খারাপ লাগে। আর একসময়, যখন দেখি বাবা অবাক হয়ে বলে—হাফিজ, তুমি এই কথা বললে? তখন আমার আর মাথা ঠিক থাকে না। আমি টেবিলের ওপর থেকে অ্যাশট্রে তুলে নিয়ে হাফিজ চাচার দিকে ছুড়ে মারি। সেটা হাফিজ চাচার কপালে গিয়ে লাগে। ঘরের সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ঝগড়া থেমে যায়। আমি আবার বলি—না বাবা, ওরকম আর করব না। হ্যাঁ, করিস না। হাফিজ খুব ভালো ছেলে। এ কথা তো একবার বললে বাবা। আবার বলছি। হাফিজের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করবি। আমি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলি—আমি খারাপ ব্যবহার করি না বাবা, ভালো ব্যবহারও না। বাবাও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে—তোর মার কথা বলার কোনো লোক নেই বাবু। একটা লোক কি কথা না বলে থাকতে পারে? হাফিজ এলে ওর একটু কথাটথা বলার সুযোগ হয়…। আমি হাসি—থাক বাবা, এসব কথা আমাকে বলার দরকার নেই। থাকবে?…থাক তাহলে, তুই যখন বলছিস। হাফিজ চাচার কথা বলার জন্য তোমার আসার দরকার নেই বাবা। তুমি যখন আসবে তখন আমরা অন্য কথা বলব, বুঝেছ? বাবা একটু হাসে—ঠিক আছে, তা-ই হবে।…আমি তাহলে এখন যাই। যাবে?…ঠিক আছে। আমারও স্কুলে যাওয়ার সময় হলো। বাবা হাসিমুখে মিলিয়ে যায়। আমারও যেন ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায়। আমি বিছানায় উঠে বসি। এ রকম স্বপ্ন দেখলাম, এত বড় স্বপ্ন কেন দেখলাম এই নিয়ে আমার এতটুকু ভাবনা হয় না। কারণ এ রকম স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। বাবা এসে আমার বিছানার পাশে বসে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে অনেক গল্প করি। এ কথা মাও জানে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আসলে বাবাকে আমি স্বপ্নে দেখি না। আধো ঘুমের মধ্যে বাবাকে কল্পনা করে নিয়ে আমি আসলে নিজের সঙ্গেই কথা বলি। ছোট একটা আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে আমি বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ি। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় স্কুল। অন্যান্য দিন ১১টায়। আজ বৃহস্পতিবার, স্কুল হাফ, আরম্ভও আগে। অবশ্য আমার খুব একটা তাড়াহুড়ো করারও কিছু নেই। স্কুল এই রেলওয়ে এলাকার বাউন্ডারির ঠিক বাইরে। হেঁটে যেতে পনেরো-বিশ মিনিট, আমাদের শর্টকাট রাস্তা আছে। রিকশায় গেলেও অবশ্য ওই পনেরো মিনিট। কারণ তখন বড় রাস্তা ধরে ঘুরে যেতে হয়। গোসল সেরে আমি বাথরুম থেকে বেরোই। পোশাক পাল্টে একদম তৈরি হয়ে তারপর ঘর থেকে বের হই। আমাদের এ ফ্ল্যাটে তিনটা রুম। তিনটা রুম আমাদের লাগে না। আমি তো ড্রইংরুমেই শুতে পারি, মার ঘরে মা, ব্যস, এই তো। আশপাশের অনেকেরই এ নিয়ে খুব চোখ টাটায়। কারো হয়তো আমাদের মতোই ফ্ল্যাট, কিন্তু ফ্যামিলি মেম্বার সাত-আটজন। আবার সি বা ডি টাইপের ফ্ল্যাট যেগুলো, সেগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। দেড়টা-দুটো করে ঘর; কিন্তু ওসব প্রতি ফ্ল্যাটেই ছ-সাতজন লোক থাকে। আর আমরা দুজন আছি তিন রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে, অনেকের খারাপ তো লাগবেই। মার চাকরি বিচার করলে আমাদের যাওয়া উচিত সি টাইপের ফ্ল্যাটে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে নোংরা নোংরা কথাও শুনতে হয় আমাকে। আমাদের সঙ্গেই পড়ে ইকবাল। ওর বাবার চাকরিও তেমন বড় নয়। থাকে সি টাইপের ফ্ল্যাটে। তবে ওদের ভাইবোনের সংখ্যা অনেক। খুব কষ্ট হয় ওদের, দু-এক দিন গিয়েই বুঝেছি। এমনিতে ইকবালের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ নয় আমার। অথচ ও-ই কিনা একদিন আড্ডায় বসে হঠাৎ করে বলে—তোরা কিছু কপাল করে এসেছিলি বাবু। কপাল মানে! আমি অবাক হয়ে যাই। এমন কী হলো যে কপালের কথা বলছিস! অত বড় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আছিস। ও, এই কথা! আমি একটু হাসি। তা, কী আর করা যাবে বল? হ্যাঁ, কী আর করা যাবে…আড়াইজন মানুষের জন্য অত বড় ফ্ল্যাট…। আড়াইজন মানুষ মানে? আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই, আড়াইজন মানুষের কথা কেন বলছে ইকবাল! আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। তখন একবার ভাবি, চেপে যাব। কিন্তু আমার রাগও হয় খুব। আমি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করি—আমাদের বাসায় তুই আড়াইজন মানুষ কোথায় দেখলি ইকবাল? এই তুই, তোর মা আর হাফিজুর রহমান সাহেব। হাফিজুর রহমান সাহেব কি আমাদের বাসায় থাকেন? সে জন্যই তো আড়াইজন বলছি। হাফিজ সাহেব আসেন-যান, আসেন-যান, তাই হাফ। ইকবালের কথা শুনে অনেকেই হেসে ওঠে। কেউ কেউ একটু অপ্রস্তুত হয়। যেমন শামীম। শামীম আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ও কঠিন চোখে ইকবালের দিকে তাকায়—তোদের বাসায় কি কেউ যাওয়া-আসা করে না? অনেকেই। ইকবাল নির্বিকার গলায় বলে। তোদের বাসায় কতজন লোক, সে হিসাবের সময় তোরা ওই লোকদেরও গুনিস? তা কেন গুনব! হাফিজ সাহেবের মতো পার্মানেন্ট গেস্ট আমাদের কেউ নেই। তুই খুব নোংরা ছেলে ইকবাল। আমি বলি। আমার সত্যিই খুব নোংরা লাগছিল ইকবালকে। ইকবাল হাসে—এটা আর নতুন কথা কী, সত্যি কথা যে বলে সে নোংরাই হয়ে যায়। তুই আর কখনো আমাকে হাফিজ চাচার কথা বলবি না। হুঁ, কতজনের মুখ তুই বন্ধ করতে পারবি? মুখ বন্ধ করতে যাব কেন? মুুখ বন্ধ করার কী হয়েছে? ইকবাল হাসে—কিছুই হয়নি। কী আবার হবে!…তুই-ই জানিস কিছু হয়েছে কী হয়নি। আমার ইচ্ছা করে এক চড়ে ইকবালের সব কটা দাঁত ফেলে দিতে। এমনভাবে চড়টা মারতে হবে, যেন ওর সব দাঁত পড়ে যায়, আর ও যেন হাসতেও না পারে আর কোনো দিন। কিন্তু চড়টা মারা হয় না। আমার কান্না পায়। খাবার টেবিলে মা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে—কী রে, রাতে ঘুম হয়নি? চোখ-মুখ অমন ফোলাফোলা? মার হাসিটা এত সুন্দর! দেখলেই ভালো লাগে। আমার মনে হয় মার ওই হাসি দেখলে অনেক মানুষই দুঃখকষ্ট ভুলে যাবে। মার দিকে তাকিয়ে আমিও একটু হাসি—না মা, ঘুমিয়েছি। বাবাকে স্বপ্নে দেখেছিস? মা আবার হাসে। মা কী করে অনুমান করল! আমি অবাক হয়ে যাই। অবাক হচ্ছিস? বাবাকে স্বপ্নে দেখলেই তোর চেহারা ওরকম হয়ে যায়। আমি হাসি—হুঁ, বাবাকে দেখলাম। কী বলল তোকে? সে কত কথা…। মা একটু হেসে যেন আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকে। তোমার কথাও বলল…। হুঁ, কী বলল? এই, তুমি কেমন আছ,…তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছে, এসব। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, একটু আনমনাও হয়ে যায়—তোর বাবা খুব ভালো মানুষ ছিল রে। আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি—হাফিজ চাচার কথা জিজ্ঞেস করল। মা একটু চমকে যায়। সেটা সামলে নেওয়ার জন্যই তড়িঘড়ি করে বলে—তাই? হ্যাঁ, বলল, হাফিজ চাচা খুব ভালো, হাফিজ চাচা না থাকলে আমাদের খুব অসুবিধে হতো…। তা একটু হতো। মা নিচু গলায় বলে।…ডিম নে, তুই যে কিছুই খেতে চাস না। সারা দিন তুমি শুধু খাই খাই-ই করো। এত কি খাওয়া যায়! হুঁ, পাখির মতো একটা শরীর বানিয়ে রেখেছিস। …ওজন কত রে তোর? কম না। সবাই বলে ঠিকই আছি, শুধু তোমার চোখেই…। তোর বাবারও এই এক অভ্যেস ছিল। আমি কিছু বললেই তার উল্টোটা বলা। আমি হাসি—তুমি কি আমার সঙ্গে বেরোবে, মা? হুঁ, সময় তো হয়ে গেছে।…আবার তোর হাফিজ চাচার আসার কথা ছিল। এখন? আমি ইচ্ছা করেই অবাক হওয়ার ভান করি। হুঁ, আসার কথা অবশ্য আরো আগে।…খুব জরুরি কাজ, বুঝেছিস? বুঝেছি। আমি ছোট করে বলি। মা হেসে বলে—স্বপ্নে তোর বাবা ঠিকই বলেছে। তোর হাফিজ চাচা না থাকলে সত্যিই আমাদের অসুবিধে হতো। হ্যাঁ, অসুবিধে হতো। আমি বলি। তারপর আর কোনো কথা বলি না। আমাদের রেলওয়ে কলোনির একেক টাইপের বিল্ডিংগুলো আলাদাভাবে বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা। আমাদের বাউন্ডারির মধ্যে মোট চারটা বিল্ডিং। একেবারে শেষ বিল্ডিং, চার নম্বরে থাকে শম্পারা। আমরা ওকে বলি গেছো! কেউ কেউ বলে মর্দানি, মরদ থেকে মর্দানি। ও নাকি ছেলে হতে হতে হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। চেহারায় বা শরীরে নয়, স্বভাব-চরিত্রে। একদম ছেলেদের মতো হাবভাব। ও যে মেয়ে একটা, ক্লাস এইটে পড়ে, এসব যেন ওর নিজেরই খেয়াল থাকে না। ওদের বিল্ডিং আর বাউন্ডারি ওয়ালের মাঝখানে একটা পেয়ারাগাছ আছে। প্রায়ই দেখি, ওই পেয়ারাগাছে কিংবা বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর উঠে বসে আছে। ওর মা ঠিক সুস্থ না, মানসিক রোগী, আরো সহজ করে বললে, অর্থাৎ সোজাসুজি বললে—পাগলী। বড় কোনো ভাইবোনও নেই ওর। ছোট এক বোন আছে অবশ্য। সুতরাং শম্পাকে শাসন করার বা সামাল দেওয়ার কেউ নেই। ইচ্ছা হচ্ছে তো স্কুলে যাচ্ছে কিংবা যাচ্ছে না, সারা দিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, একে-ওকে পিত্তি জ্বালানো সব মন্তব্য করছে। আমার সঙ্গে ওর সব সময় লেগেই আছে। সুযোগ পেলেই ও আমার পেছনে লাগে। মাঝেমধ্যে এমন নোংরা সব কথা এত অবলীলায় বলে যে কান গরম হয়ে যায়। অবশ্য আমিও ছেড়ে দিই না। বাসা থেকে বেরিয়ে বড় গেট দিয়ে বের হলে আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রিকশা নিতে হবে। কিন্তু রিকশার পয়সা বাঁচাই আমি, স্কুলে হেঁটে যাই। সে জন্য আমাকে বের হতে হয় চার নম্বরের বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে। ওখানে বাউন্ডারি ওয়ালের কিছুটা ভাঙা। ওটা আসলে আমরাই ভেঙে নিয়েছি নিজেদের সুবিধার জন্য। আমি ওই ফাঁক গলে বেরিয়ে যাই, ওখান থেকে স্কুলে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা ধরি। চার নম্বর বিল্ডিং হাতের বাঁ পাশে রেখে ঘুরতেই পেয়ারাগাছ। দেখি, শম্পা ওই পেয়ারাগাছের ওপর উঠে বসে আছে। আমাকে দেখে ছোট একটা পেয়ারা ছুড়ে মারে—লালটু বাবু, আপনি কি স্কুলে যাচ্ছেন! শম্পা আমাকে প্রায় কখনোই নাম ধরে ডাকে না। কখনো লালু বলে, কখনো লালটু, কখনো রাঙা মুলো। ওর বক্তব্য, আমার যে চেহারা তাতে নাকি এই নামগুলোই মানানসই। প্রথম প্রথম শুনলে আমার খুব রাগ হতো। এখন শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে, শম্পা কী নামে আমাকে ডাকল, সেটাকে আর গুরুত্ব দিই না। আমি বলি—খুব যে গাছের ওপর উঠে বসে আছিস গেছো, তোর কি স্কুল নেই? আজ বৃহস্পতিবার। হাফ-ডে। হাফ-ডেতে আমি স্কুল করি না। তা-ও ঠিক। তুই যদি রোজ স্কুল করিস, তবে আর মর্দানি করবে কে! এ রকম কথা শম্পার সঙ্গে আমার প্রায়ই হয়। ও বলে, আমিও বলি। কিন্তু আজ হঠাৎ করে শম্পা খেপে যায়—আমি মর্দানি করি? আমি মরদ? তুই, তুই কী? তুই লালটু, রাঙা মুলো না শালা, তুই একটা মাগি। আজ থেকে তোকে আমি মাগি বলেই ডাকব। শুনে আমার কান গরম হতে আরম্ভ করে। শম্পা নোংরা কথা বললে আমিও বলি বটে। তবে একটা পর্যায় পর্যন্ত, তারপর আর ওর সঙ্গে পারি না। এই এখন যেমন, শম্পা এমন অবলীলায় আমাকে ‘মাগি’ বলে, আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে চুপ করে যাই। তবে কিছু একটা বলা দরকার, অন্তত কম্প্রোমাইজ করার জন্য হলেও, আমার মনে হয়। কারণ শম্পার যে স্বভাব, আমি ঠিক জানি, ও ঠিক সবার সামনেই আমাকে এই নতুন নামে ডাকতে আরম্ভ করে দেবে। হয়তো দুদিনের মধ্যে এলাকার সব লোক জেনে যাবে, আমার নতুন ‘নাম’ হয়েছে। সে নামে আড়ালে কিংবা পেছন থেকে ডাকবেও হয়তো কেউ কেউ। এখন কিছু একটা বলা দরকার শম্পাকে। কিন্তু কী বলব ঠিক বুঝতেও পারি না। শেষে বোকার মতো একটু হাসি আমি—বেশ ভালোই তো হলো, তুই মরদ আমি মাগি। এখন আমরা দুজন দুজনকে বেশ খ্যাপাতে পারব। শম্পা হাসে—আমাকে তোর মতো বোকা পেয়েছিস নাকি? তুই যে মাগি, আজকের মধ্যে এটা শহরের অর্ধেক লোক জেনে যাবে, খেয়াল রাখিস। ধেৎ পাগলী, তোর যে কী সব কথা একেকটা! পটাতে আসিস না। আমি যেটা বলেছি সেটা করে ছাড়ব। আমার রাগ হয়, বুঝি শম্পাকে নরম কথা বলেও কোনো লাভ নেই। এখন বরং একে কিছু গরম কথা বলে যদি ভয় খাওয়ানো যায়। আমি তাই খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলি—তুই আবার কী করবি রে, তুই আমার ইয়ে করবি। ঠিক আছে ইয়েই করব আমি। তবে তোর ইয়ে নয়। তোর তো ইয়েই নেই। দেখবি, আছে কী নেই? দেখবি মর্দানি? একথায় শম্পার কিছু হয় না। ও বরং হাসে—বাচ্চাদের ইয়ে রাস্তায় ঘুরলেই দ্যাখা যায়। হারামজাদি, তোকে ধরে এমন একদিন দেব না! একদিন কেন, এখনই দে না! নাম, গাছ থেকে নাম, দ্যাখ, দিই কি না। শম্পা একটু ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে থুতু ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে। আমি সরে এসে বলি—আরে মর্দানি, খেয়াল কর, কামিজের ভেতর দিয়ে তোর ইয়ে দেখা যাচ্ছে। শম্পা অপ্রস্তুত হয় না, তবে সোজা হয়, ত্যাড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে—যাক না দ্যাখা। দ্যাখা গেলে কী হয় রে? বাচ্চারা দেখলে কিছু হয় না। বাজে কথা বলবি না শম্পা, বাজে কথা বলবি না। হাফিজ চাচা তোদের বাসায় দিনের মধ্যে দশবার আসে কিসের জন্য রে? সেটা তোকে বলতে হবে? না। তুই নিজেকে বল। তাহলেই বুঝতে পারবি তুই মরদ না মাগি। আমি আর কিছু বলতে পারি না। আমার শুধু রাগ হয়, খুব রাগ। শম্পা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে—আমার সঙ্গে লাগতে আসিস না বাবু। তোকে আমি একদম ন্যাংটা করে ছেড়ে দেব। বাজে কথা বলিস না তো! আমি বলি। খেয়াল রাখিস, তার আগে তোকে ন্যাংটা করব আমি। সাহস থাকলে এখনই কর না। চল সিঁড়ি ঘরে ঘাই। দেখি কে পারে। অপেক্ষা কর, সময় হোক। দেখবি পারি কি না। আমি বলি, তারপর আর দাঁড়াই না। ক্লাসে আমার মন বসে না। আজ ক্লাস মোটে তিনটে। আরেকটা ক্লাস আছে বটে, তবে ওটাকে আমরা ক্লাস বলি না। ওটা হলো ইসিএ বা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ। প্রথম দুটি ক্লাস কোনোমতে পার হয়ে যায়। তৃতীয় ক্লাসে এসে স্যারের হাতে ধরা খাই। এ ক্লাসটি হামিদ স্যারের। স্কুলে তাঁর টাইটেল পাগল। স্যার নিজেও সেটি জানেন। স্যার বোধ হয় বারকয়েক লক্ষ করেন আমি অন্যমনস্ক। একসময় জিজ্ঞেস করেন—বাবু, মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের পার্থক্য বলো তো! আমি প্রথমে স্যারের প্রশ্ন শুনতে পাই না। স্যার দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেন। আমি এমনভাবে উঠে দাঁড়াই, যেন এটা কোনো প্রশ্ন হলো? এটা তো এই এখনই বলে ফেলব। কিন্তু আমি পারি না। এই অতি সামান্য একটা প্রশ্ন, তার উত্তরও আমি দিতে পারি না। ফ্যাল ফ্যাল করে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী হলো বাবু, চুপ করে আছ কেন? বলো। মৌলিক পদার্থ হলো স্যার মৌলিক…। পাগল খেপিয়ো না বাবু। মৌলিক পদার্থ হলো।… বসো। স্যার হাঁপায়। আমার উচিত তোমার মতো গর্দভকে এই মুহূর্তে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া। যে মৌলিক আর যৌগিক পদার্থের পার্থক্য জানে না, তার ক্লাসে থাকার কোনো যুক্তি নেই, থাকতে পারে না। আমি ভয় পাই। স্যার কি এখন আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেবেন? স্যার অবশ্য তা করেন না, বলেন—তোমাকে অবশ্য ক্লাস থেকে বের করে দেব না। কারণ আমি জানি, তুমি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের পার্থক্য জানো। জানো না? আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়াই, মাথা ঝাঁকিয়ে স্যারকে জানাই, জানি আমি। তোমার কি মন খারাপ? আমার এবার কান্না পায়। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলি—জি, স্যার। মন খারাপ অবস্থায় কখনো ক্লাসে আসবে না। ওতে লাভ হয় না কোনো। আমি আজ কি পড়িয়েছি তার কিছুই তুমি শোনোনি। কী লাভ হয়েছে তোমার? মাঝখান থেকে আমার মেজাজ খারাপ করেছ। ক্লাসের বাকি সময়টুকু আমি গুম হয়ে বসে থাকি। হামিদ স্যারও আমার দিকে আর ফিরে তাকান না। ক্লাস শেষ হলে শামীম উঠে আসে এককোণ থেকে। পাশে বসে খুব সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে—তোর কী হয়েছে বাবু? আমার কিছু হয়নি শামীম। আমি রেগে যাই। তোকে কে বলল আমার কিছু হয়েছে? তুই-ই বললি। এই এখনই বললি। মানে? তুই কখনো আমার সঙ্গে এভাবে রেগে রেগে কথা বলিস না। এখন কোনো কারণ ছাড়াই বলছিস। সুতরাং ওই একটাই হতে পারে—তোর কিছু হয়েছে। স্যারকে বললাম, তখন শুনিসনি আমার মন খারাপ? আমি রাগ রাগ গলায় বলতে যাই, কিন্তু একটু হেসেও ফেলি। সে হাসি অবশ্য আমার মন ভালো করতে পারে না। ইসিএ স্যার চলে এলে শামীমও আর থাকতে পারে না আমার পাশে। ক্লাসে আমাদের প্রত্যেকের সিট নির্দিষ্ট করা। আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো যেখানে-সেখানে বসতে পারি না। আমার পাশে যে ছেলেটি বসে তার নাম বাহার। খুব সরল আর ভালো ছেলে। কিন্তু ওর মুখে গন্ধ, নিশ্চয়ই লিভারের গোলমাল কিংবা পাইওরিয়া আছে। ওর সঙ্গে অধিকাংশ সময়ই আমি অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলি। এভাবে আর কতক্ষণ কথা বলা যায়! বাহারের সঙ্গে আমার বেশি কথা কখনো হয় না। ইসিএ ক্লাসে আসলে কিছুই হয় না। ছাত্রদের অন্যান্য দিকে উৎসাহী করে তোলার জন্য এ ক্লাসের ব্যবস্থা। এ ক্লাসে কেউ হয়তো গান গাইবে, কেউ আবৃত্তি করবে, কেউ কৌতুক বলবে, কেউ অভিনয় করবে কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু ওসব কখনো কখনো হয় বটে কিছু কিছু, অধিকাংশ সময় হয় গল্পগুজব। স্যারও যেন সেটা করতেই ভালোবাসেন। কাউকে হয়তো জিজ্ঞেস করেন—আজ তোদের বাসায় কী বাজার হয়েছে রে? কিংবা অন্য কাউকে—তোদের দেশের বাড়ি কোথায়? তোরা কয় ভাইবোন? আমার এই গল্পগুজবই ভালো লাগে। কিছু কিছু খুব উৎসাহী ছেলে আছে বটে, তারা চায় ক্লাসের আর সব ছাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করবে বা ক্যারিকেচার, কারো কারো আবার গল্প শোনানোর ইচ্ছা। সাধারণত ক্লাস টিচাররাই নেন এ ক্লাসটা। আজ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়েন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। আমরা অবাক হই, তটস্থও হই। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার সেটি বোঝেন। তাই আমাদের আশ্বস্ত করার জন্যই যেন বলেন—এই তোমাদের দেখতে এলাম।…একটু দেখি তোমাদের কার কোন দিকে উৎসাহ। ক্লাসের উৎসাহী ছেলেদের মধ্যে কী যে এক সাড়া পড়ে যায়! যে কিছুই পারে না, সে ছেলেটিও কিছু করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বেশ একটা অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে যায়। কেউ আবৃত্তি করে, কেউ কৌতুক বলে, কেউ অভিনয় করে দ্যাখায়, কেউ গান গায়। স্যার কখনো গম্ভীর, কখনো হাসিমুখে সেসব শোনেন। আমি খুব মজা পাই। একেকজনের কী অবস্থা, যেন গান গেয়ে বা আবৃত্তি করে স্যারকে খুশি করার ওপরই ম্যাট্রিকে ভালো রেজাল্ট করা নির্ভর করছে। আমি যে খুব মজা পাচ্ছি, এটা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার বোধ হয় টের পেয়ে যান। একজনের অভিনয় শেষ, আরেকজন যাবে আবৃত্তি করতে, তার আগে স্যার আমার দিকে ফেরেন—তোমার নাম বাবু না? আমি তখনই উঠে দাঁড়াই—জি স্যার। তুমি আসো তো, তুমি একটা গান গাও। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কী হলো বাবু? আমি তোমাকে গান গাইতে বলছি। আমি স্যার…আমি স্যার গান গাইতে… জানো না? কিন্তু আমি শুনেছি তুমি খুব সুন্দর গান গাও। আমি বুঝতে পারি না, আমি গান গাই—এ কথা কে জানিয়েছে স্যারকে। আমি গান গাই সত্যি, কিন্তু এ কথা কেউ জানে না, মা ছাড়া কেউ জানে না। আমার এত প্রিয় বন্ধু শামীম, ওকে পর্যন্ত কখনো জানতে দিইনি। অথচ এ কথা কিনা পৌঁছে গেছে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যারের কানে! স্যার আবার আমাকে ডাকেন। আমি না তাকিয়েই টের পাই ক্লাসের সব ছেলে আমার দিকে বলতে গেলে হাঁ করেই তাকিয়ে আছে। আমি কী করব বুঝতে পারি না। আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এভাবে মরে যাওয়া যায় না। আর অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার ডাকলে না গিয়েও পারা যায় না। আমি মুখ নিচু করে হেঁটে যাই, মুখ নিচু করে গান গাই, লালনগীতি। লালনগীতিই আমার ভালো লাগে। গান শেষ হলে শুনি হাততালি আর হাততালি। আমার লজ্জাটা একটু একটু করে কেটে যায়। অবশ্য গান যখন গাইতে আরম্ভ করেছিলাম, তখনই লজ্জা কেটে গিয়েছিল কিংবা গানের মধ্যে এমন নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, ওসব লজ্জাটজ্জা কিছু টের পাচ্ছিলাম না। আমি সিটে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই স্যার আমাকে থামান—শোনো বাবু। আমি থামি, পেছনে ফিরে তাকাই। তুমি সত্যিই খুব সুন্দর গান গাও। আমি আবার লজ্জা পাই। হাফিজ আমাকে ঠিক কথাই বলেছিল। আমি বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে যাই। স্যার হাসেন—তোমার হাফিজ চাচা, বুঝেছ, তোমার হাফিজ চাচার কাছ থেকেই তোমার গানের কথা শুনেছি। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে আমি বহুদূর চলে যাব। এমন কোথাও চলে যাব, যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না। কাউকে এ কথা জানানোর প্রয়োজনও নেই। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া তো আর কাউকে বলে যাওয়ার ব্যাপার নয়। তা ছাড়া আমার বলারই বা আছে কে! বলা যায় মাকে, অর্থাৎ যদি বলতেই হয়, তবে মা-ই শুধু; আরো যদি কাউকে জানাতেই হয়, তবে সে হচ্ছে শামীম। এই তো এ দুজনই। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো রাতে আমার কে জানে কেন, খুব কান্না পায়। কোনো কোনো রাতে আমি কাঁদতে কাঁদতে বালিশও ভিজিয়ে ফেলি। এখন মনে হয়, এই শেষ রাত, এ বাড়িতে এই আমার শেষ রাত। সকালবেলা উঠে আমি বেরিয়ে পড়ব। সঙ্গে কিচ্ছু নেব না, খালি হাতে আমি চলে যাব নিরুদ্দেশে, আমাকে কেউ আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না, শুধু আমিই জানব আমার খোঁজ। কোনো কোনো মাঝরাতেও আমার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। অভ্যেস হয়ে গেছে, তবু কোনো কোনো রাতে ট্রেনের হুইসেলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কান পাতলে বুঝতে পারি, ট্রেন যাচ্ছে, যাচ্ছে বহুদূর। মনে হয়, হ্যাঁ, এই এখনই ছুটে গিয়ে আমি কোনো রাতের ট্রেনে উঠে পড়ি। রাতের ট্রেন আমাকে নিয়ে যাক, আমাকে নিয়ে যাক যেখানে ইচ্ছা। মনের কোনো ঠিক নেই। কখনো দুপুরবেলা মন খারাপ হয়ে যায়, কখনো বিকেলবেলা কিংবা কখনো কোনো সন্ধেয় আমার আর কিছু ভালো লাগে না। আমার শুধুই মনে হয়, সবাই আমাকেই দেখছে, আড়চোখে। আমি হেঁটে গেলে সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে আর ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কী বলছে সবাই ফিসফিস করে, তা তো আমার জানাই। সবার আড়চোখে তাকানো আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি আমাকে ছোট করে দ্যায়, শুধুই ছোট করে দ্যায়। আমি কি সত্যিই একদিন চলে যাব কোথাও? এমন কোনো জায়গায়, যেখানে কেউ আমার দিকে আড়চোখে তাকাবে না কিংবা ফিসফিস করবে না নিজেদের মধ্যে? এমন কোথাও চলে যাব, যেখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে না—এক ক্লাস ছেলের সামনে স্যারের মুখ থেকে শুনতে হবে না—তোমার হাফিজ চাচার কাছ থেকেই তোমার গানের কথা শুনেছি? ক্লাসে, আমার গানের পর কে কী করে, আমি কিছুই দেখি না। বাহার প্রায় কানের কাছে মুখ এনে বলে—তুমি একদিন খুব বড় শিল্পী হবে। আমি চুপ করে থাকি। তুমি যেভাবে তন্ময় হয়ে গান গাইছিলে…বড় শিল্পী ছাড়া ওভাবে কেউ গান গায় না। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। এখনো তুমি চুপ করে আছ। অর্থাৎ ওই গানের রেশ তোমার ভেতর এখনো আছে, তাই না? এবার আমার হাসি পায়। আমি হেসে ফেলি। ক্লাস শেষ হয়ে যায় মিনিট দশেক পরে। শামীম বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে আমার পাশে এসে বলে—কী করবি এখন? আমার এ জন্যই শামীমকে এত ভালো লাগে। ও ঠিকই বুঝেছে আমার মন খারাপ। নইলে, এখন কী করব, তা জিজ্ঞেস করার কোনো কারণ নেই। আমরা স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠে বসেই অনেকটা সময় পার করে দিই। ফুটবলের সময় ফুটবল খেলি, ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট কিংবা হকি-ব্যাডমিন্টন। এসব না হলেও নিদেনপক্ষে ‘টিলো—এক্সপ্রেস’ বা ‘রেস্কু’ খেলা হয় আর যেদিন স্কুল হাফ, সেদিন তো কথাই নেই! নিজেদের মধ্যেই ফুটবল ম্যাচ খেলি কিংবা ‘বি’ সেকশনের সঙ্গে। ওরা কখনো আমাদের সঙ্গে কোনো খেলায় পারে না। আমি অবশ্য খেলাধুলায় তেমন সুবিধার নই। ক্রিকেট—তা-ও মোটামুটি খেলতে পারি, তবে ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ি ফ্যাসাদে। হয়তো দ্যাখা গেল সাধারণ কোনো ল্যাঙ কিংবা ধাক্কা খেয়ে আমি চিৎপটাং। আমার ভালো লাগে টেবিল টেনিস খেলতে। স্কুলে কেউ পারে না আমার সঙ্গে। তবে টেবিল টেনিস তো আর দলবেঁধে খেলা যায় না। সুতরাং মাঠেই নামতে হয়। খেলোয়াড় হিসেবে না হলেও অন্তত কোনো না কোনো দলের সাপোর্টার হিসেবে। কিন্তু এখন যে আমার ওসব কিছুই ভালো লাগবে না, এটা শামীম বুঝেছে। আমি শামীমের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করি—করব কিছু একটা, এখনো ঠিক করিনি। তুই কী করবি? শামীমও হাসে—আমিও ঠিক করিনি কী করব। আমরা দুজনই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। শামীমই আবার বলে—চলো, মাঠেই বসি। আমার আসলে এখন একটু একা থাকার ইচ্ছা। অনেক সময় এমন হয়, সবচেয়ে প্রিয় যে তাকেও সহ্য হয় না। এখন যেমন আমার মনে হচ্ছে, শামীম পাশে থাকলে আমার যতটা ভালো লাগবে, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগবে ও যদি পাশে না থাকে। আমি অবশ্য মুখ ফুটে সেটি ওকে বলতে পারি না—মাঠে বসবি? যে ভিড়…! চল, এক কোণে বসি। এক কোণে বসলে নিরিবিলি থাকা যাবে। চল। আমি একটু ইতস্তত করে বলি। মাঠের এক কোণে বসলে নিরিবিলি অবশ্য ঠিকই থাকা যাবে। কারণ আমাদের মাঠটা খুবই বড়। স্কুল বিল্ডিং থেকে নেমে মাঠের একদম শেষদিকে হেঁটে যেতে যেতে দেখি, ইতিমধ্যেই দুটি দল হয়ে গেছে আমাদের আর ক্লাস টেনের ছেলেদের নিয়ে। কেউ কেউ জানতে চায় শামীম খেলবে কি না। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। শামীম দুর্দান্ত খেলে। সবাই বলে, ও যদি খেলা চালিয়ে যায়, তবে ঢাকার ফার্স্ট ডিভিশনের কোনো দল ওকে ডেকে নেবে। শামীম অবশ্য বলে দ্যায়, এখন খেলবে না ও, পরে সাবস্টিটিউট খেলোয়াড় হিসেবে নামলেও নামতে পারে। আমরা মাঠের শেষ কোণে গিয়ে বসি। বই-খাতা পাশে রেখে শামীম পা দুটি সামনে টান টান করে দ্যায়। আমি পা মুড়ে বসে একটা ঘাসের ডগা টেনে তুলে চিবোতে আরম্ভ করি। শামীম বলে—তোর মন খারাপ, না? শামীমের ওপর রাগ হয় আমার। তুই যদি বুঝতেই পারিস আমার মন খারাপ, তবে কেন আর ও কথা জিজ্ঞেস করিস? আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। তোর খুব ঘন ঘন মন খারাপ হয়। শামীম বলে। ঘন ঘন মন খারাপ হলে কী করব আমি। আমি এ রকমই…। কোন দিন যে আবার কবিতা লিখতে আরম্ভ করে দিবি! মন খারাপ হলে মানুষ বুঝি কবিতা লেখে? তা তো জানি না। তাহলে বললি যে বড়ো! শামীম হেসে ফেলে। আবার একটুক্ষণ চুপ থেকে বলে—বাবু, তুই আমাকেও কথাটা বলিসনি! আমি খুব অবাক হয়ে শামীমের দিকে তাকাই—তোকে আবার কখন কী বলিনি? তুই এত সুন্দর গান গাস, আমাকে কখনো বলিসনি। ধেৎ, সুন্দর কোথায়! এ রকম গান কত কে গায়! শামীম মাথা নাড়ে—না রে, গানের মধ্যে কী কী সব ব্যাপার আছে—তাল, সুর, লয়—এসব আমি একদম বুঝি না। কিন্তু তোর গান শুনতে তো আমাদের খুব ভালো লেগেছে। আমি একটু হাসার চেষ্টা করি—হয়েছে কী, আমি কোনো গুরুত্বই দিই না এটাকে, তাই তোদের বলা হয়নি। কিন্তু তোর হাফিজ চাচাকে ঠিকই বলেছিস। আমি বলিনি। আমি গম্ভীর গলায় বলি। আমি হাফিজ চাচাকে বলেছি, এটা তোকে কে বলল? তাহলে কে বলেছে তাকে? হাফিজ চাচা জানলেন কী করে? আমি চুপ করে থাকি। আমি তো জানিই কে বলেছে হাফিজ চাচাকে। মা ছাড়া আর কেউ নেই এ কথা বলার। কিন্তু সে কথা আমার শামীমকে জানাতে ইচ্ছা করে না। আমি হালকা গলায় বলি—কে আর বলবে, বাসায় আসে তো মাঝেমধ্যে, তখন বোধ হয় হঠাৎ শুনে ফেলেছে…। এক কাজ কর বাবু। তুই মাস্টার রেখে গান শেখ। রামগোপাল স্যারকে বল। তোর মাথায় কি ভূত চেপেছে? মাস্টার রেখে গান শিখব আমি! আমি ইয়ার্কি মারছি না বাবু। আমি সত্যি সত্যি বলছি। আমি চুপ করে থাকি। মাস্টার রেখে গান শিখতে আমার কি ইচ্ছা করে না? আমার সেই কত দিনের ইচ্ছা খুব নামকরা গায়ক হওয়ার। আর কোনো ইচ্ছা নেই আমার, ভালো ছাত্র হওয়ার ইচ্ছা নেই, ভালো টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছা নেই, আমার ইচ্ছা এই একটাই। কিন্তু এ-ও তো আমি জানি, জীবনের সব ইচ্ছা কখনো পূরণ হয় না। আর আমার জন্য পূরণ হওয়া তো আরো কঠিন। বাবা নেই আমার, সবার বাবা আছে, আমার নেই। মা স্কুল থেকে কয় টাকাই বা বেতন পায়! আমাদের সংসারই ঠিক ঠিক চলতে চায় না। এর ওপর আবার মাস্টার রেখে গান শেখা! রামগোপাল অনেকগুলো করে টাকা নেয়। আমি সত্যি কথাটাই বলি শামীমকে—তুই তো জানিস শামীম, মাস্টার রেখে গান শেখার মতো টাকা আমাদের নেই। মার বেতনে আমাদের সংসারই চলে না। তুই একটা কাজ করলে তো পারিস। শামীম খুব উৎসাহ নিয়ে বলে। কী করব? লেখাপড়া বাদ দিয়ে গান শিখব? আরে না, শোন। হাফিজ চাচা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যারকে তোর গানের কথা বলেছেন—মানে বোঝাই যাচ্ছে, তিনি তোর গান খুব পছন্দ করেন। তুই হাফিজ চাচাকে বল না তোর জন্য গানের মাস্টার রেখে দিতে! আমি এত অবাক হই শামীমের কথা শুনে, যেন বুঝতেই পারি না কী বলেছে ও। পরমুহূর্তে আমি ভীষণ খেপে যাই—কেন, কেন আমি হাফিজ চাচাকে বলব? কে, হাফিজ চাচা কে আমার? তুই, তুই…। শামীম বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে—তুই রেগে যাচ্ছিস কেন বাবু? তুই, তুই আমার বন্ধু শামীম। তুইও আমাকে আর সবার মতো যা ইচ্ছা বলবি! বাবু, তুই বিশ্বাস কর বাবু, আমি সত্যি অন্য কিছু ভেবে বলিনি। আমি উঠে দাঁড়াই, বই-খাতাগুলো তুলে নিই—থাক, এখন আর সাধু সাজতে হবে না। শামীম উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে আমাকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আমি ওর হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় দৌড়াতে আরম্ভ করি স্কুলের গেটের দিকে। বেশ অনেকটা পথ আমি হন হন করে চলে আসি। আমার থামতে ইচ্ছা করে না, আমার মনে হয় এভাবে যেতে যেতে আমি কোথাও না কোথাও ঠিক ঠিক পৌঁছে যাব। কিন্তু আমার একসময় থামতেই হয়, আমার মনে হয়, এভাবে কোথাও কখনো পৌঁছানো যায় না। তবে এখন যাব কোথায়, সে ব্যাপারেও আমাকে এতটুকু ভাবতে হয় না। কিছু দূরেই আমার এক প্রিয় জায়গা আছে। ওটা রেলওয়েরই জায়গা। রেলের অনেকগুলো পরিত্যক্ত বগি আর দু-একটা নষ্ট ইঞ্জিন ওখানে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক নির্জন বলা যায় না। কারণ ঘরবাড়ি নেই—এমন বেশকিছু লোক ওই বগিগুলোকে তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। কিছু আজেবাজে ধরনের লোক আর মেয়েও থাকে ওদিকে। আমার মতো কেউ ওদিকে প্রায় যায় না বললেই চলে। তবে আমার ওই জায়গাই পছন্দ। ওর মধ্যেই আমি একটু নিরিবিলি জায়গা বের করে নিই। আমার বসার জন্য ওখানে আসলে একটা জায়গা নির্দিষ্টই আছে। একটুক্ষণ আমি থেমে থাকি। তারপর ঠিক করি, হ্যাঁ, ওখানেই যাব। পকেটে হাত দিয়ে দেখি পাঁচটা টাকা আছে। পাঁচ টাকায় যতগুলো হয়, সিগারেট আর দেশলাই কিনি। তারপর হাঁটতে আরম্ভ করি ওদিকে। জায়গাটার নাম কলসভাঙা। খুব মজার নাম। কে জানে কেন এমন অদ্ভুত নাম। হয়তো এখানে কোনো দিন কলসি ভাঙা হতো। ধেৎ, পরমুহূর্তে আমার মনে হয়, তাই কি হয় নাকি কখনো! এদিকে আসতেও একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। আমি সে রাস্তা ধরে হেঁটে মিনিট পনেরো পর পৌঁছে যাই সেখানে। পরিত্যক্ত বগিগুলো খুব এলোমেলো করে ছড়ানো-ছিটানো। আমি সেগুলো পার হয়ে পৌঁছে যাই আমার জায়গায়। একটি বগি উল্টো হয়ে আছে। উল্টো হয়ে আছে বলেই বোধ হয় এখানে কেউ সংসার পাতেনি। আমি ওই উল্টো হয়ে থাকা বগির গায়ে হেলান দিয়ে বসি। আমার সামনেই একটা পুকুর। পুকুরটা অবশ্য বড় নয়, ছোট। আর পানিও খুব অপরিষ্কার, কালচে, শ্যাওলা-জমা। কিন্তু আমার খারাপ লাগে না। আমি বগিতে হেলান দিয়ে বসে কিছুক্ষণ অনেক দূর তাকিয়ে থাকি। তারপর খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটা সিগারেট ধরাই। প্রথম টানের পরই আমি কাশতে আরম্ভ করি। আমি বুঝি না, মানুষ কেন যে সিগারেট খায়! পয়সা খরচ করে মার কথায় এই চোঙা ফোঁকার কোনো মানে হয়! মুখের ভেতর কেমন বিস্বাদ হয়ে যায়, তেতো তেতো লাগে, গলার ভেতর খুক খুক করে। মানুষ এত কষ্ট করে কেন খায় সিগারেট! নিজেকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কী! আমি অবশ্য এখন সিগারেট খাবই। সিগারেট খেতে খেতে আমি শ্যাওলা-জমা, কালচে পানির পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকি। বাবার কথা মনে হয়। যদি এমন কোনো দিন হতো, বাবা শুধু স্বপ্নে নয়, সত্যি সত্যিই একদিন এসে হাজির হলো! এসে বলল—বাবু, আমাকে চিনতে পারছিস তো? কী যে তুমি বলো না বাবা! আমি তোমাকে চিনতে পারব না কেন? না, অনেক দিন হলো তো।…এখন একটা কাজ করতে হবে, বুঝেছিস। বলো, কী কাজ করতে হবে। তার আগে বল, তুই কেমন আছিস? আছি বাবা, এই তো আছি, তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ। তোর মা কেমন আছে? আছে, ভালোই আছে বলে মনে হয়। হুঁ। আর হাফিজের খবর কী? এখনো রোজ আসে? আসে মানে! তুমি জানো না আসে কী আসে না? হাফিজকে পেটাতে হবে। পেটাতে হবে? আমি বুঝতে পারি না। হ্যাঁ, পেটাতে হবে। হারামজাদাটা পেয়েছে কী? ওর ঠ্যাং ভেঙে দেব আমি। সত্যি বাবা? আমি আছি তোমার সঙ্গে। তবে কাজটা করতে হবে গোপনে। কেউ যেন বুঝতে না পারে আমরা ওর ঠ্যাং ভেঙেছি। জানি, বাবা আর কোনো দিন আসবে না, সেটা কখনো সম্ভব না। সুতরাং হাফিজ চাচার ঠ্যাং ভাঙার প্রশ্নও উঠছে না। কিন্তু আমার মনে হয়, অতসব কল্পনা করার কী দরকার? আমি তো এমনিতেই হাফিজ চাচার ঠ্যাং ভেঙে দিতে পারি। এটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার না। প্রায়ই হাফিজ চাচার রাতে ডিউটি থাকে। আমি যদি তক্কে তক্কে থাকি, তবে ঠিকই কোনো রাতে লাঠির বাড়ি দিতে পারব হাফিজ চাচার পায়ে। অন্ধকারে আর আড়ালে থেকে পেছন থেকে কাজটা যদি করি আর তার পরপরই দৌড়ে চলে যাই, তবে হাফিজ চাচা বুঝতেও পারবে না কে করেছে কাজটা। আমি অবশ্য শাহাবুদ্দিনকেও বলতে পারি। শাহাবুদ্দিনকে সবাই ‘টেরর শাহাব’ বলে ডাকে। এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে থাকে। কলেজে পড়ে, আমার চেয়ে মাত্র বছর তিন-চারেক বড় বোধ হয়; কিন্তু ওর কথা সবাই শোনে। এই পুরো এলাকায় ওর এমন দাপট, ও যা বলবে তা-ই হবে। পুলিশ ওর কিছুই করতে পারে না। খুব শক্ত ব্যাকিং আছে। এই শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে গোলমাল হয়েছিল। শাহাবুদ্দিন আমাকে চিনত না জানত না; কিন্তু ও-ই আমাকে বাঁচিয়েছিল। তারপর আরো কয়েকবার ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখে। মুখেও বলেছে সেটা—তুই আমার ছোট ভাই, বুঝেছিস বাবু! তোর যখন দরকার হবে, আমার কাছে চলে আসবি। কিছু ভাববি না, দরকার হলেই চলে আসবি…। এখন আমি যদি শাহাবুদ্দিনের কাছে যাই আর ওকে বলি, হাফিজ চাচার পা ভেঙে দিতে হবে, তবে কি ও না করবে? উঁহু, কখনো না; হয়তো খুনই করে ফেলবে। শুধু যদি বলি যে হাফিজ চাচা আমার মাকে খুব জ্বালাতন করে। এটুকু বললেই নিশ্চয়ই বুঝে নেবে। ও তো জানেই আমার বাবা নেই। বলব শাহাবুদ্দিনকে? হ্যাঁ, বলব, আমি ঠিক করি; তবে এখনই নয়, আরো কটা দিন যাক। ঠিকই বলব আমি। ঠ্যাং ভেঙে হাফিজ চাচা বিছানায় পড়ে থাকবে। আমাদের বাসায় আর আসতে হবে না। আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। এটা আরো তেতো তেতো আর বিস্বাদ লাগে। একবার তো বমিই হতে নেয়। কিন্তু আমি সিগারেট ফেলি না। যত কষ্টই হোক আমার, সব সিগারেট শেষ করে আমি তারপর উঠব। সিগারেট টানতে টানতে আমার শম্পার কথাও মনে হয়। শম্পা আজ খুব বাজে কথা বলেছে, খুব বাজে কথা। ওকে আমার কিছু একটা করতে হবে। তবে ওর লজ্জা-শরম নেই তো, মুখে কিছু বলে হবে না। ওকে ধরে সত্যিই একদিন ওর জামাকাপড় সব খুলে ফেললে তবে বুঝবে কেমন লাগে! আল্লা মালুম, তাতেও ওর শিক্ষা হবে কি না, লজ্জা পাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য শম্পার ওপর যতই রাগ হোক আমার, আমি এটাও বুঝি যে ও আসলে খুব একটা মিথ্যা কথা বলেনি। খুব একটা কেন—আসলে কোনো মিথ্যাই তো ও বলেনি। ও তো বলতেই পারে কেন হাফিজ চাচা দিনের মধ্যে দশবার আসে আমাদের বাসায়। সত্যিই তো, আমি যদি নিজেকেই জিজ্ঞেস করি কেন হাফিজ চাচা এত আসে আমাদের বাসায়, তবে কী হবে তার উত্তর? আমি তো নিজেও জানি না এর উত্তর। অবশ্য জানি না বলাটা ভুল, হাফিজ চাচা কেন আসে, সেটা আমি জানি। কিন্তু সেটা কি আমি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব? পারব না। কারণ সে কথা নিজের কাছেই বলতে আমার ইচ্ছা করে না। কিন্তু শুধু সে জন্যই, আমি ‘মাগি’ হয়ে যাচ্ছি না, যেমন শম্পা বলে। আসলে আমি সেই প্রথম থেকেই দেখছি, শম্পা আমাকে পুরুষ মানুষ হিসেবে গণ্যই করতে চায় না। ওর ধারণা, আমি নেহাতই বোকাসোকা ধরনের শান্তশিষ্ট একটা ছেলে। পরমুহূর্তে আমার আবার মনে হয়—নাকি ও আমাকে খেপিয়ে খেপিয়ে উসেক দিতে চায়? বলা যায় না, আমার মনে হয়, এ রকম হতেও পারে। প্রথম থেকে যদি ওর ভাবভঙ্গি খেয়াল করি, তবে তো মনে হয় ওর এ রকমই ইচ্ছা! ও নিশ্চয়ই আমাকে বাজিয়ে দেখতে চায়। এ রকম মনে হতে আরম্ভ করলে আমি আমার শরীরের মধ্যে এক পরিবর্তন লক্ষ করি। একটু লজ্জা যে আমার লাগে না, তা নয়। তবে আমার ভালোও লাগে খুব। এত দিন এ ব্যাপারটা মাথায় কেন আসেনি, তার জন্য নিজেকে একটু বোকাও মনে হয় আমার। ঠিক আছে, আমি একটু হাসি, এখন থেকে দেখা যাবে। তবে তার আগে আমাকে অবশ্য নিশ্চিত হতে হবে। তারপর যদি নিশ্চিত হই, ও আমাকে উসেক দিয়ে দেখতে চাচ্ছে, অর্থাৎ মজা করতে চাচ্ছে, তবে আমারও আপত্তি নেই কোনো। কাল থেকে ওকেও আমার বাজিয়ে দেখতে হবে। অবশ্য শম্পার চিন্তাটা মনে কিংবা শরীরে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বরং হাফিজ চাচার ব্যাপারটাই আমাকে আবার ব্যস্ত করে তোলে। বাসায় আসে আসুক, দিনের মধ্যে দশবার আসুক, এখন আর এটা নিয়ে আমার মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করে না। লোকজনের আড়চোখে তাকানো, নানা রকম মন্তব্য—সব আমার সহ্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কোনো দরকার নেই তার। আমি গান গাই, তাতে তার কী! আমি কি তার জন্য গান গাই নাকি! গান কি এতই সস্তা। আশ্চর্য, আবার আমার গান গাওয়ার কথা কিনা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যারকে পর্যন্ত বলেছে! যেন আমি তাঁকে বলার জন্য অনুরোধ করেছি। কী ভাবল ক্লাসের অতগুলো ছেলে! ওরা কি ভাবল না—আমি হাফিজ চাচাকে ঘরে বসে গান শোনাই? তবে এখানে মার দোষ আরো বেশি। আমি কোনো দিন হাফিজ চাচার সামনে গান গাইনি। হাফিজ চাচা বাসায় থাকলে আমি অন্য ঘরে বসে গুনগুন পর্যন্ত করি না। তখন আসলে গুনগুন করারও ইচ্ছা হয় না। অস্থির অবস্থায় থাকলে কি গান গাওয়া যায়, নাকি যায় গুনগুন করা? সুতরাং হাফিজ চাচা আমার গান শোনেনি। হাফিজ চাচা আমার গানের কথা শুনেছে মার মুখ থেকে। মা এটা একদম ভালো কাজ করেনি। আমি তাকে কখনো বলিনি, হাফিজ চাচাকে ও কথা বলার জন্য। তবে বলতে গেল কেন! আজ জিজ্ঞেস করব, মাকে আজ আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করব। দরকার হলে ঝগড়া করব আমি। আর ঝগড়া করব শামীমের সঙ্গে। নাকি কথা বলাই বন্ধ করে দেব ওর সঙ্গে? শামীমের কথা মনে হলে আমার কান্না পেয়ে যায়। ও নাকি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু! এই তার নমুনা? আমি ঠিক বুঝতে পারি না, শামীম হঠাৎ করে ও কথা কেন বলে! বরং এত দিন ও-ই তো সব সময় ওসব কথা থেকে আমাকে আড়াল করে রাখত। কেউ আমার সামনে হাফিজ চাচাকে জড়িয়ে কিছু বলতে নিলে বা ইঙ্গিত করলে ও-ই খেপে যেত বেশি। আমাকে বলত—এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিবি বাবু। মানুষজনের তো খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই…ওরা সব কে কী বলে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। সেই শামীম আজ আমাকে কিনা বলে, আমি যেন হাফিজ চাচাকে বলি আমার জন্য গানের মাস্টার রেখে দিতে! আমার আবার কান্না পায়। শামীম কি তাহলে আমার সঙ্গে এত দিন অভিনয় করত? কিন্তু আমার সে রকমও মনে হয় না। কারণ অভিনয় বোঝাই যায়। শামীম কখনো অভিনয় করে ওসব করত না, করত মন থেকে। তাহলে আজ ওর ওই কথার কী যুক্তি? নাকি বেখেয়ালে বলে ফেলেছে? সরল মনে বলে ফেলেছে? হতে পারে, আসলে কিছু একটা তো হবেই। কিন্তু অতসব ভেবে দেখতে আমার আর এতটুকু ইচ্ছা করে না। আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না, কিচ্ছু না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। একসময় ঠিক করেছিলাম, রাত করে ফিরব, অনেক রাত করে। মা চিন্তা করবে, মা অস্থির হয়ে পড়বে, মা এদিক-ওদিক খোঁজ নেবে, মা ছটফট করতে আরম্ভ করবে—বেশ হবে। আমার এ রকম মনে হয় বটে। তবে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করাও আমার হয় না। বিকেলের পরপরই এমন খিদে পেতে আরম্ভ করে! তার ওপর খালি পেটে পরপর বেশ কয়েকটা সিগারেট। একবার পানির মতো টক বমি হলে আমি উঠে পড়ি। রাত পর্যন্ত বাইরে থেকে মাকে চিন্তায় ফেলতে পারলাম না, অর্থাৎ ব্যর্থ হলাম বলা যায়। এ জন্য একটু লজ্জা লজ্জা লাগে। তবে সেটুকু আমি ঝেড়ে ফেলতে পারি। এ আর এমন কী, আরেক দিন আরো রাত করে ফিরলেই হবে। তা ছাড়া আমার তো বাড়ি থেকেই পালিয়ে বহুদূরে চলে যাওয়ার কথা আছে। কড়া নাড়লে প্রায় দৌড়ে এসে মা দরোজা খোলে। আমি বাইরে দাঁড়িয়েই বুঝি। আমার কড়া নাড়ার আলাদা ধরন আছে। আসলে শুধু আমার নয়, সবার। যারা মোটামুটি নিয়মিত যাওয়া-আসা করে, একটু খেয়াল করলে দিন কয়েক পর ঠিক বোঝা যায় তাদের কে কড়া নেড়েছে। মা যেভাবে দৌড়ে এসে দরোজা খোলে, তেমনি নিজেকে গুটিয়েও নেয় মুহূর্তের মধ্যে। খামোখা, মার কখনো আমার সামনে এসব কিছু করা উচিত নয়। কারণ মার সব কিছুই তো আমার জানা। মা চেহারা বাইরে যা-ই করুক না কেন, ভেতরে মার কী অবস্থা তা বুঝতে কখনো আমার এতটুকু অসুবিধা হয় না। এই এখন যেমন খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করছে, কিন্তু আমি জানি ভেতরে ভেতরে মার ইচ্ছা হচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরার। তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? মা খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে। আমি চুপ করে থাকি। কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলি—গিয়েছিলাম। জায়গাটার কোনো নাম নেই? থাকবে না কেন—কলসভাঙা। সেটা আবার কোথায়? আমি চুপ করে থাকি। হাফিজ চাচা বলে—আছে ভাবি, ওদিকে একটা জায়গা আছে। কিন্তু জায়গাটা তো ভালো না। বাবু, তুই ওখানে কেন গিয়েছিলি? আমি ওখানে প্রায়ই যাই। মা এভাবে কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়। তাই মার অবস্থা হয় হকচকিয়ে যাওয়া; আমি বুঝি। মা বলে—না বলে এতক্ষণ তুই বাড়ির বাইরে থাকলি! আমাদের চিন্তা হয় না। আমার বলতে ইচ্ছা করে—‘আমাদের চিন্তা’ মানে? চিন্তা হলে তো তোমার একারই হওয়া উচিত। তবে আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। হাফিজ চাচা একটু হেসে বলেন—চুপ করে আছ কেন বাবু? তোমার মা যা জিজ্ঞেস করছেন তার উত্তর দাও। আমার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। আমি কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াই। বাবু! মা কঠিন গলায় বলে। দাঁড়াও। আমার দাঁড়াতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু আমি দাঁড়াই। মা খেপেছে, গলার আওয়াজে বোঝা যায়। হাফিজ ভাই তোমাকে কিছু কথা বলেছেন। বাজে কথা কিছু বলেননি। তুমি না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছ কেন? আমি ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়াই—দুজন মিলে কথা বলার কী দরকার? একজন জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। তাই বলে তুমি কথা বলবে না? থাক থাক ভাবি। হাফিজ চাচা বলে। ওর বোধ হয় মন খারাপ, ভাবি। শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। দাঁত কিড়মিড় করে বলতে ইচ্ছা করে—আমার মন খারাপ কী খারাপ না, তার আপনি কী বোঝেন? আর আমার মন খারাপ কী খারাপ না, তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনও তো দেখছি না। আবার বারবার শুধু ‘ভাবি’ ‘ভাবি’ বলে ডাকা হচ্ছে! এমনিতে যে নাম ধরে ডাকা হয়, সেটা যেন আমি জানি না। আমি যেন পাশের ঘরে বসে সেটা কোনো দিন শুনিনি। বাবু! মা হঠাৎ করে খুব নরম গলায় বলে। মন খারাপ বলেই তুই আমাকে না বলে এতক্ষণ বাইরে বাইরে থাকবি? তুই বুঝতে পারিস না আমার কেমন লাগে? আমার কান্না পায়, আমার বলতে ইচ্ছা করে—তুমিও তো বোঝো না মা, কেন আমার মন খারাপ হয়। তুই আর কখনো এমন করবি না, বুঝেছিস? আমার বলতে ইচ্ছা করে—আমি একদিন একদম পালিয়ে যাব। তোর কিছু হলে আমার কী অবস্থা হবে তা তো তুই জানিস বাবু। আমি মুখ নিচু করে চুপ করে থাকি। আমার কান্না পায়। যা, হাত-মুখ ধুয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি। আমি পা বাড়াতে গিয়ে থমকে যাই। একবার মায়ের দিকে তাকাই, একবার হাফিজ চাচার দিকে, তারপর আবার মায়ের দিকে—মা, তুমি বলেছ? আমি খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করি। মা বুঝতে পারে না। কারণ আমার প্রশ্নটাও ঠিকমতো হয়নি। মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি যে মাঝেমধ্যে গান গাই, এ কথা তুমি কাউকে বলেছ? মা যেন এবারও বোঝে না—তোর, তোর গানের কথা মানে? আমি গান গাই, এ কথা তুমি বাইরের কাউকে বলেছ? মা অবাক হয়—তোর গান গাওয়ার কথা আমি কাকে বলব? আর বললেই বা কী! না, কেন তুমি বলবে? মা আমার রাগের কারণ বুঝতে পারে না। আমি তো তোমাকে বলতে বলিনি। তুমি কেন বলেছ? আশ্চর্য, কাকে বলেছি আমি, কী হয়েছে? আমি গান গাই সেটা আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার জানলেন কী করে? সেটা আমি কী করে বলব? মা অবাক হয়ে গেল। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার বললেন, তিনি নাকি হাফিজ চাচার কাছ থেকে শুনেছেন। আমি আড়চোখে হাফিজ চাচার দিকে তাকাই। হাফিজ চাচা একটু হাসেন—হ্যাঁ বাবু, তোমার স্যারকে আমিই বলেছি। আমার বন্ধু মানুষ তো…। মা, এবার তুমি বলো, হাফিজ চাচা কী করে জানল আমার গানের কথা? মার বিস্ময় কাটে না—জানল কী করে মানে? তোর হাফিজ চাচা জানতে পারে না? তুমি না বললে কী করে জানবে? আমি কোনো দিন হাফিজ চাচার সামনে গান গাইনি। আচ্ছা, তা না হয় আমিই বলেছি, কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী? না, কেন তুমি বলবে? আমি তোমাকে বলতে বলেছি? আর হাফিজ চাচাই বা কেন সেটা স্যারকে বলবে? আশ্চর্য! মা বলে। এটা নিয়ে এত হইচই করার কী কারণ, আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলার আগে হাফিজ চাচা বলে—বাবু, তুমি খুব সুন্দর গান গাও, এটা আমি তোমার মার মুখ থেকেই শুনেছি। কিন্তু তাতে কী হয়েছে বলো? আমাকে তোমার গানের কথা বলে তোমার মা কি ভুল করেছেন? আমি খুব রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাই। কিন্তু কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে আমি চুপ করে থাকি। হাফিজ চাচা আবার হাসেন—কোনো মা কি তার ছেলের গুণের কথা বলবে না? আমি ক্লান্ত গলায় বলি—আমি তো বলতে বলিনি। তুমি কেন বলতে যাবে? নিজের কথা কি কেউ বলে? আমি বলার মতো কিছু না পেয়ে চুপ করে থাকি। তবে আমার রাগ পড়ে না। তোমার মা তো তোমার ভালোর জন্যই বলেছেন। আমার গানের কথা কাউকে বলতে আমার ইচ্ছা করে না। মা একটু হাসে এবার—বাবু, একটা কথা শোন তুই। তোকে অবশ্য আরো কয়েক দিন পর জানানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এখনই বলে ফেলি তোকে। তোর জন্য গানের মাস্টার রাখব বলে ঠিক করেছি। আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকি। সামনের সপ্তাহ থেকে আসবে রামগোপাল বাবু। আমি ভেবেছিলাম, ঠিক আগের দিন তোকে জানাব। আমি কী বলব বুঝতে পারি না। আমার অবিশ্বাস্য মনে হয় ব্যাপারটা। রামগোপালের কাছে গান শিখব, এই ইচ্ছা আমার বহু দিনের। তবে আনন্দ হওয়ার পাশাপাশি আমার সন্দেহও হয়। হঠাৎ করে মা রামগোপালের সঙ্গে কথা বলে বসল! রামগোপালকে মা মাসে মাসে এত টাকা কোত্থেকে দেবে? এ প্রশ্নই আমি করি মাকে—রামগোপালকে মাসে মাসে অনেক টাকা দিতে হবে না? হাফিজ চাচা খুব মুরব্বির মতো করে বলে—তাই বলে কি তোমার গান শেখা হবে না! আমি সে কথা না শোনার ভান করি। মাকে জিজ্ঞাসা করি—টাকা কোথায় পাবে তুমি? সে একটা ব্যবস্থা হবে রে বাবু। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। তুমি কথা বলেছ রামগোপালের সঙ্গে? কথা তাঁর সঙ্গে বলা হয়েছে। সামনের সপ্তাহ থেকে রামগোপাল বাবু আসছেন, এই হচ্ছে কথা। আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ সবই হাফিজ চাচার ব্যবস্থা। আমার আবার নতুন করে রাগ হয়, কী পেয়েছে—করুণা করছে আমাকে? আমি কি তার করুণার পাত্র নাকি? গান শিখতে আমার খুবই ইচ্ছা, কিন্তু তাই বলে হাফিজ চাচা ব্যবস্থা করে দেবে, আর আমি শিখতে আরম্ভ করে দেব! আমি কি ছ্যাঁচড়া ছেলে? তাই ভেবেছে আমাকে? আমি গম্ভীর গলায় বলি—রামগোপালের সঙ্গে কে কথা বলেছে, আমি শুনতে চাই। বারে, তোর হাফিজ চাচা বলেছে…। রামগোপালের বেতনও কি তিনি দেবেন? হাফিজ চাচা আমার রাগ বোঝে। সেটা তরল করার জন্যই যেন হেসে ওঠে—কী আশ্চর্য ছেলে রে বাবা! বেতন কে দেবে সেটা তোমার কেন জানতে হবে! বেতন তোমার মা-ই দেবেন। কিংবা ধরো, যদি আমিই দিই তবে তোমার অসুবিধা কোথায়? তোমার তো গান শেখা নিয়ে কথা। আমরা সবাই চাই তুমি একদিন খুব বড় শিল্পী হবে…। আমি গান শিখব না। আমার গান শেখার কোনো ইচ্ছা নেই। আহা বাবু, তুমি খামোখা…। আর আপনি কোনো দিন আমার গানের কথা কাউকে বলবেন না। আমার ভালো লাগে না। কথা শেষ করে আমি পা বাড়াতে নিলে মা কঠিন গলায় বলে—বাবু! এখন তো আসলে উচিত মার ডাক না শোনা। কিন্তু এটাই পারি না আমি, কখনো পারি না। আর মাও সেটা ভালো করেই জানে। আমি থামলে মা বলে—তুই গান শিখবি বাবু, সামনের সপ্তাহ থেকে রামগোপাল বাবু আসবেন, তুই তার কাছে গান শিখবি।…শিখবি তুই, তাই না? কে জানে কেন, আমার কান্না পায়। আমি চুপ করে থাকি। বাবু, তুই তো জানিস, তোকে গান শেখানোর ইচ্ছা আমার বহু দিনের। তোকে আমি বলেছিও সে কথা। এখন একটা ব্যবস্থা করা গেছে।…তুই যদি এখন রাজি না হোস, আমি খুব কষ্ট পাব বাবু। মা কাতর গলায় বলে—শিখবি না তুই, বল? আমার আবার কান্না পায়। তাই কোনোমতে ‘হুঁ’ বলে আমি আর ওই ঘরে একমুহূর্তও থাকি না। বহু রাত পর্যন্ত আমার ঘুম আসে না। আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। একবার উঠে পড়ার টেবিলে বসে থাকি কতক্ষণ, খামোখাই বই-খাতা উল্টেপাল্টে দেখি। আরেকবার খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। শেষে আবার বিছানায়ই ফিরে আসি। এমন অস্থির লাগে আমার, আর লাগে লজ্জা। হ্যাঁ, লজ্জাই তো। কেন আমি হাফিজ চাচার সামনে স্বীকার করলাম—হ্যাঁ, গান শিখব আমি! হাফিজ চাচা ভেতরে ভেতরে হাসবে না? ভাববে, হুঁ, ভেতরে শেখার ইচ্ছা ষোলো আনা, কিন্তু বাইরে কত ঢং! কিন্তু ওসব তো আসলেও আমার ঢং নয়। ওসব তো সত্যি কথাই। কেন হাফিজ চাচার টাকায় গান শিখতে যাব? তাহলে তো শামীমের কথাই ঠিক হয়ে যায়। শামীমের ওপর তাহলে আমি আর খামোখা কেন রাগ করি! এখন আমার মার ওপর নতুন করে রাগ হয়। ঠিক আছে, না হয় সব ব্যবস্থা হাফিজ চাচাই করেছে, কিন্তু মা তো কথাটা আমাকে একা একা বলতে পারত। তখনো হয়তো ‘না না’ করতাম আমি। তবে শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই রাজিও হয়ে যেতাম। লাভ হতো এটুকু, হাফিজ চাচার সামনে আমাকে লজ্জা পেতে হতো না! এখন হাফিজ চাচাকে আমি তো বোঝাতে পারব না, গান শেখার ইচ্ছার জন্য নয়, আমি রাজি হয়েছি শুধু মাকে ‘না’ বলতে পারি না বলে। আমি ‘না’ বললে, মা কতটা কষ্ট পায় তা আমার জানা আছে। এ-ও আমি জানি, আমাকে নিয়ে মার অনেক স্বপ্ন। এসব তো না জানার কথা নয়, এসব তো বোঝাই যায়। এত সব ভাবনার পাশাপাশি আমার একটু একটু ভালোও লাগে। শেষ পর্যন্ত গান শেখা হচ্ছে আমার? হ্যাঁ, হচ্ছে; এ রকম মনে হলে আমার নিজেরই অবাক লাগে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাই, আমি রামগোপালের সামনে বসে আছি, রামগোপাল আমাকে গান শেখাচ্ছে। তারপর একটু একটু করে এই দৃশ্যটা বদলে যায়। আমি দেখি, আমি বড় হয়ে গেছি, আমি গান গাচ্ছি আর কত লোক তন্ময় হয়ে আমার গান শুনছে। বাবাও যেন কোত্থেকে চলে এসেছে। চাদরে মুখ ঢেকে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। গান শেষ করে আমি বাবার দিকে চলে যাই—আমি কেমন গাইলাম বাবা? তোর গান শুনতে শুনতে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল বাবু। এই দেখ, সত্যি বলছি। তাহলে সত্যিই বলছ তুমি? মিথ্যা বলব, তোকে? আরে, গান পছন্দ না হলে তোকে তো সোজাসুজিই বলে দিতাম—গান শিখিস না তুই। তোকে দিয়ে গান হবে না বাবু।…কিন্তু তোর গান শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, এত সুন্দর করে তুই কিভাবে গাইতে শিখলি! মা ঠিক করে দিয়েছিল, মানে রামগোপালের কাছে…। হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি আমি। তোর মা আর হাফিজ মিলে। ওরা সত্যিই একটা ভালো কাজ করেছে। তুমি বলছ? বলব না কেন? সত্যি কথা বলতে হয়। আমার আবার ভয় ছিল, তুমি আবার রাগটাগ করো কি না…। তুই হাফিজের কথা বলছিস? না রে, হাফিজ তোর জন্য মন থেকেই করেছে। আর মা তো আমাকে খুব ভালো বাসে। তুমি তো জানোই বাবা। জানি জানি। তোর মা তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার চেয়ে বেশি কে জানে! মা, আমিও খুব ভালো করে জানি বইকি, আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। আর আমি, আমি কি ভালোবাসি না মাকে? এ আর বলতে, আমি নিজেই একটু হাসি, আমিও মাকে অনেক ভালোবাসি। তাই মাঝেমধ্যে আমার বহুদূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা হলেও, আমি জানি, সেটা আমাকে দিয়ে বোধ হয় কোনো দিনই হবে না। নইলে নিরুদ্দেশে না হোক, আমি চলেই যেতে পারতাম অন্য কোথাও না কোথাও। বছর দেড়েক আগের সব কথাই আমার মনে আছে। আমাদের আত্মীয়স্বজন খুব বেশি নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমার দাদাবাড়ি কিংবা নানাবাড়ি কোনোটাই নেই। বাবারা এক ভাই এক বোন। বোন, অর্থাৎ আমার ফুপু বড়। দাদার কখনো নিজের বাড়ি ছিল না, থাকতেন ভাড়াবাড়িতে। দেশের বাড়ি ছিল বটে, তবে এখন সেখানে কিছুই নেই। আমি কখনো দেশের বাড়িতে যাইনি। মা-রা দুই বোন এক ভাই। প্রথমে মামা, তারপর মা, তারপর খালা। খালা, মামা, ফুপু একেকজন একেক জায়গায় থাকেন। নানা মারা যাওয়ার পর গ্রামেরই কে একজন মামলা করে নানার সামান্য যে সম্পত্তি ছিল, দখল করে নিয়েছে। আমার খালু পুলিশ অফিসার। কিন্তু তিনিও ওই সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেননি। আমি নাকি খুব ছোটবেলায় একবার নানাবাড়িতে গিয়েছিলাম। তবে আমার কিছু মনে নেই। আত্মীয়স্বজন বলতে আমাদের এই সব। তাদের সঙ্গে দেখাই হয় না প্রায়। তবে বাবা মারা গেলে তারা সবাই আসে। ফুপু-ফুপা, মামা-মামি, খালা-খালু। কুলখানি না হওয়া পর্যন্ত থাকে। তখন তাদের সবারই চিন্তা, এখন আমার আর মার কী হবে। তবে মার চেয়ে সবার আমাকে নিয়েই বেশি চিন্তা। মা ছোটখাটো একটা চাকরি করে, প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা। ওই চাকরির টাকায় আমাদের সংসার কি চলবে? তা ছাড়া সবাই বলে, বাবা ছিল মাথার ওপর ছাতার মতো। এখন ছাতা নেই। এখন আমি রোদে পুড়ব, জলে ভিজব। মার পক্ষে কি আর আমাকে আগলে রাখা সম্ভব হবে? মুরব্বিরা আমার সামনেই এসব আলোচনা করে, আমার জন্যই কিছু একটা করা দরকার—বারবার বলে। শেষে ফুপা বলে মাকে—সালমা, তুমি বাবুকে আমার সঙ্গে দিয়ে দাও। আপনার সঙ্গে দিয়ে দেব মানে, দুলাভাই? বাবুকে মানুষ করা নিয়ে তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না। ওর সব দায়িত্ব আমার। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—তাহলে দুলাভাই, আপনি বলতে চাচ্ছেন, ও এখানে থাকলে মানুষ হবে না? না না, না না, তা আমি কেন বলব! কিন্তু তুমি নিজেই ভেবে দেখো তোমার কত অসুবিধা। এ অসুবিধা আজকের নয়, দুলাভাই। ওর বাবা অনেক দিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। তখন অসুবিধা আরো বেশি ছিল। তুমি বুঝতে পারছ না, সংসারে বাবা একটা ছাতার মতো…। মা বলল, কিসের মতো, দুলাভাই? ফুপা চুপ করে থাকে। আর বাবুকে আপনারা নিয়ে গেলে আমি এখানে একা একা থাকব? তুমি একটা চাকরি করছ সালমা। তোমার একটা কিছু নিয়ে থাকার আছে…। বাবু আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমার আর থাকার কিছুই থাকবে না। তবু তুমি ভেবে দ্যাখো। বাবু আমাদের সঙ্গে গেলে ওরই ভালো হবে। ওর ভালো কী দুলাভাই, আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমি একেবারেই বুঝি না? তুমি বুঝবে না কেন, তুমি বুঝবে না কেন! তুমি আসলে আমার কথাই বুঝতে পারছ না। পারছি।…আপনারা তো বাবুর বাবা বেঁচে থাকতে কোনো খোঁজখবর নেননি। এটা বোধ হয় তুমি ঠিক বললে না। ফুপা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে। আর আসতে না পারি, নিয়মিত চিঠিপত্র লিখে খোঁজখবর নিয়েছি।…তুমি বোধ হয় আমাদের ভুল বুঝেছ, সালমা। না, দুলাভাই। মা নিচু গলায় বলে। ভুল আমি আপনাদের বুঝিনি। তবে বাবুকে নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকারও আমি দেখছি না। বেশ, সেটা তো আসলে তুমিই ভালো বুঝবে। তা ছাড়া তোমার ছেলে তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এখানে তো ওর কোনো অসুবিধা হবে না, দুলাভাই। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জানাতে ভুলো না। ওর বাবা অফিস থেকে পাওয়া কিছু টাকা রেখে গেছে বাবুর জন্য। খুব সামান্য অবশ্য। টাকাটাই সব নয় সালমা, জীবনে আরো সমস্যা থাকে। আমার খেয়াল থাকল, দুলাভাই। তেমন কিছু হলে আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব। আমাকে নিয়ে যেতে চায় মামা, এমনকি খালাও। মামা বলে—তোর কোনো চিন্তা নেই সালমা। না, চিন্তার কী আছে ভাইজান। মা মৃদু গলায় বলে। সে কথাই বলছি আমি। বাবুকে নিয়ে যাব আমি। ওর বয়সী ছেলে আছে আমার। ওরা দুজনে আপন ভাইয়ের মতো বড় হবে। বাবু এখানেও বড় হতে পারবে ভাইজান। তা কি আমি বলেছি পারবে না? কিন্তু নিজের অসুবিধাগুলো দেখবি না তুই? আমার কী কী অসুবিধা তুমি দেখছ, সেটা আগে বলো শুনি। মামা এমনভাবে মুখ খোলে, যেন মা-র অনেক অসুবিধার কথা বলবে। কিন্তু কিছুই বলতে না পেরে আমতা আমতা করতে আরম্ভ করে—না, মানে কত রকম অসুবিধা…। বাবু চলে গেলে আমার অসুবিধা ভাইজান, বাড়বে বই কমবে না। না, আমি বলছিলাম কী, তোরা দুজন মাত্র মানুষ, একজন মেয়ে একজন বাচ্চা…। এখন বাবুকে যে তুমি নিয়ে যেতে চাচ্ছ, আমি কি তখন একদম একা হয়ে যাব না? দুজন একসঙ্গে থাকা ভালো, না একজনের একা থাকা ভালো? আমি আসলে নানা দিক ভেবে বলছি। তোর অসুবিধা থাকতে পারে…। আমার কোনো অসুবিধা নেই ভাইজান। আমি আর বাবু দিব্যি থাকতে পারব। সে তুই-ই ভালো বুঝবি…। বাবুকেই না হয় জিজ্ঞেস করে দ্যাখো।…কী রে বাবু, যাবি তুই মামার সঙ্গে? ওখানে সোহেল আছে। আমি মাথা নাড়ি। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই। ও বাচ্চা মানুষ। মামা বলে। ও কী বুঝবে। মা মৃদু গলায় বলে—বাবা মারা গেলে কোনো ছেলে আর বাচ্চা থাকে না ভাইজান। আর খালাকে মা রীতিমতো ধমকায়—তোরা সব পেয়েছিস কী বল তো! তোরা দেখছি বাবুকে আমার কাছ থেকে আলাদা করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিস! বলি, এত দিন সব কোথায় ছিলি? কোথায় আর থাকব! খালাও তড়বড় করে বলে। এত দিন প্রয়োজন পড়েনি, তাই বাবুর কথা বলা হয়নি। এখন কী এমন ঘটেছে যে বাবুকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছে? খালা চুপ করে থাকে। আমি এটাও বুঝতে পারছি না, তোরা সবাই আমাকে আর বাবুকে আলাদা করে দিতে চাচ্ছিস কেন! আলাদা আবার কোথায়…। খালা মিনমিনে গলায় বলে। এসব কথা তোরা আর কখনো বলবি না। বাবুকে ছাড়া আমি কখনো থাকতে পারব না, বাবুও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। এখন মাঝেমধ্যে ফুপু-ফুপা বা খালা-মামার চিঠি আসে। আমরা কেমন আছি, সে বিষয় জানতে চায় তারা। আবার কোনো কোনো চিঠিতে আমার কথা আলাদাভাবে লেখা থাকত। জানতে চায় আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। তারা বলে, যদি কখনো তেমন প্রয়োজন পড়ে, তবে আমাকে গিয়ে তাদের ওখানে থাকতে। বলে, তাদের জন্য আমার দরজা সব সময়ই খোলা। মাঝেমধ্যে ওসব চিঠি পড়ে হাসে—কী রে বাবু, যাবি নাকি তুই? কোথায় মা? এই ধর, তোর খালা, মামা কিংবা ফুপুর বাসায়। ওরা এত করে বলছে। তা গেলেই হয় একবার। বেড়িয়ে আসি। আরে না। তোকে যেতে বলেছে। আমার একা একা কোথাও যেতে ভালো লাগে না। এমনি যাবি না। থাকতে যাবি। ও, সেই কথা! হ্যাঁ। তো কী লিখব? লিখব—তোর এখানে খুব অসুবিধা, তুই যাচ্ছিস থাকতে, দেব লিখে? দাও। লিখে দাও, চিঠি পাওয়া মাত্র যেন দৌড়ে আসে। বেশ। তা-ই দিচ্ছি লিখে।…নাকি তু-ই এখানে থাকবি আর আমি গিয়ে থাকব ওদের কারো সঙ্গে। মা। আমি বলি। তুমি লিখে দেবে, ওনারা যেন এসব আর কোনো দিন না লেখেন। আমি কেন? তোর ব্যাপার, তুই-ই লেখ। আমি লিখলে ভাবতেও পারে, ঠিক কথা লিখছি না। ঠিক আছে, আমিই লিখব। আশ্চর্য, এত কেন মাথাব্যথা ওনাদের। তুই-ই চিঠি লিখে জানতে চাস। মার সঙ্গে এ বিষয়ে, মামা, খালা বা ফুপুর চিঠি এলে, মাঝেমধ্যে আমার আলাপ হয়। আলাপ মানে হাসি-ঠাট্টা। আমার অবশ্য মাঝেমধ্যে অবাকও লাগে। আমাদের এই আত্মীয়রা কী পেয়েছে আর কী-ই বা তারা ভাবে! যেন কী কষ্টেই না আমি এখানে আছি! যেন মা আমাকে দেখতে পারে না! যেন তাদের কারো ওখানে গিয়ে থাকলেই কী বিশাল এক ব্যাপার ঘটে যাবে। আমি বুঝতে পারি না, তারা কী করে আশা করে আমি মাকে ছেড়ে তাদের কারো সঙ্গে গিয়ে থাকব! না, এ প্রশ্নই ওঠে না কখনো। মা যেখানে থাকবে, আমি ঠিক সেখানেই থাকব। তা ছাড়া সংসার চালাতে একটু না হয় অসুবিধা হয়, কিন্তু এই এটুকুই, এটুকুর জন্য কেউ মাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে যায়! অবশ্য মার ওপরে আমার যে রাগ হয় না, তা-ও তো নয়। বরং প্রায়ই রাগ হয় আমার। তবে সেটা হাফিজ চাচার কারণে। আমি জানি, হাফিজ চাচা না থাকলে, আমার মার মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে আর নেই। আমি জানি, হাফিজ চাচা না থাকলে কিংবা আমাদের বাসায় তার আসা বন্ধ হয়ে গেলে, মার ওপর আর কখনো আমার রাগ হবে না। আমার কখনো এমনও মনে হয়, মাকে বলে দিই, হাফিজ চাচা যেন আর কোনো দিন না আসে আমাদের বাসায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কিভাবে বলব মাকে। আমার লজ্জা লাগবে। আর মা যদি জানতে চায়—কেন, তখন কী বলব আমি? এমন তো সত্যিই হতে পারে। আমি হয়তো মাকে বললাম—মা, তোমাকে একটা কথা বলি।…তুমি হাফিজ চাচাকে এ বাসায় আসতে বারণ করে দেবে। মা কি তখন অবাক হয়ে যাবে না? হ্যাঁ, মা অবাক হবে খুব। আমিই যে ওরকমই কথা বলেছি, সেটা যেন বিশ্বাসই করতে পারবে না। কিন্তু তারপর, তারপর মা যদি জিজ্ঞেস করে—কেন আমি তোর হাফিজ চাচাকে আসতে বারণ করে দেব—তখন কী বলব আমি উত্তরে? আমার তো আমতা আমতা করতে হবে তখন। কিংবা হয়তো আরো গম্ভীর হয়ে যেতে হবে আমাকে—দেবে, আমি বলছি বারণ করে দিতে, তাই। বেশ, বুঝলাম তুই বারণ করছিস। কিন্তু কেন—সেটা তো আমার জানতে হবে। কারণ না জেনে একটা লোককে খামোখা তো আমি বাসায় আসতে বারণ করে দিতে পারি না। আমি কি উত্তরে তখন—লোকজন অনেক খারাপ কথা বলে মা—এ কথা বলতে পারব? কিংবা—কেন তার আসতে হবে মা—এ কথা বলতে পারব? কিংবা—সারা দিন ও লোকের আমাদের বাসায় কী দরকার মা—এ কথা বলতে পারব? কিংবা—ও লোককে আমার বাজে লোক মনে হয় না—এ কথা বলতে পারব? না, আমি জানি, এর একটা কথাও আমি মাকে বলতে পারব না। এটা আমি নিশ্চিত করে জানি। কারণ এ রকম কিছু বলার চেষ্টা আগেও আমি করেছি, সরাসরি না, একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। কিন্তু প্রতিবার আমি দেখেছি, শেষ মুহূর্তে এসে আমার মুখে আর কথা জোগায়নি। তা, ঘুরিয়ে-ফিরিয়েই যখন বলতে পারি না, সরাসরি বলার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া যদি এমন হয়, বললাম আমি—হাফিজ চাচার এ বাসায় আসার দরকার নেই মা, লোকজন অনেক খারাপ কথা বলে। এ কথা শুনে মা যদি জিজ্ঞেস করে—কী খারাপ কথা বলে—তখন কী বলব আমি? মাকে তো চিনি আমি, ফুলের মতো নরম যেমন, তেমন আবার লোহার মতোও শক্ত। মা ওই কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারে—হ্যাঁ বাবু, তুই বল আমাকে, লোকজন কী খারাপ খারাপ কথা বলে? এ প্রশ্নের কি কোনো উত্তর হয়? হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু সে কথা কি আমি বলতে পারি মাকে? আমি বড়জোর বলতে পারি—সে অনেক বাজে বাজে কথা মা। সেটাই শুনি। এক এক করে বল। সেসব বলা যাবে না মা। কত কী বলে লোকজন…। আমি জানি মা তখন বলবে—লোকজন অনেক কথাই বলে। লোকজনের সব কথা শুনতে হয় না। আড়ালে যখন বলে কিংবা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে, তখন আমার খুব খারাপ লাগে মা। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যাদের মন খুব নোংরা। তারা সব সময় নোংরা কথা বলে মজা পায়। তাহলে আমি কী করব মা? কিছু না। তুই কী ভেবেছিস, যারা এখন নোংরা কথা বলে, তারা তোর হাফিজ চাচা এ বাসায় আসা বন্ধ করে দিলে ওসব নোংরা কথা বলা বন্ধ করে দেবে? না, তখন ওরা অন্য অন্য নোংরা কথা বলবে। মার কথার পিঠে আমি আর কিছু বলতে পারব না। সুতরাং মাকে আমার হাফিজ চাচা সম্পর্কে কিছুই বলা হবে না। তার চেয়ে এমনি এমনি, কোনো না কোনোভাবে যদি, হাফিজ চাচার আসা বন্ধ হয়ে যেত আমাদের বাসায়, সেটা হতো খুব ভালো। হয়তো হঠাৎ একদিন হাফিজ চাচা নিজেই ঠিক করল—না, সে আর আসবে না আমাদের বাসায় কিংবা তার বন্ধুরা তাকে এমনভাবে বোঝাল, হাফিজ চাচা বুঝল আমাদের বাসায় তার আর আসা উচিত না। কিংবা আরো কত কী-ই তো হতে পারে। এই যেমন, কে জানে, হাফিজ চাচা তো হঠাৎ করে মারাও যেতে পারে! দুর্ঘটনা কি নেই মানুষের জীবনে? রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয় না? কিংবা কঠিন কোনো অসুখ, যা ডাক্তাররাও ভালো করতে পারবে না? বাদশাহ হুমায়ুন নাকি সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেছে আর শেরশাহ নাকি পোলো খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে। তাহলে হাফিজ চাচার বেলায় এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে অসুবিধা কোথায়? আর এসব যদি কিছুই না হয়, আমার মনে হয়, তার পরও ব্যবস্থা আমার হাতেই আছে। আমি শাহাবুদ্দিনকে বলতে পারি—শাহাব ভাই, আপনাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। শাহাবুদ্দিন, টেরর শাহাব তখন বলবে, আমি জানি, বলবে—তোর আবার কী কাজ রে? আছে। আগে আপনি বলেন কাজটা করে দেবেন। আরে আশ্চর্য, না শুনে আমি কী করে বলি পারব কী পারব না। আপনি পারবেন। তেমন কোনো কঠিন কাজ না। ঠিক আছে, বলো শুনি। একজনকে একটু টাইট দিতে হবে। আমি জানি, টেরর শাহাবের তখন ভ্রু কুঁচকে যাবে—তোকে মেরেছে কেউ? কোন হারামজাদা? মারেনি। কিন্তু তার চেয়ে বেশি। ঝেড়ে কাশ তো। যা বলবি পুরোটা বলবি। একটা লোক সব সময় আমাদের বাসায় আসে। হ্যাঁ, তো কী হয়েছে? আমরা বিরক্ত হই। আমরা কেউ চাই না লোকটা আমাদের বাসায় আসুক। তোরা না করে দিসনি? একদম সরাসরি না বলতে আমাদের অসুবিধা আছে। আপনি তো জানেন, আমার বাবা নেই। শুধু আমি আর মা…। বুঝেছি। শালা ফোর-টোয়েন্টি একটা। এখন আপনি কিছু একটা করেন। ওই লোক যেন আর আমাদের বাসায় না আসে। হুঁ। …তুই কী করতে বলিস? সেটা আপনি ভালো বুঝবেন। তুই চাইলে আমি ওই হারামজাদাকে একদম জানে মেরে ফেলব। আমি তখন খুশি হয়ে উঠব।—একদম জানে মেরে ফেলবেন? হ্যাঁ, এই শালাদের একদম জানেই মেরে ফেলা উচিত। আপনিই ভেবে দ্যাখেন কী করলে ভালো হয়। তুই যেটা চাইবি সেটাই হবে। তুই চাইলে ওই ব্যাটার হাত ভেঙে দেব, তুই চাইলে পা ভেঙে দেব, তুই চাইলে মাথা ফাটিয়ে দেব। তুই চাইলে ব্যাটাকে এমন কিছু করব যে সারা জীবন তোদের বাসার আশপাশেও আর যাবে না। তুই আমার ছোট ভাই, তোর মা আমার মা। তোর জন্য করব না মানে? শুধু বল কী করতে হবে! কিন্তু লোকটা যেন জানতে না পারে আমি এর পেছনে আছি। ভয় পাচ্ছিস? আরে ছোট ভাই, ভয় কিসের আমি থাকতে!…ঠিক আছে, কিছুই জানবে না লোক। এখন তুই বল, কী করব ওই লোকের। যদি সত্যিই এ রকম হয়, ‘যদি’ আর বলি কেন, শাহাবকে আমি বললে এ রকমই হবে; প্রশ্ন হচ্ছে—শাহাব যখন ওকথা বলবে, তখন কী হবে আমার উত্তর। আমি কি তখন শাহাবকে বলব—ওব্যাটার দুই হাত ভেঙে দেন আপনি। আমি কি তখন শাহাবকে বলব—ঠ্যাং ভেঙে ও শালাকে লুলো করে দেন আপনি। আমি কি তখন শাহাবকে বলব—ওই হারামির মাথা থেঁতলে দেন আপনি। আমি কি তখন শাহাবকে বলব—আসলে শাহাব ভাই, ওই লোকের বেঁচে থাকারই কোনো দরকার নেই। আমার কী বলা উচিত হবে? আমি বুুঝতে পারি না একটা মানুষের এত কেন সমস্যা। এই আমার যেমন। শাহাবকে বলে হাফিজ চাচাকে মার খাওয়ানোর ব্যাপারটা মনে মনে যখন পোক্ত করে এনেছি, তখন দেখছি হাফিজ চাচার জন্য আমার খারাপ লাগছে। কোনো মানে হয় এটার! আমি বুঝতে পারি না, হাফিজ চাচার জন্য আমার কেন খারাপ লাগবে? কিন্তু খারাপ লাগছে, এটা তো ঠিক। চোখের সামনে দেখতে পাই ভাঙা হাত নিয়ে হাফিজ চাচা ব্যথায় কাতরাচ্ছে কিংবা বিষণ্ন মুখে বসে আছে। চোখের সামনে দেখতে পাই, ভাঙা পা নিয়ে হাফিজ চাচা আর কোনো দিনই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। চোখের সামনে দেখতে পাই থেঁতলানো মাথা নিয়ে হাফিজ চাচা হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। হ্যাঁ, কিছু হলে হাফিজ চাচাকে পড়েই থাকতে হবে। কারণ তাকে দেখার কেউ নেই। আর মার মুখ তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে যাবে—তোর হাফিজ চাচার কী হয়েছে রে বাবু, শুনেছিস কিছু? ঠিক ঠিক কিছু তো জানি না মা। শুনছি কারা নাকি লোহার রড দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কারা করেছে শুনেছিস কিছু? মার গলায় উত্কণ্ঠা। না মা, তা কি এখন আর কেউ বলতে পারে? সেদিন বলছিল অফিসে নাকি কী গোলমাল হচ্ছে। আমি তখন চুপ করে থাকব। তুই গিয়েছিলি দেখতে? আমি, আমি কেন যাব! মানে, আমি গিয়ে কী করব? কেন যাবি না তুই।…লোকটিকে দেখার কেউ নেই…। মার সঙ্গে এমন কথা হবে ভাবলে আমার মনে হয়, হ্যাঁ, হাফিজ চাচার মার খাওয়াই উচিত। ও লোক মার খেলে মা কেন কষ্ট পেতে যাবে? মাকে তখন বলে দেব—খারাপ কিছু করেছিল বোধ হয় মা। খারাপ কিছু না করলে কি কেউ মার খায়? কী বলছিস তুই! মা রেগে যাবে। ওই লোক খারাপ? তোর হাফিজ চাচাকে এত দিন ধরে দেখে তোর এই ধারণা হয়েছে!…আমি বুঝতে পারছি না, ও রকম একটা মানুষের গায়ে কেউ কী করে হাত তোলে!…মানুষের উপকার ছাড়া তোর হাফিজ চাচা আর কিছু করেছে কোনো দিন? মানুষের কথা আমি জানি না। তবে আমি নিজেদের কথা জানি। হ্যাঁ, হাফিজ চাচা আমাদের অনেক উপকার করেছে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি হয়তো অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু হাফিজ চাচার উপকারের কথা আমি নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারি না। হাফিজ চাচা না থাকলে আমাদের ফ্ল্যাট থাকত না, এটা পুরনো কথা। হাফিজ চাচা না থাকলে অফিস থেকে বাবার টাকা তুলতে আমাদের খুব অসুবিধা হতো। হাফিজ চাচা না থাকলে আমার সেবার জন্ডিসের সময় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া হতো না। হাফিজ চাচা না থাকলে আমার গান শেখার জন্য রামগোপালের ব্যবস্থাও হতো না। এই হাফিজ চাচাকে মারার জন্য আমি শাহাবুদ্দিনকে বলব? কখনো আমার বলতে ইচ্ছা করে, এই এখন যেমন আমার বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আমি জানি একটু পরেই আমার মনে হবে, আমি যদি তেমন কোনো কাজ করি, তবে সেটা হবে অমানবিক একটা কাজ, সেটা হবে অকৃতজ্ঞতার প্রকাশ। তার চেয়ে আমার মনে হয়, এমনি এমনিই যদি হাফিজ চাচার মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটত, তবে সেটা হতো সবচেয়ে সহজ সমাধান। আবার পরমুহূর্তে এমনও মনে হয় আমার, হাফিজ চাচা না থাকলে আমাকে হয়তো বাইরে কোনো কথা শুনতে হবে না। কিন্তু অন্যদিকে সমস্যা কি বেড়ে যাবে না আমাদের? আমি বুঝতে পারি না। আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না। আমার তাই অস্থির লাগে এবং একসময় কান্না পায়। সকাল দশটার দিকে শামীম আসে। আমি ওর সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করব বুঝতে পারি না। আমি আশাও করিনি ও সকালবেলায়ই এসে হাজির হবে। আমি একটু হাসার চেষ্টা করি—কী রে, কী খবর তোর? তুই আমার সঙ্গে গতকাল অমন খারাপ ব্যবহার কেন করলি, সেটা জানতে এলাম। শামীম একটা বোকা। বোকা না হলে এভাবে আবার গতকালের কথা বলে? ওর তো উচিত ছিল, একদম অন্য কিছু বলা। যেন কথা বলতে বলতে একসময় ওর ওপর আমার কোনো রাগই থাকত না। কিন্তু না, বোকাটা গতকালের কথাই তুলেছে। আমি বলি—আজ সকালবেলা উঠে প্র্যাকটিস করিসনি? শামীম রোজ ভোরবেলায় উঠে আরো অনেকের সঙ্গে ফুটবল খেলে। ওটা হচ্ছে ওদের প্র্যাকটিস করা। বড় খেলোয়াড় হতে গেলে নাকি দুইবেলা এ রকম প্র্যাকটিস করতেই হয়। আসলে সব কিছুই প্র্যাকটিসের ব্যাপার। আমাদের আরেক বন্ধু শামসু বেপারি সাঁতার শেখে। খুব সরল, সাদাসিধে ছেলে। তবে চান্স পেলেই বলে—ও রোজ সাঁতার শেখে। আশপাশে বিশ মাইলের মধ্যে কেউ ওর সঙ্গে সাঁতারে পারবে না। তা, সত্যিও হতে পারে শামসুর কথা, যেই সিরিয়াস ও! শামীম বলে—প্র্যাকটিস তো করেছিই। কিন্তু তুই আমার ওপর কেন রাগ করেছিস সেটা বললি না। আচ্ছা শামীম, তোর কি মনে হয় তুই সত্যিই ঢাকা গিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলতে পারবি? সেটা কি আর বলা যায় এভাবে! কঠিন ব্যাপার। অবশ্য চেষ্টা তো চালিয়ে যাচ্ছি। তুই পারবি শামীম, দেখিস। শামীম একটু হাসে—পারলে তো ভালোই। আমি ঢাকায় ফার্স্ট ডিভিশনে খেলব আর তুই টেলিভিশনে গান গাইবি। হুঁ। আমি বলি। নে, এখন বল তুই আমার ওপর কেন রাগ করেছিলি। আমি হতাশ গলায় বলি—তেমন কোনো ব্যাপার না রে…। না, তবু আমার শুনতে হবে। আশ্চর্য, শোনার মতো কিছু না তো। না, তবু তোর বলতে হবে। কী আপদ! কী বলব আমি? শামীম একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—আমি বুঝতে পেরেছি কেন তুই আমার ওপর রাগ করেছিস। বলব? আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি—তোর যখন এতই ইচ্ছা, বল। আমি তোকে বলেছিলাম তুই যেন হাফিজ চাচাকে বলিস তোর জন্য গানের মাস্টার রেখে দিতে। সে জন্য, তাই না? আমি একটু হাসি—এটা তো আসলে না বোঝার কিছু না। কারণ তুই এ কথা বলার পরই আমি খেপে গিয়েছিলাম। শামীম হাসে—আমি এখন জানতে চাচ্ছি এ কথায় তুই কেন খেপে গেলি? আমি গম্ভীর হয়ে যাই—এসব কথা থাক না এখন। না। শামীম গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে। আমি তোর বন্ধু, আমার জানতে হবে আমি কোথায় ভুল করেছি। সে থাক তো, গতকালই আমি তোকে বলেছি। কেন আমি হাফিজ চাচাকে আমার গানের মাস্টার রেখে দেওয়ার কথা বলতে যাব? তুই বল…। দেখ বাবু। শামীম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে। আমি এ কথা বলেছিলাম। কারণ আমি হাফিজ চাচাকে তোর মুরব্বি বলে মনে করি। মুরব্বিই তো। আমি বলি। আর কী? আমিও তো সে জন্যই বলেছি। তুই খেপে গেলি কেন? এ কথার পিঠে আমার আর কিছু বলার নেই। আমি চুপ করে থাকি। আমি তো তোকে খারাপ কিছু বলিনি বাবু। আসলে হয়েছে কি শামীম—আমি আমতা আমতা করে বলি। তুই দেখ, কতজন খামোখা কত খারাপ কথা বলে।…তুই তো জানিসই। আর তুইও ভেবেছিস আমি ওদের দলে। গাধা একটা। থাক, এসব কথা। আমার আসলে হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।…বাদ দে। হ্যাঁ, বাদ। চল, ছাদে যাই। ছাদ আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় জায়গা। বিশেষ করে এই ছুটির দিনগুলোতে। আমি শামীমের বাসায় যাই কিংবা শামীম আসে আমাদের বাসায়। কিছুক্ষণ ঘরে বসে গল্প করে আমরা উঠে যাই ছাদে। আমরা বেরোতে নিলে মা বলে—শামীমকে আজ ছাড়িস না। দুপুরে ও খেয়ে যাবে। এটা কথার কথা। আমরা দুজনই হাসি। নিচে নামতেই দেখি একটু দূরে শম্পা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ বিল্ডিংয়েরই এক পিচ্চি ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। আমাদের দেখে এমনভাবে তাকায়, যেন জীবনে আমাদের দুজনের কাউকে দেখেনি। তবে ওই এক কী দুই পলক তাকাল, তারপরই এমনভাবে চোখ ফিরিয়ে নেয়, যেন যার-তার দিকে তাকানোর সময় তার নেই। শামীম মৃদু গলায় বলে—শম্পা আবার তোর পেছনে লেগেছে নাকি? ও তো লেগেই আছে সব সময়।…কিছু হয়েছে নাকি? যা একটা কথা বলল আমাকে, তোর সম্পর্কে। আমি অনুমান করতে পারি কী বলেছে শম্পা। তবু জিজ্ঞেস করি—কী বলেছে আমার সম্পর্কে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে শামীম আড়চোখে শম্পার দিকে তাকায়—ছাদে গিয়ে বলব। ছাদে আমরা বসি এক কোণে। ছাদের দুই কোণেই পানির ট্যাংক। ট্যাংকের গা ঘেঁষে যে কোণে ছায়া থাকে, আমরা সে কোণে বসি। এখন সকাল, তাই ছাদের পূর্ব দিকে ট্যাংকের কোণ ঘেঁষে ছায়া। আমরা সেখানে গিয়ে বসি। শামীম বলে—হয়েছে কী জানিস, আমি আসছি, দেখি শম্পা দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাইরের ঘরের জানালায়। আমাকে দেখে বলল—কোথায় যাচ্ছিস রে? আমি বললাম—তুই তো জানিসই আমি কোথায় যাচ্ছি, আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন? শুনে বলল—ও, ওই মাগিটার কাছে যাচ্ছিস! এ কথাই শুনব, নিশ্চিত করেই জানা ছিল আমার। তবু কান গরম হয়ে যায়। ও আবার নতুন করে তোর পেছনে লেগেছে কেন? বললাম না, লেগেই আছে সব সময়।…তবে এর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। শামীম সামান্য উত্সুক হয়—কী হয়েছে বল তো। আসলে হয়েছে কী।…আমি একটুক্ষণ চুপ করে থাকি। শম্পা মেয়েটি আসলে ভালো না। শামীম হাসে—এ তো আমরা সবাই জানি। মর্দানি একটা। শুধু বাজে বাজে কথা বলে। আমি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি—আরো ব্যাপার আছে। আমি কয়েক দিন হলো মাত্র টের পেয়েছি। এবার শামীমের উৎসাহ বাড়ে—কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। তবে তোর মুখেই শুনি। শম্পা আসলে চাচ্ছে আমি ওর সঙ্গে কিছু একটা করি। কিছু একটা মানে? প্রেম? আরে ধেৎ, ওকি প্রেম করার মেয়ে নাকি! তাহলে?…আন্দাজ অবশ্য করা যায়…। মেয়েটা আসলেই খারাপ। ও চাচ্ছে আমি ওর সঙ্গে ওই সব করি। ওই সব মানে? শামীম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে। তার পরই ও যেন বুঝতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখ-মুখ ঝলমল করে ওঠে—আরে শালা! সত্যি? সত্যি মানে! তুই বুঝতে পারছিস না ও কেন আমাকে মাগি বলেছে? ও চাচ্ছে আমি ওকে ধরি। সত্যি? শামীম আবার বলে। আমার বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। কতজন যে ওর পেছনে পেছনে ঘোরে, আর তুই কিনা বাজি মেরে দিলি। আমি একটু হাসি—বেশ কয়েক দিন হলো, দেখছি ও আমাকে বাজিয়ে দেখছে। তো আমি পাত্তা দিইনি। তাই রেগে গিয়ে এখন আমাকে ওই নামে ডাকছে। তুই পাত্তা দিসনি মানে? পাগল নাকি তুই! এ সুযোগ কেউ ছাড়ে। আমি আবার একটু হাসি—সুযোগ আবার কী! ওইটা তো মর্দানি একটা। সে হোক। মর্দানি তো আমরা বলি। এমনি তুই ভেবে দেখ, শম্পা তো একদম একটা মাল। তাহলে তুই বলছিস? বলছি মানে! আমি হলে কখনো এই সুযোগ ছাড়তাম না। ও নিজে থেকে যখন…। হ্যাঁ, আমাকে কম জ্বালায় নাকি?…দেখি, ঠিকই একদিন ধরে বসব। তারপর কিন্তু সব বলবি আমাকে। শামীম আমার হাত চেপে ধরে। আমি ভাবছি, ব্যাপারটা আবার খারাপ হয়ে যায় কি না। খারাপ হবে কেন? শামীম তখনই বলে। তুই যদি জোর করে কিছু করতি, তাহলে এককথা ছিল। কিন্তু শম্পা তো নিজেই চাচ্ছে—তুই কিছু কর। তবু…। আমি বলি। অবশ্য আমি যদি কিছু না করি, তবে সমস্যা কী জানিস, সব জায়গায় ও আমাকে ওই নামে ডেকে বেড়াবে! সে জন্যই তো বলছি, তুই কর। তোরও লাভ, ওরও লাভ। যদি কিছু করি আমি। আমি হেসে বলি। তবে তোকে আমি সত্যিই বলব। শামীম আরো ঘণ্টাখানেক থাকে। আমরা নানা গল্প করি। শেষে শামীমই ওঠে—যাই রে। আমরা নিচে নেমে আসি। তারপর ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পথ যাই। শামীমের সঙ্গে কথা বলে মজা অনেক। সবচেয়ে বড় কথা, প্রায় সব সময়ই ও আমাকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারে। ওর সঙ্গে কথা বলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। শামীমের কথা ভাবতেই আমি ফিরে আসি। একটু বেখেয়ালিই ছিলাম, শম্পার কথাও খেয়াল ছিল না। তবে ওর কথা শুনেই আমার খেয়াল হয়। ডান পাশে তাকিয়ে দেখি ও ওদের বাইরের ঘরের জানালায় বুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর মুখের ওপর থেকে চোখ নামিয়ে আনি ওর বুকের ওপর, ইচ্ছা করেই, বুঝুক ও। শম্পা বোঝে, কিন্তু তাতে যেন ওর কিছুই এসে যায় না। বরং আমাকে আরো বেশি করে দেখানোর জন্যই বুক দুটি জানালার শিকে আরো চেপে বসায়। আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগে। সেটা কাটানোর জন্যই চোখ ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করি—কিছু বললি নাকি তুই? হ্যাঁ, মাগি, বলেছি। ও নির্বিকার গলায় বলে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—মাগি, তুই কোথায় গিয়েছিলি? মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায়—তুই আরেকবার যদি ওই কথা বলবি হারামজাদি, আমি তোর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। চেষ্টা করে দেখিস। তার আগে টেনে আমি তোর ইয়ে ছিঁড়ে ফেলব। শম্পা এমন সহজভাবে এবং অবলীলায় বলে—আমি আর কথা খুঁজে পাই না। কী হলো, চুপ করে আছিস কেন! দেখি, কে কার কী ছিঁড়তে পারে। তুই কখনো আর ওই বাজে কথা বলবি না আমাকে। আমি তোকে আর মর্দানি বলি? বল না, কে তোকে বারণ করেছে। এক হাজারবার বল। না, বলব না। কিন্তু তুই আমাকে আর ওই বাজে কথা বলতে পারবি না। বলব। মাগি মাগি মাগি। আমি কী বলব, কী করব কিছুই বুঝতে পারি না। তুই এত খেপস কেন লালটু? তুই তো মাগিই একটা। দেখবি, দেখবি তুই, আমি কী? দেখা না। আমি বারণ করেছি কখনো? বলেছি—দেখব না? দাঁড়া, একদিন শুধু সুযোগ পেয়ে নিই। আয় না। শম্পা এমনভাবে বলে যেন ভাত খেতে ডাকছে। আয়, বাবা বাসায় নেই। মা থাকলেই বা কি—পাগলি একটা। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর তুই পাবি? আমার একবার ইচ্ছা করে—যাই। শামীমকে খুব একটা মিথ্যা তো আমি বলিনি। এসব উস্কানি বা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রস্তাব দেওয়া ছাড়া কী! আমি অবশ্য গতকালই এটা বুঝেছি। তবে শম্পার কথামতো ওদের ঘরে ঢুকতে আমার ভয়ও করে। কে যেন বলে—উচিত হবে না, উচিত হবে না। কেন উচিত হবে না—আমি আবার নিজের কাছেই জানতে চাই। মা যদি জেনে যায়—আমার মনে হয়। আমার সত্যিই আর কিছু মনে হয় না, শুধু মনে হয়—মা যদি জেনে যায়, তাহলে? কিন্তু অস্বীকার করব না, আমার যেতেও ইচ্ছা করে খুব। আমার শরীর যেন আমাকে ওর দিকেই টেনে নিয়ে যেতে চায়। কী হলো মাগি? সাহস হচ্ছে না তোর? এর মধ্যে আবার সাহস না হওয়ার কী হলো? তাহলে অমন হিজড়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে চলে আয় না। তোর মা আর তোর হাফিজ চাচা যা করে আমরাও তা-ই করি। আমার শরীরের সব ইচ্ছা যেন এক ফুৎকারে নিভে যায়—আবার, আবার তুই খারাপ কথা বলছিস খানকি কোথাকার। যে গালটা তুই আমাকে দিলি, সেটা তোর মাকে দে গিয়ে। আমার মা তোর কী করেছে, তোর কী করেছে খানকি? আমার মা তোর মতো না। আমি কি বলেছি তোর মা আমার মতো? আর তোর মা কী করেছে সেটা তুই-ই ভালো জানিস। আমি তোর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব হারামজাদি। শম্পা যেন বিরক্ত হয়—এ কথা তো বলেছিস একবার। তুই, তুই এখানে আছিস কেন? খানকিপাড়ায় গিয়ে ভর্তি হ। তোর ওটাই জায়গা। আর তোর মা যে নিজের বাসায় বসেই পাড়া খুলেছে? খদ্দের অবশ্য একজনই। আমার কান্না পায়। আমি কান্না চেপে থুতু ফেলি—তোর সঙ্গে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হয়। মায়ের সঙ্গে তো ঠিকই বলিস। আমি আর দাঁড়াই না। শম্পা পেছন থেকে বলে—শালা, নিজের মা সারা দিন একজনের সঙ্গে কচলাকচলি করছে, সে খবর নেই, উনি এসেছেন আমার সঙ্গে কতটা মরদ হয়েছেন উনি, তা দেখাতে। মাগি…। বাসায় ঢুকে আমি সোজা চলে যাই নিজের ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদি আমি, অনেকক্ষণ ধরে। এই কান্নার পাশাপাশি কী ভীষণ রাগও হয় আমার। আমার চারপাশের সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে একটা ছুরি হাতে ছুটে যেতে, ইচ্ছা করে সেই ছুরি সোজা হাফিজ চাচার বুকে বসিয়ে দিতে। তারপর ফেরার পথে শম্পাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিয়ে জবাই করে ফেলতে। আর মা যদি তখন ছুরি হাতে আমাকে ছুটে যেতে দেখে, বুঝতে পেরে আমাকে বাধা দিতে চায়, তখন মাকেও ছেড়ে দেব না আমি—এ রকম ইচ্ছা হয় আমার। এর পাশাপাশি একটা কথা ভেবে আমি খুব অবাকও হই। শম্পা হঠাৎ করে এসব কথা বলতে আরম্ভ করেছে কেন? এমন নয়, ও কখনো এসব কথা আমাকে বলেনি। বলেছে অনেকবার, তবে সব সময় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, আকারে-ইঙ্গিতে কখনো এমন সোজাসুজি নয়। ও কি সত্যিই কোনো কারণে আমার ওপর খুব খেপেছে? ওকে মর্দানি বলার জন্য? কিন্তু মর্দানি ওকে আমি আগেও অনেকবার বলেছি। তাহলে হঠাৎ ওর এত খেপে যাওয়ার কী কারণ! তাহলে কি আমার গতকালের ওই ভাবনাই ঠিক? একটু আগে আমি শামীমকে যা বলেছি তা-ই ঠিক? ও চায় আমি ওর সঙ্গে ওসব করতে আরম্ভ করে দিই? এ চিন্তা অবশ্য আমার মনে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার মন সাড়া দেয় না, আমার শরীরও, শম্পার কথা ভেবে, কোনো অন্য রকম অনুভূতি জাগে না; বরং শম্পার ওই কথাগুলো বারবার কানের পাশে গুনগুন করে ওঠে। আমার রাগ বেড়ে যায়, আবার আমার শরীর শিথিলও হয়ে পড়ে। আমার মনে হয়, মাকে যদি বলা যেত, শুধু মাকে যদি বলা যেত কী কী বলেছে শম্পা। যদি হুবহু সব কথা বলতে পারতাম মাকে। কিন্তু পরমুহূর্তে আমি মাথা নাড়ি, না, কেন আমি ওই নোংরা কথাগুলো মাকে বলতে যাব? আমার মা কখনো এত নোংরা নয়। তবে এভাবে বোধ হয় বলা যায়—মা, এসব কথা লোকজন বলাবলি করে মা। কিন্তু না, আমি জানি, এভাবেও আমার পক্ষে মাকে ও ধরনের নোংরা কথাগুলো কখনো বলা সম্ভন না। বরং শম্পাকে, হ্যাঁ, শম্পাকেই আমার দেখে নিতে হবে। আর হাফিজ চাচাকে। আমি অবশ্য গুছিয়ে কিছুই ভাবতে পারি না—কিভাবে আমি দেখে নেব শম্পা কিংবা হাফিজ চাচাকে। শুধু এটুকুই আমাকে অস্থির করে তোলে—দেখে নিতে হবে, ওই নোংরা মেয়েটাকে আমার দেখে নিতে হবে। যখন বুঝতে পারি না—কিভাবে, তখন অস্থিরতা আমার বেড়ে যায়। আমার আবার কান্না পায়। দরজায় মৃদু নক করে মা—কী রে বাবু, সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি। খাওয়ার সময় হয়েছে। মা এর আগে দুবার ডেকে গেছে। আমি ‘হুঁ-হ্যাঁ’ করে কাটিয়েছি। আর বেশি দেরি করলে মার সন্দেহ হবে। আমি সেটা চাই না। আমি উঠে ভালো করে চোখ মুছে নিই। পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে দশটা টাকা নিই। তারপর চুল আঁচড়ে পোশাক পাল্টে ঘর থেকে বের হই। মা আমাকে দেখে অবাক—কী রে বাবু, হঠাৎ করে তুই এমন বাবু সাজলি! শামীমদের বাসায় দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত মা। মা অবাক হয়ে যায়—কই, তখন যে কিছু বললি না? এমনি…আসলে ছাদে গিয়েই তো ঠিক হলো…। মা বোধ হয় পুরোপুরি বিশ্বাস করে না—ঠিক আছে, যা।…তাড়াতাড়ি ফিরিস।…সপ্তাহে একটা মাত্র ছুটির দিন…। বাসা থেকে বেরিয়ে আমার ভাবতে হয় না কোথায় যাব। যেতে অবশ্য আমি বেশ কয়েক জায়গায়ই পারি। শামীমদের বাসায় যেতে পারি, জুয়েলদের বাসায় যেতে পারি, রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকতে পারি। কিন্তু ওসব কোনো জায়গায় যাব না আমি। আমি যাব কলসভাঙা। আট টাকার সিগারেট কিনে নিই। ম্যাচ তো গতকালেরটাই আছে। সারা দিন কিছু খাব না আমি, একটার পর একটা শুধু সিগারেট টানব। কলসভাঙায় বসে এর চেয়ে আনন্দের ও কষ্টের আর কিছু হতে পারে না। আমার বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। আমি কলসভাঙায়ই থাকি না পুরোটা সময়। প্রায় সন্ধে পর্যন্ত ওখানে সিগারেট টেনেছি একটার পর একটা। আমার চোখ জ্বালা করেছে, পেটের ভেতর মোচড় দিয়েছে, মাথা ধরে গেছে, বমি হয়েছে। সন্ধে হয়ে এলে কলসভাঙায় আর থাকা যায় না। আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি অন্যদিকে। কতক্ষণ বড় মাঠে দাঁড়িয়ে সিনিয়রদের ফুটবল খেলা দেখেছি, কতক্ষণ বিভিন্ন রাস্তা ধরে এলোমেলো হেঁটেছি। শেষে বসেছিলাম রেলস্টেশনে। স্টেশনে বসেই টের পাই, শরীরে বোধ হয় জ্বর। নিজেকে ভীষণ দুর্বলও মনে হয়। তখন আর বাইরে থাকার সাহস হয় না আমার। বাসায় ফিরে দেখি বাইরের দরজা খোলা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই দেখি মা চুপ করে বেতের চেয়ারে বসে উদাসীন চোখে একদিকে তাকিয়ে আছে। মার অমন বসে থাকা আর তাকানো দেখেই আমার নিজেকে অসহায় মনে হয়। একটু লজ্জা লাগে আমার। মার জন্য একটু কষ্ট হয়। একটু হাসার চেষ্টা করি। মা আশ্চর্যরকম সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে—বাবু, তুই কোথায় গিয়েছিলি? আমি চুপ করে থাকি। শামীমদের ওখানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে, তুই ওদের ওখানে যাসনি। তুই মিথ্যা কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি, বাবু। আমি চুপ করে থাকি। কোথায় গিয়েছিলি তুই, বলবি না? কলসভাঙা। মা-ও কতক্ষণ চুপ করে থাকে—কেন গিয়েছিলি, আমাকে মিথ্যা বলে? আমি চুপ করে থাকি। তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস? তাহলে তুই বল আমাকে, আমি মরে যাই। আমার এবার কান্না পায়। তুই আমাকে সত্যিই মেরে ফেলতে চাস বাবু। মা ফিসফিস করে বলে। এভাবে আর একটুক্ষণ চললে আমি মরেই যেতাম।…তোর হাফিজ চাচাও সেই কখন থেকে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। বাবু। মা খুব নরম গলায় বলে। তোর কোনো অসুবিধা থাকলে সেটা আমাকে বল বাবু। আমি তোর মা। তুই আমাকে না বললে আর কাকে বলবি! আমার মনে হয়, এই এখন বোধ হয় আমি সত্যিই বলতে পারি মাকে। মা যখন নিজে থেকেই জানতে চাচ্ছে। এমন সুযোগ আমি হয়তো আর পাব না। বলে ফেলি, এই সুযোগে মাকে বলে ফেলি আমার অসুবিধাগুলোর কথা। আসলে অসুবিধা তো আমার একটাই। আমি বলার জন্য মুখ খুলতে যাই। কিন্তু তার আগেই আমার পা টলে ওঠে, মাথাটা ঘুরে যায়, চারপাশের সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসে। আমি কোনোমতে একটা চেয়ারে বসে পড়ি। মাকে ডাকতে হয় না। মা তার আগেই ছুটে আসে আমার পাশে। ডাক্তার বলে—কিছু না। আমিও জানি—কিছু না। তবু নাকি বিছানায় থাকতে হবে তিন-চার দিন। এর কোনো মানে হয় না, কিছু হয়নি যখন। কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠারও কোনো উপায় নেই। মা স্কুল থেকে প্রথম দুদিন ছুটি নেয়। এটা আমার কাছে খুব বাড়াবাড়ি মনে হয়। কিন্তু মাকে কে বোঝায়? অবশ্য প্রথম দিন মা বাসায় না থাকলে আমার অসুবিধাই হতো। একা উঠে বাথরুমে ঠিকই যেতে পারতাম, কিন্তু একা উঠে খেতে বোধ হয় পারতাম না। মা অবশ্য খাওয়াতে গিয়ে খুব বাড়াবাড়িই করে। আধা ঘণ্টা পর পর দুধ, এর কোনো মানে হয়? আধা ঘণ্টা পর পর কমলালেবু (না দেখলেও আমি জানি ওই লেবু হাফিজ চাচা এনেছে), এরও কোনো মানে হয় না। আমার এসব রীতিমতো অত্যাচার মনে হয়। আর বাড়াবাড়ি করে হাফিজ চাচা। সে রাতে আমি ঢলে পড়ার পরপরই হাফিজ চাচা ফিরেছিল। সে-ই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। ব্যস, এই এক দিনই যথেষ্ট। ডাক্তার তো নিজের মুখেই বলে গেছে—কিছু না। কিন্তু তাতে যেন হাফিজ চাচার স্বস্তি হয় না। প্রতি সকালে একবার আসে হাফিজ চাচা, বিকেলে আসে আরেকবার, সঙ্গে ডাক্তার। ডাক্তারের কী, ভিজিটে এলেই বেশি পয়সা! সুতরাং বেশ খোশমেজাজেই ডাক্তার আসে, দুই মিনিটে আমাকে দেখে, ‘এই তো, ঠিক হয়ে গেছে’ বলে চা-টা খেয়ে বিদায় হয়। শামীম চার দিনই আসে। বিকেলে, স্কুল ছুটির পর। অন্য বন্ধুরাও আসে। তবে শামীমই থাকে অনেকক্ষণ। আর ওর সঙ্গে আমার জমে। আমি প্রতিদিন জিজ্ঞেস করি—কী রে, আজ শম্পার সঙ্গে তোর রাস্তায় দেখা হয়নি? শুধু এক দিনই, শেষদিন ‘হ্যাঁ’, বলে শামীম। বলে—নিচে দেখলাম। আমি একটু হাসলাম, কিন্তু এমন ভাব করল, যেন আমাকে চেনেই না। তুই প্রথমে হাসলি যে? খাতির জমাচ্ছিস নাকি? শামীম হাসে—না রে বাবা, তোর জিনিস। আমিও হাসি—আমার জিনিস আবার কী! আমার সঙ্গে প্রেম নাকি? তাহলে বলতে পারতি—আমার জিনিস। এখন ও হচ্ছে, কি বলা যায়… বারোয়ারি জিনিস? আমি মাথা দোলাই—ঠিক বলেছিস। বারোয়ারি জিনিস। যে চান্স নিতে পারে। তাহলে তুই আগে। তোর মুখে সব শুনে আমি একটা চান্স নেব। আমরা দুজন এই নিয়ে কতক্ষণ হাসাহাসি করি। আমি বলি—তোকে একটা কথা বলা হয়নি। কী, অলরেডি শম্পার ওপর চান্স নিয়ে ফেলেছিস? আরে না।…রামগোপালকে ঠিক করা হয়েছে। রামগোপালকে ঠিক করা হয়েছে মানে? শামীম বুঝতে পারে না। গান শেখানোর জন্য। আমি বলি। আমি বোধ হয় কাল-পরশু থেকেই রামগোপালের কাছে গান শিখতে আরম্ভ করে দেব। সত্যি? শামীম খুব খুশি হয়। দারুণ হবে। তবে তুই যেন এখনই সবাইকে বলতে আরম্ভ করিস না। আগে ভালো করে শিখে নিই…। শামীম খুব ভারিক্কি বলে—আকাশে চাঁদ উঠলে তখন সবাই দেখবেই, তাই না? আমি একটু হাসি। কিছু বলি না। হাফিজ চাচা আসলে একটা খুব ভালো মানুষ। হাফিজ চাচা! আমি যেন অবাক হয়ে যাই। হাফিজ চাচা কী করেছে? এই যে তোর গান শেখার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি গম্ভীর গলায় বলি—রামগোপাল স্যারকে আমার জন্য মা ঠিক করেছেন। আমার গম্ভীর গলা শামীম খেয়াল করে না। ও খুব সহজ গলায় বলে—সে বুঝলাম। খালাম্মাই করবেন। কিন্তু দৌড়াদৌড়ি তো হাফিজ চাচাই করেছেন, তাই না? রামগোপালের যে ডিমান্ড! তাকে রাজি করানোই কঠিন কাজ। হাফিজ চাচা না থাকলে খালাম্মা পারতেন বলে আমার মনে হয় না। আমি চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। তোর অসুখের সময়ও চাচা খুব দৌড়াদৌড়ি করলেন। ডাক্তার তো প্রথম দিনই বলে দিল আমার কিছু হয়নি। ডাক্তার ডাকারও কোনো দরকার ছিল না।…খামোখা। একসময় শামীম বলে—যাই রে এখন।…তুই তো কাল থেকে স্কুলে যাবি? অন্য দিন হলে আমি হয়তো শামীমকে থাকতে বলতাম। বাসায় এখন মা-ও নেই। স্কুলে কী এক জরুরি মিটিং আছে, মা ওখানে। বলে গেছে ফিরতে ফিরতে ৭টা-সাড়ে ৭টা বাজবে। শামীম চলে গেলে এতটা সময় আমাকে একা একা কাটাতে হবে। তবে এখন শামীমের সঙ্গে থাকার চেয়ে একা একা থাকতেই আমার ভালো লাগবে। আমি নীরস গলায় বলি—যাবি? ঠিক আছে। হুঁ, স্কুলে হয়তো কাল থেকেই যাব। শামীম চলে গেলে আমি জানালার পাশে বসি। জানালা গলিয়ে বাইরে অবশ্য দেখার তেমন কিছু নেই। তবু আর কী করা, আমি বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকি। আমার আগেও এ রকম মনে হয়েছে, এখনো মনে হয়, আসলে কারো সঙ্গেই আমার সম্পর্ক রাখার দরকার নেই। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার মানেই হচ্ছে ঝামেলা। একজন মানুষ যতই কাছের বন্ধু হোক না কেন, কখনো আরেকজনকে বুঝতে পারে না। হয়তো অন্য কোনো অর্থ না করে, সরল মনেই কিছু বলে, কিন্তু বোঝে না, যাকে বলা হয় তার কেমন লাগে। এত সব না না কথা শোনার চেয়ে একা একা থাকাই অনেক ভালো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। প্রথমে শুধু শব্দটাই আমার কানে আসে, তাই মনে হয় মা ফিরছে। পরমুহূর্তে বুঝি, মা না, মা ওভাবে কড়া নাড়ে না। হাফিজ চাচা? না, হাফিজ চাচার কড়া নাড়া আমি চিনি। তবে বলা যায় না, বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে আমি ভাবি, আর যেই হোক, হাফিজ চাচা যেন না হয়। এখন হাফিজ চাচার সঙ্গে কথা বলতে আমার এতটুকুও ভালো লাগবে না। কে জানে কেন, একবার আমার শম্পার কথাও মনে হয়। মনে হয়, বাড়ি খালি জেনে শম্পাই বোধ হয় সুযোগ নিয়েছে। সে রকম অবশ্য কিছু নয়। আমি দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো দেখি রামগোপালকে। খুব একটা অবাক হই না। কারণ রামগোপালের আসার কথাই আছে। আমি কিছু বলার আগে রামগোপাল বলেন—এটা কি কালাম সাহেবের বাসা? জি। কালাম সাহেবের বাসা। বাবু কে?…তুমিই বাবু, তাই না? আমি কিছু বলার আগে রামগোপাল আমাকে প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েন—হাফিজ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, বুঝেছ? শুনলাম তুমি খুব সুন্দর গাও। তাই হাফিজ সাহেবের কথায় রাজি হলাম। আমি চুপ করে থাকি। নইলে তুমি তো জানো নিশ্চয়ই, আমার সময় নেই। আমি চুপ করে থাকি। রামগোপাল বসতে বসতে বলেন—খুব ভালো না গাইলে আমার পক্ষে একদম নতুনদের সময় দেওয়া সম্ভব না। খুব ভালো যারা গায়, আমি তাদের জন্য ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করি। হাফিজ সাহেব তোমার কথা আমাকে খুব করে বলেছেন। আমি চুপ করে থাকি। আজ অবশ্য আরম্ভ করব না।…আমি কাল থেকে, না, কাল থেকে না, পরশু থেকে আসব। এই ধরো, সন্ধে ৬টার দিকে। আমি চুপ করে থাকি। তা, কী গান তুমি পছন্দ করো? হাফিজ সাহেব বলছিলেন…। স্যার। আমি বলি। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে স্যার। আমি স্যার গান শিখব না। মানে! রামগোপাল খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান। স্যার, হয়েছে কি—আমার মা আর হাফিজ চাচার খুব ইচ্ছা আমি গান শিখি। কিন্তু স্যার, গান শেখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই…। তোমার নাম বাবুই তো? জি, আমার কথাই হাফিজ চাচা বলেছে আপনাকে। কিন্তু স্যার, ধরে-বেঁধে কি গান হয়! আমি গান গাইতেও পারি না। খামোখা স্যার আপনার সময় নষ্ট হবে। রামগোপাল খুব গম্ভীর মুখে আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। একটু একটু করে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে—তুমি মিথ্যা কথা বলছ ছেলে। আমি গান শেখাই আজ প্রায় তিরিশ বছর। কে গান জানে, কে গান ভালোবাসে আর কে জানে না, কে ভালোবাসে না, সেটা আমি মুখ দেখে বুঝতে পারি। আমি ভেতরে ভেতরে নরম হলেও বাইরে শক্ত থাকার চেষ্টা করি—কিন্তু স্যার, আমার গান শেখার কোনো ইচ্ছাই নেই। সত্যি বলছি। মিথ্যা বলছ। আমি বুঝতে পারছি। তা ছাড়া হাফিজ সাহেব যেভাবে বলেছেন…। উনি আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছেন। রামগোপাল আমার দিক থেকে চোখ ফেরান না—তাহলে গান শেখার কোনো ইচ্ছা নেই তোমার? না স্যার, আমার কোনো ইচ্ছা নেই। গান আমার ভালো লাগে না। সেটা তোমার মা বা চাচাকে বলোনি কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। এটা কি ইয়ার্কি। আমার সময়ের কোনো দাম নেই? রামগোপাল কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও থাকেন না। আমিও দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আমার এতটুকু কষ্ট হয় না; বরং আমার আনন্দ হয় খুব। আমার মনে হয়, রামগোপালকে ‘না’ বলে দিয়ে হাফিজ চাচা, মা; আর যারা আমাকে নোংরা নোংরা কথা শোনায়, তাদের সবাইকে একহাত দেখে নিতে পেরেছি। এটা মা টের পায় না তিন-চার দিন। আমি আবার স্কুলে যেতে আরম্ভ করি। সব কিছু আবার আগের মতো। মাঝখানে একদিন মা বলে—তোর গানের মাস্টার যে কেন আসছেন না বুঝতে পারছি না! আমি প্রথমে ভাবি, এ কথার পিঠে কিছু বলব না। তবে একদম চুপ করে থাকাও বোধ হয় উচিত না। আমি বলি—কে জানে, যে ব্যস্ত মানুষ। না আসুক…। তোর হাফিজ চাচাকে একবার পাঠাতে হবে খোঁজ নিতে। কী দরকার। কী দরকার মানে! তোর গান শিখতে হবে না? থাক না, গানটান শিখতে আমার ভালো লাগে না। মা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। এবং এর দুদিন পর বিকেলে মা খুব গম্ভীর গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করে—রামগোপাল স্যারকে তুই কী বলেছিস বাবু? আমি তখন স্কুল থেকে ফিরেছি। মার কিছু দূরে আরেক চেয়ারে হাফিজ চাচা মুখ কালো করে বসে আছে। আমি আমতা আমতা করে বলি—আমি আবার কী বলেছি? তুই রামগোপাল স্যারকে বলে দিয়েছিস তুই গান শিখবি না? এখন আর এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার মা যখন জানেই তখন স্বীকার করারও প্রয়োজন নেই। এ কথা তুই কেন বলেছিস বাবু? আমার পক্ষে কি সে কথা বলা সম্ভব! আমি চুপ করে থাকি। মার গলা কান্না কান্না শোনায়—এ কথা তুই কেন বলেছিস বাবু! আমি মৃদু গলায় বলি—গান শিখতে আমার ইচ্ছা করে না। এটা তুই একটা কথা বলছিস বাবু! তোর গান শেখার এত ইচ্ছা! মা যেন আর্তনাদ করে। তুমি নাকি বলেছ তুমি গান গাইতে পারো না? হাফিজ চাচা জিজ্ঞেস করে। তখনই আমার রাগ হয়—পারিই না তো। তাহলে তোমার মা যে বলেছেন তুমি গান গাইতে পারো, সেটা কি মিথ্যা কথা বলেছেন? মাকে মিথ্যাবাদী বানানো যায় না। আমি চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি সেদিনই বলে দিতে, গান শিখবে না…। তখন ভেবেছিলাম শিখব। আমি ঝাঁঝালো গলায় বলি। এর মধ্যে এমন কী ঘটেছে যে তোর গান শেখার ইচ্ছা উবে গেল? রামগোপাল বাবুর কাছে আমাকে অপমান হতে হলো, তার কী হবে? এ দুই প্রশ্নেরই উত্তর আমার কাছে নেই। আমি চুপ করে থাকি। হাফিজ চাচা আবার বলে—তুমি রামগোপালকে বলেছ আমরা নাকি তোমাকে ধরে-বেঁধে গান শেখাচ্ছি? …আশ্চর্য বাবু, এসব মিথ্যা বলে তুমি…। তুমি কাল রামগোপাল স্যারের কাছে যাবে। মা কঠিন গলায় বলে। আমি চমকে যাই—রামগোপাল স্যারের কাছে যাবে মানে? কী বলেছি শুনেছ তুমি? তুমি রামগোপাল স্যারের কাছে যাবে। কেন? আমি মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করি। আমি তো গান শিখব না। তুমি শিখবে। মার গলা আরো কঠিন শোনায়। তবে তার আগের কথা, রামগোপাল স্যার তোমাকে এখন আদৌ শেখাবেন কি না।…তুমি বলো রামগোপালের কাছে যাবে। মাফ চাইবে তার কাছে। বলবে, সেদিন যা বলার তুমিই বলেছ, বলবে আমার বা তোমার চাচা সম্পর্কে যা বলেছ তা সত্যি নয়। আমি এমন কিছু বলিনি। আমি শুধু বলেছি, আমার গান শেখার ইচ্ছা নেই। তুমি কী কী বলেছ তার সব কিছুই রামগোপাল বাবু তোমার হাফিজ চাচাকে বলেছেন। হাফিজ চাচা বলে—কী অপমানই না তোমার জন্য আমাকে হতে হলো! আমার বলতে ইচ্ছা করে—আপনি কি তার চেয়ে বেশি কিছুর যোগ্য? আমি বলতে পারি না। তবে আমি কঠিন চোখে হাফিজ চাচার দিকে ঠিকই তাকিয়ে থাকি। এই লোকটাকে লক্ষ্য করে আমি একদিন অ্যাশট্রে ছুড়ে মেরেছিলাম। তখন ছোট ছিলাম আরো। তখন যদি অ্যাশট্রে ছুড়ে মারতে পারি, এখন আগের চেয়ে বড় হয়েছি, এখন কেন চেয়ার তুলে ছুড়ে মারতে পারি না? তখন ছোট ছিলাম বুঝিনি; এখন বড় হয়েছি, বুঝি, কাজটা উচিত হবে না, তাই? কিংবা এখানে উচিত-অনুচিতের প্রশ্নই বা উঠছে কেন? কাজটা অনুচিত নয় কখনো, এ তো জানাই। নাকি আমার সাহস হচ্ছে না? তখন বাবা ছিল পাশে, সাহস পেয়েছিলাম; এখন বাবা নেই পাশে, তাই সাহস পাচ্ছি না? আমি ঠিক বুুঝতে পারি না। কারণ আমার এমনও মনে হয়, আমি ও রকম কিছু ঘটালে তার পর থেকে হাফিজ চাচা যদি আর না আসে! আমি এ রকমই চাই, তবুু কেন এমন মনে হয় আমার, বুঝতে পারি না। হাফিজ চাচা বলে—তুমি কিন্তু অবশ্যই রামগোপাল বাবুর কাছে যাবে। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুমি যদি না যাও তাহলে উনি আমাকে সারা জীবন মিথ্যুক ভেবে বসে থাকবেন। আমি তো তা-ই চাই। আমি মনে মনে বলি। বাবু। মার গলা আগের চেয়ে নরম হয়েছে। তুই কাল গিয়ে স্যারের কাছে মাফ চেয়ে আসিস। এ ইচ্ছা আমার এতটুকু নেই। কিন্তু সেটা সরাসরি বলি কী করে! বাবু, তুই কিন্তু যাবি। নইলে তোর জন্য একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাবে। আমার বলতে ইচ্ছা করে—যেন আর কোথাও কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই। রামগোপাল বাবুর বাড়ি চেনো তো তুমি? হাফিজ চাচা জিজ্ঞেস করে। আমি মাথা দোলাই, চিনি। তাহলে আর অসুবিধা কী? কাল স্কুল ছুটির পর চলে যাও। আমি রাতে বাবাকে স্বপ্নে দেখি। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করে—তোর বুঝি মন খারাপ বাবু? আমি একটু হাসি—মন আমার কখনোই বা ভালো থাকে বলো!…তুমি আছ কেমন? আমার কথা পরে। আগে তুই বল তোর কী হয়েছে? তেমন কিছু না বাবা। আমার তো বলতে গেলে এমনিতেই মন খারাপ হয়। বাবা হেসে আমার পাশে এসে বসে। আজ বাবার পরনে নীল জোব্বার বদলে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। তবে এ পোশাকেও বাবাকে খুব সুন্দর লাগছে। বাবাকে আসলে, এই যে প্রায় রোজই দেখি স্বপ্নে, কখনো আমার অসুখী মনে হয় না। আর এটাই আমার মাঝেমধ্যে মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি জিজ্ঞেস করি—দেখে তুমি তো ভালোই আছ বলে মনে হচ্ছে বাবা। বাবা উদাস গলায় বলে—আছি এক রকম। কিন্তু তুই ভালো নেই শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা কে কেমন আছি, তাতে তোমার এখন কী-ই বা এসে-যায়। কী যে বলিস না! আমি তোদের সবার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকি। সবার জন্য? আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করি। হ্যাঁ, সবার জন্য। তোর জন্য, তোর মার জন্য, তোর হাফিজ চাচার জন্য। আমি গম্ভীর গলায় বলি—হাফিজ চাচাকে আমার এতটুকু ভালো লাগে না বাবা। বাবা হেসে ফেলে—এই এক কথা তুই কতবার বলবি! বাবার ওপর আমার রাগ হয়। আমি বারবার এই এক কথা বলি? আর কেনই বা বাবার পছন্দ হবে হাফিজ চাচাকে! আমি সে কথাই জিজ্ঞেস করি বাবাকে—হাফিজ চাচাকে তোমার পছন্দ হওয়ার কী কারণ? তার আগে তুই বল, কেন ওকে তোর পছন্দ হয় না। কেন হাফিজ চাচা আমাদের বাসায় রোজ রোজ আসবে? বাবা হেসে ফেলে—এটা একটা কারণ হলো? মার সঙ্গে ওনার এত কিসের কথা? বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে—তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। হাফিজ যে আসে, তাতে কি তোর মা তার ওপর রাগ করে কিংবা বিরক্ত হয়? আমি আমতা আমতা করি—না, তা অবশ্য না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে হাফিজের আসাটা তোর মা পছন্দই করে। তাই না? তবে এ নিয়ে মার ওপর রেগে যাওয়ারও কোনো কারণ নেই তোর। তোর মারও তো কথা বলার মানুষ লাগবে। একা একা তোর মা…। আমি এবার বাবার ওপর রেগে যাই—মা একা কোথায়? আমি নেই? তুই আছিস। বাবা আবার হাসে। কিন্তু বল তো বাবু, তোর বাবা—অর্থাৎ আমি নেই বলে তোর কখনো একা লাগে না? লাগে বাবা, লাগে। আমি তখনই বলি। তোর মা আছে, তবু আমি নেই বলে তোর যদি একা লাগতে পারে, তবে তুই থাকা সত্ত্বেও আমি নেই বলে তোর মার কেন একা লাগবে না? আমি এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে পারি না। আসলে বাবু, মানুষের একেক রকম একলা লাগা আছে। বুঝলাম। কিন্তু এগুলো সব মায়ের পক্ষে যুক্তি। আমি কেন হাফিজ চাচাকে অপছন্দ করতে পারব না? অপছন্দ করতেই পারবি না, তা নয়। তাকে অপছন্দ করার তোর কী কারণ? সে এ বাসায় রোজ রোজ আসে, তোর মার সঙ্গে অনেক অনেক গল্প করে, এই তো? কিন্তু বলেছিই আমি, হাফিজের আসাটা তোর মা পছন্দ করে বলেই ও আসে। শুধু এই? আমি রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করি। হাফিজও নিশ্চয়ই তোর মাকে খুব পছন্দ করে। নইলে রোজ কেন আসে? তাই না? তুমি এই কথা বলছ? আমি আবার রেগে যাই। আমি তোর মাকে পছন্দ করতাম না? তুই তোর মাকে পছন্দ করিস না? তুমি তো করতেই, কী আশ্চর্য, আমিও তো করি। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? বাবা হাসে—তাহলে হাফিজ কেন তোর মাকে পছন্দ করতে পারবে না? পাল্টা যুক্তি খুঁজে না পেয়ে আমি চুপ করে থাকি। তুই বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়েছিস। এত সহজে এমন উতলা হয়ে যাস…। লোকজন বাইরে খুব আজেবাজে কথা বলে, বাবা। যারা বাজে কথা বলে তারা কিছু না হলেও বলবেই। এই তুমি শম্পার কথাই ধরো না কেন। ও মা আর হাফিজ চাচাকে নিয়ে কী বাজে কথা যে বলে! বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে—শম্পা মেয়েটা ভালো না। আমি সেটা জানি বাবা। তুই ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবি। আমি তো তা-ই করি বাবা। নইলে যে কথা ও বলে…। ও আসলে আজেবাজে কথা বলে তোকে খেপাতে চাচ্ছে! আমারও তা-ই ধারণা। সুতরাং শম্পা কী বলছে তা নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর কোনো দরকর নেই। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলি—শম্পার কথা না হয় বাদই দিলাম বাবা। কিন্তু শুধু শম্পা কেন? আরো কতজন কত কথা বলে! বাবা গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে—আমি বুঝতে পারছি না তোকে কী বলব। এখন লোকজন কী বলছে তা শুনতে গেলে আমার হাফিজের বিরুদ্ধেই যেতে হয়। কিন্তু হাফিজের বিরুদ্ধে যাচ্ছি না আমি…। বাবা, সত্যি করে বলো তো। হাফিজ চাচার ওপর তোমার এতটুকু রাগ হয় না? বাবা হেসে ফেলে—তুই যে কী সব জিজ্ঞেস করিস না! হাফিজের ওপর আমি কেন রাগ করতে যাব বল? তা ছাড়া আমি যেখানে আছি, সেখানে থেকে সব কিছু আসলে যেমন, ঠিক তেমন দেখা যায়। অর্থাৎ বলতে পারিস, আমরা একদম সাদা চোখে দেখতে পাই। আমাদের দেখার সঙ্গে কোনো আবেগ, অভিমান, ভালোবাসা, লজ্জা, ঘৃণা—কিছুই মিশে থাকে না। বাবা, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি বলছ—হাফিজ চাচা আর মার ব্যাপারটা আমি আবেগ আর অভিমান মিশিয়ে দেখছি, যেভাবে দেখা উচিত, সেভাবে দেখছি না, এই তো? একটু হাসে বাবা—আমি আসলে তোকে উদ্দেশ করে কিছু বলিনি। আমি আমার কথাই বলেছি। তবু তুইও ভুল বলিসনি কিছু। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলি—না বাবা, তোমার সঙ্গে কথা বলে আজ আমার মন তেমন ভালো হলো না। কেন কেন? বাবা খুব অবাক হয়ে তাকায়। তুমি আমাকে বুঝলে ঠিকই, কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারলে না। বলো, এভাবেই চলবে? বাবা গম্ভীর মুখে মাথা দোলায়—তা-ও ঠিক তা-ও ঠিক। এভাবে আর কত দিন চলে…কিন্তু কী বলি তোকে? বাবা যেন ভাবতে বসে আর আমার ঘুম ভেঙে যায়। রামগোপাল স্যারের বাসায় না যেয়ে আমি দুদিন পার করে দিই। তৃতীয় সকালে মা অবশ্য আমাকে ঠিকই ধরে—বাবু, আমার কথাটা তুই এখনো শুনিসনি! কোন কথা, মা? আমি না-বোঝার ভান করি। রামগোপাল স্যারের বাসায় তুই এখনো যাসনি। আমি খুব সহজ গলায় বলি—যাব মা, গেলেই তো হলো। আমার ইচ্ছা না যেয়ে কয়েক দিন পার করে দেওয়া। তাহলে হয়তো মা আর হাফিজ চাচা দুজনেই ভুলে যাবে। আমার আর যাওয়া লাগবে না। মা বলে—তুই আজ বিকেলে যাবি। যদি না যেতে চাস, আমাকে সরাসরি বলে দে। আমি নিজে যাব। ঠিক আছে মা। আমি বলি। আজ বিকেলেই যাব। আমি তা-ই করি। স্কুল ছুটির পর শামীম আমাকে আটকাতে চায়। আজ একটা ফুটবল খেলা আছে স্কুলের মাঠে। শামীম খেলবে এক দলে। অন্য দলও খুব শক্তিশালী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। শামীমের ইচ্ছা আমি খেলাটা দেখি। আমি বলি—কিন্তু আমাকে যে জরুরি কাজে এক জায়গায় যেতেই হবে। রামগোপাল স্যার সেই কবে কথা দিয়েছেন, কিন্তু এখনো আসতে আরম্ভ করেননি। আমি একটু খবর নিতে যাব কেন তিনি আসছেন না। শামীম তখন ছেড়ে দেয়। আমিও স্কুল থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করি। এখন একটা অস্বস্তিকর কাজ করতে হবে, এটা মনে হলেই আমার ভালো লাগে না। রামগোপালকে গিয়ে কী বলব আমি? তার চেয়ে আমার নামে হাফিজ চাচা যা ইচ্ছা তা-ই বলে দিত, তাহলেই ঝামেলা মিটে যেত। বলে দিত—আমি মিথ্যাবাদী, একটু পাগলা ধরনের। ব্যস, আমার আর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। অবশ্য আমার যাওয়ার প্রয়োজন আমি এখনো দেখি না। শুধু মার কারণে। নইলে আবার কে রামগোপালের মুখোমুখি হয়! রামগোপালের বাসা স্কুলের একদম কাছেই। হেঁটে গেলে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। আমি যাই আর ভাবি—রামগোপাল যেন বাসায় না থাকে। তাহলে মাকে আমি বলতে পারব—গিয়েছিলাম তো, কিন্তু বাসায় ছিলেন না। আবার যাব। এভাবে কয়েকটা দিন পার করে দিতে পারলে বেশ হয়। আমার আসলে রামগোপালের মুখোমুখি হতে লজ্জা লাগছে। আমার ভাবনা অবশ্য সত্য হয় না, রামগোপাল বাসায় আছে। এ বাড়িটা অদ্ভুত। এক বন্ধুর সঙ্গে আমি আগেও একবার এসে দেখেছি। বাড়ির সদর দরজা নাকি সব সময় খোলাই থাকে। আজও তা-ই দেখি। আমি আলগোছে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কাশির ভঙ্গি করি। কেউ আসে না। আমি আরেকটু ভেতরে ঢুকি। আমার বয়সী এক ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করি—স্যার আছেন? সে ছেলে—হ্যাঁ, আছেন, গান শেখানোর ঘরে—বলে বেরিয়ে যায়। আমি আরেকটু এগিয়ে ডানদিকে ঘুরি। একটা আধা-ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝি—এটাই গান শেখানোর ঘর। দরজার ঠিক পাশেই রামগোপাল বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে আরো তিনজন। এ ঘরটা বেশ বড়। ঘরের ওই কোণে সাত-আটজন ছেলে শতরঞ্জি বিছিয়ে হারমোনিয়াম, তবলা নিয়ে বসে আছে। রামগোপালের সঙ্গে যারা বসে আছে, তারা তার বন্ধু, বোঝা যায়। তবে তারা উঠব উঠব করছে। একজন বলে—তোমার এখন প্যাঁ-পোঁ আরম্ভ হবে। আমরা উঠি। তা তোমাদের উঠতেই হবে। তার আগে মজার কথাটা শুনে যাও। সেই কখন থেকে বলতে চাচ্ছি। এতক্ষণে কতবার যে বলে ফেলতে পারতে। সেই তখন থেকে বলি বলি করছ। শোনো, বলি। কয়েক দিন আগে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। বলেন, আমার এক ছেলে আছে, তাকে গান শেখাতে হবে। পরে অবশ্য নিজেই বলেন, আপন ছেলে নয় তার, তবে ছেলের মতোই। তা ভদ্রলোকের পীড়াপীড়িতে আমি রাজি হলাম। ওই ছেলের বাসায় গেলামও একদিন। কিন্তু ছেলে বলে দিল, সে গান শিখবে না। গান তার ভালো লাগে না, গান সে শিখতে চায় না। শুনে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি তাড়াতাড়ি দরজার আরেকটু আড়ালে সরে যাই। রামগোপালের এক বন্ধু বলে—এটা তোমার মজার কথা? ছেলেটার মুখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম, ছেলেটা গান জানে। কিন্তু ছেলেটা রাজি হলো না কেন, বলো তো? কে জানে! কিন্তু তোমার কথার মধ্যে কোনো মজা খুঁজে পাচ্ছি না। রামগোপাল বোধ হয় হাসে—আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছি। ছেলেটা হচ্ছে কালাম সাহেবের। ওই যে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ ডিভিশনে কাজ করতেন। আর যে লোক আমার কাছে এসেছিলেন, তার নাম হচ্ছে হাফিজুর রহমান। ওই রেলওয়েতেই আছেন। বুঝতে পারছ? সামান্যক্ষণ সবাই নীরব। তার পরই হাসির রোল পড়ে যায়। একজন বলে—হাফিজ সাহেবের বোধ হয় খুব ইচ্ছা তার প্রেয়সীর ছেলে গান শিখুক। কিন্তু ছেলে বোধ হয় তাকে দেখতে পারে না। আরেকজন হাসতে হাসতেই বলে—হাফিজ সাহেব এসে প্রথমে কী বলেছিল? তার নিজের ছেলে? তা, হতেও পারে বাবা নিজের ছেলে। সেই কবে থেকে ঢলাঢলি। চেহারাও তো মনে হয় একই রকম। আমার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমার যেন মাটির সঙ্গে পা বাঁধা, আমি পা ছাড়িয়ে নিতে পারি না। রামগোপাল বলে—হাফিজ সাহেবের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোক খুব যেন লজ্জা পেয়েছেন…। নাকি কষ্ট পেয়েছেন? খায়েশ পূর্ণ হলো না বলে? কে একজন বলে। ঘরের সবাই আবার হাসতে আরম্ভ করে। আমার ইচ্ছা, দরজা ঠেলে আমি সোজা ঢুকে যাব ভেতরে। রামগোপালের গালে খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দেব। আর লাথি মেরে সবাইকে ফেলে দেব চেয়ার থেকে। কিন্তু আমার কিছু করা হয় না। শাহাব আমার দিকে খুব কৌতূহল নিয়ে তাকায়—কী রে বাবু, হঠাৎ করে তুই? শাহাবকে খুঁজে পেতেই আমার বেশ কিছুটা সময় গেছে। শেষে ওকে পেলেও ওর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিল না। শেষে আমার নাম জেনে নিয়ে ওদেরই একজন শাহাবের সঙ্গে কথা বলে এসে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি, শাহাব দুজনের সঙ্গে মদ খাচ্ছে। একজনকে আমি চিনতে পারি, আকবর কন্ট্রাক্টর, অন্যজন বোধ হয় পুরনো আর কাটা কাপড়ের ব্যবসা করে, নাম জানি না। তারা দুজন আমাকে দেখে একটু যেন অস্বস্তিতে পড়ে। শাহাব তাদের আশ্বস্ত করে। আমি গম্ভীর গলায় বলি—আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে, শাহাব ভাই। খুব জরুরি? শাহাব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে। হ্যাঁ। আমার একটা ঝামেলা হয়েছে। তাহলে একটু অপেক্ষা কর তুই। হুইস্কি খাবি? না, থাক, তোর হুইস্কি খাওয়ার বয়স হয়নি। তুই সিগারেট খা। শাহাব আমার হাতে এক প্যাকেট দামি সিগারেট দিয়ে বলে—যা, তুই ওই বিছানায় বসে সিগারেট খা। আমি এদের কথাটা একটু শুনে নিই। আমি ঘরের আরেক কোণে এসে বিছানার ওপর বসে বিরস মুখে সিগারেট টানতে আরম্ভ করি। শাহাব উঠে আসে মিনিট পনেরো পর—ওই দুই শালা বোধ হয় সহজে যাচ্ছে না। তোর কথাটা শুনি। আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে শাহাব ভাই। শাহাব হাসে—শালা, সবাই আমার কাছে শুধু কাজের জন্য আসে। কত দিবি? আমি থতমত খেয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকি। শাহাব আবার হাসে—থাক, তোকে কিছু দিতে হবে না। কাজটা কী, তা-ই বল। একজনকে একটু টাইট দিতে হবে। সবাই শালা আমার কাছে এই কাজ নিয়েই আসে। কাকে টাইট দিতে হবে, কেন টাইট দিতে হবে, তা-ই বল। একজন আমাদের খুব জ্বালাচ্ছে। আমাদের মানে, তোকে আর কাকে? আসলে আমাদের বলা উচিত না। কারণ আমার মাকে জ্বালাচ্ছে। তবে মাকে জ্বালালে আমিও তো বাইরে থাকি না। এবার শাহাবকে একটু সিরিয়াস দেখায়—তোর মাকে জ্বালাচ্ছে মানে? খুলে বল। আপনি তো জানেন আমার বাবা নেই।…বাবার এক কলিগ রোজ আমাদের বাসায় আসে। মা এত করে না করে, শোনে না। উল্টো হুমকি দেয়। আমি আর মা সব সময়ই খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেলি। শাহাব যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়—আরে ছেলে, কাঁদিস কেন! শোন তোর আশপাশের কাউকে বলিসনি? এসব কথা কি সবাইকে বলা যায়? উল্টো আমাদেরই দোষ দেবে। হুঁ।…তা আমাকে কী করতে বলিস? সেটা আপনি ভালো বুঝবেন। লোকটা খুব ত্যাঁদড়…। ধরে ওয়ার্নিং দিয়ে দেব না সোজা পেটাব? আমি একটু ভাবার ভান করি—না, আমার মনে হয় পিটান খাওয়াই উচিত। ঠিক আছে।…তুই এখন একটু হুইস্কি খা। শাহাব বলে। তোর অবশ্য খাওয়ার বয়স হয়নি। তবে এক দিন খেলে কিছু হবে না। আজ আবার তোর মন খারাপ। …তুই খা, আমি ওই লোক দুটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলি। শাহাব আমার হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দেয়। প্রথমে আমার খেতে ইচ্ছা করে না। তারপর একটু দ্বিধায় থাকি খাব কী খাব না। মা যদি জানে, ভীষণ কষ্ট পাবে। আবার মনে হয়, খাব না কেন, কেন খাব না? না খাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক ঢোক হুইস্কি খেয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে আমার গলা আর বুকের ভেতর যেন জ্বলে-পুড়ে যায়। আমার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, পেটের ভেতর থেকে সব কিছু যেন মোচড় দিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। মানুষ এ জিনিস কী করে খায়! আবার আমার এমনও মনে হয়, এ জিনিসই আমার খাওয়া উচিত। কারণ এত কষ্ট বোধ হয় আমার আর কিছুতে হবে না। আমি বড় করে আরেকটা ঢোক খেয়ে ফেলি। মিনিট বিশেক পর শাহাব আবার আসে—কী রে, আরো খাবি? হ্যাঁ, আরেক গ্লাস। আমি তখনই বলি। শাবাশ। তবে দেখিস। শাহাব গ্লাসটা ভরে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়—নে, ধর।…ঠিক করলাম ওই লোককে পিটিয়ে দেব। এমন পিটান দেব, যেন তোদের বাড়ির আশপাশ দিয়েও না যায়।…নাম-ঠিকানা দে। আমি হাফিজ চাচার নাম বলি, ঠিকানা দিই। তারপর শাহাবকে বলি—কিন্তু আমি যে ঘটনার পেছনে আছি সেটা যেন টের না পায়। শাহাব—পেলে কি তোকে ধরবে? আরে শালা, আমি আছি না! তখন ওই ব্যাটাকে আমি একদম খুন করে ফেলব।…ভাবিস না মাতাল হয়েছি। আমি একটু হেসে বলি—এটুকু খেয়ে কি আপনি আর মাতাল হবেন! তা, কবে পেটাবেন ওই লোককে? শাহাব বলে—মাতাল যে হইনি, তার আরেকটা প্রমাণ দিই। তুই ওঠ এখন, তোর আর খাওয়া লাগবে না। আর শোন, আজ রাতে তুই পুরো ব্যাপারটা ভাব। তারপর কাল যদি এসে বলিস ওই লোককে পেটাতেই হবে, তখন পেটাব। আমি তখনই লাফিয়ে উঠি—না না, শাহাব ভাই, ওই লোককে পেটাতেই হবে। খুব জ্বালাচ্ছে। সত্যি বলছি। তা তুই বলছিস বটে। শাহাব বলে। তবে আবার কেমন কেমন যেন করছিসও। যেন বুঝতে পারছিস না ওই লোক মার খাওয়ার মতো অপরাধ করেছে, কী করেনি। আমার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। শাহাব আমার কাঁধে হাত রেখে—আমার ওপর রাগ করিস না। আমি তোকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখি। আজকের রাতটা যাক, তুই কাল এসে যদি বলিস মারতে হবে, আমি সত্যিই তা-ই করব। তুই যা বলবি, তা-ই করব। ঠিক আছে? শাহাব বলেছিল, বেশ কিছুটা রাস্তা সঙ্গে কাউকে দিয়ে দেবে। আমি রাজি হইনি। বেশ কিছুটা রাস্তা বটে, মাথাও একটু ঝিম ঝিম করছে, তবু কাউকে সঙ্গে নেওয়ার দরকার নেই আমার। শাহাবের এক ছেলে অবশ্য রিকশা ঠিক করে দেয়। রিকশাঅলাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় আমাকে কোথায় নামাতে হবে আর আমাকে বলে দেয় রিকশার ভাড়া দিতে হবে না। রিকশা খোলা রাস্তায় এসে পড়লে চারদিকে প্রচুর বাতাস। আমার একটু নেশা নেশা লাগে। মাঝেমধ্যেই মাথা নুয়ে পড়তে চায়। আমি মাথা জোরে ঝাঁকিয়ে নিয়ে টানটান হয়ে বসি। আমার শাহাবের ওপর একটু একটু রাগ হয়। আমি যে বললাম, হাফিজ চাচাকে মারতে হবে, সেটা ওর পছন্দ হলো না? আমাকে নাকি আরেক দিন ভেবে দেখতে হবে! যত্তসব, যেন এত দিন ধরে আমি কিছুই ভাবিনি। ঠিক হায়, তা-ই হবে, কাল স্কুল ছুটির পরই আমি চলে আসব শাহাবের এখানে। বলব—হ্যাঁ, কাল রাতে আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। লোকটাকে পেটাতেই হবে। তবে শাহাবকে অবশ্য বারবার বলে দিতে হবে, হাফিজ চাচা যেন কোনোমতেই বুঝতে না পারে, আমি আছি এর পেছনে। শাহাব যদি আমার পাশে থাকে, তবে হাফিজ চাচা কিছু করতে পারবে না ঠিক, কিন্তু বাসায় আমার কী অবস্থা হবে? তবে যদি এমন হয়, হাফিজ চাচা জেনে যাবেই, তাকে না জানিয়ে কাজটা সারার কোনো উপায় নেই, তবু আমি পিছপা হব না। হাফিজ চাচার হাত-পা ভাঙা বা মাথা না ফাটা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। তারপর ধরতে হবে রামগোপালকে আর তার ওই বন্ধুকে। আমি নাকি হাফিজ চাচার ছেলেও হতে পারি, আমাদের চেহারা নাকি একই রকম—এ কথা রামগোপালের যে বন্ধু বলেছে, তার নাম আমি জানি না, তবে তার মুখ চিনে রেখেছি। এই ছোট শহরে তাকে খুঁজে বের করব, শাহাবকে বলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব শাহাবের আড্ডায়। তারপর এমন এক থাপ্পড় মারব, ওই লোকের সব দাঁত পড়ে যাবে, সব! রেলওয়ে কলোনির কাছাকাছি এসে আমি রিকশা ছেড়ে দিই। রিকশাঅলা একটু ইতস্তত করে, তাকে নাকি বলা হয়েছে একদম আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে নামিয়ে দিতে। আমি তাকে বলি—আপনি যান, আমার এখানেই দরকার। এখান থেকে অবশ্য আমাদের বাসা হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আমি আসলে এমনিতেই একটু আগে নামতে চাই। বেশ একটু নেশা নেশা হয়েছে। এখন হাঁটতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। সত্যি তা-ই। আমি হাঁটতে গিয়ে দেখি, আমার পা একদম ঠিকমতো পড়ে না। অন্য কেউ হয়তো বুঝবে না, কিন্তু আমি বুঝি। যেখানে আমি পা ফেলতে চাচ্ছি সেখানে পড়ছে না। এটাও অবশ্য এক ধরনের মজা। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে আমি আমাদের বিল্ডিংয়ের কাছে পৌঁছে যাই। নিজেকে আমার খুব হালকা মনে হয়। তবে আমি যে একদম হুঁশ হারিয়ে ফেলেছি তা-ও নয়। আমি সব কিছুই বুঝতে পারছি। কিন্তু এ-ও ঠিক, নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। নিজের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে, নাকি আরো হারিয়ে যায়, যখন দেখি আমি দাঁড়িয়ে আছি শম্পাদের বাইরের ঘরের জানালার সামনে। সেই সেদিনের মতো শম্পা জানালার গায়ে শরীরের সামনের দিক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী রে রাঙামুলো, অমন হেঁড়ে গলায় ডাকলি কেন আমাকে? শম্পা জানতে চায়। ওকে আমি ডেকেছি, সেটা আমার খেয়াল হয় না। হয়তো ওই থামিয়েছে আমাকে। এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে ব্যাপারটা। আমি বলি—আমি কখন ডেকেছি তোকে? আর আমি ডাকলেই তুই ছুটে আসবি মর্দানি? অনেক দিন তোকে দেখি না মাগি। শম্পা হাসিমুখে বলে। না, দেখেছি, তবে কথা হয়নি তোর সঙ্গে। তাই তোর ডাক শুনে কেমন উতলা হয়ে গেলাম। শম্পা কথা শেষ করে বিষচোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তুই একটা খানকি। তোর উতলা হলেই বা কী, না হলেই বা কী। তবু তোর মতো হিজড়া না আমি। শালা, কাল থেকে যদি এটা আমি ছড়াতে না আরম্ভ করি…। দেখবি, দেখবি তুই আমি হিজড়া না কী? ওখানে থেকেই দেখাবি না ঘরে এসে দেখাবি? কিভাবে দেখতে চাস তুই? হুঁ, সাহস কত! দরজা খুলেই দেখ না সাহস আছে কী নেই। পারিস তো শুধু প্যাটপ্যাট করতে। আরে, তুই কী করবি রে দরজা খুললে। তোকে আমি চিনি না? আজ চিনিয়ে দেব। তুই দরজা খোল, দেখি তোর সাহস কত। শম্পা যেন একটু ভাবে—আরে যা, খুলছি দরজা, তুই দেখাবি সাহস…! শম্পা সত্যিই জানালা থেকে সরে গিয়ে দরজা খুুলে দুপা বেরিয়ে আসে। আমিও এগিয়ে যাই। শম্পা বলে—তুই ভেবেছিস তোর মতো হিজড়াকে ভয় পাই আমি! আমি দেরি না করে একটা কথাও না বলে মুহূর্তের মধ্যে শম্পাকে জড়িয়ে ধরি। শম্পা হঠাৎ করে এতে অবাক হয়ে যায়, কিছুই ও করে না। আমি এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত রাখি ওর বুকের ওপর। হাতের চাপ বাড়াতে বাড়াতে বলি—দেখেছিস, আমার সাহস দেখেছিস হারামজাদি! এ কথায় যেন সম্বিত ফিরে আসে শম্পার। ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়—ছাড় হারামজাদা, ছাড় আমাকে। কিন্তু আমি ছাড়ি না। তবে এভাবে বেশিক্ষণ যায়ও না। আমাদের দুজনের ধস্তাধস্তি হয় এবং একসময়, কয়েক মুহূর্ত পর, শম্পা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে। একটু দূরে সরে গিয়ে বাসার ভেতর ঢুকে শম্পা হাঁপায়—হারামজাদা, তুই কি ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দেব? ছাড়বি কেন? আয় না, আবার ধর আমাকে। শম্পা হাত তোলে—এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব। দিবি? আয়, বাইরে এসে দে। দেখিস, দেখিস হারামজাদা তোর কী আমি করি। আয়, বাইরে এসে দেখ কে কার কী করে। কথা বলতে বলতে আমি ওকে ধরার জন্য হাত উঠিয়ে এক পা গেলেই শম্পা দরজা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বলে—হারামজাদা, তুই ভাবিস না তোকে আমি ছেড়ে দেব। আমি একটু হাসি। আর দাঁড়াই না। হাসিমুখেই আমি ওদের সিঁড়ির কাছ থেকে বেরিয়ে আসি। আমার এই হাসিটা অবশ্য একটুও স্থায়ী হয় না। আমাদের সিঁড়িতে পা রাখতে না রাখতেই আমার মুখ শুকিয়ে যায়। কাজটা উচিত হলো? শম্পা একটা বাজে মেয়ে, ওর সঙ্গে এসব করা নিশ্চয়ই আমার উচিত না। তা ছাড়া ও যখন বলেছে, ছাড়বে না আমাকে, তখন ঠিকই কিছু একটা করবে। এসব ভেবে হঠাৎ আমার কান্না পায়। এ আমি হঠাৎ করে কী করে বসলাম! মা দরজা খুললে আমি তাকে ঠেলে প্রায় দৌড়ে যাই বাথরুমে। মা দরজা বন্ধ করে অবাক হয়ে আমার পেছনে পেছনে আসে—কী রে বাবু, কী হয়েছে তোর?…এত রাত পর্যন্ত তুই কোথায় ছিলি? আমি বেসিনের কল ছেড়ে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে বলি—কিছু না, মা। স্কুলে খেলা ছিল। তারপর শামীম জোর করে নিয়ে গেছে ওদের বাসায়। ওর গোলে জিতেছি তো, তাই ও এত খাওয়াল যে এখন একদম বমি বমি লাগছে। আবার জ্বর আসেনি তো? মার গলায় উত্কণ্ঠা। না না, জ্বরটর আসেনি। এখন এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ব। মা যেন একটু স্বস্তি বোধ করে—ভাত খাবি না? না না, বললাম না শামীমের ওখানে খেয়ে এসেছি। বাথরুম থেকে আমি খুব সহজ মুখে বেরোনোর চেষ্টা করি। খাবার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস পানি খাই। তারপর ঢুকে যাই নিজের ঘরে। তখনই অবশ্য দরজা বন্ধ করে দিই না। মা আমার পেছনে পেছনে আসে—কত দিন তোকে বলেছি রাত করে বাড়ি ফিরবি না, আমার চিন্তা হয়!…আমার কথা এখন আর তুই একদম শুনিস না বাবু। মা অবশ্য আর কিছু বলে না। দরজার পাশ থেকে সরে যায়। আমিও তখনই উঠে দরজা বন্ধ করে দিই। আলো নিভিয়ে সোজা চলে যাই বিছানায়। আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। ভোরবেলা কড়া নাড়ার তুমুল শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার শরীরে ক্লান্তি, মাথাটাও কেমন ধরে আছে। এর মধ্যে ওই কড়া নাড়ার শব্দ আমাকে খুব বিরক্ত করে। এই ভোরবেলা কে এসেছে, আর কেনই বা অমন ঝড়ের মতো কড়া নাড়ছে! আমাকে অবশ্য বিছানা ছেড়ে উঠতে হয় না। মা দরজা খোলে এবং তখনই আমি মার গলা শুনি—কী ব্যাপার, শম্পা। মুহূর্তের মধ্যে আমার শরীর হিম শীতল হয়ে যায়। বিছানা না ছেড়েও আমি বুঝতে পারি, শম্পা ঘরে এসে ঢুকেছে। বাবু কোথায়? ও গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে। বাবু? মা বোধ হয় একটু অবাক হয়। বাবু বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। আমি বাবুর নামে আপনার কাছে একটা নালিশ করতে এসেছি। বাবু এখানে আসুক। মা যেন বুঝতে পারে না—বাবুর নামে নালিশ? হ্যাঁ, বাবুর নামে নালিশ। ওকে ডাকেন। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে—ডাকতে হবে না। আমার কাছে নালিশ যখন, তুমি আমাকেই বলো। বাবু কাল রাতে আমার বুকে হাত দিয়েছে। মার চেহারা কেমন হয়েছে সেটা আমি না দেখেও বুঝতে পারি। তবে মা, যেন শম্পা কী বলেছে তা শোনেনি, এমনভাবে জিজ্ঞেস করে—কী? কিংবা এমনও হতে পারে, শম্পা যা বলেছে তা তার বিশ্বাস হয়নি। তাই আবার জানতে চাচ্ছে—কী? বাবু কাল রাতে জোর করে আমার বুকে হাত দিয়েছে। মাকে আর কিছু বলতে শুনি না। শম্পা একটু পর বলে—আপনি এর বিচার করুন। মা ঠাণ্ডা গলায় বলে—করব। এখনই করুন। বাবুকে ডাকুন। কেন ও আমার বুকে হাত দেবে? মা আগের মতোই ঠাণ্ডা গলায় বলে—তুমি আমার কাছে নালিশ করেছ, এখন বিচার আমি কখন করব সেটা আমার ব্যাপার। তুমি এখন যাও। ঠিক আছে, যাচ্ছি। তবে বিচার যদি না করেন তবে আমি কিন্তু ছেড়ে দেব না। এরপর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পাই। তারপর সব চুপচাপ। কোথাও একটা শব্দও পাই না। মা কোথায় কী করে, আমি বুঝতে পারি না। আমার শুধু মনে হয়, কী করে আমি আবার মার মুখোমুখি হব! আমার মনে হয়, বাড়ি থেকে এবার সত্যিই পালিয়ে যাব। আমার মনে হয় আত্মহত্যা করব। আমার কান্না পায়। আমি সত্যিই কাঁদতে আরম্ভ করি। ঘণ্টা দেড়েক পর মা এসে আমাকে ডাকে—বাবু, উঠেছিস, আর কতক্ষণ ঘুমাবি! আমি কথা না বলে চুপ করে থাকি। বাবু, বাবু…ওঠ। বেলা হয়েছে। আমি কোনো কথা বলি না। বাবু…মার গলা একটু অস্থির শোনায়। হ্যাঁ, মা। আমি হঠাৎ করেই বলি। খুব সহজ গলায়। ওঠ। উঠে পড়। স্কুলে যেতে হবে না। আমি তখনই উঠে পড়ি। হাত-মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে এমনভাবে নাশতা খেতে বসি, যেন কিছুই হয়নি। মা টুকটাক কিছু কথা বলে। একসময় শুধু জিজ্ঞেস করে—রামগোপাল স্যারের ওখানে গিয়েছিলি? গিয়েছিলাম। বাসায় ছিলেন না। আজ আবার যাব। যাস। মা ছোট করে বলে। আরো দু-একটা কথা বলে মা। কিন্তু সেগুলো খুবই সাধারণ। মা শম্পার ব্যাপারটা নিয়ে একটা কথাও বলে না। আমি স্বস্তি বোধ করি। কিন্তু মা যখন বেরিয়ে যায়, মা যে শম্পার ব্যাপারে কিছুই বলল না—এটাই আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মার স্কুলে কী জরুরি কাজ আছে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বেরিয়ে যায়। আমি তখন বাসায় একা। আমি বুঝতে পারি না মা কেন কিছু বলল না। একবার মনে হয়, মা বোধ হয় শম্পার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তাই বা কী করে হয়! কিছু না ঘটলে একটা মেয়ে সরাসরি ওভাবে কিছু বলতে পারে না। শম্পা যতই হালকা স্বভাবের বাজে ধরনের মেয়ে হোক না কেন, আমি কিছু না করলে ওর খামোখা নালিশ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কি মা শম্পার কথা বিশ্বাস করেছে ঠিকই, তবে ভেবেছে ও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে? কিন্তু বাড়িয়ে কী বলবে, ও তো সরাসরিই বলেছে আমি ওর বুকে হাত দিয়েছি। সত্যি না হলে শম্পার মতো মেয়েও বুকে হাত দেওয়ার কথা বলে না। তবে কি মা আমি লজ্জা পাব বলে কিছু বলেনি? হ্যাঁ, এ রকম হতে পারে, আমার মনে হয়। মা আমাকে খুব ভালোবাসে। মা হয়তো ভেবেছে, হঠাৎ একটা ভুল হয়ে গেছে আমার, তা নিয়ে আবার লজ্জা দেওয়ার কী দরকার! কিন্তু তাই বলে মা কিছুই বলবে না আমাকে? সেটা কি লাই দেওয়া হয় না? আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মা বেমালুম চেপে যাবে ব্যাপারটা? তাই বলে মা কিছুই বলবে না আমাকে—এটা আমাকে সারা দিন তাড়া করে ফেরে। আমার স্কুলে মন বসে না, স্যারের বকুনি খাই, তবে সেটাকে গুরুত্ব দিই না। টিফিন টাইমে আমি একা ক্লাসে বসে থাকি। শামীম কথা বলতে আসে, কিন্তু ওর সঙ্গেও আমি ভালো করে কথা বলি না। ও একসময় উঠে চলে যায়। স্কুল ছুটির পর আমার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। একবার মনে হয়, যাই, রামগোপালের বাসায় যাই। মা আর হাফিজ চাচা তাকে যা বলতে বলেছে বলে দুই গালে দুই চড় বসিয়ে তারপর চলে আসব। একবার মনে হয়, শাহাবের ওখানে যাই। বলে আসি—সারা রাত ধরে ভেবেছি আমি, হ্যাঁ, ওই লোককে পেটাতেই হবে। কিন্তু আমার কিছুই করা হয় না। শাহাবের ওখানে আজ না গিয়ে অন্য দিন গেলেও চলে। আর রামগোপালের ব্যাপারটাও আপাতত থাক। আমি জানি, রামগোপাল আর তার ওই বন্ধুর মুখ দেখলে আমার মেজাজ আবার বিগড়ে যাবে। কী করব আমি, বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়, সকালে খাবার টেবিলে মা যদি আমাকে ধমকাত, গাল দিত, লজ্জা ঠিকই পেতাম আমি। তবে এখনকার মতো এত খারাপ লাগত না। আমার অবশ্য এমনও মনে হয়, মা হয়তো ঠিকই বলবে কিছু। আজ সকালে কিছুই বলেনি বলে পরে কিছু বলবে না—এমন ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। হয়তো আজ রাতেই বলবে কিংবা কাল সকালে। মা হয়তো বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মা হয়তো এমন কিছু বলবে, আমি আর লজ্জায় মুখই তুলতে পারব না। কিন্তু মা কিছুই বলে না। আমি বিকেলের পর বাসায় ফিরে গিয়ে দেখি, সব কিছু রোজকার মতো স্বাভাবিক। হাফিজ চাচা একবার আসে। তবে বেশিক্ষণ থাকে না। আধঘণ্টা পর চলে যায়। তারপর মা স্কুলের খাতাপত্র নিয়ে বসে। আমি নিজের ঘরে উঠে যেতে পারি। যাই না, আমি মার সামনে বসে থাকি, আমি চাই মা আমাকে কিছু বলুক। কিন্তু মা কিছু বলে না। মা আজ স্কুলে কী মজার ঘটনা ঘটেছে, তা বলে; আজ হঠাৎ একটু যেন গুমোট পড়েছে, সে কথা বলে; আজ চিঠি এসেছে মামার; সে কথা বলে, কিন্তু শম্পা সম্পর্কে একটা কথাও বলে না। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে যায়। খাবার টেবিলে মার মুখোমুখি বসে আবার অপেক্ষা। কিন্তু আমার অপেক্ষাই সার হয়। রাতে আমার ঘুম আসে না। আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ আর ছটফট করি। মা কেন কিছু বলছে না? তবে কি আমার আগের ভাবনাই ঠিক—মা কি আমাকে লজ্জা দিতে চাচ্ছে না? মা কি শম্পার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না? মার কাছে পুরো ব্যাপারটারই কোনো গুরুত্ব নেই? মা কি ভাবছে যথেষ্ট লজ্জা আমি পেয়ে গেছি? মা কি কিছুই না বলে আমাকে করুণা করছে? এই শেষ চিন্তাটাই আমাকে হঠাৎ অস্থির করে তোলে। আমি বিছানার ওপর উঠে বসি। আমার মনে হয়, হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই, এটা ছাড়া আর কী হবে! মা নিশ্চয় আমাকে করুণা করছে। নইলে আমার মনে হয়, এত বড় একটা ব্যাপার চেপে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। মা তো আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারত—বাবু, শম্পা তোর নামে নালিশ করে গেল। আমি বলতে পারতাম—কী নালিশ মা? তুই নাকি ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিস? ও যে সব সময় আমার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে, সেটা কি আমি কারো কাছে নালিশ করতে যাই? কিন্তু ও তোর সম্পর্কে খুব খারাপ কথা বলল। তুমি তো জানই মা, শম্পা কেমন মেয়ে…। ঠিক আছে, তুই আর ওর সঙ্গে কথাই বলিস না। আমি তো বলতেই চাই না মা। ওই তো জোর করে ডেকে ডেকে…। এখন থেকে আর শুনবি না। ঠিক আছে মা। দেখো, তখন আবার কী নালিশ করতে আসে। কিংবা মা তো আমাকে বলতে পারত—শম্পার সঙ্গে তোর সম্পর্ক কেমন রে? আমি বলতে পারতাম—এ কথা হঠাৎ কেন জিজ্ঞেস করছো মা? মা একটু ইতস্তত করত—না মানে, সেই ভোরবেলা এসে তোর নামে নালিশ করে গেল কিনা।…শুনিসনি? আমি খুব অবাক হয়ে যেতাম—না তো! কী নালিশ মা? সে বাজে কথা।…থাক। না, বলো তো মা। শুনি ওই হারামজাদি কী বলেছে আমার নামে! হারামজাদি বলছিস কেন বাবু? হারামজাদি না তো কী! অসভ্য একটা। মা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলত—থাক, তোর আর শুনতে হবে না। তবে তুই কিছু বলিসও না ওকে। মেয়েটা বোধ হয় ভালো না। মাঝেমধ্যে আমি দেখি, কেমন কেমন করে…। আর বলো না মা। বাইরে যে ওর কত বদনাম! কিংবা এমনও তো হতে পারত, মা আমাকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করত—কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় তোর সঙ্গে শম্পার কি কিছু হয়েছে? আমি অবাক হয়ে যেতাম—শম্পার সঙ্গে কিছু হয়েছে মানে? সকালবেলা তোর নামে নালিশ করে গেছে শম্পা। কী নালিশ? আমার ভ্রু কুঁচকে যেত। তুই নাকি ওর গায়ে হাত দিয়েছিস? হ্যাঁ, চুল ধরে খুব করে টেনেছি। মা একটু থতমত খেয়ে বলত—চুল ধরে টেনেছিস? হ্যাঁ। কাল রাতে যখন শামীমদের বাসা থেকে ফিরছি তখন। মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলত—কেন তুই একটা মেয়ের চুল ধরে টানতে গেলি! ও কি বাচ্চা মেয়ে? ও খুব বাজে বাজে কথা বলে মা। কী বাজে বাজে কথা? আমি তখন গম্ভীর গলায় বলতাম—সে সব তোমাকে বলা যাবে না মা। কেন বলা যাবে না? বল তুই। না মা। ওসব বাজে কথা তোমাকে বলতে পারব না। বল।…শম্পা তোর সম্পর্কে অন্য নালিশ করে গেছে। আমার পুরোটা জানতে হবে। আমি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতাম—তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছিল মা। তোমার আর হাফিজ চাচা সম্পর্কে। কী! মা চমকে উঠত। ও তো আমাকে দেখলেই তোমার আর হাফিজ চাচা সম্পর্কে নোংরা নোংরা কথা বলে। তা, কাল আমার এত রাগ হলো। কালও বলেছিল তোমরা নাকি…। থাক।…তুই শম্পার সঙ্গে আর মিশবি না। কে-ই বা মিশতে যায়! কিন্তু পেছনে থেকে শুনিয়ে শুনিয়েও কথা বলে। ওসব শুনতে হবে না তোর। হ্যাঁ, এসব কথা মার সঙ্গে আমার হতে পারত। কিন্তু কথা তো মারই ওঠাতে হবে। আমি তো আর নিজ থেকে বলতে পারি না—মা, শম্পা নাকি নালিশ করে গেছে আমার নামে! না, এভাবে বলা যায় না। কিন্তু মা যদি আরম্ভ করত, আমি যা বলার বলতে পারতাম। কিন্তু মা কেন কিছু বলছে না? মা কি তবে আমাকে করুণা করছে? এই চিন্তাটা আমাকে এতটুকু সুস্থির হতে দ্যায় না। মা কি ভেবেছে ভেতরে ভেতরে আমি লজ্জায় শেষ হয়ে যাব, এটুকুই যথেষ্ট, তার আর কিছু বলার দরকার নেই? কিছুটা বটে, তবে বাকিটুকু মার করুণা, আমি মোটামুটি নিশ্চিত হই। আমি পুরো নিশ্চিত হই সকালে। সকালেও মা যখন কিছু বলে না, তখন আমার আর কোনো সন্দেহ থাকে না। হ্যাঁ, মা ভেবেচিন্তে সবদিক বিচার-বিবেচনা করেই আমাকে না বলে আছে। মা নিশ্চয় ভেবেছে, এভাবে সে চুপ করে থাকলে আমি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় মরে গিয়ে একদম তার বাধ্য ছেলে হয়ে থাকব। মা যা বলবে তাই আমি বিনা বাক্যে মেনে নেব। কারণ আমার ভেতরে সব সময়ই একটা লজ্জা কাজ করবে এই ভেবে যে—মা আমার একটা দুর্বল দিক, একটা লজ্জার কথা জানে। কিন্তু আমি কি জানি না মার দুর্বল দিকের কথা? আমি কি মাকে লজ্জায় ফেলতে পারি না? খুব জানি, খুব পারি। তবে আমি কেন একা একা লজ্জা পেতে যাব? আমি কেন মাকে একটু করুণা করতে যাব না? এসব ভাবনার পাশাপাশি আমার ভেতরে লজ্জাও খুব কাজ করে। মা যতই কিছু বলে না, ততই আমি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় ছোট হয়ে যাই। আমার মনে হয়, এর চেয়ে অনেক ভালো হতো, মা যদি সরাসরি কিছু বলত আমাকে। যদি মারত আমাকে, তাও আমার আপত্তি ছিল না। এখন এই লজ্জা থেকে বাঁচার কি কোনো উপায়ই নেই আমার? আমি কাল রাতে ভেবে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে—আছে। এখন আমি আবার ভেবে দেখি। আমার আবার মনে হয়—আছে, থাকবে না কেন! আমি বই-খাতা নিয়ে বেরোনোর সময় মাকে বলি—মা, আজ বোধ হয় আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। মা একটু অবাক, একটু গম্ভীর গলায় বলে—কোথায় যাবি? তুই তো কদিন হলো না বলেই দেরি করে ফিরছিস! আজ এক বন্ধুর বাসায় আমাদের অনেকের দাওয়াত। ওর ভাই ফিরেছে বিদেশ থেকে। বন্ধুর ভাই ফিরেছে তো তোদের কি রে? এমনি যেতে বলেছে। স্কুল ছুটির পর যাব…। বেশি দেরি করিস না।…ভালো ছেলেরা দেরি করে বাড়ি ফেরে না। আমি টিফিন টাইম পর্যন্ত স্কুল করি। এটা অবশ্য আমাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। কারণ অনেক সময় স্যাররা টিফিন টাইমের পর ফিফথ পিরিয়ডে আবার রোল কল করে। কেউ যদি তখন নতুন করে অ্যাবসেন্ট হয়, তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। গার্জিয়ানকে পর্যন্ত ডেকে আনে। কিন্তু এসবে আমি এখন ভয় করি না। এরচেয়ে যে কাজটা আমি করতে যাচ্ছি, সেটা অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। আমি একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে যাই শাহাবের ওখানে। এমন হতে পারত, শাহাব নেই। কিন্তু শাহাবকে পেয়ে যাই আমি। শাহাব আমাকে দেখে হাসে—কিরে, খবর কী তোর? সেদিন কোনো অসুবিধা হয়নি তো? আমিও একটু হাসি—না, অসুবিধা হয়নি।…শাহাব ভাই, আমি ভেবেছি। কি ভেবেছিস তুই? শাহাব অবাক। ওই লোকের ব্যাপারে। ওই লোককে না মারলে আমার মার পিছু ছাড়বে না। শাহাব কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে—সব দিক ভেবেচিন্তে বলছিস তো? আমি মার সঙ্গেও কথা বলেছি। মা বলেছে—তুই যা ভালো বুঝিস কর। শাহাব আবার কতক্ষণ ভাবতে থাকে। তারপর মাথা ঝাঁকায়—ঠিক আছে।…নাম কি ওই লোকের? আমি হাফিজ চাচার নাম বলি। ঠিকানা দে। আমি হাফিজ চাচার বাসা আর অফিস দুই ঠিকানাই দিই। কি রকম পেটালে হবে বলে তোর মনে হয়? টাইট দেবে। খুব ভালো করে টাইট দেবে, যেন আমার মার পেছনে আর না লাগে। শাহাব একটু হেসে বলে—ঠিক আছে, তাই হবে। আমি আরো ঘণ্টাখানেক শাহাবের ওখানে কাটাই। শাহাব আমাকে নানা রকম গল্প শোনায়। সবই বীরত্বের গল্প। এসব শুনতে শুনতে দিব্যি সময় কেটে যায়। তারপর আমি ফিরে আসি। তবে সোজা বাসায় ফিরে যাই না। কতক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরি। তারপর আমাদের বিল্ডিংয়ের কাছে একটা দেয়ালের পেছনে এসে দাঁড়াই। এখন অপেক্ষা, কে জানে কতক্ষণ! প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। বিকেলের পরপর আমি দেখি হাফিজ চাচাকে। আমি আরেকটু সরে যাই দেয়ালের পেছনে। হাফিজ চাচা আমাদের বিল্ডিংয়ের সীমানায় ঢুকে গেলেও আমি দেয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে আসি না। আরো মিনিট দশেক অপেক্ষা করি। তারপর দেয়ালের পেছন থেকে সরে খুব দ্রুত ঢুকে পড়ি আমাদের বিল্ডিংয়ের সীমানায়। দরকার নেই জানি, তবু এদিক-ওদিক তাকাই, তারপর সোজা উঠে যাই ছাদে। কী করব এখন—সে আমার ঠিক করা আছে। হ্যাঁ, মাকে লজ্জায় ফেলব আমি। মাকে আমি খুব ভালোবাসি, এ তো আমি নিজেও জানি। এখন, এই লজ্জা নিয়ে আমি জানি মার সামনে বেশিদিন থাকতে পারব না। কিন্তু মাকে ছেড়ে আর কোথায়ই বা যাব আমি? যেতে পারি ফুপু, খালা বা মামার বাসায়। কিন্তু মাকে ছেড়ে, আমি জানি, কোথাও আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। আবার মা আমাকে করুণা করবে, এটাই বা আমার কিভাবে সহ্য হয়! তারচেয়ে অনেক ভালো, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, দুজনের লজ্জা সমান সমান হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া এখন মার সঙ্গে এক ছাদের নিচে আমি থাকতে পারি না। সুতরাং মার কাছে আমি যেমন ছোট হয়ে আছি, তেমনি মাকেও একটু ছোট করে দিই আমার সামনে, ব্যস, সমান সমান। মাকে জানিয়ে দিই, মা যেমন শম্পার কথা জানে, তেমনি আমিও জানি কিছু কথা। আমি নিশ্চিত, শুধু এভাবেই আমি আমার লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারব। তারপর বাকি থাকবে শুধু হাফিজ চাচা। আজ যা করব আমি, হাফিজ চাচার লজ্জা থাকলে আর আমাদের বাসায় আসবে না। তা ছাড়া শাহাবকে তো বলাই হয়েছে। আমি ছাদে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করি। এ সময়ের মধ্যেই শাহাবের দেওয়া দুটি সিগারেট খাই পরপর। একটু যখন অন্ধকার হতে আরম্ভ করেছে চারপাশ, আমি তখন ছাদের কার্নিশে পা রাখি। রেলিং ধরে পা টিপে টিপে চলে যাই স্যানিটারি পাইপের কাছে। খুব সাবধানে, খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করতে হয় আমাকে। যেকোনো মুহূর্তে পা ফসকে যেতে পারে আমার। আর পা ফসকালে কী হবে, তাও জানা আছে আমার। আমি স্যানিটারি পাইপ বেয়ে একটু একটু করে নামতে আরম্ভ করি। আমার কষ্ট হয়, আমার দম ফুরিয়ে যায়, আমার হাত ছিলে যায়, কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিই না। আমাদের ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেমে আমি থেমে থাকি কিছুক্ষণ। বুক ভরে দম নিই। তারপর হাত বাড়াই বাঁদিকে। বাঁদিকে আমাদের ফ্ল্যাটের পেছনের বারান্দা। একবার, দুবার, তিনবার, চারবারের বার আমি বারান্দার ভেতরের দেয়াল ধরতে পারি। তারপর পা বাড়াই, একটু একটু করে। একসময় আমার পাও পৌঁছে যায় বারান্দার রেলিংয়ের ওপর। তখন আমি আর কিছু ভাবি না। আমি বারান্দার ভেতরের দেয়াল আর রেলিংয়ের ওপর ভরসা করে নিজেকে এগিয়ে দিই এবং একসময় নিজেকে দেখি বারান্দার ভেতর। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হয়। পেছনের বারান্দার দরোজা ভেতর থেকে অধিকাংশ সময় বন্ধই থাকে। সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মার চোখ এড়িয়ে খুলে গেছি। এর মধ্যে মার যদি তা চোখে পড়ে থাকে, আর মা যদি ছিটকানি তুলে দিয়ে থাকে তবে আমার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। অবশ্য তার পরও, যদি খোলাও থাকে বারান্দার দরোজা, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না আমি যেমনটা চাচ্ছি ঠিক তেমনটাই ঘটবে। আমি বারান্দার দরোজা ধরে টানি, খুব আস্তে, যেন কোনো শব্দ না হয়। আমাকে হতাশ হতে হয় না, বারান্দার দরোজা খোলাই আছে আর শব্দও হয় না কোনো। আমি বারান্দা থেকে এক পা রাখি ঘরের ভেতর। এটা খাবার ঘর। আমি পা টিপে টিপে খাবার ঘর পেরিয়ে ড্রইংরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমার সামনে বড় একটা পর্দা। পর্দা সরালেই আমি ড্রইংরুমের পুরোটা দেখতে পাব। এখনই পর্দা সরাব কী সরাব না, ঠিক করার আগেই আমি মার কান্নার আওয়াজ পাই। ঠিক কান্না নয়, মা ফোঁপাচ্ছে। আমি একটুক্ষণ অপেক্ষা করি। আমি নিজেই বুঝি, সাহস হচ্ছে না আমার। তবে এই দ্বিধাটুকু আমি কাটিয়ে উঠতে পারি। আমি কোনো শব্দ না করে পর্দা অনেকটা সরিয়ে দিই। আমার চোখের সামনে, একটু দূরেই মা আর হাফিজ চাচা। হাফিজ চাচা মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মার মুখ হাফিজ চাচার কাঁধের ওপর। মা কাঁদছে, এদিকেই তার মুখ, কিন্তু নিচু, আমাকে মা দ্যাখেনি। ঠিক এ রকম একটা দৃশ্যই আমি দেখতে চেয়েছিলাম। শম্পার ব্যাপারটা নিয়ে মার কাছে যে লজ্জা, এ রকম এক দৃশ্যের মাধ্যমে তা মুছে যাক, আমি চেয়েছিলাম! মা জানুক, শুধু আমার কথাই মা জানে না, মার কথাও আমি জানি। এভাবে আমাদের দুজনের লজ্জা সমান সমান হয়ে যাক, আমি চেয়েছিলাম। নিজের লজ্জা ঢাকতে আর কিই বা আমার করার ছিল। মা চোখ তুলে তাকায়। তাকিয়ে আমাকে দ্যাখে এবং দেখে ভূত দ্যাখার মতো চমকায়। যেন নিজের চোখকে মা বিশ্বাস করতে পারে না। দুর্বোধ্য এক শব্দ বের হয় মার মুখ থেকে। সেই শব্দে চমকে ওঠে হাফিজ চাচাও ফিরে তাকায়, আর আমাকে দ্যাখে। তখন কী এক লজ্জা আবার আমাকে গ্রাস করে নেয়। আমি ছোট হয়ে যাই, ছোট হয়ে যাই। আমি চোখ তুলতে পারি না। আমার মনে হয়, এরপর মার সঙ্গেই আমার কি আদৌ থাকা সম্ভব? আমি বলি, আমার বলতে খারাপ লাগে না; বরং আমার মনে হয় এ কথাটাই বলা উচিত, আমার মনে হয় এ কথাটাই আমার আরো আগে বলা উচিত ছিল, বলতে অবশ্য আমার একটু লজ্জা লজ্জা লাগে। আমি বলি—মা, আমি বলছি কি—তোমরা বিয়েটা করে ফেললেই পার।