দূরের গল্প

Durer golpoআমি আর সাজিয়া ঠিক করলাম, আমরা দুজন মিলে একটা গল্প লিখব। আমরা দুজন বলাবলি করে নিলাম এটা নতুন কোনো কাজ নয়। এ ধরনের কাজ, আমি এ মুহূর্তেই দু-চারটার নাম বলতে না পারলেও, আগেও নিশ্চয় হয়েছে, জানা কথা, পরেও কমবেশি হবে।

আমাদের ধারণা, আগে যেসব কাজ হয়েছে, সেসব ভেবেচিন্তে হয়েছে, ভবিষ্যতে যেসব হবে সেসবও হয়তো ভেবেচিন্তে হবে। আমাদেরটা সে পর্যায়ে ফেলা যাবে না। আমাদের দুজনের গল্প লেখাটা শুরু হলো হঠাৎ করে। আমাদের কথা শুরু হলো এভাবে-এক সন্ধ্যায় আমি ও সাজিয়া এক রেস্তোরাঁয়, খাবারের অর্ডার দিয়েছে সাজিয়া, বরাবর এ কাজটা ওই করে, বিল মেটানোর কাজটাও। যদিও আমি সে পরিমাণ নিঃস্ব লেখক নই যে কখনো বিল মেটাতে পারব না। তবে সাজিয়ার কথা হলো, অর্ডার দেওয়া ও বিল মেটানো, এই দুটি কাজ আসলে সে-ই করতে চায়, কারণ এই দুইয়ে তার অনেক আনন্দ।

অর্ডার দিয়ে সাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-ঠিক আছে?

আমি বুঝলাম কী, তবু জিজ্ঞেস করলাম-কী?

অর্ডার। কোনো প্লাস-মাইনাস?

আমি মৃদু গলায় বললাম-সাজিয়া, তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে!

সাজিয়া ঝলমল করে উঠল-সত্যি বলছ!

তুমি জানো একটা কথা, জানো না?

কোন কথা যে! হয়তো জানি, হয়তো জানি না। কী কথা?

তোমাকে দেখলেই আমার মনে হয় একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে?

সত্যি!…কিন্তু এখন একটা কথা এত ফিসফিস করে বলছ কেন!

আমি যতদূর জানি এসব ফিসফিস করেই বলতে হয়, কানের কাছে মুখ এনে।

না না, জোরে বলো প্লিজ, তোমার কথা সবাই শুনুক।

সে আমি বলতেই পারি, কিন্তু তোমাকে বিব্রত করে কী লাভ!

কথা দিচ্ছি বিব্রত হব না। তুমি চেনো আমাকে। জোরে বলো প্লিজ।

তোমার অর্ডারটা ভালো হয়েছে।

আমার এখন কী ইচ্ছে করছে, জানো? তোমাকে খামচে দিতে।

দাও না। মাঝে মাঝেই এই কথাটা বলো। কিন্তু কখনো দাও না। এখন দেবে?

আগেরগুলো মিলিয়ে যাক আগে, না হলে লোকে দেখলে বলতে পারে তুমি এক খামচিওয়ালির সঙ্গে ঘোরাফেরা করো।…যদিও জ্বালা ধরানো খামচিই তোমার প্রাপ্য।

তা-ই?

তুমি জানো, কেউ আমাকে সুন্দরী বললে আমার অসহ্য লাগে। তবু এক কথা কেন যে বারবার বলো।

শুধু জগলু বলত না।

না, জগলু বলত না।

জগলু তোমার ছোটবেলার ব্যাপার। তুমি বোধহয় তখন সুন্দরী হয়ে ওঠনি। আর তুমি নিজেই বলেছ, জগলু…।

জগলুর কথা থাক। আমি, সুন্দরী সুন্দরী-এসব শুনলে সত্যিই বিরক্ত হই।

যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছ, তখন থেকেই জনে জনে বলছে আর তুমি শুনছ। সে জন্য বিরক্ত লাগে। দেখো না, আমি তোমাকে ওটা কম বলি। বলি ডিগনিফায়েড, বলি গ্রেসফুল, বলি লাবণ্যময়ী, বলি মাধুর্যময়ী, বলি ময়ী…।

কারণ তুমি মিনমিনে শয়তান।

না না, তোমার অবজারভেশন ভুল।

ওকে, তুমি তাহলে নিচুস্তরের বুদ্ধিমান। আমাকে সুন্দরী বললে খুশি হব না, কিন্তু মাধুর্যময়ী বললে খুশি হব, তাই বলো। বুঝি না? তুমি আর্ট ভালো জানো।

কিসের?

পটানোর।

কক্ষনো না, ওসব আমি বুঝিই না।

চুপ। একদম।

আচ্ছা।

তোমার খবর বলো।

আমি টায়ার্ড। বাংলায় বললে ক্লান্ত।

ইদ্দিসে বললে?

জানি না যে! শুধু টায়ার্ড বা ক্লান্ত, এইটুকু জানি।

আমার প্রেম, আমার মাধুর্য তাহলে আর তোমার ক্লান্তি দূর করতে পারছে না! সাজিয়ার মুখে চাপা হাসি।

পারে না মানে! আলবত পারে। তুমি হচ্ছ সবুজ পাতা। তোমার স্পর্শেই…।

স্পর্শ ছাড়া হয় না? এমনি?

তাও হয়।

তোমার গলা কেমন সিটিয়ে যাওয়া মনে হলো!…বাদ দাও, মাঝে মাঝে তুমি আমাকে তলোয়ার বলো। সেটাও বলো একটু। শুনি।

একটু উঠে দাঁড়াবে?

সাজিয়া তখনই উঠে দাঁড়াল।

তুমি হচ্ছ খাপখোলা তলোয়ার। দেখলেই মনে হয় জবাই হয়ে যাই।

ওটা পরে হবে। সময়মতো। এখন খবর বলো।

ওই যে-টায়ার্ড, ক্লান্ত।

সাজিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে-সমস্যা কী?

প্রায় সারা বছর কিছু লিখিনি।

কেউ বারণ করেছিল? তোমার বউ এসে এসে বারণ করে যেত?

এখন, যদিও শুরুই করিনি, লেখালেখির চাপে চ্যাপ্টা।

হুঁ, তোমাকে ফিতাকৃমির মতো লাগছে।

খেতে খেতে আমি সাজিয়াকে প্রস্তাবটা দিলাম। তার আগে অবশ্য ওকে আমি জানিয়েছি, সময়মতো সব লেখা শেষ করা সম্ভব হবে না। এটা একটা খারাপ ব্যাপার হবে, মাঝখানে কয়েকটা বছর প্রায় কিছুই লিখিনি, এখন যদি এ বছরও কিছু না লিখি…। সেদিন একজন বলছিল, আমি এতটাই গ্যাপ দিয়েছি, প্রায় পুরো একটা জেনারেশন আমার লেখা পড়েনি…।

পড়েনি না, দেখেনি। নতুন জেনারেশনের কারো ইচ্ছা থাকলে সে তোমার পুরনো লেখাগুলোই পড়তে পারে।

পারে।…পড়েনি।…আচ্ছা, সে যা-ই হোক, আমি ভাবছিলাম এ বছরের শুরু থেকেই নিয়মিত হব।

হওয়া উচিত। পাঠক হিসেবে আমিও বলি, অনেক দিন তোমার নতুন লেখা দেখি না।

পারছি না।

ছুটি নাও সব কিছু থেকে। ঘরে তালা দিয়ে লিখতে বসো।

ছুটি আসলে লাগে না। তালাও না। সমস্যা হচ্ছে, আমি লিখতে পারছি না।

অনভ্যাস। না লিখতে লিখতে…।

হ্যাঁ, অনভ্যাস। অনভ্যাসে বিদ্যা নষ্ট।…সাজিয়া, একটা কাজ করে দেবে?

আমি লিখে দেব?

আমি অবাক গলায় বললাম-আশ্চর্য, তুমি বুঝলে কী করে!

সাজিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল-আমি কী বুঝলাম কেমন করে!

ওই যে, আমি তোমাকে লিখতে বলব!

সাজিয়া হাসতে আরম্ভ করল।

হেসো না। আমি সিরিয়াস।

হাসব না।…আমি লিখে দেব?

হ্যাঁ, তুমি লিখে দেবে।

আর সেটা তোমার নামে ছাপা হবে?

হ্যাঁ।…না, তা না।

শোনো, আমাদের দেখাদেখি, এটা-ওটা সব বন্ধ। সামনের কটা দিন তুমি শুধু লিখবে।

আমার প্রস্তাবটা শোনো আগে। তুমি সেদিন বলেছিলে না তোমার মাথায় কত-কত গল্প ঘোরাঘুরি করে…।

সে করতেই পারে। যেমন, তোমার-আমার ব্যাপারটাই আমার কাছে গল্প মনে হয়।

দু-তিনটা গল্প তুমি শুনিয়েছও আমাকে।

শুনিয়েছ। তুমিই বলেছ অতি নাটকীয়। এখন কেউ আর অমন নাটুকে গল্প লেখে না।

বড় লেখকরা লেখে না।…আসো, আমরা দুজন মিলে একটা গল্প লিখি।

মানেটা বলো।

আগে আমরা গল্পটা ঠিক করে নেব। এমন হতে পারে, তুমিই শুরু করলে, তোমারই পরিচিত কোনো গল্প। সেটাকে আমরা গুছিয়ে নেব। কিংবা গল্পটা না গুছিয়েই দুজন লিখে যাব।

তারপর?

তুমি কিছুটা লিখবে। আমি পড়ব। তোমার লেখার সূত্র ধরেই তারপর আমি কিছুটা লিখব। তুমি পড়বে। আবার তুমি লিখবে। দরকার হলে কিছু আলোচনাও করব।

পাগলের কথা।

জীবনে অনেক পাগলামো। এদিক-ওদিক অনেক পাগলামো করছি আমরা। এই যেমন তোমার আমার সম্পর্কই।… আরো একটা পাগলামো বাড়লে কিছু এসে যাবে না।

দেখো, তোমার-আমার সম্পর্ক আমার কাছে পাগলামো না। আমার কাছে এটার মূল্য অনেক।

আমার কাছে এটা পাগল এক পাগলামো।

পাগল এক পাগলামো!… কথাটা সুন্দর। তবু বলি-পাগলামো না।

কিন্তু আমাদের সম্পর্কের কথা উঠলে তুমিই বলো, এই পাগলামোর কোনো মানে হয় না।

বলি।

তুমিই এই সম্পর্ক মাঝে মাঝে রাখতে চাও না।

চাই না। যে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, রেখে কী লাভ!

কোন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আছে?

জানি না।…একটা কথা বলি, এই আলোচনাটা বাদ দাও।

কেন!

তুমি জানো, এই আলোচনাও আমার অসহ্য লাগে। আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পাই না।

তোমার সমস্যাটা হলো, তুমি আমাকে নিতেও পার না, ফেলতেও পার না।

তা-ই? সাজিয়া আমাকেই জিজ্ঞেস করল। তবে এমন ভঙ্গিতে, যেন সে একই সঙ্গে নিজেকেও জিজ্ঞেস করছে।

হ্যাঁ, তাই। আমি বললাম। আমি নেশার মতো।

হয়তো।… হয়তো তুমি নেশার মতো। বেশি নেশাগ্রস্ত বলে টের পাই না।

নেশা কেটে যায়।

যখন কাটবে, তখন কী হবে?

তখন নেশা কেটে যাবে, এই এটুকু।

না গুড্ডু, তুমি ভুল বলছ। এ নেশা কাটবে না।

কেন?

জানি না। হয়তো, একটা নেশা দরকার…।

হবে।…সাজিয়া, এখন গল্পের কথা।

তুমি আমার, আমার-তোমার লেখা তোমার নামে ছাপবে?

না ময়ী, তুমিও জানো সে আমি করব না।

তুমি এভাবে লেখালেখিতে ফিরতে চাচ্ছ?

ইয়েস, এভাবে। আমার মনে হচ্ছে এভাবে আমার রাইটার্স ব্লক কাটবে।

বেশ, আছি আমি। শুধু ছোট একটা শর্ত।

শুনি।

আমার অংশ নাটকীয় হবে। তুমি হাসবে না।

আমার অংশও নাটকীয় হবে।

কেন?

তুমি যেভাবে লিখবে, আমি সেভাবে মিলিয়ে লিখব। দেখি না-কী দাঁড়ায়।

রেস্তোরাঁয় বসে এসব কথার পর বেশ কিছুদিন চলে গেল। এ কদিনে আমি কিংবা সাজিয়া কেউই আর দুজন মিলে গল্প লেখার কথা তুললাম না। এটা ঠিক, সেদিন রেস্তোরাঁয় বসে প্রস্তাবটা আমি আন্তরিকভাবেই দিয়েছিলাম। শেষদিকে এসে সাজিয়াকেও সিরিয়াস মনে হয়েছিল। সিরিয়াস মানে, ব্যাপারটা ও মেনে নিয়েছিল। পরে, সত্যি কথা, আমার কাছেই ব্যাপারটার গুরুত্ব থাকল না। সাজিয়া পারবে না, সাজিয়ার সঙ্গে গল্প লেখা একটা হাস্যকর ব্যাপার হবে, এতে রাইটার্স ব্লক কাটবে না, বরং উল্টো ক্ষতি হবে-এ রকম কিছুই কিন্তু আমার মনে হলো না। এমনিতেই ব্যাপারটার গুরুত্ব থাকল না আমার কাছে। যেন রেস্তোরাঁয় আলোচনা শুরু হয়েছিল, রেস্তোরাঁয়ই শেষ হয়ে গেছে।

তবে আমি লিখতে শুরু করলাম। নিজের লেখা। কষ্ট হলো, অনেক দিন লিখি না, কিন্তু এও ঠিক, জড়তা এভাবেই কাটবে। সাজিয়াকে বলা হলো না। বলা হলো না ইচ্ছা করেই। আমি ভাবলাম, অনেকটা লিখে ওকে একদিন অবাক করে দেব। কিন্তু এর মধ্যে অবাক করা এক ঘটনা ঘটল। এক সকালে সাজিয়া এসেছে বাসায়, একসময় ব্যাগ খুলে কয়েকটা দু-ভাঁজ করা পাতা, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-দেখো তো, শুরুটাই কি নাটকীয় হয়নি?

আমি বুঝলাম সাজিয়া কী বলছে, কিন্তু আমি ভান করলাম-কী এগুলো!

দেখোই না।…আমার লেখাটা শুরু করার কথা না! বেশি দেরি করে ফেললাম!

আমি আবার ভান করলাম-ওমা, তুমি লিখে ফেলেছ!

ফেলিনি। শুরু করেছি।

গ্রেট।

এখন পড়ে দেখো কিছু হয়েছে কি না।

আমার এখন পড়ার ইচ্ছা নেই। আমার এখন অন্য ইচ্ছা। বললাম-তা তো দেখবই।

দেখো। সাজিয়ার গলায় তাড়া।

আমি সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম, তারপর পড়তে শুরু করলাম।

“সমস্যার শুরু সকালবেলা। মোনার ঘুম ভেঙে যায় সকাল সকাল, ইলিয়াসের একটু দেরি করে ওঠার অভ্যাস। এ সময়টুকু মোনার কিছু করার নেই। সে এঘর-ওঘর করে, বারান্দা বা বিশাল বাগানে ঘোরে। আবার কখনো ‘ছায়াঘরে’ গিয়ে বসে থাকে। ইলিয়াস ছাদের এক কোণে বহু টাকা খরচ করে তাকে একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছে। পরিপাটি করে সাজানো সে ঘরের নাম ‘ছায়াঘর’। ঘরটা বানানোর আগ পর্যন্ত ইলিয়াস তাকে কিছু বলেনি, যেন ছাদে একটা ঘর বানানো হচ্ছে, এই হচ্ছে ব্যাপার, ঘর বানানো যখন হয়ে গেল, মোনার তত্ত্বাবধানে গোছানোও, ইলিয়াস বলল-এই ঘর তোমার। তুমি এই ঘরে কী করবা, জানো?

এই ঘরটা তাহলে আমার? মোনা জিজ্ঞেস করল।

আরে, কও কী! তোমার না তো কার! এই ঘর তোমার, এই বাড়ি…।

কী করব আমি এ ঘরে?

একটু ভাবল ইলিয়াস, তারপর বলল-যা ইচ্ছা তা-ই করবা।

যেমন?

গান গাইবা, গিটার বাজাইবা, ল্যাখালেখি করবা। আবার কিছু করবা না।

আচ্ছা! তা, এসবের জন্য নিচে ঘর ছিল না?

ছিল। থাকুক। কিন্তু ছাদের ওপর এই রকম একটা ঘরের ব্যাপারই আলাদা।

ইলিয়াসের এই কথায় মোনার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এ রকম একটা ঘরের ব্যাপার সত্যিই আলাদা। ঘরটা সে সাজিয়েছেও যত্ন করে। মাঝে মাঝে এই ঘরে এসে সে চুপচাপ বসে থাকে। আর, ওই যে ওসব কথা, ইলিয়াস তাকে যেমন বলেছিল-গান গাইবা, গিটার বাজাইবা ল্যাখালেখি করবা-এসবও মাঝে মাঝে হয়। তবে, গান গাওয়া বলতে যা বোঝায়, সেই অর্থে সে গান আর গায় কোথায়! মাঝেমধ্যে দু-এক লাইন কিংবা একই লাইন ঘুরেফিরে বারবার। গান একসময় সে গাইত বটে। তবে ইচ্ছাটা তেমন করে আর নেই। কখনো মনে হয়, আজ সে প্রচুর গাইবে, একা একা, হয় না। সে বোঝে, ওটা ছিল একসময়ের শখের ব্যাপার, সময় গড়িয়েছে, শখটা মিটে গেছে। এখন গিটার বাজাতে তার ভালো লাগে। গিটার বাজানো শেখার এক স্কুলেও সে যায় কিছুদিন হলো। এর মধ্যে যন্ত্রটাকে সে অনেকটাই আয়ত্তে এনে ফেলেছে। এখন ইচ্ছা করলেই আঙুল আর তারের খেলায় অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। এটা তার ভালো লাগে। এ ছাড়া তার ভালো লাগে লেখালেখি করতে। এখানে ছোট একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা না থাকলে সে এর মধ্যে অনেক কিছু লিখে ফেলতে পারত। কারণ ইচ্ছাটা তার ভেতর প্রবলভাবেই আছে। সমস্যাটা হলো-সে লিখতে পারে না। সে চেষ্টা করে দেখেছে, লিখেছে, বুঝেছে-তার লেখা হয়নি। তবু এর মধ্যে দু-দুটো মোটা খাতা তার শেষ। কবিতা বেশি, কিছু গান। কিন্তু তার লেখা যে হয় না, সে বললে ইলিয়াস একদম হা হা করে ওঠে-কী কও এইসব!

যা সত্যি তা বলি। বুঝি তো।

আর আমি বুঝি না!

তুমি দেখোইনি কোনো দিন।

আহা, আমার দেখার কী দরকার! তুমি লিখছ, কথা এইটাই। শুনো ডারলিং, এই যে গান লেখছ তুমি…দাঁড়াও…দাঁড়াও, আরে, ওইটারে যেন কী কয়… হ্যাঁ, অ্যালবাম, অ্যালবাম বাইর করনের ব্যবস্থা নাও, সুর কে দিব, এইটা ঠিক করো। তুমি পারবা? পারলে ফাটাফাটি। নিজের লেখা গান, নিজের সুর, নিজের কণ্ঠ।…. নাম কী দিবা অ্যালবামের?

ফাটাফাটি।

এইটা কেমন নাম! ইলিয়াসকে চিন্তিত দেখায়।

লেখালেখি তার হয় না, পুরনো ধরনের হয়ে যায়, কয়েক লাইন লেখার পর বুঝতে পারে না আর কী লিখবে, তবু লেখার ব্যাপারটা তার ভেতর আছে। লেখার ব্যাপারটা মানে লেখার ইচ্ছাটা। সে একটা উপন্যাস লিখতে চায়। মন খারাপ করে দেওয়া একটা উপন্যাস। এ কথা সে কথায়-কথায় ইলিয়াসকে বললে ইলিয়াস অবাক-এইটা কী কও তুমি, কিছুই বুঝতেছি না।

না বোঝার কী হলো! কঠিন কিছু বলিনি।

দুঃখের কাহিনী লেখবা?

হুঁ। দুঃখের কাহিনী।

পড়লে মানুষজনের মইধ্যে দুঃখ দুঃখ ভাব আসব?

হুঁ, সে রকমই।

আরে ধাৎ। লিখবা হাসির গল্প। এমন হাসব পাবলিকে, হাসতে হাসতে চেয়ার থেইকাই পইড়া যাইব।

মন খারাপ করে দেওয়া একটা উপন্যাস বা একটা কাহিনী-এ বিষয়টা নিয়ে মোনা নিজেও খুব একটা পরিষ্কার না। মানুষ তার লেখা পড়ে চোখ মুছবে, চোখ মুছতে মুছতে একসময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে-ঠিক এরকম নয় তার ইচ্ছা। কিন্তু মানুষের বুকের ভেতর একটা হাহাকার জাগবে-কী যেন হলো না, কী যেন হলো না-এ রকম। কিংবা মানুষ একটা অস্বস্তিতে পড়বে-আচ্ছা, কোথাও কি যাওয়ার কথা ছিল তার? যাওয়া কি তবে হলো না! কিংবা-এখানে নয়, তার কি অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল, ঠিক কোথায় তার থাকার কথা ছিল, পাঠক বুঝবে না, শুধু তার মনে হবে-অন্য কোথাও। মোনা জানে এ রকম কোনো উপন্যাসের কিছুই লেখার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু তার ইচ্ছা করে, ইচ্ছার হাত-পা তো আর বেঁধে রাখা যায় না। তবে লিখুক সে বা খাতা বন্ধ থাকুক, গিটার বাজাক সে কিংবা না বাজাক, গুনগুন করে উঠুক সে কিংবা না-ই উঠুক, মাঝে মাঝে এই ঘরে এসে বসে থাকতে তার ভালো লাগে।

তবে সকালবেলা, ঘুম থেকে ওঠার পরপরই ছায়াঘরে আসতে তার ভালো লাগে না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। এখানে যদি সকালে আসে সে, বাধ্য হয়ে আসে। অল্প কিছুক্ষণ থাকে, তারপর ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। কিংবা ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এই ঘর একটু ঘুরে যায়। এসব করে খুব একটা সময় পার করা যায় না। বেডরুমে ফিরে দেখতে হয় নানারকম আওয়াজ তুলে ইলিয়াস নাক ডেকেই যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন সে ইলিয়াসকে ধাক্কায়-এই যে সাহেব, এই যে…।

ইলিয়াস পাশ ফিরে শোয়।

এ লোককে নিয়ে দেখি বড়ই মুশকিল।

কোনো দিন ইলিয়াস তখনই লাফিয়ে ওঠে, সেটা অবশ্য খুব কম দিনই, লাফিয়ে উঠে বলে-দাঁড়াও, মুশকিলের আর দেখছ কী! এখন দেখো।

এখন না, এখন না।

জাগাইলা ক্যান! এখন বুঝো।

আবার কোনো দিন অনেক ধাক্কাতেও ইলিয়াসকে ওঠানো যায় না-মোনা ডারলিং, উঠতেছি, ধাক্কাইও না। থারটি মিনিটস। প্লিজ।

ইলিয়াসের তিরিশ মিনিট অধিকাংশ দিন তিরিশ মিনিটেই শেষ হয় না। অধিকাংশ দিন সেটা এক থেকে দেড় ঘণ্টায় গড়ায়, দু-এক দিন গড়ায়, হ্যাঁ এমনও ঘটে, গড়ায় দু-তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। ঘুম পুরোপুরি ভাঙার পর সে অবশ্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে-ডারলিং, ব্রেকফাস্ট করছ?

যাও, ফ্রেশ হয়ে আসো। ব্রেকফাস্ট দুজন একসঙ্গে।

কী আশ্চর্য, এতক্ষণ!…কয়টা বাজে? দশটা! মাই গড! ব্রেকফাস্ট করো নাই।

জুস খেয়েছি। ওতে হবে না?

এটা মোনার বহু দিনের অভ্যাস। সকালে নাশতার আগে তার অবশ্যই জুস দরকার। এ জন্য ইলিয়াস, ভালো জুস বানাতে পারে, এমন একজন লোকও রেখে দিয়েছে। সে লোক একেক সকালে একক ফলের জুস বানিয়ে দেয়। কোনো দিন ককটেল। মোনার অবশ্য বেশি পছন্দ লেমন বা পাইনঅ্যাপল।

বিছানা ছাড়ার পর বাড়ি থেকে বের হতে ইলিয়াস সময় নেয় এক ঘণ্টা। মোনা একটা ব্যাপার বহুবার খেয়াল করেছে, ইলিয়াস কিছু কিছু ক্ষেত্রে দম দেওয়া ঘড়ির মতো। তার কোনো কিছুতেই একটুও এদিক-ওদিক হয় না। এতক্ষণ যা বলা হলো, তা রোজ সকালের সাধারণ নিয়মের কথা। কিন্তু তার যদি ভোর ৫টায় উঠতে হয়, উঠে যাবে। তার যদি পনেরো মিনিটের মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হয়, তাও পারবে। তখন মনে হয় ইলিয়াসকে দম দিয়ে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে মোনা ঠাট্টা-ইয়ার্কি কম করে না। ইলিয়াসও পাল্টা ইয়ার্কি মারে, তবে গম্ভীর মুখে-বুঝবা না বুঝবা না। দম দেওয়া পুতুল কও আর ঘড়ি কও, এই রকম না হইলে চলে না।

তা, এরকম ঘটে খুবই মাঝে মাঝে। প্রায় অসুরের মতো পরিশ্রম করতে পারে ইলিয়াস, আর, ব্যবসাও তার গোছানো। সে যদি ১২টায়ও অফিসে যায়, অসুবিধা নেই।

সাধারণ নিয়মে বিছানা ছাড়ার পর প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট যায় ফ্রেশ হতে, পোশাক বদলাতে, নাশতা সারতে। বাকি পনেরো মিনিট বরাদ্দ মোনার জন্য। আড়মোড়া ভাঙার হয়তো দরকার নেই, তবু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ইলিয়াস বলবে-ডারলিং, একটা কথা কইলে কি তুমি রাগ করবা?

হ্যাঁ, করব। কারণ রোজ রোজ এক কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না।

কিন্তু না কইয়া ইলিয়াসের উপায় নাই।

তাহলে বলে ফেল।

ডারলিং, তোমারে ছাড়া যাইতে ইচ্ছা করতেছে না।

না করুক, যাও।

তোমারে কয়েক ঘণ্টা না দেইখা থাকব, এইটা ভাবলেই বুকের মইধ্যে ব্যথা করে।

ব্যথাটা কেমন?

চিনচিনা ব্যথা।

তাহলে সেটা আমার জন্য না। অন্য কারো জন্য।

তুমি এই কথা বললা! পারলা!

পারলাম।

বহুত দুঃখ পাইলাম। কান্দন আসতেছে।

রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অফিসে যাও।

নিষ্ঠুর রমণী।

এই মানুষটা না…! অ্যাই, যাও তো তুমি। আল্লাহ হাফেজ।

ইলিয়াস চলে যাওয়ার পর মোনার আর কিছু করার নেই। সে কতক্ষণ বাগান দেখল। ধমকাতে হয় বলে মালীকে ধমকাল। কাজের লোককে ডেকে এটা-ওটা করতে বলল। এসবের কোনোটারই অবশ্য প্রয়োজন নেই। কারণ এ বাড়ির সব কাজের লোক, তারা সবাই জানে তাদের কী করণীয় এবং সেটা কখন করতে হবে। তবু কিছু শাসনের ওপর রাখা আর কি, কিছু সময়ও পার হয় এতে। এসব সেরে মোনা কয়েক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলল। এর মধ্যে তাদের দলবেঁধে ভুটান বেড়াতে যাওয়ার একটা পরিকল্পনাও দাঁড়িয়ে গেল।

তারপর, তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে-এই বলে সে ছায়াঘরে চলে এলো। তাকে বিরক্ত না করার কথা বলার দরকার ছিল না। কারণ সে ছায়াঘরে গেলে তাকে বিরক্ত করা যাবে না, এ সবারই জানা। এমনকি ইলিয়াস বাসায় থাকলেও এ সময়টা সে মোনাকে তার মতো থাকতে দেয়।

দুই দিন আগে মোনা একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করেছে। দেশে যে সাইজের উপন্যাস বই হয়ে বের হয়, সে তুলনায় এটি বেশ খানিকটা বড়। নাম ‘বন্দনা করি’। সেখানে নানা ঘটনা এবং নানা চরিত্র। আবার মাঝে মাঝে এমন কিছু ব্যাপার-পড়া থামিয়ে সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। এ কারণে ‘বন্দনা করি’ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। এমনিতেও সে একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারে না, আর, পড়ার মাঝে মাঝেই পড়া থামিয়ে অন্য কিছু ভাবা তার অভ্যাস। এভাবে চললে, বইটা শেষ করতে আরো কিছুদিন লেগে যাবে। লাগুক, মোনার কোনো আপত্তি বা অসুবিধা নেই তাতে। লেখাটা ভালো লাগছে তার। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ডালপালা মেলা কাহিনী। এই পরিবারের বোকা টাইপের বিএ পড়ুয়া এক মেয়ে সিনেমায় অভিনয় করার জন্য পাগল। আপাতত সে মেয়েটির এক ঘটনা শুরু হবে, এমন এক জায়গায় এসে গতকাল সে থেমেছে।

ছোট করে আড়মোড়া ভাঙল মোনা, তারপর বইটা যে পর্যন্ত পড়েছিল, তারপর থেকে পড়তে শুরু করল-

আজ রোববার। আজ তার হায়দার ভাইয়ের ওখানে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্বপ্না যাবে না, তার অন্য কোথায় যেন জরুরি কাজ। একা একা যেতে অদিতির অস্বস্তি লাগছে, সত্যি কথা হলো, একটু ভয়ও করছে তার। তার এই অস্বস্তি আর একটু ভয়ের কথা শুনে স্বপ্না এমন ভুরু কুঁচকে তাকাল, একটু বোধহয় রেগেও গেল-ভয়! ভয় কেন করবে তোর! কিসের ভয়!

না না। আসলে ঠিক ভয় না। স্বপ্না বলল, মানে একদম নতুন একটা জায়গা তো।

নতুন জায়গা কেন বলছিস! হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে তোর কি আগে পরিচয় হয়নি, আমি নিয়ে যাইনি, কথা বলিসনি?

না না, সেসব ঠিক আছে।

তো! দেখেছিসই তো কেমন মাইডিয়ার লোক।

তবু। তুই থাকলে কত সুবিধা হতো!

আমি তোকে বলেছি, আমার কাজ আছে, আমি যেতে পারব না। এখন ভেবে দেখ তুই নিজে যাবি কি যাবি না, সুযোগটা হেলায় হারাবি কি হারাবি না।

অদিতি ভেবে দেখল-সে যদি না যায় স্বপ্না যাবে না বলে, তবে সে হয়তো সত্যিই বিশাল এক সুযোগ হারাবে। সুতরাং সে যাবে। সুযোগ সব সময় আসে না।

একা একা হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করাটা বিশাল ঝামেলা। রিসিপশনের লোকটা তাকে পাত্তাই দিতে চাইল না। সে বারবার বলল, হায়দার ভাই-ই তাকে আসতে বলেছে, কিন্তু রিসিপশনের লোকটা জানাল, এরকম নাকি সব মেয়েই বলে। কত মেয়ে আসে এখানে! তখন অদিতি বলল-তাহলে আমার নাম পাঠান ভেতরে, বলেন-অদিতি এসেছে, স্বপ্নার বন্ধু। এর পরও লোকটা তাকে গুরুত্ব দিল না। তখন অদিতিরও জেদ ধরে গেল। হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা সে করবেই। সে পায়ের ওপর পা তুলে এক সোফায় বসল। রিসিপশনের লোকটা খুবই বদ টাইপের। সে পায়ের ওপর পা তুলেছে, আর ওই লোকটা তার ঊরুর দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই, আবার মাঝে মাঝে বুকের দিকেও তাকাচ্ছে। ভীষণ এক অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হলো। এ জন্যই সে বারবার স্বপ্নাকে আসতে বলেছিল। স্বপ্না সঙ্গে থাকলে, এসব ঝামেলার কিছুই হতো না। তবে যতই ঝামেলা হোক, সে নড়ছে না। লোকটা ওভাবে তাকাচ্ছে, তাকাক, সে পা নামাচ্ছে না, উঠেও যাচ্ছে না, রাস্তাঘাটে কতজন কতভাবে তাকায়! তাদের বাংলা স্যারের তাকানোও কি কম খারাপ!

বসে থাকতে থাকতে প্রায় মিনিট চল্লিশেক পার হয়ে গেল। হয়তো ওভাবেই তাকে আরো অনেকক্ষণ বসে থাকতে হতো। কিন্তু তার কপাল ভালো, হঠাৎ হায়দার ভাইয়ের ঘরের দরজাটা খুলে গেল। হায়দার ভাইকে দেখা গেল দরজায়। সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হায়দার ভাই রিসিপশনের লোকটাকে কিছু একটা বলে, আবার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগে দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে বলল-হায়দার ভাই…।

হায়দার ভাই তার দিকে তাকাল। হাসিমুখেই যদিও, অদিতির মনে হলো হায়দার ভাই তাকে চিনতে পারেনি। সে হেসে বলল-আপনি আজ আমাকে আসতে বলেছিলেন।

হায়দার ভাই তার দিকে হাসি-হাসি মুখেই তাকিয়ে থাকল।

সে বলল-আমি অদিতি।

হায়দার ভাই তবু তাকে চিনতে পারল না।

আমি অদিতি। স্বপ্নার বন্ধু।

হায়দার ভাইয়ের মুখ হাসিতে ভরে গেল-আরে, তুমি আইছ! বাইরে বইসা আছ ক্যান? আসো, ভেতরে আসো।

ঘরে ঢোকার জন্য অদিতি পা বাড়াল। তার আগে সে গম্ভীর মুখে রিসিপশনের লোকটার দিকে তাকাল। হায়দার ভাইও তাকাল লোকটার দিকে-রাজিবুদ্দিনরে একটা ফোন দাও। অহনই আইসা পড়তে বলো।

অদিতির এক কাঁধে হাত রাখল হায়দার ভাই, হাসল-তুমার কথা ভুলতে বসছিলাম, তুমার কুনোই খবর নাই। যাউক, আসছ। আমি আমার বন্ধু রাজিবুদ্দিনরে কইয়া রাখছি তুমার কথা। ফোন গেলেই আইসা পড়ব। তুমার লগে ইন্টোডিউস করায়া দিব। দেখবা!

একটু, একটু না, আসলে বেশ অস্বস্তি লাগছে অদিতির। হায়দার ভাই তাকে প্রায় জড়িয়েই রেখেছে। তবে অস্বস্তিটুকু ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল অদিতি। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে সংস্কার থাকলে চলবে না, জানে সে। সে তাই হেসে হায়দার ভাইয়ের দিকে তাকাল। হায়দার ভাই তাকে ছেড়ে দিল, বসতে বসতে অদিতিকেও বসতে বলল-বসো। …আমার এই বন্ধু রাজিবুদ্দিন হইতেছে টাকার কুমির। ফিলিম লাইনে নামবার চায়। কিন্তু একটু দোনোমনো করতেছে। আমার মনে হয় তুমারে দেখলে রাজি হইয়া যাইব।

সম্ভবত খুব কাছেই রাজিবুদ্দিনের অফিস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে চলে এলো। অদিতি কফি খাচ্ছিল। কফি তার এতটুকু ভালো লাগে না। কিন্তু ভুলটা সে নিজেই করেছে। হায়দার ভাই তাকে, ঠাণ্ডা খাবা, না গরম। জিজ্ঞেস করলে সে নিজেই বলেছে ‘গরম’। কফি এসেছে। ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে সে, তখন রাজিবুদ্দিন লোকটা এলো। লোকটা কালো, মোটা, ভালুক ভালুক চেহারার। হায়দার ভাই পরিচয় করিয়ে দিল-এ হইতেছে রাজিবুদ্দিন, আমার বন্ধু, যার কথা তুমারে আমি কইছি। গাড়ি আর স্বর্ণের ব্যবসা করে। ফিলিম লাইনে নামব বইলা ঠিক করছে। আর, রাজিবুদ্দিন, এ হইতেছে তুমার নায়িকা।

অদিতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হাসি হাসি মুখে নুয়ে পড়ে সে সালাম দিল। রাজিবুদ্দিন তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বসতে বলল।

হায়দার ভাই আবার বলল-ও হইতেছে আমগো নায়িকা। তুমি আর আমি মিইলা যে সিনেমা বানামু, সেইটার নায়িকা। দেখছ, কী সুন্দর নায়িকা খুঁইজা বাইর করছি।…অ্যাই, তুমার নাম য্যান কী?

অদিতি একটু মিষ্টি করে হাসল-জি, অদিতি।

কী দিত্তি?

অদিতি।

হায়দার ভাই ভুরু কুঁচকে একটু ভাবল-এইসব হিন্দু নামে চলব না। এই নাম বদলাইতে হইব।

হঠাৎ একটু চমকাল বটে অদিতি, তবে ফিল্ম লাইনে এলে নাম বদলাতে হয়, জানা আছে তার।

হায়দার ভাই বলল-হিন্দু নামে চলব না, বুঝছ? এইটা হইতেছে মুসলমান দেশ। পাবলিকে ইসলামী চিন্তা করে। তুমারে নতুন নাম দিমু। কী কও রাজিবুদ্দিন?

হ, নতুন নাম।…শুনো, এরে মালবিকা নাম দাও।

বলবে কি বলবে না করতে করতে অদিতি বলেই ফেলল-কিন্তু এটাও তো হিন্দু নাম হয়ে গেল!

ওই হইল আর কি! পরে তাইলে আরেকখান নাম দিমু। ফাটাফাটি নাম।

জি। অদিতি হাসল। আমিও ভাবব।

রাজিবুদ্দিন জিজ্ঞেস করল-তুমি কী করো?

জি, বিএ পড়ছি। সেকেন্ড ইয়ার।

সমস্যা।…শুনো অত ল্যাখাপড়ার দরকার নাই। আমরা কমু তুমি মেট্রিক দিছ।

কেন! বুঝতে না পেরে অদিতি অবাক হয়ে তাকাল।

তাইলে সবাই বুঝব তুমি কচি। কচি জিনিস কে না চায়, কী কও হায়দার?

ঠিক, ঠিক। তুমি ঠিক ধরছ।

রাজিবুদ্দিন হাসল-ফিলিম লাইনে নাই, কিন্তু ফিলিম লাইনের ভাও বুঝি না, এইটা তো না।

তুমি হইতেছ গিয়া বুদ্ধিমান, হায়দার হাসল।

রাজিবুদ্দিনও হাসল একটু, অদিতির দিকে ফিরল-আগে অ্যাকটিং করছ?

অদিতি আবার হাসল, যদিও তার ভেতরে একটা অস্বস্তি, কারণ এই যে সে কথায় কথায় হাসছে, একবারও বুঝতে পারছে না তার হাসিটা ক্যাটরিনা কাইফের মতো হচ্ছে কি না। বুঝতে পারছে না বলে কিছু অবশ্য করার নেই। সে বলল-জি না ভাইয়া, তবে আমাদের বাসার পরিবেশটা ওই রকম…।

মানে? হায়দার ভাই আর রাজিবুদ্দিন দুজনই বেশ কৌতূহলী হয়ে তাকাল।

আমার বাবা নাটক লেখেন।

ট্যালিভিশনে?

জি না, টেলিভিশনে এখনো প্রচারিত হয়নি। তবে মঞ্চে দুই-তিনটা মঞ্চস্থ হয়েছে। উনি খুব কালচারাল মাইন্ডেড।

অ। হায়দার ভাই বললেন। তুমারে একখান কথা কই। তুমি মনে কিছু নিও না।

না না, বলুন আপনি। আপনারা না বললে শিখব কী করে।

যারা ট্যালিভিশনে আর মঞ্চে নাটক লিখে, মঞ্চেই বেশি, তাগো গোয়ায় মাংস বেশি। তাগো গোয়া ভারী।

অদিতির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।

হায়দার ভাই রাজিবুদ্দিনের দিকে তাকাল-ঠিক কইছি কি না, কও।

রাজিবুদ্দিন তখনই মাথা ঝাঁকাল-হ, ঠিকই কইছ। তারা তো নিজেগো ছাড়া আর কাউরে মানুষই মনে করে না। তুমিই কইছিলা।

অদিতি একদম হা হা করে উঠল-না না, আমার বাবা মোটেও ওরকম নন। সুযোগ পেলে তিনি সিমেনার জন্যও স্ক্রিপ্ট লিখবেন। আমাকে বলেছেন।

বাদ দাও। হায়দার ভাই বলল। শুনো অদিতি, তুমার ব্যাপারে আমরা ফাইনাল ডিসিশন নিছি। নিছি না, রাজিবুদ্দিন?

রাজিবুদ্দিন মাথা ঝাঁকাল-কিন্তু হায়দার, অ্যাকটিংও দ্যাখলাম না, নাচও দ্যাখলাম না।

হ, নাচ দেখমু। আগে কাজের কথা সারি।… অদিতি, তুমি হইতেছ নায়িকা। সামনের মাসে তুমারে ইনটোডিউস দিমু। সব সাম্বাদিকরে ইনভাইট দিমু। একখান গালা শো হইব। দেখবা পাবলিসিটি কারে কয়!

অদিতি একটু হাসল। মুগ্ধ চোখে সে হায়দার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল।

রাজিবুদ্দিনকে মনে হলো একটু বিরক্ত-স্কিন টেস্ট না কী য্যান কয়, সেইটা করবা না?

দেখো রাজিবুদ্দিন। হায়দার ভাই বলল। আমি কিন্তু খোমা দেইখাই বুঝি কারে দিয়া হইব, কারে দিয়া হইব না। এরে দিয়া হইব।… বুঝছ অদিতি, এরে দিয়া হইব। তুমার সব ঠিক। শুধু শইলে একটু মাংস লাগব। যেমন তুমার মাই দুইটা আরো বড় না করলে পাবলিকে কিন্তু নিব না।

অদিতি বুঝতে না পেরে বলল-কী?

মাই মাই। রাজিবুদ্দিন আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল সে কিসের কথা বলছে।

রাজিবুদ্দিন ব্যস্ত গলায় বলল-মাই বড় করনের ব্যবস্থা নাই?

হায়দার ভাই হাসল-কী কও! এহন কত ব্যবস্থা!

অদিতির কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেল। আবার একই সঙ্গে তার মনে হলো, সত্যিই কি তার ও দুটো ছোট। কই, বাথরুমে আয়নায় দেখে কখনো তার ওরকম মনে হয়নি। কিন্তু, মাই-ছি, এভাবে বলে কেউ!

অদিতির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল আর মোনা হো হো করে হাসতে আরম্ভ করে দিল। তার এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হলো। সে বারবার তার হাসি থামানোর চেষ্টা করল, পারল না। বরং হাসির দমকে দমকে তার শরীর কাঁপতে লাগল। এই হাসি সে বহু কষ্টে থামাল। থামাল বটে, তবে কিছুক্ষণ পর সে আবার হাসতে আরম্ভ করল। তার মনে হলো যদি ব্যাপারটা এমন হতো, সে কাউকে উপন্যাসটা পড়ে শোনাচ্ছে, তবে যাকে পড়ে শোনাচ্ছে, সে নির্ঘাৎ ভাবত এখানে এত হাসির কী হলো!

হ্যাঁ। হাসি খুব কষ্টে চেপে রেখে নিজেকে জিজ্ঞেস করল মোনা। হ্যাঁ, সত্যিই তো এখানে এত হাসির কী হলো!

আমিও জানতে চাচ্ছি সেটা। উপন্যাসের এমন একটা জায়গায় আমরা আছি, অদিতি নামের ওই মেয়েটার জন্য আমাদের দুঃখ হওয়া উচিত।

হ্যাঁ, দুঃখ হচ্ছে।

আমরা বুঝতে পারছি, সে এক ভয়ংকর বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

পারছি। সে জন্যই জানতে চাচ্ছি, হাসছ কেন তুমি!

মাই মাই। হাসির দমকে মোনার শরীর আবার কাঁপতে লাগল।

উপন্যাসটা পড়তে তার ভালো লাগছিল। অনেক চরিত্রের একটি এই মেয়েটি কিভাবে জালে জড়িয়ে পড়ছিল, দেখছিল সে। মেয়েটার জন্য তেমন কোনো সহানুভূতি অবশ্য তার তৈরি হয়নি। লেখকের লেখার ধরনটাই এমন-কোনো চরিত্রের জন্য সহানুভূতি, আনন্দ, কষ্ট, দুঃখ, ঘৃণা কিছুই তৈরি হয় না। শুধু বোঝা যায়-একটা বাস্তবসম্মত চমৎকার বিবরণের ভেতর দিয়ে সে যাচ্ছে। আরো কয়েক পৃষ্ঠা সে অবশ্যই এখন পড়ত, কিন্তু সব কিছু এলোমেলো করে দিল ‘মাই’ শব্দটা। বহু বহুদিন পর আবার তার ওই শব্দের সঙ্গে দেখা। সেই কবে স্কুলে থাকতে এক ছেলে, নামও মনে আছে তার ওই ছেলের, রোকন, তাকে চিঠি দিয়েছিল, আর, ওই চিঠির ভেতর ছিল ‘মাই’ শব্দটা।

স্কুলে থাকতে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকটা করে চিঠি পেতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কলেজে ওঠার পর প্রেমপত্র ও সরাসরি প্রেম নিবেদনের সংখ্যা বেড়েছিল। তবে এখন কথা হচ্ছে ‘মাই’ ঘটনার, ওটা স্কুলের সময়কার।

রোকন তাকে চিঠি পাঠাল। মোনা অবশ্য কোনো চিঠিকেই অবজ্ঞা করত না। মন দিয়ে সে প্রতিটি চিঠি পড়ত। কিছু কিছু চিঠি, যেসব বেশি আকর্ষণীয় বা মজার, সে জমিয়েও রাখত। তা, রোকনের চিঠিটা ছিল সাদামাটা, অধিকাংশ চিঠি যেমন হতো আর কি। তার জন্য কি না করতে পারে রোকন, শুধু মোনা একবার বলে দেখুক, এই হচ্ছে চিঠির মূল বক্তব্য। মোনাকে না পেলে তার জীবনে কী কী ঘটবে, তাও সবিস্তারে জানানো হয়েছে। আর আছে মোনার রূপের বর্ণনা। ‘মোনা তোমার কালো কালো চোখ, মোনা তোমার কী সুন্দর ঠোঁট, মোনা তোমার গাল দেখে মনে হয় গোলাপি রঙের গোলাপ দেখছি… কী তোমার অসুন্দর বলো, কী তোমার অসুন্দর, আমি তো কিছুই খুঁজে পাই না, সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে তোমাকে বানিয়েছে! তোমার হাত দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা করে, তোমার চুল যেন নদীর ঢেউ, তোমার মাই দুটোও নজর কেড়ে নেয়…. মাই তো নয় যেন কবুতরের বাচ্চা।

মোনা পড়ে গেল সমস্যায়। মাই মানে কী! আর সব সহজেই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ঠেকে যেতে হচ্ছে ‘মাই’-এ এসে। এ শব্দ মোনা জীবনেও শোনেনি। রোকনও ভুল লিখবে না, কারণ ভালো ছাত্র হিসেবে তার নাম আছে। ওদিকে আবার আরেক সমস্যা, শুক্রবার স্কুল ছুটি, কোনো বন্ধুকে যে জিজ্ঞেস করবে, সে উপায়ও নেই। সুস্থির হতে না পেরে শেষে সে গেল মায়ের কাছে-মা।

মা বলল-আজ সারা দিন একবারও তো পড়ার টেবিলে বসতে দেখলাম না। শুক্রবার বলে কি পড়াশোনারও ছুটি?

কে বলল! বসেছিলাম তো।

মুখে মুখে কথা বলিস না। কী বলবি, বল।

মাই মানে কী?

মাই মানে কী, মানে?

আহা, মাই শব্দের একটা মানে আছে না!

তুই কদিন পর ম্যাট্রিক দিবি, মাই মানে যে ‘আমার’ এটা জানিস না?

ওই মাই না ওই মাই না। ওটা হলে তো বুঝতামই, এম ওয়াই। এটা বুঝছি না।

মা গম্ভীর মুখে কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন-এই শব্দ তোকে কে শিখিয়েছে? কোথায় শুনেছিস তুই?

আহা মা, শুনেছি। তুমি বলোই না মানে কী?

মা খপ করে তার হাত ধরলেন-তোকে বলতে হবে কে তোকে এই কথা বলেছে।

মোনা বুঝল গুরুতর কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছে সে।

সে বলল-কেউ বলেনি।

কেউ না বললে তুই এই শব্দটা কোত্থেকে পেলি?

বইয়ে দেখলাম। ওই যে তখন পড়তে বসেছিলাম।

কোন বইয়ে দেখেছিস? বই আন।

বইয়ে দেখিনি। রত্না বলেছে।

এই রত্নাটা কে?

বারে, তুমি চেনো না ওকে! আমার বন্ধু। আমাদের বাসায় তো কয়েকবার এসেছে। তুমি ওর কত প্রশংসা করো…।

মিথ্যা বলিস না।

মিথ্যা কেন হবে!

মা আরো শক্ত করে তার হাত ধরলে মোনা বুঝতে পারল, সমস্যা সে চুলোয় বসিয়ে দুধের মতো কেবল জ্বাল দিয়েই যাচ্ছে। এখন সরও পড়ে গেছে। এখন আর ফেরার পথ নেই। সে গোয়ারের মতো বলল-হ্যাঁ, রত্না বলেছে।

তুই কাল ওকে বাসায় আনতে পারবি?

পারব না কেন! বললেই আসবে। কিন্তু ওকে বাসায় আনতে হবে কেন!

ওকে আমি একটু জিজ্ঞেস করতাম ও এই কথা বলেছে কি না।

বারে, বলছি না…।

তাহলে জিজ্ঞেস করতাম, কেন বলেছে।

মোনার মনে আছে, মায়ের ওই কথার পর সে চেহারায় বিস্ময় ফুটিয়ে নিরীহ গলায় বলেছিল-মা, এখন মনে হচ্ছে কথাটার অর্থ খুবই খারাপ।…কী অর্থ, মা?

সেবার পার পেতে একটু ঝামেলাই হয়েছিল। তবে ওই ঝামেলার কথা কে মনে রাখে! ঝামেলার অংশটুকু বাদ দিয়ে সে মনে রেখেছে ‘মাই’ নিয়ে মজার অংশটুকু। আজ আবার বহুদিন পর ‘মাই’। ছায়াঘরে বসে মোনা আবার হাসতে আরম্ভ করল।”

আমি পড়া শেষ করে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সাজিয়ার দিকে-আমার একটা দুটো, না, কয়েকটা প্রশ্ন আছে। সহজ প্রশ্ন। করব?

করতে পার। উত্তর পরে।

মোনা কি তুমি?

আমি! তোমার তাই মনে হয়েছে?

হুঁ। হুবহু মিল থাকতে হবে, তা তো নয়। কোথাও মিল থাকলেও চলে। আছে?

সাজিয়া একটু ভাবল-আমার মনে হয় না।

আমার মনে হলো। যাকগে।…মফস্বল শহরে অল্প কিছুদিন ছিলে। সে শহরটা কি তোমার ভেতর কাজ করে?

কাজ করে না বললে ভুল বলা হবে।

আমার ‘বন্দনা করি’ উপন্যাস থেকে কিছু অংশ তুলে দিলে যে।

ওটা আমার খুব প্রিয় লেখা। এসে গেল। এ লেখাটা নিশ্চয় কোথাও ছাপা হচ্ছে না।

তুমি আমার ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করে ফেলেছ দেখছি? ইন্টেনশনালি করেছ?

না, প্রিয় লেখক। আমাকে অবসেসড বলতে পার।

আচ্ছা, এখন মূল প্রশ্নটা করি। তুমি লেখো না কেন?

এর পরের প্রশ্নটা শুনি।

আগে এটার উত্তর পেয়ে নিই।

লিখি। সাজিয়ার মুখে চাপা হাসি। ডায়েরি লিখি।

এখন থেকে গল্প লিখবে। প্লিজ।

আচ্ছা। তুমি যখন বলছ। সাজিয়া ঘাড় কাত করল।

আমি কিন্তু ইয়ার্কি মারছি না।

আমিও না।…একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি। শুরুটা একেবারে খারাপ হয়নি।

বেশ ভালো। বেশি ভালো এই কারণে-পাঠক আন্দাজই করতে পারবে না কী হতে যাচ্ছে।

এ তো শুরু মাত্র। শুরুতেই আন্দাজ করতে পারার কথা না।

তবু। কোনো ক্লুও নেই।…আর নাটকীয় নয় একটুও।

ভাবলাম, তোমার মতো বড় লেখকের সঙ্গে লিখব, নাটকীয় করা কি উচিত হবে?

আমি নাটকীয় করব।

কেন?

এমনি।…দেখি না করে।…সাজিয়া, নাটক আসলে কোনটা নয়? তোমার আমার শুরুটা কি নাটকীয় ছিল না?

ঠিক নাটকীয় বলা কি উচিত হবে? আমাদের দুজনের ভেতর একটা কমন ব্যাপার ছিল। আমি কাউকে ভালোবাসার কথা বলার জন্য, আর তুমি ভালোবাসার কথা শোনার জন্য অস্থির ছিলে। আমাদের দেখা হওয়া সেটা পূরণ করেছিল।

ঠিক তাই কি? তুমি যেমন অহরহ শুনেছ, আমিও তেমনি এদিক-ওদিক থেকে ভালোবাসার কথা শুনেছি। শোনা, ব্যাপার না এখানে।

কিন্তু শোনার মতো শোনোনি তুমি। তুমি নিজেই বলেছিলে-এভাবে কেউ ভালোবাসার কথা বলেনি তোমাকে। আর, আমার ব্যাপার হলো-ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে অস্থির আমি বলার জন্য ব্যাকুল ছিলাম।

কিংবা ব্যাপারটা এরকম-তুমি ভালোবাসা চাচ্ছিলে, অবচেতনে চাচ্ছিলে কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্ক চাচ্ছিলে না। হয়তো তুমি বুঝতে ভালোবাসার একটা ভার আছে। ইচ্ছা করলেই সেটা বহন করা যায় না।

এই আলোচনাটা থাক এখন পান্টু। আরম্ভ করলে তুমি এমন এমন সব কথা বলবে, আমার মন খারাপ হয়ে যাবে।

কিন্তু সত্যি কথাই বলব, তুমি জানো।

সব সত্যি সব সময় শুনতে-জানতে ইচ্ছা করে না।… তুমি এখন গল্পটা কিভাবে এগিয়ে নেবে?… তোমার অবশ্য কোনোভাবেই সমস্যা হওয়ার কথা না।

আমি এখন একজন ভিলেন নিয়ে আসব।

কেন!

কারণ এদের খুব সুখী দম্পতি মনে হচ্ছে।

টিপিক্যাল ভিলেন। হা হা হা, হো হো হো করে হাসবে, আর বলবে-এবার কোথায় যাবে সুন্দরী?

আনা যায়। কিংবা ভোদাই কোনো ভিলেন, যে ভালোবাসাও বোঝে না।

আহা, তবে সে কী করে ভিলেন হয়।

তাকে ভিলেনীয় কাজ করতেই হবে, এমন কথা নেই। ধরো সে কাবাবমে হাড্ডি, ধরো সে হুট করে ঢুকে পড়া, ধরো সে না বুঝেই ভজকট পাকাবে।

কিংবা বুঝে। তুমি নিশ্চয় এই এখনই তোমার অংশটুকু গুছিয়ে নাওনি।

নিইনি। নেব। তুমি যখন পাশে থাকো, আমার ওসব লেখালেখি গল্প-উপন্যাস এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করে না।

কেন! আমি নিজেই গল্পের মতো, তাই?

আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে সাজিয়ার দিকে তাকালাম। হঠাৎ আমার মনে এক ঘোর তৈরি হলো। আমি এই ঘোরের কারণ বুঝলাম না। সাজিয়া নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছে, নীল রং কোনো আশ্রয় পেলে অধিকতর সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, আজ জানা ছিল না, সে যেখানে বসেছে, তার পেছনে জানালা, জানালা গলে আজকাল প্রচুর আলো আসার সুযোগ নেই, আসছেও না। কিছু আলো এসে সাজিয়াকে ছুঁই ছুঁই করবে যেন সাজিয়াকে ডিঙিয়ে আর এগোতে সাহস করছে না, আমি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে যখন ওর দিকে তাকিয়েছি, হাসি কিছু ছড়িয়েছে ওর মুখেও, আমার ঠিক এই সময়টায় ঘোর তৈরি হলো, আমার মনে হলো-আমি এই মেয়েটিকে চিনি, আমি আগে এই মেয়েটিকে কোথাও দেখেছি।

সাজিয়াকে আমি চিনি। বছরখানেক আমাদের সম্পর্ক। আমি ওর ডাকনাম জানি, আমি ওর বাবা-মা, ভাই-বোনদের কথা শুনেছি। একবার এক শপিং মলে আমি পাঞ্জাবি কিনতে গিয়েছিলাম, আসার কথা ছিল না, আবার আসতে তো পারেই, সাজিয়া ওর হাজব্যান্ডকে নিয়ে শপিংয়ে এসেছিল, আমাদের যেন খুব ফর্মাল চেনাজানা এইভাবে, স্বাভাবিক, ওর হাজব্যান্ডকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তারপর ওর লেখাপড়া, ওর ঘরসংসার, ওর বন্ধুবান্ধব-এসব সম্পর্কেও আমি জানি। আমার কোন লেখাগুলো ওর বেশি ও কেন পছন্দ, তাও বিস্তারে আমার জানা। এর পাশাপাশি আমরা দুজন দুজনকে গ্রহণও করেছি, কমবার নয়, প্রায়। তবু, এই এখন, হঠাৎ আমার ভেতর কেন যে এই ঘোর তৈরি হলো, আর, মনে হলো-মেয়েটিকে আমি চিনি, একে আমি অবশ্যই দেখেছি কোথাও।

সাজিয়াকে এই কথা বললে ও হাসতে আরম্ভ করবে। কিংবা খুব অবাক হয়ে যাবে-জানটু, তুমি আমাকে চেনো না!

সাজিয়া আমাকে নানা নামে ডাকে, আমিও ওকে নানা নামে ডাকি। গুল্লু, গুড্ডু, জানটু, বুন্দিয়া, করমচা, আলুবোখারা…। আমি বললাম শোনো, আলুবোখারা…।

বলো, পাবদা মাছ।

আমার আরেকটা প্রশ্ন ছিল।

হ্যাঁ হ্যাঁ। সাজিয়া তখনই বলে উঠল। তুমি প্রথমেই বলেছিলে তোমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। সে হিসাবে আরো কিছু প্রশ্ন তুমি করতে পার।

এখন করব?

করো। শুনতে ইচ্ছে করছে।

আচ্ছা, মাই মানে কী?

সাজিয়া এমনভাবে তাকাল যেন সে জোর গলায় কিছু বলবে, তবে সে সামলে নিল, স্বাভাবিক গলায় বলল- একটা কথা কি জানো? তোমার রুচি নিম্নগামী।

নিম্নগামী? মাই কি নিচে থাকে?

আমি কেন যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে যাই।

আমরা এখন কথা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখতে চাই।

তারপর?

তারপর মাইর হবে, শব্দও হবে।

জি না ভাই। ভুলে যান মারপিটের কথা।

মাই মানে কিন্তু বলোনি।

এটা এমন একটা ব্যাপার, যেটা পুরুষের অবচেতনে থাকে।

অথচ মেয়ে হয়েই সেটা তুমি ধরে ফেলেছ!

আহা। সাজিয়া হাসি চাপল। লেখক না আমি!

তাও ঠিক, তাও ঠিক। বলতে বলতে আমি সাজিয়ার দিকে উঠে এলাম।

কী হচ্ছে!

দাঁড়িয়েছি। আর কী হবে।

ও। তো, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এগিও না।

এই দাঁড়ানো নিয়ে ছোটবেলায় আমার কিছু ভয়াবহ স্মৃতি আছে।

বলোনি কখনো।

ছোটবেলায় ক্লাসে লেখাপড়া পারতাম না…।

তুমি লেখাপড়া পারতে না!

হ্যাঁ। ছাত্র ভালো ছিলাম না। কিংবা লেখাপড়া আমার ভালো লাগত না। সুতরাং ক্লাসে কখনোই পড়া পারতাম না। প্রায় প্রতিদিনই স্যার খেপে যেতেন, সবাই পারছে আমি পারছি না। আমার দিকে তাকিয়ে তাই একসময় চেঁচিয়ে উঠতেন-স্ট্যান্ড আপ, ইউ বয়, স্ট্যান্ড আপ। দাঁড়িয়ে থাক তাই।…সাজিয়া, সেই থেকে দাঁড়ানো ব্যাপারটা আমার ভেতর স্থায়ী হয়ে যায়। হঠাৎই মনে হয়, কেউ যেন আমাকে তীব্র গলায় বলছে-স্ট্যান্ড আপ। আমি দাঁড়িয়ে যাই।

সাজিয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল-তুমি এমন অদ্ভুত সব গল্প এত অনায়াসে বানাও কী করে!

এটা বানানো গল্প। কেন, এ গল্প সত্যি হতে পারে না?

পারে।

তাহলে?

এটা বানানো।

সব বানানোর মধ্যে কিছুটা সত্যি থাকে। সোনার গয়না বানাতে হলে তোমার খাদ লাগে।

বুঝলাম। তা এখন কী বলতে চাও?…সামনে না সামনে না, পেছনে সরে বলো।

কিছুক্ষণ পর সাজিয়ার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে দিতে বললাম-মাঝে মাঝে আমার অদ্ভুত এক ধারণা হয়। আমার মনে হয় আমি তোমাকে চিনি।

তুমি চেনো আমাকে! সত্যি?

হ্যাঁ, মনে হয়। মনে হয় যেদিন থেকে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়, তার বহু আগে থেকেই আমি তোমাকে চিনি।

আমার সঙ্গে পরিচয় না হলে তোমার এ রকম মনে হতো না।

হতে পারে।

অন্য কারো সঙ্গে পরিচয় হলে তাকেই হয়তো মনে হতো বহুদিন থেকে চেনো।

হয়তো।…সাজিয়া, তোমার ব্যাপারটা এ রকম-আমার মনে হয় তুমি ছিলে।

কোথায়?

আমার পরিসরে।

এসব সময়ে তাত্ত্বিক কথা বললে কী হয় জানো? তাত্ত্বিক কথাগুলো ঠিক জমে না, আবার যেটা করছি, সেটাও না।

আমি বললাম-হুঁ।

সাজিয়া চলে যাওয়ার পর আমি দেখলাম আমার কিছু করার নেই। সাজিয়ার লেখাটুকু একবার হাতে নিলাম, টেবিলে রেখে দিলাম। দুজন একসঙ্গে লিখব ঠিক করেছিলাম বলে নিজের ওপর আমার রাগ হলো। কী করব এখন? আমি নিজেই যে লেখাটি শুরু করেছি, সেটাই লিখে যাব? নাকি এই এটা, যেটা আমার কথা মতো সাজিয়া শুরু করেছে? আমি যদি এটা কন্টিনিউ না করি, সাজিয়া হয়তো কিছু বলবে না, কিন্তু ওর মন খারাপ হবে। ভাববে-ওর লেখাটা কিছুই হয়নি। আমি বলেও বোঝাতে পারব না, ওর লেখাটা হয়েছে, ও ওটাকে নিজেই টেনে নিয়ে যেতে পারবে। আবার আমার এ রকমও মনে হলো-এই যে দুজন মিলে লিখব, এর মধ্যে একটা মজা আছে। দুজন মিলে লিখছি, মজা শুধু এখানে না, হয়তো দুজন মিলে লিখলে দুজনের লেখার ভেতর দুজনই উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে, মজা হয়তো এখানেও।

আমি পরদিন লিখতে শুরু করলাম।

“রুমি বুঝতে পারল তার গলা জড়িয়ে গেছে। যা সে বলছে, নিজেই স্পষ্ট করে বুঝছে না, যে শুনছে-সে কি বুঝছে? সম্ভবত সেও বুঝছে না, কিন্তু তার বলতে ইচ্ছা করছে। তার অনর্গল কথা বলতে ইচ্ছা করছে। এত কথা বলতে ইচ্ছা করছে, বলা শেষ হলে সবাই যেন বোঝে তার কত কথা বলার ছিল। মাঝেমধ্যে টুকটাক কিছু যদি বলতে চায়, জামান ভাই বলতে পারে, সে আপত্তি করবে না।

সে বলল-ছোটবেলায় আমার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে পর্যটক হব।

জামান ভাই গ্লাসের তলানি শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর-এই নিয়ে কথাটা তুমি তিনবার, নাকি চারবার, কয়বার বললে?

আমি যখন বেশ ছোট, স্কুলের প্রথমদিকে। রুমি বলল। ফোর বা ফাইভে পড়ি তখন, এখন আর আমার মনে নেই কী কারণে এই স্বপ্নটা আমার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। এমন হতে পারে-বাবার মধ্যে একটা স্বপ্নতাড়িত হওয়ার ব্যাপার ছিল, বলেছে আমাকে, ছোটবেলা থেকে ওটা দেখতে দেখতে…।

আমার মনে হয় তোমার এ কথাটাই ঠিক। তোমার বাবার স্বপ্নগ্রস্ত হওয়া তোমাকে সংসারবিমুখ করেছিল। সেই থেকে তোমার পর্যটক হওয়ার ইচ্ছা।

হতে পারে। রুমি টেবিলে গ্লাস রাখতে গিয়ে উল্টে ফেলল। কিন্তু জামান ভাই, সত্যি কথা হলো, কিছুই হলো না জীবনে।

কিছুই হলো না?

নাহ।…বাদাইম্যা-লোকে বলত। আমার ওই জীবনই পছন্দ ছিল। বাদাইম্যা জীবন। পায়ের নিচে ছিল সুপারি। আজ এখান তো কাল ওখানে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম কই!

কেন পারলে না?…ওহ্ বলেছ তুমি। ক্লান্তি, না?

হ্যাঁ, ক্লান্তি। এখন মাঝে মাঝেই থিতু হয়ে বসতে ইচ্ছা করে, বিশ্রামের ভেতর থাকতে ইচ্ছা করে।

তোমার বাবাও কি এরকম ছিলেন? হ্যাঁ, সংসার আর না সংসারের মাঝামাঝি।

বারবার বাবার কথা তুলছেন কেন?

তুমিই আরম্ভ করেছ। এর আগেও, বেশ আগে ফেরিঘাটে যখন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, কথা, তোমার কথা যেমন শুনেছিলাম, তোমার বাবার কথাও। সত্যি কথা কী, তোমার দেওয়া তোমার বাবার বর্ণনাই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। কে জানে, বেঁচে থাকলে আমি হয়তো ওনার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। হ্যাঁ, সংসার আর না সংসারের মাঝামাঝি যে ব্যাপারটা-সেটা নিয়ে কথা বলতাম।

ওহ।…জামান ভাই…।

বলো।

আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

বলো। কেউ বারণ করেনি।

কিন্তু মদ খেয়ে আমার জিভ জড়িয়ে গেছে।

না, বেশি জড়ায়নি। অল্প।

জামান ভাই।

বলো।

আমার সব কিছু মনে আছে।…আমরা থাকতাম মফস্বল শহরে। আমাদের বন্ধুদের দলটা ছিল বড়। তখন জামান ভাই, ক্রিকেট খেলার এতটা চল ছিল না। আমরা খেলতাম ফুটবল। আমরা খেলতাম বললে অবশ্য কিছু পরিমাণ ভুল বলা হয়।

কেন?

কারণ আমি খেলতাম না।

ভালো লাগত না?

নাহ। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, দাঁড়িয়াবান্ধা-কোনো খেলাই আমার ভালো লাগত না। তবু বন্ধুদের চাপে পড়ে মাঝে মাঝে আমাকে নামতে হতো। সে যাক, আমার ভালো লাগত, আমাদের ছোট শহরের পাশে একটা ছোট নদী ছিল, ওখানে গিয়ে বসে থাকতে।

হুমম।

অনেক বন্ধু এই নিয়ে খেপাত। ইলিয়াস বিশেষ করে। ও ছিল আস্ত একটা ডাকাত। যেমন ফুটবল খেলত, তেমন ভলিবল। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ কাউকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিতে ওর জুড়ি ছিল না। অন্য মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি হলে ও থাকত সবার আগে।

আর তুমি? সবার পেছনে?

ওরকমই।….দাঁড়ান, ইলিয়াসের আরো কথা আছে। মৌসুমি ফলের সময় বিভিন্ন বাড়ির গাছ হালকা করার দায়িত্ব আগ বাড়িয়ে ওই নিত। ওর ছিল অনেক সাহস। এ রকম সাহসী ছেলে, বুদ্ধি একটু কম ছিল যদিও, আমি খুব কম দেখেছি। এই ইলিয়াস আমাকে খেপাত। জামান ভাই, আমি কি বোঝাতে পারছি?

বলে যাও।

আমার কথা কি খুব বেশি জড়িয়ে গেছে?

অল্প। কিন্তু তুমি কথা বলছ গুছিয়ে। আরেকটু বলো, শুনি।

ইলিয়াস আমাকে খেপাত। আমরা যখন সেভেন-এইটে পড়ি, আমার পর্যটক হওয়ার ইচ্ছার কথা বন্ধুদের তখন জানা, কোনো বিকেলে আমাকে হয়তো চেপে ধরত ইলিয়াস-অই, তুই কই পালাস! টেনে ধরে ও আমাকে খেলতে নামাত। আবার খেলা শেষ হলে ও আমাকে বলত-রুমি, তরে কবিতা লিখতে দিলাম না বইলা তুই কি আমার ওপর রাগ করলি? রাগ হইছে তোর?

তুমি কি কবিতা লিখতে?

আরে না।

শৈশবে কবি হওয়ার বাসনা অনেকেরই থাকে। তাচ্ছিল্য করার কিছু নেই।

আমি কবিতা লিখতাম না জামান ভাই। আমি ইলিয়াসের কথায় খেপে যেতাম-কবিতা লেখার কথা তোকে কে বলেছে? খামাখা এসব বানাচ্ছিস কেন!

ইলিয়াস আরো চেপে ধরত-সত্য কইরা বল, তুই কবিতা লেখস না। আমিও জোর গলায় বলতাম-না।

জোর গলায় কেন বলতে? কবিতা লেখা ব্যাপারটা কি তুমি খুবই অপছন্দ করতে?

আমি আসলে সেটা বলতে পারতাম না কেন যে জোর গলায় বলতাম। তবে যতই জোর গলায় বলি না কেন ইলিয়াস হাসত-ও বুঝছি! তুই তো আবার পর্যটক হইবি। নদীর ধারে বইসা তার রিহার্সেল দ্যাস।…জামান ভাই, বন্ধুদের মুখ থেকে আমাকে এরকম অনেক কথাই শুনতে ও সহ্য করতে হতো। কখনো আমি খেপে যেতাম, কখনো হেসে উড়িয়ে দিতাম। খেপাত বেশি ইলিয়াস…।

তোমার এই বন্ধুটিকে আমার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

সত্যিই ও ইন্টারেস্টিংই ছিল।…কত দিন যে দেখা হয় না ওর সঙ্গে! কোথায় কিভাবে আছে, তার কিছুই জানি না।…যা বলছিলাম, খেপাত বেশি ইলিয়াস, আবার ভালোও বাসত। বন্ধুদের মধ্যে এই ইলিয়াসের সঙ্গেই ছিল আমার সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক। ও সময়ে-অসময়ে আমাকে খেপাত বটে, তবে ওই সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করত আমাকে বোঝার।

বুঝতে পারছি।

কোনো কোনো ছুটির দুপুরে ও চলে আসত আমাদের বাসায়। আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, আমি যদি শুয়েও থাকতাম, জিজ্ঞেস করত-কী করতেছিস রুমি? বইসা বইসা কবিতা লেখতেছিস? আমি বলতাম-তুই জানিস আমি কবিতা লিখি না। ও হাসত-তাইলে বোধ হয় ঘর থেইকা বাইর হওনের ধান্ধা করতেছিস। রুমি, সত্য কইরা বল-পর্যটক হইয়া তুই ফাস্ট চান্সে কই যাইবি?

কী ইচ্ছা ছিল তোর?

নির্দিষ্ট করে কিছু না। আমি ওকে বলতাম-ইলিয়াস, আমার পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছা, আমার সমুদ্রে যাওয়ার ইচ্ছা, আমার গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা। আমি বলতাম-বুঝেছিস ইলিয়াস, এই যে ধর তুই একটা নতুন জায়গায় গেলি, সে জায়গা সম্পর্কে হয়তো তোর কোনো ধারণাই ছিল না, এটা হচ্ছে একটা আবিষ্কারের মতো…সত্যি কথা বলি ইলিয়াস, ঘরে থাকতে আমার ভালো লাগে না। শুধু মনে হয়, অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই আনন্দ। ইলিয়াস খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনত, গম্ভীর গলায় বলত-রুমি তোর খুব সাহস রে।

কথা শেষ করে রুমি চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ সে কোনো কথা না বলে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল।

তাকে বেশ কিছুটা সময় দিল জামান, তারপর জিজ্ঞেস করল-কী হলো তোমার?

কিছু না।

তোমাকে ধ্যানমগ্নও মনে হচ্ছে না। এ জগতেই আছ।

জামান ভাই, ইলিয়াস বলত না-আমার খুব সাহস, এ কথাটা ও ভুল বলত।

তা-ই?

না হলে ফিরে এলাম কেন! কেন ধরে রাখতে পারলাম না। কেন থিতু হয়ে বসার বাসনা জাগল মনে!

ক্লান্ত?

সাহসী মানুষ কেন ক্লান্ত হবে? সাহসী মানুষ কখনো ক্লান্ত হয়!

মানুষের মাঝে মাঝে বোধ হয় গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।

আপনার মতো? আপনি প্রথম থেকেই এ রকম গোটানো?

আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেব না।

ব্যাপার আছে?

থাকলেও সব ব্যাপারই একসময় তার অবস্থান হারায়।

হয়তো।…জামান ভাই…।

তুমি খাচ্ছ না কেন?

অনেক খেয়েছি। আরো খেলে মাতাল হয়ে যাব। তা ছাড়া জিন আমার ভালো লাগে না।

কিন্তু এই ভরদুপুরে আমি তোমাকে হুইস্কি খাওয়াতে পারি না। বিয়ার অবশ্য খাওয়া যায়। কিন্তু বিয়ার আমি রাখি না। ওটা হচ্ছে অমার্জিত লোকের পানীয়।

আপনি নিজেকে যথেষ্ট মার্জিত মনে করেন?

তোমার কি সন্দেহ আছে এতে?

নাহ্। নেই। রুমি বড় করে শ্বাস ফেলল।

আমার ওই কথাটা বোধহয় তোমার পছন্দ হয়নি?

কোন কথাটা?

ওই যে, আড্ডার একদম শুরুতে বলেছিলাম-সব মানুষই নিজের ভেতর যেতে চায়…।

জি, ঠিক ধরেছেন। পছন্দ হয়নি।

কেন?

নিজের ভেতর না। সব মানুষই আসলে একটা আশ্রয়ে যেতে চায়।

সেই যে প্রথম দেখা, বহুদিন আগে ফেরিঘাটে, তখন তোমাকে যতটা বোধসম্পন্ন মনে হয়েছিল, এখন, গত দুই দিন হলো সে রকম আর মনে হচ্ছে না।

আমি ক্লান্ত।

কিংবা বোধের ওই পর্যায়ে তুমি কোনো সময়ই ছিলে না। আমি ভুল বুঝেছিলাম।

রুমি তাকাল জামানের দিকে। তাকিয়ে থাকল না, চোখ ফিরিয়ে নিল। ইদানীং তার মন ভালো থাকে না। ইদানীং অদ্ভুত এক অস্থিরতায় পায়-না, এভাবে আর না। বছর দেড়েক হলো সে এরকম ভাবছে-না, এভাবে আর না, কিন্তু কোথাও কোনো সুবিধা করতে পারছে না। ব্যবসা করার পয়সা তার নেই, চাকরি করার বয়স পার হয়ে গেছে। এখন চাকরি যদি হয়, তবে তেমন পরিচিতজনদের মাধ্যমে। কিন্তু তার পরিচিতজন কোথায়? একসময় কত বন্ধু ছিল তার, কিন্তু আজ তারা সব কে কোথায়! ফেলে আসা শহরে গেলে হয়তো বেশ কয়েকজনের খবর পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ওই শহরে ফিরতে তার ইচ্ছা করে না। তাহলে?

জামানের সঙ্গে পরিচয় তার এক নদী পার হওয়ার সময়। সে জায়গাটা ছিল বেশ ভেতরের দিকে। জামানও ঘুরতে বেরিয়েছিল। তবে সে থিতু মানুষ। বয়সে বছর দশেকের বড় হবে। বিয়ে করেনি। তার কাজ হচ্ছে প্রতিদিন বন্ধুবান্ধব ডেকে মদ খাওয়া। সে-ই ডাকে, কারণ সবার সঙ্গে মদ সে খায় না। সে মদ খায়, আর, মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়ে। টাকা-পয়সার জন্য তাকে ভাবতে হয় না। পৈতৃক সূত্রে সে দুটি বিশাল বাণিজ্যিক ভবনের মালিক।

সেবার পরিচয়ের দেড়টা দিন তারা একসঙ্গে ছিল। সময়টা ভালো কেটেছিল। মাঝখানে আরেকবার দেখা হয়েছিল তাদের। সেবার রুমি দীর্ঘদিন পর ঢাকা এসেছিল। এমনিই এসেছিল। তারপর এই আবার এসেছে সে। উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। তার আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।

জামান সামান্য শব্দ করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। রুমির দিকে তাকাল, তার মুখে হাসির একটা প্রলেপ, সে বলল-তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ, রুমি? তোমাকে গম্ভীর দেখাচ্ছে।

গম্ভীর না, দেখালে অন্যমনস্ক দেখাতে পারে। আর আমি রাগ করতে যাব কেন?

ওই যে তোমাকে বললাম, বোধের ওই পর্যায়ে তুমি হয়তো কোনো সময়ই ছিলে না।

ছোট করে হাই তুলল রুমি-না, রাগ করিনি।

কেন করোনি? তোমার কি রাগ নেই?

উত্তর দিতে গিয়ে জামানের দিকে তাকাল না রুমি, সে তাকাল বিশাল দেয়াল ঘড়ির দিকে-আমার আগে কিছু রাগ ছিল।

তারপর কেন সেটা চলে গেল?

রুমি ক্লান্ত গলায় বলল, আমার এত কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

আহা, বলোই না শুনি।

পথে পথে থাকতে থাকতে আমার রাগ চলে গেছে। আমার মনে হয়েছে রাগের কোনোই মানে হয় না।

এত চমৎকার বোধ যে জীবনে সঞ্চারিত হয়, সে জীবন ছেড়ে তুমি চলে আসবে?

আসব।…কিন্তু আপনি তো কিছুই বলছেন না।

কী বলব?

আমার একটা চাকরি বা এ ধরনের কিছুর ব্যবস্থা করে দেবেন কি না।

রুমি, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবছি।

ভাবেন। আমার অবস্থা খারাপ। বেশ খারাপ। গরিব। ওই যে আমার রাগ চলে গেছে, গরিবিও তার পেছনে একটা বড় কারণ। গরিব মানুষের রাগ থাকতে নেই।

আমার তো উল্টো মনে হয়। গরিব মানুষেরই রাগ বেশি থাকে-কেন সে গরিব!

হতে পারে, এসব আর ভাবতে ইচ্ছা করে না।

তোমার মতো শার্প ছেলের বোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এটা দুঃখজনক।

পকেট গরম আর পর্যাপ্ত সময় না থাকলে বোধের ব্যাপারটা ঠিক থাকে? মানুষ যখন উদ্বৃত্ত ফসলের অধিকারী হলো, হাতে জমা হলো বাড়তি সময়-তখনই তার ভাবনার জগৎ প্রসারিত হতে আরম্ভ করল।

দামি কথা, কিন্তু ঠিক কথা না।

কেন?

অনেক ফকির-দরবেশের কথা আমরা জানি, যাদের পকেটে পয়সা ছিল না, কিন্তু বোধের ব্যাপারটা উন্নত ছিল।

ওরা উদ্বৃত্ত সমাজের আরেক ফসল। তা ছাড়া তারা সত্যিই সংসার থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিতে পেরেছিল।

তুমিও করেছিলে। কিন্তু এখন আর সেটা টেনে নিতে পারছ না, এই তো?

হ্যাঁ, এই।

বুঝতে পারছি, আবার পারছিও না-কেন যে তুমি সংসারী হতে চাচ্ছ!

আপনি নিজেও সংসারী।

আমি আধা-সংসারী। হাফ গেরস্ত। আর আমি তোমার মতো সংসার ত্যাগও করিনি কখনো।

বলেছি তো অনেকবার-ক্লান্ত।…গরিবও। পকেটটা একবার ভারী করে দেন, দেখবেন কত দামি দামি কথা বলি।

পকেট ভারী-এভাবে বললে নির্দিষ্ট করে কিছু বোঝায় না। কারো পাঁচ শ টাকায় পকেট ভারী হয়, কারো পাঁচ লাখে।

আমার কত হলে পকেট ভারী হবে, সেটা আপনি ভালো করে জানেন।

হুঁ। হুঁ বলে মাথা ঝাঁকালেন জামান। বড় করে জিন ঢালল, লাইম মেশাল, তারপর চুমুকও দিল বড় করে।

জামান ভাই।

উঁ?

আপনি কি আমার ব্যাপারটা দেখবেনই না?

রুমি, এই সব টাকা-পয়সা, বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে একটুও ইচ্ছা করছে না।

ও।

তাছাড়া কে বলল তোমাকে ও ব্যাপারটা আমি দেখব না?

কেউ বলেনি। আপনার বলার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

ঠিকই বলেছ। চাকরি আমি তোমাকে দেব না।

দেবেন না?

না।

কেন?

চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আমার এখানে আসা বন্ধ করে দেবে।

এটা একটা কথা হলো!

হলো। ওসব চাকরিবাকরি বাদ দাও। আমার সঙ্গে আড্ডা দাও।

খাব কী? থাকব কোথায়?

তিন বেলায়ই আমার এখানে খেতে পারো। থাকার ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে। রাত ১১টার পর থেকে আমি একা থাকতে ভালোবাসি।

রুমি চুপ করে থাকল।

বেশি করে মদ খাও রুমি। জামান বলল। এই যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তোমাকে আমি চাকরি দেব না, এই দুঃখে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাও তুমি।

রুমি তাকিয়ে থাকল জামানের দিকে।

অমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছ কেন?

এমনি।

আমার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছা করছে?

রুমি জামানের প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে ঠিক করল, আরো দুই-তিন দিন এ বাসায় সে আসবে।

হয়তো জামান ভাই ইয়ার্কি মারছে। হয়তো ইয়ার্কি মারা বন্ধ করে কাল-পরশুই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। যদি না দেয়, রুমি আর কোনো দিন এ বাসায় আসবে না।

আমি এ পর্যন্ত লিখে রেখে দিলাম। এরপর থেকে সাজিয়া লিখবে। সাজিয়া গেছে ঢাকার বাইরে। একসময় ঢাকার বাইরে এক মফস্বল শহরে ওর বাবার পোস্টিং ছিল বছর তিনেকের। কখনো তিন বছর ছোট সময়, কখনো লম্বা। সাজিয়া বলে, ওদের ওই তিন বছর ছিল আনন্দময় লম্বা। চেনাজানা তো হয়েই গিয়েছিল অনেক, বন্ধুও। তাদের অনেকের সঙ্গে এখনো ওদের দেখা হয়।

ওর বাবা ওখানে কিছু জমি কিনেছিলেন। কেনার কথা না। সরকারি চাকরি, বদলি আছে। কোনো জায়গায় বদলি হয়ে এলে সেখানে জমি কেনা ঠিক চাকরির ধরনের সঙ্গে যায় না আর, আবার বদলি হয়ে কোথায় চলে যাবে, তখন জমির কী হবে? কিন্তু কেনা হয়ে গেল। কেন, কিভাবে কেনা হলো, সাজিয়ার এসব জানা নেই। তখন সে ছোট, পরে তার বাবাও তেমন কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি, মজা করেছি শুধু-কী কাণ্ড, আমি ওখানে জমি কিনে ফেলেছিলাম। সেই জমি পরে না-ও থাকতে পারত, দখল হয়ে যেতে পারত। এসব এখন সব জায়গায় হয়, হয়নি থেকে গেছে। এই এত দিন পর, সাজিয়া বলেছে, বছর দু-তিন তারা চাচ্ছে জমিটা বিক্রি করে দিতে। তারা চাচ্ছে মানে, চাচ্ছে আসলে যারা দেখাশোনার মূল দায়িত্বটা পালন করত, তারা। তারা এত দিন পরও বন্ধুস্থানীয়, তাদের সংসার বড় হয়েছে, তাদের জমি দরকার তা ছাড়া সাজিয়ার বাবা-মা কিংবা সাজিয়াও নিশ্চয় ওখানে ফিরে যাবে না। তাহলে?

তাহলে বিক্রিই তারা করবে। নিজেরাও তারা কয়েকবার এ রকম ভেবেছে। ওর তরফ থেকে প্রস্তাব আসার পর না বলার কোনো কারণ নেই। তারা না বলেওনি, সাজিয়ার বাবা তাদের বলেছিল, এ তো চমৎকার একটা ব্যাপার হবে তাহলে। নিজেদের মানুষের কাছে থাকবে যখন, থেকে যাবে ওটা, পর-পর মনে হবে না।

তবে দেখতে দেখতে বছর দুয়েক হয়ে গেল, নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই ব্যাপারটা আটকে থাকার পর এবার হচ্ছে। সাজিয়ার বাবা-মা গেছেন, সাজিয়াও। আমি অবশ্য সাজিয়াকে বলেছিলাম, তোমার যাওয়ার কী দরকার! তুমি কি দলিলে সই করবে?

বাবা-মাকে একা পাঠাব? তাঁদের বয়স হয়েছে।

তুমিই বলো ওনারা খুব শক্তপোক্ত।

তবু।…আর, আমিও যাইনি বেশ অনেক দিন, যাই না একটু।

মিথ্যা। তুমিই একবার বলেছিলে, আমার সঙ্গে পরিচয়ের আগে-আগেই গিয়েছিলে।

আহা সে কি কম দিন হলো!

ছোটবেলার কেউ আছে বুঝি! আমি একটা ফিচকে হাসি দিলাম।

সাজিয়া হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল-অনেকে।

আকবর?

আকবর।

রায়হান?

রায়হান।

মাথামোটা জগলু?

অ্যাই, ওকে তুমি মাথা মোটা বলবে না।

তুমিই বলেছিলে একবার।

আহ, সে আমি ছোটবেলার গল্প করতে গিয়ে বলেছিলাম। বলেছিলাম, ওকে সবাই ওই নামে খেপাত।

তুমিও?

না। ওর জন্য আমার বরং মমতা হতো। সবাই ওকে খেপাত, আর ও আমার কাছে এসে বসে থাকত।

লিখতে যখন শুরু করেছ, তখন তুমি ওকে নিয়েও লিখতে পার। মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমাদের এখানে কাজ নেই।

দেখো, ও ঠিক মানসিক প্রতিবন্ধীও না।

না হোক, একটা ক্যারেক্টার তো।

তোমার সঙ্গে কোনোভাবে পরিচয় হতো, তুমি ভালো লিখতে পারতে।

আমি হাসলাম-কে জানে, হয়েও যেতে পারে কোনো দিন।

সাজিয়া ফিরল আরো তিন দিন পর। সেদিনই ওর পাশে আসা সম্ভব না। শুধু ফোনে জানিয়ে রাখল। দেখা হলো তার পরদিন, বলল, কাল ফোনে একবার বলেছি, আজ সামনাসামনিও একবার বলি-স্যরি।

তোমার মুখে কালো একটা পরল পড়েছে। রোদে রোদে অনেক ঘুরেছ?

কী করব! গেছিই যে ঘুরতে।

খুব ঘুরলে?

খুব। তবে শহরটা বড় হয়ে গেছে, এটা একটু মন খারাপ করে দেয়। তবু অনেক কিছুই সেই আগের মতো। দারুণ কাটল দিনগুলো।

আমি বললাম-দারুণ কাটার কারণ নেই।

সাজিয়া হাসল-কে বলল নেই! থাকতেও পারে।

তুমি সেই স্কুলে পড়ার সময় থাকতে ওখানে। তাও বছর তিনেক। তারপর অনেক দিন গেছে। তুমি হয়তো গেছ কয়েকবার। কিন্তু এও তো ঠিক, ও শহর বদলে গেছে অনেক। সেই নরম নরম ভাবটাও নিশ্চয়ই নেই, সেই রোদ আর ছায়ামাখা অবস্থাটাও নেই। থাকার কথা না, থাকে না। এত দিন পর তুমি নিশ্চয়ই ওখানকার কেউ না। আর তোমার বন্ধুরাও নিশ্চয়ই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। যারা আছে তাদের সঙ্গে সম্পর্কও নিশ্চয়ই খাপ ছাড়া।

সাজিয়া কিছু বলতে নিল, বলল না, ভাবল, তারপর বলল-তোমার প্রায় সব কথাই ঠিক। কিন্তু ওই শহরে আমার ভালো লাগে।

এমন হতে পারে, তুমি হয়তো ওখানে কল্পনা বা ফেলে আসা দিনগুলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াও।

একটু ভাবল সাজিয়া-হ্যাঁ, হতে পারে।…লিখেছ?

আমার ওঠার ইচ্ছা হলো না। আমি লেখার টেবিল দেখিয়ে দিলাম-তুমি জানোই লেখা কোথায় থাকে। ওই যে, ওখানে।

লেখাটুকু পড়তে বেশি সময় নিল না সাজিয়া। পড়ে সে হাসতে আরম্ভ করল-ভিলেন তাহলে একজন চলেই এলো।

একে তোমার ভিলেন মনে হচ্ছে? যার দাঁড়াবার জায়গা নেই।

কে কখন কিভাবে ভিলেন হয়ে উঠবে, কেউ বলতে পারে না। যেমন কখনো বোঝা যায় না কে আসলে নায়ক।… আর শোনো, তুমি একদম আমার মতো করে লিখেছ। শুধু একটা ব্যাপার বাদে। তুমি নাটকীয় করে ফেলেছ।

মনে হলো দেখিই না নাটক-নাটক করে কেমন হয়।

তুমি কি ভেবে রেখেছ, একে, এই রুমিকে দিয়ে কী করবে?

এখন কিন্তু তোমার পালা। তুমি ঠিক করবে রুমিকে নিয়ে তুমি কিভাবে এগোবে।

এমন হতে পারে আমি তোমার দেওয়া চাল পাশ কাটিয়ে গেলাম।

এই রুমিকে তোমার অংশে আনবেই না? অন্য কিছু লিখবে?

হুঁ, হতেই পারে। হতে পারে না? আমি হয়তো মোনা আর ইলিয়াসকে নিয়েই থাকলাম।

…আচ্ছা, একটা কথা, এমন কাউকে চেনো তুমি?

আমি সাজিয়ার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে নেই। হাতের কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক সেদিকেও না। ওকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। অন্য সময় হলে খেয়াল করতাম না হয়তো, কিন্তু এখন আমার চোখে পড়ে গেল, খুব সামান্যই অন্যমনস্ক সে, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সে এড়াতে পারছে না। আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলাম।

সাজিয়া বলল-আমি রুমির কথা বলছি। এ রকম কাউকে চেনো তুমি?

চিনতেই হবে? এমন কি সত্যি সত্যিই কেউ কোথাও নেই?

থাকতেই পারে। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, তুমি ব্যক্তিগতভাবে চেনো কি না।

না, আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু নতুন সব চরিত্র চারপাশের নানা চরিত্র মিলেমিশে হয়। চারপাশের লোকজনের ওর এটা ঢোকে, এর ওটা। আবার কখনো হয়তো সত্যিই ওরকম কেউ থাকে, একটু শুধু পরিমার্জনা করতে হয়।

কখনো আবার লেখকের কিছু অংশও ঢুকে পড়ে…।

আমি হাসলাম-হ্যাঁ, তাও হয়। কিন্তু আমার আর রুমির বিস্তর ব্যবধান।

সে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ধরতে পারছি না।

কী?

আহা, সেটা বুঝলে জিজ্ঞেসই করতাম।

ভাবো।

আচ্ছা বলো তো, তুমি আছো এর মধ্যে?

কেন এই প্রশ্ন-আমি সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। মোটেও সিরিয়াস মনে হলো না ওকে। মুখে দুষ্টুমির প্রলেপ ছড়ানো একটা হাসি, আবার সে হাসি পার হয়ে কিছু একটা আছে। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম-সেটা কী। বুঝতে পারলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম-কিছু একটা।

সাজিয়া বলল-আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলিনি। উত্তর চেয়েছি।

আমাকে তোমার অমন ভ্যাবলা মনে হয়?

আহা, এ ছেলেও মোটেও ভ্যাবলা নয়, অসহায়।

আমাকে তোমার অমন অসহায় মনে হয়?

পৃথিবীর সব মানুষই কখনো না কখনো অসহায়।

কিন্তু এই রুমি পুরোটা সময়ই এ রকম। ঠিক অসহায় না, গুটিয়ে থাকা, নিজেকে পেছনে রাখা, আবার একটু থিতু হতে চাওয়াও-আমার এ রকম একটা ভাবনাই মাথায় ছিল। আমি জানি না, কখনো রুমিকে নিয়ে লিখতে হলে তুমি কিভাবে লিখবে।

এভাবেই। সাজিয়া সামান্য মাথা ঝাঁকাল। মানে এভাবেই চেষ্টা করব।

আমি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম-সত্যি কথা হলো, আমি এর মধ্যে কিছুটা হলেও আছি।

দেখেছ, আমি ঠিকই বুঝেছি।

তাহলে বলো, মিলটা কোথায়?

সেটা পারব না। সেটা আমি সত্যিই পারব না।…আপাতদৃষ্টিতে কোনো মিলই নেই। তুমি অসহায় না, তুমি নিজেকে পিছিয়ে রাখা না, তুমি গুটিয়ে রাখা না, …শুধু একটু ভ্যাবলা তুমি আছ বৈকি।

আমি সাজিয়ার শেষ বাক্যটা ইয়ার্কি যদিও, ইয়ার্কি হিসাবে নিলাম না, মাথা ঝাঁকালাম ঠিক বলেছ। সব মানুষের মধ্যেই এক-আধটু ভ্যাবলামো আছে। কখনো সেটা বোঝা যায়ই, কখনো হঠাৎ সেটা বোঝা যায় না, কখনো সেটা বোঝাই যায় না।

হুমম। …আজ উঠব।

সুন্দরী সাম্পানে করে মাধুরী এসেই বলে যাই।

এ কদিন ছিলাম না। কাজ জমে আছে অনেক।

যাও। আমি কি আর আটকে রাখার কেউ!

আহারে! তোমাকেই যে কে আটকে রাখে…!

আমি বাধ্য, আমি অনুগত, আমি সিটানো মুড়ি, ভিজে যাওয়া দেশলাই…।

যাচ্ছি দেশলাই, দুদিন পর, বেশি হলে তিন দিন পর আসছি।

এসো, অকটেন।

সাজিয়া চলে যাওয়ার পর আমার আর কিছু করার নেই। আমার ভালো লাগছে, আমি লেখালেখিটা শুরু করতে পেরেছি। এভাবে শুরু করা না হলে, করা হতো না-এমন না, এটা এমন কোনো কিছু হবে, তাও না, কিন্তু লিখছি-এ ব্যাপারটুকু আনন্দের। এটা শেষ হলে আমি আমার নিজের লেখায় হাত দেব। সেটা অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই করা যায় যে লেখাটা শুরু করেছি সাজিয়ার সঙ্গে, শুরু হয়েছে, শেষ করতে হবে, এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। তা ছাড়া সব লেখার কি শেষ থাকে? ওই অর্থে কোনো লেখারই শেষ থাকে না, সবই আপাত শেষ, এর পাশাপাশি অনেক লেখা কি আমরা লিখতে লিখতে শেষ না করেই ফেলে রাখি না, তারপর সে আর কোনো দিন লেখা হয়ে ওঠে না, সে রকম আমি এটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম।

প্রথম সমস্যা, সাজিয়া রাগ করবে। প্রস্তাবটা ওর ছিল না, আমার ছিল, আমি ওকে অনুরোধ করে শুরু করিয়েছি। হয়তো এ রকম কিছু একটা শুরু করার ইচ্ছা ওর ভেতর ছিল। না থাকলে রাজি হয়ে যাওয়ার কথা না। কিংবা ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ওর কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। সে যাই হোক, সাজিয়া আমার সঙ্গে শুরু করেছে, এখন আমিই ইতি টানলে সেটা আনন্দময় কিছু হয়ে থাকবে না। পাশাপাশি, আরো একটা ব্যাপার থাকছে। এমন হতে পারে, জানি সম্ভাবনা খুবই কম, লেখাটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠল! আমরা দুজনই বললাম-বাহ বাহ, বেশ তো দাঁড়াল! আর, যদি না দাঁড়ায় বসেই থাকে, কিংবা শুয়ে, হাত জড়তামুক্ত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে। সুতরাং চলুক। আমি জানিও না, এ লেখাটিই আপনাকে ভবিষ্যতে কখনো কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করবে না।

আমি লেখাটা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। শেষ হোক। শেষ হলে আমি একটু বেড়াতে যাব। অনেক দিন বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া হয় না। আমার ধারণা, খুঁজলে শরীরের এদিক ওদিক জং পাওয়া যাবে। ওসব কাটাতে হবে। ওসব কাটিয়ে আমি ফিরে আসব, তারপর নতুন করে লিখতে বসব।

সাজিয়া এলো চার দিন পর-স্যরি।

মঞ্জুর।

একটা বাজে কাজ করেছি। অনেকটা লিখে ফেলেছি।

বাজে কেন! এ তো ভালো।

তবে তোমার রুমিকে ধরিনি।

কোথায়?

আহা! রুমির কথা তুমিই লিখবে। এখন পড়ো তুমি। এখনই।

আমি পড়তে আরম্ভ করলাম।

“ভাই সাহেব, অ্যামাউন্টটা কি আরেকবার কইবেন?

প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে রিসিভার কানে রেখে সামনে বসা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসল ইলিয়াস, ফিসফিস করে কিছু বলতে নিল, তার আগেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো।

এক কোটি? এক কোটিই তো কইলেন, না?

ওপাশের কণ্ঠ বলল-জি। উই হ্যাব ডিসাইডেড টু গিভ ইউ দিস অ্যামাউন্ট অব মানি।

ভাই সাহেব, কী কইলেন ইংরেজিতে সেইটার অর্থ বুঝছি। কিন্তু বাংলায় কওন যায় না?

জি জি, নিশ্চয় বলা যায়।

ইংরেজি যে একেবারেই বুঝি না, এইটা না। কিন্তু খটখট কইরা কানে বাজে।

জি, ঠিক আছে। …ডিলটা কি হচ্ছে।

আপনারা তো ডিসিশন লইছেন, সমস্যা হইল আমি ডিসিশন লইতে পারতেছি না।

কেন?

টাকার পরিমাণ শুইনা।

এক কোটি টাকা কি যথেষ্ট নয়? ইজেন্ট ইট অ্যা গুড অফার?

ভাইজান, এইটা কী বলেন! এত টাকা দিয়া আমি কী করব!

জি…?

এত টাকা আপনারা আমারে দিবেন, আমি কই রাখুম কী করুম বুঝতেছি না। জীবনেও তো এই টাকা আমি শ্যাষ করতে পারমু না।

আপনার বলার ধরন অন্য মিনিং ক্যারি করছে।

আপনাদের অফারটাও অন্য মিনিং ক্যারি করতেছে। আপনেরা আমারে বিপদে ফেলার পরিকল্পনা নিছেন।

প্লিজ পরিষ্কার করে বলেন।

আমার নিজের একটা অফার ছিল…।

জি, বলেন।

বলব?

কেন বলবেন না!

টাকার পরিমাণ একটু কমাইয়া দিলে হয় না?

কেন!

যেন সামলাইতে পারি।

ইলিয়াস সাহেব…।

জি, বান্দা হাজির। বলেন।

আপনি ইয়ার্কি মারছেন।

ধইরা ফালাইছেন। মারাত্মক বুদ্ধি।

এটা কি ঠিক হলো?

কী?

আমি ইয়ার্কি পছন্দ করি না।

আমিও না। আপনে ইয়ার্কি মারলেন ক্যান? আমি আপনার সঙ্গে কোনো ইয়ার্কি মারিনি। এক কোটি দিবেন কইলেন, এইটা ইয়ার্কি না?

আমাদের কাছে যেটা রিজোনেবল মনে হয়েছে, আমরা সেটাই বলেছি।

সেটাই আমার কাছে ইয়ার্কি মনে হইছে। গুড নাইট…স্যরি, এইটা তো রাইতের বেলা বিদায় নেওনের সময় কয়। এখন তো দিন। গুডবাই। ইলিয়াস ফোন রেখে কতক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকল। তাকে কিছুটা চিন্তিতও দেখাল এবং কিছু পরে তার বিরক্তিও প্রকাশ পেল-এই ফাউল পার্টিরে কে আনছে?

তার সামনে তার কয়েকজন বন্ধু বসা, তাদের মধ্যে যার নাম ফয়সাল, সে একটু পাগলাটে ধরনের। যদিও তার সৌম্য চেহারা দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই, সে মুখ খুলল-ওই পার্টিরে আমি আনছি। সমস্যা কী?

তরে ন্যাড়ামাথা কইরা দেওন উচিত।

ক্ষুর আছে?

আরে, আমি করুম ক্যান, নাপিত আছে না। যার কাম তার সাজে, পরের কামে লাঠি বাজে। ফয়সাল, বাপ আমার, তুই এই পার্টিরে আইনা লাঠি বাজাইয়া বোসছস।

ভালো করছি। পার্টি ছাইড়া দে। সমস্যা শ্যাষ।

সমস্যা শ্যাষ কি না, এইটা তুই জানস না? ইলিয়াস ফয়সালের দিকে না তাকিয়েই বলল, সে টেবিলের ওপর রাখা তার তিনটা মোবাইল সেটের একটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল-সবুর, একটা ঠিকানা দিতেছি, আর নাম। একটু চোখে চোখে রাখবা। মেজাজ ঠাণ্ডা পার্টি, বুঝছ? এরা বিপজ্জনক।

সবুরের সঙ্গে কথা শেষ করে সে ফয়সালের দিকে তাকাল-কয় এক কোটি দিব। এরে-ওরে দিয়া আমাগো ভাগে তো ৬-৭ কইরাও পরব না। আমরা কি ফকিরা পার্টি?

আমরা যে ফকিরা পার্টি না, এইটা আমি জানাইয়া দিব।

দিবি।… এখন উঠতেছোস ক্যান।

তর মুখ দেখতে ইচ্ছা করতাছে না।

ঘুইরা দাঁড়াইতে পারুম না, যা গিয়া।

ফয়সাল উঠে দাঁড়াল। সে ইলিয়াসের দিকে তাকাল না, সে তাকাল অন্য বন্ধুদের দিকে-রাতের প্রোগ্রাম ঠিক আছে, না ওইটাও বাতিল?

ওইটা বাতিল হওনের কোনো কারণ নাই।

নাদিম তখন জানাল।

হাসিব বলল, এই মডেলরে আমি আগে দেখি নাই। সেদিন টেলিভিশনে দেইখা তো আমার কাম সারা।

নেহাল বলল, সামনে গিয়া তাইলে তো দাঁড়াইতেই পারবি না। ভালো মতো স্প্রে কইরা নিস।

আমি যাইতেছি। ফয়সাল জানাল। পারলে ইলিয়াসের সঙ্গে আনিস। এই কথা বলার সময় তার মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল। এবং সে আড়চোখে ইলিয়াসের দিকে সামান্য সময়ের জন্য তাকালও।

ইলিয়াসের চোখ এড়াল না সেটা। সে সামান্য হাসল।

ফয়সাল চলে গেল। অন্য বন্ধুরা থাকল আরো কিছুক্ষণ তারা সম্মিলিতভাবে একটা চেষ্টা চালাল। চেষ্টাটা ইলিয়াসকে রাজি করানো নিয়ে। পাশের এক দেশ থেকে মডেল না অভিনেত্রী, তবে চটক আছে, এই রকম এক মেয়ে এসেছে। তার অংশ নেওয়া একটা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে টেলিভিশনে। সেই বিজ্ঞাপন দেখে দেশের জনগণের এক অংশ গরম। মেয়েটিও ঠিক করেছে, শুধু বিজ্ঞাপন বাবদ পরিশ্রমের টাকা নিয়ে সে দেশে ফিরে যাবে না। এখন তার সামনে লম্বা লাইন, কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী অবশ্যই তার জুটেছে, তারা ঠিক করে দিচ্ছে কাদের সে নিরাশ করবে এবং কাদের কাদের সে করবে না। ফয়সাল বহু চেষ্টার পর একটা রাতের বুকিং দিতে পেরেছে। এই নিয়ে তারা গত কয়েক দিন হলো তেতে আছে। আর পাশাপাশি চেষ্টা চালাচ্ছে, ইলিয়াসকে যেন এবার তারা সঙ্গে নিতে পারে।

ইলিয়াস এসবের মধ্যে নেই। তার বন্ধুরা ব্যবসার কিংবা ব্যবসা জুটিয়ে দেওয়ার ও জোগাড় করার, এই লাইনে একেকজন পারদর্শী। তারা মাঝে মাঝে ইলয়াসকে মাঝখানে বসিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার বিশাল ভাণ্ডার খুলে বসে। তাতে অবশ্য লাভ হয় না কোনো, ইলিয়াসকে তারা অনুপ্রাণিত কিংবা উদ্দীপিত করতে পারে না। আজকেও সে রকম হলো। তারা কিছু কোমল এবং কিছু জান্তব বর্ণনা শোনাল এবং তার নিয়মমতো ইলিয়াস সেসব শুনতে শুনতে হাসল। এক সময় সে বলল, এই একটা ব্যাপার নিয়ে তোগো আমার খুবই হিংসা হয়।

স্বাভাবিক। নাদিম মাথা ঝাঁকল। জীবনে তুই কিছুই দেখলি না।

আরে আমি এইটার কথা কইতেছি না। আর কী আছে। তর এই সন্ন্যাসী জীবন তো তোর নিজের। তাইলে হিংসার কী?

আছে আছে। ইলিয়াস হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল।

ক, শুনি।

ধর ব্যবসায় ফেল মারলাম, রাস্তার গিয়া দাঁড়ামু।

তুই রাস্তায় গিয়া দাঁড়াবি?

আহা। কথার কথা কইতেছি। আর রাস্তায় গিয়া দাঁড়াইতেও পারি, এই কথা কেউ আগাম কইতে পারে না।

কী কইতেছিলি, সেইটা ক।

আর তরা যদি ফেল মারস, তোগো অভিজ্ঞতা নিয়া বই লেখবি। গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়াইয়া বেচবি, দেখবি দিন ফিইরা আসছে।

এই নিয়ে কতক্ষণ হাসাহাসি হলো। হাসাহাসি শেষ হলে দাঁড়াল। এবং ‘তাইলে আমরা গেলাম নপুংসক ইলিয়াস’ বলে বেরিয়ে গেল।

ইলিয়াস চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর জুতোসুন্ধ পা তুলে দিল।

এটা তার আনন্দ প্রকাশের একটা বড় ও প্রধান চিত্র। যদিও সে এই মুহূর্তে আনন্দ নেই। এক পার্টি মাত্র এক কোটি টাকা অফার করেছে, যে কাজের জন্য সর্বনিম্ন অফার হওয়া উচিত ছিল তিন কোটি, তারপরও অনেক টাইট অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সেখানে অফার মাত্র এক কোটি টাকার-এ ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো খেলা আছে কি না, থাকলে সেটা কী ধরনের খেলা, আর ফয়সাল সেখানে কোনো খেলোয়াড় কি না, এসব ভেবে দেখা দরকার। না, ফয়সালকে সে বিশ্বাস করে না, শুধু ফয়সাল কেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো বন্ধু কোনো নিকটজনকেই সে বিশ্বাস করে না। সে যে জীবনে বিশ্বাস করে অনেক ঠকেছে, ব্যাপার এমন নয়, তবে সে জানে বিশ্বাস করতে হয় না, এটা হচ্ছে ব্যাপার।

তা, এসব নিয়ে তার ভেতর খচখচানি। এটা আনন্দের সময় না, এটা কিছু হিসাব-নিকাশের সময়। কিন্তু সে চেয়ারে হেলান দিয়েছে আর পা তুলে দিয়েছে টেবিলের ওপর। এখন সে ভাবনাচিন্তা করবে না। এখন সে হালকা মেজাজে থাকবে। সে হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে একটু এগিয়ে, রিভলভিং চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে টেবিলের ওপর থেকে একটা মোবাইল সেট হাতে নিল। মেসেজ অপশনে গেল। ইংরেজি অক্ষর নিয়ে বাংলায় লিখল-‘মোনা, তোমারে সেই সকালে দেখছি, তারপর আর দেখি নাই। তুমিও এই গরিবের কুনো খবর নাও নাই। এইটা তুমি ঠিক করো নাই। বড় দুঃখ পাইছি, বিদায়।’ মেসেজ পাঠিয়ে সেটা পৌঁছেছে- নিশ্চিত হবার পর সে মিনিট ২-৩ অপেক্ষা করল, তারপর ডায়াল করল মোনার নাম্বারে-ডারলিং।

মোনা বলল, দরদ দেখি খুবই উথলে উঠেছে তোমার।

এইটা কী বললা। দরদ ভালোবাসা কুন সময় আমার কম ছিল?

কোনো সময়ই কম ছিল না।

তাইলে বললা যে। শুনো, দরদ উথলায়ে উঠে নাই, দরদ সব সময়ই উথলাইতেছে। সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে।

আহা আমার ময়না পাখি, কইলজা ঠাণ্ডা হইয়া গেল।

কী করছ?

পুরান ফর্মুলা। চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর পা তুইলা বইসা আছি।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি তোমাকে কেমন লাগছে।

সুন্দর লাগতেছে না?

পা নামাও।

আরে দাঁড়াও না। পাঁচ মিনিট।

পাঁচ মিনিট পর পা না নামালে আমি কিন্তু টের পাব।

ঠিক আছে। মেসেজ পাইছ?

হ্যাঁ।

উত্তর দেও নাই ক্যান!

আশ্চর্য কথা। পড়ে শেষ করার আগেই তো তোমার ফোন এলো।

জলদি কইরা উত্তর দেও। আর শুনো, ফোনও কিন্তু করো নাই।

তুমি করেছ?

দূরের গল্প

এইটা তো আরো আশ্চর্য কথা! আমি করি নাই বইলা কি তুমি করবা না? এখন জলদি কইরা মেসেজের উত্তর দেও। এই যে আমি পা নামাইতেছি!

ইলিয়াস জানে মোনার মেসেজের উত্তর আসবে এই একটু পরেই। সেই মেসেজ পড়ার আগ পর্যন্ত তার কিছু করার নেই। এভাবে কিছু না করে বসে থাকা যায়? টেবিলের ওপর থেকে পা নামানো কি ভুল হয়ে গেল? এখন কি আবার সে পা উঠিয়ে দেবে? একটু ভাবল ইলিয়াস, মাথা নাড়ল, না, ওটা করা যাবে না, মোনা ঠিকই টের পেয়ে যাবে।

সে বসে থাকা অবস্থায়ই আড়মোড়া ভাঙল। ভাঙতে ভাঙতে অদ্ভুত কিছু শব্দ করল। এভাবে নাকি ক্লান্তি কাটে। যদিও আজ ক্লান্ত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। তবে অস্বস্তি একটা কাজ করছে, আর একটা ভুলও সে করেছে। ফয়সালের সামনে সবুরকে তার ফোন করা উচিত হয়নি। এই ভুলটাও লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে খোঁচাচ্ছে। এত দিনের অভিজ্ঞতার পর তার কেন এ রকম ভুল হবে। ছি, সে নিজেকে বলল, সে নিজেকে আবার বলল-ছি।

ইন্টারকমে ম্যানেজার ফোন করে দেখা করতে চাইল। দেখা করবে সে? ম্যানেজারের আসা মানেই তো সঙ্গে একগাদা ফাইল, কিছু সমম্যার কথা শোনা। এ অবস্থায় ওসব তার মেজাজ আরো বিগড়ে দেবে না? কিন্তু এটাও সে জানে, দিনের কাজ সেরে ফেলাই ব্যবসার নিয়ম। খুব ছোট অবস্থা থেকে উঠে এসেছে সে, একটা সময় ছিল, যখন রাত আর দিনের পার্থক্য ছিল না তার কাছে। এখানো কাজের চাপ তেমন পড়লে, যদিও সবকিছুই তার গোছানো, দিন আর রাতের পার্থক্য ভুলে যায় সে। আর, ব্যবসায় একদম প্রাথমিক অবস্থায়ই সে শিখেছে ব্যবসার কিছু রীতি ও নীতি। তার একটা হলো-ফেলে না রেখে দিনের কাজ দিনেই সেরে ফেলা।

সুতরাং ম্যানেজারকে সে ডেকে পাঠাল।

কফি খেতে খেতে ম্যানেজারের সঙ্গে কাজ সারতে তার সময় লাগল মিনিট পঁচিশেক। সবকিছুই তার মুখস্থ, কিছু একটা বুঝে নিতেও তার সময় লাগে কম, সুতরাং ম্যানেজারের ফাইলপত্র আর অফিসের সমস্যার পেছনে সময় তার বেশি ব্যয় করতে হলো না। তবে সে জানে, এই কাজগুলো ম্যানেজারের ওপর ছেড়ে দিলে, পঁচিশ মিনিটের বদলে পঁচিশ ঘণ্টা সময় লাগিয়ে বসত। মাঝে মাঝে সে খুবই অবাক হয়। এরা একেকজন নাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়েছে। আর সে? থাক, নিজের কথা বলার দরকার নেই, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি নেওয়া আর এই কোর্স ওই কোর্স করে কী তাদের লাভ হয়েছে? একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত নিতেও তারা বসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা সময় নেয় অনেক। সে অবশ্য নিজে এসব কথা ওদের বলে না, বলে ওরাই।

ম্যানেজার ওঠার সময় বলল, স্যার ওই কবি ছেলেটা এখানে বসে আছে।

কবি ছেলে! সে ব্যাপারটা ধরতে পারল না।

এটাই কী ব্যাপার।

ওই যে স্যার, কবিতা লেখে একটা ছেলে আসছে না বারবার? ম্যানেজার জানাল। আজও এসেছে। ৩-৪ ঘণ্টা আগে। বসে আছে।

থাকুক।

বলেছে বিজ্ঞাপন না নিয়ে আজ সে এ অফিস থেকে যাবে না। বলেছে দরকার হলে হাঙ্গার স্ট্রাইক করবে।

প্রেসক্লাবের সামনে যাইতে কও।…এইটা কী কথা, তারে পাঠাও দেখি।

ম্যানেজার যাকে পাঠাল তার চেহারা কিছুটা পাগলের মতো। তবে খুবই একটা নির্বিকার ভাব আছে। যেন আশপাশের কিছুই সে কেয়ার করছে না। ইলিয়াস মনে মনে বলল-হালায়, এ তো দেহি পুরাই পাগল। ঠিকই আছে, কবি তো।

আপনি কবি কবিতা লিখেন? ইলিয়াস জানতে চাইল।

জি আমার নাম মাহমুদ ইমরান।

আ। আমার নাম মাহমুদ ইমরান।

আ… নাম বইলা লাভ নাই। আমি এই সব পড়ি না, পড়লেও বুঝি না। আমার ওয়াইফে পড়ে। কিন্তু তিনি তো এইখানে নাই।

জি।…আমি আপনার কাছেই আমার কথা বলতে পারি।

বলেন। তার আগে বলেন, আপনার এই নাম আসল না নিজের বানানো?

আমার আসল নাম মাহমুদুল হাসান।

বদলায়ে নিছেন। বেশ। কিন্তু বেশি আনকমন হয় নাই। কবিরা আসল নাম বদলাইয়া আজব আজব নাম নেয়। ভাবে নাম বদলাইলেই তারে কবি হিসেবে সবাই চিইনা ফেলব। আরে চিনব তো কবিতা দিয়া…। ঠিক বলি নাই?

ঠিক। আমি আশা করি আপনার কাছ থেকে এরকম কিছু শুনব।

ক্যান। আমারে ক্ষ্যাত মনে হইছে?…বাদ দেন আপনার আমার হেতু বলেন। আমরা একটা লিটিল ম্যাগাজিন করি। প্রতিবারই নিজেদের পকেট থেকে অনেক পয়সা বের হয়ে যায়।… একটা বিজ্ঞাপন দরকার আপনাদের।

আমার যে ব্যবসা, জনাব বিজ্ঞাপন প্রয়োজন পড়ে না।

তবু। বিজ্ঞাপন বলেন ডোনেশন বলেন। আমরা আমাদের পত্রিকা বন্ধ করে দিতে চাই না?

ক্যান কে বারণ করেছে? লোকের কাছে হাত পাইতা বাইর করার চেয়ে বন্ধ কইরা দেওন ভালো না?

এটা আপনার হিসাব আমাদের কাছে না, বন্ধ করা ভালো না।

কথা তো বলেন মেশিনের মতন! আপনি নাকি বলছেন, বিজ্ঞাপন না দিলে হাঙ্গার স্ট্রাইক করবেন?

বিজ্ঞাপন খুবই দরকার।

আগে বলেন বলছেন?

জি।

শইলে তো কিছু নাই। কয়দিন পারবেন? সকালে শুরু করবেন বিকালে স্যালাইন দিতে হইব। আলগা ফুটানি মারেন।

বিজ্ঞাপন খুবই দরকার।

সব মিলায়ে খরচ কত?

কিসের?

আপনার বিবাহের খরচ জানতে চাই নাই। পত্রিকার খরচ বলেন।

ছেলেটি খরচের পরিমাণ জানিয়ে বলল-আমরা ৫০০ কপি ছাপি।

বিক্রি হয়?

কিছু তো বিক্রি হয়ই।

বাকিটা বিনা মূল্যে বিতরণ করেন? শিক্ষা কার্যক্রম। দেখুন…।

দেইখা কী করব। ক্যাশে বইলা দিতেছি। ট্যাকা নিয়া যান। কিন্তু এই ফাস্ট এই লাস্ট।

কিন্তু কাউরে কইবেন না ট্যাকা আমি দিছি। ওকে?

জি, বলব না।

আবার আসবেনও না। এইবার যান, আমি বলতেছি।

ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে একটু সময় নিল, ইতস্তত করল, ঘুরে দরজার দিকে কয়েক পা এগোলে ইলিয়াস বলল-ধন্যবাদ দিবেন না?

ছেলেটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলল-জি।

এই কাজ ক্যান করলাম, জানেন?

জি না। তবে জানতে ইচ্ছা করছে।

এমনি করলাম। এমনি কাজ ইলিয়াস করে না। এইটা করলাম। এখন আঙুল কামড়াইতে ইচ্ছা করতেছে কিন্তু দেওয়া কথা ফেরত নেওনের উপায় নাই।

ইলিয়াসের মেসেজ আর ফোন এসেছিল মোনার ক্লাসের মাঝখানে। একটা গ্যাপের মধ্যে ছিল, মোনা মেসেজটা পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু ফোনটা ধরতে তার কষ্ট হলো। তখন ক্লাস পুরো চলছে, তারা ফাহিমের কথা মন দিয়ে শুনছে আর সেই অনুযায়ী কাজ করছে। এর মধ্যে ইলিয়াসের ফোন। মোনা একবার ভাবল ফোনটা ধরবে না। কিন্তু ইলিয়াসের ফোন না ধরেও পারা যায় না। সে নিজেই ইলিয়াসের ফোন না ধরে পরবে না। তবে সে পারলেও, ইলিয়াস গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে- আমার ফোন তুমি ধরলা না।

আহা, তুমি জানো আমি ক্লাসে ছিলাম। ধরা যাক মোনা বলল। সে জানে উত্তর আসবে অদু্ভত-ধরো আমি হাসপাতালের বেড থেইকা ফোন করছি। জরুরি ভিত্তিতে ব্লাড দরকার। তারপর এর জের থাকবে দুই দিন-তুমি আমারে আর ভালোবাসো না আমার ফোন ধরো না।

মোনা তার দুটো ফোনের যেটার নাম্বার সবাই জানে, সেটা ব্যস্ততার সময় অফ করে রাখে। এটার নাম্বার জানে ইলিয়াস, কাছের ও দরকারি প্রয়োজনে। এই কয়েকজনের মধ্যে কিছু বন্ধুবান্ধবী আছে, ড্রাইভার ও বাড়ির কাজের লোক আছে দুই-তিনজন। যদিও বিশেষ করে বাড়ির কাজের লোকদের ভালো করে বলা আছে, তেমন দরকার না পড়লে তারা যেন এই নাম্বারে ফোন না করে। ইলিয়াসকে সেভাবে বলা সম্ভব না। হয়তো দেখা যাবে ফোন করার জন্য নিজেই স্যরি বলল-তুমি নিশ্চয় ব্যস্ত, ওই নাম্বার বন্ধ যখন-আবার একটু পরই ফোন করে বলল-মোনা, ডারলিং…। এই মানুষটার ওপর রাগ করে থাকা যায় না। মানুষটা সরল ও মজার। ফলে তার অনেক কিছুই মোনা শেষে সহজভাবে মেনে নিয়েছে। যেমন বিয়ের পর মোনা চেষ্টা কম করেনি যেন মানুষটা ওভাবে কথা না বলে, তাদের মতো করে বলে। সে কি আর সহজ কাজ। কতভাবে কত রকম চেষ্টা। একদিন সে বলল-শোন ইলিয়াস কিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না। এবার অন্য একটা পরীক্ষা।

শুনে ইলিয়াসের মুখ শুকিয়ে গেল-এইটা তুমি কী কও-পরীক্ষা। তোমারে আমি বলি নাই-ইস্কুলে পরীক্ষার কথা শুনতে আমার জ্বর আসত। এই আছি সুস্থ মানুষ পরীক্ষার কথা হইল তো দুই সেকেন্ড পর এক শ তিন জ্বর। এসব কথা সে এমন অসহায় ভঙ্গিতে বলত, মোনার না হেসে উপায় থাকত না। সে করল কী বলল-এটা একটা অন্য ধরনের পরীক্ষা হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

পরীক্ষা পরীক্ষাই…কও।

একটা দিন। মাত্র একটা দিন তুমি ঠিক করে কথা বলবে। ঠিক আছে?

তুমি কইলে ঠিক।

তাহলে আজকের দিনটাই আমরা বেছে নেই।

আজকাই।

আজ ছুটির দিন।

এইটা জানি।

আজ তুমি আমি কেউ কোথাও যাব না। পরীক্ষাটা আজকে হলেই ভালো হয়।

ইলিয়াসের পরীক্ষা আরম্ভ হলো। একটু পর দেখা গেল তার সব কথাই বন্ধ হয়ে গেছে।

সে কেন কথাই বলছে না। মুখ গম্ভীর করে পত্রিকা পড়ছে, টেলিভিশন দেখছে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মোনা জিজ্ঞেস করল-তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?

ইলিয়াস দুপাশে মাথা নাড়ল।

অসুবিধা হলে বলো।

কী বলব।

যা ইচ্ছা বলো।

তোমার এইটা কী পরীক্ষা। কথা না বইলা কি থাকা যায়। কথা তো সব গলার কাছে বুদবুদের মতো জমা হইয়া আছে। মোনা তোমার এইটা কী পরীক্ষা।

ঠিক আছে, পরীক্ষা দিতে হবে না। তোমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা বলো।

ইলিয়াস কপালে হাত দিল-একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এতক্ষণেও জ্বর যে কেন আসে নাই।

বুঝতেছি না।

ইলিয়াসের কথা বলার ধরন যেমন বদলানো যায়নি, যখন তখন ফোন করার অভ্যাসও বদলানো যাবে না, মোনার জানা আছে। একবার হয়েছে কী, সে গেছে রোজার সময় এক এতিমখানায় এতিমদের সঙ্গে ইফতার করার জন্য। এই এতিমখানার পরিচালনা পরিষদের একজন ইলিয়াস, বছরে মোটা টাকা ডোনেশন দেয়, তবে এই নিয়ে সে কোনো প্রচারের মধ্যে নেই। কিন্তু আর যারা আছে পরিচালনা পরিষদে, তারা চাচ্ছে এবার অনুষ্ঠান করে মন্ত্রী ডেকে, সাংবাদিক এনে এতিমদের সঙ্গে ইফতার করা হবে। তার আগে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানের সকালবেলা ইলিয়াস উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। মোনা জিজ্ঞেস করল-কী হয়েছে তোমার?

আর কইয়ো না, জ্বরে গা জ্বইলা যাইতেছে। মোনা ইলিয়াসের কপালে হাত রেখে দেখল কপাল বরফঠাণ্ডা, সে বলল-তাইতো দেখছি। জ্বর তো খুবই বেশি।

এই জ্বর নিয়া আমি কেমনে যাই অনুষ্ঠানে। সত্যিই তো…।

কিন্তু কাউকে যেতে তো হবে। আমি যাব? মন্ত্রীটন্ত্রী আসবে। জ্বরের ঘোরে কী কইতে কী কইয়া বসব।

হ্যাঁ, তুমিই যাও। আর পারলে একটু কইয়ো-এতিমদের দান করতেছ, এইটা আবার ঢোল পিটাইয়া জানান দেওনের কী দরকার।

মোনা ইলিয়াসের এসব ব্যাপার মেনে নিয়েছে। সে ওভাবে কথা বলবে, অপরিচিত লোকজনের অনুষ্ঠানে যাবে না, শব্দ করে চা খাবে, ফাইভস্টার হোটেলে গিয়ে কাঁটা চামচ ছিটকে ফেলে বলবে-আরে এইটা দিয়ে খায় ক্যামনে মানুষ, শুধু তো খোঁচা লাগে, আবার যখন ইচ্ছা হবে সে অচেনা লোকের সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে দেবে এবং এ রকম আরো অনেক কিছু। এদিকে মানুষটা আবার সে বিশাল মনের। রাস্তায় কেউ বিপদে পড়লে আর ইলিয়াস সেটা দেখলে, এগোবেই। তার কাছে সাহায্যের জন্য এসে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে যায়নি। নিজের গ্রামে সে ছোট একটা হাসপাতাল করেছে। করেই ক্ষ্যান্ত দেয়নি। নিয়মিত সেটার অবস্থা দেখছে। এমনকি মোনাদের এলাকায় মোনার বাবার নামে সে একটা স্কুলও করে দিয়েছে। এটা নিয়ে অবশ্য মজার গল্প আছে একটা। স্কুলের সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে বলল-মোনা, তুমি কি ভাবছ তোমার বাবা, মানে আমার শ্বশুররে ভালোবাইসা আমি এই কাজটা করলাম?

মোনা একটু খেপল-তো কেন করলে? লোকদেখানো কাজ তো তোমার মধ্যে নেই। ঠিক। কিন্তু শ্বশুররে ভালোবাইসা কাজ করারও কুনো কারণ নাই। আছে? সেটা তুমি জানো।

আমার শ্বশুর তার কন্যারে আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে চান নাই। একসময় তিনি আমার সঙ্গে বড়ই নির্মম আচরণ করেছেন।

সেই জন্য স্কুলটা করলে?

অনেকটাই। কারণ যেইটা উচিত ছিল, সেইটাই তিনি করছিলেন।

মানে?

নিজের রাজকন্যার মতো মেয়েরে কে আমার মতন বাদাইম্যার সঙ্গে বিবাহ দেয়? আমি তো সেই সময় এক শর ওপরে বাদাইম্যা ছিলাম। সুতরাং তিনি ঠিক কাজই করছিলেন।

তো?

এই যে কন্যার প্রতি তার ভালোবাসা, এই কারণে তিনি আমার শ্রদ্ধেয়। ঠিক কাজ করছিলেন বইলা শ্রদ্ধেয়। ইস্কুলটা সেই জন্য। সব মিলিয়ে এই হচ্ছে ইলিয়াস। তবে সব মিলিয়ে এই কথাটা বললে ইলিয়াস বোধ হয় একটু সীমিতই হয়ে যায়। তার সবটা মেলানো কঠিন। যেটুকু মিলিয়েছে মোনা, সেটুকু নিয়ে সে সন্তুষ্ট। সত্যি কথা বলতে কী, ইলিয়াস তো অন্য রকমও হতে পারত। সে বিয়ের পরের কথা বলছে। বিয়ের পরে দেখা গেল, বিয়ের আগে যে কারণে পছন্দ করেছিল সে ইলিয়াসকে, ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়।

অবশ্য বিয়ের আগে ইলিয়াসকে সে কতটাই বা চিনেছিল! যেটুকু তাকে বোঝা সেটুকু তো মাত্র কয়েকটা চিঠির মাধ্যমে। ঐ সময়টার কথা মনে আছে তার। শুধু মনে আছে বললে সবটুকু বলা হয় না। সে তখন কলেজে উঠেছে মাত্র। ঐ পর্বের আরম্ভ অবশ্য আরো দু-তিন বছর আগে। সম্ভবত সে যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকে। তবে কলেজে ওঠার পর সেটা তীব্র আকার ধারণ করল। তার বাড়ির সামনে সব সময় ছেলেরা ভিড় করে। শুধু তাদের মহল্লার ছেলে না, আশপাশের আরো কয়েক মহল্লার ছেলে এসে ভিড় করে। সে যখন কলেজে যায়, ছেলেরা দল বেঁধে তার পেছনে পেছনে যায়। তার কলেজ যখন ছুটি হয় ছেলেরা ভিড় করে তখন কলেজ গেটের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকে, সে যখন বাসায় ফেরে তখন ছেলেরা তার পেছনে পেছনে তার বাসা পর্যন্ত আসে। এই দলবদ্ধ ব্যাপারের পাশে একক প্রচেষ্টাও আছে অনেক। আর আছে চিঠির জ্বালা। না, জ্বালা বলা বোধ হয় উচিত হলো না। সে বরং চিঠির ঐ অবিরাম স্রোতকে উপভোগ করত। একটা চিঠিও সে না পড়ে ফেলে দিত না। আবার অনেক চিঠি সে রেখে দিত সংগ্রহে। একটু গুছিয়ে সুন্দর করে লেখা যেগুলো, সেগুলো সে মাঝে মাঝে পড়ত, তার ভালো লাগত। তবে ব্যাপারটা সীমা ছাড়িয়েও গিয়েছিল। তার এক বন্ধু বলেছিল, মোনা, তুই কি একটা ব্যাপার জানিস?

এই বন্ধুটি সব সময়ই জ্বালা ধরানো কথা বলে, সতর্ক হয়েছিল মোনা, তবে তাকে জিজ্ঞেসও করতে হয়েছিল-কী?

বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেখবি, কোনো বাসার কুকুর, মানে মেয়ে কুকুর থাকলে, রাজ্যের যত পুরুষ কুকুর এসে সে বাসার সামনে ভিড় করে।

তো? জিজ্ঞেস করেছিল মোনা, যদিও সে বুঝে গিয়েছিল বন্ধুটি কী বলছে।

তোর অবস্থা হয়েছে সে রকম, গন্ধ ছড়াচ্ছিস আর কুকুরগুলো…।

তাকে সজোরে একটা চড় মেরেছিল মোনা; কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলেছিল-আর তুই কাপড় তুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস, কোনোই লাভ হচ্ছে না।

এই ঘটনায় কিছু হইচই হয়েছিল। অন্য কারো বাবা হলে হয়তো লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কিংবা মেয়ের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিয়ের জোর চেষ্টা চালাতেন। মোনার বাবা সেই কাজটি করেননি। তার বিশ্বাস ছিল মেয়ে ঠিক থাকবে। এই বিশ্বাস মোনার নিজেরও ছিল। সে নিশ্চিত করে জানত, কারো কোনো প্রলোভনে সে পা দেবে না। কেউ তাকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। তার চারপাশে সে রকম ছেলে সে দেখতও না যে একটু হলেও তাকে কাছে টেনে নিতে পারে।

এ রকম যখন অবস্থা তখন এক ছুটির দুপুরে তার হাতে চিঠি এলো একটা। অল্প পরিচিত এক মেয়ে এসে দিয়ে গেল-ইলিয়াস ভাই দিয়েছে। তোমাকে অন্তত পড়তে বলেছে। এ না বললেও চলত, সে তো পড়বে, সে তো পড়বেই।

ঘরের ভেতরে চিঠি পড়তে একটু অসুবিধা। পড়ার সময় বা অবস্থা হয়তো বের করা যায়। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সে চিঠি নিয়ে ছাদে চলে গেল। তখন দুপুর ফুরোতে বসেছে। সে চিলেকোঠার দরজায় হেলান দিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করল। তারপর কী যে হলো তার।

কী যে হলো তার, সে নিজেও বুঝল না। সে অস্থির চিত্তে দ্বিতীয় চিঠির অপেক্ষা করতে লাগল। দ্বিতীয় চিঠি এলো, সে আরো অস্থির হয়ে উঠল। তারপর তৃতীয় চিঠি তাকে অধিক থেকে অধিকতর অস্থির করে তুলল। সারা দিন সে অন্যমনা থাকতে আরম্ভ করল। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যেতে আরম্ভ করল। সে দেখল, যে রাতেই তার ঘুম ভেঙে যায়, তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তার কেমন কান্নাও পায়। কিন্তু কেন কান্না পায় সে বুঝতে পারে না। আবার কখনো, কোনো দুপুরে সে এক ঘোরের মধ্যে চলে যায়। মোনা টের পেল নিজেকে এমন অসহায় তার আগে কখনো মনে হয়নি।

ইলিয়াসকে দেখল সে। দেখার পর বুঝল একে সে আগেও দেখেছে। তাদের পুবপাড়ারই ছেলে। একটু ভারী শরীর, লম্বাও বেশ খানিকটা, মেজাজ তার গরম, অনেকে তাকে মাস্তান হিসেবে বেশ খানিকটা ভয়ও করে। এই ছেলে অমন আমূল কাঁপিয়ে দেওয়া চিঠি লেখে। কিভাবে লেখে।

মোনা চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দিল। সে ভাবল না, ঝাঁপ সে কোথায় দিচ্ছে-আগুনে, গভীর সাগরে কিংবা শূন্যে। সে ঝাঁপ দিল এবং ইলিয়াসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। ব্যাপারটা অবশ্য যত সহজ শোনাচ্ছে ততটা সহজ ছিল না। তাদের প্রেম হয়েছিল ঠিকই, তবে তাদের দেখা হতো না, কথা হতো না। ছোট পুবপাড়ায় সবাই সবাইকে চেনে, লুকিয়ে বা লোকের চোখ আড়াল করে সেখানে দেখা করার উপায় ছিল না। তারা প্রেম করত বিশ্বস্ত তিন বন্ধুর মাধ্যমে। পরস্পরের খবর তাদের মাধ্যমেই এদিক আর ওদিক পৌঁছত। ‘এইচএসসি পাসের পর মোনার বিয়ের তোড়জোড় চলছিল। আর ইলিয়াস বিএ ফেল করে পরীক্ষাওয়ালাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারের পাশাপাশি আরেকবার পরীক্ষা দেওয়ার কথাও ভাবছিল। কিন্তু তার আগেই বিয়ে। এ নিয়ে হইচই কম হয়নি। মোনাদের বাড়ি থেকে এ বিয়ে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ইলিয়াসদের বাড়ি থেকেও মেনে নেয়নি। তারা কজন বন্ধুর সহযোগিতায় পালিয়েছিল ঢাকায়। সেখানে এক কঠিন লড়াই। কঠিন লড়াই যদিও, ভেঙে পড়েনি দুজনের কেউই। ইলিয়াসকে সাবাস বলে মোনা, আবার নিজেকে ধন্যবাদও সে কম দেয় না। দুঃসময়ের দিনগুলোতে ইলিয়াসের পাশে দাঁড়াতে আর তাকে সাহস জোগাতে সে কখনো বিন্দুমাত্র পিছিয়ে আসেনি। সে সময়ই সে একটা ব্যাপার নিজের ভেতর আবিষ্কার করেছিল-সব কিছুর পরও সে ইলিয়াসকে আসলেই ভালোবাসে। এত বড় মনের মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায় না। আরো একটা ব্যাপার আছে অবশ্য, তবে মোনা সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চায় না। সে চায় না গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে, তবে ওটার উপস্থিতি সে টের পায়; হঠাৎ কখনো। তারপর তাদের ওই দুর্যোগের দিন পার হয়েছে। এমনভাবে পার হয়েছে, কাউকে বলে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে একসময় কিসের ভেতর দিয়ে তারা গেছে। তবে কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, কেউ শুনতে চাক আর না চাক, প্রসঙ্গ উঠলে তারা নির্বিকারভাবে বলে তাদের এক সময়কার অবস্থার কথা, তাদের লড়াই আর তাদের জয়ী হওয়ার কথা। তবে তারা শুধু অন্যকে বলে না, তারা নিজেরা একে অন্যকেও বলে। তাদের কেউ হয়তো কখনো কথা তোলে-কী যে দিন এক সময় গেছে আমাদের!

আমার এখন নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইব, এই চিন্তার চেয়ে বড় চিন্তা কি জানো?

জানি। বহুবার বলেছ। আরেকবার বললে….।

কইতে দাও কইতে দাও। চারদিকে শুধু আন্ধার দেখি আর মনে মনে ডরাই-আমার বউ না আমারে ছাইড়া চইলা যায়!

আমি পাশে না থাকলে বুঝতে।

তুমি পাশে না থাকলে আমি এখনো বুঝব। নাই হইয়া যাব।

নাই হবে না ইলিয়াস। তোমার মনের জোর অনেক বেশি।

আর তোমার কম! তুমি জোর না দিলে আমি জোর কই থেইকা পাইতাম!

আমার এখন কী মনে হয় জানো? মনে হয় আমাদের আসল ভালোবাসাটা ওই সময়ই তৈরি হয়েছিল।

শুনে ইলিয়াস ঘনঘন মাথা নাড়ে-ঠিক কথা ঠিক কথা। কথা সত্য।

আবার কোনো কোনো দিন তাদের কথা একটু ঘুরে যায় অন্যদিকে। সে রকম অবশ্য খুব কমই হয়। কোনো কোনো দিন তারা দুজনই ক্লান্তবোধ করে। এটা অবশ্য মোনার ভেতরই বেশি দেখা যায়। হঠাৎ কোনো কোনো দিন সে বলে-ভালো লাগে না।

মুহূর্তের মধ্যে ইলিয়াস ব্যস্ত হয়ে উঠে-কী হইছে তোমার ডারলিং?

মোনা বড় করে শ্বাস ফেলে বলে-জানি না।

শরীর খারাপ লাগতেছে?

না।

ডাক্তার দেখাইবা?

বললাম তো শরীর খারাপ লাগছে না।

মাঝে মাঝেই তুমি এই রকম কইরা কও-ভালো লাগে না।

মাঝে মাঝে বলি না ইলিয়াস। কখনো কখনো বলি।

সেটাই বা ক্যান বলবা!

কেন, তুমি কি কখনো বলো না?

বলি। খুব কম।

আমিও কম বলি। …. আর কিইবা এমন বলি! কখনো কখনো বলি-ভালো লাগে না। কখনো কখনো বলি-ক্লান্ত লাগে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলি? জীবনে কিছু ভালো না লাগা কিছু ক্লান্তি থাকবে না?

তা থাকবে, অস্বীকার যাই না, কিন্তু….

কিন্তু কী?

অভয় দিলে কইতে পারি।

আহা ইলিয়াস!

মাঝে মাঝে তোমারে দেইখা মনে হয় তুমি অন্য কিছু ভাবতেছ।

অন্যকিছু মানে! অন্যকিছু কী ভাবছি?

সেইটা ডারলিং আমি তোমারে বুঝায়া বলতে পারব না।

তাহলে বললে কেন?

তোমারে দেইখা কখনো ওই রকম মনে হয়, তাই বললাম।… মোনা, তুমি কী ভাবো?

জানি না।

সত্য?

ইলিয়াস, আমি কেন তোমাকে মিথ্যা বলব?

না না, এইটা সবাই মিইলা বললেও আমি বিশ্বাস যাব না।

থ্যাংকু। … ইলিয়াস, এমন কি হতে পারে না আমি আসলে কিছুই ভাবি না, কিন্তু তোমার মনে হয় আমি কিছু একটা ভাবছি?

সেইটা না, ধরো, তুমি কিছু একটা ভাবতেই পার, কিন্তু কখনো কখনো তোমারে দেখলে মনে হয় তুমি ভাবতে ভাবতে বহু দূর চইলা গেছ।

কী যে সব বলো না!

বাদ দিব?

হ্যাঁ, বাদ দাও।

দিলাম বাদ।

এসব হচ্ছে মানে মনের কথা। এ রকম দু-একটা সময় বাদ দিলে বাকি সময়টা মোনা আর ইলিয়াসের খুব আনন্দের। এই যে সময়-অসময় নেই, যখন-তখন তাকে ফোন করে ইলিয়াস-কী করতেছ ডারলিং-হয়তো কখনো বিশ-তিরিশ মিনিট পরপরই করে, সেটাও মোনার খুব পছন্দ। আর সেজন্যই সে ইলিয়াসকে তার কোনো ব্যস্ততার সময় ফোন করতে বারণ করে না। আসুক না ফোন, যখন-তখন যেখানে-সেখানে আসুক, যে মানুষটা পাগলের মতো তাকে ভালোবাসে, সে ওরকম এক-আধটু পাগলামো করতেই পারে। তার কত কত পাগলামো সে মেনে নিচ্ছে আর এটুকু মানবে না!

গিটার শেখার ক্লাস শেষ হলো একসময়। গিটার কেসে পুরতে পুরতে মোনা তার অন্য মোবাইলটা অন করল। গাড়িতে কালাম আছে, তাকে ফোনে জানালে সে এসে কেসটা নিয়ে যাবে। এটুকু না করলেও চলে। গাড়ি পর্যন্ত এটুকু পথ সে গিটারটা হাতে করেই নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রথম থেকে ব্যাপারটা এ রকমই চলে আসছে।

কালামকে জানিয়ে মোনা ভাবল, এবার সে ইলিয়াসকে একটা ফোন করবে। তার আগেই ফাহিম তার পাশে এসে দাঁড়াল-আপা।

মোনা হাসল, এটা তার বিশেষ ধরনের হাসি, সে খুব ভালো করে জানে এই হাসির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। হেসে সে হাসির প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় থাকল। সে দেখল কাজ হলো মারাত্মক। ছেলেটা প্রায় গলে পড়ে যেতে নিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলাল-আপা, কথা আছে একটা।

হ্যাঁ ভাই, বলেন।

আপনি খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু ধরে ফেলছেন। আপনি ন্যাচারাল ট্যালেন্ট।

কী যে বলেন না! সবই আসলে আপনার শেখানোর গুণে।

না না, আপনি হচ্ছেন….।

ভাই, যাই তা হলে?

কত দিন আপনাকে বলেছি, আমাকে ভাই ভাই করে ডাকবেন না। আমাকে শুধু ফাহিম বলবেন। ব্যাস।

বলব।

ফাহিম হতাশ গলায় বলল-আর কবে বলবেন!

ততক্ষণে কালাম চলে এসেছে। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মোনা কালামের পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে সে ফোন করল ইলিয়াসকে-এই যে, শোনো, তুমি এখন পা নামাতে পার টেবিলের ওপর থেকে।

ক্লাস শ্যাষ হইছে?

জি জনাব, শেষ হয়েছে।

এখন তুমি কী করবা? বাড়ি যাইবা?

অন্য কোথাও যেতে বলো?

আমার অফিসে আসবা?

তোমার অফিসে গিয়ে আমি কী করব!

আসো। আইসা দেইখা যাও আমি কেমুন আছি।

মোনা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে ইলিয়াসের অফিসে যেতে বলল।”

আমার পড়া শেষ হলো; কিন্তু আমি মুখ তুললাম না। মুখ না তুলে আমি সাজিয়াকে একটু টেনশনে রাখতে চাইলাম। সাজিয়া টের পেয়ে গেল, আমার পড়া শেষ হলেও আমি মুখ তুলছি না। সেও কতক্ষণ চুপচাপ থাকল, তারপর জিজ্ঞেস করল-খুব খারাপ হয়েছে? খুব খারাপ হলে সেটাই বলো।

কে বলে খুব খারাপ হয়েছে!

তাহলে? কেন খারাপ হয়েছে?

না, বেশ ভালো হয়েছে।

প্লিজ, ইয়ার্কি মেরো না। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে কেমন হলো আমার অংশটুকু।

ইয়ার্কি মারছি না পানতোয়া, সত্যিই বেশ ভালো হয়েছে।

সত্যি হলে থ্যাংকস।

একটা পাপ্পি দাও।

পরে।…একটু বিস্তারিত বলো।

প্রথমে পাপ্পি, তারপর।

আহা, আমার লেখাটা সম্পর্কে বলো।

কাগজ-কলম নাও।

সাজিয়া ভুরু কুঁচকে তাকাল-আমরা একটা আপাত অনিবার্য পরিণতির দিকে এগোই।

আপাত অনিবার্য পরিণতি?

সাজিয়া, সব পরিণতিই আপাত অনিবার্য পরিণতি।

তাই কি? সাজিয়া তখনই মুখ খুলল। একটু ভাবল, আবার বলল-তাই কি?

কোনো কোনো সময় অবস্থা এমন হয় না-আমরা বুঝতেই পারি এটা ঘটতে যাচ্ছে?

হ্যাঁ, তা হয়। কিন্তু লেখক ইচ্ছা করলে সেটা বদলাতেও পারে।

আমি বদলাব না। আমি অনিবার্য পরিণতির সঙ্গেই থাকব।

বেশ, দেখি তুমি কী করো।

কাগজ-কলম নাও তাহলে, আমি বলি তুমি লিখে যাও।

বাপরে, তুমি দেখছি আরামের কোলবালিশ।

আমি হাসলাম, তারপর বলতে আরম্ভ করলাম।

“রাত এত হয়ে যাবে রুমি বুঝতে পারেনি। শরীরটা ভালো লাগছিল না তার, সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন কেউ নেই, যাকে সে বলে রাখবে অমুক সময়ে তাকে উঠিয়ে দেবে। তা ছাড়া ঘুমটা এত গভীর আর দীর্ঘস্থায়ী হবে, এটাও সে বুঝতে পারেনি। এখন হাতে সময় কম। এই কম সময়ের মধ্যে পৌঁছানো যাবে?

রুমি ভাবল, একটা চান্স সে নেবে। না গেলে যা হবে-এই এখানেই শুয়েবসে সময় পার করতে হবে। কিংবা এ জায়গা ছেড়ে বাইরে বের হয়ও সে, রাস্তায় ঘুরতে হবে ইতস্তত, অর্থহীন। তার চেয়ে বরং একটা চেষ্টা চালানো যায় ওই লোকের কাছে পৌঁছানোর। এমন হতেই পারে, সে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেল।

বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে সে হঠাৎ নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত বোধ করল। গভীর এক হতাশায় সে মাথা নাড়ল-রুমি, এই ছিল জীবনে!

হাসল সে, হতাশার হাসি-আর বোলো না। এখন ভাবতে ইচ্ছা করে না এ জীবন আমিই বেছে নিয়েছিলাম।

বেছে নেওয়ায় ভুল থাকলেও পস্তানোর প্রশ্ন এসেই যেতে পারে।…আবার এভাবেও দেখতে পারো তুমি-বেছে নিয়েছিলে বলেই পস্তাতে হবে, এমন কথা নেই।

এখন যুক্তিতর্ক ভালো লাগছে না।…তবে পস্তাচ্ছি কি না-বুঝতে পারছি না।

হয়তো পস্তাচ্ছ না, হয়তো নিছকই ক্লান্তি।

ক্লান্ত।…এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হব, বুঝতে পারিনি।

এখন অনেক কিছুই তুমি বুঝতে পারবে না। কথা বাড়িয়ো না। রেডি হও।

তৈরি হওয়া আর কি-একটু হাত-মুখ ধুয়ে নেওয়া, একটু চুলটা আঁচড়িয়ে নেওয়া, এই তো। পোশাক পাল্টানো দরকার। কিন্তু পাল্টানো যাবে না। কারণ আর যে পোশাক আছে সেগুলো এর চেয়েও অপরিষ্কার।

বেরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল রুমি। ওদিকে বাস যায় কি না, তার জানা নেই। তা ছাড়া বাসের জন্য অপেক্ষা করে সময় আরো নষ্ট হতে পারে। আবার রিকশা সে নিতে পারে, পয়সা আছে পকেটে; কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম, রিকশা নিলে পয়সা আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং রিকশা নেওয়ার চিন্তা সে বাদ দিল। হাঁটার অভ্যাস আছে তার, এত দিন ধরে সে তো হাঁটার ওপরই আছে।

এগোতে এগোতে তার ক্লান্ত লাগল। এটা ইদানীং একটা সমস্যা হয়েছে। খুব অল্পতেই সে ক্লান্ত বোধ করে। এটা মানসিক না শারীরিক, সে বুঝতে পারে না। সব মিলিয়ে ভয়ংকর একটা ক্লান্তি তৈরি হয়েছে তার ভেতরে, এটা সে জানে। কিন্তু এই যে হাঁটছে, এখানেও ক্লান্তি, এটা কিসের! সে বিড়বিড় করে বলল, ওই যে কথা, অনেক কিছুই এখন আর বুঝতে পারি না…। যাক, দরকার নেই বোঝার। এখন আর বুঝেই বা কী হবে! হাতি?”

আমি বললাম-সাজিয়া, শেষ।

এটুকু! মাত্র এটুকু!

আমার মনে হচ্ছে, আপাতত এই এটুকুরই দরকার ছিল।

এখন আমার ওপর ছেড়ে দিলে?

আমরা নিজেরা আর কতটুকু বহন করি, বলো?

একটা প্রশ্ন করি তাহলে।

করো।

তুমি কী করতে চাও? ওদের এখন দেখা হয়ে যাবে? সাজিয়া জিজ্ঞেস করল।

কাদের? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মোনা আর ইলিয়াসের সঙ্গে তোমার রুমির?

রুমি যদি আমার হয়, মোনা আর ইলিয়াস তবে তোমার?

আহা, সে তো গল্পে।

আমরাই বলাবলি করেছি, গল্পে লেখক নিজেই ঢুকে পড়ে। মোনা আর ইলিয়াস তোমার পরিচিত?

একটু ভাবল সাজিয়া, দুপাশে মাথা নাড়ল-না।

ভেবে বললে যে!

ভেবে দেখলাম, আমার কোথাও কি ওরা আছে!

পেলে না?

নাহ।

তোমার কাছে না থাক, ওরা আছে, তাই না? মানে ওদের মতো?

সাজিয়া মাথা ঝাঁকাল-আছে নিশ্চয়। না হয় আমি পেলাম কিভাবে!

সে-ই। আছে। হয়তো মিশেল, হয়তো অখণ্ড।…হয়তো তোমার ভাবনায়।

আমার ভাবনায়। সাজিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল।

যখন ভুরু কুঁচকে যায় সাজিয়ার, চমৎকার লাগে ওকে। বহুবার ওকে আমি এই কথা বলেছি-তোমাকে অমন দেখলেই নিজেকে আমার উতলা উতলা লাগে। এখন বলার ইচ্ছা হলো। বললাম। সাজিয়া সেটা যেন শুনলই না-এখন কী হবে এ গল্পের।

এগোবে। আমাদের দুজনের মতো।

সাজিয়া মাথা ঝাঁকাল। ঝাঁকিয়ে অল্প অল্প হাসতে লাগল।

হাসির কারণটা বলবে?

আমরা দুজন লিখব, আর দুজনই ভাবব, এ বুঝি নিজেদের কথাই লিখছি। নিজেদের পরিচিত বা কাঙ্ক্ষিত কিছুর কথা।

যে সংসারের কথা তুমি লিখছ, সেটা তোমার কাঙ্ক্ষিত হতেই পারে।

তুমি জানো, আনোয়ার একেবারেই ওরকম না। ও অমন হতেও পারবে না, ইলিয়াসের মতো, হতে চাইবেও না।

আমি বলেছি কাঙ্ক্ষিত। তুমি হয়তো অবচেতনে চাও।

আবার ভাবল সাজিয়া, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ল-নাহ। নট ট্রু। চাই না। আনোয়ার আনোয়ারের মতো থাকুক। কেউ কারো মতো হয় না।

ঠিক সেটাও বলিনি আমি?

তাহলে? সাজিয়া জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

তুমি চেয়েছ…। আনোয়ারকেই হতে হবে, তা চাওনি। কিন্তু চেয়েছে।

এত ব্যাখ্যা কী দরকার স্টিমার! তুমি কি রুমি হতে চেয়েছিলে?

এ নিয়ে কথা বলেছি আমরা। আমি রুমি না।

আমি দেখব।

কী?

তুমি রুমি কি না।

আমিও দেখব।

তোমার আকাঙ্ক্ষায় কী ছিল।

এভাবে বললে দেখা যাবে দুজনই সতর্ক হয়ে গেছি। লিখতে গিয়ে ভাবছি।

থাক, আমরা বরং সহজভাবেই লিখি। যেভাবে এগোয় এগোক। এবার তোমার পালা।

আমার। সাজিয়া আঁতকে উঠল। শেষবার আমি কতটুকু লিখেছি আর তুমি কতটুকু?

এভাবে হিসাব করলে হবে? গজ ফিতা দিয়ে?

লেখাটা শুরু হয়েছে যেন তোমার জড়তা কাটে।

কিছু তো কেটেছে। বুঝতে পারছি।

পুরো কাটুক। যখন জড়তা কাটানোর জন্য না লিখে পাঠকের জন্য লিখতে পারবে।

আমি রাজি হলাম। সাজিয়া চলে গেল। আমার মনে হলো সাজিয়ার থাকার ইচ্ছা ছিল। এমন অনেক দিন হয়েছে, সকালের পরপরই এসেছে সে, আমরা সারা দিন একসঙ্গে থেকেছি, বিকেলের দিকে বের হয়েছি একসঙ্গে, কোনো কফিশপে সময় পার করেছি, তারপর সাজিয়া বাসায় ফিরেছে, আমিও আমার বাসায়।

আজ সময় ছিল। আমার সময় ছিল। সাজিয়ার, বোঝাই গেল, ছিল। কিন্তু আমি ক্লান্তি অনুভব করলাম, ঠিক ক্লান্তিও হয়তো নয়, আমার হয়তো একা থাকতে ইচ্ছা করল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কখনো কখনো একা থাকার ইচ্ছাই আসলে এক ধরনের ক্লান্তি। আমার ক্লান্তিটা কিসের?

সাজিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে লেখার পরিকল্পনা করার পর আমি অংশ হিসেবে একটা লেখা শুরু করেছিলাম। সে লেখার কথা সাজিয়াকে বলা হয়নি, সে লেখা নিয়ে আমার আর বসাও হয়নি। কিন্তু লেখাটা আমার ভেতরে আছে। আমার কি সে লেখাটা শুরু করা উচিত?

আমি বিকেলের পরপরই এ লেখাটা শুরু করলাম।

“প্রায় শেষ মুহূর্তে চোখের কোণ দিয়ে লোকটাকে দেখতে পেল ইলিয়াস। ডিনার সারতে সারতেই তারা ঠিক করেছিল, এখান থেকে সরাসরি তারা বাসায় ফিরবে না, এখান থেকে তারা যাবে নোমানের বাসায়, আরো দু-চারজন আসবে, আড্ডা হবে একটা। এ রকম হলে তাদের বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। এদিকে আগামীকাল আবার ছুটির দিন, সুতরাং বাসায় ফেরা বা আড্ডা গোটানোর তাড়াও কারো মধ্যে তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় ড্রাইভারকে তারা বিদায় করে দিয়েছে। দুপুরের পর থেকেই সে শরীরটা ভালো নয় বলে জানাচ্ছিল। এ অবস্থায় প্রথমেই তারা ঠিক করে নিয়েছিল ড্রাইভার তাদের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দিয়েই বিদায় নেবে। তার পরের সময়টুকু গাড়ি চালাবে ইলিয়াস। মোনাও চালায়, তবে এত ভারী জিপ মোনার জন্য ঝামেলার হয়ে যাবে। গাড়ি চালাতে ইলিয়াস পছন্দই করে। তবে গাড়ি সে জোরে চালায়, আস্তে চালানোর জন্য গাড়ি তৈরি হয়নি, সে এ রকম বলে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে সে অবশ্য বলল-কাজটা উচিত হয় নাই।

কোন কাজটা? মোনা জানতে চাইল। অফিসের কিছু টেনে এনো না প্লিজ।

নোমানের বাসায় পৌঁছায়া লোকমানরে বিদায় করা উচিত ছিল।

তুমিই না বললে ওর জ্বর…।

জ্বরই তো। কপালে হাত দিয়াও দেখছি মিথ্যা বলতেছে কি না।

তাই বলে কপালে হাত দিয়ে দেখতে হবে, ইলিয়াস!

দরকার। সত্য বলে না মিথ্যা বলে…। আর আমি তো ওই রকমই।

কাজটা উচিত হয়নি বলছ কেন! কোনো সমস্যা হচ্ছে?

মুখে উত্তর না দিয়ে ইলিয়াস মাথা ঝাঁকাল।

কী সমস্যা? অন্য ড্রাইভারকে আসতে বলব?

আরে না।…খাইছি রাক্ষসের মতো, হাঁসফাঁস লাগতেছে।

রাক্ষসের মতো খাও কেন!

আমারে এত দিন আগে বিবাহের পর এত দিন বাদে এইটা কী কথা! চোখের সামনে এত এত খাদ্য, আর আমি ইলিয়াস চুপ কইরা বইসা থাকব!

চুপ করে বসে থাকবে কেন! খাবে, কিন্তু অল্প খাবে।

আমারে কুনো দিন অল্প খাইতে দেখছ?

না।

তাইলে এইসব কথা ক্যান বলো!

তোমার বয়স হয়েছে, এমনিতেও হিসাব করে খাওয়া দরকার।

ইলিয়াস হিসাব কইরা খাওনের গুষ্টি কিলায়।

ভালো। ভালো বলে মোনা চুপ করে থাকল আর ইলিয়াস একটু পর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল-রাগ করছ মনে হয়!

তোমার গাড়ি চালানোর কাজ তুমি গাড়ি চালাও।…আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না, রাস্তার দিকে তাকাও।

কী যে করি, যতই তোমার দিকে তাকাই, মনে হয় তাকায়াই থাকি।

রাস্তার দিকে ইলিয়াস, রাস্তার দিকে।

একটু হাঁসফাঁস লাগতেছে ঠিকই, তবে এই এখনই দেখবা-বলতে বলতে ইলিয়াস রাস্তার দিকে তাকাল আর চোখের কোণে লোকটাকে দেখতে পেল। মুহূর্তের মধ্যে তার ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেল। অসাধারণ এক দক্ষতায় গাড়ির গতি সামাল দিয়ে লোকটাকে পাশ কাটাল। একটু কাঁচা ড্রাইভার হলে লোকটাকে চাপা দিত কিংবা পাশ কাটাতে গিয়ে গাড়ি উল্টে ফেলত। ওসব কিছুই হলো না, শুধু মাঝারি ধরনের একটা ঝাঁকুনি খেল তারা। মোনা একটু চেঁচিয়ে উঠল-ইলিয়াস…।

ইলিয়াস, যদিও জানে দোষ প্রায় পুরোটাই তার, বলল-এই ব্যাটারে একটু দেখন দরকার। লাট সাহেবের মতো রাস্তা পার হইতেছে।

মোনা বারণ করল-তুমি গাড়ি থেকে নামবে না।

নামব না। যা বলার গাড়িতে বইসা বলব।

তোমাকে কিছু বলতে হবে না।

ক্যান!

দোষ তোমার।

ও, ওয়াইফ হইয়া আমার দোষ দেখলা। আর ব্যাডায় যে আমার গাড়িও দেখল না, এইটা কুনো ব্যাপার না!

আচ্ছা, ঠিক আছে, দোষ দুজনেরই। তবে অ্যাঙ্েিডন্ট হয়নি, ক্ষতি হয়নি কারো। সুতরাং থামার দরকার নেই, চলো।

এইটু দেখতেই দাও না। ইলিয়াস গাড়ি ব্যাক করল। মোনা বলল, ইলিয়াস! লোকটা হাইজ্যাকার দলের কেউ হতে পারে।

কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। যতই দিন যাচ্ছে, ছিনতাই আর চাঁদাবাজির নতুন নতুন কায়দা বের হচ্ছে। তাদের এখনো সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে দু-তিনটা ঘটনার কথা তারা শুনেছে। তাদের এক পারিবারিক বন্ধু দম্পতি, খালেদ আর রোজি, আরেক বন্ধুর বাসা থেকে ফিরছিল। একটু নির্জন এক রাস্তায় আসতেই তারা দেখে রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা গাড়ি থেমে আছে। দুজন আরোহী রাস্তায় নামে, চালক আর যাত্রীই হবে, গাড়ির বনেট খুলে কিছু একটা পরীক্ষা করছে। এমন একটা ব্যবস্থা, প্রথমেই মনে হবে, গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা গেছে। এ অবস্থায়, তখন সব মিলিয়ে যা হয়েছে অবস্থা, কেউ আর গাড়ি থামায় না। তবে ওরা গাড়ি এমনভাবে রাস্তার মাঝখানে রাখে, অন্য গাড়ির গতি না কমিয়ে উপায় থাকে না। এ সুযোগটাই নেয় ওরা। খালেদ ও রোজি এ রকম এক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা গাড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল, তখন হঠাৎ করেই তাদের গাড়ির জানালায় পিস্তল ঠেকিয়ে ছিল দু-তিনজন।

মোনার কথা শুনে ইলিয়াসের ভুরু কুঁচকে গেল-লোকটারে দেখছ তুমি?

কেন?

এমন হালকা-পাতলা, মনে হয় ফুঁ দিলে উড়তে থাকব।

ও একা হবে কেন, ওর সঙ্গে দল আছে।

ততক্ষণে ইলিয়াস গাড়ি অনেকটাই ব্যাক করেছে, আর লোকটাও কিছু ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়ির জানালার পাশে।

ইলিয়াস বোতাম টিপে কাচ নামাল-ইয়েস মিস্টার, এনি সমস্যা?

হালকা-পাতলা চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কিছুটা এলোমেলো পোশাকের লোকটা বলল-মোড়ের কাছে এসে গাড়ি কেউ এত স্পিডে রাখে!

স্পিড কই দেখলেন! হাজির তো হইলেই হঠাৎ কইরা!

আর খালি রাস্তা পেয়ে আপনার মাথার ঠিক নেই।

এত কথায় কাম কী! আপনার কি লাগছে? লাগে নাই তো।

লাগতেই পারত। যদি লাগত?

যদির কথা নদীতে।

জি না। যদি লাগত তখন কী বলতেন জানেন? বলতেন-লাগছে তো কী করা যাইব, নাও লাগতে পারত।

বাহবা! ওভার বাউন্ডারি মাইরা দিলেন! বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম আপনেরে দেখে না?

মোনা চাপা গলায় বলল-ইলিয়াস, বাদ দাও তো, চলো।

হ্যাঁ, যান আপনারা। তবে এর পর থেকে একটু দেখেশুনে গাড়ি চালাবেন।

এই যে বাঙালির এই হইতেছে দোষ। সুযোগ পাইলেই উপদেশ ঝাড়ে।

উপদেশ বলছেন কেন! ২০ লাখ টাকার গাড়ি কিনে চালাচ্ছেন বলে সত্য কথাকেও উপদেশ মনে হয়!

কয় কী! ইলিয়াস লোকটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মোনার দিকে তাকাল। মোনা, এই লোক এইসব কী কয়! ইলিয়াস হাসিভরা মুখে লোকটার দিকে আবার তাকাল-শুনেন ভাই। আপনেরে বিনা পয়সায় একখান উপদেশ দেই। একদম ফাও। আপনার পয়সা লাগব না।

কোনো ইয়ার্কি মারবেন আর কি।

ইয়ার্কি মারব ক্যান!

প্রথম থেকে তো ইয়ার্কির ওপরেই আছেন।

কিন্তু এইটায় ইয়ার্কি না।…ভাই, এই গাড়ির দাম ২০ না, ৪৮ লাখ। আপনে ২০ বলছেন না, গাড়ি কষ্ট পাইছে।

ওহ, তাহলে ঠিকই আছে।

ইলিয়াস বুঝল না, সে জিজ্ঞাসু চোখে লোকটার দিকে তাকাল।

লোকটা বলল-৪৮ লাখ টাকা দামের গাড়ি তো, সেই জন্য স্পিড কমানো যায় না।

ঠিক ধরছেন।…মোনা, এই লোকের বুদ্ধি আছে, কী কও।

মোনা আবারও বলল-চলো ইলিয়াস, আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।

তাইলে আর কে থাকে। ইলিয়াস বলল। লোকটার দিকে ফিরল সে। টা টা, বাই বাই ভাইজান, এর পর থেইকা দেইখা-শুইনা রাস্তা পার হইবেন।…

ইলিয়াস গাড়ি টান দিতে গিয়ে থেমে গেল-ভাই, আরেকবার হাসেন তো?

আরেকবার হাসব মানে?

প্লিজ ভাই, এইটা একটা রিকোয়েস্ট, স্বীকার করতেছি, আমিই আপনেরে চাপা দিতে গেছিলাম। কিন্তু প্লিজ ভাই, একটু হাসেন।

লোকটা হেসে ফেলল।

সেই হাসি দেখল ইলিয়াস। সে গাড়ি একপাশে সরিয়ে আনল। গাড়ি থেকে নামল সে, লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াল-আপনেরে হঠাৎ কইরা চেনা চেনা লাগতেছে ক্যান। ব্যাপার কী?

ব্যাপার কী, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।

মহাসমস্যায় পড়লাম। ভাই আপনার নাম কইবেন?

লোকটা তার নাম বলল না, সে সরাসরি তাকাল ইলিয়াসের দিকে, সম্ভবত এই প্রথম সে এতটা সরাসরি তাকাল, তার চোখ দেখে সে রকমই মনে হলো। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল এবং তার দুচোখে হাসি ফুটে উঠল-ইলিয়াস, মোটা তুই আগেও ছিলি; কিন্তু এখন দেখি তোর পৌষ মাসের ইঁদুরের মতো অবস্থা। একটু সময় নিল ইলিয়াস, তারপর সে হো হো করে হেসে ফেলল-আর তুই তো শুকাইয়া বাঁশ, বাম্বু।

তুই কি রোজই দু-চারজনকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করিস?

তরে সত্যই চাপা দেওন উচিত ছিল। শুয়ার, তুই কই হারাইছোস?…মোনা, এই মোনা গাড়ি থেকে নাইমা আসো, ঘটনা খুবই আনন্দের। সিনেমার কাহিনী ফেল মারছে।

মোনা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামল।

এই যে, এই শয়তানটারে দেখো।

মোনা বিরক্ত মুখেই লোকটার দিকে তাকাল।

এই হইতেছে আমার ছোটবেলার বন্ধু। এর নাম রুমি। নাম শুনছ না?

মোনার বিরক্তি কিছুটা কমেছে, সে দুপাশে মাথা নাড়ল, না এই নাম সে আগে শুনেছে বলে তার মনে পড়ছে না।

আরে শুনছ, রুমির গল্প তোমার কাছে করি নাই, এইটা হইতেই পারে না।

মোনা কিছু না বলে একটু হাসল।

রুমি বলল, স্লামালেকুম ভাবি। আমার কথা তো শুনলেনই। আমি ইলিয়াসের ছোটবেলার বন্ধু, সেই পুবপাড়ার…।

পুবপাড়ার? মোনার ভ্রু একটু কুঁচকে গেল।

জি। তবে ওর সঙ্গে দেখা নেই অনেক দিন। ইলিয়াস, কত দিন পর রে?

আমার মেমোরি শর্ট, তুই এইটা জানস, তুই হিসাব কর।

আমরা এইচএসসি পাস করলাম কবে?…। দাঁড়া…আরে অনেক দিন হয়েছে তো। ১৬-১৭, নাকি আরো বেশি।

কিন্তু শুয়ার তুই ছিলি কোথায়?

রুমি কিছু না বলে হাসল।

আরে ছাগলে শুধু হাসে, কথা কয় না। ছিলি কোথায়?

রুমি হাসতে হাসতেই বলল, এই তো এইখানে ওইখানে…।

বুঝছি, ধোলাই না দিলে কথা বাইর হইব না। ছোটবেলার কথা মনে নাই?

ওরে বাপ, ভোলা যায়, তুই তো একটা ডাকাত ছিলি।

এখনো আছি, গাড়িতে উঠ।

কেন?

বাড়িতে নিয়া ধোলাই দিমু।

শরীরের অবস্থা দেখছিস? এ বয়সে ধোলাই সহ্য হবে না।

গাড়িতে উঠ।

কী আশ্চর্য, তোরা কোথাও যাচ্ছিস, আমি কোথায় যাচ্ছি। এ সময় তোর গাড়িতে উঠে আমি কী করব!

এইটা তুই কী কথা কইলি! এত দিন পর দেখা এইখানে শ্যাষ!

শেষ কেন হবে?

তুই যে আবার রওনা দিলি।

আশ্চর্য তো, রওনা দেব ঠিকই, কিন্তু তোর ঠিকানা ফোন নাম্বার এসব না নিয়ে যাব না।

ইলিয়াস সঙ্গে সঙ্গে তার পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, কিন্তু এখন গেলে কী হয়? তুই কি এই ঢাকা শহরেই থাকস?

আরে না, মাত্র কদিন হলো এসেছি। ঢাকায় থাকলে তো তোর সঙ্গে দেখা হয়েই যেত।

আছস কই, কই উঠছস?

রুমি একটু ইতস্তত করল-এই তো…আমার আবার ওঠা…হয়ে যায়।

তাইলে তুই আমার বাড়িতে যাবি না ক্যান?…মোনা, তুমি একটু কও না।

মোনা কিছু বলার আগেই রুমি বলল, ভাবির কিছু বলা লাগবে না। আমি কাল অবশ্যই তোদের বাসায় যাব। এখন খুব একটা জরুরি কাজ কী?

সেইটা কী?

আবারও একটু ইতস্তত করল রুমি, মোনার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিল-আছে।

কাজটা কী, সেইটা আমাকে কওন যায়?

যায়।…ইলিয়াস, আমাকে একজন একটা চাকরির কথা বলেছিল। তার সঙ্গে দেখা করার কথা।…জামান ভাই। আমার পরিচিত।

তুই চাকরি করবি?

এখন আর ইতস্তত ভাব, দ্বিধা কিছুই নেই রুমির মধ্যে, সে স্পষ্ট গলায় বলল-হ্যাঁ, চাকরি করব।…করতে হবে না? নাকি কোনো নিষেধ আছে? একটু হাসল সে।

ইলিয়াস কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল রুমির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, যার অর্থ-চাকরি করতে রুমির কোনো নিষেধ নেই।

তাহলে যাই আমি?

যা।

কাল আসব।…ভাবি, স্লামালেকুম। কাল দেখা হবে।”

17.2_247255_1

তুমি তাহলে ওদের দেখা করিয়ে দিলেই।

দেখাটা নাটকীয় হয়েছে?

সিনেম্যাটিক।

জীবনের অধিকাংশ দেখাই আসলে সিনেম্যাটিক। আমরা স্বীকার করি না, এই যা।…তোমার আমার দেখা হওয়ার কথাই ধরো।

আমার আর সাজিয়ার দেখা হওয়াও অনেকটা এ রকম। আমরা দুজনই ছিলাম গাড়িতে। আমি একা, সাজিয়া আনোয়ারের সঙ্গে। দোষ যে কোন গাড়ির, নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, মুখোমুখি ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেল দুটোই। প্রথমে চেঁচামেচি শুরু করল দুই ড্রাইভার, তারপর আনোয়ার, তারপর আমি, দোষ যে আমাদের গাড়ির না, দোষ যে ওদের গাড়ির, এটা বোঝানোর জন্য আমরা উচ্চ স্বরে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরপর নামল সাজিয়া। সাজিয়াকে দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। ঠিক এ রকম সুন্দরী মেয়ে আমি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না। আমার শুধু মনে হলো, ঠিক এ রকম সুন্দরকেই আমি সুন্দর বলি। আমার আরো মনে হলো, এমন একটা মেয়ের সামনে আমি গলা তুলে প্রায়-ঝগড়ার মতো করছি, এটা কেমন দেখাচ্ছে!

সাজিয়া বলল-ধাক্কা লাগতে পারত, কিন্তু লাগেনি। তাই না?

জি জি, তা লাগেনি। আমি বললাম।

যদি ধাক্কা লেগেই যেত, তাহলে যে কী হতো! সাজিয়া বলল।

আমি হাসলাম-তা ঠিক, বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি আমরা। সাজিয়ার স্বামীর মুখেও দেখলাম অপ্রস্তুত হাসি।

এরপর আর কিছু বলার থাকে না। এরপর যার যার গাড়িতে ফিরে আসতে হয়, তারপর গাড়ি যার যার দিকে চলে যায়। সত্যি কথাটা হলো, সাজিয়াকে দেখার জন্য আমার ওখানে আরো কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করছিল। ঠিক সে সময়েই সাজিয়া প্রায় চিৎকার করে উঠল-আপনি-আপনি…!

আমি কী বোঝার জন্য আমি সাজিয়ার দিকে তাকালাম।

সাজিয়াকে দেখলাম উচ্ছ্বসিত-আপনি লেখক, না? আপনি লেখক।

আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না, আমি হাসলাম।

আপনি জানেন না আপনার লেখা আমার কী ভালো লাগে! কতবার ভেবেছি আপনার সঙ্গে যেন দেখা হয়!…আজ হয়ে গেল…এভাবে…। সাজিয়া হেসে ফেলল।

এভাবে! বলে আমিও হাসলাম।

পরে আমরা দুজন এ নিয়ে বেশ অনেকবার হাসাহাসি করেছি-গাড়ি অ্যাঙ্েিডন্ট যে সব সময় খারাপ, এটা কিন্তু ঠিক না।

কখনো না। এর অনেক ভালো দিক আছে।

সাজিয়া মাঝেমধ্যে অবাক গলায় বলে-দেখো, কোথায় ছিলাম আমরা…!

আমরা এই এক শহরেই ছিলাম।

কিন্তু দেখা হয়নি আমাদের।

এই শহরে কতজনের সঙ্গে কতজনের দেখা হয় না।

কিন্তু দেখা হলে তাদের কারো কারো জীবন নিশ্চয় অন্য রকম হয়ে যায়।

আমার আর সাজিয়ার জীবন অন্য রকম হয়েছে, এটা আমরা দুজনই জানি ও মানি। এই এতটুকুই। এর বাইরে আমরা আর কখনো কিছু আলোচনা করি না। এই যেমন আমাদের কেমন সম্পর্ক এটা, এই সম্পর্ক কত দিন টিকবে, কী হবে এরপর, এইসব।

আমার বিয়ে হয়েছিল। বিয়েটা টেকেনি। রিজওয়ানা-তোমার সঙ্গে থাকা যায় না, আর লেখালেখি, লেখক এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে ইন্টারেস্টিং নয়। লেখকের অন্য নারীর প্রতি ইন্টারেস্টিং মনে হওয়ারও সামান্যতম কারণ নেই-এসব বলে আলাদা হয়ে গেছে। আমাদের একটি মেয়ে। ওর বয়স তিন বছর। ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে কখনো রিজওয়ানার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমার কোনো ভাবান্তর ঘটে না, রিজওয়ানারও না। শুনেছি, ও ওর এক কলিগের সঙ্গে প্রেম করছে। করুক, আমার কী। এই যে আমি আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসি, এটাও আমাকে তেমন টানে না। মেয়ে আমার বৈকি, কিন্তু এই মেয়ের সঙ্গে আমার কোনোই বন্ধন তৈরি হয়নি। দেখা

হলে কিছুক্ষণ পর দুজনই ভ্যাবলার মতো বসে থাকি।

সাজিয়ার সংসারটা গোছানো। ওর স্বামী বড় ব্যবসায়ী, গোছানো ব্যবসায়ী, ব্যবসার ক্ষেত্রে একটু অ্যাডভেঞ্চারও পছন্দ করে। সাজিয়া বলে, ওর স্বামী খুবই ভালো, নিরামিষ টাইপ ভালো, পাঁচফোড়নসহ, সাজিয়াকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখে সেই লোক ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গম করতে বেশি ভালোবাসে। সাজিয়া বলে, ওদের বাচ্চাও হচ্ছে।

প্রথম দিন যেদিন বলল, আমি বুঝতে না পেরে একটু ভুরু কোঁচকালাম-কার।

ওদের। আনোয়ারের আর ওর ব্যবসার।

তবে এসব নিয়ে আমাদের খুব একটা কথা হয় না। আমাদের শুধু আমাদের নিয়ে কথা হয় না-গুড্ডু, লিখছ তো?

হুঁ। লিখেই যাচ্ছি।

গুড। পুরস্কার দেব।

তোমার কাছ থেকে পুরস্কার পেতে আমার ভালো লাগে।

আমারও লাগে। তবে তুমি মাঝে মাঝে পুরস্কার আদায় করে নিয়ো। আমার সেটা ভালো লাগবে।

আবার মাঝে মাঝে কোনো কিছুই বলি না। আমরা মুখোমুখি, আমরা পাশাপাশি বসে থাকি, বসেই থাকি। আমি একদিন সাজিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-আচ্ছা, আমাদের এটা কি প্রেম?

তোমার কী মনে হয়? সাজিয়া জিজ্ঞেস করেছিল।

আমরা কেউ কোনো উত্তর দেইনি।

আজ আমরা বসেছি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁটা খোলামেলা। যে যার মতো করে বসতে পারে, সময় পার করতে পারে। কিছুটা সময় আমাদের এখানে কাটানোর ইচ্ছা। আমরা প্রথমে কফির অর্ডার দিয়েছি। প্রথম চুমুক দেওয়ার পর সাজিয়া বলল-এত ক্রিম!

মটু হয়ে যাবে?

হুঁ। তখন তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।

খুব একটা ভুল কথা না। মটু হয়ো না।

আচ্ছা, যে কথা বলছিলাম, দেখা তাহলে ওদের হয়েই গেল!

দেখা না হলে কি এই গল্প, গল্প হয়?

গল্প আমরা বানাতে পারি, সবাই বলি একদম জীবনের মতো গল্প; কিন্তু দেখো জীবনের মতো গল্প বানালেও আমরা আমাদের জীবন বানাতে পারি না।

সাজিয়ার দিকে তাকালাম, সাজিয়া ভুরু নাচাল। আমি বললাম, মাঝে মাঝে তুমি চমকে দেওয়ার মতো কথা বলো।

তোমার কাছ থেকে শিখছি।

না, এসব শিখে হয় না। এগুলো তোমার ভেতরে আছে।

সাজিয়া চুপ করে থাকল।

একটা কথা বলব তোমাকে…।

হুঁ…বলবে।

তোমার কী হয়েছে?

আমার! সাজিয়াকে সত্যিই অবাক দেখাল।

তুমি বাইরে গেলে, ফিরলে…তোমাকে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক দেখায়…।

আমাকে! কেন!

সে তুমি জানো।

আরে না। তেমন কিছু হলে আমি বুঝতাম না।

আনোয়ারের সঙ্গে সম্পর্কটা খুব খারাপ যাচ্ছে।

আমার জন্য?

না, তোমার কথা তো জানে না।…এমনিই।

আমি সামান্য মাথা ঝাঁকালাম। কিছু বললাম না।

আমি পারলে কোথাও চলে যেতাম।

এতটা খারাপ…! আমি সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

এই প্রসঙ্গ বাদ দেই। কাজের কথা বলি। এবার আমার লেখার পালা, তাই না?

তোমার কী হয়েছে, বলো তো?

আমার আবার কী হবে! বললাম না!…ঠিক হয়ে যাবে।

এবার তোমার লেখার পালা কি না, এটাই জিজ্ঞেস করছ!

আহা, কথার কথা।…আমি ভাবছি, এখন কিভাবে এগোব।

আমি হাসলাম-আমিও সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।

তুমি এমন একটা জায়গায় এসে শেষ করেছ…!

জানি তুমি পারবে।

ছাই।

রাত আটটার দিকে আমরা বিদায় নিলাম। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোবার আগে আমার হাতটা একটু ধরল, ছেড়ে দিল।

দুদিন পর এলো সাজিয়া। বলল-নাও, পড়ে দেখো, ছাইপাশ কী লিখেছি!

“আমি কিছুই হতে পারিনি জীবনে। রুমি বলল। তার গলা ম্লান ও অসহায় শোনাল। ইলিয়াস…জীবনে কিছুই হতে পারিনি আমি। শুধু ক্লান্ত হয়েছি।

রুমির দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকল ইলিয়াস।

ওইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন!

তুই হইতাছস আমার ছোটবেলার বন্ধু। তুই সব কবে থেইকা আমারে দেখতাছস। তুই জানস এইসব কথা আমি কুনো দিন বুঝি নাই, এখনো বুঝি না। সহজ কইরা ক।

এসব কথা সহজ করে বলা যায় না।

যাইব না ক্যান! সহজ করলে সহজ, কঠিন করলে কঠিন।

কী বলব! রুমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি এক ব্যর্থ, পরাজিত মানুষ।

নাটকের ডায়ালগ দিস ক্যান।

সত্যি কথাই বলছি।

কইতাছস?

হ্যাঁ। আমি এক ব্যর্থ, পরাজিত মানুষ।

আমার একখান প্রশ্নের উত্তর দে-তুই জয়ী হওনের চেষ্টা নিছিলি কবে?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুমি চুপ করে থাকল।

কী হইল? উত্তর নাই?

আছে।

শুনি। ক।

আমি তো পরাজিত বা ব্যর্থ হওয়ার চেষ্টাও করিনি।

কী করছিলি? কিছু কি করছিলি?

রুমি ইলিয়াসের এই প্রশ্নের উত্তরও দিল না। সে অন্য একদিকে তাকিয়ে থাকল। আজ সকালে সে এসেছে ইলিয়াসের বাসায়। ইলিয়াস যে অনেক টাকার মালিক হয়েছে, সেটা গত রাতেই বোঝা গেছে। শুধু অত দামি গাড়ির জন্য না। তার চেহারার মধ্যেই একটা বড়লোক বড়লোক ভাব। আর আজ সকালে ইলিয়াসের বাড়ির সামনে এসে হতবাক। বাড়িটা যেন জাহাজের মতো বড়। এত বড় বাড়িতে ইলিয়াস থাকে! এত বড় বাড়ি ইলিয়াসের।

বাড়ির সামনে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। ঢুকবে কি ঢুকবে না, ভুল ঠিকানায় এসেছে না ঠিক ঠিকানায়, এই দ্বন্দ্ব তার ছিল না। সে আসলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিল। গত রাতে যার কাছে সে চাকরির জন্য গিয়েছিল, সেই লোক তার ছোটবেলার বন্ধু ইলিয়াসের কাছে কিছুই না; যে ইলিয়াস ছোটবেলায় কিছু খেলাধুলা আর মারামারি ছাড়া তেমন কিছুই পারত না।

বাড়ির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তার ভেতরে ঢোকার জন্য একসময় গেটের পাশের বেল বাজাল। দারোয়ানের গেট খোলা আর তার পরিচয় জানার পর অতিসম্মানের সঙ্গে ভেতরে নিয়ে যাওয়া। অবশ্য ভেতরে নিয়ে যাওয়া মানেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়া নয়। বাড়ির সদর দরজার টেলিফোন আর কম্বিনেশন লকের ঝামেলা। সেসব পার হতে অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ ইলিয়াস যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ই দরজা খোলে এবং আয় বলে ইলিয়াসকে বুকের ভেতর টেনে নেয়। মোনা বাসায় ছিল না। খুব সকালে তাকে বেরোতে হয়েছে। তাদের এক সংগঠনের আজ জরুরি মিটিং। তবে সে দুপুরের আগেই চলে আসবে। সে আসার পর তারা তিনজন একসঙ্গে খাবে, সে বলে গেছে। ইলিয়াস রুমিকে নিয়ে বসেছে লনে। ব্যবস্থাটা চমৎকার, রুমি বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখেছে। বাগানের মাঝে মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে উঁচু ছাতা, চওড়া, নিচে টেবিল আর টেবিল ঘিরে ওরকম একটা ছাতার নিচে বসার পর রুমির মন নতুন করে খারাপ হতে আরম্ভ করল। অথচ এই একটু আগে ইলিয়াস যখন ‘আয়’ বলে বুকে টেনে নিল তখন এটা ছিল না। তাহলে এখন কেন ফিরে এলো! এমন কথা কখনো কোথাও ছিল না ইলিয়াস ধনী হতে পারবে না! তা ছাড়া ছোটবেলার একজন বন্ধু, ছোটবেলায় তার বন্ধু কতজনই বা ছিল, ছিল হাতে গোনা তিন-চারজন, ইলিয়াসের যে ধরন ও স্বভাব, ওর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হওয়ার কথা না; কিন্তু তাদের গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেই ইলিয়াস আজ এমন এক পর্যায়ের ধনী, এতে তার আনন্দ হওয়ার কথা। হিংসা ব্যাপারটা তার ভেতর কখনো ছিল না। তার অজান্তে এটা কবে জন্ম নিল?

তারা ওখানে বসার পর আরেক কাণ্ড ঘটল, নানা রকম খাবার আসতে লাগল তাদের টেবিলে। কয়েক রকম ফল আর মিষ্টি, কষানো মাংস, কোমল পানীয় এবং সঙ্গে আরো নানা কিছু। রুমি জিজ্ঞেস করল-এসব কী?

খাওয়া খাদ্য।

সে তো বুঝতে পারছি। কিন্তু কয়জনের? আরো অনেকে আসবে?

আর কেউ নাই। শুধু আমি আর তুই?

খাবার তো সপ্তাহখানেকের।

নাশতা খাইছি একটু আগে, নাইলে আমি একাই টানতে পারতাম।

ইলিয়াসের দিকে তাকাল রুমি। সে হঠাৎ করে খেয়াল করল, তার ভেতরকার গুমোট ভাবটা চলে যাচ্ছে। হিংসা ব্যাপারটা আর একটুও কাজ করছে না। সে হাসিমুখে বলল, তুই বোধ হয় একটুও বদলাসনি।

আরে, মানুষ আবার বদলায়নি। ইলিয়াস হাসিমুখে বলল। কাউরে কাউরে দেইখা মনে হয় বদলাইছে, আসলে ভেতরে ভেতরে সে বদলায়নি। মৃদু সুতা ধইরা টান দিলে দেখবি সব আগের মতন।

এটা ঠিক কথা না ইলিয়াস, মানুষ বদলায়।

তুই বদলাইছস?

জবাব দেবার আগে একটু ভাবল-রুমি? তারপর সে মাথা ঝাঁকাল। বদলিয়েছি। ইলিয়াস, আমি অনেক বদলিয়েছি।

আরে যা, আমি দেখতেছি না!

একে কেমন করে বোঝাবে সে! রুমি তাই চুপ করে থাকল।

তুই আগে কম কথা কইতি, এখনো সেই রকম। আগে ভাব নিতি, এখনো নিতেছস।

রুমি হেসে ফেলল।

হাসিস না। এই ইলিয়াস মিছা বলে না।

বুঝলাম। কিন্তু তুই আমার মধ্যে ভাব নেওয়ার কী দেখলি!

সেইটা আমার বোঝার বিষয়। তোর না।

ঠিক আছে, তুই কথা বল, আমি শুনি।

কথা দুইজনেই কমু।…চেহারার এই হালত হইছে ক্যান!

আমার চেহারা কোন সময় ভালো ছিল?

তর চেহারার মইধ্যে একটা মায়া ছিল। এখন হইছস খেজুরগাছ। ব্যাপার কী!

রুমি কিছু না বলে একটু হাসল।

উত্তরপাড়ার গোলাম হোসেন চাচার হইছিল ক্ষয়কাশ। কাশতে কাশতে শুকাইয়া শ্যাষ। তর চেহারায়ও যক্ষ্মার ছাপ।…রুমি, তুই কি আমার ওপর রাগ করতাছস?

একটুও যে রাগ হচ্ছিল না, তা নয়। কিন্তু রুমি দুপাশে মাথা নাড়ল।

গত রাইতে কইলি চাকরির জন্য যাইতেছিলি। এইটা কী ব্যাপার?

এটা আবার কী ব্যাপার! মানুষজন চাকরি করবে না?

ইলিয়াস বেশ কিছুটা সময় নিয়ে রুমির দিকে তাকিয়ে থাকল, বলল-না, ঠিকই আছে, চাকরি তো মানুষ করবই।…কিন্তু তর ব্যাপারটা কী আমারে ক। কিছু একটা ব্যাপার আছে, এইটা বুঝতেছি; কিন্তু ধরতে পারতেছি না।

বলার কিছু নেই।

আছে। তুই কইবিও।…কফি দিতে কইমু, না চা?

চা। কফি আমার ভারী ভারী লাগে।

একটু দূরে দাঁড়ানো অপেক্ষমাণ লোককে চা দিতে বলে ইলিয়াস রুমির দিকে ফিরল-ক।

কী বলব?

রুমি, আমার মাইর তো বহুদিন খাইস নাই, ক।

বড় করে শ্বাস ফেলল রুমি, বলল-ইলিয়াস…।

ক।

ইলিয়াস, জীবনে কিছুই হতে পারিনি আমি। শুধু ক্লান্ত হয়েছি।

ইলিয়াসের কাছে ফোন এলো একটা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর পারে তো ফোনসেট আছড়ে ভেঙে ফেলে সে। আধামিনিটের মতো সে বিড়বিড় করে, তার পরই বদলে গেল। হাসিমুখে রুমির দিকে ফিরে বলল-রুমি, সত্যি কইরা ক, তুই রুমিরে চেনস নাই?

সত্যিকথা বলতে কী-তখনই চিনে ফেলিনি। রাতে যখন মেসে ফিরলাম, ভাবলাম, তখন মনে পড়ে গেল-বাপ রে, কী প্রেম ছিল তোদের!

আর সেই প্রেমের পিছে অবদান কার?

রুমি কিছু না বলে সামান্য হাসল।

তারপর তুই তো আমাদের বিবাহ…নাকি বিবাহের আগে পলাইলি…আমাদের বিবাহ তুই দেখস নাই, দেখছস? বিশাল কাহিনী।

দেখিনি। তার আগেই আমরা পুবপাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।

মহাঝামেলা, বলুম নে।…কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, মোনাও তরে চিনতে পারে নাই।

ভাবির কি আমাকে চেনার কথা?

আরে পুবপাড়ার তরে চিনত না কে?

এটা ঠিক কথা না ইলিয়াস। আমি ছিলাম মুখচোরা ছেলে।

এইটা অবশ্য ঠিক, তুই একলা-একলা থাকতি।

আমাকে তোরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ চিনত না।

তা-ও, ক্যান যেন আমার মনে হইছিল মোনা তরে চিনব।

কারণ নেই তো কোনো।

তর কত গল্প করছি না তারে!

তবু।…ইলিয়াস, তোকে মাঝে মাঝেই গম্ভীর দেখাচ্ছে।

তাই? আর কইস না দোস্ত, ওই যে ফোনটা আইল না, ব্যবসার এক সমস্যা হইতেছে। মানুষজন ইচ্ছা কইরা ঝামেলা পাকায়। মাঝে মাঝে মনে হয়…।

সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে কোথাও চলে যাবি?

আরে না, এইটা কী কস! আমি কি ওই রকম নাকি?

তা-ও ঠিক।

ইচ্ছা হয় সবগুলারে ধইরা, যেইগুলা ঝামেলা পাকায় আর কি, এমন পিটান দেই।

দিস।…ভাবি আসবেন কখন?

ভাবিরে কী দরকার? আমার সঙ্গে কথা কইয়া তোর পোষাইতেছে না?

পোষাচ্ছে, বল।

তাইলে ভাবিরে খুঁজস ক্যান?

উঠতে হবে না?

ইলিয়াস রুমির দিকে রাগ-রাগ চোখে তাকাল।

কী করলাম আবার?

দুপুরে না তোর আমাগো সঙ্গে খাওনের কথা?

ও।

তারপর বহু গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশন নেওন বাকি আছে।

তোর ডিসিশন তুই নিবি, আমার সেখানে কাজ কী?

ডিসিশন তোরে নিয়া। তোর থাকতে হইব।

আমাকে নিয়ে কী ডিসিশন?

কাল রাইতে যে চাকরির জন্য গেলি, হয় নাই, না?

আবার কেন জিজ্ঞেস করছিস, একটু আগে তোকে বললাম না-হলেও অমন একটা লোককে সঙ্গ দেবার জন্য তার দেওয়া চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

এইটা ঠিক কথা না, চাকরি যার দরকার সে কার আন্ডারে চাকরি করব, এইটা ভাবলে তার চলে না। তয় আমি তো তর রগ চিনি। তর জইন্য অন্য ব্যবস্থা।

কী সেটা?

ছোট একটা ঘরে চারজনের থাকার ব্যবস্থা। চৌকিগুলো যেন একটার সঙ্গে একটা লেগে আছে। বাকি তিনজনই এই ঘরে দিব্যি কাটাচ্ছে। এই যে হাত বাড়ালেই আরেকজনকে ছোঁয়া যাবে, পুরনো দিনের একটা ফ্যান এমন কটর কটর শব্দ করছে, ঘরে আলো আসে কি আসে না, এই নিয়ে বাকি তিন বাসিন্দার কোনো মাথাব্যথা নেই। রুমি একবার ভেবেছিল, বাকি তিনজনের যখন নেই তখন আমারও থাকা উচিত না।

তবে এই ভাবা পর্যন্তই। তার মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এর চেয়ে খারাপ পরিবেশে সে রাত পার করেনি এমন নয়। সেদিন সন্ধ্যার দিকে মেসে ফিরে দেখে একজন ভোঁসভোঁস করে ঘুমাচ্ছে, তার লুঙ্গি খুলে চোকি থেকে নিচের দিকে ঝুলছে। এ রকম কিংবা এর চেয়ে হাস্যকর কিংবা বাজে কোনো দৃশ্য সে আগে দেখেনি, এমনও নয়। তবে সেসব হলো অন্য পরিবেশ আর পরিস্থিতির কথা, তখন সে ওসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতই ছিল। আর এখন, এখন সে সত্যিই একটু সুস্থির হতে চায়। এখন একটু গুছিয়ে কয়েকটা দিন পার করতে মন চায়।

তাই যদি হয়, তবে তাকে ইলিয়াসের প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে হয়। ইলিয়াসের প্রস্তাব কি সে গ্রহণ করবে? করাই যায়, করলে ক্ষতি নেই কোনো, লাভ আছে। একটু হয়তো বুকের মধ্যে খচখচ করতে পারে-বন্ধুর অনুগ্রহে থাকা। তা, এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই তো কারো না কারো অনুগ্রহে আছে। এখন সে যদি বন্ধুর অনুগ্রহ কিছুটা নেয়ই এই জীবনে, একটু একটু করে তার সঙ্গেই সে মানিয়ে নিতে পারবে না জীবনে? পারা উচিত, জীবনে এত কিছুর সঙ্গে সে মানিয়ে এসেছে এত দিন, এটুকু কেন সে মানিয়ে নিতে পারবে না। ওই যে সে রাতে জামান ভাইয়ের কাছে গেল সে চাকরির জন্য, খুব আত্মবিশ্বাসী, খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে বলেছিল সে, আরে তুমি গিয়েই দেখো না কী হয়। কিন্তু কী হলো, জামান ভাই এমন ব্যবহার এবার করল যে একদম ছোট হয়ে গেল। কিন্তু সে উল্টো দুটো কথা শুনিয়ে দিয়ে আসতে পারল না, কারণ চাকরি তার সত্যই দরকার। তা শেষে হবে। তার চেয়ে কোনো কথা না শুনে বন্ধুর অনুগ্রহে নেওয়া, এটাই কি ভালো না? তা ছাড়া শুধু অনুগ্রহের ব্যাপার এখানে নেই। এখানে আছে আন্তরিকতা, আর আন্তরিকতা, তবে এমন এক কৃতজ্ঞতা এখনো থাকতে পারে ইলিয়াসের, তার ধারণাই ছিল না। ইলিয়াস যখন বলল, সে একদম অবাক হয়ে গেল।

হলো কী, মোনা ফিরল দুপুরের কিছু আগে, এসে বলল-স্যরি রুমি ভাই, এটা আমার খুবই অভদ্রতা হয়ে গেল। কিন্তু উপায় ছিল না।

না না, ঠিক আছে ভাবি, ঠিক আছে। রুমি বলল। আমি শুনেছি আপনার জরুরি মিটিং ছিল।

এইসব কথা বাদ। রুমি একটা হুংকার দিল প্রায়। মোনা, তুমি বইসা পড়ো।

আমি আসছি একটু পর। মাত্র বাইরে থেকে এলাম।

আরে বসো না, তোমারে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ইনফরমেশন দিমু।

রুমি খেয়াল করল, কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই মোনা বসল। এই অনিচ্ছা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো না। কারণ অন্তত এটুকু সে বোঝে, সেই সকালে মিটিং করতে বেরিয়েছে যে মেয়েটি। বাসায় ফিরলে আগে ফ্রেশ হবে, তারপর তার অন্য কিছু। কিন্তু ওদিকে ইলিয়াসের কোনো খেয়াল নেই। সে জিজ্ঞেস করল-তুমি কি গেস করতে পারবা?

কী গেস করব?

তোমারে যে ইনফরমেশনটা দিমু, সেইটা কী?

মোনা মাথা নাড়ল-কিভাবে পারব!

তোমার বুদ্ধি দিয়া জানবা। তোমার বুদ্ধি কি কম?

উঁহু, এখানে বুদ্ধি কমবেশির কোনো ব্যাপার নেই। এখানে আছে আন্দাজের ব্যাপার।

তাইলে আন্দাজ করো।

ইলিয়াস, সেটাও আমার পক্ষে সম্ভব না।

কেন!

কারণ তোমরা কী নিয়ে কথা বলছিলে তা আমি জানি না।

এইটা তুমি ঠিকই বলছ। মোনা, তুমি সত্যই বুদ্ধিমান।

তোমার ছোটবেলার বন্ধু। কত দিন পর তোমাদের দেখা।

সেইটা আর বইলো না।

গল্প করতে করতে এখন কোনটা তোমাদের বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, সেটা বিচ্ছিন্ন কারো পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন।

শুনো, বলি এইবার…।

ইলিয়াস বলতে নিল, রুমি তাকে বাধা দিয়ে মোনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-ভাবি, ব্যাপারটা কিন্তু একটুও ইন্টারেস্টিং না। জানার পর থেকে ইলিয়াস এটাকে একটু একটু করে ইন্টারেস্টিং বানাচ্ছে।

এইটা ইন্টারেস্টিং না। কয় কী ব্যাডা। মোনা তুমি সাক্ষী, তুমি রায় দিবা।

সাক্ষী কোনো দিন রায় দেয়?

ওই হইল। মোনা, রুমি এখনো বিবাহ করে নাই।

মোনা তাকাল তার দিকে। মোনার মুখে সামান্য হাসি।

কী হইল, তুমি শুধু একটু হাসলা। আমি ভাবছিলাম তুমি চমকায়া উঠবা।

তোমাদের সালাম ভাইও তো বিয়ে করেননি। ওনার বয়স কত?

আরে, সেইটা অন্য ব্যাপার। সালাম ভাই করে নাই, কিন্তু আমার এই বন্ধু বিবাহ করে নাই এইটা আমারে খুবই অবাক করতেছে।

সে মৃদু গলায় বলল, এখানে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। পৃথিবী অনেক বড় জায়গা, অত বড় জায়গার কথা বলার দরকার নেই, বাংলাদেশের কথাও নয়, এই ঢাকা শহরের কথাই বলি না কেন, ইলিয়াস তুই খোঁজ নিয়ে দেখ এই ঢাকা শহরেই কত লোক বিয়ে করেনি।

তারা করে নাই, সেইটা তাগো ব্যাপার। কিন্তু তুই ক্যান করস নাই? সেই ছোটবেলা থেইকা কত কত মেয়ে তর জন্য পাগল ছিল।

আমার জন্য মেয়েরা পাগল ছিল?

ছিল, দেখি নাই নাকি?

তুই একটা মেয়ের নাম বলতে পারবি?

সেইটা কেমন পারব! আমি কি নাম মুখস্থ কইরা রাখছি নাকি?

সে মোনার দিকে তাকাল-ভাবি ওর এ বিষয়ক একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। যা বলছে, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছে।

ইলিয়াস মিথ্যা বলতেছে! ইলিয়াস লাফিয়ে উঠে মারার ভঙ্গি করল।

সে সেই ভঙ্গি দেখে হাসতে আরম্ভ করল আর মোনা দাঁড়িয়ে বলল-রুমি ভাই কেন বিয়ে করেনি এ বিষয়ে আমরা দুপুরে খাবার সময় কথা বলব।

দুপুরে খাবার টেবিলে অবশ্য এই কথা আর উঠল না, উঠল অন্য কথা। এলাহি আয়োজন দুপুরে, দেখে তার মনে হয় এটাকে ভোজসভা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। সে না বলে পারল না-রোজই কি এ রকম আয়োজন হয়?

ইলিয়াস গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, আমি একটু বেশি খাই এইটা ঠিক, তাই বইলা আমি কি রাক্ষস যে রোজ রোজ এই ব্যবস্থা? এইটা হইতেছে তোর অনারে।

রুমি জিজ্ঞেস করল, আমি কি রাক্ষস, তোর কি তাই ধারণা?

ক্যান, এই কথা ক্যান উঠতেছে?

এত খাবার কে খাবে? আমাকে কি রাক্ষস ভেবে তোর বাবুর্চি এত কিছু রেঁধেছে? বাবুর্চিকে বলে রেখেছিলি যে আজ একটা রাক্ষস আসবে?

ইলিয়াস মোনার দিকে তাকিয়ে হাসল-আমার বন্ধুর মুখে বোল ফুটতেছে, দেখছ? এমনিতে কথা কম কয়, কিন্তু যখন কয়…অ্যাই, তুই আয়নায় নিজেকে দেখস।

দেখি!

মনে হয় না। কাল রাইতে কইছিলাম ব্যাম্বু। এখন মনে হইতেছে আমসি কইলেই বেশি ভালো হইত।

বল।

যত পদ রান্না হইছে, সব পদ একটু একটু কইরা নিবি।

কয় দিন সময় দিবি?

চুপ ব্যাডা। গোসল সারতে সারতে তর ব্যাপারে আরো কিছু ডিসিশন লইছি।

জানাবি? সে বলল। বলে সে খুব অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে হঠাৎ করেই সে অনেকটাই সহজ বোধ করতে আরম্ভ করেছে।

না জানাইলে চলব? জানামু বইলাই তো ডিসিশন নিচ্ছি।

বল তাহলে।

মোনা, তুমিও শুনো। এর চেহারা হইছে চামচিকার মতো…।

আহা ইলিয়াস, তুমি এসব কী বলো!

উপায় নাই, ইলিয়াসের মুখ পাতলা।…রুমি, আমার এই বাড়িতে একখান মোস্ট মডার্ন জিম আছে। সব লেটেস্ট।

কী করতে হবে?

আমি ফুঁ দিলে তুই যেন চামচিকার মতো উইড়া না যাস, তাই নিয়মমতো খাইবি আর হিসাব কইরা জিমে যাইবি। একদিন দেখায়া দিমু নে। দেখি তোর চেহারা ফিরে কি না।

ইলিয়াস, চেহারাটা ভেঙে পড়েছে এটা ঠিক বুঝি; কিন্তু আমার কোনো অসুখ নেই।

ক্যামনে বুঝলি? ডাক্তার দেখাইছোস? জীবনে তুই ডাক্তারের কাছে গেছস?

ডাক্তারের দরকার নেই, নিজের অসুখটা টের পাওয়া যায়। তোকে বলেছি আমি, প্রচুর অনিয়ম করেছি, তার জের টানতে হচ্ছে এখন, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

এইটা সমস্যা। এই বয়সে ক্লান্তি কী? আমি দাবড়াইয়া বেড়াই।

তুই বুঝবি না ইলিয়াস, ক্লান্ত হওয়ার জন্য বয়স লাগে না।

ইলিয়াস বিরক্তিসূচক এক উচ্চারণের পর বলল, সেই ছোটবেলা থেইকা তরে শালা আমরা কেউ ঠিক ঠিক মতো বুঝি নাই। আমিও পুরা বুঝি নাই। মোনা, আমার এই বন্ধু ছিল কবি…।

কবি। আমি কবি ছিলাম? সে একদম অবাক হয়ে গেল।

ছিলি না? আমরা সবাই খেলতাম আর তুই একদিনও মাঠে নামতি না, দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া শুধু দেখতি।

এই জন্য কবি?

আমরা সবাই আছি আড্ডায় আর তুই বাড়ির ছাদে বইসা বই পড়তাছস। তরে বই ছাড়া কেউ কুনো দিন দেখছে?

দেখেনি, ধরে নিলাম। সে জন্য কবি হয়ে গেলাম?

তারপর আরেকটু যখন বড় হইলি, কী সব কইতে আরম্ভ করলি। আমরা ওই সবের কিছুই বুঝি না। তুই তখন কস, আরেকটু বড় হইয়া তুই বাইর হইয়া পড়বি, পৃথিবীর পথে পথে ঘুইরা বেড়াইবি। কইতি এক বন্দর থেইকা তুই আরেক বন্দরে যাবি, এক নদী থেইকা আরেক নদীতে, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরবি আর সমুদ্রের মাঝে কোনো দ্বীপে ঘর বানাইবি…।

ইলিয়াস! রুমি সত্যিই অবাক। তুই এত কিছু মনে রেখেছিস!

আমি কিছুই ভুলি নাই।

আমার মনে হয় আমি নিজেই ওসব ভুলে গেছি।

এইটা ঠিক না। ওই সব চাপা পড়তে পারে; কিন্তু ওই সব তুই ভুলিস নাই। কারণ ওই সব তর ভেতরে আছে। কারণ তুই হইতাছস কবি।

আবার বলে কবি! আরে, কবি হওয়া কি অত সহজ নাকি?

একটু ভাবল ইলিয়াস, তারপর গম্ভীর গলায় বলল-না, তুই কবি। কবি না হইলে অমন কইরা চিঠি লিইখা দিতি ক্যামনে!

এই কথা বলে ইলিয়াস একটু বিব্রত হলো। আড়চোখে সে একবার মোনার দিকেও তাকাল। মোনা মাথা ঝাঁকাল-কী?

কী?

ব্যাপার আছে মনে হচ্ছে।

কিসের!

এই যে কী বললে-চিঠি। বলে চোর চোর একটা ভাব নিয়েছ।

যেমন হঠাৎ বিব্রত হয়ে উঠেছিল ইলিয়াস, তেমনই সে দ্রুত সামাল দিল। সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে আরম্ভ করল-রুমি…না, তুই না। মোনা, শুনো। মানসম্মান যাইব বইলা তোমারে এই একটা কথা বলি নাই। এখন মনে হইতেছে মানসম্মান গেলে যাউক। শুনবা।”

পড়া শেষ করে আমি অবাক চোখে সাজিয়ার দিকে তাকালাম-তুমি দেখছি লেখালেখির অনেক কিছুই শিখে ফেলেছ।

বলেছি আগে-তোমার কাছ থেকে। তবে সব কিছু শেখার প্রশ্ন ওঠে না হাম্বা, কিছু শিখেছি।

সবাই আসলে কিছুই শেখে। তাই এদিক-ওদিক করে তাকায়। তবে আমার কাছ থেকে তুমি শেখোনি। লেখালেখির ব্যাপারটা তোমার ভেতরেই আছে।

তা জানি না। কিছু থাকতে পারে, অনেক পড়তে পড়তে…কিন্তু এখন কী হবে?

লেখক যা চাইবে, তা-ই হবে, তাই না? তুমি নিজেও নিশ্চয় কিছু একটা ভেবেছ।

ভেবেছি। আবার ভাবিওনি।

চরিত্রগুলো খুব ভালো দাঁড়িয়েছে। কোনো বর্ণনা নেই, তবু এদের চেহারা পর্যন্ত অনুমান করা যায়।…মোনার চেহারা কি তোমার মতো?

সাজিয়া হাসল-হতেও পারে।…তোমার কী মনে হয়?

তোমার মতো।

কিন্তু রুমির চেহারা কিন্তু তোমার মতন না। ওকে বেশি নরম মনে হয়।

সাজিয়া…একটা ব্যাপার ভেবেছ?

মাথা নাড়ল সাজিয়া-তুমি যে ঠিক কী ভাবার কথা বলছ!

হয়তো এই মোনা আছে, এই ইলিয়াস আছে, এই রুমি আছে।

এমনভাবে বলছ, যেন কত বড় ব্যাপার না! কিন্তু থাকতেই পারে। ঠিক তারা না হলেও, তাদের মতো।

আমি জানি এটা, নিজেও বহুবার বলেছি। কিন্তু আজ হঠাৎ খুব অবাক লাগছে। এ রকম মানুষ আছে। তাদের জীবনে ঘটনা ঘটছে।

হুমম।…লেখক, আমাদের এ লেখাটা শেষ করতে হবে।

হ্যাঁ, শেষ করা উচিত। গল্প যখন শুরু হয়ে গেছে তখন শেষ করাটাও দরকার।

মোনা কী করবে এখন, তোমার কী মনে হয়?

মোনা যা-ই করুক, ইলিয়াস যা বলতে চায়, বলে ছাড়বে।

সেটা কি আনন্দদায়ক হবে?

ইলিয়াসের সঙ্গে মানানসই হবে?…গল্পের পরিণতির সঙ্গে কতটা মানানসই হবে সেটা এই এখনই বলা যাচ্ছে না।

এক কাজ করবে? তুমি লিখতে শুরু করো।

উঁহু। এখন তোমার সঙ্গে গল্প করব।

আমি একটু বাইরে যাব।

বাইরে যাবে!…তুমি এটুকু সময়ের জন্য এসেছ?

ফিরব আবার। লিখব। আমার বাইরে একটা জরুরি কাজ। ওই যে যে জমি বিক্রি করছি, ওটার ব্যাপারে। তার পরই ফিরে আসব।

আসবে তো?

আসব। তারপর বেশ অনেকটা সময় থাকব।

সাজিয়া চলে গেল। আমি একটু পর লিখতে বসলাম। মন বসল না। এই লেখাটা নিয়ে আমার সমস্যা হলো না। এখানে কী হবে, ঠিক করেই নেওয়া যায়। আমার মন বসছে না অন্য কোনো কারণে। সেটা কী কারণ, বুঝতে পারছি না। আমার মনে হলে আগামী পরশু মেয়েকে দেখতে যাওয়ার কথা। আমি ঠিক করেছিলাম, এবার যাব না। না গেলে আমার খারাপ লাগবে না, মেয়েরও না। কিন্তু এই এখন মনে হতে লাগল-যাব। মেয়েকে বলল-মা, চলো ঘুরে আসি। যাবে?

মেয়ে কি বুঝবে? বুঝলে অবাক হয়ে যাবে-কোথায়?

আমাকে অনেক চকোলেট কিনে দেবে?

চলোই না।

মেয়েকে আমি চকোলেট, পুতুল, পোশাক, খেলার কোনো জিনিসই কিনে দেব না। মেয়েকে নিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করব। কিছুক্ষণ হাঁটলেই আমরা এক অজানা জায়গায় চলে আসব। মেয়ে অবাক গলায় বলবে-বাবা, এটা কী?

এটা একটা অচেনা জায়গা মা। আমিও চিনি না।

ওহ।…এখানে কি মাও আসবে?

মা!…আমি ঠিক জানি না যে।

আসবে। আমার মনে হয় আসবে।

তাই! তোমার মা কিছু বলেছেন?

না। মেয়ে দুপাশে মাথা নাড়বে। কিন্তু চলে আসতেও পারে। পারে না?

পারে। আমি বললাম, মা, পারে কি পারে না, এটা আসলে আগে থেকে বলা যায় না।

কেন?

মেয়েকে কিছু বলতে যাওয়ার আগে আমার মনে পড়ল, আমার লেখাটা শেষ করতে হবে। লেখাটা নিয়ে অবশ্য আমার একটুও চিন্তা নেই। কিছু গুছিয়ে নেওয়ারও নেই। আমি জানি, এরপর কী হবে। তারপর কী হবে, তা জানি না। তারপর নানা কিছু হতে পারে। সে পরের কথা, আপাতত একটা ঘটনাই ঘটতে পারে। আমি সেটাই এখন লিখব। বাকিটুকু পরে দেখা যাবে। আমি হাসিমুখে লিখতে বসে গেলাম।

মোনা কিছু বলল না। সে গম্ভীর নয়, সামান্য একটু হাসি ছড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে, বললে সে শুনবে, আর না বললে সে শোনার জন্য চাপ দেবে না।

ইলিয়াস রুমির দিকে ফিরল-কমু?

রুমি বুঝতে পারেনি ইলিয়াস কী বলতে চাচ্ছে। সে বলল-কী বলবি?

বুঝছ নাই?

আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তুই কী বলবি!

মিথ্যা। লজ্জা পাইতাছস?

লজ্জা পরের কথা, বুঝতে পারলে না।

আরে, কী বলি! ইলিয়াস তাকিয়ে থাকল রুমির দিকে। যেন, কেন সে এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। তার জন্য তার বিস্ময় ও বিরক্তি। আরে! সে আবার বলল। তর কি মনে নাই, তুই আমার হয়ে মোনারে চিঠি লিখে দিতি?

রুমি সত্যিই বিস্ময় বোধ করল-আমি চিঠি লিখে দিতাম ভাবিকে?

তুই দিতি না। তুই আমার হইয়া লিখতি।

রুমি আমতা আমতা করতে লাগল।

আরে ছাগল, তুই কি আমারে চিঠি লেইখা দেস নাই?

দিয়েছি।

তাইলে?

কিন্তু মোনা ভাবির জন্য দিয়েছি কি না, তা তো জানি না।

অত জাননের দরকার কী! লেইখা দিতি, এই হইল ব্যাপার।

রুমিকে বিব্রত দেখাল, মোনার মুখে মিটিমিটি হাসি দেখা গেল। ইলিয়াস ফিরল মোনার দিকে-মোনা, ডার্লিং, এই হইতেছে ব্যাপার। তোমারে আমি যত প্রেমপত্র দিছি, সব রুমির ল্যাখা। আজ স্বীকার গেলাম।

মোনা হাসল।

বিশ্বাস হইতেছে না?

ধরো, হচ্ছে।

শুনো, রুমি ছিল সুন্দর সুন্দর ডায়ালগ দিয়া চিঠি লেখনের ওস্তাদ।

আচ্ছা…।

আমরা সবাই ওরে দিয়া কত কত চিঠি লেখায়া নিছি।

কত কত মানে! মোনার মুখে হাসি।

এইটা কথার কথা।

বলোই না।

আরে, বুঝতেছ না! ছোটবেলায় যেই মেয়েরে ভালো লাগত, তারেই তো একটা-দুইটা চিঠি পাঠাইতাম।

মোনা একটু নড়েচড়ে বসল, তাকে দেখে মনে হলো সে এখন বেশ মজা পাচ্ছে-আর সব চিঠি লিখে দিতেন রুমি ভাই?

আর কে দিব।

তা, ছোটবেলা থেকে কয়টা প্রেম করেছ তুমি?

একটু ভাবল ইলিয়াস, আঙুলে সামান্য সময় গুনলও-না, গুইনা কইতেও পারমু না। তবে কয়েকটা তো হইবই। কিন্তু একটাও টিকে নাই।

আহা রে!

আসলে হইছে কী, চিঠির মইধ্যে রুমি এমুন ভারী ভারী ডায়ালগ দিত, কুনো মেয়ে বেশি দিন ওই ডায়ালগ সামলাইতে পারত না। যাউক গিয়া, তুমি ওই সব ডায়ালগ সামলাইছ, আমি তোমারে পাইছি, আমি হইতেছি মোস্ট হ্যাপিম্যান। এখন আসো কিছু কাজের কথা হউক। রুমির জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হয়।

আমার জন্য আবার কী ব্যবস্থা…।

তুই চুপ। সেইটা আমি আর মোনা বুঝব।

দুপুরে খাওয়ার পর রুমির বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হলো। সে অবশ্য বারবার বলছিল, চলে যাবে, চলে যাবে। তার জরুরি কাজ আছে।

ইলিয়াস অবাক গলায় বলল-তোর জরুরি কাজ!

কেন, আমার কি জরুরি কাজ থাকতে পারে না?

তুই তো ষোল আনা বেকার। বেকারদের আবার জরুরি কাজ কী?

চুপ। আমার বিশ্রামের দরকার নেই। দুপুরে আমি বিশ্রাম নেই না।

ঠিক আছে, আয় তাইলে গল্প কর। মোনা তুমি থাকবা, না যাবা?

থাকব। তুমি কটা প্রেম করেছ সে সম্পর্কে আরো কিছু যদি জানা যায়।

তারা এসে ফ্যামিলি লাউঞ্জে বসল। ইলিয়াস বলল, না, এইবার আর ওই সব কথা না। এখন রুমির জন্যই ডিসিশন নিমু।

রুমি আবার বলল-আমার জন্য কী ব্যবস্থা…।

ইলিয়াস এইবার তাকে ধমক দিল না, সে স্বাভাবিক গলায় বলল-তুই গত রাইতে চাকরির জন্যই এক লোকের বাসায় যাইতেছিলি না?

মোনার সামনে এই প্রসঙ্গ আবার ওঠায় একটু অস্বস্তি বোধ করল রুমি, সে একটু হাসার চেষ্টা করল-একসময় তো ভাবতাম চাকরি-বাকরি কিছুই করব না।

শুধু ঘুরবি না? ছোটবেলায় তো শুধু এসবই কইতি।…মোনা, বুঝছ, রুমি ছাত্র হিসেবেও খুবই ভালো ছিল, আর আমার তো ল্যাখাপড়ার কথা শুনলেই জ্বর আইত। অ্যাই রুমি, তুই একবার রচনা লেইখা ডিসি সাহেবের হাতে থেইকা পুরস্কার নিছিল না? একটা কম্পিটিশন হইছিল…।

রুমি বলল, বোধ হয়।

বোধ হয় না, সত্য। আমার মনে আছে। রচনার বিষয় কী ছিল, এইটাও মনে আছে।

বাপ রে। মোনা বলল, তোমার দেখি সব মনে আছে। কী ছিল বিষয়?

পরিষ্কার মনে নাই, বড় হইয়া আমি যা হইতে চাই-এই রকম কিছু।

কী লিখেছিলেন রুমি ভাই? মোনা জিজ্ঞেস করল।

মনে নেই। সত্যি বলছি। মনে হয় ওগুলো সব গত জন্মের কথা।

হাই থট বাদ দে। আমরা এই জন্মের কথা কই। মোনা, তুমি তো বুঝতেছ রুমির অনেক গুণ।

হুঁ, বেগুন। রুমি বলল।

আর মোনা বলল, সত্যিই রুমি ভাইয়ের অনেক গুণ।

সেই জন্যই ওর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। রুমি, ব্যবস্থা দুই রকম হইতে পারে।

রুমি আর মোনা দুইজন ইলিয়াসের দিকে তাকাল।

তুই কিছু করবি না। আসলে তর যা ইচ্ছা তা-ই করবি। তর নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকব। তুই প্রয়োজনমতো ওইখান থেইকা ট্যাকা তুইলা নিবি।

আমার অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবি তুই, আর আমি ওখান থেকে প্রয়োজন মতো টাকা তুলে নেব, এ কথাই তো বলছিস তুই?

নিবি।

কত টাকা রাখবি আমার অ্যাকাউন্টে?

যত নিতে পারবি। ট্যাকা তো উঁচা টাওয়ারে উইঠা চারপাশে উড়াইবি না, যা লাগে তার বেশিই থাকব সব সময়।

আমাকে পালবি তুই, না? তোর টাকা বেশি হয়ে গেছে?

এখন দুই নাম্বারটা কই। ধর, আমার অফিসে তুই একটা চাকরি নিলি। ধর, অফিসে আমারও কিছু বিশ্বস্ত লোক দরকার। ইংরেজিতে চিঠিপত্রও লেখতে হয়…।

এত দিন কি বাংলায় চিঠি লিখে কাজ চালিয়ে আসছিলি?

মাঝেমধ্যেই বিদেশ যাইতে হয় আমার, তুই তখন চোখ-কান খোলা রাখবি। ব্যবসা তো করস না, দুই চোখ আর দুই কান দিয়া সব সময় চলে না।

ইলিয়াস, ওসবের কিছুই আমি বুঝব না।

সময় লাগব একটু, এই যা।

বললাম তো চোখ-কান খোলা রাখার ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই।

রুমি। ইলিয়াসের গলা রাগ-রাগ শোনাল।

খেপে যাচ্ছিস কেন?

সত্যি কইরা ক, তর একটা চাকরি দরকার, না?

এবার আর বিব্রত বোধ করল না রুমি, সে বলল-হ্যাঁ, খুবই দরকার।

তুই এক লোকের বাসায় গেছিলি চাকরির জন্য। সেই লোক ধর তরে চাকরি দিল। তাইলে সেইখানে তরে কিছু না কিছু করতে হইত।

করতে হতো। বসিয়ে বসিয়ে নিশ্চয় বেতন দেবে না।

ওই অফিসে যে কাজ করতি, আমার অফিসেও সেই রকম কাজ করবি। হইল?

তুই দেখি আমার একটা গতি না করে ছাড়বি না!

হ। ঠিক ধরছস।

রুমি হাসল। তাকে সুস্থির ও নির্ভার দেখাল।

ইলিয়াস বলল-তাইলে ফাইনাল হইল। আমার অফিসে চাকরি আর এই বাড়িতে থাকা। এই বাড়িতে কত জায়গা! কোনায় একখান ঘর দিমু তরে। চুপচাপ। তুই অবসর সময়ে কবিতা লিখবি।

আবার কবিতা!

আচ্ছা, যা ইচ্ছা করবি। কেউ তরে ডিস্টার্ব দিব না। শুধু তর যখন ইচ্ছা করব, তুই আইসা আমার সঙ্গে গল্প করবি।…মোনা, আমার ব্যবস্থাটা কেমন?

মোনা হাসিমুখে বলল-খুবই ভালো ব্যবস্থা। আমার পছন্দ হয়েছে।

রুমির প্রতি, আমি বুঝছ, গ্রেটফুল। ও না থাকলে তোমারে পাইতাম কি না সন্দেহ। আর তোমারে পাইছি বইলাই আমি জীবনে এত খুশি।…রুমি, দোস্ত, তরে একখান কথা বইলা দেই। এই বাড়ি তর, আমার অফিস তর, আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তর…।

রুমি মাথা ঝাঁকাল-বুঝলাম। তার মুখে হাসি।

তুই কিছুই বোঝস নাই। তরে পাইয়া আমার কী খুশি যে লাগতেছে।

অ্যাই ব্যাটা, এত দিন একবারও খোঁজ করেছিলি আমার!

এইটা তুই কী কইলি!

খোঁজ করিসনি।

তুই গেছস উধাও হইয়া। কাউরে কিছুই জানাস নাই। আমি কি হ্যারিকেন নিয়া তরে খুঁজতে বাইর হমু! হ্যারিকেনের আলোয় তরে পামু?

মজা করছি তোর সঙ্গে।

মজা তো তুই কইরাই গেলি।

যেমন!

আমরা তোর বন্ধু ছিলাম। ছিলাম না?

ছিলি।

তবু কাউরে কিছু না বইলা দড়াম কইরা উধাও হইয়া গেলি।

তখন মনে হয়েছিল, এই এটাতেই মজা…।

তারপর একবারও আমাদের কারো কুনো খোঁজ নিছস?

রুমি না-সূচক মাথা নাড়ল।

ক্যান নিস নাই?

আমি ছিলাম কোথায় কোথায়…?

তা হইলে ক্যামনে খোঁজ পামু তোর?

তোকে প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি, বুঝতে পারছি।

মাফ কইরা দিলাম।

আমি তাহলে দুই দিন পর এ বাসায় এসে উঠব।

এইটার কী দরকার? আজ রাইতে উঠলে কী অসুবিধা?

ইলিয়াস, আমার নিজের কিছু বোঝাপড়া আছে।

শুনি?

একটুক্ষণ চুপ করে থাকল রুমি, যেন সে ভাবছে, বলল-সত্যি কথা বলি, আমার বিশ্রামের প্রয়োজন, সত্যিই প্রয়োজন। মোনা ভাবি আছেন, তা-ও বলি, আমার মানসিক অবস্থাও এখন খুব একটা সুবিধার নয়।

মানে, তুই কি পাগল হইয়া গেছস?

না। রুমি বলল। এটা একটা মানসিক বিপর্যয়, মনে করতে চাই না, কিন্তু মনে পড়েই যায়।

কিছুই বুঝতেছি না।

আসলে…আসলে কোন জীবন যে আমি চেয়েছিলাম সেটাই আমি এখন বুঝতে পারি না।

এইসব যে কী কস। কোন জীবন চাইছিলি?

বললাম না-বুঝতে পারি না। হয়তো যে জীবন চেয়েছিলাম সেখানে অপূর্ণতা থেকে গেছে কিছু কিংবা আমি হয়তো অসম্ভবকে চেয়েছিলাম।

ইলিয়াস মোনার দিকে তাকাল-আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। মোনা, তুমি তো এইসব ব্যাপার কিছু কিছু বুঝো। এখন বুঝতেছ?

মোনা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে না।

তাইলে থাক, আমারও বুঝন দরকার নেই। রুমি, তুই কী বলতেছিলি…।

বিশ্রাম দরকার আমার, থাকার নির্দিষ্ট জায়গা দরকার, চাকরি দরকার-সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমার এসবে জড়িয়ে পড়ার আদৌ দরকার আছে কি না, সেটাও আমার একটু ভেবে দেখা দরকার।

এইটা তোর বোঝাপড়া?

রুমি মাথা ঝাঁকাল।

ইলিয়াস কতক্ষণ নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকল, তারপর বলল-ঠিক আছে, এই বোঝাপড়া তুই কইরা নে। তারপর আমারে জানা। তখন অন্য ব্যবস্থাও হইতে পারে।

গেট পর্যন্ত রুমিকে এগিয়ে দিল ইলিয়াস। তারপর গাড়িতে উঠল রুমি, গাড়ি তাকে নিয়ে রওনা দিল। গাড়ি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল ইলিয়াস। ঘরে ফিরে সে মোনাকে জিজ্ঞেস করল, আমার এই বন্ধুরে তোমার কেমন লাগল, সত্য কইরা কও তো।

মোনা বলল, ভালো।

শুধু ভালো।

বেশ ভালো। যদিও আজ বেশ অনেক কথা বললেন, তবে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এত কথা বলে অভ্যস্ত না।

সব সময়ই কম কথা বলত। আড্ডায় বইসা আমরা ২০টা কথা বললে রুমি বলত ১টা।

বোঝা গেল তোমার সঙ্গে খুবই ভালো বন্ধুত্ব ছিল।

আরে, আমিই ছিলাম ওর একমাত্র বন্ধু। আমারে কেন যে এত ভালোবাসত, বুঝতাম না। রুমি সবই বুঝত, আর সব কিছু আমারে এমন সুন্দর কইরা বুঝায়া দিত। পরীক্ষার সময়ও আমারে কতভাবে হেলপ করেছে। তারপর ধরো কলেজ থেইকা বাইর হওনের পর দুইজন দুই জায়গায়। কিন্তু বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নাই…।

অন্তত ওই সময় যে নষ্ট হয়নি। মোনা খুব টিপে হাসল। সে তো টের পেলাম একটু আগে।

কিন্তু হঠাৎ কই যে গায়েব হইল…। তারপর ধরো, তখন আমরাই কিসের মধ্যে আছি…।

হুঁ।…উনি তো বললেন শুধু ঘুরে বেড়াতেন, নৌকায়, ট্রেনে, পায়ে হেঁটেও…এক দেশ থেকে আরেক দেশে…।

ঘুরে বেড়ানোর কথা সে অবশ্য খুবই কইত।…মোনা, একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার।

করো।

তুমি কি আমার ওপর রাগ করছ?

মানে?

তুমি আমার ওপর রাগ করো নাই তো?

কেন রাগ করব। রাগের কথা কেন উঠছে?

তোমার সঙ্গে কনসাল্ট না কইরাই ওরে চাকরি দিয়া দিলাম।

আহা, চাকরি দেওয়া একটা ব্যাপার হলো…।

তারপর এই বাসায় থাকতেও কইলাম ওরে।

অসুবিধা কী হয়েছে তাতে! এ বাসায় থাকার জায়গার অভাব?

ব্যাপারটা তুমি নিশ্চয় বুঝতেছ-অর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শ্যাষ নাই।

আমি অবশ্যই সেটা বুঝতে পারছি।

তবু…।

ইলিয়াস?

কিছু বলবা ডার্লিং?

আমার কিন্তু এখন সত্যি সত্যিই রাগ হচ্ছে।

কেন?

তুমি তোমার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর একটু উপকার করতে চাচ্ছ, আর আমি তাতে রাগ করব? তুমি আমাকে এ রকম ভাবলে!

না, হইতেছে কী…।

তুমি রাজ্যের মানুষের উপকার করে বেড়াও না?

সেইটা কিছু করি। তুমিও করো।

হ্যাঁ, আমিও করি। কারণ আমরা দুজনই দেখেছি, মানুষের উপকার করতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটা আর কিছুতে পাওয়া যায় না।

এইটা কথা ঠিক।

অথচ তুমি কি না ভাবছ, তুমি তোমার বন্ধুর উপকার করতে চাচ্ছ বলে আমি রাগ করেছি। আশ্চর্য!

আর ভাবতেছি না। কসম আল্লাহর।

শোনো, উনি খুবই ভালো বন্ধু তোমার। তোমরা দুজন দুজনকে খুবই পছন্দ করো। তোমাদের মধ্যে অমিল আছে অনেক; কিন্তু মিলের সংখ্যাও কম না। এখন ওনার কিছু সহযোগিতা দরকার…।

সেই জন্যই তো…।

সেটা তুমি অবশ্যই করবে। না করলে আমারই খারাপ লাগত। শোনো ইলিয়াস, ওনাকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। উনি যত দিন ইচ্ছা এ বাড়িতে থাকবেন, আমার কোনোই আপত্তি নেই।

থ্যাংকু ডার্লিং, আমি জানতাম তুমি ঠিকই বুঝবা আর এই রকমই বলবা। আবার থ্যাংকু দেই তোমারে।

হয়েছে।

হয় নাই হয় নাই। ইউ আর মাই গুড ওয়াইফ। আমি যে তোমারে কত ভালোবাসি। আবার যতই ভালোবাসি ততই ভালোবাসা বাইড়া যায়।

আর আমি? একটু এগিয়ে এসে মোনা ইলিয়াসের হাত ধরল। কী মনে হয়, আমি তোমাকে ভালোবাসি না?…ইলিয়াস, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

সাজিয়া পড়া শেষ করে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। আমি বুঝলাম সে এ লেখাটা নিয়েই ভাবছে। তাকে আমি সময় দিলাম ভাবার। সাজিয়া ফিরল আমার দিকে-ধরো, এখন আমরা ভাবলাম গল্পটা শেষ, এ রকম ভাবা যাবে না?

লেখকের ইচ্ছা। লেখক ভাবছে এ রকম, অসুবিধা কী?

কিন্তু সেটা কি যৌক্তিক হবে?

না। কারণ আসলে এখন পর্যন্ত কিছু ঘটেনি।

কিছুই ঘটেনি! এত এত ঘটনা! সাজিয়া অবাক হতে গিয়ে সামলে নিল। আচ্ছা, কিছুই ঘটেনি। ঘটেনি মানে পরিণতির মতো কিছু ঘটেনি। কিন্তু মোনা আর ইলিয়াসের সুখের সংসার…।

এখন পর্যন্ত সুখের।

শেষ পর্যন্ত সুখেরই থেকে গেল। সুখের সংসারের নমুনা দিয়ে একটা লেখা শেষ হতে পারে না?

ধরা যাক, পারে। তুমি কি সে রকমই কিছু চাও?

চাই?…আবার ধরো রুমি থাকতে আরম্ভ করল ও বাসায়। সে নিজে কিছু করল না; কিন্তু একটু একটু করে বদলাতে লাগল মোনা আর ইলিয়াসের সংসার।

তার জন্য তোমাকে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।

হ্যাঁ, তা দেখাতে হবে।…সে এমন কোনো কঠিন ব্যাপার না। পাওয়া যাবে।

যেমন? শুনি।

ভাবিনি। ভাবলে পাওয়া যাবে।

আমরা স্বাভাবিক চিন্তাটাই করি। যা ঘটার তা-ই ঘটুক।

এটা কী বলো! যা ঘটার-তা কি আমরা জানি?

ঘটার আসলে অনেক কটি কারণ থাকে-আমরা লেখক হিসাবে একটিকে বেছে নেই।

মানুষের জীবনের মতো?

মানুষের জীবনের মতো।

কিন্তু সব মানুষের বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না।

কিংবা ইচ্ছা।

আচ্ছা, ও কথা থাক। তুমি এখানে কী বেছে নিতে চাও?

তুমি?

বললাম না-সুখের সংসার ওদের।

আমি হেসে ফেললাম-তুমি আসলে তা চাও না।

কে বলেছে?

কেউ বলেনি।

কেউ বলেনি কিন্তু তুমি দিব্যি বুঝে বসে আছ।

সাজিয়া, এই যে তুমি সুখী সংসার চাও ওদের, এটা তোমার ইচ্ছার সঙ্গে গেলেও, তোমার ম্যাচুরিটির সঙ্গে যায় না।

তাহলে আমি ছেড়েই দেই ওদের?

দাও। আমরা ধরে রাখার কে!

না, আমরা ধরে রাখার কেউ না।

হুমম।

গুড্ডু?

বলো।

একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে।

বলো।

একটা পরামর্শ।

আমি পরামর্শ দেব!

হুঁ, দেবে।

আচ্ছা, শুনি।

সাজিয়া অপলক তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।

কী দেখো?

তোমাকে।

পরামর্শ?

ভাবছি?

কী পরামর্শ চাইবে তা ভাবছ?

না, আদৌ সেটা চাইব কি না। কিংবা চাইলেও এখন চাইব কি না।

বেশ।

গুড্ডু।

শুনছি।

আমি বরং অন্য একটা কথা বলি তোমাকে।

বলো।

শুনবে তো?

শুনব।

আমি টের পাই আমি তোমাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি।

“মোনার মুখে ছড়িয়ে পড়া হাসি। সে জিজ্ঞেস করল-তাই! সত্যি?

সত্যি না মানে! ছোটবেলা থেকেই আমি হালকা-পাতলা, সবাই তাই আমার সঙ্গে একটু বাহাদুরি করতে আর জোর ফলাতে চাইত। আর ইলিয়াস রাখত আমাকে পাহারা দিয়ে। একবার আমাদেরই এক বন্ধু শামীম ঝগড়ার সময় আমাকে মেরেছিল খুব, পরে ইলিয়াস শামীমকে পাকড়াও করে কী মারটাই না দিল।

সপ্তাহখানেক হলো এ বাসায় এসে উঠেছে রুমি। অফিসে অবশ্য সে এখনো যেতে আরম্ভ করেনি। ইলিয়াস বলেছে, অফিসে একটা ঝামেলা যাচ্ছে, ঝামেলাটা কাটুক। তারপর সে রুমিকে নিয়ে যাবে। রুমি আসার পর থেকেই হঠাৎ করে ব্যস্ততা বেড়েছে ইলিয়াসের। তার অবশ্য বক্তব্য, ব্যবসা এ রকমই, কখনো কখনো খাওয়া আর ঘুমের সময়ও বদলে ফেলতে হয়। শুনে হাসল রুমি-আমার কাজটাও কি ওরকম হবে? পারব না তো।

তোরে অফিসে এমন একখান রুম দিমু তুই সারাক্ষণ ঘুমাইয়া থাকবি।…মোনা?

মোনা ছিল পাশেই, সে চোখ তুলে তাকাল-হুঁ।

ফয়সালে একটা চাল চালছে, বুঝছ? ওর হাত আমি ভাইঙা দিমু।

ইলিয়াস, মাথা ঠাণ্ডা।

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেইমানি করব আর ইলিয়াসে রাখব মাথা ঠাণ্ডা!

ঠিক আছে, মাথা ঠাণ্ডা রাখার দরকার নেই, তবে সাবধান।

থ্যাংকু ডার্লিং, কিন্তু তুমি জানো আমি কত সাবধান।…শুনো, পরশু-তরশু মালয়েশিয়া যাইতে হইতে পারে। এইবার তোমারে নিমু না। তোমার জইন্য কী আনব, এইটা কও।

কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসো, তাহলেই হবে। রুমি ভাই একা থাকবেন?

তুমি আছো না?

আছি। কিন্তু তোমার মতো গল্প আমি কি রুমি ভাইয়ের সঙ্গে করত পারব?

একটা কথা ইলিয়াস, রুমি বলল। তুই ফিরে এসে কিন্তু আমাকে নাও পেতে পারিস।

রুমির মুখে হাসি আর গলায় ইয়ার্কির সুর।

ইলিয়াস ইয়ার্কিটা নিল না, সে বলল, কী কইলি আবার ক।

ধর ফিরে এসে আমাকে পেলি না।

আচ্ছা, তা ফিইরা আইসা ক্যান তরে নাও পাইতে পারি?

ধর, আবার বেরিয়ে পড়লাম। ভালো লাগল না। তুই তো জানিসই আমার স্বভাব। মন টিকল না, আবার হাঁটা ধরলাম।

মোনা, মান্নানরে শিকল কিইনা আনতে পাঠাও। যদি মালয়েশিয়া যাই, তবে অরে আমি শিকল দিয়ে বাইন্ধা তারপর যামু।

রুমি হো হো করে হাসতে আরম্ভ করল।

ইলিয়াস সত্যিই মালয়েশিয়া গেল আর রুমি পড়ল এক অস্বস্তিতে, ইলিয়াস নেই, অথচ এত এত খাতির-যত্ন। এটা এক অস্বস্তি, আরেক অস্বস্তি, কথা বলার কেউ নেই। একা থাকা কিংবা কথা একেবারেই না বলার অভ্যাস তার আছে। কিন্তু এই পরিবেশে তার মনে হচ্ছে ইলিয়াস তাকে এক নির্জন অথচ জাগতিক ও বৈষয়িক চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ আছে, এমন এক প্রাসাদে আটকে রেখে গেছে। নির্জনতা হয়তো মেনে নেওয়া যেত, তবে আরেকটা সমস্যা প্রাসাদের কোনো দরজা-জানালা নেই।

তাকে বাঁচাল মোনা। এর মধ্যে কথা হয়েছে, একসঙ্গে রাতের খাবার সেরেছে তারা, সবই ঠিক আছে। তবে গল্প বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। দুই দিন পর এক বিকেলে, রুমি তার ঘরে বিছানায় শুয়ে টেলিভিশনের রিমোট টিপছে, লোক পাঠিয়ে মোনা তাকে ডেকে নিয়ে গেল। বাড়ির পেছন দিকে যে ছড়ানো বারান্দা, সেখানে গোছানো বসার ব্যবস্থা।

মোনা বসে আছে সেখানে, তাকে দেখে হাসল-রুমি ভাই বসেন, গল্প করি। কফি দিতে বলেছি। কফি খেতে খেতে গল্প।

গল্প করতে করতে রুমি খেয়াল করল মোনা ভাবি মাঝে মাঝেই তার দিকে অন্যভাবে তাকাচ্ছে। এর কী কারণ, বুঝতে না পেরে রুমি আরেক অস্বস্তিতে পড়ল। অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে ছোটবেলার গল্প তুলল। আর মোনা ছোটবেলার গল্পের একপর্যায়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ইলিয়াস আপনাকে সত্যিই খুব ভালোবাসত, না?

বললাম না ওই যে শামীমের কথা। এ রকম আরো অনেক আছে। ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসত।

মোনা আবার এমনভাবে তাকাল, অস্বস্তি বেড়ে গেল রুমির। অস্বস্তি দূর করার জন্য সে বলল-ভাবি, আপনি কিছু বলবেন?

হুঁ।

হাসল রুমি-হ্যাঁ, বলেন।

মোনাও একটু হাসল, সে হাসি মিলিয়ে গেল দ্রুত, সে জিজ্ঞেস করল-আর আপনি, আপনি ভালোবাসতেন না ইলিয়াসকে?

এটা কি আর নতুন করে বলার দরকার। মুখ খোলার একটা সুযোগ পেয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে রুমি বাঁচল। শুনেছেনই তো, আমার বন্ধু বলতে কেউ তেমন ছিলই না। ছিল একমাত্র ইলিয়াস। ওর জন্য আমার ছিল আলাদা টান। সম্ভবত সেটা ওর প্রাণখোলা স্বভাবের জন্য। যা কাউকে বলতে পারতাম না, ওকে বলে ফেলতাম। আবার ওর কোনো অনুরোধ বা আবদারও আমি ফেলতে পারতাম না।

মোনা এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল, যেন ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝল সে। সামান্য হাসলও সে, সে হাসি অবশ্য মিলিয়ে গেল তখনই, সে রুমির দিকে তাকাল এবং চোখ সরাল না। আবার অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করল রুমি। সে ঘরের এদিক-ওদিক তাকায়, খামাখাই একটু হাসল, মেঝের দিকে চোখ রাখল কিছুক্ষণ, তারপর সে যখন মুখ খুলল তার কণ্ঠস্বরে দ্বিধা, সে জিজ্ঞেস করল-ভাবি, আপনি কি কিছু বলবেন?

মোনা বলল-বলব।

জি…।

তখনই বলল না মোনা, সে একটু সময় নিল, সে বলল, ওর কথা ফেলতে পারতেন না বলেই কি আপনি ওকে চিঠি লিখে দিতেন?

জি?

আপনি তো শুনেছেন আমি কী বলেছি। শোনেননি?

জি।

বলুন তাহলে ওর কথা ফেলতে পারতেন না বলেই কি ওকে চিঠি লিখে দিতেন?

রুমি চুপ করে থাকল। কফি দিয়ে গেছে টেবিলের ওপর। রুমি সেদিকে তাকিয়ে থাকল, যেন কফি খাওয়া ছাড়া সে আর কিছুই ভাবছে না।

মোনা একটু ঝুঁকে পড়ে নিজের কফিটা বানিয়ে নিল, বলল-আপনারটা আপনি বানিয়ে নেন। আপনার মতো করে।

রুমি কফি বানানোর জন্য ঝুঁকল। তার আগে আড়চোখে সে মোনার দিকে একবার তাকিয়ে নিল।

কফিতে ছোট করে চুমুক দিয়ে মোনা বলল, রুমি ভাই…।

কী ভাবি…।

আপনার সঙ্গে আমার আগে আলাপ হয়নি। হয়েছে?

জি না, ভাবি, হয়নি।

সে জন্যই আমার সম্পর্কে আপনার তেমন ধারণা নেই। আমি প্রশ্ন করি উত্তর পাওয়ার জন্য।

জি, বুঝতে পারছি।

ওকে চিঠি লিখে দিতেন, তাই না?

রুমি হঠাৎই হাসতে আরম্ভ করল-বারে, দেব না? বন্ধু না ও।

রুমির হাসি মোনাকে স্পর্শ করল না। আমার আগেও আরো অনেকের জন্য দিয়েছেন?

না না,…হ্যাঁ, দিয়েছি…মানে ভাবি অল্প বয়সে ওরকম।

সে আমি জানি অল্প বয়সে কী হয়, কী হতে পারে। অল্প বয়সে আমারও হয়তো কোনো বা অনেক ছেলেকে পছন্দ হয়েছে।…তা ছাড়া ইলিয়াস লুকোয় না।…ও তো সেদিন বললই আমার আগে কত মেয়েকে চিঠি দিয়েছে।

জি ভাবি, ছোটবেলায় এইসব কত কী হয়।…এমনিতেই ইলিয়াস কত সরল আর আন্তরিক।

সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। মোনা বলল। বলে সে রুমির দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। ইলিয়াস শুধু একটা কথা আমার কাছে স্বীকার করেনি।…হয়তো লজ্জায়।…হয়তো বলার অবশ্য দরকার নেই, লজ্জায়ই।

কোন কথা ভাবি?

নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। আমাকে দেওয়া ওর চিঠিগুলো ওর লেখা নয়, এ কথাটা ও আগে কখনো বলেনি।

আপনি ঠিকই বলেছেন। রুমি বলল। লজ্জার জন্যই বলেনি। তবে ও আপনাকে…।

তখন কত ভালোবাসত কিংবা ভালোবাসার ব্যাপারটা কতটা বুঝত, সেটা জানি না। তবে এখন ও কতটা ভালোবাসে, সেটা জানি।…রুমি ভাই…।

মোনা এমনভাবে ‘রুমি ভাই’ বলল, রুমি কিছুটা চমকেই গেল। তার পরই স্থির হয়ে সে মোনার দিকে তাকিয়ে থাকল।

প্রথমে বুঝিনি। কিন্তু বিয়ের পর একসময় ঠিকই বুঝেছিলাম চিঠিগুলো ওর লেখা না।

বুঝেছিলেন!…আপনি জানেন।

এটা জানার জন্য বেশি বুদ্ধি লাগে না।

রুমি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমি অবশ্য ওর কাছে কখনো জানতে চাইনি চিঠিগুলো কার লেখা।

রুমি মুখ তুলে তাকাল।

কারণ আমি সব সময়ই ভাবতে চেয়েছি চিঠিগুলো ওর লেখা।

রুমি হাসার চেষ্টা করল-আসলে তো ওরই…।

তাই?

ওই তো দিয়েছে…যে দিয়েছে, তার…।

রুমি ভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করব। একদম সত্যি উত্তর দেবেন?

জি ভাবি, নিশ্চয়, অবশ্যই।

সত্যি করে বলেন-যত চিঠি আপনি লিখে দিয়েছেন ওকে, সবগুলোই কি জেনেশুনে দিয়েছেন?

ভাবি, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

লিখে দেওয়ার সময় আপনি কি জানতেন কোন মেয়েকে ও চিঠিটা দেবে?

রুমি দুপাশে মাথা নাড়ল।

ওর হয়ে আমাকে যখন লিখেছেন তখন কি জানতেন চিঠিগুলো আমার জন্য লিখছেন?

রুমি আবারও দুপাশে মাথা নাড়ল। সে জানত না।

তবে কিভাবে লিখতেন-মেয়েটাকে না চিনে, না বুঝে?

লিখতাম। রুমি মৃদু গলায় বলল।

কিভাবে?…এটা আপনাকে বলতে হবে রুমি ভাই। কারণ আপনাকে আগেই বলেছি আমি প্রশ্ন করি উত্তর পাওয়ার জন্য।

যেন উত্তরটা হাতের তালুতে আছে, এভাবে কতক্ষণ হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকল রুমি। তারপর বড় করে শ্বাস ফেলল। বলল, আমি ভেবে নিতাম চিঠিগুলো আমিই লিখছি।…আমার পছন্দের মেয়েকে।

মৃদু হাসি একটু একটু করে মোনার মুখে ছড়িয়ে পড়ল-আমিও এ রকমই ভেবেছিলাম।…পাহাড় খুব পছন্দ আপনার, না?

খুব।

নদী?

লোকালয়ের বাইরের কোনো নির্জন নদীতে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় নৌকায় বসে থাকা যায়।

আর একবার লিখেছিলেন দ্বীপের মধ্যে বাড়ি বানাবে…।

আপনার এত কিছু মনে আছে?

সমুদ্রের মাঝখানে কোনো এক দ্বীপ…।

হ্যাঁ, যদি জনবসতিহীন কোনো দ্বীপ হয়…শুধু আমিই থাকব, আর আমি যাকে পছন্দ করি, সে। আমরা দুজনে…।

থাক, আর বলতে হবে না।

বলব না।

না।

ঠিক আছে। আমি অবশ্য চিঠির কথা না, নিজের কথা…।

নিজের কথা বলছেন, তাই না? মোনা জিজ্ঞেস করল। বলল-বলতে হবে না।

হ্যাঁ, বলব না।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মোনা বলল, আমিই বরং বলি আরেকটু। আপনার চিঠিতে সব সময় দূরের একটা ব্যাপার থাকত, মাঝে মাঝে হু হু করে উঠত চারদিক…সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করত…।

রুমি হাসল-আমি বেরিয়েছিলাম…পথে পথে, এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায়।…ভাবি, ওই জীবন বোধ হয় হয় না।

মোনা মৃদু গলায় বলল, ওই জীবন হয় না, কিন্তু ইচ্ছাটা হয়। কিছুটা সময় সে নিশ্চুপ থাকল, তারপর গলা কিছুটা তুলল-রুমি সাহেব…।

রুমি চোখ কুঁচকে তাকাল-হঠাৎ রুমি সাহেব! হাসল সে, ভাইকে সাহেব বানিয়ে ফেললেন!

রুমি সাহেব! একটু যেন হাঁফ ধরেছে মোনার। রুমি সাহেব, আপনাকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

আমাকে! রুমি এমনভাবে তাকাল যেন সে ভুল শুনেছে।

জি, আপনাকে

কেন?

আজই চলে যেতে পারেন। কিংবা আগামীকালের মধ্যে অবশ্যই।

রুমি উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকল।

আমি যদি না জানতাম চিঠিগুলো আপনার লেখা, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। আমি জানি চিঠিগুলো আজ কারো লেখা, কিন্তু কার লেখা সেটা জানি না, তাহলেও কোনো সমস্যা ছিল না।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

সেটা আপনার না বুঝলেও চলবে। চলে যেতে হবে, এটুকু বুঝলেই হবে।

ভাবি…। ভাবি বলে রুমি চুপ করে গেল।

এই যে দেখুন। মোনা তার পাশে রাখা বড় একটা খাম তুলে নিল। সেটার মুখ খুলে ছোট আকারের অনেক খাম বের করল। একটু হাসল সে।…এই যে আপনার লেখা চিঠিগুলো…ইলিয়াসের লেখা নয় জেনেও চিঠিগুলো আমি রেখে দিয়েছি, কেন জানেন?

না। কেন?

মাঝে মাঝে এই চিঠিগুলো আমি পড়ি।…কেন, জানেন?

না। কেন?

কেন-এটা আপনার না জানলেও চলবে। কথা হচ্ছে, আপনি আগামীকালের মধ্যে চলে যাচ্ছেন।

ইলিয়াস এসে কী বলবে?

সেটা আমার ব্যাপার।

কী বলবেন ওকে?

যুক্তিসংগত কিছু। হয়তো বলব-আবার আপনাকে সুদূর টান দিল। ভালো লাগছে না ভালো লাগছে না, এ জীবন আমার না-বলতে বলতে অস্থির ভঙ্গিতে আপনি বেরিয়ে গেলেন। আমি কোনোভাবেই আপনাকে আটকাতে পারলাম না।

রুমি সামান্য হাসল।

কিংবা বলব, আপনি কখন বেরিয়ে গেছেন আমি জানিই না।

ইলিয়াস বিশ্বাস করবে?

অবশ্যই করবে। আপনি তো সেই ছোটবেলা থেকে এ রকম, তাই না?

ভাবি। রুমির গলা কাতর শোনাল। আমি আসলেই ক্লান্ত।

দূরের গল্প

এমনকি হতে পারে না, কেউ আপনার চেয়েও বেশি ক্লান্ত।…বাদ দিন, ওসব কথা। আপনার যদি এর পরও থেকে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে, বলে রাখি-আমি গুরুতর অভিযোগ আনব আপনার বিরুদ্ধে। মেয়েরা পুরুষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনতে পারে। ইলিয়াস কিন্তু, যতই চিনুক আর বুঝুক আপনাকে, শেষ পর্যন্ত আমাকেই বিশ্বাস করবে। ও জানে আমি মিথ্যা বলি না, আর ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে…আমি।

রুমি স্থির বসে থাকল। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো সে হাঁপাচ্ছে।

আপনি অন্য জায়গা খুঁজে নিন। মোনা বলল। টাকা যদি লাগে, মোটা টাকাই আপনাকে দেব। অ্যামাউন্টটা শুধু জানাবেন। মোনা চিঠিগুলো গোছাতে শুরু করল। আচ্ছা, এই চিঠিগুলো কি নিয়ে যাবেন?…না থাক, আপনাকে নিতে হব না। আমিই পুড়িয়ে ফেলব।

এর পর কী ঘটবে, তার মধ্যে কিছু অনুমান বা আন্দাজের ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। যেমন-রুমি কি সত্যিই মোনার কথা শুনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে? নাকি সে মোনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে, ইলিয়াস না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? আমরা জানি সে কী পরিমাণ ক্লান্ত, থিতু হয়ে বসার এই অসাধারণ ব্যবস্থা সে কি সহজেই ছেড়ে দেবে?

আসলে সে যে কী করবে, এটা বলা মুশকিল। পাঠকের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ থাকলে, সে তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারত কী এখন তার করা উচিত। সমস্যা, কোনো পাঠকের সঙ্গেই তার কোনো যোগাযোগ নেই। কিছুটা সম্পর্ক তার এই লেখকের সঙ্গে আছে। তবে লেখকের প্রতি তার অভিমানও নিশ্চয় প্রবল। কারণ, যা সে চাচ্ছিল, তা পেয়ে, লেখকের কারণেই আবার হারাতে বসল। এমন একজন লেখকের প্রতি ভালোবাসা না থাকার কথা। বরং আমাকে কাছে পেলে, সে রাগী-রাগী গলায় এই প্রশ্ন করে বসতে পারে-এর মানেটা কী!

এর মানে কী, তা এই লেখকও জানে না। লেখক মানেই সবজান্তা-এমন ভাবনাটাও হাস্যকর। আমরা, লেখক-পাঠক মিলে প্রথমে একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি। প্রথমত, আমরা আলাপ-আলোচনা করে দেখতে পারি মোনার বক্তব্যের পর রুমি কী করবে। দ্বিতীয়ত, হয়তো একদমই উচিত হবে না, তবু আমরা ওই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই ভেবে দেখতে পারি, এই গল্পের পরিসমাপ্তি অন্য রকম হতে পারে কি না।

এক. আসুন, আমরা সবাই মিলে ধরে নিই রুমি আবার বেরিয়ে পড়বে। শরীর ক্লান্ত তার, কিন্তু কী-ইবা আর সে করবে। আবার সে পথে নামবে, পথে-পথে ঘাটে-ঘাটে এভাবে তার চলবে। তারপর কী হবে, আরো পরে, অত দূর পর্যন্ত ভাবার কোনো দরকার নেই।

দুই. ইলিয়াসের বাড়ি থেকে পথে নামবে বটে রুমি, তবে পথেই সে থাকবে না। সে আবার গিয়ে জামান ভাইকে ধরবে। উপার্জনের একটা রাস্তা জামান ভাইকে ধরে বের করেই নেবে। মেসে থাকার ব্যবস্থা তার আছেই, উপার্জন কম হলে তিনবেলা জামানের ওখানে খাওয়া। আর আসক্তি তেমন না হলেও ফ্রি মদের ব্যবস্থাও থাকছে। কে জানে, এ রকম একটা জীবনেও জড়িয়ে যেতে পারে রুমি।

তিন. ইলিয়াসের অফিসে গিয়ে রুমি তাকে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ রকম একটা কথা বলতে পারে যে, অত বড় বাড়িতে, অত প্রাচুর্যের মধ্যে থাকা তার জন্য অসম্ভব একটা ব্যাপার। ইলিয়াস যেন এই এখনই ছোট এক রুমের একটা বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তবে ভাবি আবার রেগে যেতে পারেন বলে এই এখনই ভাবিকে কিছু বলার দরকার নেই। তা ছাড়া সে ভাবিকে কিছু না বলেই ব্যাগ গুছিয়ে চুপ করে বের হয়ে এসেছে।

চার. রুমি হঠাৎ শক্ত ও রূঢ় আচরণ করতে পারে মোনার সঙ্গে। সে বলতে পারে-কেন আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন, তা কি আমি বুঝি না ভেবেছেন? না, যাব না আমি, ইলিয়াস আসুক, আপনার ইচ্ছা হলে অপবাদ দিন, তারপর যা হওয়ার হবে। আর চিঠিগুলো যে পুড়িয়ে ফেলার কথা বলছেন-ফেলুন না। আমি তো জানি, পুড়িয়ে ফেলার পরও চিঠির কথাগুলো যেখানে থাকার থেকে যাবে। থেকে যাবে বলেই আপনি আমাকে বের করে দিতে চাইছেন। ভাবছেন, তাহলে কিছু স্বস্তি আপনি বোধ করবেন, অদৃশ্য এক টান আপনি অনেক কম অনুভব করবেন। কিন্তু যাব না আমি, আসুক ইলিয়াস, যা হওয়ার তারপর হবে।

রুমি আর কী কী করতে পারে, লেখক তা আর ভাবতে চায় না। পাঠক যদি ভাবতে চায়, ভাববে; তার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না।

এখন দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। গল্পটা কি অন্যভাবে শেষ হতে পারত?

কে বলে পারত না? একই ঘটনা একেক মানুষের জীবনে একেকভাবে ঘটে না। সুতরাং গল্পের সমাপ্তি-তারপর রুমি মৃদুপায়ে ইলিয়াসের বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ল। এ রকম না হয়ে আরো নানা রকম হতে পারে।

এক. আমরা অধিকাংশ পাঠককে অখুশি করতে পারি না। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, পকেটশূন্য এবং কোনো দোষ না করা রুমি একটা আশ্রয় পেয়েছে। থিতু হয়ে বসার যে প্রবল বাসনা তার ভেতর তীব্র হয়ে উঠেছিল, সেই বাসনা তার পূর্ণ হয়েছে। এখন হঠাৎ করে আবার সব এলোমেলো হয়ে যাবে, মোনা এসে তাকে চলে যেতে বলবে বলে? উঁহু রুমির প্রতি এতটা নিষ্ঠুর না হলেও চলে। পাঠক যেমন সুখ ও তৃপ্তির কাহিনী পড়তে ভালোবাসে, লেখকও কি সে রকম লিখতে ভালোবাসে না? এই লেখকের কিন্তু সত্যিই ও রকম ইচ্ছা হচ্ছে। বেশ একটা ইচ্ছা পূরণ কাহিনী হোক, মিল মহব্বতের সঙ্গে সবাই বসবাস করুক। তাই যেখানে শেষ করা হয়েছিল এ কাহিনী, আমরা ধরে নিই কাহিনী ওখানেই শেষ হয়ে গেছে, সবাই হাসিমুখে পরমানন্দে জীবনযাপন করছে।

আমি জানতে চাইলাম-সবাই পরমানন্দে জীবন পার করছে?

সাজিয়া মাথা বাঁকিয়ে হাসল-হুঁ।

আহা, জীবন যদি তেমনই হতো।

ভাবতে দোষ কী! অন্তত এই কাহিনীতে যারা আছে, তারা।

না, ভাবতে দোষ নেই। এখন শোনো বুন্দিয়া…।

বলো লাড্ডু।

কাহিনীর বাকিটুকুও তোমারই শেষ করা উচিত ছিল।

না, আমি শুধু প্রথমটা লিখেছি, অর্থাৎ কী হতে পারত। এখন আর কী হতে পারত, অর্থাৎ দুই নাম্বার অংশটুকু তোমাকে লিখতে হবে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম-জীবনের সব দুই নাম্বারই কি আমাকে লিখতে হবে?

সাজিয়া আবারও মাথা ঝাঁকাল-হ্যাঁ। কারণ দুই নাম্বার ব্যাপার তোমার মাথায় ভালো খেলে।

মেনে নিলাম।…তুমি কিন্তু একটা না, বেশ কয়েকটা অপশনের কথা উল্লেখ করেছ। যেমন-মোনার ওই কথার পর রুমি কী কী করতে পারে…।

আবার শেষে এসে অন্যটাও বলেছি।

সেটা একটু বেশি গতানুগতিক হয়ে যাচ্ছে।

জীবনে কি গতানুগতিক কাহিনী নেই?

আছে। কিন্তু সেটা আমরা লিখি না। পাঠক পড়বে কেন!

তাহলে নতুন একটা শেষ তৈরি করে দাও তুমি।

আর ইচ্ছা করছে না। আমরা ধরে নিই, এই এখানেই শেষ।

না গুড্ডু, শেষ আসলে না, আমিও জানি তুমিও জানো। আমি অনেকটাই লিখে ফেলেছি, আরো একটু লিখে শেষও নিশ্চয় করতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হলো শেষ তোমার করা উচিত।

আমি সাজিয়ার দিকে তাকালাম। আমি এতক্ষণ সাজিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, তবু আমার মনে হলো আমি সাজিয়ার দিকে তাকালাম। আমাকে ওভাবে তাকাতে দেখে সাজিয়া অবাক হলো-কী হলো, আমার কথা পছন্দ হলো না?

আমি শেষ করব? কেন? আমি শেষ করতে পারি?

পারো না! তুমি যে লেখক।…আর আর…। সাজিয়া কথা শেষ করল না।

আর কী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তুমি জানো জীবন কত রকম হতে পারে।

তুমি জানো না?

জানি।…তোমার মতো না।

জীবন অনেক রকম।

এটা জানি। কিন্তু ধরতে পারি না। জীবন আসলে এত এত রকম, আর এমন আশ্চর্য ব্যাপার সেগুলো, খুব অবাক হয়ে যাই। গুড্ডু, সত্যিই খুব অবাক হয়ে যাই।

ভালো, তোমাকে অন্য রকম লাগছে।

কেমন অন্য রকম? আলো কমে বা বেড়ে গেছে?

তুমি যখন বললে জীবন এত এত রকম হতে পারে, কত আশ্চর্য রকম হতে পারে, মনে হলো-কথাগুলো আমার সাজিয়া না, অন্য কেউ বলল।

সাজিয়া একটু যেন থমকে গেল, খুব সামান্য, সামান্য সময় পরমুহূর্তে তাকে স্বাভাবিক দেখাল, আমি খেয়াল করলাম, সে আসলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে-কী যে সব বলো না তুমি।

আমি হাসলাম। হাসিটা আমার মুখে বেশ কিছুক্ষণ থেকে গেল।

হাসছ কেন পাগল। আজই শুরু করে দাও। তারপর আমরা আলোচনা করি-কেমন হলো। তখন না হয় জীবনের কথাও কিছু আলোচনা করব।

আমি আবারও হাসলাম-তাই? তাহলে এখনই শেষ করতে হয়।

এখন!

এখন। যদিও কেউ আশপাশে থাকলে লিখতে অস্বস্তি হয়।

বুঝি সেটা। কিন্তু তুমি যখন লেখো, আমি পাশে থাকলে আমার ভালো লাগে। আমি দুই দিন ছিলাম। তোমাকে আমার ধ্যানমগ্ন ঋষি মনে হয়েছিল।

তা-ই!…ঋষি হে, বুন্দিয়া তোমাকে ঋষি বলেছে। এবার তবে তুমি লেখো।”

“দুই। আবার এমনও হতে পারে, রুমি যখন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসবে ঘর থেকে কয়েক পা এগিয়েও যাবে, কোনো এক অদৃশ্য জায়গা থেকে ছুটে আসবে মোনা-রুমি ভাই…।

কিছু বলবেন, ভাবি?

আপনি সত্যিই চলে যাচ্ছেন!

আপনিই বললেন, ভাবি। রুমির মুখে সামান্য হাসি।

কিছু বলতে গিয়ে মোনা থেমে যাবে। একবার রুমির দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে থাকবে সে। আর, একটু অপেক্ষা করে রুমি আবার পা বাড়াবে।

রুমি ভাই…।

জি ভাবি…।

কেন, রুমি ভাই কেন। মোনা হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়বে।

কী কেন, ভাবি?

কিছু না।

আপনি কাঁদছেন কেন!

এমনি।

এমনি কেউ কাঁদে।

আপনি কেন, কেন ওই চিঠিগুলো লিখেছিলেন।

কিছু না বলে রুমি চুপ করে থাকবে আর আমাদের গল্পও শেষ হয়ে যাবে। এ রকম একটা ইঙ্গিত অবশ্য আমরা আগেও দিয়েছি। যখন আমরা বলেছি, রুমি কী কী করতে পারে-তখন। তখন এক অংশে রুমি বলেছিল-কেন আপনি আমাকে চলে যেতে বলছেন, তা আমি বুঝি। আমরা যদি রুমির এই কথাটা মনে রাখি, তবে গল্পের বর্তমান সমাপ্তি মন্দ হয় না।

তবে আরো একটি সমাপ্তির কথা আমরা ভাবতে পারি।

তিন। মোনার কথা শোনার পর রুমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে। তাকে কখনো চিন্তিত কখনো অন্যমনস্ক দেখাবে। শেষে সে মোনার কথা মেনে নেবে। বেশ, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সে। তবে কিছুটা সময় সে নেবে। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থেকে বের হবে। সন্ধ্যার দিকে বের হওয়ার মধ্যে আলাদা কোনো ব্যাপার নেই। এটা লেখকের একটা চালাকি। বিকেলের পরপরই যে সন্ধ্যা নামে, সে সময়ের আলো না পরিষ্কার, না পুরো অন্ধকার। লেখক এই আলোকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে একটা ব্যঞ্জনা তৈরি করতে চাইবে। সে দেখাবে-রুমি ধীরে ধীরে আবছায়ায় বিলীন হয়ে যাবে।

আচ্ছা, আরো একটা সমাপ্তির কথা ভাবি।

চার। আমরা এখানে দেখাতে পারি, মোনা রুমিকে কিছুই বলল না। অর্থাৎ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা, প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রত্যক্ষ লোভ, মিথ্যা অপবাদের ভয়-এসবের আশপাশ দিয়েও গেল না সে। এমন না হলে কোনো সমস্যাই থাকছে না। সুখময় পরিসমাপ্তিই ঘটছে, যেমনটা আমরা প্রথমেই বলেছি। ইলিয়াস থাকবে ব্যস্ত, কয়েক দিন পর রুমিও কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, মোনা থাকবে মোনার মতো। এই তো। প্রায় আগের মতো। তবে আমরা এই অবস্থাকে একটু জটিল করে তুলতে পারি যদি আমরা ইলিয়াস ও মোনার ভেতর রুমিকে একটু স্পষ্ট করে তুলি। না, কোনো ত্রিভুজ প্রেমের ব্যাপার থাকবে না সেখানে। ত্রিভুজ প্রেম নিয়ে এত গল্প-উপন্যাস পড়েছে পাঠক, এত সিনেমা দেখেছে দর্শক, আরো একটা ত্রিভুজ প্রেম কাহিনীর কোনোই দরকার নেই। আমরা, মোনা আর রুমির সম্পর্ক যে অন্তরঙ্গ হয়েছে, এমনও দেখাব না, তাদের মধ্যে কথাবার্তাও হবে কদাচিৎ। রুমি গোটানোই থাকবে এ রকম, ঘরের ভেতর, একা একা। ইলিয়াস দিন কয়েক তাকে নিয়ে হইচই করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ‘তুই ব্যস তোর মতো থাক’ বলে তাকে নিস্তার দেবে। তবে তার আর মোনার জীবন আগের মতোই চলতে থাকবে। হইচই, চারদিক মাতিয়ে রাখা, রাতে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া-সবই চলবে আগের মতো।

যদি তা-ই হয়, তবে যে সমস্যাটা আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি, তা তৈরি হবে কিভাবে?… আমরা এভাবে একটা চেষ্টা করে দেখতে পারি-

রেস্তোরাঁয় খেতে গেছে মোনা আর ইলিয়াস, নানা কথার ফাঁকে মোনা হঠাৎ এক সময় বলবে-জানো, একটা ব্যাপার ভাবলে মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে।

ইলিয়াস বলবে-কী ব্যাপার, কইয়া ফ্যালাও ডার্লিং।

ওই যে ওই চিঠিগুলো, যে রুমি ভাইয়ের লেখা, বিশ্বাসই হতে চায় না।

লেখা কিন্তু ওরই। বিশ্বাস হইব না ক্যান!

না, ঠিক তা না।…কী অসাধারণ চিঠি সব…।

খুঁইজা পাইতা ঠিক লোকই বাইর করছিলাম, এমন চিঠি লেখায়া নিছিলাম, তুমি ডার্লিং আমার প্রেমে না পইড়া পারো নাই।

হুঁ, অমন চিঠি পড়লে প্রেমে না পড়ে কি পারা যায়!

কিংবা আরেক দিন, দুজন বাগানের ভেতর হাঁটছে আর ফুলের গাছগুলো দেখছে, কিছু পরিচর্যা করছে, তাদের কথাবার্তা হবে এ রকম-

মোনা বলবে-রুমি ভাইকে দেখলে মাঝে মাঝে আমার খুব অবাক লাগে।

ইলিয়াস অবাক গলায় জানতে চাইবে-সে আবার কী করল!

এখনো কিছু করেনি।

তাহলে?

একদম শেকড়সহ কাঁপিয়ে দেওয়া এমন সব চিঠি তিনি লিখতে পারেন ভাবাই যায় না।

হা হা। ইলিয়াস সাহেব। তোমারে তো শেকড় থেইকাই টাইনা আনছিলাম।

এ রকম কথোপকথন হলো বেশ কয়েক দিন মোনা আর ইলিয়াসের মধ্যে। কথা বেশি বাড়ানো যাবে না, গল্পও তো শেষ করতে হবে।

তাই, আর মাত্র একটা দিনের কথা বলব আমরা। এক ছুটির সকালে এক বন্ধুর খামারবাড়িতে যাচ্ছে ইলিয়াস আর মোনা। রুমিকে সঙ্গে নেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল ইলিয়াস। রাজি করাতে পারেনি। বন্ধুর খামারবাড়ির দিকে যেতে যেতে তাদের কথোপকথন হবে এ রকম-

মোনা বলবে, কথা প্রসঙ্গে-রুমি ভাইয়ের মধ্যে সুদূরের একটা ব্যাপার আছে।

ইলিয়াস মোনার দিকে তাকাবে, কিছু বলবে না।

ভুল বললাম। আসলে রুমি ভাইয়ের মধ্যে না। ওই চিঠিগুলোর মধ্যে।

ইলিয়াস হাসবে।

অথচ লোকটা এমন গোটানো! যে লোক চিঠিতে অমন টান দিতে পারে, দূরের, কখনো না দেখা চিত্র চোখের সামনে ভাসিয়ে দিতে পারে, সেই লোক অমন গোটানো হবে কেন।

ইলিয়াস মাথা ঝাঁকাবে।

অবশ্য গোটানো কিংবা যা-ই হোক, আমাদের ধরে নিতে হবে তার মধ্যে ওই ব্যাপারগুলো আছে। তাই না? রুমি ভাই…।

ডার্লিং?

হুঁ?

সত্য বলি, তোমারে তো মিথ্যা বলি নাই কুনো দিন।

কী বলবে?

এই যে একটা ভয়, এই ভয়টা আমার ভেতর সব সময় ছিল।

ভয়! কোন ভয় ইলিয়াস?

রুমির লগে আর কুনো দিন দেখা হইব কি না, এইটা আমি নিশ্চিত ছিলাম না।

হুঁ…।

কিন্তু একদিন যে আমি তোমারে বইলা ফেলব ওই চিঠিগুলা আমার লেখা না, রুমি নামে আমার এক বন্ধুর লেখা, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

হঠাৎ এসব কেন বলছ, ইলিয়াস!

এমনি, এমনিই বলতেছি।…আমি জানতাম, চিঠির কথা আমি বইলা ফেলব…আর, তুমি…তুমি…।

আর আমি কী, কী! বলো তো ইলিয়াস, আর আমি কী…।

আর তুমি যে রুমিরে কুনো দিন দেখো নাই, ভেতরে ভেতরে তার প্রেমে পইড়া যাইবা। মোনা। এইটা আমি জানতাম।

মোনা তাকিয়ে থাকবে ইলিয়াসের দিকে। ইলিয়াস মোনার দিকে ফিরে একটু হাসবে-তোমারে আমি মাঝে মাঝে বলি না তোমার মইধ্যে কী যেন আছে…। তুমি ভাবতে ভাবতে বহুদূর চইলা যাও…।

মোনা চোখ সরিয়ে সামনে থাকবে। তার কাঁধ সামান্য ঝুঁকে পড়বে। ইলিয়াস হাত বাড়িয়ে মোনার হাতের ওপর রাখবে-আর বেশিক্ষণ না। আর আধাঘণ্টার মইধ্যে আমরা খুরশিদের খামারবাড়ি পৌঁছায় যাব।”

সাজিয়া বলল-আমি হলে কখনো এ রকম পারতাম না।

পারতে। তোমার লেখা পড়ে আসছি, পারতে।

মনে হয় না। শেষ করাটা কঠিন। কিন্তু তুমি কী অনায়াসে শেষ করে দিলে।

তোমার কথাটা কানে ঠেকছে।

কোন কথা!

এই যে কী অনায়াসে শেষ করে দিলাম।

ও মা, কানে ঠেকার কী হলো! অনায়াসে শেষ করোনি?

থাক, বাদ দাও।… চলো, বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। কোনো রেস্তোরাঁয় না, রাস্তায় রাস্তায়।

রাস্তায় কী আছে।…চলো।

লেখাটা নিয়ে আমরা দুজনের কেউ কোনো কথা বললাম না। সাজিয়া বলতে পারত আমি ভেবেছিলাম সাজিয়া বলবে, আমাকে অবাক করে দিয়ে সাজিয়া কিছু বলল না। যেন ওর কিছু জানার নেই, জানানোরও নেই। শুধু দুই-তিন দিন পর আমাকে জিজ্ঞেস করল-তুমি লিখতে শুরু করবে কবে?

করেছি।

কবে! বলোনি আমাকে।

যেদিন ঠিক করলাম দুজন মিলে লিখব একটা, তার পরদিন থেকে বোধ হয়।

আশ্চর্য, আমাকে বলবে না!

বলিনি। শেষ হয়ে গেলে বলব ভেবেছিলাম।…বেশি দূর এগোয়নি।

এখন এগোবে।…আমার এখন একটা ইচ্ছে খুব করে।

কী?

নিজে একটা লেখা লেখার।

লেখো না কেন! শুরু করো।

তা-ই? সাজিয়া ঠোঁট টিপে হাসল। করতেও পারি।

এরপর আমার আর সাজিয়ার কাহিনীর আর কিছু থাকে না। আমি লিখতে শুরু করতাম আগের মতো। সাজিয়া হয়তো লিখত কিংবা লিখত না- ধেৎ, আমি কী লিখব! তবে ওর সঙ্গে দেখা হতো আমার। আমরা ঘুরতাম, রেস্তোরাঁয় সময় কাটাতাম, কখনো ঢাকার আশপাশে বেড়াতে যেতাম, কখনো শরীরে শরীরে আক্রোশ মেটাতাম। এভাবে দিন যেত, আমার বাবা তার একমাত্র সন্তানের জন্য ভালো পরিমাণ টাকা রেখে গেছেন ব্যাংকে, ব্যাংকে বসে ডিম পাড়া সেই টাকা আমি খরচ করতাম, মেয়েকে দেখতে যেতাম কখনো, আর কে জানে, কোনোবার হয়তো মেয়েকে সত্যিই বলে বসতাম-চলো তা মা, ঘুরে আসি।

কোথায় যাব বাবা?

এমন কোনো জায়গা, যে জায়গা তুমি তো চেনই না, আমিও চিনি না।

এমন কিছু ঘটার আগে একদিন রিজওয়ানা এলো। ফোন করে এলোই সে, জানাল-আসতে চায় সে, জরুরি না হলেও কিছু কথা আছে।

রিজওয়ানা এলো মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে মায়ের পাশে সিঁটিয়ে বসে থাকল, আমি আর রিজওয়ানা কিছু গল্প করলাম। আমাদের যত অল্প সময়ের সংসারই হোক, কিছু গল্প থাকেই। পাশাপাশি এখনকার সময়ের কিছু গল্প কিছু জিজ্ঞাসা। আমরা চা আর রিজওয়ানার আনা কেক খেতে খেতে এসব গল্প করলাম। গল্প এক সময় আর পাওয়া গেল না, আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম, নীরবতা ভাঙল রিজওয়ানা-তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

হুঁ। বলেছ। আমি সামান্য হাসলাম, বলো।

আমি, মানে আমরা, বাইরে চলে যাব বলে ঠিক করেছি।

আমি এমনভাবে রিজওয়ানার কথাটা নিলাম, যেন আগেই একবার শুনেছিলাম-কোথায় যাচ্ছ?

নতুন কোনো জায়গায় না, কানাডায়।…একটা চাকরি হয়েছে। ভালো চাকরি।…আমার ওখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছা।

একেবারে? দেশে আর আসবে না? আমি এমনভাবে জিজ্ঞেস করলাম যেন রিজওয়ানার দেশে আসা না-আসাটা আমার কাছে বড় একটা ব্যাপার।

আসব কখনো কখনো। আমার খুব একটা পিছুটান নেই, তুমি জানো।

হুঁ। ….কী বলি! আমি একটু হাসলাম। ভালো থেকো, এই বলি।

তোমার মেয়েও যেহেতু যাচ্ছে,…একটা অনুমতি…।

না না, কিসের অনুমতি। ও অবশ্যই যাবে। যা হচ্ছে দেশের অবস্থা, ওর ভবিষ্যৎ আছে না। আমি হেসে মেয়ের দিকে ফিরলাম-মা, এবারে আর আমাদের অচেনা কোনো জায়গায় যাওয়া হলো না। হবে হয়তো কোনো দিন।…কী বলো?

মেয়ে মায়ের দিকে আরো ঘেঁষে বসল। রিজওয়ানা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল-অচেনা জায়গা মানে?

এটা তুমি বুঝবে না। আমি হাসলাম। এটা ওর আর আমার ব্যাপার। সিলেট।…আচ্ছা, যাচ্ছ কবে তোমরা?

রিজওয়ানা বলল-ভালো থেকো তুমি। একটু কাছে এগিয়ে এলো। না ছোঁয়ার মতো করে আমাকে একটু ছুঁল-ভালো থাকতে দোষ নেই।…আচ্ছা, একটা মেয়েলি কৌতূহল। তুমি কি মেয়েটাকে বিয়ে করবে?

কোন মেয়ে!

অবাক হচ্ছো কেন! যার সঙ্গে তোমাকে এখন দেখা যায়।… গেলাম।

রিজওয়ানা আর আমার মেয়ের এই চলে যাওয়া আমার রোজকার জীবন বদলে দেবে না। তবু একটা অস্বস্তি জেগে উঠল। কেন উঠল, বুঝতে পারলাম না। মানসিক ও শারীরিক বন্ধন বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে আমরা সেই বহুদিন হলো মুক্ত। তবে এই এটুকুই। ওই অবস্থায়ও আমি বুঝলাম এই সাময়িক অস্বস্তির বাইরে আর কিছু হবে না। নিজের বড়সড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট, বাবার রেখে যাওয়া ফার্টাইল পয়সা, আমার লেখালেখির কিছু, সাজিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক, আমাদের মেলামেশা, ঘোরাফেরা, পরস্পরকে দেখে নেওয়া, কিছুই থেমে থাকবে না। যদি কখনো এই জীবন বদলায় আমি জানি আমি নতুন জীবনেও অভ্যস্ত হয়ে উঠব। সে জীবন নিয়ে আমাকে এখনই মাথা না ঘামালেও চলবে।

তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যা ঘটল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সাজিয়া এলো এক সকালে। সারা দিন থাকল। আমরা পুরোটা সময় প্রায় উড়িয়ে উড়িয়ে দিলাম। সন্ধ্যায় যাওয়ার আগে আগে সাজিয়া বলল-তোমাকে একটা কথা বলব গুড্ডু।

কিছুটা মনেই হচ্ছিল কিছু একটা বলবে।

আমি কিছুদিন আর আসব না।

আসবে না!

হুঁ।…হয়তো যোগাযোগটাই থাকবে না।

রাখতে চাও না?

ব্যাপারটা ঠিক সে রকম না।

কী রকম?

জমিটা বিক্রির জন্য সেই যে গেলাম না?…তোমাকে বলা হয়নি, জমিটা আমরা বিক্রি করিনি। জমিটা আমি আমার নামে লিখে নিয়েছি।

কী করবে ওখানে? গরুর খামার?

কিছু একটা।

থাকবে ওখানে?

থাকব।

পারব।…তিন বছর ছিলাম ওখানে। তুমি বুঝবে না, আমার এখনো ওখানে অমনই ভালো লাগে, সেই ছোটবেলার মতো।

খারাপ না।

জগলু নামে আমার এক বন্ধু ছিল। তুমি খুব ভালো করে জানো ওর কথা।

জানি।

দুই বাড়ি পরেই থাকত ওরা। জগলু খুব বোকা ছিল।…এখনো আছে।

ওর বোকামির গল্প বলেছ।…বোকা হয়তো না, বেশি সরল।

সবাই ওকে নিয়ে হাসত। খেপাত।

কিন্তু তুমি ওকে পছন্দ করতে।

ঠিক বলেছ, কী যে সারল্য ওর, আর আমাকে কী যে ভালোবাসত!

আমার চেয়েও বেশি বুঝি?

সাজিয়া সামান্য হাসল-তোমার-আমারটা যদি ভালোবাসা হতো, ভালো হতো খুব।

হুমম, ভালোবাসা না। কিন্তু কী?

ট্রেডমিলে মাঝে মাঝে দৌড়ে ক্লান্তি দূর করা, নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা।

বেশ বললে। পছন্দ হলো। কিন্তু যা করতে যাচ্ছ, সেখানে ট্রেডমিল লাগবে না।

জগলু এখনো অমনই আছে। বিয়ে হয়েছিল। টেকেনি। টেকার কথাও না। নিজেদের বাড়িতে এককোণে ছোট একটা ঘরে থাকে।…অনেক দিন পর যখন আমাকে দেখল, ঝলমল করে উঠল-সাজিয়া, তুমি এসেছ। এমনভাবে বলল, যেন ও আমার যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। আমার কান্না পেয়ে গেল। আমার মনে হলো, এই তো আমার ছেলেবেলা।

কিন্তু এমন না, তুমি তোমার ছেলেবেলা খুঁজে বেড়াচ্ছিলে।

জানি না।…কিছু নিশ্চয় খুঁজছিলাম।

হুঁ, ঠিক। সবাই খোঁজে। শুধু আমি কিছু খুঁজি না।

ভুল। তুমিও খোঁজো।

কী?

তুমিই জানবে।

আচ্ছা শোনো, তোমার এই অ্যাডভেঞ্চারটা সফল হোক।

অ্যাডভেঞ্চার বলো আর যা-ই বলো-সফল হোক।

হুট করে একদিন তোমাদের ওখানে গিয়ে হাজির হব।

যেও। সাজিয়া আমার ইয়ার্কিটুকু নিল। একটু থামল, বলল-তোমার কথা মনে পড়বে।

তোমার কথাও মনে পড়বে আমার। তার পরও…।

তার পরও কী?

দুজনের নতুন জীবন শুরু হবে। রুমির কি শুরু হবে না বলো, যদি মোনা ওকে চলে যেতে বলে? মোনা তার দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া লজ্জায় কি থেমে যাবে? কিংবা আরো নাটকীয় কিছু, রুমির সঙ্গে যদি বেরিয়ে যায় মোনা, ইলিয়াসের কি কখনোই নতুন শুরু হবে না। আমরা গল্প যেখানে শেষ করার ইঙ্গিত দিয়েছি, জীবন কি সেখানেই থেমে গেছে, বলো?

না, গুড্ডু। জীবন একটু থমকায় শুধু। তারপর জীবন তার মতো আবার এগোয়। হয়তো সুখ থাকে না, হয়তো আনন্দ থাকে না, হয়তো পূর্ণতা থাকে, কিংবা হয়তো থাকে, তবু কোথাও একটা হাহাকার থাকে। এসব নিয়ে জীবন তার মতো আবার এগোয়।

তারপর জীবন তার মতো আবার এগোয়-সাজিয়ার এই কথাটা যদিও জানা, যদিও পুরনো, আমার খুব ভালো লাগল।